Announcement

Collapse
No announcement yet.

পাঠচক্র- ৩৭ || “ফিলিস্তিনের স্মৃতি ” ।। শহীদ ড. আবদুল্লাহ আযযাম রহ. || দ্বাদশ পর্ব

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • পাঠচক্র- ৩৭ || “ফিলিস্তিনের স্মৃতি ” ।। শহীদ ড. আবদুল্লাহ আযযাম রহ. || দ্বাদশ পর্ব

    ফিলিস্তিনের স্মৃতি
    ।।শহীদ ড. আবদুল্লাহ আযযাম রহ. ||
    এর থেকেদ্বাদশ পর্ব



    পানশিরে যুদ্ধবিরতি

    আহমদ শাহ' মাসউদ[1]। আপনারা এই নেতার নাম শুনেছেন। আপনারা তাঁর সম্পর্কে আর কী জানেন? এখন তাঁর সম্পর্কে বলি। মনে করুন, তাঁর এলাকার আশেপাশে প্রায় তিনশোটি ট্যাঙ্ক ও স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান রয়েছে। এগুলো কোনো এলাকা বা গাড়িবহরকে ধ্বংস করে দিতে পারে। রুশ বাহিনী তখন জানালো, আমরা কীভাবে এই বিপর্যয় থেকে রেহাই পেতে পারি? আমরা তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তারা আহমদ শাহ মাসউদের কাছে এই মর্মে প্রতিনিধিদল পাঠালো যে আমরা আপনার সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি-বৈঠক করতে চাই। আহমদ শাহ মাসউদ আলেমদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। আলেমগণ জানালেন, যুদ্ধবিরতি বৈঠক করতে কোনো সমস্যা নেই। রুশ বাহিনী তাঁকে আহ্বান জানালো, আপনি আমাদের কাছে আসুন। তিনি জানালেন, না, আমি আপনাদের কাছে আসতে পারবো না। রুশ বাহিনী জানালো, তাহলে আমরা পথের মাঝামাঝি স্থানে মিলিত হয়ে বৈঠক করি। আহমদ শাহ মাসউদ জানালেন, না, বরং আপনারা আমার কাছে আসুন। রুশরা জানালো, তাহলে আপনি আমাদের কাছে (বৈঠকের নিরাপত্তাবিধানের জন্যে) জামানত রাখুন। আহমদ শাহ মাসউদ জানালেন, না, আমি আপনাদের কাছে কোনো জামানত রাখতে পারবো না। এমনিতেই আপনারা আমার কাছে আসবেন। ফলে রুশ কমান্ডাররা নীচ-হেয় হয়ে আহমদ শাহ মাসউদের সামনে উপস্থিত হলো। তিনি তখন অনেক পরিণত হয়েছেন। তাঁর বয়স হয়েছে তখন ৩৭ বছর। পনেরো বছর আগে ২২ বছর বয়সে তিনি জিহাদ শুরু করেছিলেন। তিনি ও রুশ বাহিনীর জেনারেল বা উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাগণ বৈঠকে মিলিত হলেন। প্রথম রাত গেলো, দ্বিতীয় রাত গেলো, তৃতীয় রাত গেলো। কিন্তু কোনো সমাধানে পৌঁছানো গেলো না। রুশ জেনারেলরা বললেন, আপনি হয়তো আমাদের প্রকৃত অবস্থা জানেন না; কী ভয়াবহ বিপর্যয়কর অবস্থায় আমরা আছি। আমাদের মানসিক অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে। এই নির্বোধ উন্মাদ নেতা (ব্রেজনেভ[2]) আমাদের এই অবস্থায় নিক্ষেপ করে আমাদের ত্যাগ করেছেন (মৃত্যুবরণ করেছেন)। আমাদের মনে হচ্ছে, আমাদের পায়ে বেড়ি পরানো হয়েছে। আমরা বন্দি হয়ে পড়েছি। আমরা নিজেদেরকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে চাই।

