Announcement

Collapse
No announcement yet.

জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ-পর্যায় ও ব্যাখ্যা। সাইয়্যেদ কুতুব শহিদ রহঃ।

Collapse
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ-পর্যায় ও ব্যাখ্যা। সাইয়্যেদ কুতুব শহিদ রহঃ।

    ইমাম ইবনে কাইয়ুম তাঁর ‘যাদুল মাআদ’ গ্রন্থে ‘নবুওয়াতি জীবনে কাফির ও মুনাফিকদের ব্যাপারে আল্লাহর রাসুলের নীতি’ শিরনামে একটি অধ্যায় রচনা বর্ননা করেছেন । সেখানে বিজ্ঞ গ্রন্থাগার জিহাদের পর্যায়ক্রমিক স্তর বিন্যাস ও জিহাদের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, আল্লাহর রাসুলের উপর অবতির্ন সর্বপ্রথম আয়াত হলো-

    “(হে মুহাম্মাদ!) তুমি পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাটবদ্ধ রক্ত থেকে । তুমি পড়ো এবং (জেনে রাখো), তোমার প্রভু বড় মেহেরবান, যিনি (মানুষকে) কলম দ্বারা জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখিয়েছেন যা তিনি (না শেখালে) সে জান্তেই পারতো না ।”
    (সুরা আলাক=১-৫)

    এই আয়াতগুলোর মধ্য দিয়ে আল্লাহর নবীর নবুওয়াতি জীবনের সূচনা হয় । সূচনার এ পর্যায়ে আল্লাহ তাআলা তাঁকে শুধু পড়ার হুকুম দেন । প্রচারের নির্দেশ তখন দেন নি । পরবর্তী পর্যায়ে নাযিল হয় সূরা মুদ্দাছছির । এভাবে প্রথম আয়াত ‘ইকরা’র মাধ্যমে নবুওয়াত এবং দ্বিতীয় ‘ইয়া আইউহাল মুদ্দাআছির’ আয়াতের মাধ্যমে রিসালাতের দায়িত্ব দেয়া হয় । এরপর আল্লাহর রাসুল্কে নিকট আত্মীয়, প্রতিবেশী, সমগ্র আরব এবং গোটা বিশ্ববাসীর কাছে তাওহিদের দাওয়াত পৌছিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয় । বলা বাহুল্য যে, আল্লাহর নবী আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ীই দাওয়াতই মিশন পরিচালনা করেন । এ পর্যায়ে তিনি কোনো রকম যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়াই প্রায় তেরটি বছর মানুষের মনে আল্লাহর ভয়-ভীতি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন । আল্লাহর সঠিক পরিচয় এবং আল্লাহর একত্ববাদের সঠিক রূপরেখা তুলে ধরার সর্বাত্নক প্রচেষ্টা চালান । এই সময় তিনি এবং তাঁর সাহাবিরা অমানবিক যুলুম-নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও কারো প্রতি কোনোরকম আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেননি, বরং সম্পুর্ণ ধৈর্য, সংযম এবং সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন । এটা অবশ্যই আল্লাহর নির্দেশ ছিলো ।
    এরপর তাঁকে সাহাবীদের নিয়ে মদিনায় হিজরতের নির্দেশ দেয়া হয় । হিজরতের পরবর্তী সময়ে যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলো তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের নির্দেশনা দেয়া হয় এবং যারা মুসলমানদের কাজে কোনো ধরনের বাঁধা সৃষ্টি করে নি এবং তাদের বিরুদ্ধে কাউকে উস্কে দেয় নি, তাদের বিরুদ্ধে সাহায্য সহযোগিতা করে নি, তাদের বিরুদ্ধে সংযম অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয় । এরপর যখন আস্তে আস্তে আল্লাহর দ্বীন পুর্ণাঙ্গরুপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, মুসলমানরা যখন শক্তিশালী হয়ে উঠেন, তখন কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্নক জিহাদ ঘোষনার নির্দেশ দেয়া হয় । এ পর্যায়ে কাফিরদের সাথে নীতিগত অবস্থানের ব্যাপারে তাদেরকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয় ।

