মযমূন ও উসলূব:
মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ
লেখার ক্ষেত্রে একটি জরুরি বিষয় আছে যেদিকে আমাদের নবীন প্রজন্ম মোটেই খেয়াল করে না। এমনকি যারা প্রতিষ্ঠিত লেখক তারাও খেয়াল করে না। অথচ নীতিটা নতুন কোনো ইনকিশাফ নয়, যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আমাদের আরবী বালাগাতে সব সময় তা বলে আসা হয়েছে। অর্থাৎ ‘মুকতাযায়ে হালে’র রেয়ায়েত করা। আমি যে বিষয়ে লিখব, আমার শব্দ, বাক্য,
উপস্থাপনা সবকিছু ঐ বিষয়ের সথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের মযমূন যা-ই হোক, উসলূব হয় ফুকাহী। তরল। আর এটার দ্বারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন আখতার ফারূক। তিনি যেন উসলূবে ফুকাহী ছাড়া অন্য কোনো উসলূব জানতেনই না। এজন্য জানাযার বয়ান দিলে ওখানেও তার ফুকাহাত এসে যেত। এটা তাঁর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। আমার এই মন্তব্য এজন্য গ্রহণ করতে হবে যে, তার কাছ থেকে এসতেফাদার কথা আমি প্রকাশ্যে স্বীকার করি। এই দুর্বলতা তার সবচেয়ে বেশি ছিল আর এখনকার প্রায় সবারই এই দুর্বলতা। লিখতে গেলেই তরলতা এসে যায়।
আমার হাতে এখন যে লেখাটা আছে এটা আমাদের কারো লেখা নয়, প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি লেখা। এর বিষয়বস্তু হল,
লেখক শীতের রাতে একজন অসহায় ছেলেকে বিপর্যস্ত অবস্থায় দেখতে পেয়েছে। শরীরে কাপড়-চোপড় নেই, খালি মেঝেতে শুয়ে আছে। সে তখন নিজের গায়ের ওভারকোটটা তাকে দিয়ে এসেছে। এটা শীতার্ত মানুষকে নিয়ে লেখা। বিষয়বস্তু বেদনাপূর্ণ। অতএব গোটা লেখায় বেদনার আবহ থাকতে হবে। শব্দ নির্বাচন এমন হতে হবে, যেন প্রতিটি শব্দ থেকে বেদনা ঝড়ে। সর্বোপরি তা যেন হৃদয়কে স্পর্শ করে এবং পাঠকের মধ্যেও সমবেদনা ও সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে। এটার জন্য ছূরত দুটি : নিজের ভিতরে সমবেদনা থাকতে হবে, কিংবা সমবেদনা থাকলে যা হয় সে অভিনয়টা জানতে হবে। কোনটা সবচেয়ে কার্যকর সেটা পরের প্রশ্ন। কিন্তু দু’ টোর কোনো একটা অবশ্যই লাগবে।
শুরুটা হল, ‘বেশ রাত, কুয়াশা ভেদ করে হাঁটছি।’ এটা হল গল্প বলার ঢং। আয়েশী অবস্থায় গল্প বলছে-বেশ রাত, কুয়াশা ভেদ করে হাঁটছি।’ এরপরের বাক্যটি এক শব্দের-‘একা।’ গল্পের আবহ। কোনো বেদনাদায়ক ঘটনা বলবে,
তা বোঝা যাচ্ছে না। অর্থাৎ উসলূবটা বেদনাদায়ক কোনো ঘটনা বলার উসলূব নয়, গল্প বলার উসলূব।
