Announcement

Collapse
No announcement yet.

খারেজীদের ইতিকথাঃ

Collapse
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • খারেজীদের ইতিকথাঃ

    খারেজীদের ইতিকথাঃ বৈশিষ্ট্য, চেনার উপায় এবং তাদের ব্যপারে আমাদের করণীয়
    প্রিয় পাঠক, তাত্ত্বিক কথাবার্তা শোনার পূর্বে চলুন একটি ঘটনা শুনে নিই-
    আধুনিক কালে খাওয়ারিজদের ফিতনা শুরু হয় মিশরে, শূকরী মুস্তফার প্রতিষ্ঠিত ‘জামা’আতুল মুসলিমীন’ নামক দলের মাধ্যমে। ঢালাওভাবে সবাইকে তারা তাকফির [1] করতো। এমনকি তাদের তাকফির থেকে আলেম উলামারাও বাদ পড়তো না। সহজ কথায় তাদের অবস্থা ছিল হয় তুমি আমাদের সাথে আছো নইলে তুমিও একজন কাফের। সাধারণ মানুষ এ কারনে তাদেরকে ‘জামাআত আত-তাকফির ওয়াল হিজরাহ’ নামে চিনতো। তাকফির অর্থ কাউকে কাফির বলা এবং হিজরাহ বা হিজরত অর্থ পরিত্যাগ করা। এ দলের মূলনীতি ছিল তারা ছাড়া সমাজের সকল মানুষই কাফির এবং কাফিরদের সমাজ থেকে হিজরত করে তাদের সমাজে না যাওয়া পর্যন্ত কেউ মুসলিম বলে গণ্য হবে না। ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে তারা মিসরের সুপ্রসিদ্ধ আলেম ও গবেষক ড. মুহাম্মাদ হুসাইন যাহাবীকে অপহরণ করে এবং পরে তাঁকে হত্যা করে। শাইখ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযযাম (রহঃ) তাঁর ‘তাফসীরে সূরা তাওবা’য় তাদের নিয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। ইখওয়ানুল মুসলিমীনের কারারুদ্ধ শাইখ হুযাইফীর কাছে শূকরী মুস্তফার অনুসারী যুবকেরা এসে জানতে চাইলো, মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসের কি কাফের হয়ে গেছে?

    শাইখ হুযাইফী বললেন, আমি তাকে কাফির বলি বা না বলি তাতে লাভ কি? শাইখ হুযাইফী স্পষ্ট উত্তর দিলেন না। যুবকেরা ক্ষেপে গিয়ে তাকেও তাকফীর করলো।

    এ ধরনের মতবাদপুষ্ট এক যুবকের সাথে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণা করে শাইখ আযযাম বলেন-

    একদিন এক যুবক এল। সে প্রায়ই আমার নিকট আসত। আমাকে মহব্বত করত। ইতোমধ্যে সে শূকরী মুস্তফাকে পেয়ে বসল। তার কথাবার্তা ও মতাদর্শে সে বিমুগ্ধ হল। সে প্রায়ই আমার নিকট এসে ইফতার করত। আমি তখন কায়রোতে ছিলাম। একদিন শূকরী মুস্তফার সাথে দেখা সাক্ষাত করে সে আমার নিকট এল। বিভিন্ন কথা-বার্তা হল। নামাযের সময় হল। দেখলাম সে আমার পিছনে নামায আদায় করতে ইতস্তত করছে। আমি তখন বললাম এসো আজ তুমি ইমাম হও। আমরা তোমার পিছনে নামায আদায় করি। আরেক দিন ঠিক এমন অবস্থা হল। আমি তখন তাকে বললাম সত্যি করে বলতো, আমার ব্যপারে তোমার কি ধারনা? সে বলল, স্পষ্ট করে বলব? আমি বললাম, হ্যাঁ স্পষ্ট করে বল। সে বলল, আমি আপনাকে কাফির মনে করি। আমি বললাম কেন? কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে তোমার এ ধারনা হল? সে বলল, আপনি ইখওয়ানুল মুসলিমীনের একজন সদস্য, তাই। সে বলল, ইখওয়ানের সবাই কাফির। আমি বললাম কেন? সে বলল, কারন, তারা কাফির হুযাইফীকে কাফির মনে করে না।

