কিয়ামতের আলামাত — পর্ব -১
কিয়ামতের আলামাত সম্পর্কে ইলম অর্জনের গুরুত্ব
মাওলানা মাসউদ কাওসার
কিয়ামতের আলামাত সম্পর্কে ইলম অর্জনের গুরুত্ব
মাওলানা মাসউদ কাওসার
কিয়ামতের পূর্বে এমন কিছু অবস্থা ও প্রেক্ষাপট তৈরি হবে যার সাথে মুমিনদের জান্নাত ও জাহান্নামের সম্পর্ক। শেষ যমানার ব্যাপারে সবচেয়ে সত্যবাদী সংবাদ প্রদানকারী নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসের সারাংশ হল শেষ যমানায় পুরো পৃথিবী দুইটি তাবুতে বিভক্ত হয়ে যাবে। একটি হবে মুমিনদের তাবু যেখানে নিফাকের অস্তিত্ব থাকবে না। আরেকটি তাবু হবে মুনাফিকদের তাবু যেখানে ইমানের অস্তিত্ব থাকবে না। মাওলানা মাসউদ কাওসার মা: জি: এর এই আলোচনাটি সেই সফলতা ও ব্যর্থতার সাথেই সম্পৃক্ত। এই বয়ানটিতে মুমিনদের চিন্তার খোরাক রয়েছে। মাওলানা সাহেব আলোচনাটি একটি সাধারণ মজলিসে করেছিলেন। যেখানে সম্মানিত ভাই হাফেজ শাহযাদ (মুহিব্বুল্লাহ) শহিদ রহ. উপস্থিত ছিলেন। ভাই হাফেজ শাহযাদ শহিদ রহ. অনেক গুরুত্বসহকারে বয়ানটি রেকর্ড করেন। আর অডিও সেই দরসগুলো ভাই খাইরুদ্দীন লেখার আকৃতিতে নিয়ে আসেন। ইনশাআল্লাহ এই দরসগুলো ধারাবাহিকভাবে আপনাদের সামনে পেশ করা হবে।
إن الحمد لله نحمده و نستعينه ونستغفره ونؤمن به و نتوكل عليه ونعوذ بالله من شرور أنفسنا و من سيئات أعمالنا من يهده الله فلا مضل له ومن يضلله فلا هادي له ونشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له ونشهد أن سيدنا ومولانا محمدا عبده ورسوله أما بعد..
أعوذ بالله من الشيطان الرجيم ، بسم الله الرحمن الرحيم
سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنْفُسِهِمْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ
أعوذ بالله من الشيطان الرجيم ، بسم الله الرحمن الرحيم
سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنْفُسِهِمْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ
“আমি তাদেরকে (পৃথিবীর) দিক-দিগন্তে ও তাদের নিজেদের মাঝে আমার নির্দশনসমূহ দেখাব, যাতে এটি (কুরআন) যে সত্য তা তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।”
আমার সম্মানিত ভাইয়েরা!
আজ যে বিষয়টি নিয়ে এই মজলিসটি অনুষ্ঠিত হয়েছে তা হল কিয়ামতের আলামত। হাদিসের আলোকে কিয়ামতের পূর্ববর্তী ফিতনা, অবস্থা ও ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনা করা। কিয়ামতের আলামত, অবস্থাসমূহ, ফিতনাসমূহ, মালাহিম (বড় যুদ্ধসমূহ), ইমাম মাহদির আত্মপ্রকাশ, দালাজ্জালের আগমন, ইসা আলাইহিস সালামের আগমন ইত্যাদি আলোচনা শুরুর আগে আমাদেরকে তিনটি বিষয় বুঝতে হবে।
প্রথম বিষয়: কিয়ামত এবং কিয়ামতের আলামতের ব্যাপারে ইসলামের গুরুত্ব কেমন?
