আন নাসর মিডিয়া পরিবেশিত
“আকীদাতুল ওয়ালা ওয়াল-বারা” ।।
শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ
এর থেকে || ৬ষ্ঠ পর্ব
===================
“আকীদাতুল ওয়ালা ওয়াল-বারা” ।।
শাইখ আইমান আয-যাওয়াহিরী হাফিযাহুল্লাহ
এর থেকে || ৬ষ্ঠ পর্ব
===================
ঙ. আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা, মু’মিনদের সাথে অন্তরঙ্গতা এবং জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর মাঝে সম্পর্ক:
মু’মিনদের সাথে বন্ধুত্ব এবং কাফেরদের সাথে শত্রুতা পোষণের ব্যাপারে শরীয়াহর হুকুম বর্ণনা করার পর আল্লাহ তা‘আলার প্রতি মুহব্বত ও জিহাদের মধ্যকার গভীর সম্পর্ক বিষয়ক শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কথাটি হুবহু উল্লেখ করাই শ্রেয় মনে করছি।
ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন-
واسم المحبة فيه إطلاق وعموم، فإن المؤمن يحب الله ويحب رسله وأنبياءه وعباده المؤمنين وإن كان ذلك من محبة الله، وإن كانت المحبة التي لله لا يستحقها غيره، فلهذا جاءت محبة الله مذكورة بما يختص به سبحانه من العبادة والإنابة إليه والتبتل له ونحو ذلك، فكل هذه الأسماء تتضمن محبة الله سبحانه وتعالى.
ثم إنه كان بيَّن أن محبته أصل الدين فقد بيَّن أن كمال الدين بكمالها، ونقصه بنقصها، فإن النبي صلى الله عليه وسلم قال" رأس الأمر الإسلام، وعموده الصلاة، وذروة سنامه الجهاد في سبيل الله"، فأخبر أن الجهاد ذورة سنام العمل، وهو أعلاه وأشرفه.
ثم إنه كان بيَّن أن محبته أصل الدين فقد بيَّن أن كمال الدين بكمالها، ونقصه بنقصها، فإن النبي صلى الله عليه وسلم قال" رأس الأمر الإسلام، وعموده الصلاة، وذروة سنامه الجهاد في سبيل الله"، فأخبر أن الجهاد ذورة سنام العمل، وهو أعلاه وأشرفه.
‘মুহব্বত শব্দটি আরবিতে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। কারণ, মু’মিন আল্লাহকে ভালোবাসে, তাঁর নবী-রাসূলগণ ও মু’মিন বান্দাদেরকে ভালোবাসে; যদিও হোক না তা আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসারই অংশ। যদিও যে ভালোবাসার হকদার আল্লাহ তা‘আলা, সেই ভালোবাসার হকদার আল্লাহ ছাড়া কেউ হতে পারে না। তাই তো যেগুলো আল্লাহর সাথে খাস বা নির্দিষ্ট সে সব স্থানে আল্লাহর ভালোবাসার কথা এসেছে। যেমন, ইবাদত, তাওবা, আল্লাহর প্রতি একাগ্রতা ইত্যাদি। এসব শব্দ আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসার পরিচায়ক। এরপর তিনি বলেন, আল্লাহর ভালোবাসা দ্বীনের মূলভিত্তি। এ ভালোবাসা পূর্ণ হলেই দ্বীন পূর্ণ হয়। এ ভালোবাসা অপূর্ণ হলে দ্বীন অপূর্ণ হয়। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
رَأْسُ الْأَمْرِ الْإِسْلَامُ، وَعَمُودُهُ الصَّلَاةُ ، وَذِرْوَةُ سَنَامِهِ الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ
“ইসলাম হলো শির। নামাজ হলো তার খুঁটি। আর তার সফলতার চূড়া হলো জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ।” বলা হয়েছে, কাজের শীর্ষ-চূড়া হলো জিহাদ। এটাই উত্তম ও সম্মানজনক কাজ।’
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-
أَجَعَلْتُمْ سِقَايَةَ الْحَاجِّ وَعِمَارَةَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ كَمَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَجَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا يَسْتَوُونَ عِندَ اللَّهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ ﴿التوبة: ١٩﴾ الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِندَ اللَّهِ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ ﴿التوبة: ٢٠﴾
