ওয়া মু’তাসিমাহ! মু’তাসিম বাঁচাও!
আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.
বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনুল আছীর রহ. ইতিহাসগ্রন্থ ‘আল-কামেল’ এ উল্লেখ করেন—
মুসলিম জাহানের প্রবল প্রতাপশালী খলিফা মু’তাসিমের কানে যখন রোমানদের হাতে বন্দী এক নির্যাতিতা হাশেমী নারীর বুকভাঙ্গা চিৎকার— ওয়া মু’তাসিমাহ! মু’তাসিম বাঁচাও! আওয়াজ পোঁছুল তখন খলীফা মু’তাসিম সঙ্গে সঙ্গে লাব্বাইক লাব্বাইক (আমি আসছি আমি আসছি) বলে চিৎকার দিয়ে সিংহাসন থেকে নেমে আসেন। রাজ প্রাসাদের ভিতরেই ‘ঝাঁপিয়ে পড়’, ‘ঝাঁপিয়ে পড়’ বলে বজ্র কণ্ঠে ঘোষণা করতে লাগলেন। রোমীয়দের হাতে মুসলমানদের ক্ষয়-ক্ষতি সম্পর্কে রাজ্যের কাজীদের ও উপস্থিত জনগণকে অবহিত করলেন। অতঃপর ক্ষুদ্র একটি বাহিনী নিয়েই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। অসহায় মুসলিম নারীটি যে দুর্গে বন্দী ছিলেন সে দুর্গটির নাম ছিল ‘আমুরিয়া’। খলীফা মু’তাসিম সে দুর্গটি বিজয় করার পর ধ্বংস করে ধূলোয় মিশিয়ে দেন।
এটি ঐ সময়ের কথা, যখন শাসকগণ ইসলামী আদর্শে উদ্দীপ্ত ছিল। নিপীড়িতের জন্য ছিল সুহৃদ ত্রাণকর্তা। আর জালেম ও অত্যাচারীর জন্য ছিল সাক্ষাৎ যমদূত। শাসকরা নিজেদের মনে করত ইসলাম ও মুসলমানের খাদেম ও মুহাফেজ। একজন সাধারণ ব্যক্তি কিংবা অবলা বৃদ্ধাকে রক্ষার জন্য নিজেদের জীবন ও রাজ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করত না।
আর মুসলমানরা পৃথিবীর শেষ সীমানা অবধি প্রতিটি দেশে নিশ্চিন্ত নির্বিঘ্ন ও প্রশান্ত চিত্তে আত্মমর্যাদার সঙ্গে বসবাস করত। সবাই এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত ছিল, সে কখনই একা নয়; বরং তার মুসলিম ভাইয়েরা সর্বদা তার পাশে আছে এবং তাকে রক্ষা ও সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তার সাহায্যার্থে প্রয়োজনে জীবন বাজি রাখার জন্য বদ্ধপরিকর। অন্য দিকে জালেমগোষ্ঠীও ভাল করেই জানত, এদের কারো প্রতি হাত বাড়ানো মানে ঘুমন্ত শার্দুলকে জাগিয়ে তোলা কিংবা মৌচাকে ঢিল মারা। যারা অন্যায়ের চরম প্রতিশোধ নেয়ার আগ পর্যন্ত শান্ত হবে না, আর আগ্রাসী শত্রু জলে-স্থলে কোথাও পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। মুসলিম জাতির প্রতিটি সদস্যকে ‘একদেহ’ ‘একপরিবার’ রূপে গণ্য করা হত। একজন আক্রান্ত হলে অপরজন সর্বস্ব নিয়ে তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসত।