দ্বিতীয় বিষয়: অন্যান্য আরও বহু বিষয় বাদ দিয়ে কেন আমরা কিয়ামতের আলামতের ওপর এত গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা শুরু করছি?
তৃতীয় বিষয় হল আসন্ন ফিতনার সকল ঘটনা, অবস্থা, যুদ্ধ এবং এগুলোর সাথে সম্পৃক্ত যত বিষয় আছে: যুদ্ধ, স্থান, সময় ও সংখ্যা ইত্যাদি এগুলো কি সহিহ ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত?
আর সর্বশেষ এই প্রশ্নটিও আসবে যে, এই সব অবস্থা ও ঘটনা এবং এত বিস্তারিত আলোচনা সত্ত্বেও কেন পৃথিবীতে কাঙ্খিত পরিবর্তন আসছে না। পৃথিবীতে যদি পরিবর্তন আসে তাহলে তার সুরত ও গঠন আকৃতি কেমন হবে? ইনশাআল্লাহ, এই বিষয়গুলো আলোচনার পরই আমরা ইমাম মাহদির আগমন থেকে শুরু করে ইসা আলাইহিস সালামের অবতরণকালীন অবস্থা, তাঁর মৃত্যু এবং তাঁর পরবর্তী দুনিয়ার অবস্থা কেমন হবে এবং কিয়ামত পর্যন্ত কী কী হবে তা নিয়ে ইনশাআল্লাহ বিস্তারিত আলোচনা করবো। আল্লাহ তাআলা আমাদের এখানে আসা, আমাদের সফর, আমাদের বসা এবং মসজিদের পরিবেশে দ্বীনের কথা বলা ও শোনা এবং একনিষ্ঠতার সাথে এই সব অবস্থা ও ঘটনাবলী শোনা ও বোঝার নিয়তে আমাদের এই বসাকে কবুল করুন। যে ভাইরা এই মজলিসের জন্য মেহনত করেছেন আল্লাহতাআলা সে ভাইদের চিন্তা ফিকিরকে কবুল করুন। আমিন
সর্বপ্রথম কথা হল: কিয়ামত এবং কিয়ামতের আলামতের ব্যাপারে ইসলামে কেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে?
প্রিয় ভাইয়েরা!
কিয়ামত ইসলামের মৌলিক আকিদাগুলোর একটি আকিদা। কুরআনে আল্লাহ তাআলা তিনটি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কুরআনের মূল আলোচ্য বিষয় তিনটি:
১) তাওহিদ
২) রিসালাত
৩) কিয়ামত
যেখানেই কোনো আলোচনা হয়েছে তা হয়ত তাওহিদ বা তাওহিদ সংক্রান্ত আলোচনা অথবা রিসালাত বা রিসালাতের ধারক-বাহক ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা অথবা কিয়ামত এবং কিয়ামতের অবস্থা নিয়ে আলোচনা। এর অধীনে অনেক আলোচনাই এসেছে, অনেক ঘটনাই বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কুরআনের মৌলিক আলোচনা এই তিনটি বিষয়কে ঘিরেই হয়েছে। তাওহিদ ও তাওহিদ সংক্রান্ত আলোচনা, রিসালাত ও রিসালাত সংক্রান্ত আলোচনা এবং কিয়ামত ও কিয়ামত সংক্রান্ত আলোচনা।
কিয়ামতের পূর্ববর্তী অবস্থা ও ঘটনা সম্পৃক্ত আমরা যে আলোচনা শুরু করছি সেটি আকিদারও একটি অংশ। কিয়ামত এবং কিয়ামতের আলামতগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। এগুলো হল নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বলা অবস্থা ও ঘটনার সংবাদ। এই বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত অনেক হাদিস আছে। আমরা এখানে মুসলিমদের ভবিষ্যত অবস্থার ব্যাপারে হাদিসের স্পষ্ট যে ভাষ্য তা নিয়ে আলোচনা করবো। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের আলোচনায় বা এই ইলমে চারটি বিষয় একত্রিত হবে:
