জিহাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য:
আল্লাহ তাআলা মানব জাতীকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন একমাত্র তাঁর এবাদত করার জন্য। কিন্তু শয়তানের ধোঁকা এবং ও নফসের কুপ্রবৃত্তির জালে ফেঁসে বান্দা বারবার তা থেকে সরে পড়বে—আল্লাহ তা আগে থেকেই জানতেন। এজন্য আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে তাঁর নির্বাচিত বান্দা (নবী-রাসূল) প্রেরণ করে মানুষকে তার মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কথা মনে করে দিয়েছেন।
কিন্তু অনেকের উপর নফসের কুপ্রবৃত্তি এতটা চেপে বসে যে, তা থেকে বের হয়ে আল্লাহর এবাদতের দিকে ফিরে যাওয়া অনেক কষ্টকর; বরং ‘অসম্ভব’ হয়ে যায়। তদ্রূপ সমাজের মাতবর ও নেতা শ্রেণীর কারণে বাকিরা উক্ত দাওয়াত গ্রহণ করতে দ্বিধা ও সংকোচ বোধ করে। বরং কেউ গ্রহণ করতে চাইলে উক্ত শ্রেণীকর্তৃক নানা ধরনের নির্যাতন ও জুলুমের শিকার হতে হয়। তখন উক্ত অবাধ্য ও পাপাচার শ্রেণীকর্তৃক জুলুমের আস্ফালন রোধ করতে এবং তাদের মূল কাজ, আল্লাহর এবাদতের দিকে ফিরে নিতে বলপ্রয়োগ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। সুতরাং উক্ত উদ্দেশ্যকেই সামনে রেখে আল্লাহ তাআলা জিহাদের বিধান দিয়েছেন।[1]
তাই জিহাদের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে, বান্দাকে মাখলুক (বান্দা) ও কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে বের করে এক আল্লাহর গোলামিতে ফিরিয়ে নেওয়া। -আহম্মিয়্যাতুল জিহাদ: পৃ: ১৫৮ (দারু তায়বাহ)
পারস্য সেনাপতি রুসতুম যখন প্রখ্যাত সাহাবী রিবয়ী বিন আমির রাদি.কে জিজ্ঞাসা করে, তোমরা কী জন্য এসেছ? উত্তরে রিবয়ী রাদি. বলেন,
“আল্লাহ আমাদেরকে পাঠিয়েছেন এবং তিনিই আমাদেরকে (তোমাদের কাছে) নিয়ে এসেছেন; যাতে আমরা আল্লাহ যার ব্যাপারে চান, তাকে বান্দার দাসত্ব থেকে আল্লাহ গোলামির দিকে; দুনিয়ার সঙ্কীর্ণতা থেকে প্রশস্ততার দিকে এবং ভ্রান্ত ধর্মসমূহের অত্যাচার থেকে ইসলামের আদল ও ইনসাফের দিকে বের করতে পারি। সুতরাং তিনি আমাদেরকে তাঁর দীন দিয়ে তাঁরই বান্দাদের কাছে পাঠিয়েছেন; যাতে আমরা তাদেরকে দীনের প্রতি আহ্বান করি। যে উক্ত দীন গ্রহণ করবে, আমরাও তার থেকে তা গ্রহণ করে ফিরে যাব এবং তার এলাকা ও আশপাশ তার জন্য ছেড়ে যাব। আর যে তা অস্বীকার করবে আমরা আল্লাহর প্রতিশ্রুতিতে পৌঁছা পর্যন্ত সর্বদা তার সাথে যুদ্ধ করে যাব।” –তারীখে তাবারী: ৩/৫২০ (দারুত তুরাস); আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া: ৭/৩৯ (দারুল ফিকর)
উক্ত মৌলিক লক্ষ্যটি তখনই বাস্তবায়ন হবে যখন আল্লাহর দীন বিজয়ী হবে এবং কুফুরের দাপট ভূলুণ্ঠিত হবে। অন্যথায় তা সম্ভব নয়। তাই উক্ত মৌলিক লক্ষ্যকে অন্যভাবে বললে বলা যায়, জিহাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দুইটি— এক. আল্লাহর দীন বিজয় করা। এবং দুই. কুফুরের দাপট ভূলুণ্ঠিত করা। -ফাতহুর কাদীর: ৫/৪২২ (ইলমিয়্যাহ); বেনায়া শরহে হেদায়া: ৭/৯৬ (ইলমিয়্যাহ); তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম: ৩/৬ (দারু ইহয়ায়িত তুরাসিল আরাবী)
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
“আর তোমরা তাদের (কাফেরদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকো, যতক্ষণ না ফিতনা দূরীভূত হয় এবং দীন একমাত্র আল্লাহর হয়ে যায়। এতে যদি তারা বিরত হয়ে যায়, তাহলে জালিম ছাড়া অন্য কারো প্রতি কোনো কঠোরতা নেই।” –সূরা বাকারা: ১৯৩
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা জিহাদের মৌলিক দুটি লক্ষ্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। একটি হচ্ছে ফিতনা দূরীভূত হওয়া। অর্থাৎ কুফুর ও শিরকের দাপট না থাকা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে দীন একমাত্র আল্লাহ হওয়া। অর্থাৎ পৃথিবীতে একমাত্র আল্লাহর দীন বিজয়ী হওয়া। অন্য কোনো ধর্ম বিজয়ী না থাকা। -তাফসীরে তাবারী: ১৩/৫৩৭ (মুআসসাসাতুর রিসালাহ); আহকামুল কুরআন: ১/৩১৬ (ইলমিয়্যাহ); তাফসীরে ইবনে আতিয়্যাহ: ১/২৬৩ (ইলমিয়্যাহ)
