শহীদ তিতুমীর রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর সমকালীন জমিদার এবং তালুকদার শ্রেণীর লোকদের অত্যাচার এবং জুলুমের বিবরণ আমরা মোটামুটি সবাই জানি। কিন্ত এরপরে হিন্দু জমিদার এবং বৃটিশ গভমেন্টকে তিতুমীর যে পালটা জবাব দিয়েছিলেন তার অনেক কিছুই আমরা জানি না। না জানার একটা কারণ থাকতে পারে আমাদের পাঠ্যবইতে এই বিষয়কে অত সিরিয়াস হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি। আর যেহেতু পরবর্তীতে নির্দিষ্ট একটা শ্রেণীর লোকদের দ্বারা ইতিহাস রচিত হয়েছে তাই তারা তিতুমীরের অনেক আদর্শের সাথেই দ্বিমত পোষণ করতেন। যেকারণে তাদের লেখায় তিতুমীরের ইতিহাসকে অনেক কমই গ্লোরিফাই হয়েছে। এমনকি বাঁশের কেল্লার পতনের পরেও তৎকালীন সময়ে স্থানীয় বাংলা এবং হিন্দি পত্রিকাগুলোতে তিতুমীরকে নিয়ে খুব সমালোচনা করে খবর ছাপানো হয়েছিল । কিন্ত Sociological Researchl Unit, Indian Statistical Institute এর অতিশ দাশগুপ্তের তিতুমীরকে নিয়ে লেখা Titu Meer's Rebellion: A Profile শিরোনামের চমৎকার একটি প্রবন্ধ সাম্প্রতিক সময়ে আমার পড়ার সুযোগ হয় । এই প্রবন্ধে আমি তিতুমীরকে নিয়ে যা জানতে পারি তা আমার আগে কখনো জানা ছিল না। আমি প্রবন্ধের নির্দিষ্ট অংশ পাঠকের সুবিধার্থে বিশেষ করে তিতুমীরের দল গঠন করার পরবর্তী সময়ের ঘটনা সমূহ নাম্বারিং দিয়ে নিচে উল্লেখ করছি।
(১) তিতুমীর গরীব কৃষক শ্রেনীর লোকদের নিয়ে যে দল গঠন করে জমিদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন সেই দল গঠন করার জন্য বা যুদ্ধ করার জন্য আশ্চর্য হলেও সত্য তিনি নির্দিষ্ট কোন আলেম থেকে পরামর্শ বা উৎসাহ এবং তৎকালীন মুসলিম জমিদারদের থেকে কোন অর্থ সাহায্য নেন নি।
(২) তিনি তাঁর দল গঠনের পরে দলের লোকদের নিয়ে হায়দ্রাপুর থেকে নারিকেলবাড়িয়াতে চলে যান। এবং দলের লোকদের নিয়ে মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তৎকালীন সময়ে হাতের তৈরি যে বর্শা, তরবাড়ি, লাঠি যে অস্ত্র সহজল্ভ্য ছিল তা দিয়েই তিতুমীর তার অনুসারীদের প্রশিক্ষন দেওয়া আরম্ভ করেন।
(৩) ১৮৩০ সালের অক্টোবর মাসে তিতুমীর নিম্নোক্ত ঘোষণা দেন।
“ জনগণ ! বৃটিশদের সময় সমাপ্ত। এবং রাষ্ট্রের আসল মালিক এখন মুসলিমরাই কেননা মুসলিমদের থেকেই তারা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল।"
এরপর তিনি ঘোষণা দেন যে আশপাশে যত জমিদার আছে তাদের সকলে এখন থেকে আর বৃটিশের ট্রেজারিতে লভ্যাংশ জমা দিতে পারবে না এবং লভ্যাংশের পুরোটাই তাঁর নিকট জমা দিতে হবে। এর অন্যথা হলে চরম পর্যায়ের শাস্তিভোগ করতে হবে।
(৪) ১৪ অক্টোবর, ১৮৩০ সালে তিতুমীরের বাহিনী খাসপুরের একজন মুসলিম জমিদারের সম্পদ লুট করে। কেননা তিনি তিতুমীরের উপরোক্ত ঘোষণাকে অমান্য করেছিল।
(৫) এমনকি তিতুমীর তাঁর অধীনে থাকা দলের লোকদের মধ্যে কড়াভাবে ঘোষণা করে দেন , যে সব জমিদারেরা তাঁর আন্দোলনের বিরুদ্ধে যাবে তাদেরকে কোন প্রকার ভাড়া পরিশোধ করা যাবে না আর অবৈধ ট্যাক্স দেওয়ার প্রশ্নই তো আসে না।
(৬) স্থানীয় পুলিশ বাহিনী অকার্যকর হয়ে পড়ে। তাই কিছু জমিদার এবং তালুকদার বাধ্য হয়ে কলকাতা পালিয়ে যায়।
(৭) এরপর তিতুমীর তাঁর পুরাতন শত্রু জমিদার কৃষ্ণদেবের দিকে নজর দেন। ১৮৩০ সালের ৩১ অক্টোবর তিতুমীর তিনশ জনের এক বাহিনী নিয়ে শরফারাজপুরে কৃষ্ণদেবের বাড়ি ঘেরাও করে। এবং আশপাশের মার্কেট দোকানে লুট করে। পাশাপাশি যারা টাকা পয়সা লেনদেনের ব্যাপারে অসুদাপয় অবলম্বন করত এদের ব্যবসা প্রতিষ্টানে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে কয়েকজন হলঃ লক্ষন দেব, মোহন সাহা, গোলক সাহা এবং অন্যান্যরা।
