সন ১৫৪২, নভেম্বর ২৩। দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুন শের শাহের নিকট পরাজিত হয়ে সিন্ধুর অমরনাথ কোর্টে স্ত্রী হামিদা বানুসহ আশ্রয় নেন। নির্বাসিত অবস্থায় তাদের ঘরে এক পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। নাম রাখেন আবুল ফাতাহ জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর। এক কথায় ইনিই মুঘল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী এবং ভারতবর্ষের মুসলমানদের আশার প্রদীপ।
ভারতবর্ষের পশ্চিমে যখন মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারীর জন্ম তখন মুঘল সাম্রাজ্য হতে হাজার মাইল দূরে ভারতের পূর্বাঞ্চলেও ইতিহাসের এক অকুতোভয় বীর জন্ম গ্রহণ করেন। না তিনি কোন রাজপরিবার কিংবা বনেদি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নি। তার উপর মুসলমানদের কোন আশা ভরসাও ছিলো না। তিনি জন্মেছিলেন বাংলার প্রত্যন্ত এক গ্রমীণ হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে। জন্মের পর তার নামও লিখে রাখা হয় নি, এজন্য নানা মুনির নানা মত। কারো মতে রাজীবলোচন রায় তো কারো মতে রাজনারায়ণ। তবে কালাচাঁদ রায় এবং রাজু ডাকনামটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।
সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মগ্রহণ করা আকবর অল্প বয়সে ক্ষমতা - প্রতিপত্তি লাভ করেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর হুমায়ুনের বিশ্বস্ত সহচর ও বন্ধু বৈরাম খানের সহায়তায় দিল্লির সিংহাসনে আরোহন করেন। এ সময়ে বৈরাম খান নাবালক আকবরের অভিবাকত্ব গ্রহণ করে, সম্রাজ্যের যাবতীয় বিষয়াদি দেখাশোনা করেন।কিন্তু একছত্র ক্ষমতালিপ্সু আকবরের বিষয়টি মোটেই ভালো লাগে নি। মূলত ক্ষমতার অন্ধ মোহের বিষয়টি আকবরের চরিত্রে অল্প বয়সে ফুটে উঠে এবং সিংহাসনে আরোহনের অল্প সময়ের মধ্যেই নাবালক আকবর বৈরাম খানকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
আকবর দিল্লিতে নিজের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে প্রশাসনিক সংস্কার করেন এবং সেনাবাহিনী, রাজস্ব, ভূমিসহ রাজ্যের প্রতিটি কাঠামো ঢেলে সাজান।কিন্তু ক্ষমতার মোহে অন্ধ আকবর এতে সন্তুষ্ট না থেকে দ্বীন-ইসলামের তোয়াক্কা না করেই পার্শ্ববর্তী উগ্র হিন্দু রাজপুতদের বড় বড় পদ দান করেন এবং পুরো ভারতে নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে আশেপাশের বড় বড় হিন্দু রাজপরিবারগুলোর সাথে ধর্মান্তর ব্যাতীতই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে আকবর অম্বরের রাজা বিহারি মলের মেয়ে যোধবাই এবং ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে বিকানিরের রাজা কল্যাণ মল ও জয়সল মীরের কণ্যাদ্বয়কে বিয়ে করেন। তার পুত্র সেলিমকে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে জয়পুরের ভগবান দাসের কণ্যার সাথে বিয়ে দেয়া হয়।