    ১। চুক্তিবদ্ধ ২। যুদ্ধরত ৩। জিম্মি

    যেসব কাফিরদের সাথে আল্লাহর রাসুল পূর্ব থেকে কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন তাদের ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয় যে, যতক্ষন তারা চুক্তি রক্ষা করে চলবে ততক্ষণ তোমারাও নিয়মমাফিক চুক্তি রক্ষা করে চলবে । তবে হ্যা, তাদের পক্ষ থেকে চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলমানদের বিপদে ফেলার সন্দেহ দেখা দিলে, কোনো রকম লুকোচুরি না করে প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে আল্লাহর রাসুলকে তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে । যারা প্রকাশ্যে চুক্তি ভঙ্গ করে নি, কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে চুক্তি ভঙ্গের আভাস পাওয়া গিয়েছে, তাদেরকে যথা নিয়মে চুক্তি বাতিলের নোটিশ না দিয়ে তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে নিষেধ করা হয়েছে ।
    সূরা তাওবাতে আল্লাহ তাআলা তিনটি শ্রেণির ব্যাপারেই তাঁর নীতি ঘোষনা করেন । এই বিধানে বলা হয়, আহলে কিতাবরা যতক্ষন পর্যন্ত ইসলাম গ্রহন না করবে বা নিজ হাতে জিজিয়া না দেবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ অব্যাহত থাকবে । কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে কঠোর জিহাদ শুরুর নির্দেশ দেয়া হয় । এই দুই শ্রেনীর সাথে জিহাদের পদ্ধতি ছিলো দুই ধরনের । কাফিরদের বিরুদ্ধে সরাসরি সশস্ত্র জিহাদ, আর মুজনাফিকদের সামনে অখণ্ডনীয় যুক্তি-প্রমান উপস্থাপনের মাধ্যমে মৌখিক জিহাদ শুরু হয় ।
    সূরা তাওবার প্রথম আয়াতেই কাফির-মুশরিকদের সাথে সম্পাদিত আল্লাহর রাসুলের সকল চুক্তি বাতিল বলে ঘোষণা করা হয় । এরপর চুক্তিবদ্ধ কাফিরদের চুক্তির ধরন ও প্রকারভেদ তিন শ্রেনীতে ভাগ করা হয় এবং তিন শ্রেনীর ব্যাপারে চূড়ান্ত পর্যায়ে একই নীতি হলেও সাময়িকভাবে তিন নীতি ঘোষনা করা হয় ।
    ১। যারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয় ।

    ২। মেয়াদী চুক্তিতে আবদ্ধ যেসব কাফিররা চুক্তি ভঙ্গ করেনি, মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাউকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করে নি এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য-সহযোগিতা করেনি, তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করতে নির্দেশ দেয়া হয় ।

    ৩। অনির্দিষ্টকালের জন্য চুক্তিবদ্ধদের মধ্যে যারা যথাযথ সম্মানের সাথে চুক্তি মেনে চলেছিলো তাদেরকে চার মাস সময় দেয়া হয় । এই সময়ের পর তারা আল্লাহর দ্বীন গ্রহন না করলে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দেয়া হয় ।

    আল্লাহর রাসুল কুরআনের হুকুম যথানিয়মে পালন করেন । এতে দেখা যায় যে, তাদের অধিকাংশ ইসলাম গ্রহন করে । আর যারা ইসলাম গ্রহন করেনি তারাও জিযিয়া (ট্যাক্স) প্রদানের মাধ্যমে মুসলিম রাষ্ট্রের আনুগত্য মেনে নেয় । আমরা সার্বিক অবস্থা ও কুরআনের নির্দেশনা বিশ্লেষন করে দেখতে পায় যে, সূরা তাওবা নযিলের হওয়ার পর কাফিররা সর্বমোট তিনটি শ্রেনীতে ভাগ হয়ে যায় ।

    ১। মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কাফির ।
    ২। চুক্তিবদ্ধ কাফির ।
    ৩। জিম্মি ।

    দ্বিতীয় শ্রেনীর কাফিররা পরবর্তী পর্যায়ে ব্যাপকহারে ইসলাম গ্রহন করার প্রেক্ষিতে কাফিরদের এই শ্রেণিটি বিলুপ্ত হয়ে যায় । বাকী থাকে দুটি শ্রেনী-

    (১) যুদ্ধরত
    (২) জিম্মি

    আমরা এই নীতির আলোকে সারা পৃথিবীর মানুষকে তিনটি শ্রেনীতে বিভক্ত দেখতে পাই । প্রত্যেকটি জাতি এর কোনো না কোনো দলে বিভক্ত ।

