বাংলাদেশ অঞ্চলে দ্বীনকায়েমের সমস্যা সম্ভাবনা:৩য় পর্ব
• আকাবির/বুজুর্গ/ওলী আল্লাহ বা আল্লাহর ওলী নির্বাচনে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহনঃ সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর চেয়ে বড় কোন আকাবির নেই, সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর চেয়ে বড় কোন নায়েবে রাসূল নেই, সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর চেয়ে বড় কোন আশেকে রাসূল নেই, সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর চেয়ে বড় কোন আলেম নেই, সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর চেয়ে বড় কোন বুজুর্গ, ওলী, আওলিয়া নেই। তাহলে কেন আমরা সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর স্থলে কথায় কথায় বিগত শতাব্দীর আকাবিরগণকে টেনে এনে শুধুমাত্র তাদের ফায়সালাই গ্রহন করি ? সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর জীবনে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট সে বিষয়গুলোতে ভিন্ন কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ কি আমাদের আছে ? যদি কোন বিধান বা আমল সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর থেকে বুঝতে অসুবিধা বোধকরি তখনই না কেবল অন্যত্র তালাস করব। আর সেক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের তালাসের প্রথম জায়গা হবে তাবেয়ীগণ তারপর তাবেতাবেয়ীগণ তারপর পর্যায়ক্রমে অধস্তন আকাবিরগণ। তাহলে কেন আমরা আমাদের উপরস্থ আকাবিরগণকে বাদ দিয়ে প্রথেমেই একেবারে শেষযুগের আকাবিরদের দারস্থ হচ্ছি ? আবার শেষ যুগের আকাবিরদের মধ্যে শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ), শাহ ইসমাঈল শহীদ (রঃ), সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর (রঃ), হাজী শরীয়ত উল্লাহ ফরায়েজী (রঃ) বা হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী (রঃ), বা নিদেন পক্ষে যে আল্লাহর ওলীর সাথে নিসবত রাখার জন্য গর্ব করে নিজের নামের সাথে কাসেমী লকব জুরে দিচ্ছি সেই কাসেম নানুতুবীর (রঃ) এর কর্মনীতি বা সিদ্ধান্ত সামনে না রেখে শুধুমাত্র তৎপরবর্তী আকাবিরদের সিদ্ধান্তকে সামনে রাখছি ?
আবার ওলী আল্লাহ বা বুর্জুগানে দ্বীন হিসাবে আমরা উপযুক্ত ব্যক্তিগণের স্থলে অনুপযুক্ত ব্যক্তিগণকে (যাদের সীরাতের সঙ্গে সাহাবায়ে কেরাম এর বা খায়রুল কুরুনের কোন নায়েবে রাসূলের সিরাতের কোন মিল নেই) কেন উম্মার সামনে তুলে ধরছি ? আমাদের এই একটি ভুলের কারণেই অধিকাংশ মুসলমান আজ আলেম নামধারী অযোগ্য, বে-আমল, বে-খবর, দরবারীদের এবং একই সাথে বেদাতি ও বে-শরা পীর ফকিরদের খপ্পরে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের বানানো এসকল নেতা/শাইখ/পীর/মুর্শিদদেরকে অনেক ক্ষেত্রেই প্রভু বানিয়ে নিয়েছে এবং কুরআন হাদিস বাদ দিয়ে তাদের ফায়সালাকেই চূড়ান্ত মানছে।
আবার প্রকৃত আল্লাহর ওলী বা বুর্জুগানে দ্বীনের মূল গুনের পরিবর্তে নিজেদের জন্য সুবিধাজনক ভিন্ন কোন গুনকে উম্মার সামনে তুলে ধরেও উম্মাহকে বিপথগামী করা হচ্ছে। যেমন – হযরত শাহ জালাল (র এর জায়নামাজের কিচ্ছাই শুধু বলা হয় । কিন্তু তিনি এত দূরের পথ অতিক্রম করে কি উদ্দেশ্যে এবং কি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন তা আর বলা হয় না। অর্থাৎ তিনি যে হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজা কর্তৃক একজন মুসলমানের সন্তান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহন করার জন্য তরবারী হাতে এসেছিলেন সেটা ভুল করেও সামনে আনা হয় না। যে কারণে আমরা ঘুনাক্ষরেও জানতে পারিনা ঠিক কোন পন্থায় হযরত শাহজালাল ইয়ামনী (রঃ) মুসলমানের সন্তান হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন এবং এ অঞ্চলে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেছিলেন ? আর এই উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচারের কারণেই বর্তমান সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তালেবে ইলম এবং নবীন আলেম তাদের দলের নেতাদের কিছু সাউন্ড গ্রেনেড টাইপের হুংকার শুনেই তাদের নেতাদেরকে জিন্দা শাহজালাল বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। কত বড় জুলুমের কথা ! মাত্র একজন মুসলমানের সন্তান হত্যার প্রতিশোধ নিতে যিনি হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে চলে এলেন এই সিলেটে । তার সাথে কিনা তুলনা দিচ্ছে আমাদের ঘরের দুয়ারে (আরাকানে) পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতিসহ হাজার হাজার মুসলমান নিহত হওয়ার পরও যারা নাফ নদী পেরিয়ে নরখাদক মিয়ানমারের বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের দমনের বা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহনের কোন পদক্ষেপই নেয়নি তাদেরকে ! নাউযুবিল্লাহ। এভাবেই আমরা নিজেদের অজান্তেই নিতান্ত অযোগ্য, ভীরু, ভোগবাদী, দরবারী (অনেকেই আবার গোপন দরবারী) আলেম নামধারী বুড়া (বড় নয়) এবং সাহেবজাদাদেরকে জিন্দা শাহজালাল, আমিরুল মুজাহিদীন, পীরে কামেল ইত্যাদি টাইটেল দিয়ে উম্মাহকে এদের সোপর্দ করে এ অঞ্চলে দ্বীন কায়েমের পথ রুদ্ধ করে ফেলছি।
• ঈমান/তাওহীদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকা : দাওয়াতে তাবলীগ বা পীর সাহেবদের খানকা বা মাদরাসা সব জায়গা হতে প্রথমেই বলা হয় ঈমানের মেহনতের মাধ্যমে বা তাযকিয়াতুন নফসের মাধ্যমে আগে ঈমান ঠিক করতে হবে। কিন্তু ঈমানের পূর্ণাঙ্গ রূপ কি তা কোথাও আলোচিত হয়না। সব ক্ষেত্রেই ঈমানের/তাওহীদের আংশিক রূপ আলোচিত হয় । ঈমানের/তাওহীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ তথা তাওহীদুল হাকিমিয়্যা অর্থাৎ ‘বিধান ও সংবিধান প্রনয়েণের ক্ষেত্রে আল্লাহকে এক ও একক মানা।’ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আরোচিত হয় না । ফলে নগন্য সংখ্যক আল্লাহর বান্দা ছাড়া পুরো উম্মাহ শিরকে আকবারে লিপ্ত আছে ।
অর্থাৎ আল্লাহর বিধান না মেনে অন্য কারো বিধান মানা বা আল্লাহর আনুগত্য না করে অন্য কারো আনুগত্য করার দ্বারা । আল্লাহ তাআলা বলেন, সৃষ্টি তার বিধানও তাঁর’ - (সুরা আরাফ ৫৪) । অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বিধান দেওয়ার ক্ষামতা একমাত্র আল্লাহর’- (সুরা ইউসুফ ৪০) ।
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, নিশ্চই শয়তানরা তাদের বন্ধুদের নিকট ওহী প্রেরণ করে যাতে তারা তোমাদের সাথে বির্তক কর।আর যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, নিশ্চিত তোমরাও মুশরিক হয়ে যাবে। [সূরা আনআম: ১২১]
ইবনে কাসীর (রহঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন :
আল্লাহ তায়ালার বাণী - ‘যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তোমরাও মুশরিক হয়ে যাবে”র্অথাৎ তোমরা যদি আল্লাহর আদেশ ও শরীয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য কারো কথার দিকে দৃষ্টি দাও এবং সেটিকেই প্রাধান্য দাও তাহলে সেটিই হবে শরিক। [তাফসীরে ইবনে কাছীর, খন্ড:৩, পৃষ্ঠা:৩২৯]
