Announcement

Collapse
No announcement yet.

গণতন্ত্র ও নির্বাচন : কিছু নিবেদন (প্রথম পর্ব)

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • গণতন্ত্র ও নির্বাচন : কিছু নিবেদন (প্রথম পর্ব)

    গণতন্ত্র ও নির্বাচন : কিছু নিবেদন
    (প্রথম পর্ব)

    গণতন্ত্রপরিচয়, প্রেক্ষাপট, বাস্তবতা ও কদর্যতা :
    গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থার আকিদা বা বিশ্বাস হলো, ধর্ম ব্যক্তিজীবনে এবং ইবাদতখানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে আর রাষ্ট্র ও সমাজ মানুষের নিজস্ব মতামত দিয়ে পরিচালিত হবে। পক্ষান্তরে ইসলামি জীবনব্যবস্থার আকিদা হলো, মানুষের জন্য আল্লাহ তাআলা জীবনব্যবস্থা প্রদান করেছেন। জীবন ও রাষ্ট্র সকল কিছুই সে ব্যবস্থানুপাতে পরিচালিত হবে। আল্লাহর হুকুম কেবল ব্যক্তিজীবনে সীমাবদ্ধ রেখে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না।

    গণতন্ত্রের সূচনাকাল :
    খ্রিষ্ট সপ্তম শতাব্দী থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় মুসলিমদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে যেমন উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য ইউরোপ ও আমেরিকায় যেতে হয়, চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের অধিবাসীদেরকেও তেমনই জ্ঞানের তালাশে মুসলিম অধ্যুষিত আন্দালুসের (আন্দালুসের বর্তমান নাম স্পেন) আল-হামরা, কর্ডোভা ও গ্রানাডায় ভিড় জমাতে হতো। সেকালে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সকল ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব ছিলো মুসলিমদের হাতে। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়। এর পূর্ব পর্যন্ত তারা অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। সে সময় ইউরোপে খ্রিষ্টান পাদরিদের শাসন চলছিল। ইউরোপের পাদরি শাসকরা শোষণ ও নির্যাতন করার হাতিয়ার হিসাবে ধর্মকে ব্যবহার করত। পাদরিরা ধর্মের নামে মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে একচ্ছত্র অধিপতি হিসাবে রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা নিজেদের আল্লাহ তাআলার প্রতিনিধি হিসাবে দাবি করত। পাশাপাশি তারা আরও দাবি করত যে, আল্লাহ তাআলা তাদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ও তা তত্ত্বাবধায়ন করার ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছেন।
    পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপে যখন নতুন জ্ঞানচর্চার উন্মেষ ঘটে, মানুষ অন্ধকার থেকে ধীরে ধীরে আলোর দিকে আসতে শুরু করে, তখন তাদের নিকট পাদরিদের মনগড়া মতামত ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হতে থাকে। এখান থেকেই তাদের সাথে জনগণের সংঘাত শুরু হয়। পাদরিরা আর কোনো উপায় না পেয়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে শক্তি প্রয়োগ করতে লাগল। ধর্মের নামে পাদরিদের এ অধার্মিক আচরণ জনগণের মনে তীব্র ধর্মবিদ্বেষ সৃষ্টি করল। এরপর সাধারণ জনগণ জীবনের সকল বিভাগ থেকে পাদরিদের উৎখাত করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে অগ্রসর হওয়া শুরু করল। ষোড়শ ও সপ্তদশ দীর্ঘ দুশতাব্দী ধরে এ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলতে থাকে। ইতিহাসে এ সংগ্রামযুদ্ধ গির্জা বনাম রাষ্ট্রের লড়াইনামে পরিচিত।
    এ সংঘাতের সমাধানের জন্য দার্শনিক ও চিন্তাবিদরা এগিয়ে আসল। তাদের মধ্যে অনেকে ছিল নাস্তিক আর অন্যরা সরাসরি ধর্মকে অস্বীকার না করলেও রাষ্ট্রের মাঝে ধর্মের প্রভাবকে অস্বীকার করল। এভাবে তারা সকলে ধর্মকে রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে আলাদা করে ফেলার সিদ্ধান্তে ঐকমত্য পোষণ করল। তাদের মতে ধর্ম নিতান্তই ব্যক্তিগত একটি বিষয়। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণে ধর্মকে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া যায় না। তারা শাসনব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করল এবং মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে একটি আপস রফায় উপনীত হলো।
    এ আপসের প্রস্তাবে বলা হলো, ‘ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ থাকবে এবং মানুষের ধর্মীয় দিকের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পাদরিদের হাতে থাকবে। আর জনগণকে শাসন করার কর্তৃত্ব থাকবে জনগণের হাতে। তাদের ওপর আর কারও কর্তৃত্ব থাকবে না। জনগণই আইন প্রণয়ন করবে এবং এ আইন দ্বারাই তারা শাসিত হবে। তারা যে বিধান রচনা করবে, তদ্বারা পরিচালনার জন্য নিজেরাই নিজেদের শাসক নিযুক্ত করবে। অবশ্য রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দকে পাদরিদের নিকটই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার শপথ গ্রহণ করতে হবে। এভাবে জনগণকে পাদরিদের শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য মানবরচিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সূত্রপাত হয়।
    নিঃসন্দেহে এটি সম্পূর্ণরূপে মানবরচিত একটি শাসনব্যবস্থা। পশ্চিমা সভ্যতার এ বিশ্বাসের ফলে জীবন ও রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করে ফেলা হলো। ধর্ম সঠিক কি-না, তা তাদের বিবেচ্য বিষয় ছিল না; বরং তারা ধর্মকে সমস্যা মনে করে তাদের জীবন থেকেই তা সরিয়ে দিয়েছে। আর এখান থেকেই সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার উৎপত্তি হয়। আজ যারা সেক্যুলারিজমের কথা বলে তাদের এ কথা মনে রাখা উচিত যে, ধর্মনিরপেক্ষতা খ্রিষ্টান ধর্মের পাদরিদের সাথে জনগণের সৃষ্ট সমস্যা থেকে এসেছে, ইসলামের সৃষ্ট কোনো সমস্যা থেকে এর উৎপত্তি ঘটেনি। তারপরও তা জোর করেই মুসলিমদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
    উল্লেখ্য যে, খ্রিষ্টান পাদরিরা ধর্মের নামে অন্যায় আচরণ ও মনগড়া নীতি প্রচার করত। আর তাই প্রকৃতপক্ষে জনগণের এ সংগ্রাম ধর্মের বিরুদ্ধে ছিল না; মৌলিকভাবে তা ছিল খ্রিষ্টান পাদরিদের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে। কিন্তু পাদরিদের মোকাবেলা করতে গিয়ে তারা জীবন থেকে ধর্মকেই পরিত্যাগ করে বসল। যাকে বলে মাথাব্যথা দূর করার জন্য মাথা কেটে ফেলার পরামর্শ। এ গণতান্ত্রিক মতবাদ নাস্তিকদের মতো সরাসরি আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না বটে, তবে তাদের মতে দুনিয়ার জীবনে উন্নতি, শান্তি ও প্রগতির জন্য আল্লাহ বা নবি-রাসুলের কোনো প্রয়োজন নেই। তারা ব্যক্তিগত জীবনে ঐচ্ছিকভাবে ধর্মীয় বিধান মেনে চলা এবং সমাজ জীবনে আল্লাহকে অস্বীকার করার সুবিধা-সংবলিত মতবাদ তৈরি করে নিল। ফলে মানবসমাজের জন্য আল্লাহ তাআলাকে বিধানদাতা হিসাবে অস্বীকার করা হলো। এ বিশ্বের সকল কিছু যেহেতু আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন, তাই সে মহাশক্তিশালী স্রষ্টার দেওয়া বিধানকে বাস্তব জীবনে গ্রহণ না করা এবং এতে বাধা দেওয়া সরাসরি আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ ও কুফরির শামিল। আল্লাহ তাআলাকে যদি পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে মান্য করা না-ই যায়, তাহলে কেবল ব্যক্তিজীবনে তাঁর ইবাদত অর্থহীন হয়ে পড়ে। আফসোসের বিষয় হলো, মুসলিমরা আজ ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়ে পশ্চিমা প্রভুদের নিকট নিজেদের সর্বস্ব বিক্রি করে বিশ্বস্ত গোলামের মতো তাদের প্রদত্ত জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করে নিয়েছে।

    গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও পরিচিতি :
    আভিধানিক অর্থ :
    গণতন্ত্রের ইংরেজি হলো Democracyশব্দটি মূলত গ্রীকভাষায় Demos এবং kratía শব্দ দুটির সমন্বয়ে গঠিত। Demos অর্থ জনগণ আর kratía অর্থ শাসন। তাহলে Democracy এর অর্থ হলো, জনগণের শাসন।
    পারিভাষিক অর্থ :
    ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকায় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে :
    Democratic System of Government : A system of government based on the principle of majority dicision-making. অর্থাৎ সরকারের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি : সংখ্যাগরিষ্ঠের মত গ্রহণের নীতির ওপর ভিত্তি করে সরকারব্যবস্থা।’ [দেখুন- Encarta 2009 Encyclopedia Britannica 2012]
    আধুনিক গণতন্ত্রের রূপদাতা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন :
    Government of the people, by the people, for the people. অর্থাৎ জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণের সরকার।’ [দেখুন- President Abraham Lincoln, The Gettysburg Address (Nov.19,1863)]
    উইকিপিডিয়ায় গণতন্ত্রের বিবরণ এভাবে দেওয়া হয়েছে :
    গণতন্ত্র বলতে কোনো জাতিরাষ্ট্রের (অথবা কোনো সংগঠনের) এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক বা সদস্যের সমান ভোটাধিকার থাকে। গণতন্ত্রে আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে, যা সরাসরি বা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে হয়ে থাকে।’ [দেখুন- https://bn.wikipedia.org/wiki/গণতন্ত্র]
    সুতরাং গণতন্ত্র বলতে জনগণের স্বার্থে জনগণের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে বুঝানো হয়। তারা নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থা তৈরি করে এবং তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে নিজেদের সার্বভৌমিক ক্ষমতার মধ্যে আইন রচনা করে। এভাবে জনগণ নিজেদের ক্ষমতার অনুশীলন করে এবং নিজেরাই নিজেদের পরিচালনা করে। গণতন্ত্রের দৃষ্টিতে আইন প্রণয়ন ও শাসক নির্বাচন করার ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তির সমান অধিকার রয়েছে।
    জনগণই এ ব্যবস্থায় বিধান ও আইন প্রণয়ন করে এবং তারা নিজেদের তৈরি কর্তৃপক্ষ ব্যতীত অন্য কারও কাছে জবাবদিহি করে না। জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতা ধারণ করে এবং জনগণই তাদের সার্বভৌমত্ব চর্চা করতে পারে। তাই বলা যায়, জনগণই এ ব্যবস্থার প্রভু। আর জীবন থেকে ধর্মকে আলাদা করাই হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল বিশ্বাস এবং এ বিশ্বাসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি। এ বিশ্বাস থেকেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে। ইসলাম এ বিশ্বাস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ইসলামি আকিদা-বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে, দ্বীন ও দুনিয়ার যাবতীয় বিষয় আল্লাহ তাআলার আদেশ এবং নিষেধ অনুযায়ী পরিচালিত হতে হবে এবং আল্লাহ তাআলা যে ব্যবস্থা দিয়েছেন, সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা আবশ্যক ও বাধ্যতামূলক। এর বিপরীত গণতন্ত্র হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত একটি ব্যবস্থা, যার সাথে ইসলামের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই।
    গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষ প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হতে বাধ্য। আল্লাহ তাআলা মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রে বিধিবিধান নাজিল করেছেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে আল্লাহর বিধিবিধানকে অস্বীকার করা হয়। তাই এটি মূলত আল্লাহর বিধান অস্বীকারকারীদের প্রণীত ব্যবস্থা বা এককথায় এটা কুফরি ব্যবস্থা। তাই জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলামের বিপরীতে তাদের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না; বরং সম্পূর্ণভাবে তা বর্জন করতে হবে। আল্লাহ তাআলা এ সকল কিছুকে বর্জন করার কঠোর নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ করেন :
    يُرِيدُونَ أَن يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَن يَكْفُرُوا بِهِ
    তারা বিচার-ফয়সালার জন্য তাগুতের (অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্যদের) কাছে যেতে চায়; অথচ তাগুতকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করার জন্য তাদের আদেশ করা হয়েছে।’ [সুরা আন-নিসা : ৬০]
    যে আকিদা-বিশ্বাস থেকে এ ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে, যে ভিত্তির ওপর এটি প্রতিষ্ঠিত এবং যে চিন্তা-ধারণার সে জন্ম দেয়, তা সম্পূর্ণরূপে মুসলিমদের আকিদার বিপরীত এবং তাদের বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক।
    গণতন্ত্রের আকিদা-বিশ্বাস থেকে নিম্নোক্ত দুটি ধারণার উদ্ভব হয় :
    ১. সার্বভৌমত্ব জনগণের জন্য সাব্যস্ত।
    ২. জনগণই সকল ক্ষমতার উৎসমূল।
    উপরিউক্ত দুটি ধারণার ওপর ভিত্তি করেই ইউরোপের দার্শনিক ও চিন্তাবিদগণ তাদের ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে। এর দ্বারা পাদরিদের কর্তৃত্বকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন করে জনগণের হাতে তা সমর্পণ করা হয়েছে। পোপদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ফসল হিসেবে ধর্মীয় আইন-কানুনের অবসান করা হয়েছে। ফলে সার্বভৌমত্ব হলো জনগণের জন্য এবং জনগণই হলো সকল ক্ষমতার উৎস। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এ দুটি ধারণাই বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। ফলে জনগণই হয়ে যায় সার্বভৌমত্বের প্রতীক এবং সকল ক্ষমতার উৎস।
    পক্ষান্তরে ইসলামে সার্বভৌমিক ক্ষমতা হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য। গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের কিছু শাখাগত বিষয় বাহ্যিকভাবে এক মনে হলেও বাস্তবে এই দুটি দ্বীন বা জীবনব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। একটি মেনে নিলে অপরটি আপনাপনি বাতিল হয়ে যেতে বাধ্য। কোনো অবস্থাতেই উভয়টির সংমিশ্রণ হতে পারে না। হয় ইসলাম থাকবে; নচেৎ গণতন্ত্র।

