Announcement

Collapse
No announcement yet.

উইঘুর মুসলিমদের আর্তনাদ || পর্ব-২ || কল্পকথা নয় – হাইতিওয়াজির গল্প

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • উইঘুর মুসলিমদের আর্তনাদ || পর্ব-২ || কল্পকথা নয় – হাইতিওয়াজির গল্প

    উইঘুর মুসলিমদের আর্তনাদ || পর্ব-২ || কল্পকথা নয় – হাইতিওয়াজির গল্প



    গুলবাহার হাইতিওয়াজি, ৫৫ বছর বয়স্ক এই উইঘুর মুসলিম নারী প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একটি দুঃস্বপ্ন দেখেন, যা পূর্ব তুর্কীস্তানের ডিটেনশন ক্যাম্পে তাঁর কাটানো সময়গুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলে।

    হাইতিওয়াজি বলেন, “আমি সব সময় উদ্বিগ্ন থাকি। আমরা উইঘুর মুসলিমরা আজ সেখানে বন্দী, পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। আমার উদ্বেগ আরও বেড়ে যায় যখন আমার মনে হয় যে, আমরা হয়তো গণহত্যার শিকার হতে যাচ্ছি।”

    উইঘুর এই স্মৃতিচারণকারিণী তাঁর “কিভাবে আমি একটি চীনা ‘পুনঃশিক্ষা’ ক্যাম্পে বেঁচে ছিলাম” বইতে চীনের ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকাকালীন অভিজ্ঞতার কথাগুলি ব্যক্ত করেছেন যা পরবর্তীতে একাধিক ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বর্তমানে প্যারিসের উপকণ্ঠে একটি এপার্টমেন্টে বসবাস করছেন।

    হতাশা ও ভয় :

    হাইতিওয়াজি বলেন, সেখানকার বিষয়ে প্রথম যে দুটি শব্দ আমার মনে আসে তার একটি হল ‘হতাশা’। কারণ সেখানকার মানুষরা কখনই জানতে পারে না যে কতদিন তাঁরা সেখানে থাকবে। অপরটি হল ‘ভয়’, কারণ সেখানকার মানুষরা সব সময় সামনের দিনগুলি নিয়ে খুবই ভয়ে থাকে।

    হাইতিওয়াজি মূলত ছিলেন একজন প্রকৌশলী। ২০০৬ সালে তিনি তাঁর মেয়েদের নিয়ে ফ্রান্সে তাঁর স্বামীর কাছে চলে যান। ২০১৬ সালের নভেম্বরে তিনি একটি ফোন পান যেখানে ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি নিজেকে জিনজিয়াং অয়েলফিল্ড কোম্পানির হিসাবরক্ষক বলে দাবি করে। ফোনে সেই ব্যক্তিটি হাইতিওয়াজিকে তাঁর প্রশাসনিক অবসর প্রক্রিয়ার জন্য কারামে ফিরে আসতে বলে।

    হাইতিওয়াজি বলেন, আমার মধ্যে কোন সন্দেহ কাজ করে নি। কারণ ফ্রান্সে থাকাকালীন আমি চীনা বিরোধী কোন কর্মকাণ্ডে কখনও অংশগ্রহণ করিনি। কিন্তু কারামে সেই কোম্পানিতে আসার পর আমি বুঝতে পারলাম যে আমাকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। আমি সেখানে পৌঁছানোর দশ মিনিট পর তিনজন পুলিশ অফিসার এসে আমাকে থানায় নিয়ে যায়।

    পুলিশ হাইতিওয়াজিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং প্যারিসে ‘উইঘুর অধিকার সমাবেশে’ তাঁর মেয়ের অংশ নেওয়ার একটি ছবি তাঁকে দেখায়।

    হাইতিওয়াজিকে ওই রাতেই সাময়িকভাবে চলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলেও পুলিশ তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে। দুই মাস পর পুলিশ তাঁকে তাঁর পাসপোর্টটি নেওয়ার জন্য কারামের একটি থানায় যেতে বলে। হাইতিওয়াজি সেখানে গেলে তাঁকে আবারও গ্রেফতার করে পুলিশ।

    হাইতিওয়াজিকে মাত্র নয়জন কয়েদী থাকার মতো একটি সেলে বন্দী করে রাখা হলেও প্রকৃতপক্ষে সেই সেলে ছিল প্রায় ৩৫ জনের মতো বন্দী। তিনি বলেন, সেখানে বন্দীদের ভিড় ছিল। কর্তৃপক্ষ প্রতিটি সেলে পাশাপাশি নয়টি বিছানা বিছিয়ে একটি বড় বিছানা তৈরী করেছিল। বিছানার এক পাশে ছিল কিছু বড় বড় হাতকড়ার মতো ধাতব। সেখানে যাদের শাস্তি দেওয়া হতো তাঁদের সেই হাতকড়া দিয়ে বেঁধে রাখা হত।

    তারা আমাকে ২০ দিন পর্যন্ত বেঁধে রেখেছিল। তবে এক বন্দীকে একটানা তিন মাস পর্যন্ত বেঁধে রাখার রেকর্ড সেখানে আছে। হাইতিওয়াজি বলেন, আমি জানতাম না যে কেন আমাকে তারা এই শাস্তি দিয়েছিল।

    তিনি বলেন, যখন আমাকে বিছানায় বেঁধে রাখা হয় তখন প্রায় ১০ দিন আমি আমার অন্ত্রের নাড়াচাড়া করতে পারি নি। আমাকে সেখানে ঠিক কুকুরের মতো বেঁধে রাখা হয়। আমার জীবনে প্রথম মানুষের সামনে আমাকে এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। এসব কথা যখন আমার মনে আসত তখন আমি অনেক কান্না করতাম।

