Announcement

Collapse
No announcement yet.

মুসলিম বিশ্ব ও শারিয়াহ'র উপনিবেশীকরণ (ভূমিকা পর্ব)

Collapse
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • মুসলিম বিশ্ব ও শারিয়াহ'র উপনিবেশীকরণ (ভূমিকা পর্ব)

    ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর দ্বারা মুসলিম বিশ্বের উপনিবেশীকরণ এবং শারিয়াহর উপর তাদের হস্তক্ষেপ একটি দীর্ঘ ও পরিকল্পিত প্রক্রিয়া, যার শিকড় ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত। এই প্রক্রিয়াটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও ভূখণ্ডগত দখলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এটি ছিল এক বৃহত্তর সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপনিবেশনের অংশ, যার লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা, আইন, জীবনব্যবস্থা এবং আত্মপরিচয়কে ধ্বংস বা পরিবর্তন করে ফেলা।

    মুসলিম বিশ্ব শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শারিয়াহর ভিত্তিতে পরিচালিত হতো। এই শারিয়াহ ছিল কেবল ধর্মীয় অনুশাসন নয়, বরং এটি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একটি ঈমানী কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত করত। বিচারব্যবস্থা, সম্পত্তির অধিকার, বাণিজ্যিক নীতি, যুদ্ধ ও শান্তির বিধান, এমনকি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও শারিয়াহর স্পষ্ট দিকনির্দেশনা ছিল। এই প্রেক্ষাপটে উপনিবেশকারীরা যখন মুসলিম বিশ্বে প্রবেশ করে, তারা সরাসরি শারিয়াহর সঙ্গে সংঘাতে যায়নি; বরং তারা ধূর্ততার সাথে আইন ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ইউরোপীয় আইন ঢুকিয়ে শারিয়াহর প্রভাব ও প্রয়োগকে ধীরে ধীরে সংকুচিত করে তোলে।

    উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে ‘আঙ্গিক আইন’ (Anglo-Muhammadan Law) প্রণয়ন করে। তারা ফিকহের নির্দিষ্ট অংশকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে, নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে এবং বিচারকদের নির্দেশ দেয় যে তারা এই সংস্কৃত ফিকহই প্রয়োগ করবেন। এতে শারিয়াহর দার্শনিক ভিত্তি ও প্রেক্ষাপট হারিয়ে যেতে থাকে। একইভাবে, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত আইন ছাড়া অপরাধবিধি, বাণিজ্য আইন, প্রমাণ বিধি ইত্যাদি সবকিছুতেই ইউরোপীয় আইনকে প্রাধান্য দেয়া হয়।

    এটি ছিল একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কৌশল, যাতে মুসলমানরা ধীরে ধীরে শারিয়াহ থেকে দূরে সরে যায় এবং পশ্চিমা মূল্যবোধকে গ্রহণ করে। এই কৌশলের সঙ্গে আরও একটি বিষয় জড়িত ছিল—শিক্ষা। উপনিবেশকারীরা ধীরে ধীরে মাদরাসাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে সেক্যুলার শিক্ষার বিস্তার ঘটায়। ধর্মীয় জ্ঞানকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ এবং ‘অবৈজ্ঞানিক’ আখ্যা দিয়ে পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ ও বস্তুবাদভিত্তিক চিন্তার বিস্তার ঘটানো হয়। ফলে পরবর্তী প্রজন্ম নিজেদের ধর্মীয় ও আইনগত ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞ বা উদাসীন হয়ে পড়ে।

    এই প্রক্রিয়া মুসলিম সমাজে বিভক্তির জন্ম দেয়। একদল শিক্ষিত মুসলমান ইউরোপীয় আইন ও সংস্কৃতির অনুসরণে নিজেদের আধুনিক ও প্রগতিশীল মনে করে, যারা শারিয়াহকে কেবল ব্যক্তিগত ধর্মীয় আচারের মধ্যে সীমিত দেখতে চায়। অন্যদিকে, ধর্মীয়ভাবে সচেতন মুসলমানরা এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা উপনিবেশিক প্রভাবের বিপরীতে ইসলামী জীবনব্যবস্থার পূনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। এই প্রতিক্রিয়াই পরবর্তীতে বিভিন্ন ইসলামপন্থী আন্দোলনের জন্ম দেয়, যেমন দারুল উলুম দেওবন্দ, জামায়াতে ইসলামি বা মুসলিম ব্রাদারহুড, যারা ইসলামী আইনের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগের আহ্বান জানায়।