    তারপরের রাত থেকে তাঁরা যা কিছু আলোচনা করেন তা আমি লিখে রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। পরে ভাবলাম তা ঠিক হবে না। এটা হবে একটা নীচু ধরনের কাজ। তাছাড়া এতে মজলিসের আমানত রক্ষা হবে না। তাঁরা একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করলেন। পানশিরে ছয়মাস যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। আহমদ শাহ মাসউদ মুজাহিদদের পানশিরের বাইরে পাঠাতে লাগলেন। তারা অন্যান্য এলাকায় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করবে এবং পানশিরে ফিরে আসবে। পানশিরে ছয়মাস যুদ্ধ নিষিদ্ধ। পানশির এবং সালাং গমনের মধ্যবর্তী স্থানে একটি পাহাড় আছে। তিনি মুজাহিদদের একটি দল বা সেনাদের একটি কোম্পানি সালাংয়ে প্রেরণ করেন। তারা সেখানে অভিযান চালায় এবং পানশিরে ফিরে আসে। এদিকে পানশিরের আকাশে বিমান চলাচল নিষিদ্ধ। ট্যাঙ্ক থেকে গোলাবর্ষণ নিষিদ্ধ। ফলে রুশরা বুঝতে পারে, তাদের যুদ্ধবিরতির চুক্তি লাভজনক হয় নি।

    আন্দ্রোপভের[3] মৃত্যু হয় এবং তারপর চেরনেনকো[4] ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু আপনারা বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহপাকের কৌশল দেখেন। সুবহানাকা ইয়া রব! আপনারা কি কখনো শুনেছেন মাত্র চার বছরে সোভিয়েত ইউনিয়নের তিনজন নেতার মৃত্যু হয়েছে? আফগানিস্তানের মজলুম ও নির্যাতিতদের দোয়া আল্লাহপাক এভাবেই কার্যকর করেছিলেন। মাত্র চার বছরে সোভিয়েত ইউনিয়নের তিনজন নেতা মারা গেলেন। স্টালিন[5] তিরিশ বছর রাশিয়া শাসন করেন। [স্টালিনের পর জর্জি মালেনকভ কয়েক মাস পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং ৫ই মার্চ, ১৯৫৩ থেকে ৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৫ এই দুই বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পার্টির ক্ষমতা নিয়ে ক্রুশ্চেভের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিলো।] তারপর আসেন ক্রুশ্চেভ[6]। তিনি শাসন করেন দশ বছর। ক্রুশ্চেভের পর প্রেসিডেন্ট হন ব্রেজনেভ। ব্রেজনেভ রাশিয়া শাসন করেন পনেরো বছর। [তিনি মূলত মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আঠারো বছর দেশ শাসন করেন।] তারপর তিনি মাত্র এক বছর বেঁচে ছিলেন। (তিনিই আফগানিস্তানে আক্রমণ করার জন্যে রুশ সামরিক বাহিনী প্রেরণ করেন।) তারপর ক্ষমতায় আসেন আন্দ্রোপভ। দেড় বছরের মাথায় তিনি মারা যান। তারপর আসেন চেরনেনকো এবং এক বছরের মাথায় মারা যান। এভাবেই মাত্র চার বছরে পরপর তিনজন নেতা মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেন। আফগানিস্তানের নির্যাতিত নর-নারীর আহাজারি আসমানে পৌঁছেছিলো এবং তাদের ওপর শাস্তি আপতিত হয়েছিলো। আল্লাহপাক তাদেরকে ধ্বংস করেছেন।

    চেরনেনকো ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা করলেন, এইভাবে মার খাওয়া আমাদের জন্যে পরিহাস ছাড়া কিছু নয়। আপনারা নতুনভাবে কমিটি গঠন করুন। এই কমিটি আহমদ শাহ মাসউদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করবে। তারা নতুন কমিটি গঠন করে। এই নতুন কমিটি যুদ্ধবিরতির জন্যে কতোগুলো শর্ত লিপিবদ্ধ করে। কমিটি শর্তসম্বলিত কাগজপত্র আহমদ শাহ মাসউদের কাছে প্রেরণ করে এবং এই মর্মে দুঃখ প্রকাশ করে যে, আগের কমিটি ধোঁকা দিয়েছিলো এবং শর্ত ভঙ্গ করেছিলো। এবার আমরা নতুনভাবে কমিটি গঠন করে নতুন শর্ত তৈরি করেছি। আমরা আগামীকাল যুদ্ধবিরতির শর্তগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্যে আপনার সঙ্গে বসতে চাই। আহমদ শাহ মাসউদ জানালেন, আমরা আগামীকাল আপনাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারবো না। ইনশাআল্লাহ, দুই সপ্তাহ পর আমরা আপনাদের সঙ্গে বসবো। এরপর তিনি কৃষকদেরকে গম ও অন্যান্য শস্য জমিয়ে রাখতে আদেশ দিলেন। তিনি তাদের বললেন, আমি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। আপনারা গম ও অন্যান্য শস্য সংগ্রহ করে ঘরে তুলে রাখুন।