    আমি তার কথা শুনে বিস্ময়ে হতভাগ হয়ে গেলাম। বললাম, বেশ তাহলে শোন, ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) অলসতা করে নামায পরিত্যাগকারী সম্পর্কে মতবিরোধ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী বলেছেন, তাকে কাফির বলা যাবে না। আর ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল বলেছেন, তাকে কাফির বলতে হবে। তারা মতবিরোধ করেছেন। তবে এই কারনে একে অপরকে কাফির বলেন নি।

    সুবহানাল্লাহ। সাথে সাথে সে বলে উঠলো, আমি যদি সেখানে থাকতাম, তাহলে ইমাম শাফেয়ীর সাথে ঝগড়া করতাম। যদি তিনি তাঁকে কাফির না বলতেন, তাহলে আমি তাঁকে কাফির বলতাম। আমি বললাম লা- হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিলাহ। বেশ তুমি যাও। তোমার সাথে কোন কথা নেই। [তাফসীরে সূরা তাওবা]

    প্রিয় পাঠক, আপনাদের এই ঘটনা বললাম, তার কারন হচ্ছে এর মাঝে খারেজীদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন বৈশিষ্ট্য খুব পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে-

    মেশিনগান তাকফির (Machine Gun Takfir): তাকফির ইস্যুতে ইতিহাসে ২ বিপরীতমুখী বিভ্রান্তি দেখা যায়। একদল যত্রতত্র যাচ্ছেতাইভাবে যাকে তাকে তাকফির করে, এরা হচ্ছে খারেজী গ্রুপ। আর এর ঠিক বিপরীত হচ্ছে মুরজিয়ারা যারা মনে করে, কেউ একবার কালেমা পাঠ করার পর যাই-ই করুক না কেন, সে আর কোনভাবেই কাফির হবে না। এই দুই ধরনের প্রান্তীয় মতবাদের মাঝামাঝি ভারসাম্যপূর্ণ মত হচ্ছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মত। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত তাকফিরকে দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল অংশ মনে করে এবং তাকফির প্রয়োগের ব্যপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে। অন্যদিকে খারেজীদের তাকফির হল মেশিনগানের গুলির মত, অন্ধের মত আপনি এদিক ওদিক অবিরাম ধারায় গুলি ছুড়েই চলছেন, ছুড়েই চলছেন, কোথায় কি হচ্ছে তার কোন হুঁশ আপনার নেই। এদিক থেকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের তাকফিরকে তুলনা করা যায় স্নাইপারের সাথে, আপনি সবকিছু ভালো মত চেক করলেন, রেঞ্জ পর্যালোচনা করলেন, টার্গেট ফিক্স করলেন তারপর হয়তো আপনি ট্রিগার চাপলেন। আর তাকফির ইস্যুতে এটাই হল সঠিক আচরণ।

    চেইন তাকফির (Chain Takfir): এটাও খারেজিদের একটা Sole Criteria. উপরের ঘটনায় আপনারা দেখেছেন শূকরী মুস্তফার দলবল প্রথমে মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসেরকে তাকফির করেছে। এরপর জামাল আব্দুন নাসেরকে কাফির না বলায় শাইখ হুযাইফীকে তাকফির করেছে। শাইখ হুযাইফিকে কাফির না মনে করায় ‘ইখওয়ানুল মুসলিমীন’কে তাকফির করেছে। এরপর শাইখ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযযামকে, এবং তাদের তাকফিরের এই চেইন বিক্রিয়া একটা থেকে একটা এভাবে চলতেই থাকবে যদি কেবল আপনি তাদের সাথে দ্বিমত করেন। অন্যদিকে তাকফিরের ক্ষেত্রে আমরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের কর্মপন্থা বুঝতে পারি ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের (রহঃ) মধ্যকার বিতর্ক থেকে। [2]

    খারেজীদের বৈশিষ্ট্য ও চেনার উপায়ঃ

    ১। মুসলিমদের আক্বীদা-বিশ্বাস হল কবীরা গুনাহের কারনে কোন ব্যক্তি দ্বীন ইসলামের গন্ডি থেকে বের হয়ে যায় না অর্থাৎ কাফির হয়ে যায় না। অন্যদিকে খারেজীরা কবীরা গুনাহের (যেমন মদ্যপান, ব্যভিচার ইত্যাদি) কারনে মুসলিমদেরকে কাফির বলে সাব্যস্ত করে। আর খারেজীদের এই বৈশিষ্ট সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেন-

