আল হিকমাহ মিডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত
দাওয়াতের পদ্ধতি ও জিহাদী মানহাজের হেফাযত
শাইখ উসামা মাহমুদ হাফিযাহুল্লাহ.
এর থেকে
পর্ব- ৯
==================================================
===============================
দাওয়াতের তরিকার মধ্যে বাড়াবাড়ি কেন সৃষ্টি হয়?
দাওয়াতের পদ্ধতি ও জিহাদী মানহাজের হেফাযত
শাইখ উসামা মাহমুদ হাফিযাহুল্লাহ.
এর থেকে
পর্ব- ৯
==================================================
===============================
দাওয়াতের তরিকার মধ্যে বাড়াবাড়ি কেন সৃষ্টি হয়?
তৃতীয় কারণ: মুদারাত (সৌজন্য) ও মুদাহানাতের (খোশামোদ, চাটুকারিতা) মাঝে পার্থক্য না করা
দাওয়াতের মাঝে গুলুর আরেকটি কারণ হলো, মুদারাত ও মুদাহানাতকে এক মনে করা। অথচ উভয়ের মাঝে পার্থক্য আছে। একটি জায়েয এবং প্রশংসনীয়, অন্যটি নিন্দনীয়। ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ মুদারাত ও মুদাহানাতের মাঝে পার্থক্য এভাবে বর্ণনা করেছেন: “মুদারাত হলো দুনিয়া বা দ্বীন অথবা উভয়টির ফায়দার জন্য দুনিয়াবি কোনো কিছু ত্যাগ করা। যা জায়েয, অনেক সময় মুস্তাহাব কিন্তু মুদাহানাত হলো দুনিয়ার জন্য দ্বীনকে ত্যাগ করা। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে:
মানুষের সাথে সৌজন্য আচরণ সদকা (তাবারানী)
শারেহ ইবনে বাত্তাল রহিমাহুল্লাহ বলেন: “সৌজন্য মুমিনের আখলাকের অংশ। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মানুষের সামনে নিজের কাঁধ ঝুঁকিয়ে দেয়া। কথাবার্তায় তাদের সাথে শক্ত ব্যবহার না করা। এই গুণ নিঃসন্দেহে ভালোবাসা মহব্বত সৃষ্টির একটি উত্তম মাধ্যম”।
সুতরাং শ্রোতার বিরোধিতায় ধৈর্য ধারণ করা, দাওয়াতের জন্য নরম-কোমল ও উপকারী পদ্ধতিতে হকের দিকে আহবান করা এবং শ্রোতার ভ্রান্ত মতকে কোনভাবেই সঠিক না বলা -এটা মুদারাত, এটা প্রশংসনীয়। কিন্তু যদি এই নরম ব্যবহারের সাথে বাতিলকে হক বলা হয়, তখন সেটা মুদাহানাত, এটা নিষেধ। এজন্যে দাঈর মুদারাত-মুদাহানাতের সীমারেখা বোঝা উচিৎ। যাতে মুদারাতের নাম দিয়ে মুদাহানাতে লিপ্ত না হয়। অথবা মুদাহানাতের বিরোধিতা করতে গিয়ে মুদারাতও পরিত্যাগ না করে।
আফসোস! আজ কিছু দ্বীনদার শ্রেণি দাওয়াতে বিচক্ষণতার নাম দিয়ে গণতন্ত্র, স্বদেশপ্রেম, সেক্যুলারিজ্যমকে পর্যন্ত সমর্থন করে। অথচ কুফুরি শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বিরোধিতা কাম্য। কিন্তু এই হযরতরা তাদের সাথে সমঝোতা ও সহযোগিতামূলক আচরণ করে। আর যদি কেউ ফরজ ডাকে ‘লাব্বাইক’ বলে বাতিল শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় এবং এই নিকৃষ্ট পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন তারা তাকে ফাসাদ সৃষ্টিকারী বলে অভিহিত করে। এই গণতন্ত্র ও অন্যান্য মানুষ নির্মিত মতবাদে অংশগ্রহণ ও সমর্থন শরীয়তের খেলাফ কাজ?
