আধুনিক বিশ্ব এক ভয়াবহ দ্বন্দ্বের মধ্যে প্রবেশ করেছে—যেখানে যুদ্ধ আর ট্যাংক বা রাইফেল-নির্ভর নয়; বরং তথ্য, অ্যালগরিদম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) ঘূর্ণিপাকে ঘূর্ণায়মান। একসময় যেখানে যুদ্ধ মানে ছিল সম্মুখসমরে মুখোমুখি লড়াই, আজ তা হয়ে দাঁড়িয়েছে "বাটনের এক চাপায় বোমা বর্ষণের আধুনিক রূপ।" এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি যে জাতি নির্যাতনের শিকার—তা হলো মুসলিম উম্মাহ।
বিশেষ করে জায়নবাদী শক্তিগুলো—যাদের ইতিহাস দখল, ষড়যন্ত্র এবং ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোপন ও প্রকাশ্য যুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করে—তারা এখন AI-চালিত অস্ত্র, স্মার্ট ড্রোন ও ফেসিয়াল রিকগনিশন সিস্টেমের মাধ্যমে মুসলিম ভূখণ্ডকে টার্গেট করছে।
এই অস্ত্রগুলো শুধুমাত্র শত্রুকে ‘নির্বাচন’ করে ধ্বংস করে না—বরং পুরো জনপদের ওপর নেমে আসে নজরদারির ঘন ছায়া, সন্দেহের আগুন, ও নিরাপত্তাহীনতার বাতাবরণ। AI এখন শুধু প্রযুক্তি নয়—এটি একটি ‘সাইবার-ফিরআউনী ব্যবস্থা’ হয়ে উঠেছে, যা আল্লাহর বান্দাদের ভয় ও নীরবতায় ঠেলে দিতে চায়।
তাহলে প্রশ্ন আসে—এই চতুর, ভয়ানক এবং ধর্মবিদ্বেষী প্রযুক্তিগত আগ্রাসনের মুখে আমাদের করণীয় কী?
মুসলিম উম্মাহ কি কেবল দর্শক হয়ে থাকবে, না কি আত্মরক্ষার দায়িত্বে ঈমানদার ও প্রস্তুত এক জামাআত গড়ে তুলবে?
প্রথম করণীয়: তাওয়াক্কুল—আত্মরক্ষার প্রথম স্তম্ভ
আমরা যারা বিশ্বাস করি—জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর ইচ্ছায় নির্ধারিত, তাদের জন্য এটি একটি গভীর আত্মবিশ্বাস এবং শক্তির উৎস। আধুনিক প্রযুক্তি, বিশেষত AI এবং ড্রোনের মতো অস্ত্রের অগ্রগতি আমাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন আনলেও, আমাদের বিশ্বাস একটিই থাকে—এটা আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটতে পারে না। যখন আল্লাহর হুকুমে জীবনের পরিসমাপ্তি নির্ধারিত হয়, তখন কোনো AI বা স্মার্ট বোমাও তা থামাতে পারে না। এই বিশ্বাস আমাদের শান্তি এবং নিরাপত্তা দেয়, কারণ আমাদের চিত্ত সবসময় আল্লাহর ওপর থাকে। যেমন আল্লাহ বলেছেন, “কোনো প্রাণেরই মৃত্যু ঘটে না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৪৫) এই আয়াতের মাধ্যমে আমাদের জানানো হয়েছে যে, মৃত্যুর সময় এবং স্থান সব কিছু আল্লাহর হাতে, এবং তার ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটবে না।
এখন, যেহেতু জায়নবাদীরা তাদের আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে ক্ষমতা ও দখল প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে, সেখানে একজন মুমিনের জন্য সত্যিকারের শান্তি এবং সাহস আসে এই বিশ্বাস থেকেই—“হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিআমাল ওকীল।” এই তাওয়াক্কুল আমাদের ভয়মুক্ত রাখে, আমাদের সংকটে সাহসী করে তোলে, এবং প্রতিটি প্রতিকূলতায় আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ের প্রতি বিশ্বাস জাগ্রত রাখে। তবে, এই তাওয়াক্কুল কখনোই অলসতা বা আত্মসমর্পণ নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই আমাদের শিখিয়েছেন যে, আল্লাহর ওপর ভরসা করার পাশাপাশি আমাদের দায়িত্ব ও প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। তিনি বলেছেন, “উটটিকে বেঁধে রাখো, তারপর আল্লাহর উপর ভরসা করো।” এটি আমাদের নির্দেশ দেয় যে, শুধুমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করার মাধ্যমে দায়িত্ব পালনে অলস হওয়া উচিত নয়। আমাদের অবশ্যই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে, যেন আমরা ইসলামের দৃষ্টিতে দায়িত্বশীল থাকি।
তাওয়াক্কুলের মধ্যে রয়েছে একটি ভারসাম্য—এটি মানে শুধুমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করা নয়, বরং পাশাপাশি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি, সংগ্রাম এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়েও অংশগ্রহণ করা। এইভাবে আমরা আল্লাহর ইচ্ছার সাথে আমাদের কর্মকে একত্রিত করি, যা আমাদের ঈমানের শক্তি এবং সাহস বৃদ্ধি করে। আর মনে রাখুন, “আমেরিকার বিমান যত উঁচুতেই উঠুক না কেন, তা সবসময় থাকবে আর-রহমানের আরশের নিচেই।” আল্লাহর কর্তৃত্বের সামনে পৃথিবীর যে কোনো প্রযুক্তি বা শক্তি তুচ্ছ—এটি একজন মুমিনের অন্তরে স্থিতিশীলতা এবং সাহস দেয়। এই সত্যই তাকে প্রতিটি কঠিন পরিস্থিতিতে অটল ও অবিচল রাখে, কেননা সে জানে, আল্লাহই সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন
দ্বিতীয় করণীয়: ইস্তিগফার—রহমতের ঢাল ও আযাব থেকে নিরাপত্তা
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলমানরা, যেমন ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়া, এবং অন্যান্য এলাকার অধিবাসীরা, প্রকৃতপক্ষে এক অত্যন্ত কঠিন এবং সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি। এসব অঞ্চলে যাদের জীবন-যাপন ধ্বংস হয়ে গেছে, যাদের শরীরের ওপর শত্রু বাহিনীর হামলা, বিমান বা ড্রোনের আক্রমণ, যুদ্ধের বিভীষিকা নেমে এসেছে—তাদের জন্য প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে চাওয়া কিংবা অস্ত্রের সামর্থ্য নিয়ে ভাবা অনেকাংশে অপ্রয়োজনীয়। কারণ, আল্লাহর রহমত ছাড়া, কোনো প্রযুক্তি, কোনো বাহিনী, কোনো শক্তিই তাদের রক্ষা করতে পারে না। আল্লাহর রহমতই একমাত্র রক্ষাকারী, যে রক্ষা তাদের পৃথিবী ও আখিরাতের যেকোনো সংকট থেকে মুক্ত করতে পারে।
কুরআনে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টভাবে বলেছেন, "আর আল্লাহ তাদের শাস্তি দেবেন না, যখন তুমি তাদের মাঝে আছো; এবং আল্লাহ তাদের শাস্তি দেন না, যখন তারা ইস্তিগফার করে।" (সূরা আল-আনফাল, ৮:৩৩)। এখানে পরিষ্কারভাবে বলা হচ্ছে, ইস্তিগফার আল্লাহর নিকট এমন এক অস্ত্র, যা শাস্তি এবং বিপদকে প্রতিহত করতে পারে। এটি শুধুমাত্র আল্লাহর রহমত ও সাহায্যকে আহ্বান করে না, বরং এটি ফেরেশতাদের হেফাজতও তৈরি করে, যা কোনো প্রযুক্তি বা বাহিনীর কাছে নেই। যেকোনো বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, শত্রুদের চক্রান্তের মাঝে এই ইস্তিগফার একটি অদৃশ্য সুরক্ষা বলয় তৈরি করে দেয়।
আজকের যুগে, যখন "No-fly zone" এর ধারণা আমাদের কানে বাজে, তখন আমরা ভুলে যাই যে, "Istighfar zone" এর সৃষ্টি অনেক বড় নিরাপত্তার বলয় তৈরি করতে সক্ষম। একটি সত্যিকারের নিরাপত্তা এবং শান্তি কোনো প্রযুক্তির মাধ্যমে নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে, এবং ইস্তিগফার সেই পথের অন্যতম সেতু। যেসব মুসলমান ভাইবোনেরা এমন বিপদের মধ্যে আছেন—তাদের উচিত একে অপরকে সর্বদা প্ররোচিত করা, যে কোনো ক্ষতি বা বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইস্তিগফারে লিপ্ত থাকতে। তাদের রাত-দিন আল্লাহর কাছে ফিরে আসা উচিত, নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে এবং নিজেদের আত্মাকে শুদ্ধ করতে। আল্লাহর সামনে অশ্রুসিক্ত হৃদয়ে, কেবল একটিই কথা বলুন, "রব্বি গ্ফির লি," অর্থাৎ "হে আমার প্রভু, আমাকে ক্ষমা করে দিন।"
এভাবে তারা নিজেকে শুদ্ধ করে, আল্লাহর রহমত ও সহায়তা লাভ করতে পারেন, যা শুধুমাত্র তাদের নিরাপত্তাই বাড়াবে না, বরং তাদের দুশ্চিন্তা এবং ভয়ও দূর করবে। ইস্তিগফারের মাধ্যমে, তারা এক নতুন শক্তির উন্মোচন করবে—এটি হতে পারে এক অদৃশ্য শক্তি, যা প্রযুক্তি ও যুদ্ধের সব ভীতিকর অস্ত্রের সামনে তাদের আল্লাহর সাহায্য ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করবে।
তৃতীয় করণীয়: মাজলুমদের জন্য দো‘আ—ভ্রাতৃত্বের অকাট্য প্রমাণ
যারা আজ AI বোমার পরিধির বাইরে আছেন, অর্থাৎ আমরা যারা তুলনামূলক নিরাপদ ঘরে বসে খবর পড়ছি, ভিডিও দেখছি, কিংবা আলোচনা করছি—আমাদের জন্য সবচেয়ে জরুরি করণীয় হলো মজলুমদের জন্য দো‘আ করা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
"মজলুমের দো‘আ এবং মুমিনের ভাইয়ের জন্য পেছনে করা দো‘আ—এই দুইয়ের মাঝে পর্দা থাকে না।"
(সহীহ মুসলিম)
দো‘আ কেবল নিঃস্বের হাত নয়—এটি এক আত্মিক আগ্রাসন, যা ফেরেশতাদের নাজিল করে, আসমান কাঁপায় এবং যালিমদের মূল নাড়া দিয়ে দেয়।
আমরা যারা এখনও:
বোমার শব্দ শুনি না,
ড্রোনের ছায়া দেখি না,
ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়িনি—
তারা যেন এই নি‘আমতের বদলে নিরবতা নয়, বরং আক্ষেপমিশ্রিত কান্না ও দো‘আর আওয়াজ তুলতে পারি।
আমাদের দো‘আ হবে যেন:
দো‘আ কখনো ছোট কাজ নয়—বরং এটি আসমান-ভেদী এক ক্ষেপণাস্ত্র, যা ঈমানদার অন্তর থেকেই উৎক্ষেপিত হয়।
নোট:
আমরা যারা উম্মাহর প্রতি সামান্যতম দরদ অনুভব করি, আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজেকে মুহাসাবার সময় এই প্রশ্নটি করা:
"আজ আমি আল্লাহর কাছে মাজলুম উম্মাহর জন্য কি একবারও চোখের পানি ফেলে দো‘আ করেছি?"