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যারা দাবী করে যে যা আপনার প্রতি অর্বতীণ হয়েছে এবং আপনার র্পূবে যা অর্বতীণ হয়েছে তার উপর তারা ঈমান এনেছে ইহা সত্ত্বওে তারা তাগূতের কাছে বিচার র্প্রাথনার ইচ্ছা পোষণ করছে। অথচ তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল যাতে তারা তাকে (তাগূতকে) অস্বীকার করে । পক্ষান্তরে শয়তান ইচ্ছা করছে তাদেরকে পরিপূর্ণ পথভ্রষ্ট করে ফেলতে। [সূরা-নসিা, আয়াত:৬০] এ আয়াতটি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এমন ব্যক্তির দাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে যে দাবী করে আল্লাহ তায়ালা তার রাসূলের উপর ও র্পূবর্বতী আম্বিয়াদের উপর যা অর্বতীণ করেছেন সে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে অথচ সে বিবদমান বিষয়াদিতে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহকে ছেড়ে ভিন্ন কোন কিছুর কাছে বিচার ফায়সালা চায়।
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, তাদের জন্য এমন কিছু শরীক আছে কি যারা তাদের জন্য দ্বীনের এমন বিধান দিয়েছে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি। [সূরা শুরা: ২১] ‘তারা কি জাহিলিয়্যাতের বিধি-বিধান কামনা করে ? বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহ অপেক্ষা কে শ্রেষ্ঠতর বিধানদানকারী? [সূরা মায়দিাহ: ৫০]
সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ (রহঃ) এ আয়াতের ব্যাখ্যা করেন: এই নসের মাধ্যমে জাহিলিয়্যাতের র্অথ নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং আল্লাহ তায়ালার র্বণনা ও তাঁর কুরআনের সংজ্ঞা অনুযায়ী জাহিলিয়্যাত বলা হয়, মানুষের জন্য তৈরী মানুষের বিধানকে। কেননা এটা মানুষ র্কতৃক মানুষের দাসত্ব, আল্লাহ তায়ালার দাসত্বকে র্বজন। তার উলুহিয়্যাতকে প্রত্যখ্যান। এবং প্রত্যাখ্যানের পর তার মোকাবেলায় কতক মানুষের উলুহিয়্যাতকে গ্রহণ। আল্লাহ তায়ালার পরিবর্তে তাদের দাসত্বের সামনে আত্মসর্মপণ।
এই নসের আলোকে বোঝা যায় জাহিলিয়্যাত কোন এক সময়রে নাম নয়। জাহিলিয়্যাত হলো, এক ধরনের উদ্ভাবন ও প্রণয়নের নাম। যা র্বতমানে বিদ্যমান আছ, ভবিষ্যতেও বিদ্যমান থাকবে। যা আসে ইসলামের মোকাবেলায়, যার সাথে থাকে ইসলামের বৈপরীত্য।[ফী-যলিাললি কুরআন, খন্ড:২, পৃষ্ঠা:৩৮৪]
আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে অন্য কারো বিধান মানা, বা আল্লাহর আনুগত্য বাদ দিয়ে অন্য কারো আনুগত্য করা যে শিরক, তা বুঝা যায় নিম্নোক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে। ইয়াহুদী নাসারাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের পাদ্রী ও ধর্ম-যাজকদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে এবং মারিয়ামের পুত্র মসীহকেও, অথচ তাদের প্রতি শুধু এই আদেশ করা হয়েছিল যে তারা শুধু এক মা’বুদের ইবাদত করবে যিনি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি তাদের অংশী স্থির করা হতে পবিত্র’-(১ সূরা তাওবা: ৩১)।
উপরোক্ত আয়াতটি থেকে স্বাভাবিকভাবে একটি ব্যাপার বুঝে আসে না - তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের পাদ্রী ও ধর্ম-যাজকদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে।’ অথচ তারা তাদেরকে রব বলে বিশ্বাস বা স্বীকার করতো না বা তাদের ইবাদতও করতো না। বরং তারা আল্লাহকেই রব বলে স্বীকার করতো ও তাঁরই ইবাদত করতো।
নিম্নের হাদিস থেকেই বিষয়টি পরিস্কার হবে ইনশা আল্লাহ । হাদীস শরীফে এসেছে ইমাম বুখারী রহ. বর্ণনা করেন: আদী ইবনে হাতমে থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি গলায় একটি ক্রুশ ঝুলন্ত অবস্থায় রসূলুল্লাহ (সা এর নিকট এলে তিনি বলেন, হে আদী এই র্মূতিটি তুমি তোমার গলা থেকে ছুঁড়ে ফেল। ফলে আমি তা খুলে ফেললাম, অতঃপর রসূলুল্লাহ (সা এর নিকট এসে দেখতে পেলাম, তিনি সূরা তাওবা তিলাওয়াত করছেনে: “তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদেরে পাদ্রী ও র্ধম-যাজকদরেকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে । আমি