মুসলিমদের বিপর্যয়:
মুসলিম জাতি এক অনন্য জাতি। তাদের রয়েছে সোনালি ইতিহাস, গৌরবময় ঐতিহ্য। তাদের মনোবল ছিল আকাশছোঁয়া, হৃদয় ছিল দৃঢ়চেতা। তারা ছিল সতেজ ও দৃঢ় ঈমানের অধিকারী।তাদের ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রজীবন পুরোটাই ছিল অনুসরণীয়, ঈর্ষণীয় ও সুখ-সমৃদ্ধিতে পূর্ণ। মুসলিম জাতি ছিল বিজয়ী জাতি। অন্যায় ও জুলুমের কাছে নতিস্বীকার তাদের ইতিহাসে নেই। সমগ্র পৃথিবী আমাদের চিনেছে, জেনেছে এ পরিচয়েই। কিন্তু আজ এ কী হচ্ছে! আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে নিগৃহীত, নির্যাতিত ও অধিকারবঞ্চিত সম্প্রদায় হলো মুসলমান। তাদের জান-মাল-ইজ্জত-আব্রু কোনো কিছুরই আজ নিরাপত্তা নেই। মুসলমানরা আজ ইহুদি, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু, শিখ, কমিউনিস্ট- এক কথায় সকল কুফরি শক্তির হাতে মার খেয়ে খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। পৃথিবীর আকাশ-বাতাস মুসলমানের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে, রক্তে লাল হয়ে উঠছে এ জমিন, তবুও যেন তাদের দিকে ফিরে তাকানোরও কেউ নেই।
কোরআনে কারীমে ঘোষণা হচ্ছে,
وَعَدَ اللّٰهُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡکُمۡ وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَیَسۡتَخۡلِفَنَّهُمۡ فِی الۡاَرۡضِ کَمَا اسۡتَخۡلَفَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِهِمۡ ۪ وَ لَیُمَکِّنَنَّ لَهُمۡ دِیۡنَهُمُ الَّذِی ارۡتَضٰی لَهُمۡ وَ لَیُبَدِّلَنَّهُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ خَوۡفِهِمۡ اَمۡنًا ؕ یَعۡبُدُوۡنَنِیۡ لَا یُشۡرِکُوۡنَ بِیۡ شَیۡئًا ؕ وَ مَنۡ کَفَرَ بَعۡدَ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ ﴿۵۵﴾
তোমাদের যারা ঈমান এনেছে ও নেক কাজ করেছে আল্লাহ তাদের প্রতিশ্রæতি দিচ্ছেন যে, তিনি তাদের পৃথিবীর কর্তৃত্ব প্রদান করবেন, যেমন তিনি তাদের পূর্ববর্তীদের দিয়েছেন। তিনি তাদের দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করবেন, যে দ্বীন তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন। আর ভয়ভীতির পরিবর্তে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে, আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। এরপর যে অকৃতজ্ঞ হয় তারাই পাপিষ্ঠ। - সূরা আন নূর : ৫৫।
আল্লাহ তায়ালা কখনোই ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। তিনি মিথ্যা বলতে পারেন না। অতএব, আমাদের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার কারণ আমাদের ঈমান ও আমলের ত্রুটি ও ঘাটতি। যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা তার এ ওয়াদা পূরণ করে দেখিয়েছেন আবার সে গুণ ও বৈশিষ্ট্য হারানোর দরুন মুসলমানদের বিপর্যয়ের সম্মুখীনও করেছেন।
হাকীমুল ইসলাম কারী তৈয়্যব রহ. বলেন, বর্তমান যুগে মুসলমানরা অভিযোগ করে, বিভিন্ন জাতি আমাদের ওপর জুলুম করছে- খ্রিষ্টানরা এই জুুলুম করেছে, হিন্দুরা এই জুলুম করেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, মুসলমানদের হত্যা করেছে। আমি বলি- এ অভিযোগ ভুল। কেউ তোমার প্রতি জুলুম করেনি; তুমি নিজেই নিজের ওপর জুলুম করেছ।
কারণ, যে রূহ ও জীবনী শক্তির কারণে তুমি জীবিত ছিলে, অর্থাৎ কোরআন ও ঈমান, তা তুমি ধ্বংস করে লাশে পরিণত হয়েছ। এখন সবার কর্তব্য হলো, লাশ দাফন করে দেয়া, জ্বালিয়ে দেয়া। লাশ জমিনে পড়ে থাকলে দুর্গন্ধ হয়ে পরিবেশ দূষিত করে তুলবে। কেউ লাশ জ্বালিয়ে দিলে অথবা লাশে আঘাত করলে অভিযোগ কেন?