কিন্তু আশ্চর্য! এসব অনৈসলামিক কাজকেও দীনী মাছলাহাত নাম দিয়ে ইসলামি কাজ বলে প্রমাণিত করা হচ্ছে। এটা স্পষ্ট মুদাহানাত। এটাই ঐ মহাবিপদ যার কারণে আজ আল্লাহর শরিয়ত পরাজিত, আর গাইরুল্লাহর আইন বিজয়ী।
সুতরাং এই মুদাহানাতের পরিচয় মানুষের সামনে তুলে ধরা এবং তার বিরোধিতা করা অত্যন্ত জরুরি। আর মুজাহিদদেরও উচিৎ সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা যাতে তাদের মধ্যে কোনভাবে এই মহামারী প্রবেশ না করে। আরেকদিকে এই মুদাহানাতের বিরোধিতা করতে করতে আমাদের কোন কোন কাফেলা মুদারাতকেও মুদাহানাত মনে করা শুরু করছে।
দাওয়াতের ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি হল বাতিলকে সরাসরি বাতিল বলা এবং হককে হক বলা। তারপর হকের দিকে দাওয়াত দেয়া এবং পুরো দাওয়াতি আমল শরিয়ত অনুযায়ী করা। এই দাওয়াত নরম ও কোমল পদ্ধতিতে হেকমত অনুযায়ী হয়। মানসিকতার ভিন্নতার কারণে এই ধরণের দাওয়াত কারও কারও কাছে মুদাহানাত মনে হয়। তার কাছে এই দাওয়াত গ্রহণযোগ্য নয়। তার মানসিক শান্তি তখনই হয়, যখন দাওয়াতের প্রাণ ও ভাষা উভয় দিক থেকে খুব শক্ত হয়।
যে দাওয়াতের মধ্যে শ্রোতার প্রতি কোন কল্যাণকামিতা বা দরদ ব্যাথা থাকে না বরং হিংসা, ঘৃণা, শত্রুতা ও খাটো করা হয় সেটা তার কাছে দাওয়াতের উত্তম পদ্ধতি মনে হয়। ভিন্ন এই মানসিকতার কারণে এই সমস্ত কাজকে সে হকের তাকাযা মনে করে। অথচ এটা গুলু বা বাড়াবাড়ি । এর কারণে দাওয়াতের উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যায় এবং জিহাদের উল্টা ক্ষতি হয়।
চতুর্থ কারণ: তাড়াহুড়া এবং দাওয়াতের ইতিহাস বিষয়ে অজ্ঞতা
দাওয়াতের তরিকার মধ্যে কঠোরতার বড় একটি কারণ হলো তাড়াহুড়া প্রবণতা। অনেক সময় ভালো ভালো মানুষও এর শিকার হয়ে যায়। যখন সে দেখে যে, দ্বীনদার শ্রেণি; বিশেষ করে ওলামায়ে কেরাম এবং দ্বীনী রাজনৈতিক দলগুলো তার সাথে নেই, তারা নীরব ভূমিকা পালন করে অথবা তার সাথে কোন বিষয়ে মতবিরোধ করে, তখন তার ধৈর্য ছুটে যায়। এর ফলে দাওয়াতে কঠোরতা সৃষ্টি হয়ে যায়।
আমাদের সামনে যদি আমরা দাওয়াতের ঐতিহাসিক বাস্তবতা রাখি, তাহলে এই কঠোরতা করবো না। বাস্তবতাটা হলো, যখনই এমন কোন বিপ্লবের সূচনা হয়েছে যার দ্বারা পূর্বের শাসনব্যবস্থা উল্টে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সে দাওয়াতে মানুষের অংশগ্রহণ সহজ নয়। বর্তমানে আমাদের দাওয়াত কবুল করা শাসন ব্যবস্থার সাথে লড়াই করা সমস্ত বিপদকে ডেকে আনার মতো ।
এজন্য এই ধরণের দাওয়াতের ফলে মানুষ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে যায়।
১. সত্যসন্ধানী, সুউচ্চ মনোবলসম্পন্ন মানুষই এই দাওয়াতে ‘লাব্বাইক’ বলে। এরা নিজেই নিজের ওপর মুসিবতের পাহাড় বহন করার জন্য সামনে অগ্রসর হয়। এই শ্রেণি সর্বদা স্বল্পসংখ্যক হয়।