    ১- নবীর আনীত দ্বীনের প্রতি ইমানদার মুসলমান ।
    ২- নিজ নিজ ধর্মাবলীম্ব জিম্মি ।
    ৩- যুদ্ধরত কাফির ।

    চতুর্থ আরেকটি বহুল আলোচিত শ্রেনী যদিও রয়ে গেছে তবে তাদের ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহনের সাধারণ নির্দেশ দেয়া হয়নি । কারন, এরা হলো বর্ণচোরা, কপট, মুনাফিক । এরা নিজেদেরকে মুসলমানই দাবি করে, মুখে ইমানের ঘোষনা দেয়, অথচ তারা ইমানদার নয় । জাহান্নামের এই কীটগুলোর ব্যাপারে কোনো সাধারণ ব্যবস্থা দেয়া হয়নি । তাদের বাহ্যিক ইমানের দাবি ও আনুগত্য মেনে নিতে বলা হয় এবং অন্তরের বিষয়টি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিতে বলা হয় । তবে তাদের চরিত্রের এই কপটতা দূরীকরণের জন্য যুক্তিপূর্ণ হৃদয়গ্রাহী আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তাদেরকে সত্যিকার অর্থে ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে ।
    এদিকে কুরআনের সরাসরি আয়াতে মাধ্যমে মুনাফিকদের জানাযা পড়তে, তাদের জন্য দয়া করতে, তাদের কবরের পাশে দাড়াতে, এমনকি তাদের গুনাহ মাফ করে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে কোনো দয়া করতে নিষেধ করা হয়েছে । সর্বশেষ পর্যায়ে এও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর নবীও যদি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন, এমনকি যদি সত্তরবারও ক্ষমা প্রার্থনা করেন তবুও তাদের ক্ষমা করা হবে না ।
    আমরা যদি গভীরভাবে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো, ইমাম ইবনে কাইয়ুমের এতক্ষনের আলোচনায় ইসলামি জিহাদের পর্যায়ক্রমে সকল স্তরগুলো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে । এ প্রক্রিয়ার মাঝে নিহিত রয়েছে এক সূদুরপ্রসারী জিহাদী পরিকল্পনা । এগুলো পর্যালোচনা করলে অনেক ইতিবাচক দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে । এ প্রসঙ্গে কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো ।

    জিহাদের প্রথম স্তরঃ

    দ্বীনের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো, এই দ্বীন কল্পনাবিলাসী বা অলৌকিক কিছু নয়; বরং আল্লাহর তরফ থেকে দেয়া সম্পুর্ণ বাস্তবসম্মত একটি জীবন বিধান । জমিনে এই দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রয়েছে বাস্তব পন্থা ও যুগের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ উপায়-উপকরণ । মানুষ পঙ্কিলতার যতো নিচেই চলে যাক না কেন, সে চাইলে দ্বীনতাঁকে মুহুর্তে নিজের শান্তিময় কোলে টেনে নিতে পারে । আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম শুরু করার সাথে সাথে জাহেলি সমাজব্যবস্থা ও তাঁর কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠির সাথে সংঘর্ষ বেধে যায় । কারন প্রতিষ্ঠিত সমাজের কাঠামো, মানুষের আকিদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে জাহেলিয়াতের ওপর । সুতরাং সংঘর্ষ তো অনিবার্য হবেই । তাই ইসলামি আন্দোলনের মুজাহিদদেরকেও ইমানি বলে বলীয়ান হওয়ার সাথে সাথে আধুনিক উপায় উপকরন, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও চেষ্টা করতে হবে-শত্রুদের সাথে অন্তত সমান সমান থাকার ।
    ইসলামি আন্দোলন একই সাথে উভয়বিধ কাজের আঞ্জাম দেয় । মানুষের চিন্তা-চেতনা, আকিদা-বিশ্বাস পরিবর্তনের জন্য প্রচার অভিযান পরিচালনার সাথে সাথে প্রতিষ্ঠিত জাহেলি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উচ্ছেদের জন্য সামরিক শক্তিসহ প্রয়োজনীয় সব রকম উপায় উপকরন দ্বারা জিহাদ পরিচালনার আদেশ দেয় । এই পথ অবলম্বন না করে কোন উপায়ও নেই । কারন, জাহেলি সমাজের নেতারাতাদের সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জিহাদ কে বাধাগ্রস্থ করে । তারা মানুষকে ইসলামের পথে আসতে বাঁধা দেয় এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার ধোয়া তুলে তাদের প্রতিষ্ঠিত কুফরী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতি অনুগত থাকতে বাধ্য করে । সাধারণ অ দুর্বল ইমানের মানুষের ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য বাদ দিয়ে সেসব জাহেলি নেতাদের আনুগত্য করা ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না । তাই কোনো মানুষকে জোর করে তাঁর বিশ্বাস পরিবর্তন করতে ইসলাম বাধ্য করে না; ঠিক তেমনি, যারা পার্থিব শক্তিপুষ্ট হয়ে মানুষকে ইসলামের পথে আসতে বাঁধা দেয়, তাদের ক্ষেত্রে শুধু ওয়াস নসিহতকে ইসলাম যথেষ্ট মনে করে না; বরং এক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেয় । এই দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জন্য উল্লিখিত ‘দাওয়াত ও সামরিক’ উভয় পন্থা প্রয়োগ সমান গুরুত্বপূর্ন । কারন, এ আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কোনো তুচ্ছ বিষয় নয়; বরং জাহেলি নেতাদের গোলামির শেকলে বন্দী বিশ্বমানবতাকে উদ্ধার করে একমাত্র আল্লাহর অনুগত করাই এই আন্দোলনের লক্ষ্য ।

