কেমন আছেন ভারতের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ||পর্ব-১ || এক রোহিঙ্গা নারীর আত্মকাহিনী
এক অসহায় রোহিঙ্গা শিশু। ফাইল ছবিঃ টিআরটি ওয়ার্ল্ড
আমাল আখতার, একজন রোহিঙ্গা মুসলিম নারী। নিজে নিজে হাঁটতে পারেন না তিনি। বসেছিলেন একটি শক্ত তোশকের উপর। কেমন যেন স্থিরতা নেই তার মাঝে। একটি বালিশে পিঠ লাগিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন; আর কথা বলছেন নরম স্বরে, তবে দৃঢ় কণ্ঠে।
আমার চোখে চোখ রেখে বলছিলেন নিজের জীবনের স্মৃতিকথা। তিনি জন্মেছেন মিয়ানমারের সর্ব পশ্চিমের রাজ্য রাখাইনে। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই রাজ্যটি যেন বিদ্রোহ, নির্যাতন, ও বর্বরতার লীলাভূমি। সেখানেই তিনি বড় হয়েছেন; জীবনের বারোটি বছর কাটিয়েছেন মা ও ভাই-বোনদের সাথে।
আখতারের বয়স এখন ২৫ বছর। কাস্তে আকৃতির লম্বা রাখাইন রাজ্য ছাড়া অন্য কোনো কিছু তিনি দেখতে পারেননি। কারণ ইন্দো-আর্য বংশোদ্ভূত মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তা, ধর্ম কিংবা ভাষা মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ বর্মিয়দের সাথে মিলে না। আর তাই প্রতিনিয়ত বঞ্চনার শিকার হতে হয় রোহিঙ্গাদের। এমনকি রাখাইনের সীমানা পেরিয়ে অন্য কোথাও ভ্রমণ করারও অনুমতি নেই তাদের।
রাখাইনে এমন বঞ্চনার শিকার হয়ে বছরের পর বছর অতিবাহিত করেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এরপর ২০১৬-১৭ সালে তাদের উপর চালানো হয় নির্মম গণহত্যা। হত্যা করা হয় অন্তত ৯,০০০ রোহিঙ্গাকে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ২০১৮ সালের তথ্যানুযায়ী, রোহিঙ্গাদেরকে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে, নিয়মিত করা হয়েছে নির্যাতন। তাদের অনেকে রয়েছে নিখোঁজ। রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে, নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৭ সালে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদেরকে বিশ্বের ‘সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
বেঁচে ফেরা রোহিঙ্গারা বর্মিদের নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। তারা দেখেছেন, লোহায় বিদ্ধ করে শিশুদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছে, আর বয়স্কদের হত্যা করা হচ্ছে গুলি করে।
আখতার সর্বশেষ তার দেশ ও আত্মীয়স্বজনকে দেখেছেন ২০১২ সালের অক্টোবরে। এরপর ছয় ঘণ্টার বেশি সাঁতার কেটে নদী পার হয়েছেন আশ্রয়ের খোঁজে। বেশিরভাগ সময় পায়ে হেঁটে, আবার কখনও অন্য উপায়ে তিন মাস সফর করেছেন তিনি। অবশেষে ২০১২ সালে ভারতে এসে পৌঁছান আরও নির্যাতন সহ্য করতে; রোহিঙ্গা নারীদের পাচার, ধর্ষণ ও খুনের প্রত্যক্ষদর্শী হতে।
আখতার এখন থাকেন দক্ষিণ দিল্লীর মদনপুর খাদান নামক একটি জঘন্য বস্তিতে। তেরপল-আচ্ছাদিত একটি বিদ্যুৎহীন ঘরের ভেতর থেকে তিনি কথা বলেছেন আমার সাথে।
আখতার বলেন, “আমার সারাটা জীবন কেটেছে সংগ্রাম ও আতঙ্কে। জীবনে কেবল একটি জিনিসই আমি চাই। আমি চাই ভয়হীন জীবন কাটাতে, আমি চাই শান্তিতে থাকতে।”
