আন নাসর মিডিয়া পরিবেশিত
“ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
একবিংশ শতাব্দীর গণতন্ত্র’’
(সূরা আসরের আলোকে)
।।মাওলানা আসেম উমর হাফিজাহুল্লাহ ||
এর থেকে– ৩য় পর্ব
“ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
একবিংশ শতাব্দীর গণতন্ত্র’’
(সূরা আসরের আলোকে)
।।মাওলানা আসেম উমর হাফিজাহুল্লাহ ||
এর থেকে– ৩য় পর্ব
ঈমান কী?
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা হলো: যে ব্যক্তি কালিমায়ে তাওহীদকে তার সমস্ত শর্তসহ পড়ে এবং এরপর এমন কোনো কথা-কাজে জড়িত হয়নি, যা সেই কালিমা থেকে বের করে দেয়, সে মুসলমান এবং সে নিশ্চয় কোনো একদিন জান্নাতে প্রবেশ করবে। যেমনটি বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
عَنْ أَنَسٍ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: يَخْرُجُ مِنْ النَّارِ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَكَانَ فِي قَلْبِهِ مِنْ الْخَيْرِ مَا يَزِنُ شَعِيرَةً ثُمَّ يَخْرُجُ مِنْ النَّارِ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَكَانَ فِي قَلْبِهِ مِنْ الْخَيْرِ مَا يَزِنُ بُرَّةً ثُمَّ يَخْرُجُ مِنْ النَّارِ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَكَانَ فِي قَلْبِهِ مَا يَزِنُ مِنْ الْخَيْرِ ذَرَّةً.
হযরত আনাস ইবনে মালেক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়েছে, অথচ তার হৃদয়ে একটি যবের ওজন পরিমাণ কল্যাণ (ঈমান) আছে, তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। তারপর বের করা হবে জাহান্নাম থেকে তাদেরকেও, যারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়েছে এবং তার হৃদয়ে একটি গমের ওজন পরিমাণ কল্যাণ (ঈমান) আছে। (সর্বশেষে) জাহান্নাম থেকে তাকে বের করা হবে, যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়েছে এবং তার হৃদয়ে অনু পরিমাণ মাত্র কল্যাণ (ঈমান) আছে।”(সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ৬৯০৬ ই,ফা,)
মুসলমানের কাছে ঈমানের দাবি
কিন্তু সাথে সাথে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এ কথায়ও একমত যে, কালিমা তখনই উপকার দেবে, যখন তার শর্তাবলিসহ পড়া হবে এবং এরপর তার দাবিসমূহ পূর্ণ করা হবে। তাই এমন কিছু শর্ত তাতে আছে, যা পূর্ণ করা ব্যতীত মুখে কালিমা পড়া সত্ত্বেও মানুষ কাফের হয়ে যায়। তেমনি এমন কিছু বিষয় আছে, যা বলা বা করার কারণে মানুষ কালিমা পড়া সত্ত্বেও ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায়।
وَمَن يَرْتَدِدْ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَٰئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ﴿البقرة: ٢١٧﴾
“তোমাদের মধ্যে যারা নিজের দ্বীন থেকে ফিরে দাঁড়াবে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের যাবতীয় আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। আর তারাই হলো দোযখবাসী। তাতে তারা চিরকাল বাস করবে।”(সূরা বাকারাহ : ২১৭)
আল্লাহর কুরআন কত এমন লোকের ব্যর্থতা ও বিফলতার কথা ঘোষণা করছে, যারা মুখে কালিমা পড়ার দাবিদার। মুনাফিকদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন- তারা জাহান্নামের নিচের স্তরে থাকবে। যদি শুধু মুখে কালিমা পড়া পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট হতো, তাহলে মুনাফিকদেরকে কাফেরদের চেয়ে কঠিন আযাব কেন দেওয়া হবে? বুঝা গেল, কিছু শর্তের ভিত্তিতে মুখে কালিমা পড়া আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য।
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের অবস্থা বর্ণনা করে ইরশাদ করেছেন-
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَا هُم بِمُؤْمِنِينَ ﴿البقرة: ٨﴾
“আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি অথচ আদৌ তারা ঈমানদার নয়।”(সূরা বাকারাহ : ৮)
إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللَّهِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُ وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَكَاذِبُونَ ﴿المنافقون: ١﴾
“মুনাফিকরা আপনার কাছে এসে বলেঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রসূল। আল্লাহ জানেন যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।”(সূরা মুনাফিকুন : ০১)
মুনাফিকদের এ স্তরটি কাফেরদের চেয়েও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। এদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَن تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا ﴿النساء: ١٤٥﴾
“নিঃসন্দেহে মুনাফেকরা রয়েছে দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে। আর তোমরা তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী কখনও পাবে না।”(সূরা নিসা : ১৪৫)
তেমনি যে ব্যক্তি এ কালিমা পাঠ করার পর এমন কাজ করে বসে, যা ইসলাম থেকে বের করে দেয়, আর সেই অবস্থায় যদি সে মারা যায়; তাহলে সেই ব্যক্তিও কঠিন ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারবে না। বুঝা গেল, যে ব্যক্তি মুখে কালিমা পাঠ করা সত্ত্বেও এমন কাজ করে, যা তাকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়; তাহলে সেই কালিমা তার কোনো উপকারে আসবে না। চাই সে মুসলমানের মতো নাম রাখুক, সালাত পড়ুক, হজ্ব করুক না কেন!
