Announcement

Collapse
No announcement yet.

কেন সাহাবীদের মতো সোনার মানুষ আর গড়ে উঠে না ? আসুন মৌলিক কারণগুলো জেনে নিই ।

Collapse
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • কেন সাহাবীদের মতো সোনার মানুষ আর গড়ে উঠে না ? আসুন মৌলিক কারণগুলো জেনে নিই ।

    কেন সাহাবীদের মতো সোনার মানুষ ও সোনার সমাজ আর গড়ে উঠে না ?



    ইসলামের বিপ্লবি জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যে কালেই হোক, যে ভূখণ্ডে হোক তা শুরু করতে হলে, এ পথের মুজাহিদদের অবশ্যই এর কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হয় । এ জ্ঞানের একমাত্র উৎস হল মহাগ্রন্থ আল কুরআন । এ অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন কুরআনই এক সময় এমন এক মানবগোষ্ঠী তৈরি করেছিল যাদের তুলনা শুধু ইসলামের ইতিহাসে কেন, গোটা মানবজাতির ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই । ইসলামই ইতিহাসের সেই সোনালি অধ্যায়ের পর আর কখনই তাদের মত যোগ্যতা ও গুনের সমাহার কোন মানবগোষ্ঠীর মাঝে পরিলক্ষিত হয়নি । অবশ্য বিক্ষিপ্তভাবে কোথাও কোথাও কয়েকজন মানুষের জন্ম হয়েছে, তবে তাদের মতো উচুমানের নৈতিক গুণসম্পন্ন কোন সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল মানবগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেনি । এটা এমন প্রমানিত, বাস্তব ইতিহাস, যা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই । তাই বিষয়টির তাৎপর্য ও কারন সম্পর্কে আমাদের ব্যাপক পর্যালোচনার মাধ্যমে এর রহস্য খুজে বের করতে হবে । এই লেখায় শুধু কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে ইনশাল্লাহ ।

    ভুমিকা

    যে কুরআন সেই যুগের জাহেলিয়াতের পঙ্কে নিমজ্জিত মানুষদের আকাশের তারার মতো উদ্ভাসিত একেকজন আলোকিত মানুষে পরিনত করেছিল, সেই কুরআন তো আজও আমাদের সামনে অবিকৃত ও অবিকল বিদ্যমান । সেই কুরআনের বাহক আল্লাহর নবির জীবনাদর্শ ও কর্মপদ্ধতির বিস্তারিত ইতিহাসও আমাদের জানা । তারপরও বর্তমান পৃথিবীতে মুসলিম জাতির বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই কেন ? আমরা কি এ কথা বলতে পারি যে, বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সঃ) সশরীরে আমাদের মাঝে উপস্থিত নেই বলে আমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না ! ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যদি আল্লাহর রাসুলের সশরীর উপস্থিতি এমন অপরিহার্যই হতো তাহলে আল্লাহ তাআলা ইসলামকে কিয়ামাত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা বলে ঘোষণা দিতেন না । নবী-রাসুল পাঠানোর ধাঁরা বন্ধ করে দিয়ে এটাকে সকল যুগ ও কালের সমগ্র মানবগোষ্ঠীর জন্য একমাত্র জীবনবিধান বলেও ঘোষণা করতেন না ।

    মুলত এখন রাসুল (সঃ) এর সশরীরে উপস্থিতর কোন প্রয়োজনও নেই; বরং কুরআনের বিদ্যমানতাই দ্বীন প্রতিষ্ঠার সকল উপায়-উপকরন ও দিকনির্দেশনা সরবরাহের জন্য যথেষ্ট । তাই আল্লাহ তাআলা নবীকে জীবিত না রেখে পবিত্র কুরআন অবিকৃত ও অবিকল রেখে হিফাযতের দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিয়েছেন । আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআন এমনভাবে রচনা করেছেন যে, কিয়ামাত পর্যন্ত উদ্ভুত যে কোন ধরনের সমস্যার সমাধান এর মাধ্যমে সম্ভব । এজন্যই আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় হাবিবের মাধ্যমে মানবজাতির নিকট এ কুরআন পৌঁছে দিয়ে তাকে নিজের কাছে তুলে নিয়ে ঘোষণা করেন যে, এ কুরআন তথা ইসলাম কিয়ামাত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা হিসেবে কার্যকর থাকবে । রাসুলের শারীরিক অনুপুস্থিতি এ দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথে কোন অন্তরাই সৃষ্টি করতে পারবে না ।

