আন নাসর মিডিয়া পরিবেশিত
“ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
একবিংশ শতাব্দীর গণতন্ত্র’’
(সূরা আসরের আলোকে)
।।মাওলানা আসেম উমর হাফিজাহুল্লাহ ||
এর থেকে– ৯ম পর্ব
“ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
একবিংশ শতাব্দীর গণতন্ত্র’’
(সূরা আসরের আলোকে)
।।মাওলানা আসেম উমর হাফিজাহুল্লাহ ||
এর থেকে– ৯ম পর্ব
আবূ জাহালের ধর্মনিরপেক্ষ প্রস্তাবনা
ইমাম আবুল লাইস সমরকন্দী রহ. তাঁর তাফসীর গ্রন্থে ইমাম মুকাতিল রহ. এর রেওয়ায়েতে আবূ জাহালের এক আশ্চর্যজনক প্রস্তাবনা বর্ণনা করেছেন।
ندخل معك في بعض ما تعبد وتدخل معنا في بعض ديننا أو نتبرأ من آلهتنا وتتبرأ من إلهك.
‘আমরা আপনার সাথে আপনার কিছু ইবাদতে অংশ নেব। আপনিও আমাদের সাথে আমাদের দ্বীনের কিছু ইবাদাতে অংশ নেবেন। অথবা আমরা আমাদের প্রভুদের থেকে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করি। আপনিও আপনার প্রভু থেকে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করুন।’
এ প্রস্তাবনার প্রথম অংশ ‘আমরা আপনার সাথে আপনার কিছু ইবাদতে অংশ নেব। আপনিও আমাদের সাথে আমাদের দ্বীনের কিছু ইবাদাতে অংশ নেবেন।’ আজকের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিদ্যমান ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ আবারও মুসলমানদের কাছে এটাই পেশ করছে। সেক্যুলার ব্যক্তি (সে আসল কাফের হোক বা মুসলমান নামের সেক্যুলার হোক) ইসলামের ইবাদতসমূহ ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রস্তুত। নিজ নিজ দেশে সেটির অনুমতি; বরং সেটির সহায়তার জন্যও প্রস্তুত। কিন্তু জীবনব্যবস্থা ও সংবিধানের প্রশ্নে সে চুল পরিমাণও পিছু হটতে প্রস্তুত নয়; বরং এ ব্যাপারে এদের চাওয়া হলো, সংবিধান ও জীবনব্যবস্থার ক্ষেত্রে আপনাদেরকে আমাদের সিস্টেমেই আসতে হবে। মানতে হবে গণতন্ত্র, বৈশ্বিক সুদব্যবস্থা, জাতীয়তাবাদ- যেটি শত্রুতা ও বন্ধুত্বের মাপকাঠি, নারী স্বাধীনতা, প্রবৃত্তি ও মুক্তচিন্তার উপর ভাসমান জীবন। আর এটিকে আদর্শ জীবন ও অনুকরণীয় ব্যবস্থা হিসেবে মানতে হবে। সুতরাং কেউ যদি এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে চায়, তখন প্রত্যেক রাষ্ট্রই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। আর ততক্ষণ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলতে থাকে, যতক্ষণ না সে তাদের মতবাদকে স্বীকার করে নেয়।
এটি আবূ জাহালের প্রস্তাবের প্রথমাংশ। আবূ জাহাল বিশ্বধর্মের যে প্রস্তাব করেছে, সে এ ব্যাপারটি মানতে কখনো প্রস্তুত ছিল না যে- রাষ্ট্রব্যবস্থা, আইন প্রণয়ন অর্থাৎ বৈধতা-অবৈধতা দানের ব্যাপারে সে হাত দেবে না।
তার প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অংশ ছিল, ‘অথবা আমরা আমাদের প্রভুদের থেকে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করি। আপনিও আপনার প্রভু থেকে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করুন।’ অর্থাৎ কোনো ধর্ম মানারই প্রয়োজন নেই।
তার এ কথা শুনে মনে হচ্ছে, আবূ জাহাল নিতান্ত বিশুদ্ধ চিন্তার সেক্যুলার ছিল; যে সর্বদা স্বীয় প্রবৃত্তির দাস ছিল। নিজের প্রভুদের মান-সম্মান (হানি হবে), তার জন্য এটা কোনো ব্যাপারই ছিল না। শুধু নিজের সর্দারি-রাজত্ব ও প্রবৃত্তিই তার প্রিয় ছিল। তা রক্ষা করার জন্য সে স্বীয় প্রভুদের থেকেও সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করতে কুণ্ঠিত ছিল না!