১/ কুরআনিক আলোচনা
২/ হাদিস
৩/ ইতিহাস
৪/ সিরাতে নববি এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত বিভিন্ন অবস্থা, ঘটনা, ফিতনা এবং ভবিষ্যতের ব্যাপারে দেয়া সংবাদের ইলম। যাকে ইলমুল ফিতান বা ফিতনা সংক্রান্ত ইলম বলা হয়।
এই হিসেবে আলোচনাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি আমাদের আকিদার একটি অংশ। হাদিসের বর্ণনা, ইতিহাস, সিরাতে নববি, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত নির্ভরযোগ্য হাদিস, হাদিসের মৌলিক কিতাবাদিতে মুসলিমদের যে ভবিষ্যত অবস্থা এবং আসন্ন ঘটনা বর্ণিত হয়েছে তা সম্পর্কে জানতে হবে।
প্রথম কথা হল কিয়ামত এবং কিয়ামতের আলামতের ব্যাপারে আলোচনা করা মুসলিমদের মৌলিক আকিদার অন্তর্ভুক্ত। এটি কুরআনের তিনটি আলোচ্য বিষয়ের একটি।
দ্বিতীয় কথা হল নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামত এবং কিয়ামতের আলামতের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কিয়ামত এবং কিয়ামতের আলামত যেমনিভাবে কুরআনের মৌলিক আলোচনা তেমনি হাদিসের মৌলিক আলোচনাও এটি। বরং এটিও বলা যায় যে, ইসলামের মৌলিক ভিত্তিগুলোর সাথে এর সম্পর্ক। মুসলমান হওয়ার জন্য পড়ে থাকি:
آمنت بالله وملائكته و كتبه ورسله واليوم الآخر
“আমি আল্লাহর প্রতি ইমান এনেছে, তার ফেরেশতা, কিতাবসমূহ, রাসুল এবং শেষ দিবসের প্রতি ইমান এনেছি।”
শেষ দিবসের মাঝে কিয়ামত এবং কিয়ামত সংক্রান্ত আলোচনাও আছে। হাদিসের ভাণ্ডারে প্রায় সাত লাখেরও বেশি হাদিস আছে। এসব হাদিসের মাঝে একটি হাদিস আছে যাকে উম্মতের আলিমগণ “উম্মুস সুন্নাহ” নামে নামকরণ করেছেন। এটি এমন একটি হাদিস যেখানে দ্বীনের মোটাদাগের সমস্ত কথা ও আলোচনা চলে এসেছে। এই হাদিসটিকে উম্মুস সুন্নাহ বলা হয়। ইসলামের মৌলিক সব বিষয়গুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়েছে। হাদিসটি অনেক প্রসিদ্ধ। এটি হল হাদিসে জিবরাইল; এটিকেই উম্মুস সুন্নাহ বলা হয়। হাদিসের সারাংশ হল জিবরাইল আলাইহিস সালাম নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে মানুষের আকৃতিতে আগমন করলেন। তিনি এসে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে প্রশ্ন করেন যে, ইসলাম কাকে বলে? ইমান কাকে বলে? ইহসান এবং ইখলাস কী জিনিস? সাথে সাথে এই প্রশ্নটিও করেন যে, কিয়ামত কবে আসবে?
নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কিয়ামতের ব্যাপারে প্রশ্নকারীর যেমন জানা নেই; তেমনি যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে তারও জানা নেই। কিয়ামত কখন হবে সে ব্যাপারে যেমন তোমার জানা নেই; তেমনি আমাকেও কিয়ামতের জ্ঞান দান করা হয়নি।
إِلَيْهِ يُرَدُّ عِلْمُ السَّاعَةِ “কিয়ামতের জ্ঞান একমাত্র তাঁরই জানা।” যখন কিয়ামতের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয় তখন একমাত্র আল্লাহ তাআলার দিকেই তা সম্পৃক্ত করে দেয়া হয়।
يَسْأَلُونَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا (৭৯:৪২)
যদি লোকেরা আপনাকে কেয়ামতের সময়ের ব্যাপারে প্রশ্ন করে; কিয়ামতের আকিদা বা আলামাত অথবা কিয়ামের দৃশ্য বা অবস্থা নিয়ে নয়। বরং أَيَّانَ مُرْسَاهَا কিয়ামতের সময় কখন এটি জিজ্ঞেস করে। এই প্রশ্নের উত্তর হবে
إِلَى رَبِّكَ مُنْتَهَاهَا (৭৯:৪৪)
এই প্রশ্নের উত্তর আল্লাহর দিকেই ফিরে যাবে। يَسْأَلُونَكَ كَأَنَّكَ حَفِيٌّ عَنْهَا (তারা আপনাকে এমনভাবে প্রশ্ন করে যেন আপনি সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত।) যদি মানুষ আপনাকে কিয়ামত কখন হবে এব্যাপারে প্রশ্ন করে তাহলে قُلْ আপনি তাদেরকে বলে দিন, لَا يُجَلِّيهَا لِوَقْتِهَا إِلَّا هُوَআল্লাহ ছাড়া অন্য কারও এই বিষয়ে খবর নেই।
নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যে হাদিসে জিবরাইল আলাইহিস সালাম এসে প্রশ্ন করেছিলেন, আর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিয়েছিলেন; সেখানে জিবরাইল আলাইহিস সালাম প্রশ্ন করেছিলেন, কিয়ামতের আলামতগুলো কী কী? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন উত্তর দিয়েছিলেন। এই হাদিসটিকে উম্মতের আলিমগণ সর্বসম্মতিক্রমে “উম্মুস সুন্নাহ” হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। একটি মৌলিক হাদিস যাতে দ্বীনের সকল মৌলিক বিধানগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। এতে এই বিষয়টিও বুঝা যায় যে, কিয়ামত এবং কিয়ামতের আলামত কুরআনেরও মৌলিক আলোচ্য বিষয় এবং হাদিসেরও মৌলিক আলোচ্য বিষয়। প্রত্যেক মুসলিমের ইমান, ইয়াকিন এবং আকিদার মাঝে এটি একটি মৌলিক আকিদা।
কিয়ামত ও কিয়ামতের আলামতসূহের গুরুত্ব বুঝার জন্য সংক্ষিপ্ত এই দু’টি কথা উল্লেখ করা হল। প্রথম কথা নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামত এবং কিয়ামতের অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আর কুরআনের আলোচ্য বিষয়ই হল এটি। বিশেষ করে শেষ পাঁচ ছয় পারা তো কিয়ামতের সমস্ত অবস্থা, ঘটনা, দৃশ্যাবলীর সাথেই সম্পৃক্ত। ছাব্বিশ পারার দ্বিতীয় সুরাটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে সুরায়ে মুহাম্মাদ। এখানে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে, আপনি লোকদেরকে বলে দিন যে, কিয়ামতের আলামতসমূহের ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে গেছে।
فَهَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا السَّاعَةَ أَنْ تَأْتِيَهُمْ بَغْتَةً ۖ فَقَدْ جَاءَ أَشْرَاطُهَا (তারা শুধু এই অপেক্ষাই করছে যে, কিয়ামত অকস্মাৎ তাদের কাছে এসে পড়ুক। বস্তুতঃ কিয়ামতের লক্ষণসমূহতো এসেই পড়েছে।)
দ্বিতীয় কথা হল: কিয়ামত আমাদের ইমানের অংশ এবং আমাদের আকিদারও অংশ। কুরআনের আলোচ্য বিষয়। হাদিসেরও আলোচ্য বিষয়। কিয়ামতের সাথে সম্পৃক্ত আলামতগুলোর গুরুত্ব কী এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতটুকু গুরুত্বের সাথে এগুলো বর্ণনা করেছেন।
সম্মানিত ভাইয়েরা আমার!