    শরিয়তের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র :
    গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার স্বরূপ থেকে বোঝা গেলো যে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অর্থ, মানবজাতির জন্য আল্লাহ তাআলার প্রণীত বিধানের পরিবর্তে মানবরচিত সংবিধান দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা। আর কোনো সন্দেহ নেই যে, এটা সুস্পষ্ট কুফর। শরিয়তের দলিলকুরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস সবকিছুর দ্বারা এর কুফরি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত। নিম্নে পর্যায়ক্রমে দলিলসমূহ পেশ করা হলো।

    কুরআন থেকে দলিল :

    আল্লাহ তাআলা বলেন :
    إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
    আইন প্রণয়নের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর তাআলার-ই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করবে না। এটাই সরল পথ, কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।’ [সুরা ইউসুফ : ৪০]
    আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :
    وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
    আর যারা আল্লাহর অবতীর্ণকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার করে না, সেসব লোকই কাফির।’ [সুরা আল-মায়িদা : ৪৪]
    আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :
    وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَن يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُّبِينًا.
    আর আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোনো বিষয়ে ফয়সালা দিলে কোনো মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর জন্য সে বিষয়ে তাদের (ভিন্ন আরেকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের) কোনো অধিকার নেই। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অবাধ্য হবে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হবে।’ [সুরা আল-আহজাব : ৩৬]

    হাদিস থেকে দলিল :
    আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন :
    يَكُوْنُ فِيْ أَخِرِ الزَّمَانِ قَوْمٌ يَحْضُرُوْنَ السُّلْطَانَ فَيَحْكُمُوْنَ بِغَيْرِ حُكْمِ اللهِ وَلَا يَنْهَوْنَ فَعَلَيْهِمْ لَعْنَةُ اللهِ.
    শেষ যুগে এমন একদল লোক আসবে, যারা শাসকের কাছে যাতায়াত করবে। তারা আল্লাহর হুকুম বাদ দিয়ে (মানবরচিত আইন দ্বারা) বিচার-শাসন করবে, কিন্তু তারা এ ব্যাপারে নিষেধ করবে না। সুতরাং তাদের ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক।
    [
    আল-ফিরদাউস বি-মাসুরিল খিতাব, দাইলামি : ৫/৪৫৫, হাদিস নং ৮৭২৭, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত]