এ সবগুলো প্রস্তাবনায় যদি লক্ষ্য করা হয়; তবে সবকিছুর একটিই সারমর্ম বেরিয়ে আসে। আমরা যে সংবিধান প্রণয়ন করেছি, পার্লামেন্টে (দারুন নাদওয়া) আমরা যেসব আইন পাশ করেছি, সেসবের দুর্নাম করা যাবে না। আপনি ব্যক্তিগত ইবাদত চালিয়ে যান; কিন্তু আমাদের দ্বীন ও সংবিধানকে কুফর বলবেন না। কারণ, আমাদের ধর্ম মানে আল্লাহরই ধর্ম। এ কথাও বলবেন না যে, আল্লাহ ছাড়া আর কারো হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা নেই। সেই ক্ষমতাটি আমাদের প্রভুদের জন্যও মেনে নিন। হোক না সেটা কুফরী আইনকে ইসলামী প্রমাণ করার অপব্যাখ্যার মাধ্যমেই!
এখানে চিন্তার বিষয় হলো, কুরাইশ-সর্দার কি এতই নির্বোধ ছিল যে, আল্লাহর রাসূল ﷺ এর কাছে সে এমন দাবি করেছিল; তাতে কি তার এ ক্ষতি ছিল না? সে যখন এক বছর মুহাম্মাদ ﷺ এর প্রভুর ইবাদত করবে, তখন পুরো জাযিরাতুল আরবে বিদ্যমান তার অনুসারীদের মধ্যে কী প্রভাব পড়বে?
আমরা যদি কুরাইশ নেতৃবর্গের এ প্রস্তাবনাকে গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে বুঝতে পারব যে, কোনো চিন্তা-ভাবনা করা ছাড়াই তারা নবী কারীম ﷺ এর দাওয়াতে বিরক্ত হয়ে এমন প্রস্তাব করে বসেছিল। কিন্তু যে ব্যক্তিই তাওহীদ ও কুফরের মানস বোঝে, সে বিশেষত মূর্তিপূজারী ধর্মের দিকে তাকিয়ে এ প্রস্তাবের গভীরতা আঁচ করতে পারবে। কুরাইশের বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ জানত যে, কেউ যদি একবার তাদের মূর্তির অবস্থানকে মেনে নেয়; তবে পরবর্তীতে সে কখনো নিজ আকীদার উপর অবিচল থাকতে পারবে না। পরিশেষে সেও একদিন মূর্তিপূজাকেই গ্রহণ করবে।
মূর্তিপূজা কেমন ধর্ম বুঝতে চাইলে হিন্দুস্তানের হিন্দুধর্মের ইতিহাস পড়তে পারেন। হিন্দুধর্ম কত সভ্যতা ও ধর্ম-বিশ্বাসকে গিলে খেয়েছে, আজ যার অস্তিত্বও বাকি নেই। খৃষ্টধর্মকে শিরকের নর্দমায় নিক্ষেপ করেছে এ মূর্তিপূজাই।
মূর্তিপূজা এমন ধর্ম, যার কোনো উৎস ও ভিত্তি নেই; বরং এটি শতভাগ সেক্যুলার তথা প্রবৃত্তির উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। অভিজাতশ্রেণীর (আরবে ছিল কুরাইশ কাফের, হিন্দুস্তানে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়) যাকে ইচ্ছে হয়েছে, তাকেই প্রভুর স্থান দিয়েছে। কারণ, বাধাদানকারী কোনো ভিত্তিই তো (ওদের) ছিল না! তবে আসমানী ধর্ম তার ব্যতিক্রম। যে কোনো শক্তিশালী, উপকারী, ক্ষতিকর বা জনপ্রিয় মানুষ আসে, (মূর্তিপূজারিরা) এটিকে নিজের প্রমাণ করে নিজের অবস্থান তৈরি করে এবং পরে তারই পূজা করতে থাকে।
