Announcement

Collapse
No announcement yet.

পাঠচক্র- ৩৭ || “ফিলিস্তিনের স্মৃতি ” ।। শহীদ ড. আবদুল্লাহ আযযাম রহ. || শেষ পর্ব

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • পাঠচক্র- ৩৭ || “ফিলিস্তিনের স্মৃতি ” ।। শহীদ ড. আবদুল্লাহ আযযাম রহ. || শেষ পর্ব

    ফিলিস্তিনের স্মৃতি
    ।।শহীদ ড. আবদুল্লাহ আযযাম রহ. ||
    এর থেকে– শেষ পর্ব


    পরিশিষ্ট

    [যে-আমেরিকা আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করার জন্যে আফগানদের সহায়তা করে ছিলো সেই আমেরিকাই ২০০১ সালে আফগানিস্তানে আক্রমণ করে। তাদের স্বার্থোদ্ধারের দ্বৈতনীতি বোঝার জন্যে নিম্নোক্ত ভাষণটির পাঠ জরুরি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত জ্য কার্ক প্র্যাট্রিক ১৯৮২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এই ভাষণ প্রদান করেন।

    জ্যঁ কার্ক প্র্যাট্রিকের ভাষণ

    সাধারণ পরিষদে আফগানিস্তানের সমস্যা আরো একবার উপস্থাপিত হয়েছে। আরো একবার যথানিয়মে এবং প্রতিনিধির পর অন্য প্রতিনিধি তাঁদের বক্তৃতায় আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসন এবং নীতিহীন গণহত্যার নিন্দা করেন । আরো একবার আমরা বিবেচনা করবো এবং গভীর প্রত্যাশায় বিপুল ভোটাধিক্যে অবিলম্বে সেখান থেকে রুশ বাহিনীর প্রস্থান, আফগানদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জোটনিরপেক্ষতা রক্ষা এবং আফগান উদ্বাস্তুদের সসম্মানে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ওপর প্রস্তাব গ্রহণ করব। কিন্তু এসব করতে গিয়ে আমরা যেনো এ সমস্যার অনন্য গুরুত্ব নির্ণন থেকে সরে না দাঁড়াই। আজ এই পরিষদে আফগান সমস্যার চেয়ে আর কোনো অধিক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নেই, সুদূরপ্রসারী অন্য কোনো তাৎপর্যও নেই ।