বললাম, আমরা তো তাদের ইবাদত করতাম না। রসূলুল্লাহ (সা বললেন, আল্লাহ তায়ালা যা হালাল করেছেন তারা তা হারাম করতো আর তোমরাও তা হারাম মানতে এবং আল্লাহ তায়ালা যা হারাম করেছেন তারা তা হালাল করতো আর তোমরাও তাকে হালাল ভাবতে। আমি বললাম, হ্যাঁ এমনটইি। তিনি (সা বললনে, এটইি তাদরে ইবাদত। [তারিখুল কাবীর লিল ইমাম বুখারী ৭ম খন্ড ৪৭১ নং হাদীস; সুনানে তিরমিযি: ৩০৯৫; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী: ১৭/৯২/২১৮,২১৯; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী: ২০৩৫০ (সনদ: হাসান সহীহ) অন্য হাদীসে রাসূল সা. বলেন, ‘স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে কোন সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না।’- তিরমিযি
আজকে এই তাওহীদুল হাকিমিয়্যার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী শিরক হচ্ছে। সুতরাং তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহ ‘র জ্ঞান ব্যতীত আমাদের ঈমানই পূর্ণাঙ্গ হবে না। বরং প্রতি পদে পদে আমরা শিরকে আকবারে লিপ্ত থাকব। (নাউযুবিল্লাহ)। আর শিরকে আকবারে লিপ্ত জাতি হিসাবে আমাদের ঈমান ভয়াবহ হুমকির মুখে নিপতিত থাকবে। এরকম গুরুতর অপরাধে লিপ্ত কোন জাতিকে আল্লাহ তা’আলা কখনই সাহায্য করবেন না। আর আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোন জাতি কখনই দ্বীন কায়েম করতে পারবে না।
চলবে ……….
বাংলাদেশ অঞ্চলে দ্বীনকায়েমের সমস্যা সম্ভাবনা:১ম পরব
বাংলাদেশ অঞ্চলে দ্বীনকায়েমের সমস্যা সম্ভাবনা:২য় পরব
• আকাবির/বুজুর্গ/ওলী আল্লাহ বা আল্লাহর ওলী নির্বাচনে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহনঃ সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর চেয়ে বড় কোন আকাবির নেই, সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর চেয়ে বড় কোন নায়েবে রাসূল নেই, সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর চেয়ে বড় কোন আশেকে রাসূল নেই, সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর চেয়ে বড় কোন আলেম নেই, সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর চেয়ে বড় কোন বুজুর্গ, ওলী, আওলিয়া নেই। তাহলে কেন আমরা সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর স্থলে কথায় কথায় বিগত শতাব্দীর আকাবিরগণকে টেনে এনে শুধুমাত্র তাদের ফায়সালাই গ্রহন করি ? সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর জীবনে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট সে বিষয়গুলোতে ভিন্ন কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ কি আমাদের আছে ? যদি কোন বিধান বা আমল সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর থেকে বুঝতে অসুবিধা বোধকরি তখনই না কেবল অন্যত্র তালাস করব। আর সেক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের তালাসের প্রথম জায়গা হবে তাবেয়ীগণ তারপর তাবেতাবেয়ীগণ তারপর পর্যায়ক্রমে অধস্তন আকাবিরগণ। তাহলে কেন আমরা আমাদের উপরস্থ আকাবিরগণকে বাদ দিয়ে প্রথেমেই একেবারে শেষযুগের আকাবিরদের দারস্থ হচ্ছি ? আবার শেষ যুগের আকাবিরদের মধ্যে শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ), শাহ ইসমাঈল শহীদ (রঃ), সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর (রঃ), হাজী শরীয়ত উল্লাহ ফরায়েজী (রঃ) বা হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী (রঃ), বা নিদেন পক্ষে যে আল্লাহর ওলীর সাথে নিসবত রাখার জন্য গর্ব করে নিজের নামের সাথে কাসেমী লকব জুরে দিচ্ছি সেই কাসেম নানুতুবীর (রঃ) এর কর্মনীতি বা সিদ্ধান্ত সামনে না রেখে শুধুমাত্র তৎপরবর্তী আকাবিরদের সিদ্ধান্তকে সামনে রাখছি ?