    আউফ বিন মালিক রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন :
    تَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى بِضْعٍ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً، أَعْظَمُهَا فِتْنَةٌ عَلَى أُمَّتِي قَوْمٌ يَقِيسُونَ الْأُمُورَ بِرَأْيِهِمْ فَيُحِلُّونَ الْحَرَامَ وَيُحَرِّمُونَ الْحَلَالَ
    আমার উম্মত সত্তরের চেয়ে কিছু বেশি দলে বিভক্ত হয়ে পড়বেএদের মধ্যে আমার উম্মতের জন্য সবচেয়ে বড় ফিতনার কারণ হবে ওইসব লোক, যারা নিজেদের (ব্যক্তিগত) মতামতের ভিত্তিতে বিভিন্ন বিষয়ে কিয়াস বা অনুমাননির্ভর ফয়সালা করবে; ফলে তারা হারামকে বৈধ ঘোষণা করবে এবং হালালকে অবৈধ ঘোষণা করবে।
    [
    মুসতাদরাকুল হাকিম : ৩/৬৩১, হাদিস নং ৬৩২৫, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত]
    মুআজ বিন জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
    أَلَا إِنَّ الْكِتَابَ وَالسُّلْطَانَ سَيَفْتَرِقَانِ فَلَا تُفَارِقُوا الْكِتَابَ , أَلَا إِنَّهُ سَيَكُونُ أُمَرَاءُ يَقْضُونَ لَكُمْ، فَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ أَضَلُّوكُمْ وَإِنْ عَصَيْتُمُوهُمْ قَتَلُوكُمْ.
    সাবধান! অচিরেই কুরআন ও শাসক পৃথক হয়ে যাবে (অর্থাৎ শাসকেরা কুরআনের আইন দিয়ে বিচার-ফয়সালা করবে না)। সুতরাং তোমরা কখনো কুরআন থেকে পৃথক হয়ে যেয়ো না। শুনে রাখো, শীঘ্রই এমন কিছু নেতা আসবে, যারা তোমাদের জন্য (কুরআন-সুন্নাহর আইন বাদ দিয়ে নিজেদের মনমতো) বিচারকার্য পরিচালনা করবে। অতএব তোমরা যদি তাদের আনুগত্য করো, তাহলে তারা তোমাদের পথভ্রষ্ট করে দেবে। আর যদি তাদের বিরোধিতা করো, তাহলে তারা তোমাদের হত্যা করে ফেলবে।
    [
    আল-মুজামুস সগির, তাবারানি : ২/৪২, হাদিস নং ৭৪৯, প্রকাশনী : আল-মাকতাবুল ইসলামি, বৈরুত]

    ইজমা থেকে দলিল :

    প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানবরচিত আইন দিয়ে শরিয়তের বিধান ও বিচার-ফয়সালাকে যে কী পরিমাণ অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করা হয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দিবালোকের ন্যায় এটা সবার কাছে সুস্পষ্ট। আর সাহাবায়ে কিরাম থেকে নিয়ে উম্মতের সকল উলামায়ে কিরাম এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, শরিয়তের আইন ও বিচার-ফয়সালাকে সন্দেহবশত কিংবা অস্বীকারমূলকভাবে প্রত্যাখ্যান করলে সে ঈমানের গণ্ডি থেকে বের হয়ে মুরতাদ হয়ে যায়। এজন্যই তো সকল সাহাবির ঐকমত্যে জাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের মুরতাদ আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হয়েছে এবং তাদের বন্দীদেরকে দাস-দাসী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
    বিখ্যাত মুফাসসির ইমাম জাসসাস আল-হানাফি রাহিমাহুল্লাহ সুরা নিসার ৬৫ নং আয়াতفَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا (কিন্তু না, আপনার রবের কসম! তারা ইমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে বিচারক নির্ধারণ করে, অতঃপর আপনি যে ফয়সালা দেবেন সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোনো দ্বিধা-সংকোচ অনুভব না করে এবং পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে।) এটার ব্যাখ্যায় বলেন :
    وَفِي هَذِهِ الْآيَةِ دَلَالَةٌ عَلَى أَنَّ مَنْ رَدَّ شَيْئًا مِنْ أَوَامِرِ اللَّهِ تَعَالَى أَوْ أَوَامِرِ رَسُولِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَهُوَ خَارِجٌ مِنْ الْإِسْلَامِ سَوَاءٌ رَدَّهُ مِنْ جِهَةِ الشَّكِّ فِيهِ أَوْ مِنْ جِهَةِ تَرْكِ الْقَبُولِ وَالِامْتِنَاعِ مِنْ التَّسْلِيمِ, وَذَلِكَ يُوجِبُ صِحَّةَ مَا ذَهَبَ إلَيْهِ الصَّحَابَةُ فِي حُكْمِهِمْ بِارْتِدَادِ مَنْ امْتَنَعَ مِنْ أَدَاءِ الزَّكَاةِ وَقَتْلِهِمْ وَسَبْيِ ذَرَارِيِّهِمْ; لِأَنَّ اللَّهَ تَعَالَى حَكَمَ بِأَنَّ مَنْ لَمْ يُسَلِّمْ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَضَاءَهُ وَحُكْمَهُ فَلَيْسَ مِنْ أَهْلِ الْإِيمَانِ
    এ আয়াতই প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা অথবা তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদেশ-নিষেধসমূহ থেকে কোনো একটি বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করবে, সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। চাই সে সন্দেহবশত প্রত্যাখ্যান করুক অথবা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে (আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সামনে) আত্মসমর্পণ করা থেকে বিরত থাকুক। আয়াতটি সকল সাহাবায়ে কিরাম কর্তৃক জাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের মুরতাদ আখ্যা দিয়ে তাদের হত্যা ও তাদের পরিবার পরিজনদের বন্দী করার সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে সাব্যস্ত করে। কেননা, আল্লাহ তাআলা ফয়সালা দিয়েছেন, যে ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিচার ও বিধানকে মেনে নেবে না, সে ইমানদার নয়।’ [আহকামুল কুরআন, জাসসাস : ২/২৬৮, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত]
    একদল লোক আল্লাহ তাআলার বিধান জাকাতকে আংশিকভাবে অস্বীকার করার কারণে সাহাবায়ে কিরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম সম্মিলিতভাবে তাদেরকে মুরতাদ আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। ইমাম জাসসাস রাহিমাহুল্লাহ এর ভাষ্যমতে যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা অথবা তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদেশ-নিষেধসমূহ থেকে কোনো একটি বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করবে, সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে।অতএব যে শাসনব্যবস্থা পুরো রাষ্ট্র থেকে দ্বীনকে আলাদা করে দিয়ে এ স্লোগান প্রচার করছে, ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবারএবং আল্লাহপ্রদত্ত হালালগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অবৈধ আর হারামগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধ করছেএসব পদ্ধতি কি স্পষ্ট কুফর নয়?!

