আত তিবয়ান পাবলিকেশন্স মিডিয়া পরিবেশিত
“‘তাওহীদের পতাকাবাহীদের প্রতি।।
এর থেকে– সপ্তম পর্ব
“‘তাওহীদের পতাকাবাহীদের প্রতি।।
এর থেকে– সপ্তম পর্ব
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য মু’মিনদের পাথেয়
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, জান্নাতে যেতে হলে বা পৃথিবীতে আল্লাহর কালিমাকে বিজয়ী করার জন্য শত্রুর মুখোমুখি হতে হলে – একজন মুমিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্বল হলো আল্লাহর ইবাদত এবং তাঁকে বেশি বেশি স্মরণ করা। এমনকি সাহায্যকারী হিসেবে যদি কেউ নাও থাকে, তাহলেও চিন্তার কিছু নেই যদি সে আল্লাহর হক্ক অনুযায়ী তাঁর ইবাদত করে এবং স্মরণ করে। আল্লাহ অনেক আয়াতেই আমাদের আদেশ করেছেন সবর এবং সালাতের মাধ্যমে তার কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য। আর পরবর্তী এই আয়াতে তিনি আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে, যারা খাশিউন (সালাতে বিনম্র এবং অন্যান্য সব ইবাদতে অত্যন্ত বিনয়ী ও অনুগত) নয়, তাদের পক্ষে এভাবে সাহায্য চাওয়া খুবই কঠিন।
“তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর এবং ইহা বিনীতগণ ব্যতীত আর সকলের নিকট নিশ্চিতভাবে কঠিন।” (সূরা বাকারা ২:৪৫)
আমরা যদি সর্বক্ষণ আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে না থাকি, তাহলে আমরা কখনোই আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো না। আমরা যদি আমাদের বিপদ সংকুল পথ চলার জন্য পাথেয় জোগাড় করতে না পারি, তাহলে আমরা কখনোই আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবো না। “IN PURSUIT OF ALLAH’S PLEASURE” বইয়ের লেখক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, এগুলোকে এমনকি আমরা আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও বলতে পারি। লেখক বলেছেনঃ “প্রত্যেক মুসাফিরেরই তার যাত্রার জন্য কিছু পাথেয় প্রয়োজন হয়। পথ যত দীর্ঘ, যত কঠিন হবে আর যত বেশি আত্মত্যাগ দরকার হবে- ঠিক তত বেশি পাথেয় প্রয়োজন। আমাদের সবসময় আল্লাহর কাছ থেকে সাহায্য এবং নির্দেশনা দরকার, আল্লাহর আমাদের কাছ থেকে কিছু দরকার নেই। বরং সব বিষয়েই আমাদের তাঁকে প্রয়োজন।”
“যখন যুবকরা গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল তখন তারা বলেছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি নিজ হতে আমাদেরকে অনুগ্রহ দান কর এবং আমাদের জন্য আমাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা কর।” (সূরা কাহাফ ১৮:১০)
আমাদের প্রতি মুহূর্তেই আল্লাহর ইবাদত এবং তাঁর স্মরণে লিপ্ত থাকতে হবে, কারণ এছাড়া আমাদের পক্ষে শত্রুর মোকাবেলা করা বা দুনিয়ার কোন পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়া সম্ভব না। ইবাদত এবং জিকিরের মাধ্যমে, সবর এবং সালাতের সাথে সাহায্য চেয়ে, তাহাজ্জুদ এবং কান্নার সাথে আমাদের আল্লাহর কাছে চাইতে হবে, (যিনি সামিউদ দু’আ) যেন তিনি দুনিয়ার সব কষ্ট আমাদের জন্য সহজ করে দেন এবং আমাদের দ্বীনের উপর দৃঢ় রাখেন।
“মু’মিন তো তারাই যাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন তার আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন উহা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপরই নির্ভর করে।” (সূরা আনফাল ৮:২)
“হে আমাদের প্রতিপালক! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্য লংঘনপ্রবণ করও না এবং তোমার নিকট হতে আমাদেরকে করুণা দাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ ওয়াদা খেলাফ করেন না।” (সূরা আলি ’ইমরান ৩:৮)
“যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুইয়ে আল্লাহর স্মরণ করে এবং আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বদ্ধে চিন্তা করে ও বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি ইহা নিরর্থক সৃষ্টি কর নাই, তুমি পবিত্র, তুমি আমাদেরকে অগ্নিশাস্তি হতে রক্ষা কর।” (সূরা আলি ’ইমরান ৩:১৯১)
“হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; প্রত্যেকেই ভাবিয়া দেখুক আগামী কলের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠাইছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত। আর তোমরা তাদের মত হইও না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করেছেন। উহারাই তো পাপাচারী।” (সূরা হাশর ৫৯:১৮-১৯)
“যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের চিত্ত প্রশান্ত হয়; জানিয়া রাখ, আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়।” (সূরা রা’দ ১৩:২৮)
এবং কারারুদ্ধ এই শাইখ (আল্লাহ তাকে রক্ষা করুন, পুরস্কৃত করুন এবং শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করুন) আরো বলেছেন, “আল্লাহকে তাঁর হক্ব অনুযায়ী ইবাদত করা ছাড়া বান্দার পক্ষে কখনোই শিরক এবং মুশরিকদের মুখামুখি হওয়া, তাদের প্রতি বারা প্রদর্শন এবং তাদের মিথ্যাচারের প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন সম্ভব না, সর্বশক্তিমান, মহামহিম আল্লাহ তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ ﷺ-কে মক্কায় অবস্থানকালে কুরআন তেলাওয়াত এবং তাহাজ্জুদের আদেশ দিয়েছিলেন। এবং তিনি শিখিয়েছিলেন যে দাওয়াহ বহন করার জন্য এটা তার প্রতিরক্ষা এবং সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করবে। এবং এই আদেশ (তাহাজ্জুদের) এসেছিল যে আয়াতে তা হলোঃ
“হে বস্ত্রাবৃত! রাত্রি জাগরণ কর, কিছু অংশ ব্যতীত, অর্ধ রাত্রি কিংবা তদপেক্ষা অল্প অথবা তদপেক্ষা বেশী। আর কুরআন পাঠ কর ধীরে ধীরে ও সুস্পষ্টভাবে; আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুভার বাণী।” (সূরা মুযযাম্মিল ৭৩:১-৫)
সুতরাং তিনি ﷺ এবং তাঁর সাহাবারা (সালাতে) দাঁড়ানো শুরু করলেন – তারা এত সময় ধরে সালাতে দাঁড়াতেন যে তাদের পা ফেটে যেত। তারা এই অভ্যাস অব্যাহত রাখেন যতদিন না আল্লাহ এ ব্যাপারে কিছু ছাড় দেন। আর এই দাঁড়ানো, তিলাওয়াত এবং সেইসাথে আল্লাহর বাণীর কথা স্মরণ করা-এগুলোই হলো একজন দা’য়ীর জন্য শ্রেষ্ঠ সুরক্ষা এবং সহায়তা, যা তাকে দাওয়ার সমস্ত সমস্যায় সাহায্য করে এবং প্রতিরোধ থেকে সুরক্ষা দেয়। আর কেউ যদি মনে করে যে, সে বিশুদ্ধ ইবাদত না করেই, বা দীর্ঘ সময় ধরে আল্লাহর স্মরণ ও তাসবীহ্ না করেই এই দাওয়াহ বহন করতে পারবে- তাহলে সে নিশ্চিতভাবেই ভুল করছে। এমনকি তারা যদি কোন উন্নতি করতেও পারে, তাহলেও কোন অবলম্বন ছাড়া তাদের পক্ষে এই সঠিক, সরল পথে থাকা সম্ভব হবে না। আর নিশ্চয়ই সবচেয়ে বড় অবলম্বন হলো তাক্বওয়া। সর্বশক্তিমান আল্লাহ এখানে দাওয়াহর বাহকদের কথা বর্ণনা করেছেন- যারা তাদের রবের সন্তুষ্টির জন্য তাকে সকালে ও সন্ধ্যায়, যারা রাতে সামান্যই ঘুমায়, যাদের পিঠ বিছানা স্পর্শ করে না, রবের ভয়ে এবং তাঁর দয়ার আশা নিয়ে যারা দুআ করে, যারা রবের পক্ষ থেকে এক ভয়াল দিনের ভয় করে, যাদের প্রতি আল্লাহ তাঁর রাসূল ﷺ-কে ধৈর্যধারণ করতে বলেছেন। আর যাদের এই গুণাবলী নেই, তাদের এই দাওয়াহ বহন করারও যোগ্যতা নেই। আল্লাহ আমাদের এদের অন্তর্ভুক্ত করে দিন, আমিন।