    সে-দেশে রুশ আগ্রাসনের ফলে বা অন্য কোথাও তার জবরদস্তি ও দখলদারিত্বমূলক উপস্থিতির জন্যে আজ পূর্ব-পশ্চিম সম্পর্ক বিলুপ্তির পথে। বস্তুত এই আগ্রাসন সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপুঞ্জের ভৌগলিক অখণ্ডতা, জাতীয় স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। এ-ধরনের কর্মকাণ্ড দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে নিজ পরিচয়ে অক্ষুণ্ণ রেখে শান্তি এবং নিরাপত্তার মধ্যে বিকশিত হতে দেয় না।
    আফগানেরা আজ জিহাদে লিপ্ত। তাঁদের এই সংগ্রামের একটি বিশেষ দিক রয়েছে। সামরিক সামর্থ্যে দুর্বল ও অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলো যদি এভাবে আক্রান্ত হয়, পাশবিকতার শিকারে পরিণত হয় এবং পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয় তাহলে এমন রাষ্ট্রগুলোর ভবিষ্যৎ কী হতে পারে? আজ যদি আফগানিস্তানের অকুতোভয়, অসীম সাহসী, মুক্তিপ্রাণ মানুষকে নিজেদের ভিটেভূমি থেকে উৎখাত করা হয়, সহায়-সম্পদ লুণ্ঠন করা হয়, তাদেরকে সহজে পদানত করে রাখতে প্রচেষ্টা ব্যয় করা হয় তাহলে যারা হীনবল তাদেরকেও নিশ্চিতভাবে এই ভাগ্য বরণ করতে হবে। যে-প্রচেষ্টার মাধ্যমে আফগানদের পদানত করে তাদের ওপর সম্পূর্ণ ভীনদেশি সর্বগ্রাসী শাসন তন্ত্র চালিয়ে দেয়া হয়েছে, তার অমানবিক হিংস্রতা বর্তমান কম্পুচিয়ার হিংস্রতাকেও হার মানায়। বিশ্ব জানে না, আফগানিস্তানে এক চরম বর্বর শাসনতান্ত্রিক চণ্ডনীতির আড়ালে এবং আসল সত্য চেপে রেখে কী ভীষণ অন্যায় আর নিষ্ঠুরতা সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু তারপরও পাশবিকতার খবর ছড়িয়ে পড়ছে। উদ্বাস্তুদের বর্ণনা, সাংবাদিকদের কলাম-বিবরণ এবং যেসব চিকিৎসক সেখানে গিয়েছেন তাঁদের কাছ থেকে খবর বেরিয়ে আসছেই। এই ঘটনার প্রচণ্ডতা অনুমান করা যায় নিজেদের ভূমি থেকে উৎখাত হওয়া এবং প্রতিবেশী দেশে আশ্রয়গ্রহণ করা উদ্বাস্তুদের সংখ্যা থেকে। যখন রুশ আগ্রাসনের ফলে আফগানিস্তানের বাবরাক কারমালের বেআইনি সরকার | ২৭-১২-১৯৭৯ থেকে ২৪-১১-১৯৮৬] প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পাকিস্তানের আফগান উদ্বাস্তুর সংখ্যা বেড়ে গিয়ে চার লাখে পৌঁছে। এসব ভিটেভূমি ত্যাগকারী মানুষ তারাকি [নুর মুহাম্মদ তারাকি, ৩০-০৪-১৯৭৮ থেকে ১৪-০৯-১৯৭৯] এবং আমিনের [হাফিজুল্লাহ আমিন, ১৪-০৯-১৯৭৯ থেকে ২৭-১২-১৯৭৯] কমিউনিস্ট শাসনামলেই বিরামহীন অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিজেদের দেশ ছেড়ে পালায়। পূর্বসূরিদের অত্যাচারের চূড়ান্ত রূপ দেয়ার জন্যে বাবরাক কারমাল[1] প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্যূন তিন বছর শাসনকালেই উদ্বাস্তুর সংখ্যা দশ গুণ বেড়ে গিয়ে ত্রিশ লাখে পৌঁছায়—যা আফগানিস্তানের ১৯৭৮ সালের আদমশুমারি অনুসারে আনুপাতিক জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। কোনো একটি জাতির এতো বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর দেশান্তর বিশ্বে এই প্রথম। কিন্তু আফগানিস্তানে প্রকৃতপক্ষে যা ঘটছে তার যথার্থ রূপ উদ্বাস্তুর এই বিপুল সংখ্যা থেকেও উদ্ধার করা কঠিন। কারণ আফগানিস্তানের ভেতরেও উদ্বাস্তু সমস্যা রয়েছে। যুদ্ধ যেখানে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে মানুষ সেখান থেকে অন্যত্র সরে পড়ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলম্বনই হচ্ছে পোড়ামাটির নীতি। ফলে এই শীত মৌসুমেও তারা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের শিকার হবে।

