ইস্পাত-দৃঢ় হৃদয় আর জ্ঞানের প্রতীক: শহীদ মোল্লা আখতার মোহাম্মদ মনসুর (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)

ইতিহাসে এমন অনেক সময় এসেছে যখন দেশগুলি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে এবং শত্রুর গর্জনে তাদের মাথা নত হয়ে পড়েছে। অপরদিকে ইতিহাস এমন অনেক নেতাকেও লিপিবদ্ধ করেছে, যাদের সাহসীকতা, জ্ঞান এবং নির্ভীক নেতৃত্বে একটি জাতিকে স্বাধীনতার দিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে আমরা দেখেছি, যখন আফগানিস্তানে ট্যাঙ্কের গর্জন, ড্রোনের শব্দ, আকাশে যুদ্ধবিমানের টহল এবং কাবুলের প্রাসাদ থেকে দাসদের বক্তৃতা আফগান জনগণকে হুমকি দিচ্ছিল এবং উম্মাহর ঐক্যের মূলে বিপর্যয় তৈরির চেষ্টা চলছিল। ঠিক তখুনি লোকচক্ষুর আড়ালে হিন্দুকুশের পর্বতগুলো থেকে মুজাহিদদের নেতৃত্ব দিতে শুরু করলেন একজন ধৈর্যশীল, শক্তিশালী এবং জ্ঞানী ব্যক্তি। যার কন্ঠস্বর উম্মাহকে আশা, শত্রুকে ভয় এবং মুনাফিকদের মিথ্যার প্রতিক্রিয়া জানাল। তিনি ছিলেন শহীদ কমান্ডার আমীরুল মু’মিনীন মোল্লা আখতার মুহাম্মদ মনসুর (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) – যিনি সাহসের সাথে মিথ্যা, ভয় এবং অপবাদের ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
শহীদ আমীরুল মু’মিনীন মোল্লা আখতার মুহাম্মদ মনসুর (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) ছিলেন উম্মাহর নীরব নেতা, যিনি কথার চেয়ে কর্মকে প্রাধান্য দিতেন এবং দখলদারদের অপবিত্র পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ধৈর্য, কৌশল এবং ঈমানী দৃঢ়তার দেয়াল নির্মাণ করেছিলেন।
যখন হোয়াইট হাউজের হাসিমাখা মুখে কারজাই আফগান জনগণের শাহাদাতে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছিল, যখন আশরাফ গনি আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে বোমা হামলার ইঙ্গিত দিচ্ছিল, যখন “গণতন্ত্রের” আড়ালে শত শত শিশু, বৃদ্ধ, আলেম এবং সাধারণ জনগণ শহীদ হচ্ছিল – তখন আফগান মুজাহিদদের ছায়া দিয়ে পরিকল্পিত সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন মোল্লা আখতার মুহাম্মদ মনসুর (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)।
তার নেতৃত্ব ছিল শক্তি ও প্রজ্ঞার এক বিরল সমন্বয়। একদিকে, এটি মুজাহিদিনদের পদমর্যাদা পুনর্গঠিত করেছিল, অন্যদিকে, শত্রুর গোয়েন্দা কৌশলকে ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। তিনি এমন একটি সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন যা কাবুলের শাসকগোষ্ঠীর স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছিল। তার চোখ কেবল যুদ্ধক্ষেত্রের দিকেই স্থির ছিল না, বরং তার মনে ভবিষ্যতের ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার আকৃতির একটি ছবিও ছিল।
কাবুল বিজয় ও তাঁর শাহাদাতের আগেই বিচক্ষণ এই নেতা অর্থনৈতিক মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্রনীতি থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ ও নিয়মতান্ত্রিক সামরিক বাহিনী এবং বিচার বিভাগ – প্রতিটি ক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। কিন্তু তিনি এই সবকিছুই এত গোপন এবং দক্ষতার সাথে করেছিলেন যে, শত্রুর চোখ থেকে তা আড়ালেই থেকে গিয়েছিল।
