সীরাত থেকে শিক্ষা- ০২ হকের বিজয় আসা অবধি অনেকে হক বুঝতে পারে না
আবু সুফিয়ান রাদি.। মক্কার নেতা। কিন্তু তিনি হক বুঝেছেন কত বছর পর? মক্কার তেরো বছর তিনি ঈমান আনেননি। তিনিই উহুদ ও খন্দক যুদ্ধে কাফেরদের নেতৃত্ব দেন। শেষে অষ্টম হিজরিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কা বিজয় করেন, তখন তিনি মুসলমান হন। একজন বিজ্ঞ মানুষ, হক বুঝতে তার ২১ টি বছর লেগে গেলো! আবু সুফিয়ান রাদি.র বন্ধু ছিল উমাইয়া বিন আবুস সালত। লোকটি অনেক জ্ঞানী ছিল। এক সময় সে আশা রাখতো সে-ই হবে শেষ যামানার নবী। পরে বুঝতে পারে নবী সে নয়, নবী হবেন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আলহাশিমি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সে ছিল তায়েফের সাকিফ গোত্রের লোক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু সাকিফ গোত্রের লোক ছিলেন না, তাই সব বুঝতে পারার পরও নিজের গোত্রের না হওয়ায় সে রাসূলকে নবী হিসেবে গ্রহণ করেনি, কাফের অবস্থায় মারা যায়।[1]
আবু সুফিয়ান রাদি. এক সফরে তার বাড়িতে গেলে সে আবু সুফিয়ান রাদি.কে বলে, মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহর মাঝে আমি নবীর গুণাবলী দেখতে পাচ্ছি। মুহাম্মাদ নবী হতে যাচ্ছে। অবশ্য সাকিফ গোত্রের বাইরের কাউকে আমি নবী বলে গ্রহণ করবো না। তাই সে ঈমান না এনেই মারা যায়।
আবু সুফিয়ান রাদি. সফর শেষে মক্কায় এসে দেখেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেকে নবী দাবি করেছেন। লোকজন তাঁকে নবী বলে মানছে না। বরং যারা তাঁকে নবী মেনে নিয়েছে তাদেরকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করছে। তখন তিনি সন্দেহে পড়ে যান যে, মুহাম্মাদ যদি নবী হবে তাহলে তার অনুসারীরা কেন মার খাবে? এক পাদ্রীর কাছ থেকে তিনি শুনেছিলেন, শেষ যামানার নবীকে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা পাঠিয়ে সাহায্য করবেন। এখন সাহাবায়ে কেরামকে মার খেতে দেখে তিনি সন্দেহে পতিত হন। তাবারানির সূত্রে বিদায়া নিহায়া গ্রন্থে ইবনে কাসীর রহ. আবু সুফিয়ান রাদি.র অনুভূতিটি উল্লেখ করেন,
حَتَّى جِئْتُ مَكَّةَ فَوَجَدْتُ أَصْحَابَهُ يُضْرَبُونَ وَيُحْقَرُونَ قَالَ أَبُو سُفْيَانَ فَجَعَلْتُ أَقُولُ فَأَيْنَ جُنْدُهُ مِنَ الْمَلَائِكَةِ قَالَ فَدَخَلَنِي مَا يَدْخُلُ النَّاسَ مِنَ النَّفَاسَة. -البداية والنهاية ط الفكر (2/ 223)
“মক্কায় এসে দেখলাম, মুহাম্মাদের অনুসারীদের পেটানো হচ্ছে। অপমান করা হচ্ছে। তখন আমি নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম: (মুহাম্মাদ যদি নবী হবে) তাহলে ফেরেশতার (যে) বাহিনী (দিয়ে তাকে সাহায্য করার কথা তা) কোথায়? এরপর অন্য দশজনের মতো আমার অন্তরেও প্রতিহিংসা জায়গা করে বসলো।” –বিদায়া নিহায়া: ২/২২৩
প্রতিহিংসা কিভাবে আবু জাহেলকে এবং কিভাবে ইয়াহুদিদেরকে ঈমান থেকে মাহরুম করলো তা আমরা দেখেছি। উমাইয়া বিন আবুস সালত সব বুঝেও এই গোত্রীয় প্রতিহিংসার কারণে ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়। আবু সুফিয়ান রাদি.র মাঝেও এটি কাজ করতে থাকে যে, হাশেমিরা নবী হবে!! বড় বড় নেতা থাকতে মুহাম্মাদ নবী হবে!! এটা মানা যায় না।
তিনি অপর যে কথাটি বলেছেন, সেটি আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। হকের অনুসারীদের মার খেতে দেখে তিনি সন্দেহে পতিত হন যে, তারা যদি সত্য সত্যই হকের পথে থাকবে, তাহলে তার বিরুদ্ধবাদীরা কেন বিজয়ী আর তারা কেন পরাজিত?