(৮) চার মাস পূর্বে জমিদার কৃষ্ণদেব একটি মসজিদ ধ্বংস করেছিল এর জবাবে তিতুমীরের বাহিনী স্থানীয় একটি মন্দিরের সামনে একটি গরুকে জবাই করে।
(৯) তিতুমীরের বাহিনীর এরকম অপারেশনের ভয়ে চব্বিশ পরগনা এবং নদিয়ার জমিদারেরা একত্রিত হয় এবং কিভাবে তিতুমীরকে পরাস্ত করা যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা আরম্ভ শুরু করে। এছাড়া নীল রোপনের জন্য যেসব লোক স্থানীয়দেরকে বাধ্য করত তারাও বুঝতে পারে যে তারা তিতুমীরের পরবর্তী টার্গেট হতে যাচ্ছে। এজন্য তারাও জমিদারদের সাথে একত্রিত হয়।
(১০) হাবড়া-গোবরডাঙ্গার জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখার্জী এই জমিদারদের নেতৃত্ব দেন। তিনি তিতুমীরকে কোন লভ্যাংশ পাঠাতে অস্বীকার করেন। পাশাপাশি প্রজাদের উপর যে অবৈধ করারোপ করা হয়েছিল তাও তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানান।
(১১) তিতুমীর কালীপ্রসন্নের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। সে তাঁর বাহিনী নিয়ে গোবরডাঙ্গার দিকে রওয়ানা করে। ডেভিস যে মোল্লাহটিতে নীল চাষ নিয়ন্ত্রন করত সে তৎক্ষণাৎ এই খবর শুনতে পেয়ে ২০০ জন অস্ত্রসহ বাহিনী দিয়ে কালীপ্রসন্নের নিকটে সাহায্যের জন্য পাঠান। কিন্ত ডেভিসের নিজেকেই তিতুমীর বাহিনীর হাত থেকে খুব কষ্ট করে জীবন নিয়ে পালাতে হয়। সে কোনক্রমে বেঁচে গোবড়া গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রয়ের নিকট গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়।
(১২) কালীপ্রসন্ন আর ডেভিসের বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করার পর তিতুমীর গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ কে শাস্তি দেওয়ার জন্য রওয়ানা করে। লৌঘাটিতে গিয়ে তিতুমীরের বাহিনীর সাথে দেবনাথের বাহিনীর যুদ্ধ বাধে। তুমুল সংঘর্ষে দেবনাথের বাহিনী পরাজিত হয় এবং দেবনাথ কে হত্যা করা হয়।
(১৩) এবার তিতুমীর নীলকরদের দিকে নজর দেয়। সে চব্বিশ পরগনার বারাশাত এবং বারিশাতের নীলকরদের যত নীল চাষের জমি আছে তা ধংস করে । এ সংক্রান্ত যত দলিলাদি আছে তা সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ কাজগুলো কৃষকেরাই মূলত করে যাতে করে তাদের চরামূল্যে সুদের লেনদেনের কোন রেকর্ডের অস্তিত্ব যেন আর না পাওয়া যায়।
(১৪) ১৮৩০ সালের নভেম্বরের শুরুতে জমিদার এবং নীলকররা সামগ্রিকভাবে মানুষের উপর থেকে তাদের প্রভাব হারায়। আট নভেম্বর থেকে ১৫ ই নভেম্বর পর্যন্ত তিতুমীরের দলে লোক আরো বাড়তে থাকে।
(১৫) নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় হতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রেসিডেন্সি ডিভিসনের নিকট তিতুমীরের ব্যাপারে খবর পৌছানো শুরু হয়। এবং তিতুমীরের আওতাধীন এলাকাগুলোতে সরকারি কর্মকর্তারা যে আক্রান্ত হয়েছে সেটাও তাদের নজরে আসে। এছাড়া ডেভিস এবং স্টর্মের মত ইউরোপিয়ান নীল করেরাও ইস্ট ইন্ডিয়ার নিকট খবর পৌছায়।
(১৬) কমিশনার চব্বিশ পরগনা এবং নদিয়ার মেজিস্ট্রেট কে অতিদ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করার হুকুম করে। ১৮৩০ সালের পনেরই নভেম্বর বারাসাতের জয়েন্ট মেজিস্ট্রেট আলেক্সান্ডার এবং বাদুড়িয়া থানার কর্মকর্তা ১২০ জনের এক পুলিশ বাহিনী নিয়ে নারিকেলবাড়িয়ার মৌজাতে প্রবেশ করে।