আবার ওলী আল্লাহ বা বুর্জুগানে দ্বীন হিসাবে আমরা উপযুক্ত ব্যক্তিগণের স্থলে অনুপযুক্ত ব্যক্তিগণকে (যাদের সীরাতের সঙ্গে সাহাবায়ে কেরাম এর বা খায়রুল কুরুনের কোন নায়েবে রাসূলের সিরাতের কোন মিল নেই) কেন উম্মার সামনে তুলে ধরছি ? আমাদের এই একটি ভুলের কারণেই অধিকাংশ মুসলমান আজ আলেম নামধারী অযোগ্য, বে-আমল, বে-খবর, দরবারীদের এবং একই সাথে বেদাতি ও বে-শরা পীর ফকিরদের খপ্পরে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের বানানো এসকল নেতা/শাইখ/পীর/মুর্শিদদেরকে অনেক ক্ষেত্রেই প্রভু বানিয়ে নিয়েছে এবং কুরআন হাদিস বাদ দিয়ে তাদের ফায়সালাকেই চূড়ান্ত মানছে।
আবার প্রকৃত আল্লাহর ওলী বা বুর্জুগানে দ্বীনের মূল গুনের পরিবর্তে নিজেদের জন্য সুবিধাজনক ভিন্ন কোন গুনকে উম্মার সামনে তুলে ধরেও উম্মাহকে বিপথগামী করা হচ্ছে। যেমন – হযরত শাহ জালাল (র এর জায়নামাজের কিচ্ছাই শুধু বলা হয় । কিন্তু তিনি এত দূরের পথ অতিক্রম করে কি উদ্দেশ্যে এবং কি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন তা আর বলা হয় না। অর্থাৎ তিনি যে হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজা কর্তৃক একজন মুসলমানের সন্তান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহন করার জন্য তরবারী হাতে এসেছিলেন সেটা ভুল করেও সামনে আনা হয় না। যে কারণে আমরা ঘুনাক্ষরেও জানতে পারিনা ঠিক কোন পন্থায় হযরত শাহজালাল ইয়ামনী (রঃ) মুসলমানের সন্তান হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন এবং এ অঞ্চলে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেছিলেন ? আর এই উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচারের কারণেই বর্তমান সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তালেবে ইলম এবং নবীন আলেম তাদের দলের নেতাদের কিছু সাউন্ড গ্রেনেড টাইপের হুংকার শুনেই তাদের নেতাদেরকে জিন্দা শাহজালাল বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। কত বড় জুলুমের কথা ! মাত্র একজন মুসলমানের সন্তান হত্যার প্রতিশোধ নিতে যিনি হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে চলে এলেন এই সিলেটে । তার সাথে কিনা তুলনা দিচ্ছে আমাদের ঘরের দুয়ারে (আরাকানে) পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতিসহ হাজার হাজার মুসলমান নিহত হওয়ার পরও যারা নাফ নদী পেরিয়ে নরখাদক মিয়ানমারের বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের দমনের বা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহনের কোন পদক্ষেপই নেয়নি তাদেরকে ! নাউযুবিল্লাহ। এভাবেই আমরা নিজেদের অজান্তেই নিতান্ত অযোগ্য, ভীরু, ভোগবাদী, দরবারী (অনেকেই আবার গোপন দরবারী) আলেম নামধারী বুড়া (বড় নয়) এবং সাহেবজাদাদেরকে জিন্দা শাহজালাল, আমিরুল মুজাহিদীন, পীরে কামেল ইত্যাদি টাইটেল দিয়ে উম্মাহকে এদের সোপর্দ করে এ অঞ্চলে দ্বীন কায়েমের পথ রুদ্ধ করে ফেলছি।
• ঈমান/তাওহীদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকা : দাওয়াতে তাবলীগ বা পীর সাহেবদের খানকা বা মাদরাসা সব জায়গা হতে প্রথমেই বলা হয় ঈমানের মেহনতের মাধ্যমে বা তাযকিয়াতুন নফসের মাধ্যমে আগে ঈমান ঠিক করতে হবে। কিন্তু ঈমানের পূর্ণাঙ্গ রূপ কি তা কোথাও আলোচিত হয়না। সব ক্ষেত্রেই ঈমানের/তাওহীদের আংশিক রূপ আলোচিত হয় । ঈমানের/তাওহীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ তথা তাওহীদুল হাকিমিয়্যা অর্থাৎ ‘বিধান ও সংবিধান প্রনয়েণের ক্ষেত্রে আল্লাহকে এক ও একক মানা।’ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আরোচিত হয় না । ফলে নগন্য সংখ্যক আল্লাহর বান্দা ছাড়া পুরো উম্মাহ শিরকে আকবারে লিপ্ত আছে ।