“তোমরা কি হাজ্বীদের পানি সরবরাহ ও মাসজিদুল হারাম রক্ষণাবেক্ষণকে সেই লোকের সমান মনে কর, যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান আনে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করে? আল্লাহর কাছে তারা সমান নয়। আর আল্লাহ জালিম লোকদের পথপ্রদর্শন করেন না। যাঁরা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে নিজেদের জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করেছে; আল্লাহর কাছে তাঁরা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ আর তাঁরাই সফলকাম। তাঁদের প্রতিপালক সুসংবাদ দিচ্ছেন, স্বীয় দয়া ও সন্তোষের এবং জান্নাতের, সেখানে আছে তাঁদের জন্য স্থায়ী শান্তি। তথায় তারা চিরদিন থাকবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে আছে মহাপুরস্কার।” (সূরাতাওবা: ১৯-২০)
জিহাদ ও মুজাহিদের ফযীলত সংক্রান্ত আয়াত ও হাদীস অসংখ্য। এটা প্রমাণিত যে, জিহাদই বান্দার জন্য সবচেয়ে উত্তম ইবাদত। আর জিহাদই হলো আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভালোবাসার প্রমাণ। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا آبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنِ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الْإِيمَانِ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ﴿التوبة: ٢٣﴾ قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ ﴿التوبة: ٢٤﴾
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পিতা ও ভাই যদি ঈমান অপেক্ষা কুফরকে ভালোবাসে; তবে তাদেরকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করো না। আর তোমাদের যারা তাদের অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করে, তারা সীমালংঘনকারী। বলুন, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা- যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান- যাকে তোমরা পছন্দ কর; যদি এসব তোমাদের নিকট আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না।” (সূরাতাওবা: ২৩-২৪)
আল্লাহ তাঁর প্রিয় ও প্রেমিক বান্দাদের গুণাবলি বর্ণনা করে ইরশাদ করেছেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَن يَرْتَدَّ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَٰلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ﴿المائدة: ٥٤﴾
“হে মু’মিনগণ! তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে, অচিরেই আল্লাহ এমন সম্প্রদায় আনবেন, যাঁদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তাঁরা তাঁকে ভালোবাসবে। তাঁরা মু’মিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে; তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনো তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্য দানকারী, মহাজ্ঞানী।” (সূরামায়িদা: ৫৪)
কারণ, জিহাদ করার জন্য ভালোবাসা আবশ্যক। কারণ, প্রিয়তম যা ভালোবাসে প্রেমিক তা-ই ভালোবাসে। সে তা-ই ঘৃণা করে, যা তার প্রিয়তম ঘৃণা করে। তার সাথেই বন্ধুত্ব করে, যার সাথে তার প্রিয়তম বন্ধুত্ব করে। তার সাথেই শত্রুতা পোষণ করে, যার সাথে প্রিয়তম শত্রুতা পোষণ করে। তার প্রতিই সন্তুষ্ট হয়, যার প্রতি প্রিয়তম সন্তুষ্ট হয়। তার প্রতিই রুষ্ট হয়, যার প্রতি প্রিয়তম রুষ্ট হয়। তা-ই আদেশ করে, যা প্রিয়তম আদেশ করে। তা-ই নিষেধ করে, যা প্রিয়তম নিষেধ করে। সুতরাং সে তাঁর অনুগামী হয়ে যায়।
মুজাহিদীন তাঁরাই, যাঁদের সন্তুষ্টিতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হোন। যাঁদের রুষ্টতায় আল্লাহ রুষ্ট হোন। কারণ, তাঁরাই তো আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হোন। আবার তাঁর রুষ্টতায় রুষ্ট হোন। যেমন, সুহাইব ও বিলাল রাযি. ছিলেন। এমন একটি দলের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর রাযি. কে বলেছিলেন-