‘দৃষ্টির দৌড় সীমিত।’ দৌড় শব্দটার ব্যবহার তরল ক্ষেত্রে হতে পারে। এই লেখার বিষয়বস্তুর সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সাদামাটা ভাষায় লিখবে যে, ‘সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।’
দৃষ্টির দৌড় সীমিত-এই মাজায এখানে চলবে না।
‘রাস্তার পার্শ্বে লাইটপোস্টের আলোয় জ্বলজ্বল করছে অক্ষরগুলো। শহীদ আরমান রোড।’
গল্পের উসলূব। তাছাড়া বাস্তবের সাথেও মেলে না। কারণ কুয়াশা ভেদ করে হাঁটছ,
দৃষ্টির দৌড় সীমিত, কিন্তু
লাইটপোস্টের আলো জ্বলজ্বল করছে কীভাবে? এখানে
‘জ্বলজ্বল’ শব্দের ব্যবহার বাস্তবসম্মত নয়।
‘শহীদী মসজিদের সামনে এলাম। টাইলস করা চত্বর। টুপটাপ ঝরছে শিশির।’ গল্প। আর চত্বরে টুপটাপ ঝরবে কীভাবে? টুপটাপ ঝরতে হলে গাছ-গাছালি লাগবে। পাতার উপর থেকে পাতায় ঝরতে হবে। মানে শব্দ শিখেছে কিন্তু
শব্দটা ভিতরে নেয়নি। আমি আগে একদিন বলেছিলাম, কোনো লেখা থেকে এস্তেফাদার ছূরত কী। আপনি লেখাটা পড়বেন। লেখা থেকে শব্দ আপনার ভিতরে যাবে। ভিতর থেকে আপনার কলম দিয়ে বেরুবে। কিন্তু এদের অবস্থা হল, এই গল্প থেকে শব্দটা শিখছে, এরপর ওখান থেকেই এই গল্পে নিয়ে আসছে। ঐখানে হয়তো শব্দটা মুকাতাযায়ে হালের মোয়াফেক ছিল, কিন্তু
এইখানে এসে আর মুকতাযায়ে হালের মোয়াফেক নেই। এই যে
‘টুপটাপ ঝরছে শিশির’ বাক্যটা সুন্দর, কিন্তু এই লেখায় তা চলবে না।
এরা কিন্তু আমাদের আদর্শের লোক না, তাই ওদের লেখা ভালো না হলেই আমরা খুশি। কিন্তু আমাদের মাওলানাদের লেখাতেও যে এই সমস্যা। মননশীল কোনো লেখা লিখছে,
কিন্তু হালকা আন্দায! আখতার ফারূকের ‘মধ্যপ্রাচ্যে হাফেজ্জী হুজুর’ বইটির আগাগোড়া ফুকাহাত। তাওয়াফের বর্ণনা দিতে গিয়েও হাসির কথা বলছেন। মযমূনের সাথে উসলূবের মিল নেই।
‘ভেজা টাইলসে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে একজন কিশোর।’ এখানেও মনে হচ্ছে, দৃশ্যটা বাস্তব নয়। কারণ ভেজা টাইলসে কেউ উপুড় হয়ে শোয় না, কাত হয়ে গুটিগুটি হয়ে শোয়।
‘উদোম গায়ে।’ আলাদা একটা জুমলা। এটা ছোটগল্প বলার আনদায। আর উদোম শব্দটা এখানে হবে না। ছোট ছেলেরা খেলাধুলা করছে, তার বর্ণনা দেয়ার সময় উদোম শব্দটা চলতে পারে। এখানে চলবে না, কিন্তু
আমি অনেকটাই নিশ্চিত যে,
লেখকের এই শব্দটার দিকে গিবতা আছে। আমি এক জায়গায় বলেছি, লেখককে অনেক সময় কঠিন হতে হয়। কোনো শব্দ আমার খুব পসন্দ, কিন্তু এই লেখার উপযোগী না হওয়ার কারণে তা বাদ দিতে হয়।
‘ময়লা ছেড়া হাফপ্যান্ট পরনে,
থমকে দাঁড়ালাম। শীতের প্রকোপ থেকে গা বাঁচানোর সব ব্যবস্থাই আছে আমার।’
