আল হিকমাহ মিডিয়া পরিবেশিত
“আল আকসা পুনরুদ্ধারের ফরয আদায় করুন ” ।।
মুঈনুদ্দীন শামী হাফিযাহুল্লাহ||
এর থেকে ২য়পর্ব
===================
“আল আকসা পুনরুদ্ধারের ফরয আদায় করুন ” ।।
মুঈনুদ্দীন শামী হাফিযাহুল্লাহ||
এর থেকে ২য়পর্ব
===================
টেরোরিজম তথা ‘সন্ত্রাসবাদ’ দর্শনের মুখোশ উন্মোচন
ফিলিস্তিন সমস্যা বিশ্বের উল্লেখযোগ্য স্পষ্ট সমস্যা কিংবা কয়েকটি স্পষ্ট যুদ্ধের মধ্যে একটি, যেখানের জিহাদকে সেক্যুলার লোকেরাও ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’ হিসাবে জানে এবং স্বীকার করে। গোটা বিশ্ব (শরীয়াহ মানদণ্ডে নয়) ফিলিস্তিনের সমস্যার সমাধান দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমঝোতার আকারে দেখতে চায়। আবার বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনকে বৈধ মনে করে।
কিন্তু ফিলিস্তিনের মুজাহিদীনরা যখন তাদের শরয়ী দায়িত্ব আদায় করা এবং ধর্মীয়, যৌক্তিক ও নৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ‘তুফানুল আকসা’র যুদ্ধ শুরু করে তখন আমেরিকা এবং পুরো ইউরোপ এই যুদ্ধকে ‘টেরোরিজম’ (সন্ত্রাসবাদ/জঙ্গিবাদ) নাম দেয়! কারণ এতে ইসরাঈল জুড়ে ইসরাঈলি মহিলাদেরও টার্গেট করা হয়েছিল। অথচ বাস্তবতা হল, এই যুদ্ধে যে সমস্ত মহিলারা নিহত বা বন্দী হয়েছিল তারা সবাই ইসরাঈলি সেনাবাহিনীতে কাজ করত বা চাকরি করতো। ইসরাঈলের প্রতিটি পুরুষ বত্রিশ মাস (আড়াই বছর) এবং মহিলারা চব্বিশ মাস (দুই বছর) ইসরাঈলি নিরাপত্তা বাহিনীতে চাকরি করে।
পবিত্র শরীয়ত সামরিক ও বেসামরিকের আধুনিক সংজ্ঞায় বিশ্বাসী নয়। পবিত্র শরীয়তের মানদণ্ডে যুদ্ধ করার ক্ষমতা সম্পন্ন প্রত্যেক ব্যক্তিকে 'হরবি', ‘মুকাতিল’ তথা যোদ্ধা বলা হয়। তবে এতে এমন বয়স্ক ব্যক্তিরাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যারা যুদ্ধে সক্ষম নয় কিন্তু মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তবে এ হুকুমের বাহিরে সন্ন্যাসী, উপাসক ও পুরোহিত যাদের যুদ্ধের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই এবং নারী ও শিশু ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ইসরাঈলি সেনাবাহিনীতে ইসরাঈলের সাধারণ নারীরাও সেবা দিয়ে থাকে। ইহুদীদের ছোট শিশুরা হরবি নয়, তবে এ বিষয়টি মনে রাখবেন যে, তারা সকলে আধুনিক অস্ত্রের প্রশিক্ষণ স্কুলেই গ্রহণ করে। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছবিগুলো এর প্রমাণ।
যে দেশে ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেয়, সেখানের নারীরা অবশ্যই অস্ত্র চালাতে জানে। তা সত্ত্বেও ইসলামের মুজাহিদগণ তাদের উপর হাত তুলেনি, বরং এই ইহুদী নারীদের ইজ্জত-সম্ভ্রমও তারা রক্ষা করেছে। এ রকম দশটি ভিডিও জনসম্মুখে এসেছে, যেখানে ইসলামের মুজাহিদীনরা নারী ও শিশুদের প্রতি করুণা দেখিয়েছেন। সেখানে তাদের বলতে শোনা যায় যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যুদ্ধের সময় নারী ও শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। খোদ ইহুদী নারীদের এমন বিবৃতি ও সাক্ষাৎকার এসেছে, যেখানে তারা মুজাহিদীনের নৈতিকতা ও ভালো আচরণের প্রশংসা করেছে।
অন্যদিকে ইসরাঈলি এক বৃদ্ধের ভিডিও সংবাদ সংস্থাগুলো প্রচার করেছে, যেখানে পঁচানব্বই বছরেরও বেশি বয়সী ইসরাঈলি বৃদ্ধ আজকের যুদ্ধে অংশ নিয়েছে এবং বলেছে যে, মুসলমানদের যেখানেই পাও সেখানেই হত্যা কর। ইসরাঈল হল বিশ্বের এমন আদর্শিক ও ধর্মীয় রাষ্ট্র; যেখানে বসবাসকারী প্রতিটি ইহুদীই দখলদার ও ছিনতাইকারী। দখলদার ও ছিনতাইকারীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের অনুমতি তো আমেরিকার গোলাম জাতিসংঘও দেয়। পূর্ব তিমুর, দক্ষিণ সুদান এরই উদাহরণ।