    গত সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে বলা হয়েছিলো। তারা সে আহ্বানের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে আফগানিস্তানের সৈন্যসংখ্যা এক লাখ পাঁচ হাজারে উন্নীত করেছে এবং সাম্প্রতিক কালের ভয়াবহ নিষ্ঠুর সমরাভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। রুশ বাহিনী তাদের অভিযানকে সুদৃঢ় করে কাবুল থেকে ২৫০ মাইল দূরে কান্দাহারের প্রতিরোধ ঘাঁটিটি কামান দাগিয়ে প্রবল গোলাবর্ষণের মাধ্যমে দখল করে নেয়। এই নৃশংস বিভীষিকাময় হামলায় অসংখ্য বেসামরিক লোক প্রাণ হারায়। দুমাস পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে হেরাত ও মাজার-ই-শরিফে। পরবর্তী বসন্ত ঋতুতে তাশকর গালে অনুরূপ নিষ্ঠুর অপারেশন চালানো হয়। পরবর্তী গ্রীষ্মকালের প্রথম দিকে বিমান ও ট্যাঙ্ক হামলা চালিয়ে গুজার শহরটিকে মনুষ্যবাসের অযোগ্য করে বিরান ধ্বংসক্ষেত্রে পরিণত করা হয়। পৈশাচিক এই আক্রমণ যতোই তীব্রতর হয়, রুশ বাহিনীর হামলার সীমানা ততোই কাবুলের নিকটবর্তী হয়। পানশির ও লোগার উপত্যকায় সোমালি এলাকায় এবং কাবুলের কাছাকাছি জেলাগুলো ছাড়াও শৈল শহর পাগমানেও যখনতখন ও যত্রতত্র বোমাবর্ষণ চলতে থাকে। যার ফলে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হচ্ছে। প্রাণে বেঁচে যাওয়া কিছু লোক জানিয়েছেন, প্রতিরোধকারীদের খুঁজে না পেয়ে রুশ বাহিনী বেসামরিক লোকদের হত্যা করছে। কান্দাহারে রুশ বাহিনী যেভাবে হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠন চালিয়ে যাচ্ছে তা বাবরাক কারমাল গোষ্ঠীর অনেক দালালকেও মর্মাহত করেছে। এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী সোমালির এক গ্রামে দশ বছরের ঊর্ধ্বে সকল পুরুষ সদস্যকে তাদের নারীদের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সুইডিশ সাংবাদিক বর্জ আলমক্যুইস্ট—যিনি জুলাই-অগস্ট মাসে লোগার প্রদেশ ঘুরে এসেছেন—জানান, নারী, শিশু এবং বৃদ্ধদের টেনে-হিচড়ে রাস্তায় জড়ো করার পর গুলি করে হত্য করা হয়েছে। যুবকদের পিঠমোড়া করে বেঁধে রাস্তায় রাস্তায় হাতাহাতি যুদ্ধে বালুর বস্তার মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি আরো জানান, রুশ বাহিনী শস্যক্ষেত জালিয়ে দিচ্ছে। খাদ্য ও খাবার পানিতে বিষ মেশাচ্ছে এবং ঘরবাড়ি ও দোকানপাট লুট করছে। তারা এক ধরনের প্রজাপতি-বোমা ব্যবহার করে অসংখ্য আফগানকে হত্যা করে চলছে।

    ১৯৮১ সালে স্বাক্ষরিত নিরাপত্তাবিষয়ক আন্তর্জাতিক চার্টার—যাতে রুশ নেতারাও স্বাক্ষর করেছেন——লঙ্ঘন করে ব্যাপক গণহত্যার উদ্দেশ্যে বিশেষ ধরনের বিস্ফোরকপূর্ণ সিগারেটের প্যাকেট এবং খেলনা ব্যবহার করা হচ্ছে। আফগানিস্তানে নিয়োজিত ফরাসি ডাক্তাররা জানিয়েছেন, রুশ বাহিনী হাজারাজাত এলাকায় গ্রামে, মাঠে ও পাহাড়ি রাস্তায় মাইন ছড়িয়ে যাচ্ছে। যার ফলে বেসামরিক লোকজন অঙ্গপ্রতঙ্গ ও প্রাণ হারাচ্ছে। ড. রুড ম্যালহুরে বলেছেন, 'মাইনের আঘাতে হাতপা বিচ্ছিন্ন বহু শিশুর চিকিৎসা আমরা করেছি।' সত্য প্রকাশিত হওয়ার ভয়ে রুশ বাহিনী ফরাসিদের হাসপাতালগুলো ধ্বংস করে তাদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। বুবিট্র্যাপ মাইনের মতো নিষিদ্ধ অস্ত্রও রুশ বাহিনী আফগানিস্তানের যত্রতত্র ব্যবহার করে যাচ্ছে। ১৯২৫ সালের জেনেভা কনভেনশন এবং ১৯৭২ সালের বায়োলজিক্যাল কনভেনশন ভঙ্গ করে তারা আফগানিস্তানে রাসায়নিক মারণাস্ত্রও প্রয়োগ করে যাচ্ছে। পৃথিবীর ১১০টি দেশের সঙ্গে রুশ নেতারাও এই নীতিমালার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন। এই বছরের গোড়ার দিকে আফগানিস্তানে ৪৭ বার এ-ধরনের রাসায়নিক মারণাস্ত্র প্রয়োগের খবর আমাদের কাছে রয়েছে। তিন বছর আগে সেখানে আক্রমণ শুরু করে রুশ বাহিনী এই পর্যন্ত তিরিশ হাজার আফগানকে হত্যা করেছে। এই ধ্বংসযজ্ঞ তারা নির্বিঘ্নেই চালিয়ে যাচ্ছে। এই বছর রুশ যুদ্ধবন্দি আনাতোল শাখারভ তিন প্রকার রাসায়নিক মারণাস্ত্র প্রয়োগের কথা স্বীকার করেছেন। এই সোভিয়েত সৈনিকের স্বীকারোক্তির যথার্থতা পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণকারী উদ্বাস্তুদের মধ্যে সেখানে কর্মরত চিকিৎসকেরা দেখতে পেয়েছেন। তারা জানতে পেরেছেন এইসব মারণাস্ত্রে আক্রান্ত হওয়ার পর মানুষের শরীর দ্রুত পচে যায় এবং স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খসে যেতে থাকে। শাখারভ আরো জানিয়েছেন, আফগান মুজাহিদদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক মারণাস্ত্র প্রয়োগের সময় রুশ সৈনিকদের গ্যাস-মুখোশ পরার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো।