এই শেষ বাক্যটা ‘শীতের ... আমার।’ এটা কিন্তু বেদনাপূর্ণ তাবীর নয়, ঘটনা বর্ণনা করার তাবীর। যেমন, পিকনিকে যাচ্ছি,
আমরা রওনা দিলাম, শীতের প্রকোপ থেকে ...।
মূলকথা হল, উসলূবটা হল ফুকাহী উসলূব, অথচ ঘটনা হল বেদনাদায়ক। এরপরে দেখেন ‘বিবেক হঠাৎ করে থাপ্পড় বসাল আমার চেতনার গালে।’ তাবীরটা হল বিনোদনমূলক তাবীর। এখানে হতে পারত, ‘হঠাৎ বিবেকের তীব্র দংশন অনুভব করলাম।’ কিংবা
‘বিবেকের তীব্র দংশনে জর্জরিত হলাম।’ এখানে বিবেক হবে হুল ফোটানোর প্রাণী। তার মতো আরেকজন ওভারকোট পরা মানুষ এসে ঠাস করে থাপ্পড় মেরেছে তার গালে-এই দৃশ্যটা এখানে চলবে না।
‘ডেকে তুলে বসালাম ছেলেটিকে।’ এটা হবে কখন? যখন ছেলেটিকে দিয়ে কোনো কাজ করাতে চাই। এখানে তার গায়ে গিয়ে হাত রাখবেন আলতো করে,
সমবেদনার সাথে সে ফিরে তাকাবে, মাথাটা তুলবে, ...।
‘গায়ের জ্যাকেটটা খুলে ওর হাতে তুলে দিয়ে ...।’
ওর গায়ে জড়িয়ে দেওয়া দরকার ছিল, হাতে তুলে দেওয়া তো প্রস্তুতিমূলক বিষয়। এখানে তো দু’জনই অপ্রস্তুত। একজন বিবেকের দংশনে, অন্যজন নতুন লোক দেখে।
‘চোরের মতো পালিয়ে এলাম।’
শব্দটা সঠিক হয়নি। সে যা করেছে তা অন্যায় নয়, সেটা যদি অন্যায় হত তাহলে চোরের মতো পালিয়ে আসত। এখানে আরো কিছু করার দরকার ছিল তা করতে না পারার অপরাধ বোধ আছে। এখানে বলা যেতে পারত-
‘অপরাধীর মতো সেখান থেকে সরে পরলাম।’
‘দূরে কোথাও ট্রেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে।’ এটা হল ভাবাল্ শব্দ। গল্পের শব্দ। আরেকটি কথা হচ্ছে, লেখা থেকে বোঝা যাচ্ছে, জায়গাটা লেখকের পরিচিত। শহীদ আরমান রোড চেনে, শহীদী মসজিদ চেনে তাহলে রেললাইন সম্পর্কে তার খবর থাকার কথা। অতএব ‘দূরে কোথাও’ এই অনির্দিষ্টতাজ্ঞাপক শব্দ এখানে চলবে না।
‘ক্রমাগত বাড়ছে, অসহ্য শব্দ উফ।’
এগুলো সব গল্পের শব্দ।
‘নাহ্ দিনবদল হয়নি।’ একটা শ্লোগান এখন খুব দেখা যায়-‘বদলে যাও বদলে দাও’
শব্দটা শুনলেই আমার দুটো শব্দ মনে পড়ে-বলদ আর বদলা খাটা। আমি যখন শব্দ নির্বাচন করি তখন চিন্তা করি, খারাপ শব্দের সাথে মোনাসাবাত আছে কি না। কারণ যেকোনো ভাবেই হোক, ঐ শব্দটা পাঠকের যেহেনে এসে যায়।
‘কেননা, আমি নিজেকে বদলাতে পরিনি আজো। বদলের খেয়াঘাটে বদলের নোঙর ফেলেছি ঠিকই, সেটা পারিনি কেবল জীবনের খেয়াঘাটে।’
এখানে ‘নোঙর’ শব্দ ঠিক না। খেয়াঘাটে কি নোঙর ফেলা হয়?
খেয়াঘাটে নৌকা ভিরতে পারে।
‘কবে আমি বদলে যাব, কবে বদলে দিব চারপরশ, কবে একটি মানুষও শীতের কষ্টে ভুগবে না, কবে?