উপর্যুক্ত বিষয়টি মৌলিকভাবে জিহাদের লক্ষ্য হলেও এ ছাড়া আরো কিছু লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে, যা মূলত জিহাদের মূল লক্ষ্য, বান্দা ও কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে বের করে আল্লাহর গোলামির দিকে ফিরিয়ে নেওয়া-এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন—
ক. মুসলিম ভূখণ্ডেরহেফাজতকরা:
ঈমান ও কুফুরের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। তাই কুফুরশক্তি ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য সর্বাবস্থায় বদ্ধপরিকর। সুতরাং এজন্য বিভিন্ন ছুতো ধরে তারা মুসলিম ভূখণ্ডের উপর আক্রমন করতে চাইবে। এমতাবস্থায় মুসলিম ভূখণ্ড হেফাজত করা জিহাদের অন্যতম লক্ষ্য।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
“আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে দুনিয়া বিধ্বস্ত হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ জগতবাসীর প্রতি অনেক দয়ালু।” –সূরা বাকারা: ২৫১
“আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে (ধর্মযাজকদের) গির্জা, (খৃস্টানদের) এবাদতখানা, (ইহুদিদের) উপাসনালয় এবং (মুসলিমদের) মসজিদসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যেত; যেগুলাতে অধিকহারে আল্লাহর নাম স্বরণ করা হয়। নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করবেন, যারা আল্লাহকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী শক্তিধর।” –সূরা হজ: ৪০
খ. জুলুম প্রতিহত করা এবং মাজলুমকে সাহায্য করা:
ঈমান ও কুফুরের চিরন্তর দ্বন্দ্ব থেকেই কাফেররা মুসলিমদের উপর নির্যাতন করার সুযোগ পেলে তা হাতছাড়া করবে না। এমতাবস্থায় জুলুম প্রতিহত করে মজলুমকে সাহায্য করাও জিহাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
“এবং তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর পথে এবং সেসকল অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশুদের (উদ্ধার করার) পথে যুদ্ধ করছ না; যারা বলছে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে এ জালিম অধিবাসীর জনপদ থেকে বের করে নিন। আর আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একজন অভিভাবক বানিয়ে দিন এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দিন।” –সূরা নিসা: ৭৫
অন্যত্র এরশাদ করেন,
“যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আপন জান ও মাল দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে এবং যারা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, তারা একে অপরের বন্ধু। আর যারা ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরত করেনি, তারা হিজরত না করা পর্যন্ত তাদের সাথে তোমাদের নূন্যতম বন্ধুত্বের প্রয়োজন নেই। তবে তারা যদি ধর্মীয় ব্যাপারে তোমাদের সাহায্য চায়, তাহলে তাদের সাহায্য করা তোমাদের জন্য আবশ্যক। কিন্তু এমন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যাবে না, যাদের সাথে তোমাদের (যুদ্ধবিরতি) চুক্তি রয়েছে। তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ তা সবই দেখেন।” –সূরা আনফাল: ৭২
গ. দীন, জান, মাল, সম্ভ্রব ও পরিবারের হেফাজত করা:
মানবজাতীর অস্তিত্বের আগে থেকেই এ কথা নির্ধারিত হয়ে আছে, এরা দুনিয়াতে খুনখারাবি করবে; একে অপরের উপর জুলুম করবে। যা আমাদের ব্যাপারে ফেরেশতাগণের অভিমত এবং আল্লাহ তাআলা তা নাকচ না করা থেকে বুঝে আসে।