    “তারা আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। আল কুরআনের যেসব আয়াত কাফিরদেরকে উদ্দেশ্য করে নাযিল হয়েছে সেগুলোকে তারা মুসলিমদের উপর প্রয়োগ করে”। [সহীহ বুখারী]

    ২। খারেজীদের ২য় বৈশিষ্ট হচ্ছে তারা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করবে অন্যদিকে কাফিরদের প্রতি সদয় হবে। এ কথার দলিল হচ্ছে, রাসূল (সঃ) এর হাদীছ-

    “……..তারা মুসলিমদেরকে হত্যা করবে আর পৌত্তলিকদের ছেড়ে দিবে। তাদের সময়ে যদি আমি উপস্থিত থাকতাম তাহলে আমি তাদেরকে সেইভাবে নির্মূল করতাম যেভাবে নির্মূল করা হয়েছিল সামূদ সম্প্রদায়কে”। [সহীহ বুখারী]

    ৩। তারা শরিয়াতের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য কোন কারন ছাড়াই বৈধ শাসকের বিরোধিতা করবে এবং শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদেরকে উৎখাতের চেষ্টা করবে। [3] [4]

    ৪। যদি কোন বিষয়ে কেউ তাদের সাথে দ্বিমত করে তাহলে তারা তাকেও কাফির সাব্যস্ত করে।

    ৫। তারা অনেক বেশি রূঢ়, কঠোর প্রকৃতির আর মাত্রাতিরিক্ত অহংকারী। আর তাদের ইলম হচ্ছে কেবলই সুপারফিসিয়াল ইলম। আর তাদের কুরআনের বুঝের দৈন্যতার কথা উল্লেখ করে নবী (সঃ) বলেন-

    “……….তারা কুর’আন পড়বে কিন্তু কুর’আন তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না”। [মুসলিম]

    তারা হবে বয়সে নবীন আর জ্ঞানের দিক থেকে অপরিপক্ক। যেমন রাসূল (সঃ) বলেন-

    “………..এ উম্মাতের মাঝে এমন একটি সম্প্রদায় আগমন করবে যারা হবে বয়সে তরুণ এবং তাদের বুদ্ধিজ্ঞান হবে অপরিপক্ক”। [বুখারী, মুসলিম]

    তারা হবে অনেক বেশি উদ্ধত আর অহংকারী। এই খাওয়ারিজদের আদিগুরু আব্দুল্লাহ ইবনে যুল খুওয়াসিরাতো স্বয়ং রাসূল (সঃ) এরও বিরোধিতা করেছিল, আর ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে বলেছিল-

    “হে নবী! আল্লাহকে ভয় করুন”! (আপনি তো বে-ইনসাফী করলেন)”

    উত্তরে আল্লাহর রাসূল (সঃ) বলেছিলেন-

    “দুর্ভোগ তোমার! পৃথিবীর বুকে আল্লাহকে ভয় করার সবচেয়ে বড় অধিকার কি আমার নয়? আমি যদি আল্লাহর অবাধ্যতা করি বা বে-ইনসাফী করি তাহলে আল্লাহর আনুগত্য আর ন্যায়-বিচার আর কে করবে”?? [বুখারী]

    ৬। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত তাওয়ীল (ব্যাখ্যাগত বিষয়), জুহুল (অজ্ঞতা) ও ইকরাহ (জবরদস্তি) কেতাকফিরের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক মনে করে। কাজেই কেউ যদি জুহুল বা অজ্ঞতার কারনে কোন কুফরী কাজ করে, অথবা কেউ যদি কোন ভুল ব্যাখ্যার বশবর্তী হয়ে কুফরী কাজ করে ফেলে, (সে হয়তো কাজটিকে ভালো জেনেই করেছে) অথবা কাউকে যদি জীবন নাশের হুমকি দিয়ে কোন কুফরী কাজ করতে বাধ্য করা হয়, – এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে তাকফির করা হয় না। কিন্তু খারেজীরা এগুলোকে ওজর হিসেবে মানতে নারাজ।