    আগামী সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রুশদের রাসায়নিক মারণাস্ত্র প্রয়োগ ও জীবাণু-অস্ত্র ব্যবহারের আরো তথ্য প্রকাশ করবে যা তারা লাওস ও কম্পুচিয়াতেও অবলীলায় প্রয়োগ করে চলেছে।

    আফগান মুজাহিদ এবং আফগান জনসাধারণ রুশদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে-শৌর্যবীর্য আর বীরত্বে পরিচয় দিচ্ছেন তা প্রমাণ করে যে, শতো বাধা-নির্যাতন আর প্রলোভন সত্ত্বেও তাঁদের ঐক্য অটুট রয়েছে। উদাহরণসরূপ বলা যেতে পারে যে, পানশির ও পাগমান এলাকায় রুশ বাহিনী একটি ঘাঁটি স্থাপন করায় মুজাহিদেরা পাহাড়ের আড়ালে আত্মগোপন করেন এবং রুশ বাহিনী সরে যাওয়ার পর তাঁরা ঘাঁটিটি দখল করে নেন। একই ঘটনা ঘটে সোমালি এলাকায়। কান্দাহারেও মুজাহিদগণ তাঁদের প্রতিরোধ ও প্রতি-আক্রমণ অব্যাহত রেখেছেন। উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই যে, গত আগস্ট মাসে সেখানকার কারাগার ভেঙ্গে সমস্ত কয়েদি বেরিয়ে পড়ে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখায়। ধ্বংসপ্রাপ্ত আর অগ্নিদগ্ধ অসংখ্য রুশ ট্যাঙ্ক আর সামরিক যান আফগানিস্তানের এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। এটা তো প্রকৃত প্রমাণ যে, রুশ বাহিনী আফগানিস্তানে মোটেও নিরাপদ নয় এবং আফগান জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতা এই যে, পুতুল সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর কোনো ইউনিটকেও সুসংহত করে যুদ্ধে নামাতে পারে নি এবং আজ পর্যন্ত কোনোরূপ সাফল্য আয় করে দেখাতে পারে নি। সামরিক বাহিনীতে বিদ্যমান জনসঙ্কট, সৈন্য সংগ্রহে সর্বপ্রকার কঠিন ফরমান জারি, বাধ্যতামূলক সৈন্য জোগাড়ের যাবতীয় প্রয়াস এবং একজন প্রাথমিক সেনা অফিসারকে উপমন্ত্রীর সমান বেতন দেয়ার অত্যুৎসাহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ফলে রাস্তাঘাট থেকে, বাড়িঘর থেকে ধর-পাকড় করে বল প্রয়োগের মাধ্যমে সৈন্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।