    দুই সপ্তাহ পর তিনি কালাশনিকভ হাতে নিলেন। এই কালাশনিকভগুলো ছিলো রুশ বাহিনী থেকে গনিমত হিসেবে পাওয়া। সামরিক পোশাক পরলেন। তিনি ও তাঁর সঙ্গে যে-দলটি ছিলো তাঁরা সামরিক পোশাক পরতেন। তাঁদের প্রত্যেকের জন্যে ফজরের নামায থেকে নিয়ে আসরের নামায পর্যন্ত সামরিক পোশাক পরা বাধ্যতামূলক ছিলো। সামরিক পোশাক পরে কালাশনিকভ হাতে নিয়ে তাঁরা সেই কমিটির অফিসে গেলেন। কাদের কমিটি ছিলো এটা? এটা সেইসব সামরিক অফিসারদের কমিটি ছিলো যারা আটলান্টিক চুক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে গোটা বিশ্বের মুখোমুখি হওয়ার পরিকল্পনা করেছিলো। আহমদ শাহ মাসউদ বলেন, 'আমি তাদের শর্তাবলির কাগজপত্র হাতে নিলাম এবং লাল কালি দিয়ে দাগালাম। তারপর নতুন করে কঠিন কতোগুলো শর্ত লিখলাম। আমার শর্তগুলো ছিলো আগের শর্তগুলোর তুলনায় বহু বহুগুণ কঠিন। আমি কাগজগুলো এগিয়ে দিলাম, তারা সেগুলো হাতে নিলো। তারা লাল দাগাদাগি দেখলো এবং তাদের কাগজগুলোর করুণ অবস্থা দেখলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নতুন শর্তগুলোর দিকে তাকালো। এরপর তারা ফুলে উঠলো, ফুঁসে উঠলো, লাল হয়ে উঠলো ও জ্বলে উঠলো।' তারা আহমদ শাহ মাসউদকে বললো, 'আমাদেরকে একটু বাইরে যাওয়ার সুযোগ দিন। আমরা সিগারেট খাবো।' আহমদ শাহ মাসউদ বললেন, "ঠিক আছে। আপনারা যান। তারা গলায় শিকার আটকে যাওয়া সাপের মতো গক গক করতে করতে বেরিয়ে গেলো। সিগারেট খেলো। 'এই ব্যাটার সঙ্গে আমরা কী আর আলোচনা করবো। যাও তোমরা সবাই ঘরে ফিরে যাও, তারা বলে। তারা ফিরে এসে আবার আগের জায়গায় বসে। এক সামরিক কর্মকর্তা—জেনারেল বা এ-পর্যায়ের একজন—কাগজগুলো হাতে নেয়। সে নিজেকে স্থির রাখতে পারে না; কাগজগুলো আহমদ শাহ মাসউদের ওপর ছুঁড়ে মারে। আহমদ শাহ মাসউদ কাগজগুলো হাতে নিয়ে মুঠি বানিয়ে সেই রুশ সামরিক কর্মকর্তার মুখে আঘাত করে বলেন, 'বেয়াদব, এখান থেকে বেরিয়ে যাও।' তখন অন্য সামরিক কর্মকর্তা বলে, 'তাকে আপনি সুযোগ দিন। সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে।' আহমদ শাহ মাসউদ বললেন, 'এই বেয়াদব ঘর থেকে বেরিয়ে না গেলে আমাদের পক্ষে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