তবে আখতার এখন থাকেন ভারতে। এখানে অন্য আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের মতো তাকেও থাকতে হবে সন্ত্রাসী, উইপোকা কিংবা ভারতের জন্য নিরাপত্তা হুমকির তকমা সয়ে। ভারতীয় রাজনীতিবিদ, সরকার, মিডিয়া — একযোগে সবাই এই পরিভাষাগুলো ব্যবহার করছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। রোহিঙ্গাদের মাঝে সর্বদা বিরাজ করে গ্রেফতারির ভয়। কোনো কারণ, ব্যাখ্যা কিংবা আইনি উপায় ব্যতীতই বন্দী করা হয় রোহিঙ্গাদের, ছুঁড়ে ফেলা হয় কারাগারে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে আখতারকে মদনপুর খাদার বস্তি থেকে তুলে নিয়ে আটককেন্দ্রে পাঠায় পুলিশ। সেখানে তাকে ভোজ্য খাদ্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, বঞ্চিত করা হয়েছে মেডিকেল চিকিৎসা এবং আইনি সহযোগিতা থেকেও। আটককেন্দ্রে দীর্ঘ ১৪ মাস এসব নির্যাতন ভোগের কথা বর্ণনা করেছেন আখতার।
আখতার বলেন, “আমাকে যখন আটককেন্দ্র থেকে মুক্তি দিলো, তখন আমি প্রায় অজ্ঞান ছিলাম। নড়াচড়া করতে পারছিলাম না, এমনকি আমার মা-কেও চিনতে পারছিলাম না। এখনও আমি একজনের সাহায্য ছাড়া নড়াচড়া করতে পারি না… আমি কেবল আশা করি এখন থেকে আমি আমার মায়ের সাথে থাকতে পারব। তারা আমাকে আবারও বন্দী করবে না।”
চলবে..ইনশাআল্লাহ্…
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ভারতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হালাত নিয়ে তৈরি “Rohingya Refugees Recall Desperate Conditions With No Legal Recourse In Delhi Detention Centre” এই শিরোনামে article14 এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আমরা ধারাবাহিক ভাবে বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করছি।
তথ্যসূত্র :
https://tinyurl.com/yvxps73w
এক অসহায় রোহিঙ্গা শিশু। ফাইল ছবিঃ টিআরটি ওয়ার্ল্ড
আমাল আখতার, একজন রোহিঙ্গা মুসলিম নারী। নিজে নিজে হাঁটতে পারেন না তিনি। বসেছিলেন একটি শক্ত তোশকের উপর। কেমন যেন স্থিরতা নেই তার মাঝে। একটি বালিশে পিঠ লাগিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন; আর কথা বলছেন নরম স্বরে, তবে দৃঢ় কণ্ঠে।
আমার চোখে চোখ রেখে বলছিলেন নিজের জীবনের স্মৃতিকথা। তিনি জন্মেছেন মিয়ানমারের সর্ব পশ্চিমের রাজ্য রাখাইনে। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই রাজ্যটি যেন বিদ্রোহ, নির্যাতন, ও বর্বরতার লীলাভূমি। সেখানেই তিনি বড় হয়েছেন; জীবনের বারোটি বছর কাটিয়েছেন মা ও ভাই-বোনদের সাথে।
আখতারের বয়স এখন ২৫ বছর। কাস্তে আকৃতির লম্বা রাখাইন রাজ্য ছাড়া অন্য কোনো কিছু তিনি দেখতে পারেননি। কারণ ইন্দো-আর্য বংশোদ্ভূত মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তা, ধর্ম কিংবা ভাষা মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ বর্মিয়দের সাথে মিলে না। আর তাই প্রতিনিয়ত বঞ্চনার শিকার হতে হয় রোহিঙ্গাদের। এমনকি রাখাইনের সীমানা পেরিয়ে অন্য কোথাও ভ্রমণ করারও অনুমতি নেই তাদের।