হৃদয়ের স্পর্শ নেই।
মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ
লেখার ক্ষেত্রে একটি জরুরি বিষয় আছে যেদিকে আমাদের নবীন প্রজন্ম মোটেই খেয়াল করে না। এমনকি যারা প্রতিষ্ঠিত লেখক তারাও খেয়াল করে না। অথচ নীতিটা নতুন কোনো ইনকিশাফ নয়, যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আমাদের আরবী বালাগাতে সব সময় তা বলে আসা হয়েছে। অর্থাৎ ‘মুকতাযায়ে হালে’র রেয়ায়েত করা। আমি যে বিষয়ে লিখব, আমার শব্দ, বাক্য,
উপস্থাপনা সবকিছু ঐ বিষয়ের সথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের মযমূন যা-ই হোক, উসলূব হয় ফুকাহী। তরল। আর এটার দ্বারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন আখতার ফারূক। তিনি যেন উসলূবে ফুকাহী ছাড়া অন্য কোনো উসলূব জানতেনই না। এজন্য জানাযার বয়ান দিলে ওখানেও তার ফুকাহাত এসে যেত। এটা তাঁর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। আমার এই মন্তব্য এজন্য গ্রহণ করতে হবে যে, তার কাছ থেকে এসতেফাদার কথা আমি প্রকাশ্যে স্বীকার করি। এই দুর্বলতা তার সবচেয়ে বেশি ছিল আর এখনকার প্রায় সবারই এই দুর্বলতা। লিখতে গেলেই তরলতা এসে যায়।
আমার হাতে এখন যে লেখাটা আছে এটা আমাদের কারো লেখা নয়, প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি লেখা। এর বিষয়বস্তু হল,
লেখক শীতের রাতে একজন অসহায় ছেলেকে বিপর্যস্ত অবস্থায় দেখতে পেয়েছে। শরীরে কাপড়-চোপড় নেই, খালি মেঝেতে শুয়ে আছে। সে তখন নিজের গায়ের ওভারকোটটা তাকে দিয়ে এসেছে। এটা শীতার্ত মানুষকে নিয়ে লেখা। বিষয়বস্তু বেদনাপূর্ণ। অতএব গোটা লেখায় বেদনার আবহ থাকতে হবে। শব্দ নির্বাচন এমন হতে হবে, যেন প্রতিটি শব্দ থেকে বেদনা ঝড়ে। সর্বোপরি তা যেন হৃদয়কে স্পর্শ করে এবং পাঠকের মধ্যেও সমবেদনা ও সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে। এটার জন্য ছূরত দুটি : নিজের ভিতরে সমবেদনা থাকতে হবে, কিংবা সমবেদনা থাকলে যা হয় সে অভিনয়টা জানতে হবে। কোনটা সবচেয়ে কার্যকর সেটা পরের প্রশ্ন। কিন্তু দু’ টোর কোনো একটা অবশ্যই লাগবে।
শুরুটা হল, ‘বেশ রাত, কুয়াশা ভেদ করে হাঁটছি।’ এটা হল গল্প বলার ঢং। আয়েশী অবস্থায় গল্প বলছে-বেশ রাত, কুয়াশা ভেদ করে হাঁটছি।’ এরপরের বাক্যটি এক শব্দের-‘একা।’ গল্পের আবহ। কোনো বেদনাদায়ক ঘটনা বলবে,
তা বোঝা যাচ্ছে না। অর্থাৎ উসলূবটা বেদনাদায়ক কোনো ঘটনা বলার উসলূব নয়, গল্প বলার উসলূব।