ঈমান সহীহ হওয়ার শর্তাবলির দিকে ইঙ্গিত করে আল্লামা শামী রহ. রদ্দুল মুহতারে বলেন, “সেই ব্যক্তির কাফের হওয়াতে কোনো সন্দেহ নেই, যে ব্যক্তি ইসলামের আবশ্যকীয় বিষয়ের বিরোধিতা করে; যদিও সে কেবলা মানুক এবং পুরো জীবন ইবাদত করুক।”
আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ. ইকফারুল মুলহিদীন গ্রন্থে বলেন, রাসূল ﷺ এর এ হাদীস-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ صَلَّى صَلَاتَنَا وَاسْتَقْبَلَ قِبْلَتَنَا وَأَكَلَ ذَبِيحَتَنَا فَذَلِكَ الْمُسْلِمُ الَّذِي لَهُ ذِمَّةُ اللَّهِ وَذِمَّةُ رَسُولِهِ فَلَا تُخْفِرُوا اللَّهَ فِي ذِمَّتِهِ
হযরত আনাস ইবনে মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
“যে ব্যক্তি আমাদের ন্যায় সালাত আদায় করে, আমাদের কেবলামুখী হয় এবং আমাদের যবেহ করা প্রাণী খায়, সে-ই মুসলিম, যার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যিম্মাদার। সুতরাং তোমরা আল্লাহর যিম্মাদারীতে খিয়ানত করো না।”(সহীহ বুখারী : হাদীস নং- ৩৮৪, ই,ফা)
আমি এ হাদীসটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলি, এ হাদীসের ব্যাখ্যা হলো- দ্বীন পূর্ণাঙ্গভাবে মানতে হবে। কোনো কুফরী আবশ্যক করে এমন আকীদা, কথা বা কাজে জড়িত না হতে হবে। এর এ অর্থ নয় যে, যে ব্যক্তিই এ তিন কাজ করবে, যত কুফরী আকীদা ও কাজে জড়িত হোক না কেন; সে মুসলমান।
وَقَدْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ فَمَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ عَصَمَ مِنِّي مَالَهُ وَنَفْسَهُ إِلَّا بِحَقِّهِ وَحِسَابُهُ عَلَى اللَّهِ
রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহুআলাইহিওয়াসাল্লামবলেছেন- “‘লাইলাহাইল্লাল্লাহ’ বলারপূর্বপর্যন্তমানুষেরবিরুদ্ধেযুদ্ধকরারআদেশআমাকেদেওয়াহয়েছে।যেকেউ‘লাইলাহাইল্লাল্লাহ’ বলল, সেতারজীবনওসম্পদআমারপক্ষথেকেনিরাপদকরেনিল।তবেইসলামেরবিধানলংঘনকরলে (শাস্তিদেওয়াযাবে), আরতারঅন্তরেরগভীরে (হৃদয়াভ্যন্তরেকুফরীবাপাপলুকানোথাকলেএর) হিসাব-নিকাশআল্লাহরজিম্মায়।”(সহীহবুখারী, হাদীসনং- ১৩১৮, ই, ফা,)
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেন-
فتوهم طائفة من الصحابة أن مراده أن مجرد هذه الكلمة يعصم الدم حتى توقفوا في قتال من منع الزكاة، حتى بين لهم أبو بكر - ورجع الصحابة إلى قوله: أن المراد: الكلمتان بحقوقهما ولوازمهما، وهو الإتيان ببقية مباني الإسلام
‘কতিপয় সাহাবায়ে কেরাম মনে করেন, এর (উল্লিখিত হাদীস) ব্যাখ্যা হলো, শুধু এ কালিমা পড়ে নেওয়া মৃত্যুদণ্ড এড়াতে পারে। এ কারণে, তাঁরা যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উপর (প্রথমে) দ্বিধাবোধ করলেন। যখন আবূ বকর রাযি. তাঁদেরকে (এ হাদীসের উদ্দেশ্য) বর্ণনা করলেন, সাহাবায়ে কেরামগণও তাঁর কথায় একমত পোষণ করলেন। এর ব্যাখ্যা হলো- এগুলো এমন দু’টি বাক্য; যা তার দাবি ও শর্তাবলিসহ প্রযোজ্য। আর তা হলো, ইসলামের অন্যান্য মৌলিক বিষয়সমূহ পালন করা।’
এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ হচ্ছে, নবী ﷺ এর ওফাতের পর যখন জাযিরাতুল আরবে ইরতিদাদের ফেতনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তখন এসবের মধ্যে অন্যতম ছিল যাকাত অস্বীকারকারীদের দল। তাদের মাঝে এমন মানুষও ছিল, যারা যাকাত অস্বীকার করত না; তবে বলত যে, যাকাত নেওয়া রাসূল ﷺ এরই বৈশিষ্ট্য ছিল। তাই এখন আমরা নিজেরাই যাকাত আদায় করব। হযরত আবূ বকরকে (জমা) দেব না। এ কারণেই হযরত আবূ বকর রাযি. তাদের সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দেন।
قَالَ أَبُو بَكْرٍ: وَاللَّهِ لَأُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ؛ فَإِنَّ الزَّكَاةَ حَقُّ المَالِ
‘হযরত আবূ বকর রাযি. বললেন, আল্লাহর কসম! তাদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়িই আমি যুদ্ধ করবো, যারা সালাত ও যাকাতের মাঝে পার্থক্য করবে। কেননা, যাকাত হল সম্পদের উপর আরোপিত হক।’
সে সময় হযরত উমর রাযি. বলেন, যে ব্যক্তি কালিমা পাঠ করেছে, তার জান-মাল নিরাপদ হয়ে গেছে। তখন আবূ বকর রাযি. এ হাদীসের দলিল দিয়ে বলেন, সেই হাদীসে আছে, অর্থাৎ তার জান-মাল নিরাপদ থাকবে না, যে কালিমা পড়ার পরও ইসলামের হকসমূহ আদায় করেনি। আর যাকাত হলো ইসলামের হক। তাই আমি তাদের সাথে ততদিন পর্যন্ত যুদ্ধ করব, যতদিন পর্যন্ত না তারা যাকাত আদায় করবে। এমনকি একটি উটের রশিও যদি তারা না দেয়, যা রাসূলের যুগে দিত; তার জন্যও যুদ্ধ চলবে।
এ কথা শুনে উমর রাযি.ও একমত হলেন। বললেন, আল্লাহর কসম! আল্লাহ তা‘আলা আবূ বকর রাযি. এর হৃদয়ের দ্বার খুলে দিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম রাযি. বলতেন, আবূ বকরই আমাদেরকে ইরতিদাদ থেকে বাঁচিয়েছেন।
তেমনি এ হাদীসের ব্যাখ্যা করে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ফাতহুল বারীতে বলেন-
وقد وردت الأحاديث بذلك زائدا بعضها على بعض ففي حديث أبي هريرة الاقتصار على قول لا إله إلا الله وفي حديثه من وجه آخر عند مسلم حتى يشهدوا أن لا إله إلا الله وأن محمدا رسول الله وفي حديث بن عمر ما ذكرت وفي حديث أنس الماضي في أبواب القبلة فإذا صلوا واستقبلوا وأكلوا ذبيحتنا قال الطبري وغيره أما الأول فقاله في حالة قتاله لأهل الأوثان الذين لا يقرون بالتوحيد وأما الثاني فقاله في حالة قتال أهل الكتاب الذين يعترفون بالتوحيد ويجحدون نبوته عموما أو خصوصا وأما الثالث ففيه الإشارة إلى أن من دخل في الإسلام وشهد بالتوحيد وبالنبوة ولم يعمل بالطاعات أن حكمهم أن يقاتلوا حتى يذعنوا إلى ذلك وقد تقدمت الإشارة إلى شيء من ذلك في أبواب القبلة .