রাখাইনে এমন বঞ্চনার শিকার হয়ে বছরের পর বছর অতিবাহিত করেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এরপর ২০১৬-১৭ সালে তাদের উপর চালানো হয় নির্মম গণহত্যা। হত্যা করা হয় অন্তত ৯,০০০ রোহিঙ্গাকে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ২০১৮ সালের তথ্যানুযায়ী, রোহিঙ্গাদেরকে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে, নিয়মিত করা হয়েছে নির্যাতন। তাদের অনেকে রয়েছে নিখোঁজ। রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে, নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৭ সালে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদেরকে বিশ্বের ‘সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
বেঁচে ফেরা রোহিঙ্গারা বর্মিদের নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। তারা দেখেছেন, লোহায় বিদ্ধ করে শিশুদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছে, আর বয়স্কদের হত্যা করা হচ্ছে গুলি করে।
আখতার সর্বশেষ তার দেশ ও আত্মীয়স্বজনকে দেখেছেন ২০১২ সালের অক্টোবরে। এরপর ছয় ঘণ্টার বেশি সাঁতার কেটে নদী পার হয়েছেন আশ্রয়ের খোঁজে। বেশিরভাগ সময় পায়ে হেঁটে, আবার কখনও অন্য উপায়ে তিন মাস সফর করেছেন তিনি। অবশেষে ২০১২ সালে ভারতে এসে পৌঁছান আরও নির্যাতন সহ্য করতে; রোহিঙ্গা নারীদের পাচার, ধর্ষণ ও খুনের প্রত্যক্ষদর্শী হতে।
আখতার এখন থাকেন দক্ষিণ দিল্লীর মদনপুর খাদান নামক একটি জঘন্য বস্তিতে। তেরপল-আচ্ছাদিত একটি বিদ্যুৎহীন ঘরের ভেতর থেকে তিনি কথা বলেছেন আমার সাথে।
আখতার বলেন, “আমার সারাটা জীবন কেটেছে সংগ্রাম ও আতঙ্কে। জীবনে কেবল একটি জিনিসই আমি চাই। আমি চাই ভয়হীন জীবন কাটাতে, আমি চাই শান্তিতে থাকতে।”
তবে আখতার এখন থাকেন ভারতে। এখানে অন্য আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের মতো তাকেও থাকতে হবে সন্ত্রাসী, উইপোকা কিংবা ভারতের জন্য নিরাপত্তা হুমকির তকমা সয়ে। ভারতীয় রাজনীতিবিদ, সরকার, মিডিয়া — একযোগে সবাই এই পরিভাষাগুলো ব্যবহার করছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। রোহিঙ্গাদের মাঝে সর্বদা বিরাজ করে গ্রেফতারির ভয়। কোনো কারণ, ব্যাখ্যা কিংবা আইনি উপায় ব্যতীতই বন্দী করা হয় রোহিঙ্গাদের, ছুঁড়ে ফেলা হয় কারাগারে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে আখতারকে মদনপুর খাদার বস্তি থেকে তুলে নিয়ে আটককেন্দ্রে পাঠায় পুলিশ। সেখানে তাকে ভোজ্য খাদ্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, বঞ্চিত করা হয়েছে মেডিকেল চিকিৎসা এবং আইনি সহযোগিতা থেকেও। আটককেন্দ্রে দীর্ঘ ১৪ মাস এসব নির্যাতন ভোগের কথা বর্ণনা করেছেন আখতার।
আখতার বলেন, “আমাকে যখন আটককেন্দ্র থেকে মুক্তি দিলো, তখন আমি প্রায় অজ্ঞান ছিলাম। নড়াচড়া করতে পারছিলাম না, এমনকি আমার মা-কেও চিনতে পারছিলাম না। এখনও আমি একজনের সাহায্য ছাড়া নড়াচড়া করতে পারি না… আমি কেবল আশা করি এখন থেকে আমি আমার মায়ের সাথে থাকতে পারব। তারা আমাকে আবারও বন্দী করবে না।”
চলবে..ইনশাআল্লাহ্…
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ভারতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হালাত নিয়ে তৈরি “Rohingya Refugees Recall Desperate Conditions With No Legal Recourse In Delhi Detention Centre” এই শিরোনামে article14 এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আমরা ধারাবাহিক ভাবে বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করছি।
অনুবাদক ও সংকলক : সাইফুল ইসলাম
তথ্যসূত্র :
https://tinyurl.com/yvxps73w
Comment