এমন এক যুগে, যখন AI প্রযুক্তি মুসলমানদের রক্ত ঝরাতে ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন প্রতিটি মুসলমানের জন্য ওয়াজিব করে নেওয়া উচিত—
'প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও, আল্লাহর দরবারে উম্মাহর জন্য কান্না করে দো‘আ করবে।'
এই এক ফোঁটা কান্না হয়তো কোনো শহীদ শিশুর চোখে শান্তি নামিয়ে আনবে, হয়তো কোনো বিধ্বস্ত মায়ের জন্য রহমতের জানালা খুলে দেবে।
চতুর্থ করণীয়: দাওয়াতী উদ্যোগ—প্রযুক্তিবিদদের অন্তর জাগিয়ে তোলা
আমরা মুসলমানরা প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে পিছিয়ে—এটি বাস্তবতা। কিন্তু প্রশ্ন হলো: এই পিছিয়ে থাকা নিয়ে কতটা চিন্তিত আমরা?
আর আমাদের আশপাশে যারা আজও প্রযুক্তির জগতে কাজ করছেন—AI, সফটওয়্যার, সাইবার নিরাপত্তা, ডেটা অ্যানালিটিক্স ইত্যাদিতে—তাদের মাঝে কি কেউ আছে, যাদের আমরা দাওয়াত দিয়ে প্রযুক্তিকে আল্লাহর দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করেছি?
এই দাওয়াহ কোনো বক্তৃতা নয়—এটি অন্তর্জগতের জাগরণ।
তাদেরকে বলার সময় এসেছে:
আমরা জানি, আমরা অনেক পিছিয়ে।
তবুও, যদি আমরা এক বিঘত এগিয়ে আসি, তবে আল্লাহ এক হাত এগিয়ে আসবেন।
এই দাওয়াহ, এই আহ্বান যদি একেকজন প্রযুক্তিবিদের অন্তরে জায়গা করে নেয়—তবে গড়ে উঠতে পারে এক মুত্তাকী প্রযুক্তিবিদ সমাজ, যারা শুধুমাত্র কোড লেখে না, বরং কিবলার দিকে মুখ রেখে প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ আঁকে।
এই দাওয়াহ হবে আমাদের জিহাদের এক নীরব কিন্তু বিস্ফোরক প্রস্তুতি।
চলুন, এই দায়িত্ব কাঁধে নিই—তাদের কাছে যাই, বুঝাই, প্রশ্ন করি, অনুপ্রাণিত করি।
পঞ্চম করণীয়: অর্থ সংগ্রহ—মাজলুমদের সাহায্য ও প্রযুক্তি উন্নয়নে ব্যয় করা
বর্তমান বিশ্বে মাজলুম উম্মাহ কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন—ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়া, মিয়ানমার ইত্যাদি অঞ্চলের মুসলমানরা শত্রুর হাতে অত্যাচারিত। তাদের জন্য ত্রাণ ও সহায়তা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কার্য। তবে, এই কাজটি একমাত্র দো‘আ বা সহানুভূতির মাধ্যমে সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে আমাদের আর্থিক শক্তির প্রয়োজন, যা একদিকে মাজলুমদের সহায়তা করবে, অন্যদিকে প্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যবহৃত হবে—যাতে আমরা ভবিষ্যতে স্বনির্ভর হতে পারি এবং শত্রুর আধিপত্য থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হই।
অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্য:
1. মাজলুমদের সাহায্য: সংগ্রহ করা অর্থ ব্যবহার হবে মানবিক সহায়তার জন্য—খাবার, চিকিৎসা সেবা, আশ্রয়, ত্রাণ এবং অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য।
2. প্রযুক্তি উন্নয়ন: ঐ অর্থের একটি অংশ মুসলিম উম্মাহর প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত হবে। এর মাধ্যমে, আমরা মুসলিম বিজ্ঞানী, গবেষক এবং প্রযুক্তিবিদদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারব, যারা ভবিষ্যতে উম্মাহর প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।
ষষ্ঠ করণীয়: পরিখা খনন—নবীর সুন্নাহ, গেরিলা যুদ্ধ কৌশল এবং আধুনিক প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি
পরিখা খনন কেবল একটি শারীরিক প্রতিরক্ষা কৌশল ছিল না, বরং এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ এবং ইসলামের ইতিহাসের একটি অমূল্য শিক্ষা। খন্দক যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনা শহরের চারপাশে পরিখা খনন করেছিলেন, তখন এটি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সিদ্ধান্ত, যা মুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। যখন মক্কার কুরাইশ এবং তাদের সহযোগী শত্রুরা মদীনা আক্রমণ করতে এসেছিল, তখন মুসলিমরা সঠিক সময়ে একটি কৌশলগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শত্রুদের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের নির্দেশ দেন শহরের চারপাশে পরিখা খনন করতে, যাতে শত্রু বাহিনী মদীনা শহরে প্রবেশ করতে না পারে। এটি ছিল একটি অত্যন্ত বিচক্ষণ কৌশল, কারণ শত্রু বাহিনীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি এবং শত্রুদের আধিপত্য ঠেকানোর জন্য একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দরকার ছিল। পরিখা খনন শত্রু বাহিনীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল, যা তাদের আক্রমণকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করেছিল। এর ফলে মুসলিমরা নিজেদের নিরাপদ রাখতে সক্ষম হয় এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য ও ঈমানের শক্তিতে এই যুদ্ধ থেকে বিজয়ী হয়।