(১৭) এই বাহিনীর আগমনের ব্যাপারে তিতুমীর আগেই জেনে ফেলেছিল। সে পাঁচশ জন কৃষক এবং লাঠিয়ালের এক বাহিনী তাদের মোকাবেলার জন্য পাঠান। এদের নেতৃত্ব দেন তিতুমীরের ভাতিজা গোলাম মাসুম। যিনি পুলিশ বাহিনীকে তৎক্ষণাৎভাবে পরাজিত করেন। জয়েন্ট মেজিস্ট্রেট কোনক্রমে নদিয়ার পাশের গ্রামে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করেন। এ সংঘর্ষের কারণে বাদুড়িয়া থানার ঘৃণিত পুলিশ কর্মকর্তা রামরাম চক্রবর্তী মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া একজন জমিদার , দশজন কনস্টেবল , এবং তিনজন বরকন্দাজ মৃত্যুবরণ করে।
(১৮) এই সফলতার পর তিতুমীর নিজেকে মোঘল শাসকদের ন্যায় 'বাদশাহ' ঘোষণা করে। রুদ্রপুরের মাইনুদ্দীন কে উযীর নিয়োগ করেন। মাইনুদ্দীন বংশীয়ভাবে জোলা বংশের লোক ছিলেন। তিতুমীর তাঁর ভাতিজা গোলাম মাসুম কে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দান করেন। আট হাজারের মত অনুসারী নারিকেলবাড়িয়া এবং এর আশপাশ থেকে এসে যাদের মধ্যে হিন্দু এবং মুসলিম উভয় ধর্মের লোকই ছিল তারা তিতুমীরের দলে যোগদান করে। বারাসাতের নির্দিষ্ট এলাকাতে তিতুমীর এদের নিয়ে নিজস্ব রাজ্য প্রতিষ্টা করেন। এই 'স্বাধীন' এলাকাতে তিতুমীর প্রায় এক বছরের মত রাষ্ট্রের মত পরিচালনা করেন। স্থানীয় জমিদারেরা হয় তিতুমীরের কাছে নত স্বীকার করতে হত আর নয়তো তাদের সম্পত্তি রেখে চলে যেতে হত। তিতুমীরের অনুসারিরাই ট্যাক্স নেওয়া আরম্ভ করল, এবং তারা বিচারকার্য সহ অন্যান্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করল।
(১৯) এরকমভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য কিরকম মূল্য দেওয়া লাগতে পারে এটা তিতুমীর পূর্বেই আঁচ করতে পারে। তিনি বুঝতে পারেন অতি শীঘ্রই ইস্ট ইন্ডিয়ার বাহিনীর সাথে তাদের মোকাবেলা হতে যাচ্ছে। এজন্য নারিকেলবাড়িয়াকে সুরক্ষিত রাখার জন্য তিনি বাঁশের কেল্লা বানানো শুরু করেন। এবং তিনি তাঁর বাহিনীকে নিয়ে অসম্ভব দ্রুততার সাথে বাঁশের কেল্লা তৈরি করে ফেলেন।
(২০) কিন্ত জমিদার এবং নীলকরেরাও বসে ছিল না। চব্বিশ পরগনা, নদিয়া এবং যশোরের জমিদারগণ লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সাথে দেখা করেন এবং তাকে তারা সরাসরি অস্ত্র নিয়ে হামলা করার জন্য আহ্বান করেন। বেন্টিঙ্ক তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে নদিয়ার ডিস্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট স্মিথকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পুলিশ বাহিনী এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করার জন্য আদেশ দেন।
(২১) ১৮৩১ সালের ১৭ ই নভেম্বর সকালে স্মিথ নীলকর ডেভিড অ্যান্ড্রু এবং আরো চারজন ডিস্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট মিলে নারিকেলবাড়িয়ার দিকে রওয়ানা করে এবং তাদের সামনে থাকে তিনশ জনের অস্ত্রসহ এক পুলিশ বাহিনী। জমিদারেরা অনেক লোক এবং হাতি দিয়ে স্মিথের বাহিনীকে সহায়তা করে।
(২২) গোলাম মাসুম, যিনি তিতুমীরের প্রধান সেনাপতি তিনি পূর্বেই স্মিথের বাহিনীর আগমন জানতে পারেন। স্মিথের বাহিনী নারিকেলবাড়িয়া আসার পূর্বেই সে পনেরশ জনের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বারঘরের দিকে রওয়ানা শুরু করে। বারঘরের অবস্থান নারিকেলবাড়িয়া থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে । দুই বাহিনী মুখোমুখি হলে স্মিথের বাহিনী তুমুল গুলি বর্ষন আরম্ভ করে। কিন্ত এগুলো তিতুমীরের বাহিনীর উপর কোন রকম প্রভাব ফেলতে পারে না। তিতুমীরের বাহিনীর লোকবলের নিকট স্মিথের বাহিনী অতি দ্রুত পরাজিত বরন করে। তিতুমীর বাহিনীর স্থানীয় অস্ত্রসস্ত্রের নিকট আধুনিক অস্ত্র বেকার হয়ে বসে। ইংলিশ অফিসারেরা ইছামতি নদী পার হয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে।