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিসের যে অংশটি কিয়ামত, কিয়ামতের আলামত, কিয়ামতের পূর্ববর্তী অবস্থা, ঘটনাবলী, ফিতনা ও যুদ্ধসহ এধরণের ইলম নিয়ে বর্ণিত তা এত বিস্তারিত বর্ণনা যে, এরচেয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। মুহাদ্দিসীনে কেরাম এবং উলামায়ে উম্মত হাদিসের এই অংশটিকে পৃথকভাবে নাম দিয়ে বর্ণনা করেছেন। তারা এটিকে নাম দিয়েছেন “ইলমুল ফিতান”। বর্ণিত সব হাদিসকে এখানে পৃথক শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে। উলামায়ে কেরাম কিতাবু ফিতান বা আশরাতুস সাআহ নামে নিজ নিজ হাদিসের কিতাবে হাদিসগুলো বর্ণনা করেছেন। হাদিসের বড় এমন কোনো কিতাব নেই যেখানে কিতাবুল ফিতান বা আবওয়াবুল ফিতান উল্লেখ করা হয়নি। কিতাবুল ফিতানে ফিতনা ও কিয়ামত সংক্রান্ত সকল হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে। এটি হাদিসের কিতাবে পৃথক একটি শিরোনাম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি হাদিসের কিতাবে এটি আছে। সহিহ বুখারির দ্বিতীয় খণ্ডে কিতাবুল ফিতান, সহিহ মুসলিমের দ্বিতীয় খণ্ডে কিতাবুল ফিতান (আশরাতুস সাআহ), সুনানে আবু দাউদের দ্বিতীয় খণ্ডে কিতাবুল ফিতান এবং আবওয়াবুল মাহদি ও জিকরুদ দাজ্জালÑনামেও পৃথক অধ্যায় রয়েছে, জামে’ তিরমিজির দ্বিতীয় খণ্ডে আবওয়াবুল ফিতান আর-রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে উল্লেখ করা হয়েছে। সুনানে ইবনে মাজাহতে আবওয়াবুল ফিতান Ñনামে এই সবগুলো হাদিস জমা করা হয়েছে। সুনানে নাসাই, মুসনাদে হাকিমেও কিতাবুল ফিতান রয়েছে। মুসনাদে আহমাদে “আবওয়াবুল ফিতান” শিরোনামে বহু সংখ্যক বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিসের বড় এবং নির্ভরযোগ্য প্রতিটি গ্রন্থে “আল-ফিতান” নামে একটি শিরোনাম উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে কিয়ামতের সাথে সম্পৃক্ত সকল ঘটনা ও অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে এই সংক্রান্ত সকল হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে। এতেই বুঝা যায়, ইসলামে এই বিষয়ািটর গুরুত্ব কত?