আজকের আধুনিক যুগে, বিশেষত গেরিলা যুদ্ধ কৌশল এবং ফিলিস্তিনের মুজাহিদদের মতো সংগ্রামীদের কাছে পরিখা খনন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তারা আজও নিজেদের শহর ও অঞ্চলের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পরিখা এবং টানেল খনন করছে, যাতে শত্রু বাহিনী তাদের আক্রমণ করতে না পারে। ফিলিস্তিনের মুজাহিদরা তাদের প্রতিরক্ষা কৌশল হিসেবে এই পরিখা খননকে ব্যবহার করে শত্রু বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করছে। এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ গেরিলা যুদ্ধ কৌশল, যেখানে শত্রুর বাহিনীকে বিভ্রান্ত করা হয় এবং তাদের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করা হয়। ফিলিস্তিনি মুজাহিদরা তাদের টানেল এবং পরিখা ব্যবহার করে নিরাপদে চলাচল করে, শত্রুর ওপর আক্রমণ করে এবং আবার লুকিয়ে যায়। এটি একটি অত্যন্ত দক্ষ এবং সৃজনশীল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা শত্রুদের জন্য মনের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করে এবং তাদের পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দেয়।
গেরিলা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পরিখা খনন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কৌশলটি মূলত শত্রু বাহিনীকে অভ্যন্তরীণভাবে অক্ষম করে দেয় এবং তাদের কার্যকলাপকে আটকে রাখে। গেরিলা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো শত্রুকে এমনভাবে মোকাবেলা করা, যাতে তার শক্তি এবং পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। পরিখা খনন এই যুদ্ধের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে, কারণ এটি শত্রুর বাহিনীকে বিভ্রান্ত করে এবং তাদের জন্য নিজেদের অবস্থান জানার কাজটি কঠিন করে তোলে। এর ফলে শত্রু বাহিনী চাপে পড়ে এবং তাদের আক্রমণ সফল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। এই ধরনের কৌশল শত্রুদের ওপর শৃঙ্খলা ও মানসিক চাপে প্রভাব ফেলতে সাহায্য করে, যা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে।
অতএব, পরিখা খনন কেবল একটি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি কৌশলগত প্রক্রিয়া, যা শত্রু বাহিনীকে বিভ্রান্ত করে এবং তাদের পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দেয়। এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ থেকে আমাদের শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এবং আধুনিক সময়ের গেরিলা যুদ্ধ কৌশলে তার প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি শক্তিশালী এবং কার্যকরী কৌশল, যা আমাদের প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে পারে।
এই লেখার মাধ্যমে আমরা মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু করণীয় আলোচনা করেছি, যা আজকের বিশ্বে আমাদের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য অপরিহার্য। প্রথমত, আমাদের বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে, কারণ আমাদের জন্ম ও মৃত্যু তাঁর হাতে। পরবর্তীতে, মুসলিম উম্মাহর জন্য ইস্তেগফার ও দো'আ একটি অপরিহার্য কর্ম, যাতে আল্লাহ আমাদের সাহায্য ও সহায়তা প্রদান করেন। আমরা যারা শত্রুদের প্রকৌশল ও যুদ্ধের সামনে আছি, আমাদের অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে দো'আ করতে হবে এবং যারা আমাদের চেয়ে নিরাপদ অবস্থানে আছেন, তাদের জন্যও দো'আ করা একান্ত প্রয়োজন।
এছাড়া, আমাদের উম্মাহর মধ্যে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে, যাতে আমরা আধুনিক যুদ্ধের কৌশল ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে পারি। পরিখা খননের মতো আদিম কৌশল গ্রহণ করার পাশাপাশি, বর্তমান প্রযুক্তি ও গেরিলা যুদ্ধ কৌশলগুলোকে সমৃদ্ধ করতে হবে। এগুলি শুধুমাত্র আমাদের প্রতিরক্ষা শক্তি বৃদ্ধি করবে না, বরং একটি সামগ্রিকভাবে শক্তিশালী উম্মাহ হিসেবে আমাদের পরিচিতি আরও দৃঢ় করবে।
অবশেষে, আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, বিশ্বজুড়ে যে ظلم ও নির্যাতন চলছে, তাতে আমাদের দায়িত্ব বাড়ে। আমাদের ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, প্রতিটি মুসলিমের উচিত মাজলুমদের জন্য প্রার্থনা করা এবং তাদের সাহায্যার্থে কাজ করা। মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী একে অপরকে সহায়তা করতে হবে, যাতে আমরা সঠিক পথে চলতে পারি এবং আল্লাহর সাহায্য লাভ করতে পারি।
বিশেষ করে জায়নবাদী শক্তিগুলো—যাদের ইতিহাস দখল, ষড়যন্ত্র এবং ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোপন ও প্রকাশ্য যুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করে—তারা এখন AI-চালিত অস্ত্র, স্মার্ট ড্রোন ও ফেসিয়াল রিকগনিশন সিস্টেমের মাধ্যমে মুসলিম ভূখণ্ডকে টার্গেট করছে।
এই অস্ত্রগুলো শুধুমাত্র শত্রুকে ‘নির্বাচন’ করে ধ্বংস করে না—বরং পুরো জনপদের ওপর নেমে আসে নজরদারির ঘন ছায়া, সন্দেহের আগুন, ও নিরাপত্তাহীনতার বাতাবরণ। AI এখন শুধু প্রযুক্তি নয়—এটি একটি ‘সাইবার-ফিরআউনী ব্যবস্থা’ হয়ে উঠেছে, যা আল্লাহর বান্দাদের ভয় ও নীরবতায় ঠেলে দিতে চায়।
তাহলে প্রশ্ন আসে—এই চতুর, ভয়ানক এবং ধর্মবিদ্বেষী প্রযুক্তিগত আগ্রাসনের মুখে আমাদের করণীয় কী?