(২৩) ১৭ই নভেম্বর ১৮৩১ সালে পরাজিত হওয়ার পর স্মিথ গভর্নর জেনারেলের কাছে চিঠি পাঠায়। চিঠিতে তিনি বলেন,
“ আমি এই বিস্ময়কর মানুষদের মধ্যে যে পরিমাণ উৎসাহ, সংকল্প এবং উগ্রতা দেখতে পেলাম যাদের সংখ্যা সব মিলিয়ে পনেরশোর বেশি হবে না। আমি এ ব্যাপারে কোন দ্বিধা করছি না বলতে যে, এদেরকে পরাজিত করতে হলে গভমেন্টের অবশ্য এবং অতিশীঘ্র সাহায্য পাঠাতে হবে।"
(২৪) এই চিঠির পর লর্ড বেন্টিংক আসল অবস্থার ব্যাপারে আঁচ পায়। নভেম্বরের আঠারো তারিখে মেজর স্কটের অধীনে পুরোদস্তুর একটি মিলিটারি বাহিনী পাঠানো হয়। এবং এ বাহিনীতে আরো ছিলেন লেফট্যানান্ট শেক্সপিয়র, ক্যাপ্টেন সাদারল্যান্ড । তারা একটি অশ্বারোহী বাহিনী এবং একটি পদাতিক বাহিনীর সমন্বয়ে তিনশজনের একটি বাহিনী পরিচালনা করেন। এবং এই বাহিনীতে দুটো কামানও ছিল। একমাত্র সিভিলিয়ান অফিসার হিসেবে ছিল আলেক্সান্ডার যিনি বারাসাতের মেজিস্ট্রেট ছিলেন। নভেম্বরের আঠারো তারিখের মধ্যাহ্ন নাগাদ তারা নারিকেলবাড়িয়াতে পৌছাল। এবং তারা বাঁশের কেল্লা চারিদিক থেকে ঘিরে রাখল। ইতোমধ্যেই অবশ্যই তিতুমীরের দলের বেশিরভাগ লোকই ফেরত চলে এসে তারা নিজ নিজ স্থানে অস্ত্র নিয়ে প্রস্তত থাকল। সেদিন আর বেশি কিছু হয় নি।
(২৫) ঐতিহাসিক যুদ্ধ শুরু হয় নভেম্বরের উনিশ তারিখ সকালে। বৃটিশ বাহিনীর তিন ঘন্টা টানা কামান এবং গুলি বর্ষণের মধ্যেও তিতুমীরের বাহিনী তাদের লাঠি, বল্লম , তীর ধনুক এবং মাসকেট বন্দুকের সাহায্যে সাহসীকতার সাথে প্রতিরোধ করে । তিতুমীর আহত হয় কিন্ত তারপরেও তাঁর অনুসারীদের কে শেষ সময় পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ প্রদান করতে থাকে। কিন্ত অবশেষে কামানের একের পর এক গোলার আঘাত সহ্য করতে না পেরে বাঁশের কেল্লা ভেঙ্গে পড়তে আরম্ভ করে।
(২৬) ইংলিশ আর্মি ভিতরে প্রবেশ করে এবং তিতুমীর কে তারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাঁর পঞ্চাশজন কমরেড কে হত্যা করা হয়। তিতুমীরের লাশ শহীদ হিসেবে তাঁর অনুসারীরা গ্রহণ করতে পারে এই ভয়ে আলেক্সান্ডার তিতুমীরের লাশ কে পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।
(২৭) প্রায় আটশ জন বিদ্রোহীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদেরকে আলীপুর কোর্টে পাঠানো হয়। ১৪০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তি প্রদান করা হয়। কিন্ত গোলাম মাসুম যিনি তিতুমীরের প্রধান সেনাপতি ছিলেন তাকে ধ্বংস্প্রাপ্ত বাঁশের কেল্লার সামনে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় এবং সেখানে অন্যান্য বিদ্রোহীদের ভবিষ্যত শিক্ষার জন্য লাশটিকে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
তিতুমীর (রহঃ), হাজী শরীয়তউল্লাহ (রহঃ) এবং তাঁর ছেলে দুদু মিয়া (রহঃ) এদেরকে বাদ দিলে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে সত্যিকারার্থেই বাঙ্গালী (মুসলিম) সমাজের কোন অবস্থান নেই। এবং এ আন্দোলনগুলো স্পষ্ট করে বললে যে আঙ্গিকেই দেখা হোক না কেন, এগুলো চরমভাবে (ইসলাম) ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। যেহেতু তৎকালীন সময়ে এলিট সমাজের প্রতিনিধিত্ব করত সরাসরি হিন্দু জমিদার এবং তাদের অনুগত সভাসদের বুদ্ধিজীবিরা তারা কখনোই মুসলিমদেরকে আপন মনে করে কাছে টানতে পারে নি। কিন্ত তিতুমীরের আন্দোলন এবং যুদ্ধ এগুলো যতই ধর্মকেন্দ্রিক হোক না কেন তা সমস্ত মজলুমদেরকে একত্রিত করার জন্য অন্যতম সহায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তিতুমীর কে নিয়ে প্রথম বাংলা বই লেখা হয় ১৮৯৭ সালে। বইয়ের লেখক ছিলেন বিহারীলাল সরকার। তিতুমীরকে নিয়ে লেখা বই কিন্ত এই বইতে তিনি স্পষ্ট করে হিন্দু জমিদার এবং ইংরেজদের পক্ষে খোলাখুলিভাবে সাফাই গায়। তাই তিতুমীরকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে লেখা বইগুলো তিতুমীরকে বাস্তবভাবে তুলে ধরতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়। তারপরেও প্রবন্ধের লেখক অনেক যাচাই বাছাই করে নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রবন্ধটি নিবন্ধিত করেন।