    আল্লাহু আকবার! আল্লাহর রাসুলের একজন সৈনিক এক রুশ জেনারেলকে বৈঠক থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করলেন! ইসলাম তার সৈনিককে জিহাদের মাধ্যমে কী মর্যাদাই না দিয়েছে। তারা সেই জেনারেলকে বৈঠক থেকে বের করে দিয়ে আবার বসলো। দ্বিতীয় দিন তারা আহমদ শাহ মাসউদকে একটা চিঠি লিখলো, 'আমরা কালাশনিকভের ভয়ে শঙ্কিত। তাছাড়া এইসব শর্ত পক্ষপাতমূলক ও বিধ্বংসী। শর্তগুলো মানা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।' কমিটির প্রধান আহমদ শাহ মাসউদের কাছে আসে। তাঁকে অনুরোধ করে, "আপনি অনেক কঠিন শর্ত দিয়েছেন। আপনি আমাদের প্রতি নরম হোন।' সে আরো নানা ধরনের অনুরোধ জানায়। ইয়া সালাম! আহমদ শাহ মাসউদ তাদের প্রতি দয়ার্দ্র হন। তিনি শর্তগুলো শিথিল করেন এবং একটি বা দুটি শর্ত কেটে দেন। তারা আবার আলোচনায় বসে এবং তারা এটাকে রাশিয়ার সম্মানের জন্যে হুমকি মনে করে।

    এক উপত্যকায় একজন সামান্য মুজাহিদ। এখন পর্যন্ত সেখানে গাড়ি প্রবেশ করে না। সেখানকার জমি এখনো আবাদ হয় নি। রুশরা ভাবে, এই ব্যাটা যা ইচ্ছা তাই আমাদের ওপর চাপিয়ে দেবে, তা হতে পারে না। আহমদ শাহ মাসউদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিরক্ষা-মন্ত্রী সপোলভ নিজে সেখানে আসে। যুদ্ধের সার্বিক পরিকল্পনা করতে সে তার সঙ্গে দুইজন জেনারেলকে (বা দুইজন মার্শাল) নিয়ে আসে। আফগানিস্তানে নিযুক্ত তাদের গোয়েন্দারা তাদেরকে জানায় যে, 'আহমদ শাহ মাসউদকে দেশের সব যুবকই পছন্দ করে।' আলহামদুলিল্লাহ, আপনারা যুবকদের পকেটে আহমদ শাহ মাসউদের ছবি দেখতে পাবেন। রুশরা বলে, তাহলে তো সে তার জাতির লোক। হ্যাঁ তারা সত্যই বলেছিলো এবং সেটাই ছিলো বাস্তব ।

    তারা পরিকল্পনা করে যে পানশিরে একান্ন হাজার রুশ সেনা প্রবেশ করবে। অথচ সেখানে ছিলো মাত্র চার হাজার মুজাহিদ। প্রথম তিনদিনের প্রতিদিন ছয়শো বিমান হামলা হবে। প্রতিটি হামলায় অংশ নেবে প্রায় তিরিশটি বিমান। অর্থাৎ, আপনি কল্পনা করুন... ছয়শো হামলা, অর্থাৎ পানশিরে একদিনে চব্বিশ হাজার টন বিস্ফোরক ফেলা হবে। সংখ্যাটি ভুল নয়, পানশিরে একদিনে বিস্ফোরক ফেলা হবে চব্বিশ হাজার টন। এক কেজি বিস্ফোরক দিয়ে প্রায় বিশটি বোমা বানানো যায়। তাহলে একটন দিয়ে কতোগুলো বোমা বানানো যাবে? বিশ হাজার বোমা বানানো যাবে। এই সংখ্যাটিকে চব্বিশ হাজার দিয়ে গুণ করুন। দেখুন কতো হয়। মানে ৪৮,০০,০০,০০০টি বোমার সমপরিমাণ বিস্ফোরক ফেলা হবে প্রতিদিন। এর ফলে কী ঘটে? বরফ গলে এলাকা প্লাবিত হয়। কাহিনি অনেক লম্বা।