    প্রথম কারণঃ

    সাহাবিদের মতো মানুষ এখন না হওয়ার হেতু খুজতে গেলে প্রথমে দেখা যাবে, তারা যে কুরআনের স্বচ্ছ, নির্মূল, নির্ভেজাল ঝর্নাধাঁরা থেকে তাদের জ্ঞান-পিপাসা মিটিয়েছেন, কালের আবর্তনে সেই ঝর্নাধারার সাথে অনেক ভেজাল মিশে গেছে । পুথিগতভাবে যদিও এসবের মুল কুরআনের সাথে সংযুক্ত হয়নি, কিন্তু মানুষের চিন্তাচেতনায় ঐসব ভেজালের প্রভাব আমরা এখন অস্বীকার করতে পারিনা । যে ঝরনাধারা থেকে সেই যুগের সোনার মানুষেরা তাদের জ্ঞান-পিপাসা মিটাতেন, সঞ্জিবনীশক্তি গ্রহন করতেন, পাথেয় সংগ্রহ করতেন তা হল পবিত্র কুরআন । কারন হাদিস বলতে আমরা যা বুঝি, তা মুলত কোনো উৎস বা ঝর্নাধারা নয়, বরং তা হল ঐ কুরআনী ঝরনারই স্রোতধারা । তাইতো আমরা দেখতে পাই ‘আল্লাহর নবির চরিত্র কেমন ছিল’- এর জবাবে উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘কুরআনই তার চরিত্র’ ।

    মহাগ্রন্থ আল কুরআন থেকেই সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) তাদের প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ গ্রহন করতেন । তারা নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে কুরআনের ছাচে গড়ে তুলেছিলেন । কথা হল- কেন তারা কুরআনকে এভাবে গ্রহন করতেন? অন্য কোন সভ্যতা, সাহিত্য, শিক্ষাকেন্দ্র, বিদ্যাপীঠ ইত্যাদি না থাকার কারণে বাধ্য হয়েই কি তারা কুরআনকে এমন পরমভাবে গ্রহন করেছিলেন? কিছুতেই নয়, কস্মিনকালেও এটা সত্য নয় ।

    প্রকৃত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পাবো, তৎকালীন রোমান সভ্যতা ও রোমান আইনশাস্ত্রকে আজও ইউরোপে সভ্যতার আদি মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয় । সে যুগের গ্রিক যুক্তিবিদ্যা, গ্রিক দর্শন, আর্টসহ সাহিত্যিক আজও পশ্চাত্তে উন্নত চিন্তাধারার অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয় । পারস্য সভ্যতা, তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাও সে যুগে ছিল অত্যন্ত সুগঠিত ও ঐতিহ্যবাহী হিসেবে সুপরিচিত । আরবের নিকটে ও দূরে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আর অনেক সভ্যতা তখন বিদ্যমান ছিল-তাতে চীন ও ভারতের কথাও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । আরবের উত্তরে ছিল রোমান সভ্যতার কেন্দ্রভুমি, আর দক্ষিনে ছিল পারস্য সভ্যতা । সুতরাং একজন সুস্থ চিন্তার মানুষ একথা বলতে পারেনা যে, সাহিত্য, সভ্যতা ও সুগঠিত কোন ব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণে সে যুগের মুসলমানরা কুরআনকে তাদের একমাত্র জীবনবিধান হিসেবে গ্রহন করেছে । তারা অনেক ভেবেচিন্তে বুঝেশুনে বিদ্যমান সব ব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে কুরআনকেই তাদের জীবনবিধান হিসেবে বেচে নিয়েছে । এ ব্যাপারে তাওরাতের অংশবিশেষ নিয়ে হযরত ওমর (রাঃ) আল্লাহর রাসুলের কাছে আসার ঘটনাটি আমাদেরকে আরও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয় । তাওরাতের কপি আনতে দেখে আল্লাহর রাসুল (সঃ) অসন্তুষ্ট হয়ে হযরত ওমর (রাঃ) কে বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম, আজ যদি মুসা (আঃ)ও জীবিত থাকতেন তাহলে আমার আনুগত্য তার উপরও ফরজ করে দেয়া হতো। ’