    ৭। যদি মুসলিমদের কোন অংশ তাদের সাথে দ্বিমত করে তাহলে তারা তাদের সাথে এমনভাবে যুদ্ধ করে যেমনিভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করে। তারা তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালাবে, তাদের ধন সম্পদ ছিনিয়ে নিবে।

    আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত ‘কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করা’ এবং ‘সীমালঙ্ঘনকারী মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করা’ এ দুটিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে। যুদ্ধরত ২ টি মুসলিম গ্রুপের ১ টি যদি পালিয়ে যায় তাহলে আহলে সুন্নাতের কর্মপন্থা হল তাদের পিছু না নেওয়া। অন্যদিকে খাওয়ারিজদের কর্মপন্থা হল তাদের পিছন পিছন ধাওয়া করে তাদেরকে হত্যা করা, এবং তাদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে গনীমত হিসেবে গ্রহণ করা। অন্যদিকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত মনে করে কোন মুসলিম নারীকে গনিমত হিসেবে গ্রহণ করা সম্পূর্ণরূপে নাজায়েজ। এই খাওয়ারিজদের ১ম জেনারেশন তো এমনকি মু’মিনদের মা আয়েশা (রাঃ) কেও গনীমত হিসেবে পেতে চেয়েছিল।

    ৮। তারা তাদের গ্রুপের এমন এমন নামকরণ করবে যাতে সহজেই অন্য মুসলিমদের থেকে তাদের পৃথক করা যায়, নাম শুনে মনে হবে কেবল তারাই যেন শুধু মুসলিম। যেমন জামায়াত আল মুসলিমীন, আহলে তাওহীদ ইত্যাদি।

    তাকফিরি ও খাওয়ারিজদের পার্থক্যঃ

    মুসলিমদের মাঝে পারস্পরিক বিদ্বেষ, ইখতিলাফ ইস্যুতে বাড়াবাড়ি, সুপারফিসিয়াল জ্ঞান নিয়ে দাম্ভিকতা ইত্যাদি কারনে ইদানীং অন্যদেরকে ঢালাওভাবে কাফির বলার প্রবনতা অনেক বেড়ে গেছে। তবে এসব লোকদের সবাই পুরোপুরি খাওয়ারিজ নয়। কারন তারা এখনও তাদের তাকফিরের উপর ভিত্তি করে মুসলিমদের রক্তপাত ঝরানো শুরু করে নি। তাই তাদেরকে খাওয়ারিজ মেন্টালিটির লোক বলা যেতে পারে, অথবা বলা যেতে পারে Pseudo-Khawarij, বা আরো সহজভাবে ‘তাকফিরি’ বলা যেতে পারে। খাওয়ারিজরা তাদের তাকফিরের উপর ভিত্তি করে মুসলিমদেরকে হত্যা করে। অন্যদিকে তাকফিরিরা ঢালাওভাবে তাকফির করেই ক্ষান্ত থাকে। এদিক থেকে বলা যায়-

    প্রত্যেক খাওয়ারিজই তাকফিরি কিন্তু প্রত্যেক তাকফিরিই খাওয়ারিজ নয়।

    তাকফিরি গ্রুপের একটা পরিচিত উদাহরন হল বাংলাদেশের আহলে হাদীস [5] তরুণদের উগ্র একটি অংশ (সবাই নয়) যারা কথায় কথায় হানাফী বা দেওবন্দী আলেমদের তাকফির করে থাকে। অনুরূপভাবে অনেক পশ্চিমা দাঈরাও এ ধরনের ঢালাও তাকফিরে আসক্ত হয়ে গেছে। ফেসবুকের কিছু ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী’ কিছিমের দাম্ভিক সেলেব্রেটিদেরও একই সমস্যা। তবে তাদেরকে ঠিক খাওয়ারিজ ক্যাটাগরিতে ফেলা যাবে না।

    খাওয়ারিজ ও তাকফিরিদের মাঝে এই পার্থক্যকরনের ভিত্তি হল, আল্লাহর রাসূলের উক্তি,
    “তারা মুসলিমদেরকে হত্যা করবে আর মুশরিকদের ছেড়ে দিবে”। তিনি এ কথা বলেন নি যে তারা শুধু মুসলিমদেরকে তাকফির করবে”।

    খারেজীদের সাথে আমাদের আচরণ কি হবে??