    যাই হোক। মুজাহিদরা ট্যাঙ্ক ধ্বংস করার জন্যে উপত্যকায় মাইন পুঁতে রাখে। রুশরা তাদের ধারণামতে যে-পথ দিয়ে পানশিরে প্রবেশ করবে সে-পথে মুজাহিদরা সারি সারি মাইন বিছিয়ে রাখে। উপত্যকার বাইরেও তারা মাইন বিছিয়ে রাখে। উপত্যকার ভেতরে তারা ওত পেতে থাকে ট্যাঙ্ক ধ্বংস করার জন্যে। রুশরা একই সঙ্গে ওপর থেকে বিমান হামলা করছিলো এবং স্থলপথ দিয়ে ট্যাঙ্ক নিয়ে এগিয়ে আসছিলো। প্রথম দিন ট্যাঙ্কগুলো প্রবেশ করে। এদিকে পানশিরে মুজাহিদদের ধ্বংসের খবর শোনার জন্যে সপোল তার আস্তানায় বসে ছিলো। তবে তার কাছে মুজাহিদদের ধ্বংসের কোনো খবর আসে না। খবর আসে, 'আমরা পানশিরে প্রবেশ করে মাইন ছাড়া আর কিছুই পাই নি। আমাদের অনেক ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়ে গেছে। এই খবর শোনার পর সপোলভ এতোটাই হতভম্ব হয়ে যায় যে তার হাত থেকে কলম পড়ে যায়। কর্মকর্তারা তাকে জিজ্ঞেস করে, 'আপনার মনোভাব কি, কী মনে হয় আপনার?' সে বলে, 'আমরা যুদ্ধে হেরে গেছি।'

    সেদিন রাতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সম্মানে রুশ দূতাবাস কর্তৃক আয়োজিত এক নৈশভোজের অনুষ্ঠান ছিলো। যথারীতি সেখানে রুশ রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। ফরাসি রাষ্ট্রদূত রুশ রাষ্ট্রদূতকে জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনারা কি পানশিরের সবাইকে জবাই করে ফেলেছেন?' জবাবটা রুশ রাষ্ট্রদূতের জানা ছিলো। তাই সে তার মাথা নিচু করে রাখে। চা-পানপর্বের আগেই সে জলসা থেকে বেরিয়ে যায়।

    যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ছয়মাস পেরিয়ে যায়। রুশ বোমারু বিমান একেক দিন কাবুলের খাজারাওয়াশ থেকে, বাগরাম থেকে, কালাদিহ থেকে আসতো এবং পানশিরে হামলা করে ফিরে যেতো। আবার রাশিয়া থেকেও একদিনের জন্যে আসতো বোমারু বিমান। সকালে আসতো এবং পানশিরে হামলা করে রাশিয়ায় ফিরে যেতো। সকালে যখন বিমান আসতো, বারওয়ান ও কাবিসার বাসিন্দারা বিমান দেখার জন্যে কান্নাকাটি করতো। তারা থাকতো পাহাড়ের চূড়ায়। পাহাড়ের চূড়ায় বিছানো থাকতো মাইন। সেখানে রুশ কমান্ডোরা নামতো। পাহাড়ের চূড়াতেই তারা কমান্ডোদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতো। কমান্ডোরা তাদেরকে উপত্যকার দিকে নিয়ে আসতো। উপত্যকায় তাদের ওপর বোমারু বিমান বোমা বর্ষণ করতো। ট্যাঙ্কগুলো উপত্যকায় প্রবেশ করে তাদেরকে পুড়িয়ে মারতো।