    এ ঘটনা থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায়, মহানবী (সঃ) তার সাহাবীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষন দানের জন্য একমাত্র কুরআনিক নির্দেশনাই কাজে লাগিয়েছেন । কুরআনের বিশুদ্ধ ঝরনাধারা থেকেই জ্ঞানপিপাসা মেটানোর আদেশ দিয়েছেন । সুস্পষ্টভাবে তিনি তাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এ কুরআনের জন্যই জীবন উৎসর্গ করতে হবে এবং এ কুরআনের শিক্ষা মোতাবেক জীবন গড়ে তুলতে হবে । এ কারণে দেখা যায়, ঐশী গ্রন্থ হওয়া সত্ত্বেও তাওরাতের দিকে মনোযোগ দেয়ার জন্য হযরত ওমর (রাঃ)-এর প্রতি আল্লাহর নবী (সঃ) অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন । আল্লাহর নবির একমাত্র চাওয়া পাওয়াই ছিল এমন একটি সুসংগঠিত, সুসংঘবদ্ধ মানবগোষ্ঠী গড়ে তলা-যারা হবে সকল ধরনের হীনমন্যতা, কলুষতা ও পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত; যারা হবে আল্লাহর রঙে রঞ্জিত একটি বিপ্লবী মানবগোষ্ঠী । আর আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হতে হলে বিশুদ্ধ কুরআনী প্রশিক্ষন ছাড়া দ্বিতীয় কোন পন্থা নেই । কেননা, এই কুরআনই হল সেই মহাগ্রন্থ, যার মাধ্যমে মহান রাব্বুল আলামীন সরাসরি তার বান্দাদেরকে প্রশিক্ষন দান করেন ।

    আমাদের সবার জানা যে, সেই মহাভাগ্যবান সোনার মানুষেরা স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের জীবন-মরণ সবকিছু এ কুরআনী প্রশিক্ষনের লক্ষে বিলীন করে দিয়ে নিজেদেরকে মানবজাতির শ্রেষ্ঠ আসনে সমাসীন করেন। পরবর্তী যুগের মানুষেরা এই দিক থেকে প্রায় বঞ্চিত এবং বিমুখ । সেই সোনালি যুগ শেষ হয়ে যাওয়ার পর এ পথের পরিচ্ছন্ন স্রোতধারার সাথে কিছু ভেজাল মিশে যায় । তন্মধে উল্লেখযোগ্য হল- গ্রীক দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা, প্রাচীন উপকথা, ইহুদীদের মুখরোচক গল্পকথা (ইসরাইলি বর্ণনা), খ্রিস্টানদের কাছে রক্ষিত আসমানি কিতাবের বিক্ষিপ্ত ও বিকৃত কিছু অংশ ইত্যাদি । পরবর্তীকালের মুফাসসিরিন কেরাম এসব বিষয়গুলোকে তাদের ‘স্থুল পণ্ডিতপূর্ণ’ আলোচনার অংশে পরিণত করেন । ফলশ্রুতিতে এ অবাঞ্ছিত বিষয়গুলো কুরআনি স্রোতধারার সাথে মিশে একাকার হয়ে যায় । এ কারণেই পরবর্তী বংশধর বঞ্চিত হয় কুরআনের নির্ভেজাল জ্ঞান থেকে এবং তারা জ্ঞান অর্জন করতে থাকে সেসব ভেজাল মিশ্রিত জ্ঞান থেকে । এর স্বাভাবিক পরিণতি হল, পরবর্তী বংশধরের মাঝে সাহাবীদের মতো চরিত্র ও গুণসম্পন্ন কোন মানব বা গোষ্ঠী গড়ে ওঠেনি । আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, সোনালি যুগের সোনার মানুষদের সাথে চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও গুনগতমানের দিক থেকে পরবর্তীকালের মানুষদের যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েচে-সেটিই হল এর প্রধান কারন । এ কারণেই বিক্ষিপ্তভাবে দু’একজন মানুষ বিভিন্ন যুগে জন্ম নিলেও সমষ্টিগতভাবে সাহাবীদের মতো কোন মানবগোষ্ঠী পরবর্তীকালে গড়ে ওঠেনি উপরন্তু বিভিন্ন ধরনের অবাঞ্ছিত ও বাতিল সংমিশ্রণের ফলে যেসব ‘মনগড়া ইলম’ তৈরি হয় তাতে ইসলামের আসল রূপ চেনা কঠিন হয়ে পড়ে ।