এতক্ষণ যাদের কথা আলোচনা করা হয়েছে, তারা ঐ সকল মুসলিম শাসক যাদের অন্যায় ও অবিচারে ইতিহাসের পাতা ভরে আছে। যারা কোনভাবেই ন্যায়পরায়ণ ও সুশাসকের কাতারে পড়ে না। তারা নিজেরাও নিজেদেরকে উত্তম ও ধর্মপ্রাণ মনে করত না; বরং নিজেদের অন্যায় ও অপরাধের কথা অকপটে স্বীকার করত। কিন্তু দেখুন তাদের মাঝেও ধর্মীয় চেতনা এমন পর্যায়ের ছিল যে, তারা তাদের বীর সেনাপতিদের নেতৃত্বে বিশাল বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছে মুসলমানদের একটি বসতি রক্ষার উদ্দেশে কিংবা কিছু ভিনদেশি মুসলিম নারীকে রক্ষার জন্য, দস্যুরা যাদের পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিল। অথচ সে পর্যন্ত পৌঁছানোর পথ নিষ্কণ্টক ছিল না। আল্লাহ তাআলা তাঁদের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং অসহায় মুসলিম ভাই-বোনদের প্রতি সংবেদনশীলতার কারণে এ অভিযানের মাধ্যমে এক অবিস্মরণীয় বিজয়ের দ্বার উন্মোচন করেন। সূচনা হয় নব যুগের।
ঐতিহাসিক ‘বালাজুরী’ তার অমর গ্রন্থ ‘ফুতুহুল বুলদানে’ লিখেন— ভারত সাগরের উপকূলবর্তী দেবল (বর্তমানে করাচী) বন্দর অতিক্রমকালে একটি আরবীয় বাণিজ্যিক জাহাজ -যাতে নারীরাও ছিল- স্থানীয় জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। জলদস্যুরা জাহাজের যাবতীয় মালপত্র ও যাত্রীসহ জাহাজটি ছিনতাই করে। তখন দস্যুদল কর্তৃক আটক নারীদের একজন যিনি ইয়ারবূ গোত্রের ছিলেন, এ বলে আর্তনাদ করেন— হাজ্জাজ তুমি কোথায়? এ খবর শোনামাত্র হাজ্জাজ বিন ইউসুফ লাব্বাইক! আমি আসছি বলে হুংকার দেন। অতঃপর সিন্দুর শাসক রাজা দাহিরের কাছে বন্দী নারীদের মুক্তি দেয়ার জন্য লোক পাঠান। কিন্তু দাহির এ বলে তাদের ফিরিয়ে দেয় যে, তারা
দস্যু কর্তৃক অপহৃত; তাদের উপর আমার ক্ষমতা নেই। তখন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ওবায়দুল্লাহ বিন নাবহানকে সেনাপতি করে দেবলে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু সেনাপতি ওবায়দুল্লাহ যুদ্ধে নিহত হন। তখন বুদাইল বিন তুহফাকে সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। তিনি নিহত হলে হাজ্জাজ নিজ জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসেমকে সেনাপতি করে সিন্দু অভিযানে পাঠান। এটা ছিল খলীফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের যুগে। সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের হাতেই সিন্দু বিজয় হয়।
ইসলামী ইতিহাসে এমন অসংখ্য বিস্ময়কর ও দুঃসাহসিক ঘটনা রয়েছে, যাতে ধর্মীয় মূল্যবোধ উজ্জ্বলভাবে ফুটে ওঠে, যা এ উম্মাহর উপর মহান আল্লাহর বিরাট অনুগ্রহ বৈ কিছু নয়, যার মাধ্যমে উন্নত চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আর এর বিনিময়ে মানব জীবনে আত্মমর্যাদাবোধ ও ইজ্জত-সম্মানের বিকাশ ঘটে।
প্রকৃত পক্ষে শহর রক্ষা করা কিংবা মানুষের অধিকার রক্ষা করা মানে পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে রক্ষা করা। যারা মানুষের সাথে অমানবিক আচরণ করে, তাদের ইজ্জত-সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, বসত ভিটা থেকে তাদেরকে উচ্ছেদ করে এ ধরনের অসভ্য ও বর্বর শায়েস্তা করা তো মানব সভ্যতা রক্ষার স্বার্থেই আবশ্যক হয়ে পড়ে।
ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য স্বজাতির স্বার্থে যাদের মাঝে আত্মমর্যাদা বোধ জাগ্রত হয় না- তারা তো ভীরু, কাপুরুষ।
আরবের লোকেরা সে জাহেলি যুগ থেকেই আত্মমর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে অতিসংবেদনশীল। তাঁরা আত্মমর্যাদাবোধকে মনে করত নৈতিকতার ভিত্তিমূল। আর যারা স্বজাতির কোন কন্যাকে মরুভূমি কিংবা নির্জন ভূমিতে নির্যাতিত হওয়ার সংবাদ শুনেও তাকে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাগাদা অনুভব করে না, তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে বিলম্ব করে তারা অতি নিম্ন প্রকৃতির লোক বলে ধিকৃত হত। এ কলঙ্কের গ্লানি বংশ পরম্পরায় পরবর্তী প্রজন্মকেও বহন করতে হত। তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হত। তাদের এই মূল্যবোধের ভিত্তি ছিল এই হাদীস—
انصر اخاك ظالما اومظلوما
তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর চাই সে জালেম হোক, চাই মাজলুম।
ন্যায় হোক অন্যায় হোক অন্ধ গোত্রপ্রীতি ও সাম্প্রদায়িকতার দাবী হল গোত্রের লোকের পক্ষে দাঁড়াতেই হবে, তাকে সাহায্য করতেই হবে। সুতরাং এ নীতি থেকে যারা বিচ্যুত হবে বা ছাড় দিবে তারা সমাজে ধিকৃত হতে বাধ্য। এমনকি তাকে সমাজচ্যুত করে এক ঘরে করে রাখা হত।
বনী শায়বান গোত্রের কিছু লোক বনী আনবার গোত্রের কুরাইজ বিন উনাইফ নামক এক ব্যক্তির উপর আক্রমণ করে তার ত্রিশটি উট লুট করে নিয়ে যায়; কিন্তু এ বিপদের সময় তার গোত্রের কেউ সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেনি। অথচ জাহেলি যুগে গোত্রের কোন লোক বিপদে পড়লে অন্যরা এগিয়ে আসার চিরায়ত রীতি ছিল। এ ঘটনা সেই গোত্রের কবির হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। তখন সে যে কবিতা আবৃত্তি করে তা পরবর্তীতে সকল মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হতে থাকে। কারণ সে একজন প্রথিতযশা কবি ছিল। তার কবিতার চরণগুলো ছিল নিম্নরূপ—
আমি যদি মাযেন গোত্রের হতাম, তাহলে আমার উটগুলো খোয়া যেত না
বনূ লাকিতাহ জাহল বিন শায়বান এর বংশধর
তাহলে আমার দুর্দশায় কঠোর প্রকৃতির লোকেরা এগিয়ে আসত
যখন বিপদ তাদের গোত্রের আত্মসম্মানের দিকে হাত বাড়ায়।
তারা এমন জাতি, যখন মুসিবত তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলে
তারা দল বেঁধে ও বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিআক্রমণ করে
গোত্রের কেউ সাহায্যের আবেদন করলে
তারা দলিল-প্রমাণের পিছনে সময় নষ্ট করে না
তবে আমার গোত্র, যদিও সংখ্যায় অনেক,
কিন্তু তাদের আত্মসম্মানে আঘাত আসলেও তারা তা গায়ে মাখে না।
বরং তারা অত্যাচারির উপর দয়ালু সাজে-
আর মন্দ লোকের দিকে অনুগ্রহের হাত বাড়ায়।
সৃষ্টিকর্তা তার সাহায্যের জন্য এসব অথর্ব লোকদের ছাড়া
আর কাউকে কি সৃষ্টি করেননি!?