‘উল্লিখিত হাদীস বিভিন্ন শব্দে বর্ধিত হয়ে এসেছে। হযরত আবূ হুরাইরার হাদীসে শুধু ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উল্লেখ আছে। আবার তাঁরই (বর্ণিত) হাদীস সহীহ মুসলিমে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর সাথে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহও উল্লেখ আছে এবং ইবনে উমরের হাদীসে, যা আমি উল্লেখ করেছি। হযরত আনাস রাযি. এর হাদীসে কালিমার সাথে সালাত, কেবলা ও জবাইকৃত জন্তুর কথাও উল্লেখ আছে। ইমাম তবারী রহ. বলেন, প্রথম বর্ণনাটি মূর্তিপূজারী মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে এসেছে, যারা তাওহীদকেই অস্বীকার করে। দ্বিতীয় বর্ণনাটি এসেছে আহলে কিতাবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে, যারা তাওহীদের স্বীকারোক্তি তো দেয়; তবে নবী ﷺ এর নবুওয়াতকে অস্বীকার করে। তৃতীয় বর্ণনাটি তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, যারা ঈমান এনেছে তাওহীদ ও রিসালাতের প্রতি; তবে আল্লাহর দেওয়া ফরযসমূহ পালন করেনি। তাদের ব্যাপারে শরীয়তের নির্দেশ হলো, তাদের বিরুদ্ধে ততদিন পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হবে, যতদিন না তারা ফরয পালন আরম্ভ করবে। এ জাতীয় অধ্যায়গুলোর বিষয়ে পূর্বে কিছু ইশারা-ইঙ্গিত অতিবাহিত হয়েছে।’ (ফাতহুল বারী, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-১১২, শামেলা)
মুখে কালিমা পড়ার ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম বিস্তারিত এভাবে বলেছেন, ইমাম তহাবী রহ. ‘শারহু মা‘আনিল আসার’ এ বলেন-
وَحَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي دَاوُدَ، قَالَ: ثنا عَمْرُو بْنُ مَرْزُوقٍ، قَالَ: ثنا شُعْبَةُ، عَنْ عَمْرِو بْنِ مُرَّةَ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ سَلَمَةَ عَنْ صَفْوَانَ بْنِ عَسَّالٍ أَنَّ يَهُودِيًّا قَالَ لِصَاحِبِهِ: تَعَالَ نَسْأَلْ هَذَا النَّبِيَّ، فَقَالَ لَهُ الْآخَرُ: لَا تَقُلْ لَهُ نَبِيٌّ، فَإِنَّهُ إِنْ سَمِعَهَا صَارَتْ لَهُ أَرْبَعَةُ أَعْيُنٌ، فَأَتَاهُ فَسَأَلَهُ عَنْ هَذِهِ الْآيَةِ ﴿ وَلَقَدْ آتَيْنَا مُوسَى تِسْعَ آيَاتٍ بَيِّنَاتٍ ﴾ ﴿الإسراء: ١٠١﴾ فَقَالَ لَا تُشْرِكُوا بِاللهِ شَيْئًا، وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللهُ إِلَّا بِالْحَقِّ، وَلَا تَسْرِقُوا، وَلَا تَزْنُوا، وَلَا تَسْحَرُوا، وَلَا تَأْكُلُوا الرَّبَّا، وَلَا تَمْشُوا بِبَرِيءٍ إِلَى سُلْطَانٍ لِيَقْتُلَهُ، وَلَا تَقْذِفُوا الْمُحْصَنَةَ، وَلَا تَفِرُّوا مِنَ الزَّحْفِ، وَعَلَيْكُمْ خَاصَّةَ الْيَهُودِ، أَنْ لَا تَعْدُوا فِي السَّبْتِ قَالَ: فَقَبَّلُوا يَدَهُ، وَقَالُوا: نَشْهَدُ أَنَّكَ نَبِيٌّ، قَالَ فَمَا يَمْنَعُكُمْ أَنْ تَتْبَعُونِي؟ قَالُوا: إِنَّ دَاوُدَ دَعَا أَنْ لَا يَزَالَ فِي ذُرِّيَّتِهِ نَبِيٌّ، وَإِنَّا نَخْشَى إِنِ اتَّبَعْنَاكَ، أَنْ تَقْتُلَنَا الْيَهُودُ "قَالَ أَبُو جَعْفَرٍ: فَفِي هَذَا الْحَدِيثِ أَنَّ الْيَهُودَ قَدْ كَانُوا أَقَرُّوا بِنُبُوَّةِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَعَ تَوْحِيدِهِمْ لِلَّهِ، فَلَمْ يُقَاتِلْهُمْ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى يُقِرُّوا بِجَمِيعِ مَا يُقِرُّ بِهِ الْمُسْلِمُونَ، فَدَلَّ ذَلِكَ أَنَّهُمْ لَمْ يَكُونُوا بِذَلِكَ الْقَوْلِ مُسْلِمِينَ، وَثَبَتَ أَنَّ الْإِسْلَامَ لَا يَكُونُ إِلَّا بِالْمَعَانِي الَّتِي تَدُلُّ عَلَى الدُّخُولِ فِي الْإِسْلَامِ، وَتَرْكِ سَائِرِ الْمِلَلِ، وَقَدْ رُوِيَ عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، مَا يَدُلُّ عَلَى ذَلِكَ.
‘হযরত সফওয়ান ইবনে আসসাল থেকে বর্ণিত, এক ইয়াহুদী তার বন্ধুকে বলল, আস! এই নবীর কাছে কিছু প্রশ্ন করি। দ্বিতীয়জন বলল, নবী বলো না। তিনি শুনে ফেললে আবার খুশিতে বাগবাগ হয়ে যাবেন। তখন তারা দু’জন নবী কারীম ﷺ এর কাছে এল। কুরআনের আয়াত- وَلَقَدْ آتَيْنَا مُوسَىٰ تِسْعَ آيَاتٍ بَيِّنَاتٍ ﴿الإسراء: ١٠١﴾ ‘আমি মূসাকে নয়টি প্রকাশ্য নিদর্শন দান করেছি’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। নবী কারীম ﷺ এর উত্তরে বললেন, নয়টি নিদর্শন হলো এই- আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না, আল্লাহ তা‘আলা যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন, তাকে হত্যা করো না; তবে কোনো দন্ডবিধির কারণে হত্যা করা যাবে, চুরি করো না, ব্যভিচার করো না, জাদু করো না, সুদ খেয়ো না, কোনো নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বিচারকের কাছে যেও না, সতী-সাধ্বী নারীদেরকে অপবাদ দিও না, কাফেরদের সাথে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পালিয়ে যেও না, ইয়াহুদীদের জন্য আলাদা হুকুম হলো, তারা শনিবারে অবাধ্যতা থেকে মুক্ত থাকবে। তখন সেই দুই ইয়াহুদী রাসূল ﷺ এর হাতে চুমো খেল এবং বলল, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর নবী। রাসূল ﷺ বললেন, তারপরও কেন তোমরা আমার অনুসরণ করছ না? তারা বলল, দাউদ আ. আল্লাহর কাছে দুআ করেছিলেন, তাঁর সন্তান-সন্তুতিতে সব সময় নবী থাকবে। সুতরাং আমাদের আশংকা হয়, আমরা আপনার অনুসরণ করলে ইয়াহুদীরা আমাদের হত্যা করে ফেলবে।’
ইমাম তহাবী রহ. বলেন, এ হাদীসের মধ্যে ইয়াহুদীরা আল্লাহর তাওহীদের স্বীকারোক্তি দেওয়ার সাথে সাথে নবী কারীম ﷺ এর নবুওয়াতকেও স্বীকার করে নিয়েছিল। তারপরও তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকতে বলেননি, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা অন্যান্য মুসলমানের মতো সেই বিষয়াবলি মেনে নেয়; যা মানা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক।’