সাথে সাথে এই বিষয়টিও মনে রাখতে হবে যে, দুনিয়াতে ইসলামই একমাত্র ধর্ম যেখানে মানুষকে মানুষের ইতিহাসের সাথে সাথে দুনিয়ার শুরু ও শেষ এবং দুনিয়ার আগের অবস্থা ও দুনিয়ার পরবর্তী অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া অন্য কোনো ধর্মে এসব বিষয়ে এত বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, দুনিয়াতে মানুষের আগমনের আগে কী ছিল কুরআন ও হাদিসে তা বর্ণনা করা হয়েছে। দুনিয়া যখন অস্তিত্বে ছিল না তখন কী ছিল তা কুরআন ও হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদেরকে কী দিয়ে এবং কিভাবে তৈরি করেছেন তা কুরআন ও হাদিস বর্ণনা করেছে। দুনিয়া ও জমিন সৃষ্টির আগে কী ছিল তা হাদিস বর্ণনা করেছে। আল্লাহর আরশ কোথায় ছিল তা কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। দুনিয়া কিভাবে অস্তিত্বে এসেছে কুরআন ও হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে। আদম আলাইহিস সালামকে কিভাবে তৈরি করা হয়েছে? তার সাথে কী কথা-বার্তা হয়েছে? তিনি কিভাবে জান্নাতে প্রবেশ করেছেন? তার সাথে কে ছিল? কিভাবে জান্নাত থেকে বের হলেন? কোথায় এসেছেন? কতদিন তিনি একাকী ছিলেন? আল্লাহ তাআলার কাছে কী কী প্রার্থনা করেছেন? কোথায় তারা একত্রিত হয়েছেন? তার আগে সৃষ্টি কেমন ছিল? তাঁকে কিভাবে নবুওয়াত দান করা হয়েছে? তাঁর সন্তানের ধারা কিভাবে চালু হয়েছিল? দুনিয়া কিভাবে অস্তিত্বে আসে? বংশধারা কিভাবে অস্তিত্বে আসে? এই সব কিছু কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত আছে। মানব সৃষ্টি কিভাবে হয়? এটি কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত আছে। জগতসমূহ কিভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে? কোন জিনিসের পরিমাণ কতটুকু? এটি কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত আছে। ভূমির ইতিহাস কী? আসমানের ইতিহাস কী? পাহাড়ের ইতিহাস কী? মানব সভ্যতার ইতিহাস কী? মানব সৃষ্টির পর্বগুলো কী কী? মানুষ কোন কোন পর্বগুলো অতিক্রমের পর অস্তিত্বে আসে? এটিও কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত আছে। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুনিয়াতে আগমনের পর যখন এই উম্মত তৈরি হল, দ্বীনের সূচনা হল তখন কিভাবে এটি হয়েছিল এবং কখন হয়েছিল? সমস্ত জাতির অবস্থা, নবিদের বিস্তারিত সংবাদ হাদিসের মাধ্যমে, কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন। এই সব কিছু উম্মতে মুসলিমার কাছে সংরক্ষিত আছে। এরপর সৃষ্টিজগত কিভাবে নিজের মোড় পরিবর্তন করেছে এটিও সংরক্ষিত আছে। এগুলো ছিল অতীতের খবর। কিন্তু বর্তমানে কী কী হওয়া উচিত! মানব জাতির প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত? এই শিক্ষাও ইসলামে আছে। আপনি কিভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবেন? নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষা কেমন ছিল? এটিও কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত আছে। এছাড়াও ভবিষ্যতের সকল জ্ঞানও এখানে আছে। দুনিয়ার পরিবর্তন কিভাবে ঘটবে? কোন ভূখণ্ডে কিভাবে আসবে? কে কার ওপর হামলা করবে? ইসলামের ভবিষ্যত কেমন হবে? কোন অঞ্চলের মুসলিমগণ কেমন থাকবেন? তাদের পরিবর্তন আসবে কিভাবে? তাদের ভবিষ্যত কেমন হবে? আরবের ভবিষ্যত কেমন হবে? হিন্দুস্তানের ভবিষ্যত কেমন হবে? সিন্ধুর ভবিষ্যত কেমন হবে? এগুলো কুরআন ও হাদিসে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইমাম মাহদির আত্মপ্রকাশ কিভাবে হবে? জিহাদের মাধ্যমে দুনিয়াতে ইসলামের বিজয় কিভাবে হবে? ইমাম মাহদি কখন, কিভাবে এবং কোন অবস্থায় আসবেন? হযরত ইসা আলাইহিস সালাম কখন, কোন দেশে, কিভাবে অবতরণ করবেন? কুরআন ও হাদিসে এসব কিছু বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।