এ করুণ পরিণতি থেকে পরিত্রাণের উপায়:
হাকীমুল ইসলাম কারী তৈয়্যব রহ. বলেন, নিজের মধ্যে রূহ ও জীবনী শক্তি সৃষ্টি করা। জীবিতের ওপর হামলার দুঃসাহস কেউ করবে না। লাশ পড়ে থাকলে যে কেউ তার ওপর হামলা করবে। তুমি তো লাশের মতো হয়ে গেছ। এখন কেউ জ্বালিয়ে দিলে কাঁদো কেন? আঘাত করলে অভিযোগ করো কেন? তুমি নিজের মধ্যে রূহ ও জীবনী শক্তি সৃষ্টি করো। অর্থাৎ গোনাহ বর্জন করো এবং নেক আমল করো।
তবে পরিস্থিতি হতে উত্তরণ এবং সংকট ও শঙ্কা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মুসলিম জাতির জন্য সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এ যে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন।
এক. এই মুহূর্তে বিশ্বের সকল মুসলমান বিশেষত অপেক্ষাকৃত অধিক সংকটে নিপতিত মুসলমানদের জন্য সর্বপ্রথম ও সর্বাপেক্ষা জরুরী ও কর্তব্য বিষয় হল, আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ, রুজু ইলাল্লাহ তথা একান্তভাবে আল্লাহ অভিমুখী হওয়া, তাওবা ও ইস্তিগফার করা, দুআ করা ও কাকুতি মিনতি সহকারে কান্নাকাটি করা।
কুরআন মজীদ বিষয়টাকে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছে এবং বলছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
হে মুমিনগণ ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।-সূরা বাকারা, আয়াত ১৫৩
অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে-
أَمَّنْ يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ وَيَجْعَلُكُمْ خُلَفَاءَ الْأَرْضِ
বরং তিনি যিনি আর্তের আহবানে সাড়া দেন যখন সে তাঁকে ডাকে এবং তিনিই বিপদ আপদ দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেন।-সূরা নামল, আয়াত ৬২
অন্যত্র বলা হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ
মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা কর-বিশুদ্ধ তাওবা; তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কর্মগুলো মোচন করে দেবেন।-সূরা তাহরীম, আয়াত ৮
স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রীতি ছিল এই যে, যখনই তাঁর সামনে সামান্যতম উদ্বেগের কোন কিছুর আবির্ভাব ঘটত তখন তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং দুআয় মশগুল হতেন।
হযরত হুযাইফা রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত-
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا حزبه أمر صلى
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে যখন কোন উদ্বেগ সৃষ্টিকারী বিষয় উপস্থিত হত তখন তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন।-আবু দাউদ, হাদীস নং ১৩২১
হযরত আবুদ্দারদা রা. কর্তৃক বর্ণিত-
كان النبي صلى الله عليه وسلم إذا كانت ليلة ريح شديدة كان مفزعه إلى المسجد حتى تسكن الريح وإذا حدث في السماء حدث من خسوف شمس أو قمر كان مفزعه إلى المصلى حتى ينجلي.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অভ্যাস ছিল প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়ার রাত হলে তাঁর আশ্রয়স্থল হত মসজিদ যতক্ষণ না ঝড়ো হাওয়া শান্ত হত। আর যখন আকাশে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের ঘটনা ঘটত তখন তাঁর আশ্রয়স্থল হল নামাযস্থল (অর্থাৎ তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং নামায অব্যাহত রাখতেন) যতক্ষণ না সূর্য বা চন্দ্র গ্রহণমুক্ত হয়ে যেত।