    উপনিবেশিক শক্তিগুলোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল ছিল ধর্মীয় কর্তৃত্বের পুনর্গঠন। তারা স্থানীয় উলামা ও মুফতিদের ক্ষমতা সীমিত করে নিজেদের প্রশিক্ষিত 'মুসলিম আইনবিদ' তৈরি করে, যারা মূলত ব্রিটিশ বা ফরাসি প্রশাসনের আনুগত্যে ছিল। এর মাধ্যমে তারা একধরনের 'কলোনিয়াল ইসলামিক অথরিটি' তৈরি করে, যা শারিয়াহকে একটি আত্মবিচ্ছিন্ন, প্রাসঙ্গিকতাবিহীন এবং শুধুই ঐতিহ্যগত আইনি কাঠামোতে রূপান্তর করে।

    এখনো বহু মুসলিম দেশে এই উপনিবেশিক আইন ও কাঠামো বজায় রয়েছে। সৌদি আরবের মতো কিছু রাষ্ট্র যদিও শারিয়াহকে রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে প্রয়োগ করে, তবুও সেখানে উপনিবেশিক প্রভাব পুরোপুরি দূর হয়নি। আর অধিকাংশ মুসলিম দেশেই একটি সংকর ব্যবস্থা বিদ্যমান, যেখানে ফরাসি বা ব্রিটিশ বেসামরিক আইন এবং কিছু ধর্মীয় আইন পাশাপাশি চলে।

    এই প্রক্রিয়া বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন রূপে বাস্তবায়িত হয়। ভারতবর্ষে ব্রিটিশরা শারিয়াহর বিচারব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে পেছনের সারিতে ঠেলে দেয় এবং নিজেদের গঠিত 'আঙ্গ্ল-মোহাম্মদান' আইনের মাধ্যমে ইসলামি ফিকহকে বিকৃত করে। একই সময়ে ইন্দোনেশিয়ায় ডাচরা ইসলামি নেতৃত্বকে তাদের প্রশাসনের অংশ করে একটি নিয়ন্ত্রিত ধর্মীয় কাঠামো তৈরি করে, যাতে ইসলামী আইন ব্যহত হলেও প্রতিরোধের মুখে না পড়তে হয়। অন্যদিকে, ওসমানি খেলাফত ইউরোপীয় চাপে ও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতায় নিজের আইনব্যবস্থায় সংস্কারের নামে সেক্যুলার কোড ঢুকিয়ে ফেলে। মিশরে আধুনিকতা ও উন্নয়নের অজুহাতে আলী পরিবার একটি পাশ্চাত্যিক রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে এবং ইসলামি আইনের বিস্তার রোধ করে। ইরানেও একই চিত্র দেখা যায়, যেখানে কাজিকানুন ও পশ্চিমা অনুকরণে গঠিত পার্লামেন্ট শারিয়াহর স্থানে বসে।

    এই সব ঘটনাই আলাদা আলাদা মনে হলেও, একটি অভিন্ন সূত্রে বাঁধা: ইউরোপীয় আধিপত্য শুধু ভূখণ্ড নয়, মুসলিম চেতনাকেও জয় করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয়কে একটি ব্যক্তিগত অনুশাসনে রূপান্তরিত করতে, যাতে মুসলমানদের রাষ্ট্রভিত্তিক চিন্তা, আইনি কাঠামো ও সামাজিক সংগঠন আর আল্লাহর বিধানের ওপর নির্ভর না করে বরং ইউরোপীয় ধারণাগুলোর অনুসারী হয়ে ওঠে।