    দ্বিতীয় কারণঃ

    এ ব্যাপারে অন্য একটি কারণও আমরা অবহেলা করতে পারি না । কারণটি বের করতে হলে আমাদের দেখতে হবে প্রথম যুগের মানুষের জীবনে কুরআনের সাথে তাদের সম্পর্কের ধরন কি ছিল; কুরআন থেকে শিক্ষা গ্রহনের পদ্ধতি কি ছিলো? এক্ষেত্রে পরবর্তীকালের মানুষের সাথে প্রথম যুগের মানুষের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো সাহাবায়ে কেরাম কখনো হাফেয, মাওলানা, ক্বারি, মোল্লা, ইমাম, খতিব, মৌলভি ইত্যাদি হওয়ার জন্য কুরআন পড়েননি । কিংবা নিছক পন্ডিতপুর্ণ জ্ঞানার্জন, বৈজ্ঞানিক তথ্যের মুলসুত্র অনুসন্ধান, আইনশাস্ত্রের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ-এক কথায় নিছক কোন বুদ্ধিভিত্তিক কোন প্রয়োজন বা চাহিদা মেটানোর জন্য কুরআন পড়েননি । বরং বাস্তব পরিচালনার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোন বিষয়ে কি বিধান নাযিল করেছেন,তা জেনে সেভাবে জীবন পরিচালনার জন্য তারা কুরআন পড়তেন । যুদ্ধের ময়দানে একজন সৈনিক যেভাবে কমান্ডারের প্রতিটি হুকুম জীবন বাজি রেখে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে, ঠিক তেমনিভাবে সাহাবিগন কুরআনের প্রতিটি নির্দেশ পালন করতেন । এমন ঘটনাও রয়েছে যে, কেউ কেউ একসাথে দশটি আয়াতের বেশি পড়তেন না। কারন তারা জানতেন যে, একসাথে অনেক সংখ্যক বিধি-নিষেধের ভার বহন করা দুরূহ ব্যাপার । আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর একটি বর্ণনার মাধ্যমে এ তথ্যটি আমরা জানতে পারি । ‘কুরআনের বিধান এসেছে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য’-এ চেতনাই তাদের নৈতিক উন্নতি ও বাস্তবমুখী জ্ঞানের পথ সুগম করে দিয়েছিল । তারা যদি নিছক পন্ডিত্যপুর্ন জ্ঞানার্জন, তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহ কিংবা হাফেয, মাওলানা, ক্বারি, ইমাম, খতিব ইত্যাদি নাম ধারনের জন্য কুরআন অধ্যয়ন করতেন তাহলে এ নৈতিক উন্নতির পথে তারা অগ্রসর হতে পারতেন না ।

    তাছাড়া ‘কুরআন এসেছে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য’ এ উপলব্ধি তাদেরকে কুরআনের বিধি-বিধান জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ করে দিত। ফলে তারা চালচলন, আচার আচরণ, লেনদেন তথা সার্বিক জীবনে কুরআনকে এমনভাবে বাস্তবায়ন করতেন যে কারণে তারা কুরআনের এক একটি বাস্তব দৃষ্টান্তে পরিণত হতেন । তাদের কাছে ঈমান কোন পণ্ডিত্যের জটিল বাক্য কিংবা কুটিল সংজ্ঞাই সংজ্ঞায়িত কোন বিষয় ছিল না। ছিলো না বই-পুস্তকে লেখা নিছক আলোচনার বিষয় । ছিল না অন্তরে ধারণকৃত নিছক উপলব্ধির ব্যাপার; বরং ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক তথা সার্বিক জীবনের আমুল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত একটি বৈপ্লবিক আন্দোলনের নাম ছিল ঈমান ।

