Announcement

Collapse
No announcement yet.

আরাকানের ইতিহাস—ইতিহাসের আরাকান-১

Collapse
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • আরাকানের ইতিহাস—ইতিহাসের আরাকান-১

    আরাকানের ইতিহাস—ইতিহাসের আরাকান-১


    [বীভৎসতা ও বর্বরতায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে পেছনে ফেলে দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তখন একটি মাত্র দেশ বার্মা এবং রেঙ্গুনসহ দুতিনটি যেসব শহরে হত্যাযজ্ঞ চলেছিল সেসব থেকেই কিছুটা অনুমান করা সম্ভব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সার্বিক অভিঘাত কী ছিল। সেটাকেও হার মানিয়েছে বর্তমান আরাকান বা রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর বার্মার সামরিকজান্তার নির্মম পাশবিকতা। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, স্থানীয় মুসলমানদের প্রতি বার্মার আক্রোশের বীভৎস চিত্র। এখানে উপনিবেশবাদ আরো চতুর হয়েছে। মানবধ্বংসী এসব যুদ্ধ শুধু বার্মা নয়; বিশ্বের নানা প্রান্তে নানা জায়গায় মতবাদ আর আদর্শের দোহাই দিয়ে ঘটেই চলেছে। আর শরণার্থীদের জাতীয়তা পাল্টাচ্ছে; কিন্তু তাদের পালাবার পথ রুদ্ধ করে দাড়াচ্ছে পশ্চিমের অচলায়তনগুলির দেয়াল। যা ভেঙ্গে মুক্তির পথ বের করতে হবে আমাদেরকেই। বিবর্ণ এই আরাকানকে নিয়েই আমাদের এ ক্ষুদ্র আয়োজন।]