    নবী কারীম (সঃ) বলেন-

    “এ উম্মাতের মাঝে এমন একটি সম্প্রদায় আগমন করবে যারা হবে বয়সে তরুণ এবং তাদের বুদ্ধিজ্ঞান হবে অপরিপক্ক। মানুষ যত কথা বলে তন্মধ্যে সর্বোত্তম কথা তারা বলবে। কিন্তু তারা দ্বীন ইসলাম থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে, যেমন তীর শিকারের দেহ থেকে বের হয়ে যায়। তাদের ঈমান তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না।তোমরা তাদেরকে যেখানেই পাবে সেখানেই হত্যা করবে। কারণ যে তাদেরকে হত্যা করবে তার জন্য ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট নেকী রয়েছে”। [বুখারী, মুসলিম]

    অন্য হাদীসে নবী (সঃ) বলেন-

    “…..সমস্ত সৃষ্টির মাঝে তারা হচ্ছে নিকৃষ্ট। কাজেই তাদেরকে যারা হত্যা করবে এবং তাদের হাতে যারা নিহত হবে, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ”। [মুসলিম]

    এই হাদীস দুটিতে রাসূল (সঃ) খারেজীদের বিষয়ে আমাদেরকে একটি জেনারেল দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তবে আমরা যদি খাওয়ারিজ ও খাওয়ারিজ মেন্টালিটির লোকদেরকে একটু ভালোমত পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখতে পাবো তাদের বিভিন্ন ধরন রয়েছে। এ কারনে আমাদেরকে এই General দিক-নির্দেশনাকে একটু Elaborate করতে হবে। কাজের ধরনের দিক থেকে

    খাওয়ারিজ এবং খাওয়ারিজ মেন্টালিটির লোকেরা মোটামোটি ৪ ভাগে বিভক্ত-

    ১) ক্ষমতাসীন খাওয়ারিজঃ যে সমস্ত খাওয়ারিজ শাসন ক্ষমতা দখল করে আছে এবং মুসলিমদেরকে হত্যা করছে, তাদের সাথে অবশ্যই যুদ্ধ করতে হবে। এবং মুসলিম উম্মাহর উপর তাদের কোন কর্তৃত্ব বজায় রাখতে দেওয়া যাবে না।

    ২) যে সমস্ত খাওয়ারিজ বিভিন্ন ক্রুসেডার গ্রুপ, মুরতাদ কিংবা বাতিল ফিরক্বার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত আছে, তাদের ক্ষেত্রে আমরা চাইবো তারা একে অপরকে ধ্বংস করতে থাকুক, “Let them destroy each other!!” তবে যে মুহুর্তে তারা মুসলিম উম্মাহর দিকে পা বাড়াবে তখন থেকে আমরাও তাদেরকে রুখে দাড়াবো। আর এ জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি রাখা দরকার। এ ধরনের খাওয়ারিজ যারা বিভিন্ন ক্রুসেডার গ্রুপ, মুরতাদ কিংবা বাতিল ফিরক্বার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত, কোন মুসলিম চাইলে তাদের সাথে মিলিত হয়ে কাফিরদের মোকাবেলা করতে পারবে। কিছু তাবেয়ী থেকে এরকম ঘটনা পাওয়া যায়। তবে উত্তম হল আহলে সুন্নাতের মুজাহিদ জামাআত গঠন করেই কাফিরদের মোকাবেলা করা। কেননা যেকোন সময়ে খারেজীদের বন্দুকের নল ঘুরে যেতে পারে।

    ৩) যে সমস্ত খাওয়ারিজ মুসলিম উম্মাহর সাথেই যুদ্ধে লিপ্ত আছে এবং তাদের ধংসাত্বক কার্যকলাপ চালু রেখেছে তাদের সাথে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হবে যতক্ষণ না তারা সত্যকে গ্রহণ করে অথবা তারা পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যায়। কেননা রাসূল (সঃ) বলেছেন, “তাদের সময়ে যদি আমি উপস্থিত থাকতাম তাহলে আমি তাদেরকে সেইভাবে ধ্বংস করতাম যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল আদ সম্প্রদায়কে”। [সহীহ বুখারী]