অতএব এ মুহূর্তে আমাদের সকলের জন্য জরুরী তাওবা ইস্তিগফার, আল্লাহ-অভিমুখিতা, দুআ ও মুনাজাত। সেই সঙ্গে কুরআন তিলাওয়াতের আমল অব্যাহত রাখা এবং আপদকালীন পঠিতব্য কুরআনের সূরা ও আয়াত বেশী বেশী পাঠ করা। যেমন সূরা ফীল, সূরা কুরাইশ, لا اله الا انت سبحانك انى كنت من الظلمين، نصر من الله وفتح قريب قريب ইত্যাদি।
দুই. দ্বিতীয় জরুরী ও ত্বরিৎ পদক্ষেপের বিষয় হল: তাকওয়া অবলম্বন, গুনাহ পরিহার, গুনাহ হতে আত্মরক্ষা করে চলা। কোন গুনাহকেই সাধারণ ও তুচ্ছ গণ্য না করা।
এক্ষেত্রে হযরত উমার ইবনে আবদুল আজীজ (রাহ.) এর একটি চিঠি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন তাঁর এক সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানের উদ্দেশ্যে। তিনি লিখেছিলেন,
আল্লাহর বান্দাহ উমর ইবনে আবদুল আজীজ এর পক্ষ হতে মানসূর ইবনে গালেবের নামে
তামরা সর্বদা তাকওয়ার উপর অবিচল থাকবে। কেননা তাকওয়া ও আল্লাহভীতিই সর্বোত্তম পাথেয় ও উপকরণ, অধিক কার্যকর কৌশল এবং প্রকৃত শক্তি। সেনাপ্রধান নিজে এবং তার অধীনস্থ সৈনিকেরা যেন শত্রু অপেক্ষা গুনাহকে অধিক ভয় করে। কেননা, শত্রুদের কৌশল, তাদের শক্তি ও আক্রমণ অপেক্ষা গুনাহ অধিক ভয়াবহ। আমরা শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করি তাদের গুনাহর কারণে। তাদের গুনাহ না থাকলে আমরা তাদের সঙ্গে শক্তিতে পেরে উঠতাম না। কারণ আমাদের সৈন্য সংখ্যা ও অস্ত্রশক্তি তাদের তুলনায় কম। গুনাহকর্মে যদি আমরা তাদের সমপর্যায়ের হয়ে যাই তাহলে অস্ত্রশক্তি ও সৈন্যসংখ্যায় তারা আমাদের তুলনায় অগ্রগামী থাকবে। দুশমন অপেক্ষা নিজের গুনাহর ব্যাপারে অধিক সচেতন হওয়া প্রয়োজন। যতদূর সম্ভব অন্য সবকিছু অপেক্ষা নিজের গুনাহর ব্যাপারে অধিক চিন্তিত থাকা উচিৎ।-সীরাতে উমার বিন আবদুল আজীজ, আবদুল্লাহ বিন আবদুল হাকাম (সংক্ষেপিত)
তদ্রæপ সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. সৈন্যসহ যখন দজলা নদীতে ঘোড়া নামিয়ে দিলেন এবং দজলা নদীর পানির উপর দিয়ে ঘোড়া চলতে থাকল আর তাঁরা নদী পার হতে থাকলেন এমনভাবে যেন তাঁরা মাটির উপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন তখন তাঁর পাশে ছিলেন সালমান ফারসী রা.। সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. বললেন,
حسبنا الله ونعم الوكيل، والله لينصرن الله وليه وليظهرن دينه وليهزمن الله عدوه إن لم يكن في الجيش بغي أو ذنوب تغلب الحسنات
আল্লাহ তাআলাই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই সর্বোত্তম তত্ত্বাবধায়ক। আল্লাহর শপথ, আল্লাহ তাআলা তাঁর বন্ধুদের সাহায্য করবেন এবং তাঁর দীনকে সমুন্নত করবেন এবং তাঁর শত্রুদেরকে পরাস্ত করবেন যদি না সেনাবাহিনীর মধ্যে নাফরমানী এবং পুণ্যকর্ম বিনাশকারী গুনাহকর্ম বিদ্যমান থাকে।-দালাইলুন নুবুওয়াহ, আবূ নুআইম আলআসফাহানী