হায় যদি আমার জাতি এমন হত
দল বেঁধে তাদের অত্যাচারের সমুচিত জবাব দিবে।
ইসলাম এসে জাহেলী রীতি-নীতি যেগুলো ঐতিহ্য রূপে পালনীয় হত- সেগুলো রিসালাতের সাথে সমন্বয় করে তাতে ভারসাম্য সৃষ্টি করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমার ভাইয়ের সাহায্য কর- চাই সে জালিম হোক, চাই মাজলুম।’ সাহাবাদের কাছে এ বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে হল। কারণ, নববী তা’লীম-তরবিয়তে এতদিন তারা যা অর্জন করেছে এটা তার সাথে খাপ খায় না। তাই তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাজলুমকে সাহায্য করার বিষয়টি তো বুঝে আসে; কিন্তু জালেমকে সাহায্য করার বিষয়টি তো বুঝে আসছে না? তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইসলামী ব্যাখ্যা দেন এ বলে, জালেমের জুলুমের হাত চেপে ধরবে- যেন সে জুলুম করতে না পারে। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী।
তখন থেকেই মুসলমান জাতি এ আদর্শে উজ্জীবিত, মুসলমান চাই আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, কাছের হোক বা দূরের- মাজলুম হলে তাদের উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেত। আর জালেম হলে তাদের জুলুমের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াত। অত্যাচার-নিপীড়ন যে ধরনেরই হোক, পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক-তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হত। এক্ষেত্রে জালেমের রক্ত চক্ষুকে পরোয়া করত না। তার নিপীড়ণের হাতকে শক্তিশালি করার তো প্রশ্নই আসে না। মোটকথা জালেমের জুলুম মুখবুজে সহ্য করত না। এতে যা হবার হোক। যদি কারো মধ্যে এ মনোভাবের ব্যত্যয় ঘটতো, তাহলে সে গাদ্দার ও বিশ্বাসঘাতক বলে চিহ্নিত হত। তাকে ভীরু-কাপুরুষ বলা হত। অন্যরা তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করত এবং তাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করত। একসময় মুসলিম জাতির ভাগ্যে অমাবশ্যার দুর্যোগ নেমে এল। আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থচিন্তার ভূত তাদের ঘাড়ে চেপে বসল। ক্ষমতা ও রাজত্বের লালসায় তারা বুদ হয়ে পড়ল। ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত হওয়া তো দূরের কথা, সাধারণ মনুষ্যত্ব ও আত্মমর্যাদাবোধেরও অপমৃত্যু ঘটলো। (চলবে)
আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.
বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনুল আছীর রহ. ইতিহাসগ্রন্থ ‘আল-কামেল’ এ উল্লেখ করেন—
মুসলিম জাহানের প্রবল প্রতাপশালী খলিফা মু’তাসিমের কানে যখন রোমানদের হাতে বন্দী এক নির্যাতিতা হাশেমী নারীর বুকভাঙ্গা চিৎকার— ওয়া মু’তাসিমাহ! মু’তাসিম বাঁচাও! আওয়াজ পোঁছুল তখন খলীফা মু’তাসিম সঙ্গে সঙ্গে লাব্বাইক লাব্বাইক (আমি আসছি আমি আসছি) বলে চিৎকার দিয়ে সিংহাসন থেকে নেমে আসেন। রাজ প্রাসাদের ভিতরেই ‘ঝাঁপিয়ে পড়’, ‘ঝাঁপিয়ে পড়’ বলে বজ্র কণ্ঠে ঘোষণা করতে লাগলেন। রোমীয়দের হাতে মুসলমানদের ক্ষয়-ক্ষতি সম্পর্কে রাজ্যের কাজীদের ও উপস্থিত জনগণকে অবহিত করলেন। অতঃপর ক্ষুদ্র একটি বাহিনী নিয়েই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। অসহায় মুসলিম নারীটি যে দুর্গে বন্দী ছিলেন সে দুর্গটির নাম ছিল ‘আমুরিয়া’। খলীফা মু’তাসিম সে দুর্গটি বিজয় করার পর ধ্বংস করে ধূলোয় মিশিয়ে দেন।