لَعَلَّكَ أَغْضَبْتَهُمْ لَئِنْ كُنْتَ أَغْضَبْتَهُمْ لَقَدْ أَغْضَبْتَ رَبَّكَ فَقَالَ لَهُمْ يَا إِخْوَتي هلْ أَغْضَبْتُكُمْ قَالُوا لَا يَغْفِرُ اللَّهُ لَكَ يَا أَبَا بَكْرٍ
“হয়তো তুমি তাদেরকে রাগিয়ে দিয়েছ। যদি তুমি তাদেরকে রুষ্ট করে থাক; তাহলে তুমি তোমার রবকেও রুষ্ট করেছ। তিনি বললেন, ভাইয়েরা! আমি কি তোমাদেরকে রুষ্ট করেছি? তাঁরা বললেন, আবু বকর! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করবেন না।”
তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল আবু সুফিয়ান ইবনে হারব। তাঁরা বললেন, তলোয়ারটা জায়গা মতো পৌঁছল না। তখন আবু বকর রাযি. তাঁদেরকে বললেন, কুরাইশ সর্দারকে তোমরা এমন কথা বলছ? আবু বকর রাযি. ঘটনাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানালেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আগে বেড় না। কারণ, তাঁরা আল্লাহর জন্য রুষ্ট হয়েই এমনটি বলেছে। তাঁরা যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে এবং তাঁদের শত্রুদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে শুধুমাত্র সেটার পূর্ণতার জন্যই এমনটি করেছে। তাই তো বিশুদ্ধ বর্ণনায় হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন-
لاَ يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطِشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا فبي يَسْمَعُ ، وَبِيْ يُبْصِرُ ، وَبِيْ يَبْطِشُ ، وَبِيْ يَمْشِي ، وَلَئِنِ سَأَلَنِي لَأُعْطِيَنَّهُ وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِي لَأُعِيذَنَّهُ وَمَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَيْءٍ أَنَا فَاعِلُهُ تَرَدُّدِي عَنْ نَفْسِ الْمُؤْمِنِ يَكْرَهُ الْمَوْتَ وَأَنَا أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ وَلَا بُدَّ مِنْهُ
“আমার বান্দা নফল কাজের মাধ্যমে আমার নিকটবর্তী হয়, এমনকি এক সময় আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। যখন আমি তাকে ভালোবাসি, তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যেটা দিয়ে সে শুনতে পায়। আমি তার চোখ হয়ে যাই, যেটা দিয়ে সে দেখতে পায়। আমি তার হাত হয়ে যাই, যেটা দিয়ে সে ধরে। আমি তার পা হয়ে যাই, যেটা দিয়ে সে হাঁটে। সে শুধু আমার জন্যই শোনে। আমার জন্যই দেখে। আমার জন্যই ধরে। আমার জন্যই হাঁটে। সে আমার কাছে চাইলে আমি তাকে দিই। সে আশ্রয় চাইলে আমি আশ্রয় দিই। কোনো ব্যাপারেই আমি তাঁকে ফেরত দিইনি। আমিই দিয়েছি সবকিছু। আমার মু’মিন বান্দার রুহ কবজা করতে আমার ইতস্তত লাগে। সে যে মৃত্যুযন্ত্রণা অপছন্দ করে, আমিও তাকে কষ্ট দিতে চাই না। তবে তা ছাড়া যে কোনো উপায় নেই।” (আত-তুহফাতুল ইরাকিয়্যাহ, ১/৬৩-৬৪ পৃ.)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. ইয়াহুদী-নাসারাদের সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্কে বলেন, পার্থিব বিষয়াদিতে সাদৃশ্য থাকলে ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সুতরাং ধর্মীয় বিষয়াদিতে সাদৃশ্য থাকলে কী পরিণাম হবে?? কারণ, তা-ই গভীর থেকে গভীরতর বন্ধুত্বের দিকে নিয়ে যায়।
আর তাদের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা ঈমানের বিপরীত। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ ﴿المائدة: ٥١﴾ فَتَرَى الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ يُسَارِعُونَ فِيهِمْ يَقُولُونَ نَخْشَىٰ أَن تُصِيبَنَا دَائِرَةٌ فَعَسَى اللَّهُ أَن يَأْتِيَ بِالْفَتْحِ أَوْ أَمْرٍ مِّنْ عِندِهِ فَيُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا أَسَرُّوا فِي أَنفُسِهِمْ نَادِمِينَ ﴿المائدة: ٥٢﴾ وَيَقُولُ الَّذِينَ آمَنُوا أَهَٰؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمُوا بِاللَّهِ جَهْدَ أَيْمَانِهِمْ إِنَّهُمْ لَمَعَكُمْ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَأَصْبَحُوا خَاسِرِينَ ﴿المائدة: ٥٣﴾