    গত গ্রীষ্মকালে বিরাট সংখ্যক বাধ্যতামূলকভাবে তালিকাভুক্ত সৈন্য (Conscript) পালিয়ে গিয়ে প্রমাণ করেছে যে, রুশদের এই প্রচেষ্টাও পণ্ডশ্রম হয়েছে। মুজাহিদ বাহিনীকে হয়রানি এবং তাদের বিরুদ্ধে সব ধরনের আক্রমণাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও রুশ বাহিনী এবং তাদের দালালরা সাধারণ আফগান জনগণের কাছে প্রথ্যাখ্যাতই হয়েছে। কিন্তু সবকিছু জেনেও রুশ বাহিনী আফগানিস্তানে তাদের অবস্থান দৃঢ় করেছে। তাদের এক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আছেই বলে মনে হয়। ক্ষতিকর যুদ্ধ চালিয়ে মুজাহিদ বাহিনীকে নিস্তেজ করা এবং সামরিক-সংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে আফগানিস্তানকে সম্প্রসারণবাদী সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গীভূত করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। তারা এই মতলব হাসিলে অনেক কাজই আঞ্জাম দিয়েছে। সামরিক নিয়ন্ত্রণ, সংস্থাপন, যানবাহন পরিচালনা, যোগাযোগ- ব্যবস্থাপনা, বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণসহ যাবতীয় অনুকূল অবকাঠামোর সবকিছুই রুশ বাহিনী নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে তারা আমু দরিয়ার ওপর একটি সেতুও নির্মাণ করেছে।

    চীনের সঙ্গে সংযোগকারী ও পাকিস্তানের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত ওয়াখান এলাকায় ওরা স্থাপন করেছে নিজেদের ঘাঁটি। সোভিয়েত ও তার জোটভুক্ত সকল দেশের অর্থনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে আফগানিস্তানের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে আবর্তিত করানো হচ্ছে। সোভিয়েতের হীনতম প্রয়াসের মধ্যে সম্ভবত রয়েছে আফগানদের সাংস্কৃতিকভাবে নতুন মতাদর্শে নেশাগ্রস্ত করা। এই উদ্দেশ্যে রাশিয়াতে ছয় থেকে নয় বছরের ছেলেমেয়েসহ অনেকের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং আফগানিস্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহকে মর্জিমাফিক ঢেলে সাজানো হচ্ছে। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে রুশ বিশেষজ্ঞদের বসিয়ে মগজ ধোলাইকরণের আরেক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের নতুন পাঠ্যক্রম চালু করে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করা হয়েছে, যাতে নতুন প্রজন্মকে সোভিয়েতের মূল ভূমিতে পাঠিয়ে সত্যকার মার্কসবাদী বানানো যায় ।

    সোভিয়েত রাশিয়ার বর্বরতা ও সামরিক হস্তক্ষেপের প্রেক্ষিতে ১৯৭৮ সালের 'সওর বিপ্লব' অপরিবর্তনীয়—তাদের এই পৌনঃপুনিক ঘোষণার বিশ্লেষণ দরকার। কিন্তু প্রশ্ন জাগে যে, কেনো রুশ বাহিনী জাতিসঙ্ঘের সনদকে ভ্রূকুটি দেখিয়ে বিশ্বজনমত ও আন্তর্জাতিক রীতি-নীতিকে পদদলিত করে একটি জোটনিরপেক্ষ ও প্রতিষ্ঠিত সরকারের পতন ঘটালো? একমাত্র আফগান জনসাধারণ ও তাদের বৈধ সরকারই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে, ১৯৭৮ সালের ঘটনাবলি পরিবর্তনযোগ্য না-কি অপরিবর্তনীয়। আফগানেরা বস্তুত অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে। তারা মুসলিম আলেমদের নিধন, জুলুম-অত্যাচার এবং রুশীয় জীবনপদ্ধতি প্রয়োগের বিরুদ্ধে অনেক আগেই রুখে দাঁড়িয়েছিলো। তারা হত্যা, বর্বরতা ও পাশবিক অত্যাচারের বিপ্লবকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং নিজেদের জীবনদর্শনকে মূলধন করে এগিয়ে চলেছে। সারা দেশব্যাপী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রুশ নীতিকে তারা প্রতিরোধ করে চলেছে। পুল-ই-চারখা ও কারালায় রুশ বর্বরদের রচিত গণসমাধিতে বুলন্দ আওয়াজ তুলেছে। যে-বিপ্লব ইসলামকে অবমাননা করে সে-বিপ্লবকে তারা গর্বের সঙ্গে পদাঘাত করে বারবার সরিয়ে দিয়েছে। রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গোটা দেশে জনধিক্কার ফুঁসে উঠেছে। কিন্তু গণধিকৃত মার্কসবাদী সরকার টিকিয়ে রাখার জন্যে সামরিক অভিযান চালিয়ে রুশ বাহিনী তৃতীয় বিশ্বের একটি স্বাধীন দেশে ব্রেজনেভ-নীতি প্রয়োগের ব্যবস্থা নিচ্ছে।