এরূপ বহু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। যার সবগুলোর মর্মার্থ একটিই। আর তা হল, গুনাহকর্ম হতে বিরত থাকা মুসলমানের বিজয়, উৎকর্ষলাভ ও উন্নতশির হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত এবং প্রধান শর্ত।
তিন. আরেকটি জরুরী বিষয় হল, মুসলিম জনসাধারণকে ঈমান বিধ্বংসী ফিতনা সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করা। তাওহীদ ও ঈমানের সঙ্গে তাদেরকে যথার্থরূপে পরিচিত করে তোলা। কুফর কী, কুফরের ভয়াবহ পরিণাম কী সে সম্পর্কে তাদেরকে সম্যক ধারণা দেওয়া। মসজিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে গভীর করে তোলা। আলেম উলামার- সংসর্গ অবলম্বনে উদ্বুদ্ধ করা। এর জন্য দাওয়াত ও তাবলীগী কার্যক্রমের সঙ্গে তাদেরকে যুক্ত করাসহ নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। এ ক্ষেত্রে সাধারণ দ্বীনদার শ্রেণী ও আমাদের যে দায়িত্ব ছিল তিক্ত হলেও সত্য যে, সেই দায়িত্ব পালনে সীমাহীন অবহেলা ও ত্রুটি হয়েছে। পরিণামে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
চার. আরও অনেক জরুরী বিষয়ের মধ্য হতে এই ছোট্ট লেখায় উল্লেখ করার মত সর্বশেষ জরুরী বিষয় হল, আমাদের নতুন প্রজন্মকে দ্বীনের জরুরী বিষয় সম্পর্কে অবহিত করা। দ্বীনী ফরযসমূহ ও ইসলামী নীতি, চরিত্র ও আদর্শ সম্পর্কে অবহিত করা। দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত করা। তাদের মন ও মস্তিষ্কে এ কথা বদ্ধমূল করে দেওয়া যে, মানবজীবনের জন্য কল্যাণকর আদর্শ একমাত্র ইসলামী আদর্শ, ইসলাম ব্যতীত অন্য যে কোন আদর্শের শ্লোগান-তা যতই চিত্তাকর্ষক হোক, ফাঁকা বুলিসর্বস্ব বৈ কিছু নয়। আর এই দায়িত্ব প্রথমত প্রতিটি পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও সন্তান-সন্ততির পিতামাতাকেই গ্রহণ করতে হবে। এবং এটাকে চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থাকরণের ন্যায় অপরিহার্য দায়িত্ব বলে মনে করতে হবে। বরং প্রকৃত সত্য হল, পার্থিব এই বিষয়গুলোর ব্যবস্থাপনা অপেক্ষা অধিক জরুরী সন্তান সন্ততিকে আকীদা বিশ্বাসের তালীম দান, তাদের আকীদা বিশ্বাসকে বিশুদ্ধকরণ রক্ষাকরণ ও শক্তিশালী করণ। এ ব্যাপারে শৈথিল্য কি অবহেলা সন্তান-সন্ততির পার্থিব প্রয়োজনের বিষয়গুলোর ব্যাপারে অবহেলা অপেক্ষা অধিক কুফলবাহী, অধিক ভয়াবহ।
কারণ পার্থিব প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর সম্পর্ক ক্ষণস্থায়ী জীবনের সঙ্গে আর দ্বীনী শিক্ষা ও দীক্ষা এবং আকীদা বিশ্বাসের সম্পর্ক মৃত্যু পরবর্তী চিরস্থায়ী জীবনের সঙ্গে। ঐ জীবনের ভালোমন্দ পরিণামের সঙ্গে।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ
মুমিনগণ, তোমরা রক্ষা কর নিজেরদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে ঐ আগুন হতে যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।
হাদীসে এসেছে-
أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ.