“হে মু’মিনগণ! তোমরা ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে; সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না। বস্তুত যাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, তাদেরকে আপনি দেখবেন, দৌড়ে গিয়ে তাদেরই মধ্যে প্রবেশ করে। তারা বলে, আমরা আশঙ্কা করি, পাছে না আমরা কোনো দুর্ঘটনায় পতিত হই। অতএব, সেদিন দূরে নয়, যেদিন আল্লাহ তা‘আলা বিজয় দান করবেন অথবা নিজের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশ দেবেন; ফলে তারা স্বীয় গোপন মনোভাবের জন্য অনুতপ্ত হবে। মু’মিনরা বলবে, এরাই কি সে সব লোক, যারা আল্লাহর নামে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করত যে, আমরা তোমাদের সাথেই আছি? তাদের কৃতকর্মসমূহ নষ্ট হয়ে গেছে; ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আছে।” (সূরা মায়িদা: ৫১-৫৩)
আল্লাহ তা‘আলা আহলে কিতাবের দুর্নাম করে বলেছেন-
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَىٰ لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَوا وَّكَانُوا يَعْتَدُونَ ﴿المائدة: ٧٨﴾ كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَن مُّنكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ ﴿المائدة: ٧٩﴾ تَرَىٰ كَثِيرًا مِّنْهُمْ يَتَوَلَّوْنَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَبِئْسَ مَا قَدَّمَتْ لَهُمْ أَنفُسُهُمْ أَن سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَفِي الْعَذَابِ هُمْ خَالِدُونَ ﴿المائدة: ٨٠﴾ وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ وَلَٰكِنَّ كَثِيرًا مِّنْهُمْ فَاسِقُونَ ﴿المائدة: ٨١﴾
“বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কাফের, তাদেরকে দাউদ ও মরিয়ম তনয় ঈসার মুখে অভিসম্পাত করা হয়েছে। এটা এ কারণে যে, তারা ছিল অবাধ্য এবং সীমালঙ্ঘনকারী। তারা যেসব মন্দ কাজ করত, পরস্পরকে সে সব মন্দ কাজে নিষেধ করত না। তারা যা করত, তা কতই না নিকৃষ্ট ছিল। আপনি তাদের অনেককে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন। কত নিকৃষ্ট তাদের কৃতকর্ম। যে কারণে তাদের প্রতি আল্লাহ ক্রোধান্বিত হয়েছেন এবং তারা চিরকাল শাস্তিভোগ করতে থাকবে। যদি তারা আল্লাহর প্রতি ও নবীর প্রতি এবং তাঁর উপর অবতীর্ণ বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করত; তবে কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত না। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই দুরাচার।” (সূরা মায়িদা: ৭৮-৮১)
আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, আল্লাহর প্রতি, নবীর প্রতি এবং তাঁর উপর অবতীর্ণ কিতাবের প্রতি ঈমান আনার জন্য তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ আবশ্যক। সুতরাং তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা আল্লাহর প্রতি ঈমান না থাকাই প্রমাণ করে। কারণ লাযেমের অনুপস্থিতি মালযুমের অনুপস্থিতিকে প্রমাণ করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন-
لَّا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُولَٰئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُم بِرُوحٍ مِّنْهُ … ﴿المجادلة: ٢٢﴾
“যাঁরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাঁদেরকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না; যদিও তারা তাঁদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয়। তাঁদের অন্তরে আল্লাহ ঈমানকে সুদৃঢ় করে দিয়েছেন এবং তাঁদেরকে তাঁর পক্ষ হতে রূহ দ্বারা শক্তিশালী করেছেন।” (সূরামুজাদালা: ২২)
আল্লাহ জানিয়ে দিচ্ছেন, এমন কোনো মু’মিন নেই, যে কোনো কাফেরের সাথে বন্ধুত্ব করে। সুতরাং যে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করে, সে মু’মিন নয়। আর বাহ্যিক সাদৃশ্য থেকেই বন্ধুত্বের অনুমান করা যায়। তাই তাও হারাম হবে। যে সম্পর্কে পূর্বে আলোচিত হয়েছে।” (ইকতিজাউস সিরাতিল মুস্তাকীম, ১/২২১-২২২ পৃ.)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. আরও বলেন, মু’মিনের উপর কর্তব্য হলো: আল্লাহর জন্য শত্রুতা করা এবং আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব করা। মু’মিনকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতেই হবে; যদিও সে তাকে অত্যাচার করুক। কারণ, অত্যাচার ঈমানী বন্ধন ছিন্ন করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-
وَإِن طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِن بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيءَ إِلَىٰ أَمْرِ اللَّهِ فَإِن فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ ﴿الحجرات: ٩﴾ إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ﴿الحجرات: ١٠﴾
“যদি মু’মিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে; তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। আর তাদের একদল যদি অপর দলের উপর চড়াও হয়; তবে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি তারা ফিরে আসে; তবে তাদের মধ্যে ন্যায়সম্মত পন্থায় মীমাংসা করে দেবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালোবাসেন। মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে-যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।” (সূরা হুজুরাত: ৯-১০)
পারস্পরিক যুদ্ধ-বিদ্রোহ থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ভাই আখ্যা দিচ্ছেন এবং সংশোধন করার আদেশ দিচ্ছেন।
এ দু’টি প্রকারের পার্থক্য প্রত্যেক মু’মিনকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। অনেকেই এ দু’টি প্রকারে একটিকে অন্যটির সাথে ঘুলিয়ে ফেলেন। আরও জানতে হবে যে, মু’মিন জুলুম-অত্যাচার করলেও তার সাথে বন্ধুত্ব আবশ্যক। আর কাফের দয়া-দাক্ষিণ্য করলেও তার সাথে শত্রুতা আবশ্যক। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূলদের প্রেরণ করেছেন এবং কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করেছেন; যাতে দ্বীন পূর্ণাঙ্গভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। অতএব, তাঁর বন্ধুদেরকে ভালোবাসতে হবে এবং তাঁর শত্রুদের সাথে শত্রুতা পোষণ করতে হবে। তাঁর বন্ধুদেরকে সম্মানিত করতে হবে এবং শত্রুদেরকে লাঞ্ছিত করতে হবে। তাঁর বন্ধুদেরকে পুরস্কৃত করতে হবে এবং শত্রুদেরকে শাস্তি দিতে হবে।
একই ব্যক্তির মাঝে যদি ভালো-মন্দ, আনুগত্য-অবাধ্যতা, সুন্নাত-বিদআতের সন্নিবেশ ঘটে, সে তার ভালো কাজের পরিণামে বন্ধুত্ব ও পুরস্কারের অধিকারী হবে। আর মন্দ কাজের পরিণামে শাস্তি ও শত্রুতা প্রাপ্ত হবে। সুতরাং একই ব্যক্তির মাঝে সম্মান ও অপমান দু’টোর কারণ পাওয়া যেতে পারে; ফলে তার পরিণামও দুই ধরনের হবে। যেমন, অসহায় চোরের হাত কাটা হবে চুরি করার অপরাধে এবং অসহায়ত্বের কারণে তাকে বায়তুল মাল থেকে প্রয়োজন মতো ভরণ পোষণ দেওয়া হবে। এটি এমন এক নীতি, যার উপর আহলুস সুন্নাহর সমস্ত আলেম একমত।” (মাজমূউল ফাতাওয়া, ২৮/২০৭-২০৯ পৃ.)
আরও পড়ুন