অর্থাৎ আল্লাহর বিধান না মেনে অন্য কারো বিধান মানা বা আল্লাহর আনুগত্য না করে অন্য কারো আনুগত্য করার দ্বারা । আল্লাহ তাআলা বলেন, সৃষ্টি তার বিধানও তাঁর’ - (সুরা আরাফ ৫৪) । অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বিধান দেওয়ার ক্ষামতা একমাত্র আল্লাহর’- (সুরা ইউসুফ ৪০) ।
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, নিশ্চই শয়তানরা তাদের বন্ধুদের নিকট ওহী প্রেরণ করে যাতে তারা তোমাদের সাথে বির্তক কর।আর যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, নিশ্চিত তোমরাও মুশরিক হয়ে যাবে। [সূরা আনআম: ১২১]
ইবনে কাসীর (রহঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন :
আল্লাহ তায়ালার বাণী - ‘যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তোমরাও মুশরিক হয়ে যাবে”র্অথাৎ তোমরা যদি আল্লাহর আদেশ ও শরীয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য কারো কথার দিকে দৃষ্টি দাও এবং সেটিকেই প্রাধান্য দাও তাহলে সেটিই হবে শরিক। [তাফসীরে ইবনে কাছীর, খন্ড:৩, পৃষ্ঠা:৩২৯]
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যারা দাবী করে যে যা আপনার প্রতি অর্বতীণ হয়েছে এবং আপনার র্পূবে যা অর্বতীণ হয়েছে তার উপর তারা ঈমান এনেছে ইহা সত্ত্বওে তারা তাগূতের কাছে বিচার র্প্রাথনার ইচ্ছা পোষণ করছে। অথচ তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল যাতে তারা তাকে (তাগূতকে) অস্বীকার করে । পক্ষান্তরে শয়তান ইচ্ছা করছে তাদেরকে পরিপূর্ণ পথভ্রষ্ট করে ফেলতে। [সূরা-নসিা, আয়াত:৬০] এ আয়াতটি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এমন ব্যক্তির দাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে যে দাবী করে আল্লাহ তায়ালা তার রাসূলের উপর ও র্পূবর্বতী আম্বিয়াদের উপর যা অর্বতীণ করেছেন সে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে অথচ সে বিবদমান বিষয়াদিতে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহকে ছেড়ে ভিন্ন কোন কিছুর কাছে বিচার ফায়সালা চায়।
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, তাদের জন্য এমন কিছু শরীক আছে কি যারা তাদের জন্য দ্বীনের এমন বিধান দিয়েছে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি। [সূরা শুরা: ২১] ‘তারা কি জাহিলিয়্যাতের বিধি-বিধান কামনা করে ? বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহ অপেক্ষা কে শ্রেষ্ঠতর বিধানদানকারী? [সূরা মায়দিাহ: ৫০]
সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ (রহঃ) এ আয়াতের ব্যাখ্যা করেন: এই নসের মাধ্যমে জাহিলিয়্যাতের র্অথ নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং আল্লাহ তায়ালার র্বণনা ও তাঁর কুরআনের সংজ্ঞা অনুযায়ী জাহিলিয়্যাত বলা হয়, মানুষের জন্য তৈরী মানুষের বিধানকে। কেননা এটা মানুষ র্কতৃক মানুষের দাসত্ব, আল্লাহ তায়ালার দাসত্বকে র্বজন। তার উলুহিয়্যাতকে প্রত্যখ্যান। এবং প্রত্যাখ্যানের পর তার মোকাবেলায় কতক মানুষের উলুহিয়্যাতকে গ্রহণ। আল্লাহ তায়ালার পরিবর্তে তাদের দাসত্বের সামনে আত্মসর্মপণ।