এতগুলো পদস্খলনের পরও ক্ষমতার মোহে অন্ধ নির্বোধ আকবর তার চূড়ান্ত সীমালঙ্ঘন করেন ১৫৮২ সালে দ্বীন-ই-ইলাহী নামক নতুন কুফরি ধর্ম আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে। এ নব্য আবিষ্কৃত কুফরি ধর্মটি আকবর হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে তার রাজ্যের সকল মানুষের জন্য বাধ্যতামুলক করে দেন।
এ কুফরি ধর্মের সকল রীতিনীতি সম্পর্কে এখানে আলোচনা সম্ভব না। তবে এর কয়েকটি দিক তুলে ধরছি। নিয়মিত সূর্যের প্রতি প্রার্থনা করা হতো, জরাথুস্ত্র ধর্মের অনুকরণে এই ধর্মে সূর্যকে খুবই ক্ষমতাশালী ভাবা হতো, যা সুস্পষ্ট শিরক্ ।দ্বীন-ই-ইলাহি ধর্মে মদ পান, জুয়া খেলা তেমন দোষনীয় কিছু ছিলো না, যা ইসলাম অনুযায়ী নিষিদ্ধ।এই ধর্মে দেখা হলে সালামের রীতি ছিল, একজন বলতো ‘আল্লাহু আকবার’, অন্যজন জবাব দিতো ‘জাল্লা জালালুহু’, যার অর্থ হচ্ছে ‘সম্রাট মহান’। এভাবেই ইসলামের একটি সুন্দর নিয়ম রদ করে আকবর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার চেষ্টা করে।তাছাড়া, টাকশাল হতে জারিকৃত মুদ্রায় "লা ইলাহ ইল্লাল্লাহু " এর পরিবর্তে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে " আল্লাহু আকবার " লিখার প্রচলন করা হয়। আরবি হিজরি সালের পরিবর্তে বর্তমান বাংলা সাল এ সময়েই আকবর প্রবর্তন করেন।
ওয়াজিব দাঁড়ি রাখার নিয়মকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয়, দাঁড়ি কেটে ফেলতে উৎসাহিত করা হয়। শুধুমাত্র হিন্দুদের মন রক্ষার্থে গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়। আকবরের এই ধর্মমত মেনে না নেওয়ায় ও এতে ভিন্নতম পোষণ করায় বহু আলেমকে নানাভাবে হেনস্থা থেকে শুরু করে কান্দাহার, সিন্ধু থেকে শুরু করে দূরবর্তী প্রদেশগুলোতে নির্বাসন দেওয়া হয়।
পশ্চিম ভারতে যখন নির্বোধ আকবরের নেতৃত্বে কুফর- শিরকের সয়লাভ পূর্ব ভারতে তখন মুর্তি ও মুর্তি পূজারীদের বিরুদ্ধে এক তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলা তখনও মুঘলদের অধিকারে আসে নি এবং স্বাধীন সুলতান হিসেবে সোলায়মান খান কাররানী বাংলা শাসন করছিলেন, তার সময়কালেই রাজু সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন। ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ছোটবেলা থেকেই হিন্দু জাতপ্রথা ও যাবতীয় কুসংস্কার সম্পর্কে রাজুর মনে তীব্র বিদ্বেষ ছিল। ফলে, মুসলমানদের সংস্পর্শে সেনাবাহিনীতে কিছুদিন থাকার পর ছুটিতে বাড়িতে আসলে ব্রাহ্মণদের সকল ভন্ডামি তার নিকট দিনের আলোর ন্যায় উদ্ভাসিত হয়ে যায় এবং ছুটি শেষে সেনাবাহিনীতে ফিরে গিয়েই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজের নাম রাখেন, মুহাম্মদ পরমান আলী। রাজুর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে সোলায়মান কাররানীর কণ্যা দুলারি বিবির প্রণয়ের মুখরোচক কাহিনিটি মূলত ঊনবিংশ -বিংশ শতাব্দীর নব্য ব্রাহ্মণ্যবাদী জ্ঞানপাপীদের ইতিহাস বিকৃতি। কেননা, এর সাপেক্ষে এসব জ্ঞানপাপী কোন ঐতিহাসিক দলিল উপাস্থাপন করেন নি।বরং, মধ্যযুগের মুসলিম ঐতিহাসিকগন তাকে সুলায়মান কাররানীর ভাই হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ সম্পর্কেও জ্ঞানপাপীরা প্রশ্ন তুললেও আমরা সকলে জানি, যেকেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর মুসলমানদের মাঝে ভাইয়ের মর্যাদা লাভ করেন।