    জিহাদের দ্বিতীয় স্তরঃ

    আল্লাহর দ্বীনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এই
    দ্বীন ‘এক লাফে তালগাছে ওঠা’র নীতি অবলম্বন করে না । একসাথে সব হুকুম চাপিয়ে দিয়ে মানুষের জীবন দুর্বিসহ করে তোলে না । বরং এই আন্দোলন সুপরিকল্পিতভাবে, ধাপে ধাপে অগ্রসর হয় এবং প্রতিটি পর্যায়ে বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উপায় উপকরণ ব্যবহার করে । একটি ধাপ অতিক্রম করার মধ্য দিয়েই সে পরবর্তী ধাপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে । জাহেলি নেতৃত্ব যখন এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য বিভিন্ন ধরনের বস্তুগত উপায় উপকরন নিয়ে মাঠে নামে তখন নিছক ওয়াজ নসিহতের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকার কথা ইসলাম বলে না । পক্ষান্তরে অলঙ্ঘনীয় কোনো বাঁধা ধরা নিয়মের ছকে চলতেও বাধ্য করে না । এমন অনেকেই রয়েছেন যারা জিহাদের আয়াত উদ্ধৃত করেই জিহাদের আলোচনা করেন, কিন্তু ইসলামি আন্দোলনের পর্যায়ক্রমিক স্তর সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো বুঝতে সক্ষম হন না । আন্দোলনের কোনো স্তরে কুরআনের কোন আয়াত মাযিল হয়েছে এবং এই পর্যায়ে আয়াতটি নাযিল হওয়ার তাৎপর্য কি- তাও তারা বুঝে উঠতে পারে না । কুরআনের আয়াত নাযিলের এই স্তরগুলোর সঠিক তাৎপর্য না বোঝার কারণে তারা জিহাদের সঠিক রূপরেখা ও তাৎপর্যকে বিকৃত করে ফেলেন । আন্দোলনের স্তরগুলোর সাথে কুরআনের আয়াতের গভীর সম্পর্কের দিকগুলো না জানার কারণে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন এবং প্রত্যেকটি আয়াতকেই তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মনে করেন ।
    আসলে বর্তমানের নামসর্বস্ব মুসলমানেরা জাহেলি সমাজে জন্মগ্রহন করে, অধঃপতিত মুসলমান সমাজের হতাশাজনক অবস্থা ও তাদের দুর্বল সমরশক্তি দেখে ঘাবড়ে যাওয়ার কারণেই তারা এমন পরাজিত মানসিকতার শিকার হয়েছে । এই পরাজিত মানসিকতার কারণেই তারা বলেন, ‘ইসলাম শুধু আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধেরই অনুমতি দেয়’ । এসব অপব্যাখ্যার দ্বারা আল্লাহর দ্বীনকে তাঁর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেও তারা মনে করে যে, তারা ইসলামের বিরাট কল্যান সাধন করেছে । অথচ তাদের এসব ব্যাখ্যা গ্রহন করা হলে ইসলাম তাঁর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মূল বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলবে । এই ব্যাখ্যা গ্রহন করা হলে তাগুতি শাসনব্যবস্থা উচ্ছেদ করে মানুষকে তাদের গোলামি থেকে মুক্ত করার কর্মসূচি বলতে আর কিছু থাকে না । তবে এর অর্থ এই নয় যে, ইসলাম গর্দানে তলোয়ার ধরে কাউকে তাঁর ধর্ম মত পরিবর্তন করতে বাধ্য করে । বরং প্রতিটি মানুষ যেন তাঁর নিজস্ব চিন্তা চেতনা লালন করতে পারে, নিজ ধর্ম পালন করতে পারে সে জন্য ইসলাম যুলুমবাজ তাগুতি শক্তিকে উচ্ছেদ করে জনগনের স্বাধীনতা জনগনের হাতে ফিরিয়ে দেয় । তাইতো ইসলাম জিযিয়া দিয়ে সম্পুর্ণ স্বাধীনভাবে বিধর্মীদেরকে ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসের সুযোগ দেয় । শুধু সৃষ্টিজগতের একচ্ছত্র সার্বভৌম মালিকের জীবনবিধান গ্রহন করতে এবং টা সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে যারা বাঁধা দেয় তাদের আমুল উচ্ছেদেই ইসলামের জিহাদের মূল লক্ষ্য । প্রতিটি মানুষই স্বাধীনভাবে ইসলাম গ্রহন করা বা না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, এতে কোনো জোর জবরদস্তি নেই ।