‘দৃষ্টির দৌড় সীমিত।’ দৌড় শব্দটার ব্যবহার তরল ক্ষেত্রে হতে পারে। এই লেখার বিষয়বস্তুর সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সাদামাটা ভাষায় লিখবে যে, ‘সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।’
দৃষ্টির দৌড় সীমিত-এই মাজায এখানে চলবে না।
‘রাস্তার পার্শ্বে লাইটপোস্টের আলোয় জ্বলজ্বল করছে অক্ষরগুলো। শহীদ আরমান রোড।’
গল্পের উসলূব। তাছাড়া বাস্তবের সাথেও মেলে না। কারণ কুয়াশা ভেদ করে হাঁটছ,
দৃষ্টির দৌড় সীমিত, কিন্তু
লাইটপোস্টের আলো জ্বলজ্বল করছে কীভাবে? এখানে
‘জ্বলজ্বল’ শব্দের ব্যবহার বাস্তবসম্মত নয়।
‘শহীদী মসজিদের সামনে এলাম। টাইলস করা চত্বর। টুপটাপ ঝরছে শিশির।’ গল্প। আর চত্বরে টুপটাপ ঝরবে কীভাবে? টুপটাপ ঝরতে হলে গাছ-গাছালি লাগবে। পাতার উপর থেকে পাতায় ঝরতে হবে। মানে শব্দ শিখেছে কিন্তু
শব্দটা ভিতরে নেয়নি। আমি আগে একদিন বলেছিলাম, কোনো লেখা থেকে এস্তেফাদার ছূরত কী। আপনি লেখাটা পড়বেন। লেখা থেকে শব্দ আপনার ভিতরে যাবে। ভিতর থেকে আপনার কলম দিয়ে বেরুবে। কিন্তু এদের অবস্থা হল, এই গল্প থেকে শব্দটা শিখছে, এরপর ওখান থেকেই এই গল্পে নিয়ে আসছে। ঐখানে হয়তো শব্দটা মুকাতাযায়ে হালের মোয়াফেক ছিল, কিন্তু
এইখানে এসে আর মুকতাযায়ে হালের মোয়াফেক নেই। এই যে
‘টুপটাপ ঝরছে শিশির’ বাক্যটা সুন্দর, কিন্তু এই লেখায় তা চলবে না।
এরা কিন্তু আমাদের আদর্শের লোক না, তাই ওদের লেখা ভালো না হলেই আমরা খুশি। কিন্তু আমাদের মাওলানাদের লেখাতেও যে এই সমস্যা। মননশীল কোনো লেখা লিখছে,
কিন্তু হালকা আন্দায! আখতার ফারূকের ‘মধ্যপ্রাচ্যে হাফেজ্জী হুজুর’ বইটির আগাগোড়া ফুকাহাত। তাওয়াফের বর্ণনা দিতে গিয়েও হাসির কথা বলছেন। মযমূনের সাথে উসলূবের মিল নেই।
‘ভেজা টাইলসে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে একজন কিশোর।’ এখানেও মনে হচ্ছে, দৃশ্যটা বাস্তব নয়। কারণ ভেজা টাইলসে কেউ উপুড় হয়ে শোয় না, কাত হয়ে গুটিগুটি হয়ে শোয়।
‘উদোম গায়ে।’ আলাদা একটা জুমলা। এটা ছোটগল্প বলার আনদায। আর উদোম শব্দটা এখানে হবে না। ছোট ছেলেরা খেলাধুলা করছে, তার বর্ণনা দেয়ার সময় উদোম শব্দটা চলতে পারে। এখানে চলবে না, কিন্তু
আমি অনেকটাই নিশ্চিত যে,
লেখকের এই শব্দটার দিকে গিবতা আছে। আমি এক জায়গায় বলেছি, লেখককে অনেক সময় কঠিন হতে হয়। কোনো শব্দ আমার খুব পসন্দ, কিন্তু এই লেখার উপযোগী না হওয়ার কারণে তা বাদ দিতে হয়।
‘ময়লা ছেড়া হাফপ্যান্ট পরনে,
থমকে দাঁড়ালাম। শীতের প্রকোপ থেকে গা বাঁচানোর সব ব্যবস্থাই আছে আমার।’