    বর্তমান মিয়ানমারের একটি প্রদেশের নাম আরাকান। এ প্রদেশটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তবর্তী একটি এলাকা। এই প্রদেশটির উত্তরে চীন ও ভারত, দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর ও পশ্চিমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে নাফ নদী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৬৬ থেকে ১৭৮৪ ইং সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর ধরে এখানকার স্বাধীনতা-স্বকীয়তা, রাজনৈতিক ঐতিহ্য এবং অর্থনৈতিক নির্ভরতা ইতিহাসে যেমন অবিস্মরণীয় হয়ে আছে তেমনি অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতি এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিতে মুসলমানগণ এক অভিনব ও স্বতন্ত্র অধ্যায় নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলো। এ অঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসী মুসলমান। থাম্ভইক্যা, জেরবাদী, কামানাচি, রোহিঙ্গা ইত্যাদি অভিধায় তার অভিহিত হয়ে থাকে। তবে তাদের মধ্যে রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী। আজকে শুধু আরাকানে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, ভৌগলিক অবস্থান ও এর জনগোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
    আরাকান নামটি অত্যন্ত পুরনো। তবে বর্তমান সরকারি নথিপত্রে এ নামটি বিলুপ্তই বলা যেতে পারে। মিয়ানমারের সামরিক শাসক নে উইন ১৯৭৪ সালে এ নামটি পরিবর্তন করে ‘রাখাইন স্টেট’ নামকরণ পূর্বক এটিকে একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত করেন। সেই থেকে আজ অব্দি সরকারিভাবে আরাকানকে ‘রাখাইন স্টেট’ নামেই অভিহিত করা হয়। যদিও ‘রাখাইন’ এর পরিবর্তে এখনো সবার কাছে ‘আরাকান’ নামেই বেশ পরিচিত। অবশ্য বর্তমানে মিডিয়ার কল্যাণে এদেশের মানুষের কাছে এখন ‘রাখাইন সম্প্রদায়’ রোহিঙ্গা মুসলমান ইত্যাদি নামে তারা বেশি পরিচিত। তবে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অতীতকালে আরাকানের অধিবাসীরা তাদের জন্মভূমিকে ‘রখইঙ্গ’ নামে অভিহিত করে থাকে। এটি সংস্কৃত ‘রক্ষ’ (জধশংযধ) এবং ‘যকখো’ (ণড়শশযড়) হতে উৎপন্ন হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। কারণ বৌদ্ধরা আধুনিক শ্রীলংকা জয় করার পূর্বে আরাকানের আদি অধিাবাসীদের ‘রক্ষ’ ও ‘যক্ষ’ নামেই ডাকতো। রাখাইং শব্দের অর্থ দৈত্য বা রাক্ষস। আর রাখাইংরা তাদের জন্মভূমিকে রাখাইংপে (জধশযধরহমঢ়যর) বলতো। ঐতিহাসিকদের মতে আরাকানের প্রাচীন অনেকগুলো নাম পাওয়া যায়। যেমন তিব্বতী ঐতিহাসিক লামা তারাকানাথ আরাকানকে ‘রখন’ বলে উল্লেখ করেছেন। আর মির্জা নাথান ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বিতে আরাকানকে ‘রাখাঙ’ এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে ‘রখঙ্গী’ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে ঐতিহাসিক আর্থার ফেয়ার আরাকানকে ‘রাখাইং’ নামের বিকৃতি বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি পেগুতে ‘রাখাইন’ নামের একটি জনগোষ্ঠীর সন্ধান পেয়েছেন। কিন্তু ‘রাখাইন’ নামের উক্ত জনগোষ্ঠীর ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে আরাকানীদের ধর্মের কোন সাদৃশ্য নেই। তবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মতে আরাকান নামটি অনেক পুরনো। আরাকান শব্দটি মূলত আরবি ‘আরকান’—আরবি ‘আর রুকন’ শব্দ থেকে উদগত। এ শব্দের অর্থ হলো স্তম্ভ বা খুঁটি। তাই তাদের ধারনা, সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে তৎকালীন মুসলমানরা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের দিকে খেয়াল রেখে এ অঞ্চলের নাম ‘আরাকান’ রেখেছেন।
    নাফ নদী বাংলাদেশ ও আরাকনের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমারেখা হিসেবে পরিগণিত হয়। নাফ নদী প্রস্থে বেশ ছোট হলেও অত্যন্ত খরস্রোতা। এ নদীর পূর্বতীরে আরাকানের মংডু টাউনশীপ ও পশ্চিমে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত অঞ্চল। নাফ নদী ছাড়াও আরাকানে আরো বেশ কয়েকটি নদী রয়েছে। সেসব নদীর অন্যতম মায়ু, অনন, কালাদান, লেমব্রু, তানগু, স্যান্ডোয়ে ইত্যাদি। এসব নদী ছাড়াও বেশ কয়েকটি ছোট ছোট নালা রয়েছে। পরমা, মায়ুথিট, সাবিবিনিইন, উশিঙ্গা, মিংলাগুই, গদুছারা, তুন, ঘানুকনডু, পিনবায়ু ও কাইন প্রভৃতি ছোট ছোট নালা পাহাড়ী হ্রদ থেকে নেমে নাফ নদীতে এসে মিশেছে। আর নাফ নদী গিয়ে মিলিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে।