সুতরাং বুঝা যায়, ইয়াহুদীরা সেই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে মুসলমান হয়ে যায়নি। এ কথাও প্রমাণিত হলো যে, সেসব বিষয় ছাড়া ইসলাম গ্রহণযোগ্য নয়, যা ইসলামে প্রবেশের উপর বুঝায়। আর সব ধর্ম ত্যাগ না করলে ইসলামে প্রবেশ করা যায় না। এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল ﷺ থেকে হযরত আনাস ইবনে মালিক রাযি. একটি হাদীসও বর্ণনা করেছেন।(শারহু মা‘আনিল আসার’, হাদীস নং-৪৭৩৮ খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-২১৫, শামেলা)
এ ব্যাপারে ইমাম তহাবী রহ. আরও বলেন-
حَدَّثَنَا ابْنُ مَرْزُوقٍ، قَالَ: ثنا عَبْدُ اللهِ بْنُ بَكْرٍ، قَالَ: ثنا بَهْزُ بْنُ حَكِيمٍ، عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ، قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، مَا آيَةُ الْإِسْلَامِ؟ قَالَ أَنْ تَقُولَ أَسْلَمْتُ وَجْهِي لِلَّهِ، وَتَخَلَّيْتُ، وَتُقِيمَ الصَّلَاةَ، وَتُؤْتِيَ الزَّكَاةَ وَتُفَارِقَ الْمُشْرِكِينَ إِلَى الْمُسْلِمِينَ فَلَمَّا كَانَ جَوَابُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِمُعَاوِيَةَ بْنِ حَيْدَةَ، لَمَّا سُئِلَ عَنْ آيَةِ الْإِسْلَامِ أَنْ تَقُولَ أَسْلَمْتُ وَجْهِي لِلَّهِ، وَتَخَلَّيْتُ، وَتُقِيمَ الصَّلَاةَ، وَتُؤْتِيَ الزَّكَاةَ، وَتُفَارِقَ الْمُشْرِكِينَ إِلَى الْمُسْلِمِينَ وَكَانَ التَّخَلِّي هُوَ تَرْكُ كُلِّ الْأَدْيَانِ إِلَى اللهِ ثَبَتَ بِذَلِكَ أَنَّ كُلَّ مَنْ لَمْ يَتَخَلَّ مِمَّا سِوَى الْإِسْلَامِ، لَمْ يَعْلَمْ بِذَلِكَ دُخُولَهُ فِي الْإِسْلَامِ، وَهَذَا قَوْلُ أَبِي حَنِيفَةَ، وَأَبِي يُوسُفَ، وَمُحَمَّدٍ، رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ أَجْمَعِينَ.
‘বাহায ইবনে হাকীম তাঁর পিতা থেকে, তিনি তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! ইসলামের নিদর্শনাবলি কী কী? তিনি বললেন, তোমরা বলো, আমি নিজের চেহারা আল্লাহর সামনে ঝুঁকিয়ে দিয়েছি। সব ধর্মকে পরিত্যাগ করেছি। তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো, যাকাত প্রদান করো। আর মুশরিকদের সাথে বসবাস ছেড়ে মুসলমানদের কাছে চলে এসো।
ইমাম তহাবী রহ. বলেন, تخلي অর্থ সব ধর্ম ছেড়ে দেওয়া। এর দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত বাকি সব দ্বীন পরিত্যাগ করবে না, সে ইসলামে প্রবেশ করেছে বলে ধর্তব্য হবে না। এটি ইমাম আবূ হানিফা, আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ রহ. এর মতামত।’
(শারহু মা‘আনিল আসার’, হাদীস নং-৪৭৪১, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-২১৬, শামেলা)
বিস্তারিত আলোচনায় এ কথা প্রতিভাত হয় যে, কালিমার কিছু দাবি আছে, যা পূর্ণ করা ব্যতীত এ কালিমার প্রতি বিশ্বাস গ্রহণযোগ্য হবে না।
আরও পড়ুন