দাজ্জালের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। প্রতিটি বড় বড় যুদ্ধের ব্যাপারে আলোচনা এসেছে। কিতাবুল মালাহিম নামে পৃথক অধ্যায় তৈরি করা হয়েছে। কোথায় কোথায়, কার কার সাথে কতগুলো যুদ্ধ হবে? এসব বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তখন তাদের সংখ্যা কত হবে তাও উল্লেখ করা হয়েছে। নিহত হবে কতজন? সত্যের ওপর কে থাকবে? এই সব কিছুর বিস্তারিত আলোচনা কুরআন, সুন্নাহ এবং সিহাহ সিত্তার কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। নির্ভরযোগ্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজিতে সমস্ত ঘটনাগুলো বর্ণিত হয়েছে। আমরা এখানে হাদিসের যে ঘটনাগুলো বর্ণনা করবো সেগুলোর সাথে সাথে এটিও দায়িত্বের সাথে উল্লেখ করবো যে, এগুলো কুরআন এবং সুন্নাহতে আছে এবং সহিহ সনদের মাধ্যমে এগুলো প্রমাণিত। উম্মতও এগুলোর ওপর একমত রয়েছেন। ইসা আলাইহিস সালাম-এর অবতরণ অবস্থা কেমন হবে? তার পরবর্তী অবস্থা কেমন হবে? কিয়ামতের বড় বড় আলামতগুলো কী? কিয়ামত কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? তখনকার পরিস্থিতি কেমন হবে? মানুষের মৃত্যুর পর তার কবরের অবস্থা কেমন হয়? বরযখের অবস্থা কেমন হয়? হাশর কিভাবে অনুষ্ঠিত হবে? আল্লাহ তাআলা প্রথম প্রশ্ন কী করবেন? জান্নাতে সর্বপ্রথম কে প্রবেশ করবেন এবং সর্বশেষ কে প্রবেশ করবেন? জাহান্নামে সর্বশেষ কে প্রবেশ করবে? সেখানে আল্লাহ তাআলার প্রশ্ন এবং উত্তরের ধারাগুলো কেমন হবে? সুপারিশ কিভাবে হবে? জান্নাতের নেয়ামতগুলো কী কী? জান্নাতে কী কী প্রশ্ন করা হবে? জান্নাতের স্তরগুলো কী কী? জান্নাতের অনুষ্ঠানগুলো কেমন হবে? জান্নাতের আলাপচারিতা কেমন হবে? জাহান্নামের অবস্থা কেমন? জাহান্নামের তবকাগুলো কী কী? তার শাস্তি কী কী? এই সব কিছুর খবর কুরআন ও হাদিস বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সম্পূর্ণ জ্ঞান আল্লাহ তাআলা কুরআন এবং হাদিসের মাধ্যমে এই উম্মতকে দান করেছেন। এই উম্মতের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সকল কাহিনী আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুল উম্মতকে বিস্তারিত বলে দিয়েছেন। ইসলামই পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম যা এই সব কিছু বর্ণনা করেছে। আর এগুলো এজন্যই বর্ণনা করা হয়েছে যেন অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, বর্তমানে সে শিক্ষা অনুযায়ী জীবন-যাপন করে এবং ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