তাই মানবজাতীর কেউ অপরজন দ্বারা দীন, জান, মাল, সম্ভ্রব, পরিবার—এক কথায় যেকোনো বৈধ অধিকারে জুলুমের শিকার হলে, তা উদ্ধার ও হেফাজতের নিশ্চয়তা দেওয়া জিহাদের অন্যতম লক্ষ্য। এমনকি আক্রমনকারী মুসলিম হলেও তা প্রতিহত করা হবে।
হাদীসে এসেছে,
“সাঈদ বিন যায়েদ রাদি. বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তার সম্পদের জন্য নিহত হলো সে শহীদ। যে তার দীনের জন্য নিহত হলো সে শহীদ। যে তার রক্তের জন্য নিহত হলো সে শহীদ। যে তার পরিবারের জন্য নিহত হলো সে শহীদ। -জামে’ তিরমিযী: ১৪২১; সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৭২; সুনানে নাসায়ী: ৪০৯৫। ইমাম তিরমিযী রহ. হাদীসটি হাসান সহীহ বলেছেন।
ফকীহগণ এ পর্যন্ত বলেছেন, যদি মুসলিম পিতাও অন্যায়ভাবে আক্রমন করে এবং প্রত্যাঘাত ছাড়া তা প্রতিহত সম্ভব না হয়, তাহলে তা প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে নাশী হামলা বৈধ। -ফাতহুল কাদীর: ৫/৪৩৯ (ইলমিয়্যাহ); রদ্দুল মুহতার: ৪/১৩৩ (দারুল ফিকর)
ঘ. সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করা:
ইসলামের জয়জয়কার দেখলে অথবা দুনিয়াবি কোনো স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে অনেক মুনাফিকচক্র মুসলিম হওয়ার; এমনকি মুসলিম উম্মাহর হিতাকাঙ্ক্ষী হওয়ার দাবি করে বসবে। এমতাবস্থায় সত্যিকার মুমিন ও দাবিদার মুনাফিকের মাঝে পার্থক্য করা; সত্যকে মিথ্যার বেড়াজাল থেকে বের করা এবং মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করা হচ্ছে জিহাদের অন্যতম লক্ষ্য।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
“উভয় (কাফের ও মুসিলম) দল সামনাসামনি মিলিত হওয়ার দিন (উহুদের দিন) যা তোমাদের উপর আবর্তিত হয়েছে, তা আল্লাহর হুকুমেই হয়েছে। এবং যাতে আল্লাহ যাচাই করতে পারেন, কারা প্রকৃত ঈমানদার এবং যাচাই করতে পারেন, কারা মুনাফিক। (মুনাফিকদের আলামত হচ্ছে) তাদেরকে বলা হলো— এসো, আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করো অথবা (অন্তত) প্রতিহত করো। তারা বলেছিল, আমরা যদি জানতাম যে লড়াই হবে, তাহলে অবশ্যই তোমাদের সাথে থাকতাম। সে দিন তারা ঈমানের তুলনায় কুফরীর বেশি নিকটবর্তী ছিল। তারা মুখে তা বলে যা তাদের অন্তরে নেই। তারা যা কিছু গোপন করে আল্লাহ ভালভাবে জানেন।” -সূরা আলে ইমরান: ১৬৬, ১৬৭
“আল্লাহ মুমিনদেরকে তোমাদের অবস্থায় এমনিতে ছেড়ে দিবেন না; যতক্ষণ না নাপাককে পাক থেকে পৃথক করতে পারেন।” -সূরা আলে ইমরান: ১৭৯
“আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যতক্ষণ না যাচাই করতে পারি তোমাদের মধ্যে কারা মুজাহিদ ও সবরকারী এবং যতক্ষণ না যাচাই করতে পারি তোমাদের অবস্থাসমূহ।” –সূরা মুহাম্মদ: ৩১
ঙ. আল্লাহর সন্তুষ্টি ও শাহাদতের মর্জদা অর্জন:
আল্লাহ তাআলা তাঁর বিশেষ কিছু বান্দাকে বিশেষভাবে ভূষিত করতে চান। এজন্য একটি মাধ্যম তো নবুওত রেখেছেন। কিন্তু উক্ত বিশেষত্বটি অল্প কিছু বান্দা পেয়েছেন এবং তা বান্দার ক্ষমতার ঊর্ধে। তাই আল্লাহ তাআলা সাধারণ বান্দাদের জন্য নবুওয়তের চেয়ে নিচের স্থরে এবং বান্দার সামর্থের ভিতরে আরেকটি বিষয় রেখেছেন। আর তা হচ্ছে, তাঁর রাস্তায় শাহাদত বরণ করা।
তাই জিহাদের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, শাহাদতের চূড়ায় চড়ে আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ স্তরটি অর্জন করা।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
“(এভাবে যুদ্ধে সাময়িক পরাজয় দেন) যাতে আল্লাহ জানতে পারেন কারা প্রকৃত ঈমানদার এবং যাতে তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন। আর আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না।” –সূরা আলে ইমরান: ১৪০
হাদীসে এসেছে,
“আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার জান! যদি এমন মুমিন না থাকত, যারা আমার সাথে জিহাদ করা থেকে পিছনে থাকতে পছন্দ করবে না এবং আমিও তাদেরকে আরোহি দিতে পারি না, তাহলে আমি আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বের হওয়া কোনো সৈন্যদল থেকে পিছিয়ে থাকতাম না। সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার জান! আমি অবশ্যই পছন্দ করি, যেন আমি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হই। আবার জীবিত হয়ে পুনরায় শহীদ হই। আবার জীবিত হয়ে পুনরায় শহীদ হই। আবার জীবিত হয়ে আবার শহীদ হই।” –সহীহ বুখারী: ২৭৯৭
উপর্যুক্ত সব কয়টির প্রতি লক্ষ্য করলে একটি বিষয় স্পষ্ট দেখা যাবে— কোনো বান্দার দাসত্ব বা কুপ্রবৃত্তির প্ররোচনায় আল্লাহ বিধিনিষেধ অমান্য করা হয়েছে। তাই তাদেরকে আল্লাহ দিকে ফিরিয়ে নিতেই জিহাদের বিধান। উক্ত বিষয়সমূহ ছাড়া আরো কিছু লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে, যা মূলত প্রথমোক্ত বিষয় দুটির অন্তর্ভুক্ত।
[1] এখানে এ সংশয় করার সুযোগ নেই যে, “ইসলাম কোনো ব্যক্তিকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করে না”। কেননা, মানুষকে আল্লাহর এবাদতের দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে জিহাদ করা মানে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হবে, এমনটা জরুরি নয়। বরং জিহাদ শুরু করার আগে কাফেরদেরকে ইসলাম গ্রহণ, যিম্মাচু্ক্তিতে সম্মত হওয়া অথবা লড়াইয়ের পথ বেছে নেওয়া—এ তিনটি সুযোগ দেওয়া হবে। ইসলাম গ্রহণ না করলে নির্দিষ্ট শর্তে যিম্মাচুক্তিতে সম্মত হলে ভালো। অন্যথায় লড়াইয়ের মাধ্যমে সমাধান হবে। আর যিম্মী বানানোর মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে, ইসলামী বিধিবিধানের অধিনে বসবাস করে ইসলামের সুন্দর্য দেখে যাতে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তা গ্রহণ করতে পারে। অন্যথায় শুধু বস্তুগত কিছু ফায়দা হাসিল করা যিম্মাচুক্তির লক্ষ্য নয়। তাই যিম্মাচুক্তিও পরোক্ষভাবে ইসলামের দিকে দাওয়াতের মাধ্যম হলো।
আল্লাহ তাআলা মানব জাতীকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন একমাত্র তাঁর এবাদত করার জন্য। কিন্তু শয়তানের ধোঁকা এবং ও নফসের কুপ্রবৃত্তির জালে ফেঁসে বান্দা বারবার তা থেকে সরে পড়বে—আল্লাহ তা আগে থেকেই জানতেন। এজন্য আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে তাঁর নির্বাচিত বান্দা (নবী-রাসূল) প্রেরণ করে মানুষকে তার মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কথা মনে করে দিয়েছেন।
কিন্তু অনেকের উপর নফসের কুপ্রবৃত্তি এতটা চেপে বসে যে, তা থেকে বের হয়ে আল্লাহর এবাদতের দিকে ফিরে যাওয়া অনেক কষ্টকর; বরং ‘অসম্ভব’ হয়ে যায়। তদ্রূপ সমাজের মাতবর ও নেতা শ্রেণীর কারণে বাকিরা উক্ত দাওয়াত গ্রহণ করতে দ্বিধা ও সংকোচ বোধ করে। বরং কেউ গ্রহণ করতে চাইলে উক্ত শ্রেণীকর্তৃক নানা ধরনের নির্যাতন ও জুলুমের শিকার হতে হয়। তখন উক্ত অবাধ্য ও পাপাচার শ্রেণীকর্তৃক জুলুমের আস্ফালন রোধ করতে এবং তাদের মূল কাজ, আল্লাহর এবাদতের দিকে ফিরে নিতে বলপ্রয়োগ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। সুতরাং উক্ত উদ্দেশ্যকেই সামনে রেখে আল্লাহ তাআলা জিহাদের বিধান দিয়েছেন।[1]
তাই জিহাদের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে, বান্দাকে মাখলুক (বান্দা) ও কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে বের করে এক আল্লাহর গোলামিতে ফিরিয়ে নেওয়া। -আহম্মিয়্যাতুল জিহাদ: পৃ: ১৫৮ (দারু তায়বাহ)
পারস্য সেনাপতি রুসতুম যখন প্রখ্যাত সাহাবী রিবয়ী বিন আমির রাদি.কে জিজ্ঞাসা করে, তোমরা কী জন্য এসেছ? উত্তরে রিবয়ী রাদি. বলেন,