    কিন্তু এই ঘৃণ্য আগ্রাসন নীরবে মেনে নেয়া যেতে পারে না। 'আফগানিস্তানে ভাতৃসুলভ সাহায্য দিচ্ছি–সোভিয়েতের এই দাবিকে বিশ্ববাসী প্রত্যাখ্যান করেছে। 'সাময়িক সামরিক সাহায্য'—এই জাতীয় কপট আশ্বাস আজ থেকে ষাট বছর আগে সোভিয়েত রাশিয়া প্রতিবেশী স্বাধীন রাষ্ট্র খিভা এবং বোখারাকেও দিয়েছিলো। এ-প্রসঙ্গে ১৯২২ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারিতে কাবুলে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতের আফগান বিদেশ মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত চিঠির উদ্ধৃতি দিতে চাই। তিনি লিখেছিলেন, 'খিভা ও বোখারার স্বাধীন মর্যাদা আমাদের উভয় রাষ্ট্র সোভিয়েত ও আফগান সরকারের স্বাক্ষরিত চুক্তিতে বিধৃত হয়েছে। আমাদের সরকার এই দুই রাষ্ট্রের স্বাধীন সত্তাকে সব সময় স্বীকৃতি দিয়েছে। কেবল বোখারা সরকারের অনুরোধেই সেখানে কিছু সংখ্যক সৈন্য প্রেরণ করা হয়েছে এবং বোখারা সরকারের ইচ্ছাতেই তাদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে আনা হবে। আমাদের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সাহায্য কোনোমতেই বোখারায় কোনো প্রকার স্থায়ী হস্তক্ষেপ নয়।' স্মর্তব্য যে, রুশ রাষ্ট্রদূতের উল্লিখিত চিঠি লেখার দুবছর পরই খিভা ও বোখারাকে মূল সোভিয়েত ভূমির অঙ্গীভূত করা হয়। সে-দেশদুটির ভাষা তুর্কি ও ফরাসিকে উৎখাত করে এক ধরনের রুশ ভাষা আরোপিত হয়েছে, যা এই দেশদুটিতে আঞ্চলিক উপভাষা ছাড়া কিছুই ছিলো না। মসজিদগুলোকে যাদুঘরে পরিণত করা হয়। কুরআনের শিক্ষা বাতিল করা হয়। যারা এসবের বিরোধিতা করেছিলেন তাঁদের প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দিয়ে নির্মমভাবে হত্য করা হয়। তারপর রুশদর্শনে দীক্ষিত আমলা দিয়ে শাসনশোষণের যাঁতাকল ঘোরানোর কাজ শুরু হয়।

    ষাট বছর পর আজ আফগানিস্তানের ব্যাপারে একই যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছে। আফগানিস্তানে কি সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে? আজ পর্যন্ত ঘটনাপঞ্জির খতিয়ানে মনে হয় সেখানে খিভা ও বোখারার ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হচ্ছে। সরাসরি দখলদার মনে না হলেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে রুশেরা আফগানিস্তানে তাদের অবস্থান ক্রমশ চিরস্থায়ী করে চলেছে। এটা যদি চলতে দেয়া হয় তাহলে এর শেষ কোথায়? বিভা ও বোখারার মতো একই ভাগ্য কি প্রতিবেশীদের জন্যে অপেক্ষমাণ নয়?