তথ্যসমূহ ১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসের Social Scientist জার্নালের ৪২-৪৫ পৃষ্টাতে স্থান পেয়েছে।
(১) তিতুমীর গরীব কৃষক শ্রেনীর লোকদের নিয়ে যে দল গঠন করে জমিদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন সেই দল গঠন করার জন্য বা যুদ্ধ করার জন্য আশ্চর্য হলেও সত্য তিনি নির্দিষ্ট কোন আলেম থেকে পরামর্শ বা উৎসাহ এবং তৎকালীন মুসলিম জমিদারদের থেকে কোন অর্থ সাহায্য নেন নি।
(২) তিনি তাঁর দল গঠনের পরে দলের লোকদের নিয়ে হায়দ্রাপুর থেকে নারিকেলবাড়িয়াতে চলে যান। এবং দলের লোকদের নিয়ে মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তৎকালীন সময়ে হাতের তৈরি যে বর্শা, তরবাড়ি, লাঠি যে অস্ত্র সহজল্ভ্য ছিল তা দিয়েই তিতুমীর তার অনুসারীদের প্রশিক্ষন দেওয়া আরম্ভ করেন।
(৩) ১৮৩০ সালের অক্টোবর মাসে তিতুমীর নিম্নোক্ত ঘোষণা দেন।
“ জনগণ ! বৃটিশদের সময় সমাপ্ত। এবং রাষ্ট্রের আসল মালিক এখন মুসলিমরাই কেননা মুসলিমদের থেকেই তারা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল।"
এরপর তিনি ঘোষণা দেন যে আশপাশে যত জমিদার আছে তাদের সকলে এখন থেকে আর বৃটিশের ট্রেজারিতে লভ্যাংশ জমা দিতে পারবে না এবং লভ্যাংশের পুরোটাই তাঁর নিকট জমা দিতে হবে। এর অন্যথা হলে চরম পর্যায়ের শাস্তিভোগ করতে হবে।
(৪) ১৪ অক্টোবর, ১৮৩০ সালে তিতুমীরের বাহিনী খাসপুরের একজন মুসলিম জমিদারের সম্পদ লুট করে। কেননা তিনি তিতুমীরের উপরোক্ত ঘোষণাকে অমান্য করেছিল।
(৫) এমনকি তিতুমীর তাঁর অধীনে থাকা দলের লোকদের মধ্যে কড়াভাবে ঘোষণা করে দেন , যে সব জমিদারেরা তাঁর আন্দোলনের বিরুদ্ধে যাবে তাদেরকে কোন প্রকার ভাড়া পরিশোধ করা যাবে না আর অবৈধ ট্যাক্স দেওয়ার প্রশ্নই তো আসে না।
(৬) স্থানীয় পুলিশ বাহিনী অকার্যকর হয়ে পড়ে। তাই কিছু জমিদার এবং তালুকদার বাধ্য হয়ে কলকাতা পালিয়ে যায়।
(৭) এরপর তিতুমীর তাঁর পুরাতন শত্রু জমিদার কৃষ্ণদেবের দিকে নজর দেন। ১৮৩০ সালের ৩১ অক্টোবর তিতুমীর তিনশ জনের এক বাহিনী নিয়ে শরফারাজপুরে কৃষ্ণদেবের বাড়ি ঘেরাও করে। এবং আশপাশের মার্কেট দোকানে লুট করে। পাশাপাশি যারা টাকা পয়সা লেনদেনের ব্যাপারে অসুদাপয় অবলম্বন করত এদের ব্যবসা প্রতিষ্টানে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে কয়েকজন হলঃ লক্ষন দেব, মোহন সাহা, গোলক সাহা এবং অন্যান্যরা।
(৮) চার মাস পূর্বে জমিদার কৃষ্ণদেব একটি মসজিদ ধ্বংস করেছিল এর জবাবে তিতুমীরের বাহিনী স্থানীয় একটি মন্দিরের সামনে একটি গরুকে জবাই করে।
(৯) তিতুমীরের বাহিনীর এরকম অপারেশনের ভয়ে চব্বিশ পরগনা এবং নদিয়ার জমিদারেরা একত্রিত হয় এবং কিভাবে তিতুমীরকে পরাস্ত করা যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা আরম্ভ শুরু করে। এছাড়া নীল রোপনের জন্য যেসব লোক স্থানীয়দেরকে বাধ্য করত তারাও বুঝতে পারে যে তারা তিতুমীরের পরবর্তী টার্গেট হতে যাচ্ছে। এজন্য তারাও জমিদারদের সাথে একত্রিত হয়।