এটি ঐ সময়ের কথা, যখন শাসকগণ ইসলামী আদর্শে উদ্দীপ্ত ছিল। নিপীড়িতের জন্য ছিল সুহৃদ ত্রাণকর্তা। আর জালেম ও অত্যাচারীর জন্য ছিল সাক্ষাৎ যমদূত। শাসকরা নিজেদের মনে করত ইসলাম ও মুসলমানের খাদেম ও মুহাফেজ। একজন সাধারণ ব্যক্তি কিংবা অবলা বৃদ্ধাকে রক্ষার জন্য নিজেদের জীবন ও রাজ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করত না।
আর মুসলমানরা পৃথিবীর শেষ সীমানা অবধি প্রতিটি দেশে নিশ্চিন্ত নির্বিঘ্ন ও প্রশান্ত চিত্তে আত্মমর্যাদার সঙ্গে বসবাস করত। সবাই এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত ছিল, সে কখনই একা নয়; বরং তার মুসলিম ভাইয়েরা সর্বদা তার পাশে আছে এবং তাকে রক্ষা ও সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তার সাহায্যার্থে প্রয়োজনে জীবন বাজি রাখার জন্য বদ্ধপরিকর। অন্য দিকে জালেমগোষ্ঠীও ভাল করেই জানত, এদের কারো প্রতি হাত বাড়ানো মানে ঘুমন্ত শার্দুলকে জাগিয়ে তোলা কিংবা মৌচাকে ঢিল মারা। যারা অন্যায়ের চরম প্রতিশোধ নেয়ার আগ পর্যন্ত শান্ত হবে না, আর আগ্রাসী শত্রু জলে-স্থলে কোথাও পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। মুসলিম জাতির প্রতিটি সদস্যকে ‘একদেহ’ ‘একপরিবার’ রূপে গণ্য করা হত। একজন আক্রান্ত হলে অপরজন সর্বস্ব নিয়ে তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসত।
এতক্ষণ যাদের কথা আলোচনা করা হয়েছে, তারা ঐ সকল মুসলিম শাসক যাদের অন্যায় ও অবিচারে ইতিহাসের পাতা ভরে আছে। যারা কোনভাবেই ন্যায়পরায়ণ ও সুশাসকের কাতারে পড়ে না। তারা নিজেরাও নিজেদেরকে উত্তম ও ধর্মপ্রাণ মনে করত না; বরং নিজেদের অন্যায় ও অপরাধের কথা অকপটে স্বীকার করত। কিন্তু দেখুন তাদের মাঝেও ধর্মীয় চেতনা এমন পর্যায়ের ছিল যে, তারা তাদের বীর সেনাপতিদের নেতৃত্বে বিশাল বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছে মুসলমানদের একটি বসতি রক্ষার উদ্দেশে কিংবা কিছু ভিনদেশি মুসলিম নারীকে রক্ষার জন্য, দস্যুরা যাদের পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিল। অথচ সে পর্যন্ত পৌঁছানোর পথ নিষ্কণ্টক ছিল না। আল্লাহ তাআলা তাঁদের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং অসহায় মুসলিম ভাই-বোনদের প্রতি সংবেদনশীলতার কারণে এ অভিযানের মাধ্যমে এক অবিস্মরণীয় বিজয়ের দ্বার উন্মোচন করেন। সূচনা হয় নব যুগের।
ঐতিহাসিক ‘বালাজুরী’ তার অমর গ্রন্থ ‘ফুতুহুল বুলদানে’ লিখেন— ভারত সাগরের উপকূলবর্তী দেবল (বর্তমানে করাচী) বন্দর অতিক্রমকালে একটি আরবীয় বাণিজ্যিক জাহাজ -যাতে নারীরাও ছিল- স্থানীয় জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। জলদস্যুরা জাহাজের যাবতীয় মালপত্র ও যাত্রীসহ জাহাজটি ছিনতাই করে। তখন দস্যুদল কর্তৃক আটক নারীদের একজন যিনি ইয়ারবূ গোত্রের ছিলেন, এ বলে আর্তনাদ করেন— হাজ্জাজ তুমি কোথায়? এ খবর শোনামাত্র হাজ্জাজ বিন ইউসুফ লাব্বাইক! আমি আসছি বলে হুংকার দেন। অতঃপর সিন্দুর শাসক রাজা দাহিরের কাছে বন্দী নারীদের মুক্তি দেয়ার জন্য লোক পাঠান। কিন্তু দাহির এ বলে তাদের ফিরিয়ে দেয় যে, তারা