মুসলিম উম্মাহ কি কেবল দর্শক হয়ে থাকবে, না কি আত্মরক্ষার দায়িত্বে ঈমানদার ও প্রস্তুত এক জামাআত গড়ে তুলবে?
প্রথম করণীয়: তাওয়াক্কুল—আত্মরক্ষার প্রথম স্তম্ভ
আমরা যারা বিশ্বাস করি—জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর ইচ্ছায় নির্ধারিত, তাদের জন্য এটি একটি গভীর আত্মবিশ্বাস এবং শক্তির উৎস। আধুনিক প্রযুক্তি, বিশেষত AI এবং ড্রোনের মতো অস্ত্রের অগ্রগতি আমাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন আনলেও, আমাদের বিশ্বাস একটিই থাকে—এটা আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটতে পারে না। যখন আল্লাহর হুকুমে জীবনের পরিসমাপ্তি নির্ধারিত হয়, তখন কোনো AI বা স্মার্ট বোমাও তা থামাতে পারে না। এই বিশ্বাস আমাদের শান্তি এবং নিরাপত্তা দেয়, কারণ আমাদের চিত্ত সবসময় আল্লাহর ওপর থাকে। যেমন আল্লাহ বলেছেন, “কোনো প্রাণেরই মৃত্যু ঘটে না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৪৫) এই আয়াতের মাধ্যমে আমাদের জানানো হয়েছে যে, মৃত্যুর সময় এবং স্থান সব কিছু আল্লাহর হাতে, এবং তার ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটবে না।
এখন, যেহেতু জায়নবাদীরা তাদের আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে ক্ষমতা ও দখল প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে, সেখানে একজন মুমিনের জন্য সত্যিকারের শান্তি এবং সাহস আসে এই বিশ্বাস থেকেই—“হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিআমাল ওকীল।” এই তাওয়াক্কুল আমাদের ভয়মুক্ত রাখে, আমাদের সংকটে সাহসী করে তোলে, এবং প্রতিটি প্রতিকূলতায় আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ের প্রতি বিশ্বাস জাগ্রত রাখে। তবে, এই তাওয়াক্কুল কখনোই অলসতা বা আত্মসমর্পণ নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই আমাদের শিখিয়েছেন যে, আল্লাহর ওপর ভরসা করার পাশাপাশি আমাদের দায়িত্ব ও প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। তিনি বলেছেন, “উটটিকে বেঁধে রাখো, তারপর আল্লাহর উপর ভরসা করো।” এটি আমাদের নির্দেশ দেয় যে, শুধুমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করার মাধ্যমে দায়িত্ব পালনে অলস হওয়া উচিত নয়। আমাদের অবশ্যই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে, যেন আমরা ইসলামের দৃষ্টিতে দায়িত্বশীল থাকি।
তাওয়াক্কুলের মধ্যে রয়েছে একটি ভারসাম্য—এটি মানে শুধুমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করা নয়, বরং পাশাপাশি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি, সংগ্রাম এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়েও অংশগ্রহণ করা। এইভাবে আমরা আল্লাহর ইচ্ছার সাথে আমাদের কর্মকে একত্রিত করি, যা আমাদের ঈমানের শক্তি এবং সাহস বৃদ্ধি করে। আর মনে রাখুন, “আমেরিকার বিমান যত উঁচুতেই উঠুক না কেন, তা সবসময় থাকবে আর-রহমানের আরশের নিচেই।” আল্লাহর কর্তৃত্বের সামনে পৃথিবীর যে কোনো প্রযুক্তি বা শক্তি তুচ্ছ—এটি একজন মুমিনের অন্তরে স্থিতিশীলতা এবং সাহস দেয়। এই সত্যই তাকে প্রতিটি কঠিন পরিস্থিতিতে অটল ও অবিচল রাখে, কেননা সে জানে, আল্লাহই সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন
দ্বিতীয় করণীয়: ইস্তিগফার—রহমতের ঢাল ও আযাব থেকে নিরাপত্তা
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলমানরা, যেমন ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়া, এবং অন্যান্য এলাকার অধিবাসীরা, প্রকৃতপক্ষে এক অত্যন্ত কঠিন এবং সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি। এসব অঞ্চলে যাদের জীবন-যাপন ধ্বংস হয়ে গেছে, যাদের শরীরের ওপর শত্রু বাহিনীর হামলা, বিমান বা ড্রোনের আক্রমণ, যুদ্ধের বিভীষিকা নেমে এসেছে—তাদের জন্য প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে চাওয়া কিংবা অস্ত্রের সামর্থ্য নিয়ে ভাবা অনেকাংশে অপ্রয়োজনীয়। কারণ, আল্লাহর রহমত ছাড়া, কোনো প্রযুক্তি, কোনো বাহিনী, কোনো শক্তিই তাদের রক্ষা করতে পারে না। আল্লাহর রহমতই একমাত্র রক্ষাকারী, যে রক্ষা তাদের পৃথিবী ও আখিরাতের যেকোনো সংকট থেকে মুক্ত করতে পারে।