এই নসের আলোকে বোঝা যায় জাহিলিয়্যাত কোন এক সময়রে নাম নয়। জাহিলিয়্যাত হলো, এক ধরনের উদ্ভাবন ও প্রণয়নের নাম। যা র্বতমানে বিদ্যমান আছ, ভবিষ্যতেও বিদ্যমান থাকবে। যা আসে ইসলামের মোকাবেলায়, যার সাথে থাকে ইসলামের বৈপরীত্য।[ফী-যলিাললি কুরআন, খন্ড:২, পৃষ্ঠা:৩৮৪]
আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে অন্য কারো বিধান মানা, বা আল্লাহর আনুগত্য বাদ দিয়ে অন্য কারো আনুগত্য করা যে শিরক, তা বুঝা যায় নিম্নোক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে। ইয়াহুদী নাসারাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের পাদ্রী ও ধর্ম-যাজকদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে এবং মারিয়ামের পুত্র মসীহকেও, অথচ তাদের প্রতি শুধু এই আদেশ করা হয়েছিল যে তারা শুধু এক মা’বুদের ইবাদত করবে যিনি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি তাদের অংশী স্থির করা হতে পবিত্র’-(১ সূরা তাওবা: ৩১)।
উপরোক্ত আয়াতটি থেকে স্বাভাবিকভাবে একটি ব্যাপার বুঝে আসে না - তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের পাদ্রী ও ধর্ম-যাজকদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে।’ অথচ তারা তাদেরকে রব বলে বিশ্বাস বা স্বীকার করতো না বা তাদের ইবাদতও করতো না। বরং তারা আল্লাহকেই রব বলে স্বীকার করতো ও তাঁরই ইবাদত করতো।
নিম্নের হাদিস থেকেই বিষয়টি পরিস্কার হবে ইনশা আল্লাহ । হাদীস শরীফে এসেছে ইমাম বুখারী রহ. বর্ণনা করেন: আদী ইবনে হাতমে থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি গলায় একটি ক্রুশ ঝুলন্ত অবস্থায় রসূলুল্লাহ (সা এর নিকট এলে তিনি বলেন, হে আদী এই র্মূতিটি তুমি তোমার গলা থেকে ছুঁড়ে ফেল। ফলে আমি তা খুলে ফেললাম, অতঃপর রসূলুল্লাহ (সা এর নিকট এসে দেখতে পেলাম, তিনি সূরা তাওবা তিলাওয়াত করছেনে: “তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদেরে পাদ্রী ও র্ধম-যাজকদরেকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে । আমি বললাম, আমরা তো তাদের ইবাদত করতাম না। রসূলুল্লাহ (সা বললেন, আল্লাহ তায়ালা যা হালাল করেছেন তারা তা হারাম করতো আর তোমরাও তা হারাম মানতে এবং আল্লাহ তায়ালা যা হারাম করেছেন তারা তা হালাল করতো আর তোমরাও তাকে হালাল ভাবতে। আমি বললাম, হ্যাঁ এমনটইি। তিনি (সা বললনে, এটইি তাদরে ইবাদত। [তারিখুল কাবীর লিল ইমাম বুখারী ৭ম খন্ড ৪৭১ নং হাদীস; সুনানে তিরমিযি: ৩০৯৫; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী: ১৭/৯২/২১৮,২১৯; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী: ২০৩৫০ (সনদ: হাসান সহীহ) অন্য হাদীসে রাসূল সা. বলেন, ‘স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে কোন সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না।’- তিরমিযি
আজকে এই তাওহীদুল হাকিমিয়্যার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী শিরক হচ্ছে। সুতরাং তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহ ‘র জ্ঞান ব্যতীত আমাদের ঈমানই পূর্ণাঙ্গ হবে না। বরং প্রতি পদে পদে আমরা শিরকে আকবারে লিপ্ত থাকব। (নাউযুবিল্লাহ)। আর শিরকে আকবারে লিপ্ত জাতি হিসাবে আমাদের ঈমান ভয়াবহ হুমকির মুখে নিপতিত থাকবে। এরকম গুরুতর অপরাধে লিপ্ত কোন জাতিকে আল্লাহ তা’আলা কখনই সাহায্য করবেন না। আর আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোন জাতি কখনই দ্বীন কায়েম করতে পারবে না।
চলবে ……….
বাংলাদেশ অঞ্চলে দ্বীনকায়েমের সমস্যা সম্ভাবনা:১ম পরব
বাংলাদেশ অঞ্চলে দ্বীনকায়েমের সমস্যা সম্ভাবনা:২য় পরব