قال: الله ابتعثنا، والله جاء بنا لنخرج من شاء من عبادة العباد إلى عبادة الله، ومن ضيق الدنيا إلى سعتها، ومن جور الأديان إلى عدل الإسلام، فأرسلنا بدينه إلى خلقه لندعوهم إليه، فمن قبل منا ذلك قبلنا ذلك منه ورجعنا عنه، وتركناه وأرضه يليها دوننا، ومن أبى قاتلناه أبدا، حتى نفضي إلى موعود الله.اهـــ -تاريخ الطبري ط. دار التراث (3/ 520)؛ البداية والنهاية ط. دار الفكر (7/ 39)
“আল্লাহ আমাদেরকে পাঠিয়েছেন এবং তিনিই আমাদেরকে (তোমাদের কাছে) নিয়ে এসেছেন; যাতে আমরা আল্লাহ যার ব্যাপারে চান, তাকে বান্দার দাসত্ব থেকে আল্লাহ গোলামির দিকে; দুনিয়ার সঙ্কীর্ণতা থেকে প্রশস্ততার দিকে এবং ভ্রান্ত ধর্মসমূহের অত্যাচার থেকে ইসলামের আদল ও ইনসাফের দিকে বের করতে পারি। সুতরাং তিনি আমাদেরকে তাঁর দীন দিয়ে তাঁরই বান্দাদের কাছে পাঠিয়েছেন; যাতে আমরা তাদেরকে দীনের প্রতি আহ্বান করি। যে উক্ত দীন গ্রহণ করবে, আমরাও তার থেকে তা গ্রহণ করে ফিরে যাব এবং তার এলাকা ও আশপাশ তার জন্য ছেড়ে যাব। আর যে তা অস্বীকার করবে আমরা আল্লাহর প্রতিশ্রুতিতে পৌঁছা পর্যন্ত সর্বদা তার সাথে যুদ্ধ করে যাব।” –তারীখে তাবারী: ৩/৫২০ (দারুত তুরাস); আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া: ৭/৩৯ (দারুল ফিকর)
উক্ত মৌলিক লক্ষ্যটি তখনই বাস্তবায়ন হবে যখন আল্লাহর দীন বিজয়ী হবে এবং কুফুরের দাপট ভূলুণ্ঠিত হবে। অন্যথায় তা সম্ভব নয়। তাই উক্ত মৌলিক লক্ষ্যকে অন্যভাবে বললে বলা যায়, জিহাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দুইটি— এক. আল্লাহর দীন বিজয় করা। এবং দুই. কুফুরের দাপট ভূলুণ্ঠিত করা। -ফাতহুর কাদীর: ৫/৪২২ (ইলমিয়্যাহ); বেনায়া শরহে হেদায়া: ৭/৯৬ (ইলমিয়্যাহ); তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম: ৩/৬ (দারু ইহয়ায়িত তুরাসিল আরাবী)
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ فَإِنِ انْتَهَوْا فَلَا عُدْوَانَ إِلَّا عَلَى الظَّالِمِينَ -سورة البقرة: 193
“আর তোমরা তাদের (কাফেরদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকো, যতক্ষণ না ফিতনা দূরীভূত হয় এবং দীন একমাত্র আল্লাহর হয়ে যায়। এতে যদি তারা বিরত হয়ে যায়, তাহলে জালিম ছাড়া অন্য কারো প্রতি কোনো কঠোরতা নেই।” –সূরা বাকারা: ১৯৩
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা জিহাদের মৌলিক দুটি লক্ষ্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। একটি হচ্ছে ফিতনা দূরীভূত হওয়া। অর্থাৎ কুফুর ও শিরকের দাপট না থাকা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে দীন একমাত্র আল্লাহ হওয়া। অর্থাৎ পৃথিবীতে একমাত্র আল্লাহর দীন বিজয়ী হওয়া। অন্য কোনো ধর্ম বিজয়ী না থাকা। -তাফসীরে তাবারী: ১৩/৫৩৭ (মুআসসাসাতুর রিসালাহ); আহকামুল কুরআন: ১/৩১৬ (ইলমিয়্যাহ); তাফসীরে ইবনে আতিয়্যাহ: ১/২৬৩ (ইলমিয়্যাহ)
উপর্যুক্ত বিষয়টি মৌলিকভাবে জিহাদের লক্ষ্য হলেও এ ছাড়া আরো কিছু লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে, যা মূলত জিহাদের মূল লক্ষ্য, বান্দা ও কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে বের করে আল্লাহর গোলামির দিকে ফিরিয়ে নেওয়া-এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন—
ক. মুসলিম ভূখণ্ডেরহেফাজতকরা:
ঈমান ও কুফুরের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। তাই কুফুরশক্তি ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য সর্বাবস্থায় বদ্ধপরিকর। সুতরাং এজন্য বিভিন্ন ছুতো ধরে তারা মুসলিম ভূখণ্ডের উপর আক্রমন করতে চাইবে। এমতাবস্থায় মুসলিম ভূখণ্ড হেফাজত করা জিহাদের অন্যতম লক্ষ্য।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَفَسَدَتِ الْأَرْضُ وَلَكِنَّ اللَّهَ ذُو فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِينَ -سورة البقرة: 251
“আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে দুনিয়া বিধ্বস্ত হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ জগতবাসীর প্রতি অনেক দয়ালু।” –সূরা বাকারা: ২৫১
وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ -سورة الحج: 40
“আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে (ধর্মযাজকদের) গির্জা, (খৃস্টানদের) এবাদতখানা, (ইহুদিদের) উপাসনালয় এবং (মুসলিমদের) মসজিদসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যেত; যেগুলাতে অধিকহারে আল্লাহর নাম স্বরণ করা হয়। নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করবেন, যারা আল্লাহকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী শক্তিধর।” –সূরা হজ: ৪০
খ. জুলুম প্রতিহত করা এবং মাজলুমকে সাহায্য করা:
ঈমান ও কুফুরের চিরন্তর দ্বন্দ্ব থেকেই কাফেররা মুসলিমদের উপর নির্যাতন করার সুযোগ পেলে তা হাতছাড়া করবে না। এমতাবস্থায় জুলুম প্রতিহত করে মজলুমকে সাহায্য করাও জিহাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا -سورة النساء: 75
“এবং তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর পথে এবং সেসকল অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশুদের (উদ্ধার করার) পথে যুদ্ধ করছ না; যারা বলছে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে এ জালিম অধিবাসীর জনপদ থেকে বের করে নিন। আর আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একজন অভিভাবক বানিয়ে দিন এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দিন।” –সূরা নিসা: ৭৫
অন্যত্র এরশাদ করেন,
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ آوَوْا وَنَصَرُوا أُولَئِكَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يُهَاجِرُوا مَا لَكُمْ مِنْ وَلَايَتِهِمْ مِنْ شَيْءٍ حَتَّى يُهَاجِرُوا وَإِنِ اسْتَنْصَرُوكُمْ فِي الدِّينِ فَعَلَيْكُمُ النَّصْرُ إِلَّا عَلَى قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ مِيثَاقٌ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ -سورة الأنفال: 72
“যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আপন জান ও মাল দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে এবং যারা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, তারা একে অপরের বন্ধু। আর যারা ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরত করেনি, তারা হিজরত না করা পর্যন্ত তাদের সাথে তোমাদের নূন্যতম বন্ধুত্বের প্রয়োজন নেই। তবে তারা যদি ধর্মীয় ব্যাপারে তোমাদের সাহায্য চায়, তাহলে তাদের সাহায্য করা তোমাদের জন্য আবশ্যক। কিন্তু এমন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যাবে না, যাদের সাথে তোমাদের (যুদ্ধবিরতি) চুক্তি রয়েছে। তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ তা সবই দেখেন।” –সূরা আনফাল: ৭২
গ. দীন, জান, মাল, সম্ভ্রব ও পরিবারের হেফাজত করা:
মানবজাতীর অস্তিত্বের আগে থেকেই এ কথা নির্ধারিত হয়ে আছে, এরা দুনিয়াতে খুনখারাবি করবে; একে অপরের উপর জুলুম করবে। যা আমাদের ব্যাপারে ফেরেশতাগণের অভিমত এবং আল্লাহ তাআলা তা নাকচ না করা থেকে বুঝে আসে।
তাই মানবজাতীর কেউ অপরজন দ্বারা দীন, জান, মাল, সম্ভ্রব, পরিবার—এক কথায় যেকোনো বৈধ অধিকারে জুলুমের শিকার হলে, তা উদ্ধার ও হেফাজতের নিশ্চয়তা দেওয়া জিহাদের অন্যতম লক্ষ্য। এমনকি আক্রমনকারী মুসলিম হলেও তা প্রতিহত করা হবে।
হাদীসে এসেছে,