কুরআনে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টভাবে বলেছেন, "আর আল্লাহ তাদের শাস্তি দেবেন না, যখন তুমি তাদের মাঝে আছো; এবং আল্লাহ তাদের শাস্তি দেন না, যখন তারা ইস্তিগফার করে।" (সূরা আল-আনফাল, ৮:৩৩)। এখানে পরিষ্কারভাবে বলা হচ্ছে, ইস্তিগফার আল্লাহর নিকট এমন এক অস্ত্র, যা শাস্তি এবং বিপদকে প্রতিহত করতে পারে। এটি শুধুমাত্র আল্লাহর রহমত ও সাহায্যকে আহ্বান করে না, বরং এটি ফেরেশতাদের হেফাজতও তৈরি করে, যা কোনো প্রযুক্তি বা বাহিনীর কাছে নেই। যেকোনো বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, শত্রুদের চক্রান্তের মাঝে এই ইস্তিগফার একটি অদৃশ্য সুরক্ষা বলয় তৈরি করে দেয়।
আজকের যুগে, যখন "No-fly zone" এর ধারণা আমাদের কানে বাজে, তখন আমরা ভুলে যাই যে, "Istighfar zone" এর সৃষ্টি অনেক বড় নিরাপত্তার বলয় তৈরি করতে সক্ষম। একটি সত্যিকারের নিরাপত্তা এবং শান্তি কোনো প্রযুক্তির মাধ্যমে নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে, এবং ইস্তিগফার সেই পথের অন্যতম সেতু। যেসব মুসলমান ভাইবোনেরা এমন বিপদের মধ্যে আছেন—তাদের উচিত একে অপরকে সর্বদা প্ররোচিত করা, যে কোনো ক্ষতি বা বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইস্তিগফারে লিপ্ত থাকতে। তাদের রাত-দিন আল্লাহর কাছে ফিরে আসা উচিত, নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে এবং নিজেদের আত্মাকে শুদ্ধ করতে। আল্লাহর সামনে অশ্রুসিক্ত হৃদয়ে, কেবল একটিই কথা বলুন, "রব্বি গ্ফির লি," অর্থাৎ "হে আমার প্রভু, আমাকে ক্ষমা করে দিন।"
এভাবে তারা নিজেকে শুদ্ধ করে, আল্লাহর রহমত ও সহায়তা লাভ করতে পারেন, যা শুধুমাত্র তাদের নিরাপত্তাই বাড়াবে না, বরং তাদের দুশ্চিন্তা এবং ভয়ও দূর করবে। ইস্তিগফারের মাধ্যমে, তারা এক নতুন শক্তির উন্মোচন করবে—এটি হতে পারে এক অদৃশ্য শক্তি, যা প্রযুক্তি ও যুদ্ধের সব ভীতিকর অস্ত্রের সামনে তাদের আল্লাহর সাহায্য ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করবে।
তৃতীয় করণীয়: মাজলুমদের জন্য দো‘আ—ভ্রাতৃত্বের অকাট্য প্রমাণ
যারা আজ AI বোমার পরিধির বাইরে আছেন, অর্থাৎ আমরা যারা তুলনামূলক নিরাপদ ঘরে বসে খবর পড়ছি, ভিডিও দেখছি, কিংবা আলোচনা করছি—আমাদের জন্য সবচেয়ে জরুরি করণীয় হলো মজলুমদের জন্য দো‘আ করা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
"মজলুমের দো‘আ এবং মুমিনের ভাইয়ের জন্য পেছনে করা দো‘আ—এই দুইয়ের মাঝে পর্দা থাকে না।"
(সহীহ মুসলিম)
দো‘আ কেবল নিঃস্বের হাত নয়—এটি এক আত্মিক আগ্রাসন, যা ফেরেশতাদের নাজিল করে, আসমান কাঁপায় এবং যালিমদের মূল নাড়া দিয়ে দেয়।
আমরা যারা এখনও:
বোমার শব্দ শুনি না,
ড্রোনের ছায়া দেখি না,
ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়িনি—
তারা যেন এই নি‘আমতের বদলে নিরবতা নয়, বরং আক্ষেপমিশ্রিত কান্না ও দো‘আর আওয়াজ তুলতে পারি।
আমাদের দো‘আ হবে যেন:
- আল্লাহ মজলুমদের ধৈর্য ও বিজয় দান করেন,
- শত্রুদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেন,
- এবং উম্মাহর মধ্যে একতা, হিকমাহ ও আত্মশক্তির জাগরণ হয়।
দো‘আ কখনো ছোট কাজ নয়—বরং এটি আসমান-ভেদী এক ক্ষেপণাস্ত্র, যা ঈমানদার অন্তর থেকেই উৎক্ষেপিত হয়।
নোট:
আমরা যারা উম্মাহর প্রতি সামান্যতম দরদ অনুভব করি, আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজেকে মুহাসাবার সময় এই প্রশ্নটি করা:
"আজ আমি আল্লাহর কাছে মাজলুম উম্মাহর জন্য কি একবারও চোখের পানি ফেলে দো‘আ করেছি?"