আর ‘In Pursuit of Allah’s Pleasure’ – বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ে লেখকরা উল্লেখ করেছেন, আমাদের পাথেয় হলোঃ (১) তাক্বওয়া (আল্লাহর ভয়) (২) ইলম (জ্ঞান) (৩) ইয়াক্বীন (নিশ্চিত বিশ্বাস) (৪) তাওয়াক্কুল (আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা) (৫) শোকর (কৃতজ্ঞতা) (৬) সবর (ধৈর্য) এবং (৭) যুহুদ (দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা না রাখা)। আমি প্রত্যেক ভাই ও বোনকে অনুরোধ করছি এই অধ্যায়টি খুব ভাল ভাবে পড়তে এবং আল্লাহ কাছে দু’আ করতে যেন তিনি এই জ্ঞান আমাদের অন্তরে গেঁথে দেন যাতে আমরা এটা কখনো ভুলে না যাই এবং তিনি যেন আমাদের জীবনে এই পাথেয়গুলো দিয়ে দেন যাতে আমরা সব পরীক্ষা পার হয়ে শুদ্ধ হতে পারি এবং আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি।
শ্রেষ্ঠ কাতারের মুসলিমদের এসব পাথেয় থাকে। আল্লাহ আমাদেরকে তাদের অন্তর্গত করুন এবং আমাদের আখিরাতকে নবী, সিদ্দিক, শহীদ এবং সালেহদের সাথে করুন।
“আর কেউ আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য করলে সে নবী, সত্যনিষ্ঠ, শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ – যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন – তাদের সংগী হবে এবং তারা কত উত্তম সংগী!” (সূরা নিসা ৪:৬৯)
ও আমার নাফস! এটা কিভাবে সম্ভব যে, তুমি তাদের সাথে থাকতে আগ্রহী, অথচ তারপরও কেন তুমি সেই সব কঠিন অবস্থা থেকে পালাতে চাচ্ছো যেসব অবস্থায় তাঁরা সম্পূর্ণ তাওয়াক্কুল এবং ঈমানের পরিচয় দিয়েছেন? এটা কিভাবে সম্ভব যে তুমি উনাদের সাথে থাকতে চাও, অথচ উনারা পার্থিব যেসব বস্তু ছুড়ে ফেলেছেন এবং পরিত্যাগ করেছেন সেগুলোই তুমি আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছো?
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “আমার উম্মাতের মধ্যে একটি অংশ (ত্বাইফা) কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর হুকুমের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। অপমানকারীর অপমান এবং বিরোধিতাকারীর বিরোধিতা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তারা মানুষের মাঝে বিজয়ী থাকবে।” (মুয়াবিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মুসলিম ১৩০)
রাসূল ﷺ বলেছেন, “আমার উম্মত থেকে একটি দল হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে প্রকাশ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে কিয়ামত পর্যন্ত।” (জাবীর বিন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, মুসলিম)
হে আল্লাহ, আমাদের এই কাতারে শামিল করে দিন যেমনটি আপনি আমাদেরকে আশা দিয়েছেন-
“এবং অল্প সংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্যে হতে।” (সূরা ওয়াকি‘য়াহ ৫৬:১৪)
পরীক্ষার সময় নিচের কাতারের মুসলিমদের অবস্থাঃ
এই কাতারের মুসলিম হলো তারা, যারা নিজেদের ফিতনা থেকে দূরে এবং শিরক থেকে বাঁচাতে একাকী নির্জনে বসবাস শুরু করে। জীবনের ন্যুনতম চাহিদা পূরণের জন্য যা দরকার, শুধু তাই নিয়ে সে পাপের এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও (যেমন, পাহাড়ে) গিয়ে একাকী আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকে। অথবা সে শুধু নিজের পরিবারকে আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করে; সে তাওহীদের উপর থাকে এবং তার মনে শিরক ও মুশরিকদের প্রতি ঘৃণাও থাকে – কিন্তু সাবেকুনদের তুলনায় তার ঈমানের দুর্বলতার কারণে সে এটা প্রকাশ্যভাবে প্রচার করতে পারেনা। সে পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে এবং সুযোগ পেলেই বেশি খারাপ স্থান থেকে হিজরত করে কম খারাপ স্থানে চলে যায় (যেমন, সাহাবাদের আবিসিনিয়ায় হিজরত)। এই শ্রেণীর মু’মিনরা মানুষের মাঝে নিজেদের দ্বীনকে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে না। তাই এরা ঐসব মু’মিনদের কাতারে থাকতে পারেনা যারা সব ধরনের মুনকার প্রতিরোধ করছে তাদের জিহ্বা দিয়ে, তাদের হাত দিয়ে, দাওয়াহ এবং জিহাদের মধ্যে দিয়ে। সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মু’মিন হলো তারা যারা মিল্লাতে ইবরাহীম অনুসরণ করে তাদের দাওয়াহ এবং দ্বীনকে উম্মুক্তভাবে প্রকাশ করে দেয় এবং শত্রুদের প্রতি তাদের বারা’আ, শত্রুতা এবং ঘৃণাও সুস্পষ্ট করে দেয়। সবচেয়ে উঁচু স্তরের ঈমান হলো মুনকারকে হাত দিয়ে পরিবর্তন করা, তার পরের স্তর হলো কথা দিয়ে তা পরিবর্তন করা এবং সবচেয়ে নিচু স্তর হলো মন থেকে ঘৃণা করা।
তবে এটা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য যে, এই মু’মিনরা নিজেদের ঈমানকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। যেহেতু অত্যাচার সহ্য করার বা কুফরী শক্তির বিরোধিতা করার সাধ্য তাদের নেই, সেহেতু তাওহীদ হারাবার ভয়ে তারা সেই সমাজ ত্যাগ করে। যদিও এই মু’মিনরা তাদের সমান নয় যারা কুফর এবং ফিতনার বিরুদ্ধে জিহাদ করছে তবুও অন্ততপক্ষে এরা ঐসব মানুষের চেয়ে ভালো যারা কাফিরদের মাঝেই বসবাস করছে, নিজের দ্বীনকে বিকৃত করে এবং অত্যাচারের ভয়ে কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব করে।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেছেনঃ “একটা সময় আসবে যখন একজন মুসলিমের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হবে তার ভেড়ার পাল, যা নিয়ে সে পাহাড়ের চূড়ায় চলে যাবে বা যেখানে বৃষ্টিপাত হয় সেখানে চলে যাবে, যাতে সে তার দ্বীনকে ফিতনা থেকে বাঁচাতে পারে।” (বুখারী)
আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “এমন এক ফিতনার সময় আসবে যখন একজন বসে থাকা মানুষের অবস্থা হবে দাঁড়ানো মানুষের চেয়ে ভালো, দাঁড়ানো মানুষের অবস্থা হবে হাটতে থাকা মানুষের চেয়ে ভালো, হাটতে থাকা মানুষের অবস্থা হবে ছুটন্ত মানুষের চেয়ে ভালো – আর যে কেউ এই ফিতনায় নিজেকে উন্মুক্ত করে দিবে, সেই ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই কেউ যদি এর থেকে বাঁচার মতো কোন জায়গা পায়, তাহলে সে যেন সেখানে আশ্রয় নেয়।” (বুখারী)
যে বাইরে বাইরে কুফর দেখালেও অন্তর থেকে সেটাকে ঘৃণা করে
এ রকম মানুষের অবস্থা দুইরকম হতে পারেঃ
(১) যাকে বাধ্য (ইকরাহ) করা হয়েছে
এটা হচ্ছে সেই ব্যক্তির অবস্থা, যাকে কাফিররা প্রচন্ডভাবে অত্যাচার করেছে এবং কুফরী কাজ না করলে বা কুফরী কথা না বললে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। এই অবস্থায় কেউ যদি বাইরে কুফর করে, তবে তার মনে দৃঢ় ঈমান থাকে – তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে না। যেমনঃ
“কেহতার উপর ঈমান আনার পর আল্লাহকে অস্বীকার করলে এবং কুফরীর জন্য হৃদয়উন্মুক্ত রাখলে তার উপর আপতিত হবে আল্লাহর গযব এবং তার জন্য আছে মহাশাস্তি; তবে তার জন্য নয়, যাকে কুফরীর জন্য বাধ্য করা হয় কিন্তু তার চিত্ত ঈমানে অবিচলিত।” (সূরা নাহল ১৬:১০৬)
তবে আলেমরা এমন ঘটনায় কুফরী না হওয়ার জন্য কিছু শর্ত দিয়েছেন। যদি এই শর্তগুলো অনুপস্থিত থাকে, তাহলে কেউ কুফরী কথা বা কাজ করলে সেই ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যাবে, এমনকি সে যদি নিজেকে নিরুপায় (’ইকরাহ’র কারণে) মনে করে এবং উপরের আয়াতের কারণে ছাড় পাওয়ার আশা করে তাহলেও।