ফিলিস্তিনের মুজাহিদীন তাদের নিপীড়িত মুসলিম জাতির প্রতিশোধ নিয়েছে এবং তাদের নিরপরাধদের জীবন রক্ষাকারী ওষুধের উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী ইসরাঈলের উপর পাল্টা আক্রমণ করেছে। এই হামলাকে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইসরাঈলসহ ইউরোপীয় দেশগুলো ‘সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
পশ্চিমাদের পরিশ্রমের কারণে আমাদের মুসলমানদের মাঝে সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও ইউরোপ ও আমেরিকায় সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা ও পরিচয় খুবই স্পষ্ট। 9/11 এর হামলা সন্ত্রাসবাদ, মোল্লা উমর রহিমাহুল্লাহ, উসামা বিন লাদেন রহিমাহুল্লাহ, আইমান আয-যাওয়াহিরী রহিমাহুল্লাহ, আহমাদ ইয়াসীন রহিমাহুল্লাহ, আব্দুল আজীজ রান্টিসি রহিমাহুল্লাহ সবাই সন্ত্রাসী এবং তাঁদের কর্মকাণ্ড সন্ত্রাসবাদ।
ইসরাঈলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধও সন্ত্রাসবাদ।
আজকের যুদ্ধ ‘তুফানুল আকসা’ সন্ত্রাসবাদের দর্শনের মুখোশ খুলে দিয়েছে।
আমেরিকাই সকল নষ্টের মূল
‘তুফানুল আকসা’র যুদ্ধের পরে যেভাবে আমেরিকা তার মিত্রদের (বিশেষ করে ফ্রান্স এবং গ্রেট ব্রিটেন) সহ ইসরাঈলকে রক্ষা করার জন্য ছুটে এসেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে ইসরাঈল নিজেকে রক্ষা করতে অক্ষম। ‘আয়রন ডোম’ও আমেরিকার সরবরাহ করা।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমেরিকা ইসরাঈলকে ১৫০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত শুধু সামরিক সহায়তা হিসাবে ইসরাঈলকে প্রতি বছর ২.৬৭ বিলিয়ন ডলার করে দেওয়া হয়েছিল। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্তের জন্য এই বার্ষিক সাহায্য তিন বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি করা হয়েছিল। অতঃপর ২০১৯ সালে বার্ষিক সাহায্য তৃতীয়বার বাড়ানো হয়, এবং এখন আমেরিকা প্রতি বছর ইসরাঈলকে সামরিক সহায়তা হিসাবে ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিচ্ছে। অর্থাৎ ১৯৯৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আমেরিকা ইসরাঈলকে ৭১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার শুধু সামরিক সহায়তাই দিয়েছে।[1]
পূর্বেকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাইতুল মাকদিস পরিদর্শন করে আল-কুদস (জেরুজালেম)কে ইসরাঈলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সাথে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরেরও ঘোষণা দিয়েছিল।
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একটি কথা আজ বেশ প্রসিদ্ধ। যেখানে সে ২০২২ সালের অক্টোবরে বলেছিল যে, "যদি ইসরাঈল না থাকতো তবে আমাদেরকেই একটি ইসরাঈল উদ্ভাবন করতে হত।” (If there was no Israel we’d have to invent one.)[2]
এই আমেরিকাই ইসরাঈলের সবচেয়ে বড় সমর্থক। একটু চিন্তা করে দেখুন; ইসরাঈলি ভূখণ্ডে ১০০০ ফিদায়ী মুজাহিদীনের প্রবেশ এবং আক্রমণের কারণে আমেরিকা তার নৌবহর, ব্রিটেন তার দুটি যুদ্ধজাহাজ এবং আকাশ নজরদারি ব্যবস্থা ইসরাঈলকে দান করেছে। এটা ঐ ব্রিটেন, যেটি তার ইতিহাসের গভীরতম রাজনীতিক ও আর্থিক সংকটের মুখোমুখি। ঐ আমেরিকা, যার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্বল রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব বলে গণ্য হয়। আমেরিকা তার জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তার জনগণের জন্য চিকিৎসা সুবিধা ও কর্মক্ষেত্র তৈরি না করে বরং দখলদার ইসরাঈলের নিরাপত্তায় তাদের ট্যাক্সের অর্থ ব্যয় করছে।
ফিলিস্তিনের জনগণকে কিভাবে সাহায্য করবেন?