তোমাদের প্রত্যেকেই অধীনস্থদের তত্ত্বাবধায়ক, দায়িত্বশীল ও শাসকের মর্যাদা রাখ। অতএব তোমাদের প্রত্যেককেই তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জবাবদিহী করতে হবে। (বুখারী: ৭১৩৮)
এ ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামকেও এগিয়ে আসতে হবে। জনগণকে সচেতন করণ, পাড়া-মহল্লায় মক্তব প্রতিষ্ঠা করণসহ স্থান ও কাল উপযোগী যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উলামায়ে কেরাম যদি তাদের কর্মপরিধিকে বিস্তৃত করেন তাহলে তাঁরা নিজেরাও নিরাপদ হবেন, দেশও নিরাপদ হবে।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, মাত্রাতিরিক্ত আবেগতাড়িত হয়ে খন্ডকালীন ও তৎক্ষণাৎ কর্মসূচীর অপেক্ষা সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত দীর্ঘস্থায়ী কর্মসূচী গ্রহণের মধ্যেই কল্যাণ নিহিত।
(হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর একটি ভাষণ অবলম্বনে)
সাইয়েদ মুহাম্মদ রাবে হাসানী নদভী হাফি: সকল সমস্যার সমাধান হিসাবে বলেন,
শরীয়তের ওপর আমলই সব সমস্যার সমাধান
মুসলমান ও মুসলিম শব্দদুটি অর্থগতভাবে ঐ ব্যক্তিকে নির্দেশ করে যিনি নিজেকে আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর সন্তুষ্টির সামনে সোপর্দ করে দেন। আরবী ভাষায় ইসলাম শব্দের আভিধানিক অর্থ সমর্পণ করা, সোপর্দ করা। তেমনিভাবে প্রকৃত মুসলিম ঐ ব্যক্তিকে বলে যিনি তার সত্তাকে আল্লাহর নির্দেশনার কাছে সোপর্দ করে দেন। তিনি এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, আমি তাই করব, আমার প্রভু যা চান। আমি সে কাজই করব, আমার প্রভু যা করার অনুমতি দিয়েছেন। যখন আমাদেরকে আত্মসমর্পণ বা নিজেকে আপন প্রভুর সন্তুষ্টির সামনে হাওয়ালা করে দেয়ার ব্যাপার রয়েছে, তখন আমাদের জানা প্রয়োজন আমাদের প্রভু কী বলেছেন? আর কোন ধরনের আমল তিনি আমাদের জীবনের জন্য পছন্দ করেছেন?
আমাদের সমাজে বাস্তবে যা হচ্ছে তা হল, নিছক মুসলিম ঘরে জন্ম নেয়ার দ্বারাই মুসলমান সাধারণত আশ্বস্ত হয়ে যায়। আর এতেই তারা মনে করে থাকে আমরা মুসলমান। যখন আমরা মুসলমান তখন আল্লাহ তাআলার ওপর যেন আমাদের এই হক প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, তিনি আমাদের সঙ্গে রহম, দান ও সাহায্যমূলক আচরণ করবেন। কারণ আমরা মুসলমান। কিন্তু এ বিষয়টি সাধারণত ভুলে যাই যে, মুসলমান (মুসলিম) দ্বারা উদ্দেশ্য শুধু এই নয় যে, মুসলমান মা-বাবার ঘরে জন্ম হয়েছে। বরং মুসলমানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিজেকে আল্লাহ তাআলার নির্দেশের কাছে সোপর্দ করে দেয়া।
সুতরাং আমরা আমাদের জীবনের হিসাব কষে বলি, আমরা কি আমাদের নিজেদেরকে আল্লাহর নির্দেশের সামনে সোপর্দ করে দিয়েছি? মুসলমানদের শান এটা বলা হয়েছে, বরং তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সে যেন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সঙ্গে এই পরিমাণ মহববত রাখে, যা তার পিতামাতা, সন্তান এবং আত্মীয়-স্বজনের চেয়েও বেশি হয়। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে,
لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَلَدِهِ وَوَالِدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
‘তোমরা ঐ পর্যন্ত পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তোমাদের কাছে তোমাদের পিতামাতা, আপন সন্তান এবং সমস্ত মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হব।’ (বুখারী:১৫, মুসলিম:১৭৮)
আর যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে আমাদের এই পরিমাণ মহব্বত হবে তখন এটা স্পষ্ট যে, আমরা তাঁর ইরশাদাতের বিরোধিতা করতে পারব না। বরং আমাদের কারো জন্য এমন কোনো কাজ করা উচিত হবে না যা রাসূল সা. এর হিদায়াত ও ইরশাদের বিরোধী হয় কিংবা যা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পছন্দ করেননি। আর যদি আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পছন্দের পরিপন্থী কোনো কাজ করি তাহলে এর অর্থ হলো-প্রকৃত পক্ষে আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঐ মহববত করি না যে মহববতের নির্দেশ আমাদেরকে দেয়া হয়েছে। সে মহববত নিজের সন্তান-সন্তুতি এবং পিতামাতাকে মহববতের চেয়েও বেশি।
এ ব্যাপারে প্রথমত প্রয়োজন হল আমাদের ঐ আহকামসমূহ জানা যে আহকামের ওপর আমল করায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হুকুম বাস্তবায়ন করা হয়। আর যার ওপর আমল করা ব্যতিরেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে আমাদের প্রকৃত মহববত প্রমাণিত হবে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মহববতই যদি আমাদের জীবনে অর্জিত না হয় তাহলে আখেরাতে আমাদের কী ফায়দা হাসিল হবে?