সে যাই হোক, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর রাজুর মনে মূর্তির প্রতি বিদ্বেষ চরমে পোঁছে। অপরদিকে, সেনাবাহিনীতে স্বীয় প্রতিভা গুণে অল্প সময়ের মাঝেই সেনাপতির পদ অলংকৃত করেন।
১৫৬৪-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে আকবর বাদশাহের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে উড়িষ্যার রাজা হরিচন্দন মুকুন্দদেব বাংলা আক্রমণ করে গঙ্গার তীরে অবস্থিত সাতগাঁও বন্দর অধিকার করে নেন। পরে আকবর যখন মেবারের শিশোদীয় রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সেসময় ১৫৬৮ সালে সুলায়মান খান কররানী সেনাপতি রাজু তথা ফরমান আলীর নেতৃত্বে উড়িষ্যা আক্রমণ করেন। তিনি উড়িষ্যা জয়ের পরে পুরীর শ্রী শ্রী জগন্ননাথ ধাম আক্রমণ করেন এবং মন্দির ও বিগ্রহের প্রচুর ক্ষতিসাধন করেন।
এটাই ছিলো সেনাপতি ফরমান আলীর প্রথম বিজয়াভিযান এবং মুর্তি ধ্বংস করার ঘটনা ।এরপর থেকে ফরমান আলী যতগুলো নতুন জায়গা বিজয় করেছিলেন তার কোনটাতেই মন্দির কিংবা মুর্তির কোন অস্তিত্ব রাখেন নি।তার এসকল কর্মকাণ্ডের দরুন হিন্দুরা বিদ্বেষপ্রসূত তার নাম রাখেন 'কালাপাহাড়', অথচ আমরা তার আসল নাম কিংবা মুসলিম নামটি না জানলেও "কালাপাহাড়" নামটি সকলেই জানি। ঐতিহাসিকদের মতে, পূর্ব আসাম থেকে কাশি, হিমালয়ের পাদদেশ হতে উড়িষ্যা পর্যন্ত এমন কোন মন্দর ছিলো না যা রাজু তথা ফরমান আলী ধ্বংস করেন নি। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, পুরীর জগন্নাথ মন্দির, আসামের কামাখ্যা মন্দির, সুভদ্রার মন্দির, বালেশ্বরের গোপীনাথ মন্দির, ভুবনেশ্বরের কাছে কোনার্ক মন্দির, ময়ুরভঞ্জ মন্দির ইত্যাদি। এজন্য এ অঞ্চলে ১৬ শতকের আগের কোন মন্দিরের অস্তিত্ব নেই। কামাখ্যা ষোল শতকের শেষের দিকে , ঢাকেশ্বরী সতেরো শতকের শুরুর দিকে পুন:নির্মাণ এবং কান্তজীর মন্দির নির্মাণ করা হয় আটারো শতকের শেষের দিকে।
ফরমান আলী সুলায়মান খান পরবর্তী দাউদ খান কাররানীর সময়েও বাংলা সালতানাতের সেনাপতি ছিলেন। মুঘল সম্রাট নির্বোধ আকবর এ সময়ে আফগান ও অন্যান্য বিদ্রোহীদের উপর জয়লাভ করে বাংলায় নজর দেন। বাংলার সুলতান আকবরের বিরুদ্ধে কয়েকটি খন্ড যুদ্ধের পর সর্বশেষ রাজ মহলের যুদ্ধে সম্পূর্ণরুপে পরাজিত হলে ফরমান আলী আফগান নেতা মাসুদ কাবুলির নেতৃত্বে মুর্তাদ আকবরের বিরুদ্ধে জীবনের শেষনিঃশাস পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যান।
ধারনা করা হয়, মুঘল সেনাপতি খান ই আজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মাসুম কাবুলী পরাস্ত হলে সেই যুদ্ধে ফরমান আলী নিহত হলে তাকে উড়িষ্যার সম্বলপুরে মহানদীর তীরে সমাধিস্থ করা হয়। সম্বলেশ্বর কলেজ বিল্ডিং-এর গায়ে অসংখ্য সমাধি দেখে অনুমান করা হয় এগুলি ফরমান আলীর সহযোদ্ধাদের এবং ২০০৬ সালে একদল উগ্র হিন্দু ছাত্র কর্তৃক এগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।আমরা ভুলে গেলেও উগ্র হিন্দুরা কালাপাহাড় তথা ফরমান আলীকে কোনদিনও ভুলে যায় নি এবং ভুলবে না।