ফিলিস্তিনের জনগণের সাহায্য মূলত ইসলাম ও মুসলমানের সাহায্য, প্রথম কিবলার সাহায্য ও পরকালের পুঁজি। অবশ্য ফিলিস্তিনের জনগণকে নানাভাবে সাহায্য করা যেতে পারে। সেগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য কিছু এই হতে পারে:
প্রথমে সবচেয়ে বড় শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ!
ইসরাঈলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ, হামলা তথা জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি কঠিন বিষয়। কারণ তথাকথিত ইসরাঈলের একদিকে সমুদ্র এবং তিন দিকে আরব দেশ, যাদের শাসকরা আমেরিকার পুতুল ও গোলাম। তাই ইসরাঈলের বিরুদ্ধে মুসলমানরা সেই কাজ-ই করতে পারে, যা ‘তুফানুল আকসা’র রূপে ‘কাতাইব আল-কাসসাম’ এর মুজাহিদীন করেছে। কাতাইব আল-কাসসামের মুজাহিদীনকে হাজার বার মোবারকবাদ জানাই; কিন্তু আমরা জানি যে, দখলদার ইসরাঈলকে শেষ করার জন্য যে সকল যুদ্ধের প্রয়োজন, তার মাঝে ‘তুফানুল আকসা’ই প্রথম সিদ্ধান্তমূলক এবং বড় যুদ্ধ। কিন্তু এই ধরনের যুদ্ধ ইসরাঈলকে (যার পিছনে বড় তাগুত আমেরিকা দাঁড়িয়ে আছে) অবশ্যই দুর্বল করবে, কিন্তু উৎখাত করতে পারবে না।
- এতদসত্ত্বেও যারা ফিলিস্তিনের জনগণকে আর্থিক ও শারীরিকভাবে সরাসরি সাহায্য করার পথ খুঁজে পান, তাদের উচিত তাদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে সাহায্য-সহায়তা করা।
- ইসলামের মুজাহিদীন যেখানে যেখানে জিহাদের কাজ আঞ্জাম দিচ্ছেন, যেমন- পাকিস্তান, কাশ্মীর ও বাংলাদেশ, ইয়েমেন, মালি, আলজেরিয়া, সিরিয়া, সোমালিয়া ইত্যাদিতে, তাদের উচিত- সেসব জায়গায় তাদের জিহাদী শক্তি বৃদ্ধি করা। তাদের জিহাদে আরও গতি সঞ্চার করা ও শক্তি আনয়ন করা। তাদের আরও উচিত- নিজস্ব জমি এবং নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলিকে জিহাদী কেন্দ্রে পরিণত করা। আমেরিকা ও ইসরাঈলের নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের অধীনে বিশ্বব্যাপী কুফরী সরকারকে উৎখাত করার জন্য ‘স্থানীয় জিহাদকে বৈশ্বিক জিহাদের সমর্থকে’ পরিণত করা।
- আজ ইসলামী বিশ্বের শাসকদের রীতি-নীতি সবার সামনে প্রকাশিত। এই শাসকরা এবং তাদের সেনাবাহিনীর অবস্থা এমন যে, আজ তারা উদ্যমী ও সাহসী মুসলমানদেরকে ইহুদীদের উপর আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখছে!
- সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মুসলমানদের জন্য ইসরাঈলে পৌঁছানো কঠিন। কিন্তু ইসরাঈলের সবচেয়ে বড় মদদদাতা আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের স্বার্থ, আমেরিকা ও ইউরোপসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে, যেখানেই কোনো ইসরাঈলি, আমেরিকান, ব্রিটিশ, ফরাসি অথবা ইসরাঈলের সমর্থক অন্য কোনো ইউরোপীয়ানকে পাওয়া যাবে, তাকে সেখানেই হত্যা করা উচিত। আজকের বিশ্ব একটি বৈশ্বিক মঞ্চ, যেখানে সকলের স্বার্থই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
ইহুদীরা একটি পবিত্র ভূমির বিশ্বাস লালন করে। তাই তারা নীল নদ ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী স্থানে বসবাস করতে চায়। কিন্তু ইসরাঈলের সমর্থকদের ক্ষেত্রে এমন কোনো পবিত্র স্থান নেই। তাই তারা সারা বিশ্বে বিদ্যমান। যদি আমেরিকা, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে ইসরাঈলের সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করতে ইহুদীরা জাহাজ ভরে ভরে আসতে পারে, তবে কেন আমেরিকা, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ায় এদের পুরুষ ও নারী সৈন্যদেরকে টার্গেট করে জাহান্নামে পাঠানো হবে না? এছাড়া আমেরিকানদের উপর এমন আঘাত এবং এমন যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে হবে যা আমেরিকানদেরকে ইসরাঈলকে সমর্থন ও রক্ষা করার চিন্তা করার কথা ভুলিয়ে দিবে।
[1] US Foreign Aid Israel (https://fas.org/sgp/crs/mideast/RL33222.pdf)
[2] The New Arad
Comment