শুধু আহকাম জেনে নেয়ার দ্বারাই কাজ চলবে না। মাসায়েল জেনে নেয়ার প্রয়োজন এজন্য যে, সে অনুযায়ী আমল করতে হয়। এটা বুঝা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর নুসরত ও মদদ, রহম ও করমের ওয়াদা করেছেন ভালো কাজের ভিত্তিতে। আর ভালো কাজের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ পালন করা। যখন এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে তখনই আল্লাহর সাহায্য ও দয়া আমাদের ওপর হবে। আল্লাহ না করুক, আমরা যদি আল্লাহর হুকুম পালন না করি এবং তাঁর অবাধ্যতা করি, আল্লাহর রাসূলের হিদায়াতের বিরুদ্ধাচরণ করি, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের রহম ও করমের আশা আমরা করতে পারি না। আমরা তাঁর নাফরমানি করব আর তিনি আমাদের ওপর রহম করবেন-এটা কিভাবে হয়? এটা কি যুক্তিসঙ্গত কোনো কথা?
আমাদেরকে জীবনের প্রকৃত পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। আমাদের দেখতে হবে আমরা আল্লাহর নির্দেশের ওপর কতটুকু আমল করছি? আমরা তাঁর মর্জিকে আমাদের মর্জির ওপর কোথায় কোথায় প্রাধান্য দিচ্ছি? তাঁর মর্জিকে যদি নিজেদের মর্জির ওপর প্রাধান্য না দেই তাহলে তাকে আনুগত্য বলবে না। আনুগত্য সেটাকেই বলবে যখন আমরা আল্লাহ ও রাসূলের মর্জিকে সব জিনিসের ওপর প্রাধান্য দিব। ব্যয়ের বিষয় হোক, আমদানি প্রসঙ্গ হোক, কারো সঙ্গে লেনদেনের ব্যাপার হোক অথবা অন্য যেকোনো বিষয় হোক, জীবনের অসংখ্য দিক রয়েছে, আমাদেরকে প্রত্যেক দিকে এই খেয়াল রাখতে হবে যে, আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিব। আমরা আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টিকে যে পরিমাণ প্রাধান্য দিব তাঁর নুসরত, মদদ এবং করমও আমাদের ততটুকুই হাসিল হবে। আমরা যদি ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাব যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানরা তাদের উত্তম জীবনের প্রমাণ পেশ করতে পেরেছে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর রহম, করম ও নুসরত তাদের সঙ্গী হয়েছে। কুরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে ওয়াদা করেছেন, ‘তোমরা যদি ভালো কাজ কর তবে আমি তোমাদেরকে পরিতৃপ্ত করে দিব, আর যদি মন্দ কাজ কর তাহলে তোমাদেরকে পাকড়াও করা হবে এবং শাস্তি দেয়া হবে।’
মুসলমানদের অবস্থা বলে দেয়, তাদের সমস্ত বিপদাপদ, পেরেশানী, ক্ষয়ক্ষতি এবং তাদের অপদস্থতা আমরা যেখানেই তাদের নাফরমানি ও বদ আমলীর প্রতিদান। এখানে মানুষের সম্পর্ক সরাসরি তার প্রভুর সঙ্গে। সে যদি তার প্রভুর নাফরমানি না করে তবে তার অবস্থা পরিবর্তন হয়ে যায়। এ গোটা দুনিয়া আল্লাহ তাআলার গোলাম। এই দুনিয়া এবং সমস্ত বিশ্ব ঐ সময় যুৎসই হবে যখন আমরা আল্লাহর নির্দেশনা মোতাবেক আমাদের জীবনকে যুৎসই বানাব। সুতরাং আমাদের জন্য উচিত হল, ওলামায়ে কেরামের কাছ থেকে মাসায়েল জেনে নিজেদের জীবনকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের মোতাবেক পরিচালিত করা।