    কিয়াস বা যুক্তি থেকে দলিল :

    সকলের জানা যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওফাতের পর আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের গুরুদায়িত্বে অধিষ্ঠিত হলেন। তখন একদল লোক জাকাতের ফরজিয়্যাত বা আবশ্যকীয়তা অস্বীকার না করলেও খলিফার নিকট তা আদায় করতে অস্বীকৃতি জানাল। তাদেরকে জাকাত না দেওয়ার কারণ দর্শানোর আদেশ করা হলে তারা কুরআনের এ আয়াত থেকে দলিল পেশ করল, خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةًআপনি তাদের সম্পদ থেকে সাদাকা (জাকাত) গ্রহণ করুন।’ [সুরা আত-তাওবা : ১০৩] তারা এ আয়াত দিয়ে যুক্তি পেশ করে বলল, এখানে জাকাত আদায়ের আদেশ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সম্বোধন করে দেওয়া হয়েছে। আর এখন তো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেঁচে নেই, তাই আমরা জাকাত দেবো না। অতঃপর সাহাবায়ে কিরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম তাদের এ ভ্রান্ত ব্যাখ্যাকে অগ্রণযোগ্য আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে স্বশস্ত্র জিহাদ করে তাদের মাল-সম্পদ গনিমত হিসাবে গ্রহণ করলেন এবং তাদের পরিবার-পরিজনকে বন্দী করে দাস-দাসী হিসেবে বণ্টন করলেন।
    ইমাম জাসসাস রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ, কাজি আবু ইয়ালা রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ-সহ অসংখ্য ফকিহ ও মুহাদ্দিস থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, সাহাবায়ে কিরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম তাদের মুরতাদ আখ্যায়িত করেই তাদের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। অনেক ফকিহ এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম এর ইজমা বা ঐকমত্য ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। সাহাবায়ে কিরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম এর যুদ্ধের ধরন থেকেও এর পক্ষে প্রমাণ মেলে। কেননা, সাহাবায়ে কিরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম তাদের পরিবার-পরিজনকে যুদ্ধবন্দী করেছিলেন। তারা কালিমা পাঠ করত, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করত। নামাজ, রোজা, হজ, তাহাজ্জুদ-সহ অন্যান্য সকল বিধানও পালন করত। কিন্তু কেবল একটি বিধান পুরোপুরিভাবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে সাহাবায়ে কিরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম সর্বসম্মতিক্রমে তাদের মুরতাদ ঘোষণা করেছিলেন। এরপর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের যুদ্ধবন্দী হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।
    সুতরাং দ্বীনের একটি মাত্র বিধানকে অমান্য করলে যেখানে মানুষের ইমান থাকে না, তাহলে যে শাসনব্যবস্থা পুরো রাষ্ট্র থেকে দ্বীনকে আলাদা করে দিয়েছে এবং স্লোগান তুলছে, ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবারসেটার কী অবস্থা হবে? শুধু এতটুকুই-ই নয়; বরং নিজেদের স্বপক্ষে কুরআনের এ আয়াত থেকে অপব্যাখ্যার মাধ্যমে দলিলও পেশ করা হচ্ছে যে, لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِদ্বীনের ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই’ [সুরা আল-বাকারা : ২৫৬]; অথচ এটার সাথে তাদের দাবির কোনোই সম্পর্ক নেই। এরকম একটি নয় দুটি নয়; বরং দ্বীনের শত শত বিধানকে অপব্যাখ্যা ও অমান্য করা হচ্ছে। শুধু অমান্য করা হচ্ছে এমনটিই নয়; বরং গণতান্ত্রিক পন্থায় সবকিছু করেও দাবি করা হচ্ছে, মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চলছে। যে ক্ষমতায় যায় সে-ই বলছে, আমরা কুরআন সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করিনি এবং সামনেও করব না; অথচ প্রচলিত আইনব্যবস্থায় কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী অসংখ্য আইন বিদ্যমান রয়েছে। বরং পুরো সিস্টেমটাই কুফরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যদি শরিয়তের একটি বিধান প্রত্যাখ্যান করার কারণে তা সুস্পষ্ট কুফর বলে গণ্য হয়, তাহলে সিস্টেমগতভাবে এবং অসংখ্য শারয়ি বিধানকে অমান্য ও নিষিদ্ধ করার পরও কি এ গণতন্ত্র কুফরি তন্ত্র বলে বিবেচিত হবে না?! কিয়াস ও যুক্তি তো এটাই বলে যে, এটা নিঃসন্দেহে কুফরি ব্যবস্থা বলে বিবেচিত হবে।

    সংখ্যাগরিষ্ঠতা কি হকের মানদণ্ড?
    গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা-ই হচ্ছে সকল সিদ্ধান্তের মানদণ্ড। এ ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকেই সকল জনগণের মত হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, আইন প্রণয়ন করা, প্রতিনিধি নির্বাচন করা, সরকারের ইতিবাচক বা নেতিবাচক অবস্থা যাচাই করা-সহ সকল ক্ষেত্রেই যেদিকে বেশি ভোট পড়ে, সেটিই সঠিক বলে বিবেচনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে জ্ঞানী ও অশিক্ষিত লোকদের মতামত এক পাল্লায় মাপা হয়। এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতেই আল্লাহ তাআলার হালাল বিধানকে হারাম আর হারাম বিধানকে হালাল করা হয়। পক্ষান্তরে ইসলামের দৃষ্টিতে যদি দুনিয়ার সকল মানুষও একত্রিত হয়ে কোনো হারামকে হালাল হওয়ার পক্ষে মত দেয়, তবুও তা কোনোদিন হালাল হবে না এবং তা গ্রহণ করা যাবে না।

    গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতার অপব্যবহার :
    পশ্চিমা রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন ধর্ম থেকে তাদের জীবনকে আলাদা করে ফেলল, তখন সে তার নিজের সিদ্ধান্তকে আল্লাহর হুকুমের চেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল। তাদের সিদ্ধান্তের মূল চালিকাশক্তি হয়ে গেল লাভ-লোকসান। তারা ভালো-মন্দ, পছন্দ-অপছন্দ কোনো কিছু করা কিংবা না করা, সকল কিছু নির্ধারণ করতে লাগল লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে। এভাবে তারা আল্লাহর সন্তষ্টি বাদ দিয়ে চারটি মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে। মানদণ্ড চারটি হলো :
    ক. বিশ্বাসের স্বাধীনতা
    খ. মত প্রকাশের স্বাধীনতা
    গ. মালিকানার স্বাধীনতা
    ঘ. ব্যক্তি স্বাধীনতা

    বিশ্বাসের স্বাধীনতা :
    গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষকে বিশ্বাসের স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ এ ব্যবস্থার আওতায় কোনো মানুষ যেকোনো কিছুকে আকিদা বা বিশ্বাস হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। যেকোনো কিছুর ওপর ঈমান আনতে পারে কিংবা যেকোনো বিশ্বাস প্রত্যাখ্যানও করতে পারে। একজন মানুষ আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা হিসাবে স্বীকার করতেও পারে আবার ইচ্ছে করলে না-ও করতে পারে। অনুরূপ একজন মানুষ চাইলে নামাজ পড়তে পারে, আবার চাইলে সে মূর্তিপূজায়ও অংশগ্রহণ করতে পারে। এ হচ্ছে তার বিশ্বাসের স্বাধীনতা। আজকাল গণতন্ত্র চর্চার ফলে আমাদের সমাজে এ প্রভাব স্পষ্টভাবেই লক্ষ করা যাচ্ছে। যেমন অনেক মুসলিম যুবক শবে কদরে সারারাত জেগে ইবাদত করে, আবার পহেলা বৈশাখে মঙ্গল প্রদীপের নামে অগ্নিপূজাও করে। একইভাবে তারা যেমন ঈদের নামাজে দলবেঁধে শামিল হয়, তেমনই দুর্গাপূজাকে সর্বজনীন বলে তাতেও অংশগ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটাই স্বাভাবিক। যেমন আমাদের দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের শীর্ষ এক নেতা বিগত ১৩ জুলাই ২০১১ এক অনুষ্ঠানে বলেছিল, ‘আমি হিন্দুও নই, মুসলমানও নই।সে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিজের জীবনব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করেছে বলেই তার আকিদার স্বাধীনতা থেকে এ কথাগুলো বলতে পেরেছে। অর্থাৎ এ ব্যবস্থায় যে কেউ তার আকিদা-বিশ্বাস পরিবর্তন করতে পারে।

    মত প্রকাশের স্বাধীনতা :
    মত প্রকাশের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি। এ ব্যবস্থায় কোনো ব্যক্তি যে সকল চিন্তা-চেতনা ধারণ করে, তা সে প্রকাশ করার অধিকার রাখে এবং এ মতের দিকে অন্যদেরকেও আহ্বান করতে পারে। এ ব্যাপারে সে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে। এ ক্ষেত্রে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই।
    গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রায়শই অন্য মত বা ব্যক্তি আক্রমণের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। গণতন্ত্রপন্থীরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার আশ্রয় গ্রহণ করে নানা অপকর্ম করে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ভারতীয় বংশদ্ভুত সালমান রুশদি satanic verses লিখে ইসলামকে আক্রমণ করেছিল এবং এটাকে তার মত প্রকাশের অধিকার বলে চালিয়ে দিয়েছিল। পশ্চিমা মিডিয়াগুলোও জিগির তুলেছিল যে, সে তার মতামত প্রকাশের অধিকার রাখে। একইভাবে ডেনমার্কের কার্টুনিস্ট এবং আমাদের দেশের প্রথম আলো পত্রিকা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করে এটাকে তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলে প্রচার করেছিল। এভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা মূলত ভিন্নমত বা বিশ্বাসকে আক্রমণ করার অবাধ স্বাধীনতা প্রদান করে।
    পক্ষান্তরে ইসলামের দৃষ্টিতে, মুসলিমদের সকল মতামত ও চিন্তা-বিশ্বাস শরিয়তের আলোকে হতে হবে। ইসলামি শরিয়াহ অনুমোদন করে নাএমন কোনো মতামত বা চিন্তা-বিশ্বাস মুসলিমরা রাখতে পারবে না। কেউ যদি সীমালঙ্ঘন করে, তাহলে তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

    মালিকানার স্বাধীনতা :
    গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেহেতু অবাধ ব্যক্তি মালিকানার স্বাধীনতা আছে এবং এর মূল বিশ্বাসই হচ্ছে, যেকোনো উপায়ে অধিক পরিমাণ লাভ পাওয়া, তাই এ ব্যবস্থায় কেউ ইচ্ছা করলে প্রচুর পরিমাণ পণ্য মজুদ করে পণ্যের দাম বাড়িয়েও ব্যবসা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কাছে সে কোনো অপরাধী নয়।
    পক্ষান্তরে ইসলাম জনগণের ভোগান্তি হতে পারেএমন সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। কেউ এরকম কোনো কাজ করলে রাষ্ট্র তাকে প্রতিহত করবে এবং প্রয়োজনে তাকে শাস্তি প্রদান করবে।