    তাই শুধু কূটনৈতিক আলোড়ন নয়, বরং মানবিক চেতনাবোধ আজ আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। আজ জাতিসঙ্ঘ সনদ, 'জোরজবরদস্তি নয়'—এই নীতিজ্ঞান, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, জাতীয় স্বাধীনতা, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব অটুট রাখার ধ্যানধারণা বিপন্ন। এসবের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেললে অতি দ্রুত এই পৃথিবীতে নৈরাজ্য নেমে আসবে এবং সবল দুর্বলের প্রতি নিষ্ঠুরতা ও শোষণ চালাতে থাকবে। না, আমরা পারি না। আমরা এরূপ হতে দিতে পারি না। সোভিয়েত নেতৃবর্গের ধারণা জন্মেছে যে, আফগানিস্তানে নৃশংস আগ্রাসনের ফলে সারা বিশ্বে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া কিছুদিন ধৈর্যের সঙ্গে তাদের সয়ে যেতে হবে। জাতিসঙ্ঘ রুশদের এই কৌশলকে অবদমিত রাখতে অক্ষম। কিন্তু এই কালক্ষেপণ কোনোমতেই আগ্রাসনের অনুকূলে যাচ্ছে না। যতোই দিন যাচ্ছে আফগানিস্তানে সোভিয়েত উপস্থিতি ততোই ঘৃণার কারণে পরিণত হচ্ছে।

    আফগানিস্তানকে মুক্ত করার এক সুযোগ আমাদের সামনে উপস্থিত এবং আমরা ক্রেমলিন সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, তাদের ছলনা ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এককভাবে কিংবা এই বিশ্বপ্রতিষ্ঠান সামগ্রিকভাবে এটি ভাবতে চাই না যে, রুশদেরও এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকুক। আজকের প্রস্তাব আফগান সমস্যার সম্মানজনক অবসান ঘটাক এই আমরা চাই। সুষ্ঠু আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে রুশ সৈন্য আফগানিস্তান থেকে চলে যাক ফিরে আসুক আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সুযোগ এবং অগণিত আফগান উদ্বাস্তু তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাক। এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে জাতিসঙ্ঘ রুশদের বুঝিয়ে দিচ্ছে-তাদের অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। আশা করবো, এই প্রস্তাব সমাধান ত্বরান্বিত করবে।

    মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবকে এই প্রেক্ষিতে তাঁর মূল্যবান অবদানের জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছে। আমরা তাঁর প্রচেষ্টার সাফল্য কামনা করি এবং আশা করি রুশেরা তাঁকে সহায়তা করবেন এবং এগিয়ে আসবেন এই মনে করে যে 'সময় খুবই মূল্যবান।'

    অমিততেজ আফগান মুজাহিদিনি ঘন ঘন তীব্র আঘাতের মুখেও গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে স্বাধীনতা রক্ষার মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রমাণ হচ্ছে যে, তাঁরা কতো শক্তিমান, স্বাধীনতা রক্ষায় কী গর্বিত এই আফগান নারী-পুরুষ আর তাঁদের বীরত্ব কী সীমাহীন। আমাদের সকলের সমর্থনে তাঁরা একদিন নিজেদের মুক্ত করবেন এবং স্বাধীন জাতিসত্তা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেন—প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের ভাষায় 'নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়ার জন্যে'। তাঁরা তো এই-ই চান। আমরা এবং জাতিসঙ্ঘের সদস্যগণও এই প্রত্যাশা করি। [সামান্য সংক্ষেপিত]



    [1] বাবরাক কারমাল ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৭৯ থেকে ২৪ শে নভেম্বর, ১৯৮৬ পর্যন্ত আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯২৯ সালের ৬ই জানুয়ারি তিনি আফগানিস্তানের কামারাইতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯৬ সালের ১লা বা ৩রা ডিসেম্বর মস্কোতে মৃত্যুবরণ করেন।




    ​আরও পড়ুন
    বিংশ পর্ব
Working...
X