আপনি ইতিহাস পড়ে দেখুন, দেখবেন উপমহাদেশের মুসলমানদের ইতিহাস উত্থান-পতনের ইতিহাস। তাদের সামনে বড় সমস্যাও এসেছে আবার অত্যন্ত প্রাচুর্যপূর্ণ অবস্থাও হয়েছে। আপনি এগুলো পর্যালোচনা করলে দেখবেন, যখন আল্লাহর মর্জি মোতাবেক জীবন অতিবাহিত হয়েছে তখন আল্লাহর রহম ও বরকতের ধারা বর্ষিত হয়েছে, সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ হয়েছে। পক্ষান্তরে যখন নাফরমানি করেছে তখন সমস্যা ও প্রতিকূলতা, বিপদ ও পেরেশানীতে চারদিক ছেয়ে গেছে।
বর্তমানে উম্মতের অবস্থা হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য এবং তার নির্দেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে অবস্থানে থাকার কথা সে অবস্থান থেকে তারা আজ অনেক দূরে। এজন্য আমরা লক্ষ করছি, আমাদের জীবন আজ সমস্যাসঙ্কুল। এর ওপর যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে জানতে পারব এক্ষেত্রে আমাদের অমনোযোগিতার বেশ দখল রয়েছে। আমাদের উচিত নিজেদের জীবন পর্যালোচনা করে তাকে শরীয়তের মোতাবেক বানানোর প্রচেষ্টা করা। কারণ এছাড়া কোনো উপায় নেই।
ইসলামী শরীয়তের যে সমস্ত আহকাম রয়েছে এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের দায়িত্ব তো হচ্ছে, সেগুলো সংরক্ষণ করা, মানুষকে তালীম দেয়া, এর প্রচার-প্রসারে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক উদ্যোগ গ্রহণ করা। আর মুসলিম জনসাধারণ তথা সকল মুসলমানের জিম্মাদারী হল সেসব আহকাম জেনে এর ওপর পরিপূর্ণভাবে আমল করা এবং নিজের বাস্তব জীবনে এগুলোর বাস্তবায়ন করা। কারণ এর বাস্তবায়নের ওপরই এ দুনিয়ায় ইজ্জত-সম্মান এবং পরকালে কামিয়াবী ও সমৃদ্ধি হাসিল হবে। আর সবচেয়ে বড় অর্জন তো হল আখেরাতে আমরা আল্লাহর অসন্তুষ্টি এবং আযাবে নিপতিত হব না। এর পাশাপাশি এই ইহজগতও সম্মান এবং প্রশান্তির সঙ্গে কাটবে। কিন্তু তা তখনই হবে আমরা যখন এর (শরীয়াত) ওপর আমল করব। আমাদের সকলের ফরজ একটিই-নিজের জীবনটাকে পর্যালোচনা করে দেখা যে, আমরা শরীয়াতে ইসলামীর ওপর কতটুকু আমল করছি? শরীয়াতে ইসলামী বলা হয় জীবনের জন্য ইসলামী আহকামকে। অর্থাৎ আল্লাহ ও রাসূলের আহকামের নামই শরীয়াত। সুতরাং আমাদের দেখতে হবে, আমরা শরীয়াতে ইসলামীর ওপর কতটুকু আমল করছি। গোটা জীবনটাকে যাচাই-বাছাই করে এতে যে ত্রুটি ও বিচ্যুতি নজরে আসবে তা দূর করার প্রচেষ্টা চালানো। এর ফলাফল এই হবে যে, দুনিয়াতেও আমরা সম্মান, প্রতিপত্তি ও প্রশান্তি অর্জন করব আর পরকালেও হাসিল করতে পারব পরম কাক্সিক্ষত কামিয়াবী।.... ( শেষ)
আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে নিপতীত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো, অনর্থক অধিক রাত্রি জাগারণ ও দিনের শুরুরাংশ ঘুমে অতিবাহিত করা।
বিপর্যস্ত মুসলিম জাতি উপরোক্ত উপায় অবলম্বনের পাশাপাশি যখন নিজেদের ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ করবে। রাতে দ্রæত শুয়ে যাবে এবং ভোর রাতে আল্লাহর দরবারে দন্ডায়মান হবে। ফজরের পরে ঘুম না গিয়ে আল্লাহর বন্টিত বরকত লুফে নিবে তবেই আমরা উঠে আসতে পারবো।
সবশেষে আমি আমাদের বিপর্যয়ের কারণ হিসাবে একটা হাদীস উল্লেখ করছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
يَقُولُ: إِذَا تَبَايَعْتُمْ بِالْعِينَةِ، وَأَخَذْتُمْ أَذْنَابَ الْبَقَرِ، وَرَضِيتُمْ بِالزَّرْعِ، وَتَرَكْتُمُ الْجِهَادَ، سَلَّطَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ ذُلًّا لَا يَنْزِعُهُ حَتَّى تَرْجِعُوا إِلَى دِينِكُمْ،