হয়তো এ কারণেই হিন্দুত্ববাদের সর্দারশ্রেণীর (ব্রাহ্মণদের) ইসলাম গ্রহণের হার অন্যান্য জাতির তুলনায় অনেক কম। কারণ, আপনি তাকে যত দলিলই দিন না কেন, সে তা মেনে নিলেও; সত্যের গন্ডিতে আসার পরিবর্তে সেই সত্যকেই নিজের প্রবৃত্তি মতে ঢেলে সাজাবে। সেই ধর্ম গ্রহণ করার পরিবর্তে সেটিকে হিন্দুত্ববাদে এমনভাবে অন্তর্ভুক্ত করে নেবে যে, সে ধর্মের অস্তিত্বের খবরও জানা যাবে না। যেমন, আপনি তাদেরকে যদি আল্লাহ তা‘আলার সত্তার ব্যাপারে দলিল দিয়ে বুঝান, তখন তারা তা বুঝবে ঠিক; কিন্তু তা এমন পন্থায় মানবে যে, আল্লাহর জন্যও একটি মূর্তি বানিয়ে সামনে রেখে দেবে। তাই প্রমাণিত সত্য হলো, অধিকাংশ ব্রাহ্মণ সত্য গ্রহণ করার পরও মুসলমান হতে পারে না; তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।
সুতরাং কুরাইশ পৌত্তলিকদের এ চুক্তির ফলাফল খুব খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এতে মক্কার কাফেরদেরই ফায়দা হতো। কারণ এ চুক্তির পর আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দেওয়া সম্ভব হতো না।
এ ঘটনার মাঝে বর্তমান ঐ সকল লোকদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় আছে, যারা ইসলাম ও হিন্দুত্ববাদ বা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও অন্যান্য মতাদর্শের মাঝে পারস্পরিক সম্প্রীতি, বোঝাপড়া ও সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের নামে ইসলাম ও কুফরকে একীভূত করে মুসলমানদেরকে প্রকাশ্য কুফরের দিকে দাওয়াত দিচ্ছে।
উপমহাদেশের হক্কানী উলামায়ে কেরাম যুগে যুগে মুসলমানদেরকে এ ধরনের কুফরী চুক্তি ও উদ্যোগের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। আল্লামা আবূল হাসান আলী নদভী রহ. ‘দ্বীনে হক্ব ওয়া উলামায়ে রব্বানী’ নামক রিসালায় বলেন, আম্বিয়ায়ে কেরাম আ. কুফরকে পরিপূর্ণরূপে মূলোৎপাটন করতেন। তাঁরা কুফরের প্রতি এবং তাদের সাথে নমনীয় চুক্তি সম্পাদনের প্রতি সহিষ্ণু ছিলেন না। কুফরের পরিচয় চেনার ক্ষেত্রে তাঁদের দারুণ যোগ্যতা ছিল। এক্ষেত্রে তাঁদের দৃষ্টি ছিল খুবই তীক্ষ্ম ও সুদূরপ্রসারী। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ হেকমত ও দৃঢ়তা দান করেছেন। আল্লাহপ্রদত্ত বিচক্ষণতা ও অন্তর্দৃষ্টির উপর ভরসা করা ছাড়া তাঁদের কোনো উপায় নেই। দ্বীনের হেফাযতের জন্য এটাই একমাত্র উপায় যে, ইসলাম ও কুফরের যে সীমানা তাঁরা স্থাপন করে দিয়েছেন এবং যে নিদর্শনাবলি তাঁরা উল্লেখ করে দিয়েছেন, তার পরিপূর্ণ হেফাযত করতে হবে। এর মধ্যে সামান্য উদারবোধ ও সহিষ্ণুতা দ্বীনকে এমনভাবে বিকৃত করে ফেলে, যেমনিভাবে ইয়াহুদী ধর্ম, খৃষ্টান ধর্ম ও ভারতের ধর্মসমূহ বিকৃত হয়ে পড়েছে।