    ইতিহাসের পাতায় আরাকান মৌলিকভাবে চারটি সীমারেখায় বিভক্ত। এ সীমানাগুলো হচ্ছে, ধন্যাবতী, রামাবতী, মেখাবতী ও দারাবতী। তৎকালীন ধন্যাবতীই বর্তমান আরাকানের রাজধানী। রামাবতী হলো রামব্রী দ্বীপ, মেখাবতীর নাম চেদুবা এবং দারাবতী হলো আধুনিক স্যা-োয়েকে বলা হয়ে থাকে। এছাড়া আরাকানে প্রায় ১৭টির মতো শহর রয়েছে। সেগুলো হলো, অন, রাথিদং, মেনাং, রামব্রী, মেবন, গোয়া, টংগু, মংডু, পিউকতাউ, মিনবিয়া, ¤্রাউক-উ, গোয়া, কিয়াকতাউ, কিয়াউকপাউ, বুচিদং, স্যা-োয়ে ও আকিয়াব ইত্যাদি। এসব শহরের মধ্যে আকিয়াব শহরটি কালাদান নদীর তীরে অবস্থিত। এ শহরটি আরকানের প্রধান সমুদ্র বন্দরও বটে।
    মূলত আরাকানের আয়তন নির্ণয় করা খুবই কঠিন একটি কাজ। কারণ বাংলাদেশের সাথে আরাকানের সীমারেখা প্রায়ই পরিবর্তন হতো। এদেশের কক্সবাজার, রামু ও চট্টগ্রামসহ বিশাল একটি অংশ এক সময় আরাকানের শাসনাধীন ছিলো। তবে ১৬৬৬ সনে শায়েস্তা খা কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয়ের মাধ্যমে আরাকানের ভৌগলিক আয়তন নির্ধারিত হয়। সেই হিসাব অনুযায়ী বৃটিশ শাসনকাল পর্যন্ত আরাকানের আয়তন ছিলো বিশ হাজার (২০,০০০) বর্গমাইল। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা উত্তর পার্বত্য আরাকান বর্তমান বার্মার চিন (পযরহ) প্রদেশে এবং দক্ষিণ আরাকানের লেয়ার বার্মার অংশ করে দেয়ায় এখন আরাকানের আয়তন চৌদ্দ হাজার (১৪,২০০) বর্গমাইল।
    আরাকানের জনসংখ্যা নিয়েও মতভেদ রয়েছে। বিশেষত সামরিক জান্তা শাসিত রুদ্ধদ্বার দেশ হিসেবে সেখানকার পরিস্থিতি ও জনসংখ্যার বিন্যাস সব ক্ষেত্রেই অস্পষ্টতা দেখা যায়। তাছাড়া স্বাধীনতার পরবর্তী সময় এ অঞ্চলের কোন আদমশুমারীও হয়নি ফলে মত পার্থক্য রয়েই গেছে। বাংলাদেশের মিডিয়া ভাষ্য আরাকানের মুসলিম লেখকদের মতানুযায়ী আরাকানের জন সংখ্যা ৫০ লক্ষ। ৩০ লক্ষ মুসলমান; যা সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় ৬০%। বিশিষ্ট গবেষক আ. করিম এর মতে, আরাকানের জনসংখ্যা ৪০ লক্ষ। তন্মধ্যে ২০ লাখ বৌদ্ধ-মগ। ১৪ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান, ৪ লাখ সর্বপ্রাণবাদী এবং ২ লাখ হিন্দু ও খ্রিস্টান।
    আরাকানী মুসলিম লেখকদের মতে, বিভিন্ন সময় নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান আরাকান থেকে পালিয়েছে। এসব মুসলমানদের মধ্যে সৌদি আরবে ৫ লাখ, পাকিস্তানে ২ লাখ ৫০ হাজার, বাংলাদেশে ৩ লাখ ৩০ হাজার, গালফ স্টেটসমূহে ৫৫ হাজার, মালেশিয়া ও থাইল্যান্ডে ৪৩ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ১০ হাজারেরও বেশি মুসলমান আশ্রয় নিয়েছে। তাছাড়া তৎকালীন বৃটিশ প্রশাসন বর্তমান গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানাধীন সুবিরনগরে এবং কক্সবাজারের সমুদ্রোপকূলে শরনার্থী ক্যাম্প তৈরি করে এদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করে। এভাবে বিভিন্ন সময় দাঙ্গা, হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়নের কারণে মুসলমানদের সংখ্যা অনেকাংশে কমে যায়। তাছাড়া আরাকানী মুসলমানদের হিসাবটি উত্তর আরাকান তথা বুচিদং ও মংডু অঞ্চলের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। সেই সঙ্গে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরিসংখ্যানের সঙ্গে বিতাড়িত নিহত মুসলমানদের সংখ্যা যোগ করলে আরাকানী মুসলিম লেখকদের সঙ্গে পরিসংখ্যানের হিসাব মিলে যায়। কারণ, ১৯১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী আকিয়াবের মুসলমান সংখ্যা ছিল ৩৩%। ১৯৩১ সালের হিসাব অনুযায়ী আরাকানের জনসংখ্যা হচ্ছে ১২,৯৯,৪১২ জন। এর মধ্যে বৌদ্ধদের সংখ্যা ৮,৭৮,২৪৪ জন। মুসলমানদের সংখ্যা ৩,৮৮,২৫৪ জন। হিন্দুদের সংখ্যা ৩,২৮১ জন এবং খ্রিস্টানদের সংখ্যা ২,৭৫৩ জন। আর অন্যান্য ধর্মালম্বী ছিল ২৫,৮৮০ জন। সুতরাং একথা বলা যায় যে, বর্তমানে আরাকানের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষ। এর মধ্যে ৪০% মুসলমান। (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ২২ ডিসেম্বর ২০০১ ইং, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি পত্রিকা : প্রথম সংখ্যা ২০০২)
    এ হলো বর্তমান আরাকানের সংক্ষিপ্ত বিবরণী। অবশ্য আরাকানের জনসংখ্যার পরিসংখ্যানটি ২০০১ ও ২০০২ সালের। বর্তমান এর জনসংখ্যা আরো বেশি। যদিও উইকিপিডিয়া বলছে, ২০১২ সালের পর কোনো আদমশুমারী হয়নি। সে অনুযায়ী আরাকানের জনসংখ্যা মাত্র ৮ লক্ষ। তথ্যটি কতোটুকু নির্ভরযোগ্য সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। ইতিহাসের এই সংক্ষিপ্ত খেরোখাতায় তুলে ধরা হলো নির্যাতিত আরাকানবাসীর সামান্য পরিচয়। তবে আমরা কামনা করি, নীপিড়ীত আরাকান মুক্তি পাক।নির্যাতিত রোহিঙ্গারা নাজাত পাক।

  • #2
    আমীন.................

    Comment


    • #3
      জাযাকাল্লাহ

      Comment

      Working...
      X