রাজ মহলের যুদ্ধে মুর্তাদ আকবরের কাছে বাংলা সালতানাতের সর্বশেষ সুলতান দাউদ খান সম্পূর্ণরুপে পরাজিত হলেও আকবর কোন দিনও সম্পূর্ণ বাংলা অধিকার করতে পারেন নি।কেননা, এ সময়ে ইসা খাঁর নেতৃত্বে বাংলার সামন্তশাসকরা আকবরের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, যা ইতিহাসে বাংলার বারো ভুঁইয়াদের বিদ্রোহ নামে পরিচিত।আকবরের সেনাপতি ইসা খাঁর বিরুদ্ধে অনেকগুলো খন্ড যুদ্ধ এবং কয়েকটি নৌযুদ্ধে পরাজিত হন।
মূলত ধর্মীয় বাড়াবাড়িই মুর্তাদ আকবরের বিরুদ্ধে বাংলায় তীব্র বিদ্রোহের প্রধানতম কারন। এক্ষেত্রে তৎকালীন বাংলার কাজী মীর মইদুল মুলক এবং জৌনপুরের কাজী মুহাম্মদ ইয়াজদীর আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বৈধ হওয়ার ফতোয়াটি উল্লেখযোগ্য।
আকবরের মৃত্যুর পর ছেলে জাহাঙ্গীর সম্রাট হন এবং প্রথমদিকে পিতার আবিষ্কৃত কুফরি ধর্মের উপর অটল থাকেন।কিন্তু, এ সময়ে উত্তর ভারতের শায়েখ আহমদ্ শের হিন্দের তীব্র আন্দোলনের মুখে একসময় সম্রাট জাহাঙ্গীর তওবা করে পুনরায় ঈমান আনতে এবং মুঘল সাম্রাজ্যে ইসলামি রীতিনীতি চালু করতে বাধ্য হন। উক্ত সময়ে বাংলায় বিদ্রোহী বারো ভুঁইয়াদের নেতৃত্বে ছিলো ঈসা খাঁ পুত্র মুসা খাঁ।সম্রাট জাহাঙ্গীর ইসলামের পথে ফিরে আসায় মুসা খাঁ তার অধীনতা স্বীকার করে নেন এবং মুঘলদের পক্ষে ত্রিপুরা ও আসাম বিজয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এভাবে বাংলা ইসলামি মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় যা পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
ভারতবর্ষের পশ্চিমে যখন মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারীর জন্ম তখন মুঘল সাম্রাজ্য হতে হাজার মাইল দূরে ভারতের পূর্বাঞ্চলেও ইতিহাসের এক অকুতোভয় বীর জন্ম গ্রহণ করেন। না তিনি কোন রাজপরিবার কিংবা বনেদি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নি। তার উপর মুসলমানদের কোন আশা ভরসাও ছিলো না। তিনি জন্মেছিলেন বাংলার প্রত্যন্ত এক গ্রমীণ হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে। জন্মের পর তার নামও লিখে রাখা হয় নি, এজন্য নানা মুনির নানা মত। কারো মতে রাজীবলোচন রায় তো কারো মতে রাজনারায়ণ। তবে কালাচাঁদ রায় এবং রাজু ডাকনামটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।
সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মগ্রহণ করা আকবর অল্প বয়সে ক্ষমতা - প্রতিপত্তি লাভ করেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর হুমায়ুনের বিশ্বস্ত সহচর ও বন্ধু বৈরাম খানের সহায়তায় দিল্লির সিংহাসনে আরোহন করেন। এ সময়ে বৈরাম খান নাবালক আকবরের অভিবাকত্ব গ্রহণ করে, সম্রাজ্যের যাবতীয় বিষয়াদি দেখাশোনা করেন।কিন্তু একছত্র ক্ষমতালিপ্সু আকবরের বিষয়টি মোটেই ভালো লাগে নি। মূলত ক্ষমতার অন্ধ মোহের বিষয়টি আকবরের চরিত্রে অল্প বয়সে ফুটে উঠে এবং সিংহাসনে আরোহনের অল্প সময়ের মধ্যেই নাবালক আকবর বৈরাম খানকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