হক্কানী উলামায়ে কেরাম সম্পর্কে তিনি লিখেন, আম্বিয়ায়ে কেরাম আ. এর সত্যিকারের অনুসারীগণও এ বিষয়ে তাঁদের মতো বিচক্ষণতা ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে থাকেন। তাঁরা এক এক করে কুফরের সকল নিশানা মুছে ফেলেন। এক এক করে জাহিলিয়্যাতের দাগ দূরীভূত করেন। কুফর শনাক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁদের বোধশক্তি সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে। কুফর যে বেশে এবং যে আকৃতিতেই আসুক না কেন, তা তাঁরা ঠিকই ধরে ফেলেন এবং নিজের কোমর বেঁধে তার বিরোধিতায় নেমে পড়েন। কখনো তাঁরা ভারতে বিধবাদের দ্বিতীয় বিবাহকে হারাম মনে করা ও তার প্রতি প্রবল ঘৃণা পোষণ করার মাঝে কুফরের গন্ধ পান এবং সেটার (বিধবাদের দ্বিতীয় বিবাহ) প্রচার-প্রসার ঘটানো এবং এই সুন্নাহকে জীবিত করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। অনেক সময় তার জন্য জানবাজি রেখে সংগ্রাম করেন। কখনো শরয়ী কানুনের উপর প্রচলিত রীতি-রেওয়াজকে প্রাধান্য দেওয়া এবং বোনদেরকে মিরাস-অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জোর দেওয়াকে তাঁদের নিকট কুফরী মনে হয় এবং এ ধরনের লোকদের বিরোধিতা ও তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাকে ফরয মনে করেন তাঁরা। কখনো আল্লাহ ও রাসূল ﷺ এর পরিষ্কার বিধান জানার পর না মানা এবং গাইরে ইলাহী আদালত ও আইনের আশ্রয় নেওয়া ও অনৈসলামিক আহকাম ও কানুন প্রতিষ্ঠা করাকে ইসলামের গন্ডি থেকে খারিজকারী বিষয় বলে মনে হয় তাঁদের নিকট এবং তাঁরা এর প্রতিবাদ করতে অপারগ হলে সেখান থেকে হিজরত করে চলে যান। কখনো কোনো নওমুসলিম বা এমন মুসলিম, যে অমুসলিমদের সাথে ওঠাবসা করে এবং এমন জবাইকৃত জন্তু ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাকে ঘৃণা করে, যে জবাইকৃত জন্তু থেকে তাদের মিত্র জাতি ও দেশবাসী প্রবলভাবে বেঁচে থাকে। আর এ বিষয়ে তাদের মধ্যে যথেষ্ট ঘৃণা ও দূরত্ববোধ রয়েছে। এমন মুসলমানদের ঈমানে দুর্বলতা ও তাদের মাঝে পুরাতন ধর্ম বা অমুসলিমদের ধর্মের প্রভাব আছে বলে মনে করেন তাঁরা।
যুগে যুগে এ ধরনের আল্লাহওয়ালা ও সত্যপথে অবিচল পথিকদের বিরুদ্ধে অনেক কথা হয়েছে। বিষাক্ত তীর-বর্শার আঘাত তাঁদের অন্তরকে চালনি করে দিয়েছে। তাঁদের বিরোধিতা ও যুক্তি খণ্ডনের জন্য নফসের পূজারীদেরকে উচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতাসম্পন্ন পদ-পদবি ও নিকৃষ্ট পৃথিবীর নিকৃষ্ট সম্পদ প্রতিদান হিসেবে দেওয়া হয়েছে; যার সাহায্যে তারা নিজেদের পেটে জাহান্নামের আগুন ভরেছে।
আরও পড়ুন
৮ম পর্ব ---------------------------------------------------------------------------------------------------- ১০ম পর্ব