(১০) হাবড়া-গোবরডাঙ্গার জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখার্জী এই জমিদারদের নেতৃত্ব দেন। তিনি তিতুমীরকে কোন লভ্যাংশ পাঠাতে অস্বীকার করেন। পাশাপাশি প্রজাদের উপর যে অবৈধ করারোপ করা হয়েছিল তাও তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানান।
(১১) তিতুমীর কালীপ্রসন্নের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। সে তাঁর বাহিনী নিয়ে গোবরডাঙ্গার দিকে রওয়ানা করে। ডেভিস যে মোল্লাহটিতে নীল চাষ নিয়ন্ত্রন করত সে তৎক্ষণাৎ এই খবর শুনতে পেয়ে ২০০ জন অস্ত্রসহ বাহিনী দিয়ে কালীপ্রসন্নের নিকটে সাহায্যের জন্য পাঠান। কিন্ত ডেভিসের নিজেকেই তিতুমীর বাহিনীর হাত থেকে খুব কষ্ট করে জীবন নিয়ে পালাতে হয়। সে কোনক্রমে বেঁচে গোবড়া গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রয়ের নিকট গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়।
(১২) কালীপ্রসন্ন আর ডেভিসের বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করার পর তিতুমীর গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ কে শাস্তি দেওয়ার জন্য রওয়ানা করে। লৌঘাটিতে গিয়ে তিতুমীরের বাহিনীর সাথে দেবনাথের বাহিনীর যুদ্ধ বাধে। তুমুল সংঘর্ষে দেবনাথের বাহিনী পরাজিত হয় এবং দেবনাথ কে হত্যা করা হয়।
(১৩) এবার তিতুমীর নীলকরদের দিকে নজর দেয়। সে চব্বিশ পরগনার বারাশাত এবং বারিশাতের নীলকরদের যত নীল চাষের জমি আছে তা ধংস করে । এ সংক্রান্ত যত দলিলাদি আছে তা সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ কাজগুলো কৃষকেরাই মূলত করে যাতে করে তাদের চরামূল্যে সুদের লেনদেনের কোন রেকর্ডের অস্তিত্ব যেন আর না পাওয়া যায়।
(১৪) ১৮৩০ সালের নভেম্বরের শুরুতে জমিদার এবং নীলকররা সামগ্রিকভাবে মানুষের উপর থেকে তাদের প্রভাব হারায়। আট নভেম্বর থেকে ১৫ ই নভেম্বর পর্যন্ত তিতুমীরের দলে লোক আরো বাড়তে থাকে।
(১৫) নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় হতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রেসিডেন্সি ডিভিসনের নিকট তিতুমীরের ব্যাপারে খবর পৌছানো শুরু হয়। এবং তিতুমীরের আওতাধীন এলাকাগুলোতে সরকারি কর্মকর্তারা যে আক্রান্ত হয়েছে সেটাও তাদের নজরে আসে। এছাড়া ডেভিস এবং স্টর্মের মত ইউরোপিয়ান নীল করেরাও ইস্ট ইন্ডিয়ার নিকট খবর পৌছায়।
(১৬) কমিশনার চব্বিশ পরগনা এবং নদিয়ার মেজিস্ট্রেট কে অতিদ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করার হুকুম করে। ১৮৩০ সালের পনেরই নভেম্বর বারাসাতের জয়েন্ট মেজিস্ট্রেট আলেক্সান্ডার এবং বাদুড়িয়া থানার কর্মকর্তা ১২০ জনের এক পুলিশ বাহিনী নিয়ে নারিকেলবাড়িয়ার মৌজাতে প্রবেশ করে।
(১৭) এই বাহিনীর আগমনের ব্যাপারে তিতুমীর আগেই জেনে ফেলেছিল। সে পাঁচশ জন কৃষক এবং লাঠিয়ালের এক বাহিনী তাদের মোকাবেলার জন্য পাঠান। এদের নেতৃত্ব দেন তিতুমীরের ভাতিজা গোলাম মাসুম। যিনি পুলিশ বাহিনীকে তৎক্ষণাৎভাবে পরাজিত করেন। জয়েন্ট মেজিস্ট্রেট কোনক্রমে নদিয়ার পাশের গ্রামে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করেন। এ সংঘর্ষের কারণে বাদুড়িয়া থানার ঘৃণিত পুলিশ কর্মকর্তা রামরাম চক্রবর্তী মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া একজন জমিদার , দশজন কনস্টেবল , এবং তিনজন বরকন্দাজ মৃত্যুবরণ করে।