    হাইতিওয়াজির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছিল। তবে সকল অভিযোগের মূলে ছিল কথিত ‘সন্ত্রাসবাদ’।

    হাইতিওয়াজি বলেন, শেষ পর্যন্ত তারা আমার স্বামী এবং মেয়েকে সন্ত্রাসী হিসেবে মেনে নিতে জোর করে। যদিও তারা সেটা করতে ব্যর্থ হয়।

    ‘স্কুল’ জীবন :
    চার মাস সাত দিন বন্দী থাকার পর হাইতিওয়াজিকে পূর্ব তুর্কীস্তানের একটি ‘স্কুলে’ প্রেরণ করা হয়। তারা প্রত্যেক বন্দীকে একটি করে ‘জেল নম্বর’ দেয়। হাইতিওয়াজির নম্বর ছিল ৯। হাইতিওয়াজি যাদের সাথে বন্দী ছিল তাঁদের নাম তিনি কখনই জানতে পারেননি।

    তিনি বলেন, স্কুলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের একটি প্রতিকৃতি ছিল যার নিচে সকল ‘শিক্ষার্থীদের’ একত্রে মিছিল করতে হত। স্কুলে সেখানে মান্দারিন, সাহিত্য, গণিত, ইতিহাস ও ভূগোলের উপর ‘শিক্ষার্থীদের’ ক্লাস করতে হত।

    হাইতিওয়াজি বলেন, স্কুলে আমার জীবন অনেকটা রোবটের মতো ছিল। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, ১১ ঘন্টা ক্লাস নেওয়া, চীন সরকার কর্তৃক নির্ধারিত পাঠ্যক্রম- ইতিহাস, আইন, চীনা ভাষা অধ্যয়ন করা ইত্যাদি আমার দৈনিক কাজ ছিল। প্রতি সপ্তাহে আমাদের একটি বিশেষ গান শিখতে হত যা ‘লাল গান’ (বা রেড সং- যা কমিউনিস্টদের জন্য ছিল) নামে পরিচিত ছিল। সেই গানের মধ্যে একটি কথা ছিল এমন যে, “কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া, কোন নতুন চীন থাকবে না.”

    প্রতি শুক্রবার সেখানে পরীক্ষা হতো। এবং শিক্ষার্থীদের বলা হতো তারা যদি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয় তবে তাদের সেখানে চিরকাল থাকতে হবে।

    চীন কি বলে?
    ২০২১ সালের এক সংবাদ সম্মেলনে পূর্ব তুর্কীস্তানের জননিরাপত্তা বিভাগের উপ-পরিচালক ইয়ালুন ইয়াকুপ হাইতিওয়াজিকে ‘গুলিবাহার মাইহামুতিজান’ নামে উল্লেখ করে। ইয়াকুপ হাইতিওয়াজিকে “বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং সন্ত্রাসী” হিসেবে আখ্যা দেয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা বলার অভিযোগ আনে। ইয়াকুপের দাবি হাইতিওয়াজি বেশ কয়েকবার চীনে এসেছেন এবং উইঘুরপন্থী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে দেশে “দাঙ্গা” লাগানোর চেষ্টা করেছেন।

    রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া কর্তৃক প্রকাশিত ২০২১ সালের একটি নিবন্ধে চীন পূর্ব তুর্কীস্তানের কথিত ‘সুবিধাগুলিকে’ বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে বর্ণনা করেছে। তাদের মতে সেখানে প্রশিক্ষণার্থীদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং মর্যাদা পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে। সেই নিবন্ধে তারা উল্লেখ করেছে যে, এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের লক্ষ্য ছিল প্রশিক্ষণার্থীদের ডির‍্যাডিকালাইজ করা। সেখানে আরও উল্লেখা হয়েছে যে, কেন্দ্রের সমস্ত প্রশিক্ষণার্থী ২০১৯ এর অক্টোবরের মধ্যে তাদের স্নাতক সম্পন্ন করেছে।

    হাইতিওয়াজি বলেন, বর্তমানে চীন সেখানে আরও ক্যাম্প তৈরি করেছে। তারা বিশ্বকে কেবল প্রতারিতই করেছে।

    আটক পরবর্তী জীবন :

    ২০১৯ সালের আগস্টে হাইতিওয়াজির পরিবার এবং ফরাসি সরকারের প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাঁকে মুক্ত করে প্যারিসে ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি বলেন, পূর্ব তুর্কীস্তানে তিনি যে নারীদের পেছনে ফেলে এসেছেন তাঁদের কথা তিনি এখনো ভাবেন।

    তিনি বলেন, তাঁরাই প্রকৃত কারাগারে বাস করে। এমনকি তাঁরা যখন মুক্তি পায় তখনও তাঁরা খোলা আকাশের কারাগারে থাকে। কারণ তাঁদের নেই কোন বাক-স্বাধীনতা, নেই কোন সমালোচনা করার স্বাধীনতা, নেই কোন চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা।

    হাইতিওয়াজি পূর্ব তুর্কীস্তানের ক্যাম্পে বন্দী থাকা সকল উইঘুর মুসলিমদের উৎসর্গ করে তাঁর বইয়ের শিরোনাম পাতায় লিখেছেন- “তাঁদের সবার জন্য যারা আজও সেখানে বন্দী।”



    অনুবাদক ও সংকলক : ওবায়দুল ইসলাম




    তথ্যসূত্র :
    1. A Uyghur’s Story: What It’s Like Inside a Xinjiang Reeducation Facility
    https://tinyurl.com/bdzn79sr
    আপনাদের নেক দোয়ায় আমাদের ভুলবেন না। ভিজিট করুন আমাদের ওয়েবসাইট: alfirdaws.org
Working...
X