শর্তগুলো হলোঃ
# তাকে অবশ্যই তার সমস্ত সামর্থ্য এবং সম্পদ দিয়ে এই অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে নিজের ঈমান বাঁচাতে চেষ্টা করতে হবে। তার যদি পালানোর উপায় থাকে, তাহলে অত্যাচারের এলাকায় সে থাকতে পারবে না। আসহাবে কাহাফের ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়-
“যখন যুবকরা গুহায় আশ্রয় নিল তখন তারা বলেছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি নিজ হতে আমাদেরকে অনুগ্রহ দান কর এবং আমাদের জন্য আমাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা কর।” (সূরা ইউনুস ১০:১৮)
“তোমরাযখন বিচ্ছিন্ন হলে ওদের হতে ও উহারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করেতাদের হতে তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যতাহার দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসূকরবার ব্যবস্থা করবেন।” (সূরা কাহাফ ১৮:১৬)
“এবং এইভাবেই আমি উহাদেরকে জাগরিত করলাম যাতে উহারা পরস্পরের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করে। উহাদের একজন বলল, তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ? কেহ কেহ বলিল, আমরা অবস্থান করেছি এক দিন অথবা একদিনের কিছু অংশ। কেহ কেহ বলিল, তোমরাকত কাল অবস্থান করেছ তা তোমাদের প্রতিপালকই ভালো জানেন। উহারা যদি তোমাদেরবিষয় জানতে পারে তবে তোমাদেরকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করবে অথবা তোমাদেরকেউহাদের ধর্মে ফিরাইয়া নিবে এবং সেক্ষেত্রে তোমরা কখনও সাফল্য লাভ করবে না।” (সূরা কাহাফ ১৮:২০)
আমরা যদি পালানোর সুযোগ পেয়েও পালানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা না করি, তাহলে এরপরে যদি কাফিররা আমাকে দিয়ে জোর করে কুফরী করায় – তাহলেও আমি কাফির হয়ে যাব।
# যে কাফির হত্যা বা অত্যাচারের হুমকি দিচ্ছে, তার পক্ষে এগুলো সত্যি সত্যিই করা সম্ভব এবং মুসলিম ব্যক্তিটির পক্ষে এটা থামানো সম্ভব না বা পালানোও সম্ভব না।
# মুসলিম ব্যক্তিটি নিশ্চিত যে, সে যদি কাফিরের কথামতো কুফরী কাজটি না করে তাহলে সে (ঐ কাফির) সত্যি সত্যিই তার হুমকি মতো মুসলিমটিকে হত্যা করবে।
# কাফির যে হুমকি দিচ্ছে সেটা তাৎক্ষনিক হতে হবে। যেমন, কাফির যদি বলে, “তুমি অমুক কাজ না করলে আমি আগামীকালই তোমাকে মারবো।” – তাহলে তার কথা শুনে কুফরী করলে আর ইকরাহর অজুহাত দেয়া যাবে না। অর্থাৎ ভবিষ্যতের কোন হুমকির মাঝে থাকাটা ইকরাহ হিসেবে গ্রহণযোগ্য অবস্থা না।
# অত্যাচার বা মৃত্যু থেকে বাঁচতে ন্যুনতম যেটুকু বলতে হয় বা করতে হয়, শুধুমাত্র ততটুকুই বলা বা করা যাবে। কেউ যদি তাকে যতটুকু কুফরী করার জন্য জোর করা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি কুফর করে তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে।
(২) যাকে বাধ্য করা হয়নি
এ সেই লোক যে ইসলামকে ঘৃণা করে না বা অবিশ্বাস করে না বরং মনে মনে কুফরকেই ঘৃণা করে – কিন্তু ক্ষমতার লোভে, সম্পদের লোভে, দেশ বা পরিবারের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসার কারণে বা সম্পদ হারানোর ভয়ে বাইরে বাইরে কুফরী আচরণ করে, এরকম অবস্থা হলে সে মুরতাদ হয়ে যাবে। মনে মনে কুফরীকে ঘৃণা করায় কোন লাভই হবে না। আর এদের ব্যাপারেই আল্লাহ বলেছেনঃ
“ইহা এইজন্য যে, তারা দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের উপর প্রাধান্য দেয় এবং আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।” (সূরা নাহল ১৬:১০৭)