আকবর দিল্লিতে নিজের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে প্রশাসনিক সংস্কার করেন এবং সেনাবাহিনী, রাজস্ব, ভূমিসহ রাজ্যের প্রতিটি কাঠামো ঢেলে সাজান।কিন্তু ক্ষমতার মোহে অন্ধ আকবর এতে সন্তুষ্ট না থেকে দ্বীন-ইসলামের তোয়াক্কা না করেই পার্শ্ববর্তী উগ্র হিন্দু রাজপুতদের বড় বড় পদ দান করেন এবং পুরো ভারতে নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে আশেপাশের বড় বড় হিন্দু রাজপরিবারগুলোর সাথে ধর্মান্তর ব্যাতীতই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে আকবর অম্বরের রাজা বিহারি মলের মেয়ে যোধবাই এবং ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে বিকানিরের রাজা কল্যাণ মল ও জয়সল মীরের কণ্যাদ্বয়কে বিয়ে করেন। তার পুত্র সেলিমকে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে জয়পুরের ভগবান দাসের কণ্যার সাথে বিয়ে দেয়া হয়।
এতগুলো পদস্খলনের পরও ক্ষমতার মোহে অন্ধ নির্বোধ আকবর তার চূড়ান্ত সীমালঙ্ঘন করেন ১৫৮২ সালে দ্বীন-ই-ইলাহী নামক নতুন কুফরি ধর্ম আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে। এ নব্য আবিষ্কৃত কুফরি ধর্মটি আকবর হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে তার রাজ্যের সকল মানুষের জন্য বাধ্যতামুলক করে দেন।
এ কুফরি ধর্মের সকল রীতিনীতি সম্পর্কে এখানে আলোচনা সম্ভব না। তবে এর কয়েকটি দিক তুলে ধরছি। নিয়মিত সূর্যের প্রতি প্রার্থনা করা হতো, জরাথুস্ত্র ধর্মের অনুকরণে এই ধর্মে সূর্যকে খুবই ক্ষমতাশালী ভাবা হতো, যা সুস্পষ্ট শিরক্ ।দ্বীন-ই-ইলাহি ধর্মে মদ পান, জুয়া খেলা তেমন দোষনীয় কিছু ছিলো না, যা ইসলাম অনুযায়ী নিষিদ্ধ।এই ধর্মে দেখা হলে সালামের রীতি ছিল, একজন বলতো ‘আল্লাহু আকবার’, অন্যজন জবাব দিতো ‘জাল্লা জালালুহু’, যার অর্থ হচ্ছে ‘সম্রাট মহান’। এভাবেই ইসলামের একটি সুন্দর নিয়ম রদ করে আকবর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার চেষ্টা করে।তাছাড়া, টাকশাল হতে জারিকৃত মুদ্রায় "লা ইলাহ ইল্লাল্লাহু " এর পরিবর্তে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে " আল্লাহু আকবার " লিখার প্রচলন করা হয়। আরবি হিজরি সালের পরিবর্তে বর্তমান বাংলা সাল এ সময়েই আকবর প্রবর্তন করেন।
ওয়াজিব দাঁড়ি রাখার নিয়মকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয়, দাঁড়ি কেটে ফেলতে উৎসাহিত করা হয়। শুধুমাত্র হিন্দুদের মন রক্ষার্থে গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়। আকবরের এই ধর্মমত মেনে না নেওয়ায় ও এতে ভিন্নতম পোষণ করায় বহু আলেমকে নানাভাবে হেনস্থা থেকে শুরু করে কান্দাহার, সিন্ধু থেকে শুরু করে দূরবর্তী প্রদেশগুলোতে নির্বাসন দেওয়া হয়।