দখলদারদের সমস্ত বিনিয়োগ, সমস্ত অস্ত্র, সমস্ত ভাড়াটে সৈনিক এবং সমস্ত প্রচারণা তার নেতৃত্ব ভাঙতে পারেনি। তিনি ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, তার বন্দুকের পিছনে ছিল কৌশল এবং তার সিদ্ধান্তের পিছনে ছিল দৃঢ় সংকল্প। মোল্লা আখতার মুহাম্মদ মনসুরের সেই নেতৃত্ব আফগান পুতুল সরকারকে উৎখাত করার জন্য রাতের নীরব ছায়াকে দিনের রোদে রূপান্তরিত করেছিল।
আমীরুল মু’মিনীন মোল্লা আখতার মুহাম্মদ মনসুর (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন কিন্তু জনগণের পিছনে ছিলেন না, বরং তিনি তাদের মধ্যেই ছিলেন। আর তার দৃঢ় নেতৃত্বে দখলদারিত্বের অন্ধকারের পর, নতুন ভোর আসতে শুরু করে, পশ্চিমা গোলামদের প্রাসাদগুলো ভেঙ্গে যেতে থাকে এবং কাবুল আবারও স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এসবই সম্ভব হয়েছে মহান রবের সাহায্য, শহীদের সাহসিকতা এবং ত্যাগের ফলে।
তার বিচক্ষণতা “নেতৃত্ব” এর সংজ্ঞা পরিবর্তন করে দিয়েছিল।
মোল্লা আখতার মুহাম্মদ মনসুরের (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) নেতৃত্ব কেবল আদেশ দেওয়ার শিল্প ছিল না, বরং কৌশল, ধৈর্য, সহনশীলতা এবং গভীর চিন্তাভাবনারও ছিল। আমীরুল মু’মিনীন মোল্লা মুহাম্মদ ওমর মুজাহিদ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর বিদায়ের পর যখন মুমিনদের হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল, তখন তিনি পুনরায় মুজাহিদদের মনোবল বৃদ্ধি করলেন, তাদের পুনর্গঠন করলেন। তিনি শত্রুর চক্রান্তগুলো চূর্ণ করলেন এবং তাদের চোখ থেকে শান্তির ঘুম কেড়ে নিলেন।
প্রতিটি পাহাড়, উপত্যকা এবং মরুভূমিতে, একটি কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল: “এই কাফেলারা কারো জন্য অপেক্ষা করবে না!” এসময় তিনি ইলম এবং বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি দিয়ে খারেজিদের লজ্জায় ফেলেছিলেন, সামরিক শক্তি দিয়ে তাদের পরাজিত করেছিলেন। তিনি জাতিকে শিখিয়েছিলেন যে, প্রতিটি কালো পতাকাবাহী ই মুজাহিদ নয়, আল্লাহর নাম উচ্চারণকারী প্রত্যেকেই সত্যবাদী নয়।
ক্রুসেডার মার্কিন বাহিনীর ড্রোন হামলা ২২ মে, ২০১৬ তারিখে, পাক-আফগান সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মোল্লা মানসুর (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর দেহ ধ্বংস করে দিয়েছে। এতে তিনি শাহাদাত বরণ করেছেন ঠিকই, কিন্তু তার চিন্তাভাবনা, উপদেশ, প্রজ্ঞা এবং উত্তরাধিকার আজও ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের স্তম্ভ হিসেবে রয়ে গেছে। এই মহান নেতাদের আত্মত্যাগে আজ আমরা ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানে এমন একটি ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করছি যেখানে কুরআন হলো আইন, শরিয়াহ হলো ভারসাম্য এবং এর নিরাপত্তা হলো বিশ্বের জন্য উদাহরণ।
নিশ্চয়ই শহীদ মনসুর (আল্লাহ তাকে কবুল করুন) কেবল একজন নেতাই ছিলেন না, বরং একজন চিন্তাবিদ, একজন যোদ্ধা, একজন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এবং আন্তরিক সেবকও ছিলেন।
আমরা দোয়া করি! আমীরুল মু’মিনীন, যিনি ছিলেন উম্মাহর আশা এবং শত্রুর ভয়ের নাম, মহান রব্বুল আলামীন যেনো তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান দান করেন। আমীন
আমীরুল মু’মিনীন মোল্লা আখতার মুহাম্মদ মনসুর (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী জানতে আরও পড়ুন:
মোল্লা আখতার মোহাম্মদ মনসুর (রহ.) : ইমারাতে ইসলামিয়ার দুঃসময়ের কিংবদন্তি নেতা