    ব্যক্তি স্বাধীনতা :
    গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বাধীনতা কোনো ব্যক্তিকে সকল প্রকার বিধিনিষেধ থেকে অবাধ স্বাধীনতা প্রদান করে। এ ব্যবস্থায় ব্যক্তি হচ্ছে মুখ্য। এ স্বাধীনতার ফলে সে যেভাবে জীবনের চাহিদা মেটাতে পছন্দ করে, সেভাবে তা উপভোগ করবে এবং সেখান থেকে কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না। অবাধ ব্যক্তি স্বাধীনতার ফলে পশ্চিমা সমাজে যে অধঃপতিত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, এবারে তার গুটিকয়েক নমুনা তুলে ধরা যাক।
    এক. অবাধ যৌনাচার
    ব্যক্তি স্বাধীনতার ফলে পশ্চিমা সমাজে যৌনাচারের বিস্তার লাভ করেছে। কিশোর-কিশোরীরা যথেচ্ছা যৌনাচারে লিপ্ত হলেও মা-বাবারও কিছু করার থাকে না। কারণ, এ অধিকারটি তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতার আওতায় পড়ে। পশ্চিমা দেশের রাস্তা-ঘাটে, পার্কে, বাসে, অনুষ্ঠানে, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী-পুরুষের জড়াজড়ি, আলিঙ্গন ও চুম্বন মহড়া কারও দৃষ্টির তোয়াক্কা করে না। তারা নগ্ন হয়ে চলাফেরা করতে পারে, মাতাল হতে পারে, অনেক নারী-পুরুষ একত্রে একই স্থানে একই সময়ে যৌনাচারে লিপ্ত হতে পারে, যা বনের জীব-জানোয়ারকেও হার মানায়। অস্ট্রেলিয়াতে এক বাবা তার মেয়েকে সাত বছর আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে, যা অনেকেই মিডিয়াতে লক্ষ করেছেন। এটা হলো তার ব্যক্তি স্বাধীনতা। তাকে কেউ বাধা দিতে পারবে না; এমনকি তাদের অনেকে নিজের মা-বোন ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে পর্যন্ত যৌনাচার করে থাকে। নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক।
    পক্ষান্তরে ইসলামি জীবনব্যবস্থায় মানুষ কীভাবে তাদের যৌন চাহিদা মেটাবে, তার জন্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে এবং ইসলাম মিলনের ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা প্রদান করেছে। হয় তাকে বিবাহ করতে হবে, নয়তো কোনো দাসীর মালিকানা অর্জন করতে হবে। এ দুই পদ্ধতি ব্যতীত অন্য কোনো সম্পর্কের ভিত্তিতে নারী-পুরুষ একান্তে মিলিত হতে পারবে না। এ শৃঙ্খলা রক্ষায় ইসলাম কঠোর শাস্তির বিধান আরোপ করেছে।
    দুই. সমকামিতা
    যেহেতু গণতন্ত্র ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করে, তাই পশ্চিমা পার্লামেন্ট আজ তাদের বিকৃত চাহিদা মেটানোর জন্য সমকামী বিবাহের বৈধতা দান করেছে। নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক। আর এটি এখন বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের স্বাভাবিক আচরণে পরিণত হয়েছে। এমনকি আজ পশ্চিমা সমাজ বর্বরতার এমন স্তরে গিয়ে উপনীত হয়েছে যে, তারা কুকুর, বিড়াল ও বিভিন্ন পশুর সাথে নিজেদের প্রবৃত্তির চাহিদা মেটাতেও দ্বিধাবোধ করে না।
    পক্ষান্তরে ইসলাম এই গর্হিত কাজকে কঠিনভাবে ঘৃণা করে। এমনকি শরিয়াহ তার জন্য যথাযথ ও কঠোর শাস্তির বিধান রেখেছে। পূর্ববর্তী একাধিক জাতিকে আল্লাহ তাআলা এ জঘন্য অপরাধের কারণে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
    তিন. লিভ টুগেদার
    পশ্চিমা ব্যবস্থায় আজ ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে চলছে লিভ টুগেদারের রমরমা প্রচলন। পবিত্র বিবাহব্যবস্থাকে ঝামেলাপূর্ণ মনে করে অনেক মানুষ এখন বিবাহ ছাড়াই এক ছাদের নিচে রাত কাটাচ্ছে। যখন প্রয়োজন ফুরিয়ে যাচ্ছে, তখন প্রত্যেকে যার পথ সে বেছে নিচ্ছে। এভাবে বৈবাহিক জীবনকে তাদের সমাজব্যবস্থা থেকে ছুঁড়ে ফেলায় তাদের বার্ধক্যে কোথাও ঠাঁই মিলছে না। একপর্যায়ে হতাশায় কেউ আত্মহত্যা করছে, কেউ ইউগার ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করছে আর কেউ বা পথে পথে ঠোকর খেয়ে ফিরছে।
    পক্ষান্তরে ইসলাম দাসীর মালিকানা ও বিবাহ বহির্ভূত সকল যৌন সম্পর্ককে কঠিনভাবে নিষেধ করেছে। এর জন্য ভয়ানক শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছে। শরিয়ায় বিভিন্নভাবে বিবাহের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে এবং এর অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। আর তাই বিচ্ছিন্নভাবে গোপনে কিছু লিভ টুগেদারের ঘটনা ঘটলেও আজও মুসলিম সমাজকে প্রকাশ্যে এ ভাইরাস সংক্রমণ করতে পারেনি। এরকম গর্হিত একটি ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে মুসলিমদের কলুষিত করতে পারেনি।