عَنْ سَعِيدِ بْنِ زَيْدٍ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «مَنْ قُتِلَ دُونَ مَالِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ، وَمَنْ قُتِلَ دُونَ دِينِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ، وَمَنْ قُتِلَ دُونَ دَمِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ، وَمَنْ قُتِلَ دُونَ أَهْلِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ» -رواه الترمذي (1421) وأبو داود (4772) والنسائي (4095). وقال الترمذي رحمه الله: هذا حديث حسن صحيح.اهـــ
“সাঈদ বিন যায়েদ রাদি. বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তার সম্পদের জন্য নিহত হলো সে শহীদ। যে তার দীনের জন্য নিহত হলো সে শহীদ। যে তার রক্তের জন্য নিহত হলো সে শহীদ। যে তার পরিবারের জন্য নিহত হলো সে শহীদ। -জামে’ তিরমিযী: ১৪২১; সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৭২; সুনানে নাসায়ী: ৪০৯৫। ইমাম তিরমিযী রহ. হাদীসটি হাসান সহীহ বলেছেন।
ফকীহগণ এ পর্যন্ত বলেছেন, যদি মুসলিম পিতাও অন্যায়ভাবে আক্রমন করে এবং প্রত্যাঘাত ছাড়া তা প্রতিহত সম্ভব না হয়, তাহলে তা প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে নাশী হামলা বৈধ। -ফাতহুল কাদীর: ৫/৪৩৯ (ইলমিয়্যাহ); রদ্দুল মুহতার: ৪/১৩৩ (দারুল ফিকর)
ঘ. সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করা:
ইসলামের জয়জয়কার দেখলে অথবা দুনিয়াবি কোনো স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে অনেক মুনাফিকচক্র মুসলিম হওয়ার; এমনকি মুসলিম উম্মাহর হিতাকাঙ্ক্ষী হওয়ার দাবি করে বসবে। এমতাবস্থায় সত্যিকার মুমিন ও দাবিদার মুনাফিকের মাঝে পার্থক্য করা; সত্যকে মিথ্যার বেড়াজাল থেকে বের করা এবং মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করা হচ্ছে জিহাদের অন্যতম লক্ষ্য।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَمَا أَصَابَكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ فَبِإِذْنِ اللَّهِ وَلِيَعْلَمَ الْمُؤْمِنِينَ (166) وَلِيَعْلَمَ الَّذِينَ نَافَقُوا وَقِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا قَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوِ ادْفَعُوا قَالُوا لَوْ نَعْلَمُ قِتَالًا لَاتَّبَعْنَاكُمْ هُمْ لِلْكُفْرِ يَوْمَئِذٍ أَقْرَبُ مِنْهُمْ لِلْإِيمَانِ يَقُولُونَ بِأَفْوَاهِهِمْ مَا لَيْسَ فِي قُلُوبِهِمْ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا يَكْتُمُونَ -سورة آل عمران: 166، 167
“উভয় (কাফের ও মুসিলম) দল সামনাসামনি মিলিত হওয়ার দিন (উহুদের দিন) যা তোমাদের উপর আবর্তিত হয়েছে, তা আল্লাহর হুকুমেই হয়েছে। এবং যাতে আল্লাহ যাচাই করতে পারেন, কারা প্রকৃত ঈমানদার এবং যাচাই করতে পারেন, কারা মুনাফিক। (মুনাফিকদের আলামত হচ্ছে) তাদেরকে বলা হলো— এসো, আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করো অথবা (অন্তত) প্রতিহত করো। তারা বলেছিল, আমরা যদি জানতাম যে লড়াই হবে, তাহলে অবশ্যই তোমাদের সাথে থাকতাম। সে দিন তারা ঈমানের তুলনায় কুফরীর বেশি নিকটবর্তী ছিল। তারা মুখে তা বলে যা তাদের অন্তরে নেই। তারা যা কিছু গোপন করে আল্লাহ ভালভাবে জানেন।” -সূরা আলে ইমরান: ১৬৬, ১৬৭
مَا كَانَ اللَّهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ حَتَّى يَمِيزَ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ -سورة آل عمران: 179
“আল্লাহ মুমিনদেরকে তোমাদের অবস্থায় এমনিতে ছেড়ে দিবেন না; যতক্ষণ না নাপাককে পাক থেকে পৃথক করতে পারেন।” -সূরা আলে ইমরান: ১৭৯
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ -سورة محمد: 31
“আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যতক্ষণ না যাচাই করতে পারি তোমাদের মধ্যে কারা মুজাহিদ ও সবরকারী এবং যতক্ষণ না যাচাই করতে পারি তোমাদের অবস্থাসমূহ।” –সূরা মুহাম্মদ: ৩১
ঙ. আল্লাহর সন্তুষ্টি ও শাহাদতের মর্জদা অর্জন:
আল্লাহ তাআলা তাঁর বিশেষ কিছু বান্দাকে বিশেষভাবে ভূষিত করতে চান। এজন্য একটি মাধ্যম তো নবুওত রেখেছেন। কিন্তু উক্ত বিশেষত্বটি অল্প কিছু বান্দা পেয়েছেন এবং তা বান্দার ক্ষমতার ঊর্ধে। তাই আল্লাহ তাআলা সাধারণ বান্দাদের জন্য নবুওয়তের চেয়ে নিচের স্থরে এবং বান্দার সামর্থের ভিতরে আরেকটি বিষয় রেখেছেন। আর তা হচ্ছে, তাঁর রাস্তায় শাহাদত বরণ করা।
তাই জিহাদের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, শাহাদতের চূড়ায় চড়ে আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ স্তরটি অর্জন করা।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنْكُمْ شُهَدَاءَ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ -سورة آل عمران: 140
“(এভাবে যুদ্ধে সাময়িক পরাজয় দেন) যাতে আল্লাহ জানতে পারেন কারা প্রকৃত ঈমানদার এবং যাতে তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন। আর আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না।” –সূরা আলে ইমরান: ১৪০
হাদীসে এসেছে,
عَنِ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْلاَ أَنَّ رِجَالًا مِنَ المُؤْمِنِينَ لاَ تَطِيبُ أَنْفُسُهُمْ أَنْ يَتَخَلَّفُوا عَنِّي، وَلاَ أَجِدُ مَا أَحْمِلُهُمْ عَلَيْهِ مَا تَخَلَّفْتُ عَنْ سَرِيَّةٍ تَغْزُو فِي سَبِيلِ اللَّهِ، وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوَدِدْتُ أَنِّي أُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ، ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ، ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ» -رواه البخاري (2797)
“আবু হুরায়রা রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার জান! যদি এমন মুমিন না থাকত, যারা আমার সাথে জিহাদ করা থেকে পিছনে থাকতে পছন্দ করবে না এবং আমিও তাদেরকে আরোহি দিতে পারি না, তাহলে আমি আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বের হওয়া কোনো সৈন্যদল থেকে পিছিয়ে থাকতাম না। সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার জান! আমি অবশ্যই পছন্দ করি, যেন আমি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হই। আবার জীবিত হয়ে পুনরায় শহীদ হই। আবার জীবিত হয়ে পুনরায় শহীদ হই। আবার জীবিত হয়ে আবার শহীদ হই।” –সহীহ বুখারী: ২৭৯৭
উপর্যুক্ত সব কয়টির প্রতি লক্ষ্য করলে একটি বিষয় স্পষ্ট দেখা যাবে— কোনো বান্দার দাসত্ব বা কুপ্রবৃত্তির প্ররোচনায় আল্লাহ বিধিনিষেধ অমান্য করা হয়েছে। তাই তাদেরকে আল্লাহ দিকে ফিরিয়ে নিতেই জিহাদের বিধান। উক্ত বিষয়সমূহ ছাড়া আরো কিছু লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে, যা মূলত প্রথমোক্ত বিষয় দুটির অন্তর্ভুক্ত।
[1] এখানে এ সংশয় করার সুযোগ নেই যে, “ইসলাম কোনো ব্যক্তিকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করে না”। কেননা, মানুষকে আল্লাহর এবাদতের দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে জিহাদ করা মানে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হবে, এমনটা জরুরি নয়। বরং জিহাদ শুরু করার আগে কাফেরদেরকে ইসলাম গ্রহণ, যিম্মাচু্ক্তিতে সম্মত হওয়া অথবা লড়াইয়ের পথ বেছে নেওয়া—এ তিনটি সুযোগ দেওয়া হবে। ইসলাম গ্রহণ না করলে নির্দিষ্ট শর্তে যিম্মাচুক্তিতে সম্মত হলে ভালো। অন্যথায় লড়াইয়ের মাধ্যমে সমাধান হবে। আর যিম্মী বানানোর মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে, ইসলামী বিধিবিধানের অধিনে বসবাস করে ইসলামের সুন্দর্য দেখে যাতে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তা গ্রহণ করতে পারে। অন্যথায় শুধু বস্তুগত কিছু ফায়দা হাসিল করা যিম্মাচুক্তির লক্ষ্য নয়। তাই যিম্মাচুক্তিও পরোক্ষভাবে ইসলামের দিকে দাওয়াতের মাধ্যম হলো।