পশ্চিম ভারতে যখন নির্বোধ আকবরের নেতৃত্বে কুফর- শিরকের সয়লাভ পূর্ব ভারতে তখন মুর্তি ও মুর্তি পূজারীদের বিরুদ্ধে এক তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলা তখনও মুঘলদের অধিকারে আসে নি এবং স্বাধীন সুলতান হিসেবে সোলায়মান খান কাররানী বাংলা শাসন করছিলেন, তার সময়কালেই রাজু সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন। ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ছোটবেলা থেকেই হিন্দু জাতপ্রথা ও যাবতীয় কুসংস্কার সম্পর্কে রাজুর মনে তীব্র বিদ্বেষ ছিল। ফলে, মুসলমানদের সংস্পর্শে সেনাবাহিনীতে কিছুদিন থাকার পর ছুটিতে বাড়িতে আসলে ব্রাহ্মণদের সকল ভন্ডামি তার নিকট দিনের আলোর ন্যায় উদ্ভাসিত হয়ে যায় এবং ছুটি শেষে সেনাবাহিনীতে ফিরে গিয়েই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজের নাম রাখেন, মুহাম্মদ পরমান আলী। রাজুর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে সোলায়মান কাররানীর কণ্যা দুলারি বিবির প্রণয়ের মুখরোচক কাহিনিটি মূলত ঊনবিংশ -বিংশ শতাব্দীর নব্য ব্রাহ্মণ্যবাদী জ্ঞানপাপীদের ইতিহাস বিকৃতি। কেননা, এর সাপেক্ষে এসব জ্ঞানপাপী কোন ঐতিহাসিক দলিল উপাস্থাপন করেন নি।বরং, মধ্যযুগের মুসলিম ঐতিহাসিকগন তাকে সুলায়মান কাররানীর ভাই হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ সম্পর্কেও জ্ঞানপাপীরা প্রশ্ন তুললেও আমরা সকলে জানি, যেকেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর মুসলমানদের মাঝে ভাইয়ের মর্যাদা লাভ করেন।
সে যাই হোক, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর রাজুর মনে মূর্তির প্রতি বিদ্বেষ চরমে পোঁছে। অপরদিকে, সেনাবাহিনীতে স্বীয় প্রতিভা গুণে অল্প সময়ের মাঝেই সেনাপতির পদ অলংকৃত করেন।
১৫৬৪-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে আকবর বাদশাহের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে উড়িষ্যার রাজা হরিচন্দন মুকুন্দদেব বাংলা আক্রমণ করে গঙ্গার তীরে অবস্থিত সাতগাঁও বন্দর অধিকার করে নেন। পরে আকবর যখন মেবারের শিশোদীয় রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সেসময় ১৫৬৮ সালে সুলায়মান খান কররানী সেনাপতি রাজু তথা ফরমান আলীর নেতৃত্বে উড়িষ্যা আক্রমণ করেন। তিনি উড়িষ্যা জয়ের পরে পুরীর শ্রী শ্রী জগন্ননাথ ধাম আক্রমণ করেন এবং মন্দির ও বিগ্রহের প্রচুর ক্ষতিসাধন করেন।
এটাই ছিলো সেনাপতি ফরমান আলীর প্রথম বিজয়াভিযান এবং মুর্তি ধ্বংস করার ঘটনা ।এরপর থেকে ফরমান আলী যতগুলো নতুন জায়গা বিজয় করেছিলেন তার কোনটাতেই মন্দির কিংবা মুর্তির কোন অস্তিত্ব রাখেন নি।তার এসকল কর্মকাণ্ডের দরুন হিন্দুরা বিদ্বেষপ্রসূত তার নাম রাখেন 'কালাপাহাড়', অথচ আমরা তার আসল নাম কিংবা মুসলিম নামটি না জানলেও "কালাপাহাড়" নামটি সকলেই জানি। ঐতিহাসিকদের মতে, পূর্ব আসাম থেকে কাশি, হিমালয়ের পাদদেশ হতে উড়িষ্যা পর্যন্ত এমন কোন মন্দর ছিলো না যা রাজু তথা ফরমান আলী ধ্বংস করেন নি। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, পুরীর জগন্নাথ মন্দির, আসামের কামাখ্যা মন্দির, সুভদ্রার মন্দির, বালেশ্বরের গোপীনাথ মন্দির, ভুবনেশ্বরের কাছে কোনার্ক মন্দির, ময়ুরভঞ্জ মন্দির ইত্যাদি। এজন্য এ অঞ্চলে ১৬ শতকের আগের কোন মন্দিরের অস্তিত্ব নেই। কামাখ্যা ষোল শতকের শেষের দিকে , ঢাকেশ্বরী সতেরো শতকের শুরুর দিকে পুন:নির্মাণ এবং কান্তজীর মন্দির নির্মাণ করা হয় আটারো শতকের শেষের দিকে।