    ফিরআউনি ব্যবস্থার আধুনিক সংস্করণ :
    এ বিষয়টি আজ উপলদ্ধি করা বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে যে, ফিরআউন প্রথমদিকে ছিল একজন সাধারণ রাষ্ট্রপ্রধান। সে অন্যান্য রাজা-বাদশাদের মতোই জুলুম-ইনসাফ মিলিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সে দীর্ঘমেয়াদি রাজত্ব পেলে তাকে অহংকার পেয়ে বসল। ফলে সে নিজের জন্য সার্বভৌমত্ব দাবি করে নিজেকে জনগণের রব ঘোষণা করল। শুধু রবই নয়; বরং সবচেয়ে বড় রব হিসেবে নিজেকে জাহির করল।
    কুরআনের মাধ্যমে ফিরআউনের কাহিনী আমাদের নিকট পেশ করার কারণ হলো, আমরা যেন এমন কোনো রাজা-বাদশাকে বা এমন কোনো ব্যবস্থাপনাকে না মানি, যারা সার্বভৌমত্বের দাবি করে বসে। আমরা যেন ফিরআউনের মতো কোনো শাসককে মেনে শিরকে নিপতিত না হয়ে যাই। কারণ, আল্লাহ তাআলার পরিবর্তে অন্য কারও সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়ার মানেই হচ্ছে তাকে রব বলে স্বীকার করে নেওয়া। যদি ফিরআউনকে মানলে শিরক হয়, তাহলে এ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মানলেও শিরক হবে। মুসলিমরা এসব নব্য ফিরআউনদের অনুসরণ করে যাতে আবার শিরকের মধ্যে হাবুডুবু না খায়, তা থেকে সর্তক করার জন্যই আল্লাহ তাআলা ফিরআউনের কাহিনী আমাদের কাছে পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। আজ গণতন্ত্ররূপী নব্য ফিরআউনবাদ জনগণকে আল্লাহর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যা নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল করলে অনেকখানি-ই স্পষ্ট হয়ে যাবে। বিষয়গুলো হলো :
    ১. ইসলাম আল্লাহর দেওয়া পূর্ণাঙ্গ একটি জীবনব্যবস্থা। পক্ষান্তরে গণতন্ত্র হচ্ছে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের তৈরি ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ ব্যবস্থা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
    الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
    আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি, তোমাদের ওপর আমার নিয়ামতের পূর্ণতা দান করেছি এবং দ্বীন হিসেবে তোমাদের জন্য ইসলামকে মনোনীত করেছি।’ [সুরা আল-মায়িদা : ৩]
    ২. ইসলামি শরিয়তে সর্ব বিষয়ে যাবতীয় ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা। পক্ষান্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণই হলো সকল ক্ষমতার অধিকারী, যা জনগণের নির্বাচিত সাংসদদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
    لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
    আসমানসমূহ ও জমিনের সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁরই; তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান; আর তিনিই সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।’ [সুরা আল-হাদিদ : ২]
    ৩. ইসলামে আইনের উৎস হলো কুরআন-সুন্নাহ। পক্ষান্তরে গণতন্ত্রে আইনের উৎস হলো অধিকাংশ মানুষের বিবেকপ্রসূত রায় ও মতামত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
    إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ
    বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই।’ [সুরা ইউসুফ : ৪০]
    আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন :
    أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ
    জেনে রাখো, সৃষ্টি করা এবং নির্দেশদান একমাত্র তাঁরই কাজ।’ [সুরা আল-আরাফ : ৫৪]
    ৪. ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহর অবতীর্ণকৃত বিধানানুসারে যারা বিচার-ফয়সালা করে না, তারাই কাফির, তারাই জালিম, তারাই ফাসিক। পক্ষান্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলছে, কোর্ট-কাচারিতে দেশের মানবরচিত সাংবিধানিক আইন চলে, এখানে আল্লাহর আইন ও বিচারব্যবস্থা কার্যকর নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন :
    وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
    যেসব লোক আল্লাহর অবতীর্ণকৃত বিধানানুসারে বিচার-ফয়সালা করে না, তারাই কাফির।’ [সুরা আল-মায়িদা : ৪৪]
    আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :
    وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
    যেসব লোক আল্লাহর অবতীর্ণকৃত বিধানানুসারে বিচার-ফয়সালা করে না, তারাই জালিম।’ [সুরা আল-মায়িদা : ৪৫]
    আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :
    وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
    যেসব লোক আল্লাহর অবতীর্ণকৃত বিধানানুসারে বিচার-ফয়সালা করে না, তারাই ফাসিক।’ [সুরা আল-মায়িদা : ৪৭]
    ৫. ইসলামের শিক্ষা নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ। আর গণতন্ত্রের শিক্ষা ব্যক্তিস্বার্থ ভোগবাদ। সহিহ বুখারির বর্ণনায় এসেছে, আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
    لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ
    তোমাদের কেউ (প্রকৃত) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য সেটাই পছন্দ করবে, যা তার নিজের জন্য পছন্দ করে।

    [সহিহুল বুখারি : ১/১২, হাদিস নং ১৩, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত]
    ৬. ইসলামে তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস এবং আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করা অপরিহার্য। পক্ষান্তরে গণতন্ত্রে আল্লাহর অস্তিত্ব উপেক্ষিত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
    وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ
    আর তাদের একমাত্র এক আল্লাহরই ইবাদত করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ (ইবাদতের উপযুক্ত) নেই। কাফিররা যেসব অংশীদার সাব্যস্ত করে তিনি তা থেকে পবিত্র।’ [সুরা আত-তাওবা : ৩১]

    চলবে ইনশাআল্লাহ...

    ✍️
    Collected‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬

    ‘যার গুনাহ অনেক বেশি তার সর্বোত্তম চিকিৎসা হল জিহাদ’-শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.

  • #2
    গণতন্ত্র ও নির্বাচন : কিছু নিবেদন (ভূমিকা পর্ব)
    ‘যার গুনাহ অনেক বেশি তার সর্বোত্তম চিকিৎসা হল জিহাদ’-শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.

    Comment


    • #3
      ধিক্কার এই নিকৃষ্ট গনতন্ত্রের উপর । মূলত তাদের ধর্ম ছিল ভ্রান্ত এবং তারা ধর্মের গন্ডি থেকে বের হয়ে যে মতাদর্শ গ্রহন করেছে তাও ছিল ভ্রান্ত। তাই এর থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হল ইসলামতন্ত্র। তাই তাদের ভয় হল মানুষ এর ফলে ইসলামের দিকে ধাবিত হয়ে যায় কিনা তাই তারা ইসলামের এই মহান আদর্শকে তাদের নিকৃষ্ট আদর্শের সাথে তুলনা করে বাদ দিতে চাইছে।
      পৃথিবীর রঙ্গে রঙ্গিন না হয়ে পৃথিবীকে আখেরাতের রঙ্গে রাঙ্গাই।

      Comment

      Working...
      X