    জিহাদের তৃতীয় স্তরঃ

    এই আন্দোলনের তৃতীয় আরেকটি দিক হলো যে, যতো যুলুম-নির্যাতন, বাঁধা-বিপত্তি, হত্যাযজ্ঞ ও ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হোক না কেন, কোনো অবস্থাতেই সে তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয় না । আল্লাহর নবী তাঁর নবুওয়াতি জীবনে যখন যে স্তরে যাদেরকেই দাওয়াত দিয়েছেন, তাদেরকে একটু খুশি করার জন্য দাওয়াতের মূল বক্তব্য প্রকাশে কোনো রকম লুকোচুরি বা অস্পষ্টতার আশ্রয় নেননি । ইসলামের বাণী সুস্পষ্টভাবে, আপসহীন নীতিতেই তাদের সামনে তুলে ধরেছেন । তিনি যাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন তাদেরকে প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন যে, এই দাওয়াত হলো প্রতিষ্ঠিত জাহেলি সমাজের মানুষের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ও আইন প্রনেতা হিসেবে যারা মানুষের প্রভু সেজে বসেছে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনার দাওয়াত । এ দাওয়াত হলো মানুষের গোলামি থেকে মুক্ত হয়ে এক আল্লাহর গোলামিতে আত্মনিয়োগ করার দাওয়াত । এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র নমনীয়তা বা আপসের সুযোগ নেই । এ আহ্বানকে ব্যক্তিগত জীবনে, সমাজে ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাস্তবমুখী এবং সুপরিকল্পিত নীতিমালা অনুসরণ করেই আন্দোলন তাঁর প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করে ।