এমন এক যুগে, যখন AI প্রযুক্তি মুসলমানদের রক্ত ঝরাতে ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন প্রতিটি মুসলমানের জন্য ওয়াজিব করে নেওয়া উচিত—
'প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও, আল্লাহর দরবারে উম্মাহর জন্য কান্না করে দো‘আ করবে।'
এই এক ফোঁটা কান্না হয়তো কোনো শহীদ শিশুর চোখে শান্তি নামিয়ে আনবে, হয়তো কোনো বিধ্বস্ত মায়ের জন্য রহমতের জানালা খুলে দেবে।
চতুর্থ করণীয়: দাওয়াতী উদ্যোগ—প্রযুক্তিবিদদের অন্তর জাগিয়ে তোলা
আমরা মুসলমানরা প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে পিছিয়ে—এটি বাস্তবতা। কিন্তু প্রশ্ন হলো: এই পিছিয়ে থাকা নিয়ে কতটা চিন্তিত আমরা?
আর আমাদের আশপাশে যারা আজও প্রযুক্তির জগতে কাজ করছেন—AI, সফটওয়্যার, সাইবার নিরাপত্তা, ডেটা অ্যানালিটিক্স ইত্যাদিতে—তাদের মাঝে কি কেউ আছে, যাদের আমরা দাওয়াত দিয়ে প্রযুক্তিকে আল্লাহর দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করেছি?
এই দাওয়াহ কোনো বক্তৃতা নয়—এটি অন্তর্জগতের জাগরণ।
তাদেরকে বলার সময় এসেছে:
- [*=1]"তোমার কোডিং যদি উম্মাহ রক্ষায় কাজে না আসে, তবে সেই জ্ঞান কিসের?" [*=1]"তোমার তৈরি সফটওয়্যার কি কেবল পুঁজিবাদের সেবা করবে, না কি মজলুম মুসলিম ভাইয়ের নিরাপত্তাও রক্ষা করবে?"
আমরা জানি, আমরা অনেক পিছিয়ে।
তবুও, যদি আমরা এক বিঘত এগিয়ে আসি, তবে আল্লাহ এক হাত এগিয়ে আসবেন।
এই দাওয়াহ, এই আহ্বান যদি একেকজন প্রযুক্তিবিদের অন্তরে জায়গা করে নেয়—তবে গড়ে উঠতে পারে এক মুত্তাকী প্রযুক্তিবিদ সমাজ, যারা শুধুমাত্র কোড লেখে না, বরং কিবলার দিকে মুখ রেখে প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ আঁকে।
এই দাওয়াহ হবে আমাদের জিহাদের এক নীরব কিন্তু বিস্ফোরক প্রস্তুতি।
চলুন, এই দায়িত্ব কাঁধে নিই—তাদের কাছে যাই, বুঝাই, প্রশ্ন করি, অনুপ্রাণিত করি।
পঞ্চম করণীয়: অর্থ সংগ্রহ—মাজলুমদের সাহায্য ও প্রযুক্তি উন্নয়নে ব্যয় করা
বর্তমান বিশ্বে মাজলুম উম্মাহ কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন—ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়া, মিয়ানমার ইত্যাদি অঞ্চলের মুসলমানরা শত্রুর হাতে অত্যাচারিত। তাদের জন্য ত্রাণ ও সহায়তা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কার্য। তবে, এই কাজটি একমাত্র দো‘আ বা সহানুভূতির মাধ্যমে সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে আমাদের আর্থিক শক্তির প্রয়োজন, যা একদিকে মাজলুমদের সহায়তা করবে, অন্যদিকে প্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যবহৃত হবে—যাতে আমরা ভবিষ্যতে স্বনির্ভর হতে পারি এবং শত্রুর আধিপত্য থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হই।
অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্য:
1. মাজলুমদের সাহায্য: সংগ্রহ করা অর্থ ব্যবহার হবে মানবিক সহায়তার জন্য—খাবার, চিকিৎসা সেবা, আশ্রয়, ত্রাণ এবং অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য।
2. প্রযুক্তি উন্নয়ন: ঐ অর্থের একটি অংশ মুসলিম উম্মাহর প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত হবে। এর মাধ্যমে, আমরা মুসলিম বিজ্ঞানী, গবেষক এবং প্রযুক্তিবিদদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারব, যারা ভবিষ্যতে উম্মাহর প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।
ষষ্ঠ করণীয়: পরিখা খনন—নবীর সুন্নাহ, গেরিলা যুদ্ধ কৌশল এবং আধুনিক প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি
পরিখা খনন কেবল একটি শারীরিক প্রতিরক্ষা কৌশল ছিল না, বরং এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ এবং ইসলামের ইতিহাসের একটি অমূল্য শিক্ষা। খন্দক যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনা শহরের চারপাশে পরিখা খনন করেছিলেন, তখন এটি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সিদ্ধান্ত, যা মুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। যখন মক্কার কুরাইশ এবং তাদের সহযোগী শত্রুরা মদীনা আক্রমণ করতে এসেছিল, তখন মুসলিমরা সঠিক সময়ে একটি কৌশলগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শত্রুদের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের নির্দেশ দেন শহরের চারপাশে পরিখা খনন করতে, যাতে শত্রু বাহিনী মদীনা শহরে প্রবেশ করতে না পারে। এটি ছিল একটি অত্যন্ত বিচক্ষণ কৌশল, কারণ শত্রু বাহিনীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি এবং শত্রুদের আধিপত্য ঠেকানোর জন্য একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দরকার ছিল। পরিখা খনন শত্রু বাহিনীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল, যা তাদের আক্রমণকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করেছিল। এর ফলে মুসলিমরা নিজেদের নিরাপদ রাখতে সক্ষম হয় এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য ও ঈমানের শক্তিতে এই যুদ্ধ থেকে বিজয়ী হয়।