    এই বাস্তবতাকে বোঝা এবং বিশ্লেষণ করা আমাদের জন্য শুধু ঐতিহাসিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি বর্তমান মুসলিম বিশ্বের আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য। আজ আমরা যদি দেখি যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো শারিয়াহ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত, ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা করে দেখে, অথবা পশ্চিমা আইন ও মানবাধিকার ধারণাকে প্রাধান্য দেয়, তাহলে বুঝতে হবে এই ধারা হঠাৎ করে আসেনি; এটি উপনিবেশিক যুগেরই এক গভীর উত্তরাধিকার।

    এই আলোচনাকে সুস্পষ্ট ও গভীরভাবে অনুধাবনের জন্য আমরা ইনশা আল্লাহ পুরো বিষয়বস্তুকে পাঁচটি ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক ভাগে বিশ্লেষণ করব:

    ১. ভারতে ব্রিটিশ শাসন ও ইসলামী আইনব্যবস্থার পরিণতি – এখানে আমরা দেখব কীভাবে ব্রিটিশরা ইসলামি আইন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে এক বিকৃত ও নিয়ন্ত্রিত আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে, যা আজও উপমহাদেশের মুসলমানদের শিকলে বেঁধে রেখেছে।

    ২. ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ উপনিবেশবাদ ও ইসলামী চেতনার অবক্ষয় – এ পর্বে আমরা দেখব কীভাবে ডাচরা একধরনের 'সহনশীল উপনিবেশবাদ' চালু করে, যেখানে ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে দুর্বল করে সামাজিকভাবে নিরস্ত করে ফেলা হয়।

    ৩. চাপে পড়া উসমানি খেলাফত ও শারিয়াহর পশ্চাৎপসরণ – এখানে আমরা বিশ্লেষণ করব ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ এবং অভ্যন্তরীণ সংস্কারপন্থীদের চাপে ওসমানি খিলাফত কীভাবে ইসলামী আইনব্যবস্থার পরিবর্তে পশ্চিমা আইন গ্রহণ করে, যা একসময় খেলাফতের পতনের পথ প্রশস্ত করে।

    ৪. মিশরের আধুনিকতার যাত্রা ও ইসলামী আইনব্যবস্থার সংকোচন– মিশরে আমরা দেখব আধুনিকতার নামে কীভাবে ইসলামি আইনি ও ধর্মীয় কাঠামো ধ্বংস করা হয়, এবং তার বিপরীতে কী ধরনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়।

    ৫. ইরানে সংস্কারের নামে ধর্মনিরপেক্ষতার অনুপ্রবেশ – ইরানে শারিয়াহর কাঠামো কীভাবে রাজতন্ত্র, সাংবিধানিক আন্দোলন এবং পশ্চিমাপন্থী সংস্কারনীতির চাপে বারবার বিতাড়িত হয়, তা হবে এই পর্বের আলোচ্য বিষয়।

    এই বাস্তবতা থেকে মুক্তির জন্য শুধু শারীরিক স্বাধীনতা যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন চিন্তার মুক্তি, আত্মপরিচয়ের পুনরুদ্ধার এবং একটি ঈমানভিত্তিক জ্ঞানের ভিত্তি নির্মাণ। শারিয়াহ যদি আল্লাহর বিধান হিসেবে মুসলমানদের জন্য নাযিল হয়ে থাকে, তাহলে সেটি কেবল ঐতিহ্যের স্মারক নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক হিসেবেও প্রাসঙ্গিক। উপনিবেশিক ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আইনের উপর আধিপত্য, মূলত চিন্তার উপর আধিপত্য কায়েম করার একটি হাতিয়ার। সুতরাং, যদি আমরা সত্যিকার অর্থেই স্বাধীনতা চাই, তবে আমাদের উচিত শারিয়াহর আসল রূপ ও মূল্যবোধকে বুঝে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে আসা।

    উৎস ও সহায়ক গ্রন্থ:
    -
    Impossible State
    by: Wael B. Hallaq
Working...
X