    ৪) যারা প্রকৃত অর্থে খাওয়ারিজ নয় তবে খাওয়ারিজ মেন্টালিটির অর্থাৎ তাকফিরি, তাদের সাথে আমরা তরবারী নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হব না। তবে আমরা আমাদের মুখ ও কলমের মাধ্যমে তাদের মুখ ও কলমের অনিষ্ট সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করবো। আর এ বিষয়টা খারেজীদের সাথে আলী (রাঃ) এর কর্মপন্থা থেকে চমৎকারভাবে বুঝা যায়। তিনি শুধু তাদের তাকফির প্রবনতার কারনে তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন নি। এ সময় তিনি তাদের বলেছিলেন,”তোমাদের ব্যাপারে আমরা তিনটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি: ১) মসজিদে আসতে তোমাদের আমরা বারণ করব না ২) রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে তোমাদের বঞ্চিত করব না ৩) আগে-ভাগে কিছু না করলে আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না”।

    কিন্তু যখন তারা সীমালঙ্ঘন করলো, বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন খাব্বাব বিন আরিত (রা কে হত্যা করলো, তাঁর স্ত্রীর পেট ফেড়ে দু-টুকরা করে গর্ভস্থ ভ্রূণকেও হত্যা করলো। তখন আলী (রা তাদের জিজ্ঞাস করেন, আব্দুল্লাহ্*কে কে হত্যা করেছে? জবাবে তারা ‘আমরা সবাই মিলে হত্যা করেছি’- বলে স্লোগান দিতে থাকে। এরপর আলী (রা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। নাহরওয়ান অঞ্চলে তাদের সাথে মুসলমানদের তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে খারেজীরা পরাজিত হয়। খারেজি সম্প্রদায়ের ফেতনাও সাময়িক ভাবে খতম হয়ে যায়।

    যুদ্ধ শেষে লোকেরা আলী (রাঃ) কে অভিনন্দন জানাতে এল যেহেতু তাঁর হাত দিয়ে আল্লাহ খারেজীদের ফিতনাকে নির্মূল করেছেন। তখন তিনি তাঁর সেই ঐতিহাসিক উক্তিটি করলেন-

    “No, by Allah, they are still in the backs and spines of men and the wombs of women. And when are alive, they hardly leave anyone alone”. [6]

    আপনি জেনে অবাক হবেন যে মিশরের খাওয়ারিজ, শূকরী মুস্তফার দলবলের একটা অংশ যখন আফগানিস্তানে গিয়েছিল, তখন তারা শাইখ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযযাম (রহঃ), শাইখ উসামা বিন লাদেন (রহঃ), মোল্লা মুহাম্মাদ ওমরকেও (রহঃ) তাকফির করেছিল। চিন্তা করে দেখুন, যারা কাফির মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদেরকেই কিনা কাফির সাব্যস্ত করা হচ্ছে। আর এসব কিছুই আলী (রাঃ) এর উক্তিকে প্রতিধ্বনিত করে- they hardly leave anyone alone.”

    আলজেরিয়ার গ্রুপটা তো আরো একধাপ আগবেড়ে বলেছিল, আগে মুরতাদদের সাথে যুদ্ধ করার পূর্বে সেইসব জিহাদী জামাআতের সাথে যুদ্ধ করতে হবে যারা তাদের মত ঠালাওভাবে তাকফির করতে রাজী হয় নি!! খারেজীপনার ক্ষেত্রে এর চেয়ে প্রকট বৈশিষ্ট্য আর কি হতে পারে??

    শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ) বলেন-

    “It is concluded by the Muslims that the Khawarij are not the only Khawarij mentioned in the battle with Ali (R) in Nahraawaan”. [Majmu’a al Fatwa]

    কাজেই হে প্রিয় ভাইয়েরা! আসুন খারেজীদের সম্পর্কে নিজেরা সতর্ক হই, অন্যদেরকেও সতর্ক করি আর সর্বোপরি মহান আল্লাহর কাছে দুআ করি তিনি যেন আমাদেরকে খারেজীদের ফিতনা থেকে হেফাযত করেন। আমীন।