    জিহাদের চতুর্থ স্তরঃ

    এ পর্যায়ে আলোচনা করা হবে ইসলাম রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর পর কোন ক্ষেত্রে কোন নীতি অবলম্বন করবে সে সম্পর্কে । অবশ্য ইতিঃপূর্বে উদ্ধৃত ‘যাদুল মাআদ’ গ্রন্থের অংশে এ বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ।
    ইসলাম যেহেতু সমগ্র বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রব্বুল আলামিনের দেয়া জীবনবিধান, সেহেতু প্রতিটি মানুষের জন্যই এই জীবনবিধান গ্রহন করা নীতিগতভাবে বাধ্যতামুলক । তারপরও আল্লাহ তাআলা যেহেতু মানুষকে দুনিয়ার জীবনে চলার পথ নির্ধারনের স্বাধীনতা দিয়ে পাঠিয়েছেন, সেহেতু যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবে অন্য কোনো ধর্মমত নিয়ে জীবনযাপন করতে চায়, তাহলে ইসলামি শরিয়াত তার ওপর শক্তি প্রয়োগের বৈধতা দেয় না । তবে হাঁ, কোনো অবস্থাতেই তারা ইসলামের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর অধিকার পাবে না । প্রচার প্রসারের মাধ্যমে অথবা সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনো প্রকার শক্তি প্রয়োগ করে কেউ ইসলামের বিরোধিতা করবে’তা কিছুতেই ইসলাম বরদাস্ত করবে না । ভিন্ন-ধর্মীদের অবশ্যই ইসলামের সাথে আপোস করে, নত হয়ে এবং জিযিয়া দিয়ে চলতে হবে । যদি কেউ ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করে, মানুষের ইসলাম গ্রহন কিংবা ইসলামি আইনকানুন পালনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মৃত্যুবরন অথবা বশ্যতা স্বীকার না করা পর্যন্ত ইসলাম সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখবে ।
    দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীতে মুসলমানদের চরম দুরব্যবস্থার কারণে পশ্চাত্যের হীন প্রপাগাণ্ডার কাছে মানসিকভাবে পরাজিত হয়ে যেসব অতি পণ্ডিতরা ইসলামি আদর্শ থেকে ‘জিহাদ’ নামের কলঙ্ক (!) দূর করার চেষ্টা করে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চান তারা মুলত ইসলামের দুটো নীতি বুঝতে না পারার কারণে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন ।
    প্রথম নীতিটি হলো, ‘লা ইকরাহা ফিদদীন’ অর্থাৎ ইসলামে কোনো জোর জবরদস্তি নেই ।
    দ্বিতীয়টি হলো, যেসব অপশক্তি মানুষকে আল্লাহর গোলামী থেকে ফিরিয়ে এনে তাদের গোলামী করতে বাধ্য করে, সেসব অপশক্তির বিরুদ্ধে ঘোষিত আপোষহীন জিহাদ ।
    আপনি যদি এই দুটো মূলনীতি বিশ্লেষণ করেন তাহলে নিজেই বুঝতে পারবেন, এ দুটোর মাঝে কোনো সংঘর্ষ নেই । স্ব স্ব ক্ষেত্রে দুটো নীতি সমানভাবেই ব্যস্ত বায়নযোগ্য । কিন্তু পাশ্চাত্যের প্রভুদের গোলামী করেই যেসব পরাজিত ও দুর্বল মনোভাবাপন্ন ‘স্কলাররা’ শান্তি পায়, তারা বিভিন্ন রকম কথার ফুলঝুরি আর গোজামিলের যুক্তি দিয়ে ইসলামের জিহাদকে নিছক ‘আত্মরক্ষামূলক জিহাদ’ বলে চালিয়ে দিতে চান । তারা তাগুতি শক্তির উচ্ছেদ করতে গিয়ে ঘোষিত জিহাদকে ঝামেলা মনে করেন, কলঙ্ক ভাবেন । তারা বর্তমান পৃথিবীতে ঘটমান স্বার্থভিত্তিক, নোংরা ও হীন উদ্দেশ্য পরিচালিত নৃশংস যুদ্ধের পাশাপাশি ইসলামের সুমহান ‘জিহাদের’ তুলনামূলক আলোচনা করেন । অথচ ইসলামের জিহাদের ধরন, প্রকৃতি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কোনো দিক থেকেই এসব বর্বর যুদ্ধের মতো নয়; বরং যুদ্ধের কারণ, ধরন সবই ভিন্ন । বর্তমান বিশ্বের এসব নোংরা বর্বর যুদ্ধের সাথে ইসলামি জিহাদের কোনো সামঞ্জস্য নেই । ইসলামি জিহাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, প্রকৃতি যদি বুঝতে হয় তাহলে আল্লাহর দ্বীনের প্রকৃতি, বিশ্বজগত এর ভূমিকা, দ্বীনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, আল্লাহর নবির রিসালাত ও তাঁর জীবন অনুসৃত পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে অবশ্যই যথাযথ জ্ঞান অর্জন করতে হবে । এসবের মাঝেই ইসলামের জিহাদের তাৎপর্য খুজে পাওয়া যাবে ।

    ((সংগৃহীত))
Working...
X