    [1] আহমদ শাহ মাসউদ ১৯৫৩ সালের ২রা জানুয়ারি পানশিরের জানকালাক এলাকার বাজারাক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা দোস্ত মুহাম্মদ খান আফগান রয়্যাল আর্মিতে কর্নেল ছিলেন। আহমদ শাহ কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশলবিদ্যায় ডিগ্রি অর্জ করেন। তিনি পশতু ছাড়াও ফরাসি, ফার্সি, উর্দু ভালো বলতে পারতেন এবং ইংরেজি ভালো পড়তে পারতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাককালীন জমিয়তে ইসলামির ছাত্র সংগঠন সমান- ই জোওয়ানান-ই মুসলমান ( Organization of Muslim Youth)-এ যুক্ত হন। তখন জমিয়তে ইসলামির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক বুরহান উদ্দিন রব্বানি। ১৯৭৫ সালের দিকে জমিয়তে ইসলামি ও গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন হিযবে ইসলামির মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। এ সময় হিযবে ইসলামির কর্মীরা আহমদ শাহকে হত্যা করার চেষ্টা করে। ১৯৭৮ সালের ২৭ এপ্রিল পিপলস্ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তান (মার্ক্সবাদী) এবং সেনাবাহিনীর একটি দল প্রেসিডেন্ট দাউদ খানকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। তারা সমাজতন্ত্রের বিস্তার এবং সেভাবে নীতি নির্ধারণ করতে চাইলে দেশের ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এ-সময় সমাজতন্ত্রী সেনাদের হাতে সারাদেশে পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ মানুষ নিহত হয়। ১৯৭৯ সালে ২৪টি প্রদেশে সংঘাত শুরু হয়। অর্ধেকের বেশি সৈনিক সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে যায়। ৬ই জুলাই আহমদ শাহ মাসউদ পানশিরে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সম্মুখ যুদ্ধে সফল না হয়ে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। এ বছরেই ২৪ শে ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগান সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্যে সেনা প্রেরণ করে। সরকারবিরোধীদের তারা নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। আহমদ শাহ সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে এবং প্রতিরোধ যুদ্ধের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠেন। ১৯৮৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি রুশ বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করে। তারপরও পিপলস্ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সরকার মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। আহমদ শাহ মাসউদ সরকারবিরোধী লড়াই অব্যাহত রাখেন। দেশে চরম দুরবস্থা বিরাজমান রেখে ১৯৯২ সালে ১৭ই এপ্রিল এ সরকার ক্ষমতা ত্যাগ করে। ২৪ শে এপ্রিল পেশোয়ারে সমাজতন্ত্রবিরোধী দলগুলোর মধ্যে শান্তি ও ক্ষমতাবণ্টন চুক্তি সম্পাদিত হয়। এ চুক্তিতে আহমদ শাহ মাসউদকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। কিন্তু হেকমতিয়ার এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন। পরে অবশ্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২৭ শে সেপ্টেম্বর তালেবান ক্ষমতা দখল করে। এ সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন জমিয়তে ইসলামির বুরহান উদ্দিন রব্বানি এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হিযবে ইসলামির গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর প্রেসিডেন্ট হন মোল্লা মুহাম্মদ উমর এবং প্রধানমন্ত্রী হন মোল্লা বুরহান উদ্দিন। আহমদ শাহ মাসউদ তখনো প্রতিরক্ষামন্ত্রীকিন্তু হেকমতিয়ার ও তালেবান নেতাদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ অব্যাহত ছিলো এবং তিনি তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। যদিও তাঁরা উভয়ই তালেবান সরকারবিরোধী উত্তরাঞ্চলীয় জোটে ছিলেন।

    ২০০১ সালে ৯ই সেপ্টেম্বর (টুইন টাওয়ারে হামলার মাত্র দুই দিন আগে) উত্তর আফগানিস্তানের তাখার প্রদেশে খাজা বাহাউদ্দিন এলাকায় এক আত্মঘাতী হামলায় আহমদ শাহ মাসউদ নিহত হন। এই হামলার জন্যে আল-কায়েদাকে অভিযুক্ত করা হয়। কারণ ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিলো। এর আগে বহুবার কেজিবি, আইএসআই, আফগান কমিউনিস্ট কেএইচএডি, তালেবান ও আল-কায়েদা তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সেসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তাঁর জন্মস্থান বাজারাকেই তাঁকে দাফন করা হয়। কমিউনিস্টবিরোধী যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার জন্যে তাকে 'শেরে পানশির বা পানশিরের সিংহ নামে ডাকা হয়। তিনিই একমাত্র আফগান নেতা যিনি কখনো আফগানিস্তানের বাইরে থাকেন নি। ২০০১ সালে হামিদ কারজাইর সরকার তাকে 'আফগানিস্তানের জাতীয় বীর উপাধিতে ভূষিত করে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক পুত্র ও পাঁচ কন্যার জনক। তাঁর স্ত্রী সাদিকা মাসউদ ২০০৫ সালে ফরাসি ভাষায় রচিত তাঁর Pour lamour de Massoud (মাসউদের ভালোবাসার জন্যে) গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এতে তিনি প্রিয়তম স্বামীর ব্যক্তিজীবনের বর্ণনা দেন