দস্যু কর্তৃক অপহৃত; তাদের উপর আমার ক্ষমতা নেই। তখন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ওবায়দুল্লাহ বিন নাবহানকে সেনাপতি করে দেবলে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু সেনাপতি ওবায়দুল্লাহ যুদ্ধে নিহত হন। তখন বুদাইল বিন তুহফাকে সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। তিনি নিহত হলে হাজ্জাজ নিজ জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসেমকে সেনাপতি করে সিন্দু অভিযানে পাঠান। এটা ছিল খলীফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের যুগে। সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের হাতেই সিন্দু বিজয় হয়।
ইসলামী ইতিহাসে এমন অসংখ্য বিস্ময়কর ও দুঃসাহসিক ঘটনা রয়েছে, যাতে ধর্মীয় মূল্যবোধ উজ্জ্বলভাবে ফুটে ওঠে, যা এ উম্মাহর উপর মহান আল্লাহর বিরাট অনুগ্রহ বৈ কিছু নয়, যার মাধ্যমে উন্নত চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আর এর বিনিময়ে মানব জীবনে আত্মমর্যাদাবোধ ও ইজ্জত-সম্মানের বিকাশ ঘটে।
প্রকৃত পক্ষে শহর রক্ষা করা কিংবা মানুষের অধিকার রক্ষা করা মানে পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে রক্ষা করা। যারা মানুষের সাথে অমানবিক আচরণ করে, তাদের ইজ্জত-সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, বসত ভিটা থেকে তাদেরকে উচ্ছেদ করে এ ধরনের অসভ্য ও বর্বর শায়েস্তা করা তো মানব সভ্যতা রক্ষার স্বার্থেই আবশ্যক হয়ে পড়ে।
ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য স্বজাতির স্বার্থে যাদের মাঝে আত্মমর্যাদা বোধ জাগ্রত হয় না- তারা তো ভীরু, কাপুরুষ।
আরবের লোকেরা সে জাহেলি যুগ থেকেই আত্মমর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে অতিসংবেদনশীল। তাঁরা আত্মমর্যাদাবোধকে মনে করত নৈতিকতার ভিত্তিমূল। আর যারা স্বজাতির কোন কন্যাকে মরুভূমি কিংবা নির্জন ভূমিতে নির্যাতিত হওয়ার সংবাদ শুনেও তাকে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাগাদা অনুভব করে না, তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে বিলম্ব করে তারা অতি নিম্ন প্রকৃতির লোক বলে ধিকৃত হত। এ কলঙ্কের গ্লানি বংশ পরম্পরায় পরবর্তী প্রজন্মকেও বহন করতে হত। তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হত। তাদের এই মূল্যবোধের ভিত্তি ছিল এই হাদীস—
انصر اخاك ظالما اومظلوما
তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর চাই সে জালেম হোক, চাই মাজলুম।
ন্যায় হোক অন্যায় হোক অন্ধ গোত্রপ্রীতি ও সাম্প্রদায়িকতার দাবী হল গোত্রের লোকের পক্ষে দাঁড়াতেই হবে, তাকে সাহায্য করতেই হবে। সুতরাং এ নীতি থেকে যারা বিচ্যুত হবে বা ছাড় দিবে তারা সমাজে ধিকৃত হতে বাধ্য। এমনকি তাকে সমাজচ্যুত করে এক ঘরে করে রাখা হত।
বনী শায়বান গোত্রের কিছু লোক বনী আনবার গোত্রের কুরাইজ বিন উনাইফ নামক এক ব্যক্তির উপর আক্রমণ করে তার ত্রিশটি উট লুট করে নিয়ে যায়; কিন্তু এ বিপদের সময় তার গোত্রের কেউ সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেনি। অথচ জাহেলি যুগে গোত্রের কোন লোক বিপদে পড়লে অন্যরা এগিয়ে আসার চিরায়ত রীতি ছিল। এ ঘটনা সেই গোত্রের কবির হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। তখন সে যে কবিতা আবৃত্তি করে তা পরবর্তীতে সকল মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হতে থাকে। কারণ সে একজন প্রথিতযশা কবি ছিল। তার কবিতার চরণগুলো ছিল নিম্নরূপ—