    টিকাঃ

    [1] তাকফির করা মানে কাউকে কাফির বলে সাব্যস্ত করা।

    [2] ‘কাফিরকে যে কাফির বলে না সেও কাফির‘ – এই উসুলটি শুধু ‘তাকফিরুন নছ’ এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ কুরআন-হাদীসের অকাট্য, সুস্পষ্ট এবং দ্বর্থ্যহীন বাক্য যদি কাউকে নির্দিষ্ট করে কাফির সাব্যস্ত করে, সেক্ষেত্রে প্রয়োজ্য। যেমন কুরআন স্পষ্টভাবে আবু লাহাবকে, ইয়াহুদী, খ্রীস্টানদেরকে কাফির বলেছে। এখন কেউ যদি আবু লাহাবকে কাফির বলতে অস্বীকার করে তাহলে সে নিজেই কাফির হয়ে যাবে। কেননা আবু লাহাবকে কাফির বলতে অস্বীকার করা মানে হল কুরআনের আয়াতকে অস্বীকার করা। কিন্তু যে ক্ষেত্রে ইজতিহাদের মাধ্যমে তাকফিরের একটি মূলনীতি সাব্যস্ত করা হয়েছে, এরপর সেই মূলনীতি কোন বিশেষ ব্যক্তির উপর প্রযুক্ত হবে কিনা সেটা নিয়ে আরেক দফা ইজতিহাদ করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে কোন আলেম যদি কাউকে কাফের বলে আর অন্য একজন যদি কাফির না বলতে চায়, তাহলে তাদের কাউকেই দোষারোপ করা যাবে না। কিন্তু খারেজীরা তাকফিরুন-নছ, তাকফিরে ইজতিহাদ এবং তাকফিরে মুয়াই’য়িন (নাম ধরে তাকফির) এগুলোর মাঝে প্যাঁচ লাগিয়ে দিয়েছে, যেটা তাদের ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী’র আরো একটা প্রমাণ।

    [3] অনেকে মনে করে শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মানেই খারেজী হয়ে যাওয়া, যেটা ভয়াবহ রকম একটি ভুল ধারণা। সত্যি বলতে এমন অনেক কন্ডিশন আছে যেখানে শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা ওয়াজিব। তাই এ বিষয়ে আমি ‘কখন কখন শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা জায়েয’ এই শিরোনামে একটি আর্টিকেল লিখবো ইনশাআল্লাহ।

    [4] বর্তমানে কথায় কথায় অন্যদেরকে খারেজী বলাটা যেন এক ধরনের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। আর আপনি যদি মুজাহিদীনদের সাপোর্টার কেউ হয়ে থাকেন তাহলে তো কথাই নেই, কতবার যে খারেজী ট্যাগ খেয়েছেন তার হয়তো কোন ইয়াত্তা নেই। সেই কারনে এই সিরিজের পরবর্তী আর্টিকেল ‘আমরা কি খারেজী??’ – শিরোনামে এই কনফিউশন দূর করা হবে ইনশাআল্লাহ।

    [5] আহলে হাদীস ভাইদের অনেককে আমি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি, অন্তর থেকে ভালোবাসি, যদিও কিছু বিষয়ে আমাদের মতপার্থক্য আছে । তবে তাদের অনেককে আমি তাকফিরি মনোভাবের কারনে কিংবা মাদখালী মনোভাবের কারনে অপছন্দ করি, সেটাও অপকটে স্বীকার করি।

    [6] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া

    বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এই আর্টিকেলটি তৈরি করতে আমি শাইখ আবু হামযা আল মিশরীর (হাফীঃ) ‘Khawarij and Jihad’, শাইখ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযযামের (রহঃ) ‘তাফসীরে সূরা তাওবা’, এবং আরো কিছু বইয়ের সাহায্য নিয়েছি। মহান আল্লাহ তাদেরকে কবুল করুন। আমীন।
    Last edited by tayfamansura; 12-06-2015, 02:40 PM.

  • #2
    মাশাআল্লাহ। অনেক বিস্তারিত একটি আলোচনা করেছেন।
    কথা ও কাজের পূর্বে ইলম

    Comment


    • #3
      হাদীসে নবী (সঃ) বলেন-

      “…..সমস্ত সৃষ্টির মাঝে তারা হচ্ছে নিকৃষ্ট। কাজেই তাদেরকে যারা হত্যা করবে এবং তাদের হাতে যারা নিহত হবে, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ”। [মুসলিম]

      Comment

      Working...
      X