    [2] পুরো নাম লিউনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ১৯০৬ সালের ১৯ শে ডিসেম্বর রাশিয়ার কামিয়ানস্কিতে (বর্তমানে নিপ্রোদজারঝিনস্ক, ইউক্রেন) জন্মগ্রহণ করেন। দিপ্রোদজারঝিনস্ক মেটালারজিক্যাল টেকনিকাম থেকে ১৯৩৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন শেষে ধাতব প্রকৌশলী হিসেবে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে লৌহ ও ইস্পাত কারখানায় যোগ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জরুরিভাবে সামরিক বাহিনীতে প্রেরিত হন এবং ১৯৪৬ সালে মেজর জেনারেল পদবি নিয়ে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন এবং ১৯৬৪ সালে মহাসচিব হিসেবে নিকিতা ক্রুশ্চেভের স্থলাভিষিক্ত হন। ব্রেজনেভ ১৪ই অক্টোবর, ১৯৬৪ থেকে ১০ই নভেম্বর ১৯৮২ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব ছিলেন। মূলত কমিউনিস্ট পার্টির নেতারাই দেশ পরিচালনা করতেন। রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানরা ছিলেন তাঁদের হাতের পুতুল। কারণ কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিবের চেয়ে বড়ো কোনো পদ ছিলো না। ব্রেজনেভ জোসেফ স্টালিনের পর সর্বাধিক আঠারো বছর ক্ষমতায় থেকে ১৯৬৪ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করেন। তিনি সামরিক খাতে উল্লেখযোগ্য হারে ব্যয় বৃদ্ধি করেন যা ছিলো মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ৫০%১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট নিরসনে ভূমিকা রাখতে না পেরে স্থবির অর্থনীতির জন্ম দেন। আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। ১৯৮২ সালের ১০ শে নভেম্বর মস্কোতে তাঁর মৃত্যু হয়।
    [3] পুরো নাম ইউরি ভ্লাডিমিরোভিচ আন্দ্রোপভ১৯১৪ সালের ১৫ই জুন রাশিয়ার স্টানিসা নাওস্কায়া অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। ১২ই নভেম্বর ১৯৮২ থেকে ৯ই ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব ছিলেন। এ-দিনেই মস্কোতে তাঁর মৃত্যু হয়।
    [4] পুরো নাম কোস্টাটিন ইউস্টিনোভিচ চেরনেনকো। ১৩ই ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৮৪ থেকে মৃত্যুর দিন ১০ই মার্চ ১৯৮৫ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯১১ সালে
    [5] পুরো নাম উওসেফ ভিসারিওনভিচ জুগাভিলি। আমাদের দেশে জোসেফ স্টালিন বা স্তালিন নামে পরিচিত। ১৮৭৯ সালে জর্জিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। রুশ কমিউনিস্ট একনায়ক। লেনিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির সবচেয়ে কর্তৃত্বময় ও প্রভাবশালী নেতা। বলশেভিক বিপ্লবের পর ১৯২২ সালের বলশেভিক দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯২৪ সালের লেনিনের মৃত্যুর পর কামিনিয়েভ ও জিনোভিয়েভের সঙ্গে যৌথভাবে লেনিনের স্থলাভিষিক্ত হন। প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রস্কি ও জিনোভিয়েভকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করে ১৯২৭ সালে তিনি পার্টির সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নে আমলাতন্ত্রের প্রবর্তক হিসেবে স্টালিনের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
    [6] পুরো নাম নিকিতা সের্গেইয়েভিচ ক্রুশ্চেভ (ক্রুশ্চেভ লেখা হলেও উচ্চারণ ক্রু-শোষ)১৮৯৪ সালের ১৭ই এপ্রিল রাশিয়ার ডিমিট্রিইয়েভস্কি এলাকার কালিনভ্কা গ্রামে তাঁর জন্ম। ১৯১৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৩৪ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ পান। ১৯৩৮ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক কমিটির ফার্স্ট সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৪ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৩ থেকে ১৪ অক্টোবর ১৯৬৪ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৫৮ সালে পার্টিপ্রধানের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী হয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। ১৯৬৪ সালে উভয় পদ থেকে অপসারিত হন। ১৯৭১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মস্কোতে তাঁর মৃত্যু হয়।






    আরও পড়ুন

    একাদশ পর্ব
    Last edited by tahsin muhammad; 13 hours ago.
Working...
X