সুবহানাল্লাহ! হকের অনুসারীরা পরাজিত- এটি তাঁর হক বুঝার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। তিনি নিজেকে মানাতে পারছিলেন না যে, মুহাম্মাদ হকের পথে থাকলে তারা কেন দুর্বল? কেন পরাজিত? কেন মার খাবে? কেন অপমানিত হবে? কেন লাঞ্ছিত হবে? অথচ মক্কা বিজয়ের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সেনাবাহিনী নিয়ে মক্কা অবরোধ করেন এবং অস্ত্রের জোরে মক্কা বিজয় করেন, তখন তাঁর বুঝে আসে, মুহাম্মাদ তাঁর দাবিতে সত্য। মুহাম্মাদ সত্য সত্যই আল্লাহর নবী। তখন তিনি ঈমান কবুল করে মুসলমান হন।
প্রিয় ভাই, আপনি কি এ ঘটনা থেকে শিখার মতো কিছু পাচ্ছেন? আপনি আজ যে হকের দাওয়াত দিচ্ছেন, তা নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। জঙ্গিবাদ, উগ্রতা, খারেজিপনা, মানহাজি ইত্যাদি ট্যাগ লাগানো হচ্ছে। কেনো? কারণ:
- আপনি হয় বেলালের মতো বন্দী।
- না হয় আবু যর গিফারির মতো আহত।
- না হয় আম্মারের পিতা মাতার মতো নির্যাতনের মুখে শহীদ।
- না হয় হাবশা-মদীনায় পলাতকদের মতো দেশছাড়া।
তালেবানরা যে আজ দুনিয়ার মডেল হয়ে গেছে, আপনি কি জানেন: অনেকে তালেবানদের শুরুটাকে ভালো চোখে দেখেনি? বরং তাদের বিশ্বাস ছিল: তালেবান ভুল করছে, অচিরেই এ ভুলের পরিণতি তাদের ভুগতে হবে। কিন্তু ২০ বছর পর বিজয়ের সোনার হরিণ যখন তাদের হাতে ধরা দিল, তখন তারাই হয়ে গেলো মহান মুজাহিদ, দুনিয়ার রোলমডেল, গর্বের সন্তান।
এই ‘উগ্রজঙ্গি’ অপবাদটি পরিবর্তন হয়ে ‘গর্বের সন্তান’ উপাধিটি আপনার লাভ হতে যাচ্ছে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু আপনাকে সবর করতে হবে। সহনশীল হতে হবে। হাল ছাড়া যাবে না। আজ যে আপনি দুর্বল, এটিই অনেকের সামনে একটি বাধা হয়ে আছে। আপনার বিজয় আসবে তো এই বাধা সরে যাবে। তখন হক বুঝে আসবে অনেকের। শায়খ উসামা রহ. ঠিকই বলেছেন, তরবারি হক বুঝার পথে সহায়ক হয়ে থাকে।
আজ আপনি দেখতে পাচ্ছেন চতুর্দিকে হামাসের প্রশংসা। কিন্তু হামাসকে যদি দু’দিন পর পরাজিত হতে হতো, তখন দেখতেন তাদের ভুলের ফিরিস্তি কত লম্বা হয়ে দাঁড়াত। কত জনের কত কত কলমে এই হামলার নির্বুদ্ধিতা (!!) নিয়ে কত গবেষণাপত্র বের হতো। এমনকি – আল্লাহ না করুন- যদি সামনে হামাস এই যুদ্ধে পরাজিত হয়, তাহলেও আজকের প্রশংসাবাণী আস্তে আস্তে সমালোচনায় পরিণত হতে শুরু করবে। আল্লাহ মুজাহিদদের ইজ্জত রক্ষা করুন।
এ প্রসঙ্গ নিয়ে সামনের পর্বে ইনশাআল্লাহ আরও কিছু বলার আছে।
[1] البداية والنهاية ط الفكر (2/ 223): قُلْتُ فَأَيْنَ أَنْتَ مِنْهُ يَا أَبَا عُثْمَانَ؟ فَقَالَ وَاللَّهِ مَا كُنْتُ لِأُومِنَ بِرَسُولٍ مِنْ غَيْرِ ثَقِيفٍ أَبَدًا. اهـ
Comment