আমি যদি মাযেন গোত্রের হতাম, তাহলে আমার উটগুলো খোয়া যেত না
বনূ লাকিতাহ জাহল বিন শায়বান এর বংশধর
তাহলে আমার দুর্দশায় কঠোর প্রকৃতির লোকেরা এগিয়ে আসত
যখন বিপদ তাদের গোত্রের আত্মসম্মানের দিকে হাত বাড়ায়।
তারা এমন জাতি, যখন মুসিবত তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলে
তারা দল বেঁধে ও বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিআক্রমণ করে
গোত্রের কেউ সাহায্যের আবেদন করলে
তারা দলিল-প্রমাণের পিছনে সময় নষ্ট করে না
তবে আমার গোত্র, যদিও সংখ্যায় অনেক,
কিন্তু তাদের আত্মসম্মানে আঘাত আসলেও তারা তা গায়ে মাখে না।
বরং তারা অত্যাচারির উপর দয়ালু সাজে-
আর মন্দ লোকের দিকে অনুগ্রহের হাত বাড়ায়।
সৃষ্টিকর্তা তার সাহায্যের জন্য এসব অথর্ব লোকদের ছাড়া
আর কাউকে কি সৃষ্টি করেননি!?
হায় যদি আমার জাতি এমন হত
দল বেঁধে তাদের অত্যাচারের সমুচিত জবাব দিবে।
ইসলাম এসে জাহেলী রীতি-নীতি যেগুলো ঐতিহ্য রূপে পালনীয় হত- সেগুলো রিসালাতের সাথে সমন্বয় করে তাতে ভারসাম্য সৃষ্টি করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমার ভাইয়ের সাহায্য কর- চাই সে জালিম হোক, চাই মাজলুম।’ সাহাবাদের কাছে এ বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে হল। কারণ, নববী তা’লীম-তরবিয়তে এতদিন তারা যা অর্জন করেছে এটা তার সাথে খাপ খায় না। তাই তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাজলুমকে সাহায্য করার বিষয়টি তো বুঝে আসে; কিন্তু জালেমকে সাহায্য করার বিষয়টি তো বুঝে আসছে না? তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইসলামী ব্যাখ্যা দেন এ বলে, জালেমের জুলুমের হাত চেপে ধরবে- যেন সে জুলুম করতে না পারে। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী।
তখন থেকেই মুসলমান জাতি এ আদর্শে উজ্জীবিত, মুসলমান চাই আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, কাছের হোক বা দূরের- মাজলুম হলে তাদের উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেত। আর জালেম হলে তাদের জুলুমের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াত। অত্যাচার-নিপীড়ন যে ধরনেরই হোক, পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক-তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হত। এক্ষেত্রে জালেমের রক্ত চক্ষুকে পরোয়া করত না। তার নিপীড়ণের হাতকে শক্তিশালি করার তো প্রশ্নই আসে না। মোটকথা জালেমের জুলুম মুখবুজে সহ্য করত না। এতে যা হবার হোক। যদি কারো মধ্যে এ মনোভাবের ব্যত্যয় ঘটতো, তাহলে সে গাদ্দার ও বিশ্বাসঘাতক বলে চিহ্নিত হত। তাকে ভীরু-কাপুরুষ বলা হত। অন্যরা তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করত এবং তাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করত। একসময় মুসলিম জাতির ভাগ্যে অমাবশ্যার দুর্যোগ নেমে এল। আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থচিন্তার ভূত তাদের ঘাড়ে চেপে বসল। ক্ষমতা ও রাজত্বের লালসায় তারা বুদ হয়ে পড়ল। ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত হওয়া তো দূরের কথা, সাধারণ মনুষ্যত্ব ও আত্মমর্যাদাবোধেরও অপমৃত্যু ঘটলো। (চলবে)
Comment