ফরমান আলী সুলায়মান খান পরবর্তী দাউদ খান কাররানীর সময়েও বাংলা সালতানাতের সেনাপতি ছিলেন। মুঘল সম্রাট নির্বোধ আকবর এ সময়ে আফগান ও অন্যান্য বিদ্রোহীদের উপর জয়লাভ করে বাংলায় নজর দেন। বাংলার সুলতান আকবরের বিরুদ্ধে কয়েকটি খন্ড যুদ্ধের পর সর্বশেষ রাজ মহলের যুদ্ধে সম্পূর্ণরুপে পরাজিত হলে ফরমান আলী আফগান নেতা মাসুদ কাবুলির নেতৃত্বে মুর্তাদ আকবরের বিরুদ্ধে জীবনের শেষনিঃশাস পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যান।
ধারনা করা হয়, মুঘল সেনাপতি খান ই আজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মাসুম কাবুলী পরাস্ত হলে সেই যুদ্ধে ফরমান আলী নিহত হলে তাকে উড়িষ্যার সম্বলপুরে মহানদীর তীরে সমাধিস্থ করা হয়। সম্বলেশ্বর কলেজ বিল্ডিং-এর গায়ে অসংখ্য সমাধি দেখে অনুমান করা হয় এগুলি ফরমান আলীর সহযোদ্ধাদের এবং ২০০৬ সালে একদল উগ্র হিন্দু ছাত্র কর্তৃক এগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।আমরা ভুলে গেলেও উগ্র হিন্দুরা কালাপাহাড় তথা ফরমান আলীকে কোনদিনও ভুলে যায় নি এবং ভুলবে না।
রাজ মহলের যুদ্ধে মুর্তাদ আকবরের কাছে বাংলা সালতানাতের সর্বশেষ সুলতান দাউদ খান সম্পূর্ণরুপে পরাজিত হলেও আকবর কোন দিনও সম্পূর্ণ বাংলা অধিকার করতে পারেন নি।কেননা, এ সময়ে ইসা খাঁর নেতৃত্বে বাংলার সামন্তশাসকরা আকবরের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, যা ইতিহাসে বাংলার বারো ভুঁইয়াদের বিদ্রোহ নামে পরিচিত।আকবরের সেনাপতি ইসা খাঁর বিরুদ্ধে অনেকগুলো খন্ড যুদ্ধ এবং কয়েকটি নৌযুদ্ধে পরাজিত হন।
মূলত ধর্মীয় বাড়াবাড়িই মুর্তাদ আকবরের বিরুদ্ধে বাংলায় তীব্র বিদ্রোহের প্রধানতম কারন। এক্ষেত্রে তৎকালীন বাংলার কাজী মীর মইদুল মুলক এবং জৌনপুরের কাজী মুহাম্মদ ইয়াজদীর আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বৈধ হওয়ার ফতোয়াটি উল্লেখযোগ্য।
আকবরের মৃত্যুর পর ছেলে জাহাঙ্গীর সম্রাট হন এবং প্রথমদিকে পিতার আবিষ্কৃত কুফরি ধর্মের উপর অটল থাকেন।কিন্তু, এ সময়ে উত্তর ভারতের শায়েখ আহমদ্ শের হিন্দের তীব্র আন্দোলনের মুখে একসময় সম্রাট জাহাঙ্গীর তওবা করে পুনরায় ঈমান আনতে এবং মুঘল সাম্রাজ্যে ইসলামি রীতিনীতি চালু করতে বাধ্য হন। উক্ত সময়ে বাংলায় বিদ্রোহী বারো ভুঁইয়াদের নেতৃত্বে ছিলো ঈসা খাঁ পুত্র মুসা খাঁ।সম্রাট জাহাঙ্গীর ইসলামের পথে ফিরে আসায় মুসা খাঁ তার অধীনতা স্বীকার করে নেন এবং মুঘলদের পক্ষে ত্রিপুরা ও আসাম বিজয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এভাবে বাংলা ইসলামি মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় যা পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী হয়।