আমরা নিজেদের ভবিষ্যতের ভিত্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা অনুযায়ী স্থাপন করবো। আমাদের এই দরসগুলোতে কিয়ামতের আলামত এই ভিত্তিতে আলোচনা করা হবে যে,নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই উম্মতকে উম্মতের ভবিষ্যতের ব্যাপারে কী বলেছেন এবং কতটুকু গুরুত্বের সাথে বলেছেন। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে সাহাবিদেরকে তাওহিদের শিক্ষা দিতেন, মাসায়েল ও ফাজায়েল শিক্ষা দিতেন, যেখানে জিহাদি কাফেলা প্রেরণ করতেন, দাওয়াতের জন্য তাশকিল করতেন, জাতি ও রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতেন, উম্মত যেখানে অস্তিত্বে এসেছে সেখানেই নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে উম্মতের অবস্থা, ঘটনাবলী এবং ভবিষ্যতের সংবাদ দিয়ে একটি পূর্ণ সিরিজ তৈরি করেছেন। সাহাবিদের একটি জামাআত ছিল যারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভবিষ্যতের ব্যাপারে প্রশ্ন করতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে সে ব্যাপারে সংবাদ দিতেন। তিনি তাদেরকে সে সব লিখিয়ে দিতেন। হাদিস শুনিয়ে দিতেন। অবস্থা ও ঘটনাবলী বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতেন। যা সাবাবিগণ (সাহাবীগণ) একত্রিত করেছেন এবং উম্মত পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।
নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দেয়া এসব সংবাদগুলো দু’ধরণের। এক: ঐ সকল সংবাদ যা নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণ মজলিসে আলোচনা করেছেন এবং তিনি এগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। যদি এই সব বিস্তারিত আলোচনা করতে যাই তাহলে সময় এখানেই শেষ হয়ে যাবে। মূলকথা হল সহিহ মুসলিমে কিতাবুল ফিতান এবং আশরাতুস সাআহ অধ্যায়ে বর্ণিত যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের সামনে একটি দীর্ঘ খুতবা দিয়েছিলেন। এটি অনেক দীর্ঘ ছিল। সেখানে না ছিল তাওহিদের আলোচনা, না সেখানে মাসায়েল বা ফাজায়েল আলোচনা করা হয়েছে, আর না উম্মতকে অসিয়ত করা হয়েছে! তাহলে সেই দীর্ঘ খুতবার আলোচ্য বিষয় কী ছিল? শুধু এটিই আলোচনা করা হয়েছে যে, যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই খুতবা দিচ্ছেন তখন থেকে কিয়ামতের আগ পর্যন্ত এই উম্মতের মাঝে কী কী হবে। উম্মতকে উম্মতের ভবিষ্যতের সংবাদ দিয়েছেন। তোমাদের সামনে এই এই বিষয় সংঘটিত হবে এবং পরে এই এই অবস্থার সম্মুখীন হবে। এই এই ফিতনা আসবে, এই এই যুদ্ধ হবে। ইসলামের বিজয় এভাবে আসবে, ইমাম মাহদি আসবেন এবং দাজ্জালের আগমন ঘটবে। ইসা আলাইহিস সালাম আগমন করবেন। কিয়ামত পর্যন্ত সকল অবস্থা বর্ণনা করেছেন। কিয়ামত প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগ পর্যন্ত সকল অবস্থা নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই খুতবায় আলোচনা করেছেন। খুতবাটিতে বিস্তারিতভাবে সব কিছু উল্লেখ করেছেন। আর এই ইলমকেই “ইলমুল ফিতান” বলা হয়। ইলমুল ফিতান হল সেই খুতবা যা নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণ মজলিসে দিয়েছিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবা শুরু করেছেন ফজরের সালাতের পর পর। ফজরের সালাত পড়ে মিম্বারে উঠে বসেন এবং খুতবা আরম্ভ করেন। খুতবাটি ছিল কিয়ামতের আলামত, ফিতনা, অবস্থা ও ঘটনাবলী নিয়ে। সেখানে উম্মতকে উম্মতের ভবিষ্যতের ব্যাপারে সংবাদ দেওয়া হয়েছে। এই আলোচনায় ছিল বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা, বিভিন্ন নিদর্শনের কথা এবং বিভিন্ন শিক্ষা। কিন্তু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আলোচনার মূল পয়েন্ট ছিল কিয়ামতের আলামত এবং ফিতনার বর্ণনা।
চলবে.....
সূত্র: নওয়ায়ে আফগান জিহাদ - জানুয়ারি ২০২০ ইং সংখ্যা থেকে অনূদিত
Comment