(১৮) এই সফলতার পর তিতুমীর নিজেকে মোঘল শাসকদের ন্যায় 'বাদশাহ' ঘোষণা করে। রুদ্রপুরের মাইনুদ্দীন কে উযীর নিয়োগ করেন। মাইনুদ্দীন বংশীয়ভাবে জোলা বংশের লোক ছিলেন। তিতুমীর তাঁর ভাতিজা গোলাম মাসুম কে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দান করেন। আট হাজারের মত অনুসারী নারিকেলবাড়িয়া এবং এর আশপাশ থেকে এসে যাদের মধ্যে হিন্দু এবং মুসলিম উভয় ধর্মের লোকই ছিল তারা তিতুমীরের দলে যোগদান করে। বারাসাতের নির্দিষ্ট এলাকাতে তিতুমীর এদের নিয়ে নিজস্ব রাজ্য প্রতিষ্টা করেন। এই 'স্বাধীন' এলাকাতে তিতুমীর প্রায় এক বছরের মত রাষ্ট্রের মত পরিচালনা করেন। স্থানীয় জমিদারেরা হয় তিতুমীরের কাছে নত স্বীকার করতে হত আর নয়তো তাদের সম্পত্তি রেখে চলে যেতে হত। তিতুমীরের অনুসারিরাই ট্যাক্স নেওয়া আরম্ভ করল, এবং তারা বিচারকার্য সহ অন্যান্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করল।
(১৯) এরকমভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য কিরকম মূল্য দেওয়া লাগতে পারে এটা তিতুমীর পূর্বেই আঁচ করতে পারে। তিনি বুঝতে পারেন অতি শীঘ্রই ইস্ট ইন্ডিয়ার বাহিনীর সাথে তাদের মোকাবেলা হতে যাচ্ছে। এজন্য নারিকেলবাড়িয়াকে সুরক্ষিত রাখার জন্য তিনি বাঁশের কেল্লা বানানো শুরু করেন। এবং তিনি তাঁর বাহিনীকে নিয়ে অসম্ভব দ্রুততার সাথে বাঁশের কেল্লা তৈরি করে ফেলেন।
(২০) কিন্ত জমিদার এবং নীলকরেরাও বসে ছিল না। চব্বিশ পরগনা, নদিয়া এবং যশোরের জমিদারগণ লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সাথে দেখা করেন এবং তাকে তারা সরাসরি অস্ত্র নিয়ে হামলা করার জন্য আহ্বান করেন। বেন্টিঙ্ক তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে নদিয়ার ডিস্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট স্মিথকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পুলিশ বাহিনী এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করার জন্য আদেশ দেন।
(২১) ১৮৩১ সালের ১৭ ই নভেম্বর সকালে স্মিথ নীলকর ডেভিড অ্যান্ড্রু এবং আরো চারজন ডিস্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট মিলে নারিকেলবাড়িয়ার দিকে রওয়ানা করে এবং তাদের সামনে থাকে তিনশ জনের অস্ত্রসহ এক পুলিশ বাহিনী। জমিদারেরা অনেক লোক এবং হাতি দিয়ে স্মিথের বাহিনীকে সহায়তা করে।
(২২) গোলাম মাসুম, যিনি তিতুমীরের প্রধান সেনাপতি তিনি পূর্বেই স্মিথের বাহিনীর আগমন জানতে পারেন। স্মিথের বাহিনী নারিকেলবাড়িয়া আসার পূর্বেই সে পনেরশ জনের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বারঘরের দিকে রওয়ানা শুরু করে। বারঘরের অবস্থান নারিকেলবাড়িয়া থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে । দুই বাহিনী মুখোমুখি হলে স্মিথের বাহিনী তুমুল গুলি বর্ষন আরম্ভ করে। কিন্ত এগুলো তিতুমীরের বাহিনীর উপর কোন রকম প্রভাব ফেলতে পারে না। তিতুমীরের বাহিনীর লোকবলের নিকট স্মিথের বাহিনী অতি দ্রুত পরাজিত বরন করে। তিতুমীর বাহিনীর স্থানীয় অস্ত্রসস্ত্রের নিকট আধুনিক অস্ত্র বেকার হয়ে বসে। ইংলিশ অফিসারেরা ইছামতি নদী পার হয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে।
(২৩) ১৭ই নভেম্বর ১৮৩১ সালে পরাজিত হওয়ার পর স্মিথ গভর্নর জেনারেলের কাছে চিঠি পাঠায়। চিঠিতে তিনি বলেন,
“ আমি এই বিস্ময়কর মানুষদের মধ্যে যে পরিমাণ উৎসাহ, সংকল্প এবং উগ্রতা দেখতে পেলাম যাদের সংখ্যা সব মিলিয়ে পনেরশোর বেশি হবে না। আমি এ ব্যাপারে কোন দ্বিধা করছি না বলতে যে, এদেরকে পরাজিত করতে হলে গভমেন্টের অবশ্য এবং অতিশীঘ্র সাহায্য পাঠাতে হবে।"