এই শেষ বাক্যটা ‘শীতের ... আমার।’ এটা কিন্তু বেদনাপূর্ণ তাবীর নয়, ঘটনা বর্ণনা করার তাবীর। যেমন, পিকনিকে যাচ্ছি,
আমরা রওনা দিলাম, শীতের প্রকোপ থেকে ...।
মূলকথা হল, উসলূবটা হল ফুকাহী উসলূব, অথচ ঘটনা হল বেদনাদায়ক। এরপরে দেখেন ‘বিবেক হঠাৎ করে থাপ্পড় বসাল আমার চেতনার গালে।’ তাবীরটা হল বিনোদনমূলক তাবীর। এখানে হতে পারত, ‘হঠাৎ বিবেকের তীব্র দংশন অনুভব করলাম।’ কিংবা
‘বিবেকের তীব্র দংশনে জর্জরিত হলাম।’ এখানে বিবেক হবে হুল ফোটানোর প্রাণী। তার মতো আরেকজন ওভারকোট পরা মানুষ এসে ঠাস করে থাপ্পড় মেরেছে তার গালে-এই দৃশ্যটা এখানে চলবে না।
‘ডেকে তুলে বসালাম ছেলেটিকে।’ এটা হবে কখন? যখন ছেলেটিকে দিয়ে কোনো কাজ করাতে চাই। এখানে তার গায়ে গিয়ে হাত রাখবেন আলতো করে,
সমবেদনার সাথে সে ফিরে তাকাবে, মাথাটা তুলবে, ...।
‘গায়ের জ্যাকেটটা খুলে ওর হাতে তুলে দিয়ে ...।’
ওর গায়ে জড়িয়ে দেওয়া দরকার ছিল, হাতে তুলে দেওয়া তো প্রস্তুতিমূলক বিষয়। এখানে তো দু’জনই অপ্রস্তুত। একজন বিবেকের দংশনে, অন্যজন নতুন লোক দেখে।
‘চোরের মতো পালিয়ে এলাম।’
শব্দটা সঠিক হয়নি। সে যা করেছে তা অন্যায় নয়, সেটা যদি অন্যায় হত তাহলে চোরের মতো পালিয়ে আসত। এখানে আরো কিছু করার দরকার ছিল তা করতে না পারার অপরাধ বোধ আছে। এখানে বলা যেতে পারত-
‘অপরাধীর মতো সেখান থেকে সরে পরলাম।’
‘দূরে কোথাও ট্রেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে।’ এটা হল ভাবাল্ শব্দ। গল্পের শব্দ। আরেকটি কথা হচ্ছে, লেখা থেকে বোঝা যাচ্ছে, জায়গাটা লেখকের পরিচিত। শহীদ আরমান রোড চেনে, শহীদী মসজিদ চেনে তাহলে রেললাইন সম্পর্কে তার খবর থাকার কথা। অতএব ‘দূরে কোথাও’ এই অনির্দিষ্টতাজ্ঞাপক শব্দ এখানে চলবে না।
‘ক্রমাগত বাড়ছে, অসহ্য শব্দ উফ।’
এগুলো সব গল্পের শব্দ।
‘নাহ্ দিনবদল হয়নি।’ একটা শ্লোগান এখন খুব দেখা যায়-‘বদলে যাও বদলে দাও’
শব্দটা শুনলেই আমার দুটো শব্দ মনে পড়ে-বলদ আর বদলা খাটা। আমি যখন শব্দ নির্বাচন করি তখন চিন্তা করি, খারাপ শব্দের সাথে মোনাসাবাত আছে কি না। কারণ যেকোনো ভাবেই হোক, ঐ শব্দটা পাঠকের যেহেনে এসে যায়।
‘কেননা, আমি নিজেকে বদলাতে পরিনি আজো। বদলের খেয়াঘাটে বদলের নোঙর ফেলেছি ঠিকই, সেটা পারিনি কেবল জীবনের খেয়াঘাটে।’
এখানে ‘নোঙর’ শব্দ ঠিক না। খেয়াঘাটে কি নোঙর ফেলা হয়?
খেয়াঘাটে নৌকা ভিরতে পারে।
‘কবে আমি বদলে যাব, কবে বদলে দিব চারপরশ, কবে একটি মানুষও শীতের কষ্টে ভুগবে না, কবে?
হৃদয়ের স্পর্শ নেই।