২. দ্বিতীয় শ্রেণি তারা যারা নেতৃত্বের আসনে থাকে অথবা যারা প্রচলিত ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত থাকে। এই শ্রেণি এই আন্দোলনের বিরোধিতা করে এবং এটাকে নির্মূল করার জন্য মাঠে নেমে আসে।
৩. তৃতীয় শ্রেণি, যারা স্বাভাবিক জীবনযাপনে নিমজ্জিত। এদের অনেকেই হক-বাতিলের মাঝে পার্থক্য করার ইচ্ছা রাখে এবং হকের সাথে থাকতে আগ্রহী। কিন্তু তাদের ক্ষমতাসীনদের ভয় প্রবল। এজন্য অনেক লাভকে ছেড়ে দেয়া এবং বহু ক্ষতি গ্রহণ করতে তাদের মন তৈরি হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত এই আন্দোলন শক্তিশালী না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তার মধ্যে এই আন্দোলনকে গ্রহণ করার জযবা তৈরি হয় না। সে অবস্থা পরিবর্তনের অপেক্ষায় থাকে। যখন এই আন্দোলন শক্তিশালী হওয়া শুরু করে তখন এই শ্রেণি দলে দলে সাহায্য করা ও সমর্থন দেওয়ার জন্য অগ্রসর হয়।
এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত ও তাঁর দাওয়াতি কাফেলার ইতিহাস। যতক্ষণ পর্যন্ত মক্কার মুশরিকদের শক্তি খর্ব না হয়েছে ততদিন মুসলমানের সংখ্যা কম ছিলো। এরপর যখন মক্কা বিজয় হলো তখন দলে দলে মানুষ মুসলমান হওয়া শুরু হলো।
إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّـهِ وَالْفَتْحُ ﴿١﴾ وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّـهِ أَفْوَاجًا
অর্থ: যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে (১) এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন, (২) [সূরা আন-নাসর ১১০:১-২]
সুতরাং সংখ্যাধিক্য, সেটা সাধারণ মানুষের হোক বা দ্বীনদার শ্রেণির হোক, তাদের নীরব অবস্থান বা কিছু বিরোধিতা দেখে জিহাদের দাঈ ধৈর্যহীন হবে না। এটা কখনই হয়নি যে, জিহাদি আন্দোলন কঠিন স্তর পার করছে আর সমাজের অধিকাংশ মানুষ তাদের সাথে আছে। সুতরাং আমাদের এই সংখ্যাধিক্যের সাথে (خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ) ”ক্ষমাকে গ্রহণ করুন, সৎ কাজের নির্দেশ দান করুন এবং মূর্খদেরকে এড়িয়ে চলুন” এর ওপর আমল করতে হবে।
(খুযিল আফওয়া) অর্থাৎ যতটুকু সাহায্য ও কল্যাণকামিতা তারা আপনার সাথে করতে পারে কৃতজ্ঞতার সাথে তা গ্রহণ করুন। (ওয়া’মুর বিল উরফ) অর্থাৎ দরদের সাথে দাওয়াত, ইসলাহ, উৎসাহদান ও দিকনির্দেশনার কাজ চালু রাখুন। দলিল প্রমাণের মাধ্যমে তাদের বুদ্ধিকে কাবু করুন। তাদের মধ্য থেকে যারা (জবান ও কলম দ্বারা ) মূর্খতা প্রকাশ করে তাদেরকে এড়িয়ে যান। আপনার জ্ঞান, বুদ্ধি, অস্ত্র যেন কুফুরি শাসনব্যবস্থা নির্মূল করার কাছে ব্যয় হয়। অন্য কাজে যেন সময় নষ্ট না হয়।
আরও পড়ুন
Comment