আজকের আধুনিক যুগে, বিশেষত গেরিলা যুদ্ধ কৌশল এবং ফিলিস্তিনের মুজাহিদদের মতো সংগ্রামীদের কাছে পরিখা খনন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তারা আজও নিজেদের শহর ও অঞ্চলের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পরিখা এবং টানেল খনন করছে, যাতে শত্রু বাহিনী তাদের আক্রমণ করতে না পারে। ফিলিস্তিনের মুজাহিদরা তাদের প্রতিরক্ষা কৌশল হিসেবে এই পরিখা খননকে ব্যবহার করে শত্রু বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করছে। এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ গেরিলা যুদ্ধ কৌশল, যেখানে শত্রুর বাহিনীকে বিভ্রান্ত করা হয় এবং তাদের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করা হয়। ফিলিস্তিনি মুজাহিদরা তাদের টানেল এবং পরিখা ব্যবহার করে নিরাপদে চলাচল করে, শত্রুর ওপর আক্রমণ করে এবং আবার লুকিয়ে যায়। এটি একটি অত্যন্ত দক্ষ এবং সৃজনশীল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা শত্রুদের জন্য মনের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করে এবং তাদের পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দেয়।
গেরিলা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পরিখা খনন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কৌশলটি মূলত শত্রু বাহিনীকে অভ্যন্তরীণভাবে অক্ষম করে দেয় এবং তাদের কার্যকলাপকে আটকে রাখে। গেরিলা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো শত্রুকে এমনভাবে মোকাবেলা করা, যাতে তার শক্তি এবং পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। পরিখা খনন এই যুদ্ধের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে, কারণ এটি শত্রুর বাহিনীকে বিভ্রান্ত করে এবং তাদের জন্য নিজেদের অবস্থান জানার কাজটি কঠিন করে তোলে। এর ফলে শত্রু বাহিনী চাপে পড়ে এবং তাদের আক্রমণ সফল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। এই ধরনের কৌশল শত্রুদের ওপর শৃঙ্খলা ও মানসিক চাপে প্রভাব ফেলতে সাহায্য করে, যা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে।
অতএব, পরিখা খনন কেবল একটি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি কৌশলগত প্রক্রিয়া, যা শত্রু বাহিনীকে বিভ্রান্ত করে এবং তাদের পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দেয়। এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ থেকে আমাদের শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এবং আধুনিক সময়ের গেরিলা যুদ্ধ কৌশলে তার প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি শক্তিশালী এবং কার্যকরী কৌশল, যা আমাদের প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে পারে।
এই লেখার মাধ্যমে আমরা মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু করণীয় আলোচনা করেছি, যা আজকের বিশ্বে আমাদের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য অপরিহার্য। প্রথমত, আমাদের বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে, কারণ আমাদের জন্ম ও মৃত্যু তাঁর হাতে। পরবর্তীতে, মুসলিম উম্মাহর জন্য ইস্তেগফার ও দো'আ একটি অপরিহার্য কর্ম, যাতে আল্লাহ আমাদের সাহায্য ও সহায়তা প্রদান করেন। আমরা যারা শত্রুদের প্রকৌশল ও যুদ্ধের সামনে আছি, আমাদের অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে দো'আ করতে হবে এবং যারা আমাদের চেয়ে নিরাপদ অবস্থানে আছেন, তাদের জন্যও দো'আ করা একান্ত প্রয়োজন।
এছাড়া, আমাদের উম্মাহর মধ্যে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে, যাতে আমরা আধুনিক যুদ্ধের কৌশল ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে পারি। পরিখা খননের মতো আদিম কৌশল গ্রহণ করার পাশাপাশি, বর্তমান প্রযুক্তি ও গেরিলা যুদ্ধ কৌশলগুলোকে সমৃদ্ধ করতে হবে। এগুলি শুধুমাত্র আমাদের প্রতিরক্ষা শক্তি বৃদ্ধি করবে না, বরং একটি সামগ্রিকভাবে শক্তিশালী উম্মাহ হিসেবে আমাদের পরিচিতি আরও দৃঢ় করবে।
অবশেষে, আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, বিশ্বজুড়ে যে ظلم ও নির্যাতন চলছে, তাতে আমাদের দায়িত্ব বাড়ে। আমাদের ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, প্রতিটি মুসলিমের উচিত মাজলুমদের জন্য প্রার্থনা করা এবং তাদের সাহায্যার্থে কাজ করা। মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী একে অপরকে সহায়তা করতে হবে, যাতে আমরা সঠিক পথে চলতে পারি এবং আল্লাহর সাহায্য লাভ করতে পারি।
Comment