    কুরআনের হুকুম-আহকাম যারা নিজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অধ্যয়ন করে না, কুরআন কখনই তাদের জন্য লুকায়িত জ্ঞানভান্ডার খুলে দেয় না । কুরআনকে যারা নিছক পুঁথিগত তাত্ত্বিক আলোচনা, একই শব্দের বিভিন্ন অর্থবোধক এক অসাধারণ গ্রন্থ, সাহিত্যচর্চা, পৃথিবীর আদি ইতিহাস জানার নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র কিংবা নিছক সুর করে পড়ার গ্রন্থ হিসেবে গ্রহন করে, তারা কুরআনের সাথে যথার্থ আচরণ করেন না । কুরআন এমন কোন গ্রন্থ নয় । কুরআন একটি জীবন্ত ও সার্বজনীন জীবনবিধান । কুরআনি আইন জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে মানুষ আল্লাহর দরবারে সর্বাত্নক আত্মসমর্পণ করবে- কুরআন এ জন্যই এসেছে । এ কারণেই আল্লাহ তাআলা সমগ্র কুরআন একত্রে নাযিল করেন নি; বরং প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে অল্প অল্প করে ধাপে ধাপে নাযিল করেছেন ।

    وَقُرۡاٰنًا فَرَقۡنٰهُ لِتَقۡرَاَهٗ عَلَى النَّاسِ عَلٰى مُكۡثٍ وَّنَزَّلۡنٰهُ تَنۡزِيۡلً

    আমি কুরআনকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছি, যাতে তুমি ক্রমে ক্রমে তা মানুষের সামনে পড়তে পারো- আর (এ কারনে) আমি তা পর পর নাযিল করেছি ।
    (বানী ইসরাইল-১৭ ; ১০৬)

    ক্রমবিকাশমান ইসলামি সমাজের নতুন নতুন সমস্যার প্রেক্ষিতে, মানুষের চিন্তাচেতনার পরিবর্তনের ধারার সাথে সংগতি রেখে, সমাজ জীবনের পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পর্যায়ক্রমে কুরআন নাযিল হয়েছে । কোন কোন বিশেষ ঘটনা, বিশেষ বিশেষ প্রশ্নের জবাব কিংবা বিশেষ পরিস্থিতি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য জরুরি দিকনির্দেশনাসহ এক বা একাধিক আয়াত নিয়ে বিভিন্ন সময় আল্লাহর দূত জিবরাঈল (আঃ) এসেছেন । বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে মানুষের মনে উদিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়াও ছিল কুরআনের একটি বিশেষ দিক । মানুষের জীবনে যেসব দোষত্রুটি, ভুলভ্রান্তি রয়েছে, সেগুলোকে হাতে-কলমে ধরিয়ে দিয়ে তা সংশোধনের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর ইচ্ছার সামনে আত্মসমর্পণের কথা বলতে কুরআন এসেছে ।

    এ কারণেই সে সময়ের মুসলমানরা গভিরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, তাদের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি চিন্তা সৃষ্টিকুলের মালিক মহান রাব্বুল আলামিনের সার্বক্ষণিক তদারকিতেই সংগঠিত হচ্ছে এবং তাদের প্রতিটি মুহূর্তই আল্লাহর রহমতের ছায়ায় অতিবাহিত হচ্ছে । দয়াময় রব্বুল আলামিনের সাথে গভির ও সার্বক্ষণিক সম্পর্কের অনুভূতি তাদেরকে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার অদম্য সাহস ও আগ্রহ ঝুগিয়ে ছিল ।

    এভাবেই (খায়রুল কুরুন) সোনালি যুগের সোনার মানুষেরা নিজেদের জীবন কুরআনিক ছাচে গড়ে তুলেছিলেন । কিন্তু অত্যন্ত দুক্ষজনক হলেও সত্য যে, পরবর্তীকালের মুসলমানরা কুরআনকে নিছক জ্ঞানগর্ভ তাত্ত্বিক আলোচনা, বিজ্ঞানের তথ্যসূত্র, তর্ক-বিতর্ক, ফিকহি জটিলতার দুর্ভেদ্য জাল, সেমিনার, সিম্পজিয়াম ও নিছক ওয়াজ-মাহফিলের বিষয়ে পরিণত করে ফেলে । এ কারণেই কুরআন অবিকৃত অবস্থায় বিদ্যমান থাকা এবং কুরআনের যথেষ্ট পাঠ হওয়া সত্ত্বেও সেই আদর্শ সমাজ গড়ে উঠে নি ।