(২৪) এই চিঠির পর লর্ড বেন্টিংক আসল অবস্থার ব্যাপারে আঁচ পায়। নভেম্বরের আঠারো তারিখে মেজর স্কটের অধীনে পুরোদস্তুর একটি মিলিটারি বাহিনী পাঠানো হয়। এবং এ বাহিনীতে আরো ছিলেন লেফট্যানান্ট শেক্সপিয়র, ক্যাপ্টেন সাদারল্যান্ড । তারা একটি অশ্বারোহী বাহিনী এবং একটি পদাতিক বাহিনীর সমন্বয়ে তিনশজনের একটি বাহিনী পরিচালনা করেন। এবং এই বাহিনীতে দুটো কামানও ছিল। একমাত্র সিভিলিয়ান অফিসার হিসেবে ছিল আলেক্সান্ডার যিনি বারাসাতের মেজিস্ট্রেট ছিলেন। নভেম্বরের আঠারো তারিখের মধ্যাহ্ন নাগাদ তারা নারিকেলবাড়িয়াতে পৌছাল। এবং তারা বাঁশের কেল্লা চারিদিক থেকে ঘিরে রাখল। ইতোমধ্যেই অবশ্যই তিতুমীরের দলের বেশিরভাগ লোকই ফেরত চলে এসে তারা নিজ নিজ স্থানে অস্ত্র নিয়ে প্রস্তত থাকল। সেদিন আর বেশি কিছু হয় নি।
(২৫) ঐতিহাসিক যুদ্ধ শুরু হয় নভেম্বরের উনিশ তারিখ সকালে। বৃটিশ বাহিনীর তিন ঘন্টা টানা কামান এবং গুলি বর্ষণের মধ্যেও তিতুমীরের বাহিনী তাদের লাঠি, বল্লম , তীর ধনুক এবং মাসকেট বন্দুকের সাহায্যে সাহসীকতার সাথে প্রতিরোধ করে । তিতুমীর আহত হয় কিন্ত তারপরেও তাঁর অনুসারীদের কে শেষ সময় পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ প্রদান করতে থাকে। কিন্ত অবশেষে কামানের একের পর এক গোলার আঘাত সহ্য করতে না পেরে বাঁশের কেল্লা ভেঙ্গে পড়তে আরম্ভ করে।
(২৬) ইংলিশ আর্মি ভিতরে প্রবেশ করে এবং তিতুমীর কে তারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাঁর পঞ্চাশজন কমরেড কে হত্যা করা হয়। তিতুমীরের লাশ শহীদ হিসেবে তাঁর অনুসারীরা গ্রহণ করতে পারে এই ভয়ে আলেক্সান্ডার তিতুমীরের লাশ কে পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।
(২৭) প্রায় আটশ জন বিদ্রোহীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদেরকে আলীপুর কোর্টে পাঠানো হয়। ১৪০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তি প্রদান করা হয়। কিন্ত গোলাম মাসুম যিনি তিতুমীরের প্রধান সেনাপতি ছিলেন তাকে ধ্বংস্প্রাপ্ত বাঁশের কেল্লার সামনে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় এবং সেখানে অন্যান্য বিদ্রোহীদের ভবিষ্যত শিক্ষার জন্য লাশটিকে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
তিতুমীর (রহঃ), হাজী শরীয়তউল্লাহ (রহঃ) এবং তাঁর ছেলে দুদু মিয়া (রহঃ) এদেরকে বাদ দিলে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে সত্যিকারার্থেই বাঙ্গালী (মুসলিম) সমাজের কোন অবস্থান নেই। এবং এ আন্দোলনগুলো স্পষ্ট করে বললে যে আঙ্গিকেই দেখা হোক না কেন, এগুলো চরমভাবে (ইসলাম) ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। যেহেতু তৎকালীন সময়ে এলিট সমাজের প্রতিনিধিত্ব করত সরাসরি হিন্দু জমিদার এবং তাদের অনুগত সভাসদের বুদ্ধিজীবিরা তারা কখনোই মুসলিমদেরকে আপন মনে করে কাছে টানতে পারে নি। কিন্ত তিতুমীরের আন্দোলন এবং যুদ্ধ এগুলো যতই ধর্মকেন্দ্রিক হোক না কেন তা সমস্ত মজলুমদেরকে একত্রিত করার জন্য অন্যতম সহায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তিতুমীর কে নিয়ে প্রথম বাংলা বই লেখা হয় ১৮৯৭ সালে। বইয়ের লেখক ছিলেন বিহারীলাল সরকার। তিতুমীরকে নিয়ে লেখা বই কিন্ত এই বইতে তিনি স্পষ্ট করে হিন্দু জমিদার এবং ইংরেজদের পক্ষে খোলাখুলিভাবে সাফাই গায়। তাই তিতুমীরকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে লেখা বইগুলো তিতুমীরকে বাস্তবভাবে তুলে ধরতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়। তারপরেও প্রবন্ধের লেখক অনেক যাচাই বাছাই করে নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রবন্ধটি নিবন্ধিত করেন।
তথ্যসমূহ ১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসের Social Scientist জার্নালের ৪২-৪৫ পৃষ্টাতে স্থান পেয়েছে।
~~ফেসবুক থেকে সংগৃহীত~~