    তৃতীয় কারণঃ

    তৃতীয় যে কারনটি আমরা খুজে পাই, তা অতিব গুরুত্বপূর্ণ । রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর সময় যে ব্যক্তি কুরআনের ছায়া তলে আসতেন, তিনি পুর্বেকার জাহেলি জীবন ও জাহেলি সমাজব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ রূপে সম্পর্ক ছিন্ন করেই আসতেন । কুরআনের ছায়াতলে এসে সম্পূর্ণ নতুন জীবন শুরু করতেন । জাহেলি সমাজের সদস্য থাকাই তিনি যে পাপ- পঙ্কিল পথে চলেছেন সেজন্য হৃদয়ের গভীর থেকে প্রচণ্ড অনুতাপ অনুশোচনা বোধ করতেন । কোন অবস্থায়ই যে আর জাহেলি সমাজ ও তার নেতৃত্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা যাবেনা- তা পূর্ণমাত্রাই বিশ্বাস করতেন । মানবীয় দুর্বলতার কারনে, জীবনের কোন ঘূর্ণিপাক বা কোন প্ররোচনাই পড়ে কখনো যদি ভুল করে কোন জাহেলি আচরণ করে ফেলেতেন, সঙ্গে সঙ্গে অনুতাপ-অনুশোচনায় উৎকণ্ঠিত ও অনুতপ্ত হয়ে উঠতেন এবং ক্ষণকাল বিলম্ব না করে কুরআনের ছায়ায় আশ্রয় নিতেন ।

    এভাবে ইসলাম গ্রহনের সাথে সাথে মানুষের জীবনযাত্রার গতি জাহেলিয়াত থেকে সম্পর্ক ছেদ করে কুরআনমুখী হয়ে যেতো । জাহেলিয়াত থেকে সম্পর্ক ছেদ ও কুরআনি বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ এ কারণেই তাদের পক্ষে সম্ভব হতো যে, তারা ভেবেচিন্তে, বুঝেশুনে মহান রাব্বুল আলামিনের পথে নিজেকে কুরবানি করে দেয়ার মানসিকতা নিয়েই ইসলামে প্রবেশ করতেন । অবশ্য এর অর্থ এ নয় যে, তারা মুশরিকদের সাথে লেনদেন, বেচাকেনা, দেখা-সাক্ষাত সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে অরণ্যে চলে যেতেন । কেননা, বৈষয়িক সম্পর্ক ও আদর্শিক ঐক্যবদ্ধতা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি বিষয় । জাহেলি সমাজ ও তাদের চিন্তা চেতনার সাথে সম্পর্কচ্ছেদের মূল অর্থ হল শিরকবাদী সমাজ ও আদর্শের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে তাওহিদ ভিত্তিক জীবনাদর্শ গ্রহণ এবং নতুন ইসলামি সমাজের আনুগত্য মেনে নেয়া । ইসলাম গ্রহনের অর্থই ছিল এক নতুন জীবনবিধানের সাথে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া এবং সকল প্রকার অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে উঠে এসে এক আলোকিত জীবনে পদার্পণ করা ।

    ইচ্ছে করলেই যে কেউ এ আলোকিত জীবনের পথে পা বাড়াতে পারতো, জাহেলিয়াত থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করতে পারতো- এমনটি ভাবার কোন অবকাশ নেই । ইসলামের পথে পা বাড়ানোর অর্থই ছিল জাহেলি সমাজের নিষ্ঠুর ও নির্মম জুলুম নির্যাতনের শিকার হওয়া । কেউ এ পথে অগ্রসর হলেই তার উপর নেমে আসতো চরম অত্যাচার । এতো দিনের ঘনিষ্ঠ পরিচিত আপনজনরাও হঠাত হয়ে উঠত অন্য চেহারার মানুষ । বহুদিনের পরিচিত সমাজ, হাট-ঘাট সবকিছু তাদের উপর সংকুচিত হয়ে আসতো । চতুর্মুখী বিভীষিকাময় নির্যাতন ও আগ্রাসনের মুখে পড়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েই তারা এ পথে অগ্রসর হতেন। এমনকি মৃত্যুকে হাসিমুখে বরন করে এ সোনার মানুষেরা সত্যকে গ্রহন করেছেন । কোন কিছুই তাদের সংকল্পে সামান্য ফাটল ধরাতে পারেনি ।

    সাহাবাদের মতো মানবসমাজ আর না গড়ে উঠার হয়তো অনেকে আরো অনেক কারণ দেখাতে পারেন তবে সবগুলো ঘুরে ফিরে এই তিনটা মৌলিক কারণের মধ্যেই আবদ্ধ ।

    [collected]
Working...
X