যখন তোমরা ঈনা পদ্ধতিতে ব্যবসা করবে, গরুর লেজ আঁকড়ে ধরবে, কৃষিকাজেই সন্তুষ্ট থাকবে এবং জিহাদ ছেড়ে দিবে তখন আল্লাহ তোমাদের উপর লাঞ্ছনা ও অপমান চাপিয়ে দিবেন। তোমরা তোমাদের দ্বীনে ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহ তোমাদেরকে এই অপমান থেকে মুক্তি দিবেন না। (আবু দাউদ:৩৪৬২)
হাদীসে বর্ণিত সকল কারণ আমাদের মাঝে পাওয়া যায়। যতদিন আমরা নিজেদেরকে দ্বীনের উপর নিয়ে আসতে না পারবো এবং ঈনা পদ্ধতিতে ব্যবসা, গরুর লেজ আকড়ে ধরা ও কৃষি কাজের উপর সন্তুষ্ট থাকবো এবং জিহাদ ছেড়ে দিয়ে আরাম আয়েশে যিন্দেগী কাটানোর ফিকির করব। ততদিন আমরা বর্তমান এই পরিস্থিতি থেকে উঠে আসতে পারবোনা।
সুতরাং আমাদেরকে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ফিরে পেতে শরীয়াহ অনুযায়ী নিজের জীবনকে পরিচালনা করতে হবে এবং অহেতুক গল্প-গুজবে কিংবা আড্ডায় রাত না কাটিয়ে দ্রুত ঘুমিয়ে যেতে হবে, ভোর রাতে আল্লাহর দরবারে রোনাজারী করে ও ফজরের পরের সময় যিকির ও আযকারে কাটিয়ে আল্লাহ প্রদত্ত¡ বরকত লূফে নিতে হবে।
মুসলিম উম্মাহর প্রতি বিশেষ নসীহা।
হে প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনেরা! বর্তমান যুগের কথিত আধুনিক সভ্যতা আমাদেরকে দ্বীন ইসলাম থেকে ধীরে ধীরে বহুদূরে ঠেলে দিয়েছে। ফলে আমরা দ্বীন ও ইসলামের বিধানাবলীর তোয়াক্কা না করে পশ্চিমা কৃষ্টিকালচারকে নিজেদের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছি। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জিবনে রয়েছে আমাদের জন্য অনুপম আদর্শ।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيراً﴿২১﴾
তোমাদের জন্য আল্লাহর রসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের আশা রাখে আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে। ( সূরা আহযাব:২১)
আজ আমরা সভ্যতার ফাঁদে পড়ে নিজেদের ঈমান আমল হারাতে বসেছি। নিজেদেরকে কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী পরিচালনা করার পরিবর্তে পশ্চিমাদের আদর্শ অনুযায়ী পরিচালনা করছি। শুধু তাই নয়, বরং তাদের মত জীবন-যাপন করাকে গর্ব ও অহংকারের বিষয়বস্তু বানিয়ে নিয়েছি। অথচ একজন মুসলিম হিসাবে আমাদের করণীয় হলো, আমরা সকল ক্ষেত্রেই কুরআন-সুন্নাহকে প্রাধান্য দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুপম আদর্শের পরিপূর্ণ অনুসরণ করব।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
হে নবী! আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসকল ক্ষমা করবেন, বস্তুতঃ আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আলে-ইমরান:৩৩)
যান্ত্রিকতার এই যুগে আমরা ইউরোপীয় সভ্যতার পদাঙ্ক অনুসরণে ঘুমকে বিলম্বিত করে ফজরের নামাযের পর পর্যন্ত টেনে নিয়েছি। যে রাতকে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন আমাদের জন্য আরামদায়ক বানিয়েছেন, দিনের বেলার ক্লান্তি দূরিকরণে রাতকে আমাদের ঘুমের জন্য তৈরী করেছেন, তা আমরা মোবাইল স্ক্রল করতে করতে কিংবা চায়ের দোকানে, রাস্তার মোড়ে অথবা ঘরের মাঝে গল্প-গুজবে কাটিয়ে দিচ্ছি। ফলে আমাদের ফজরের নামাযের সময় মসজিদগুলো বিরাণ হয়ে থাকে। কোন কোন মসজিদে তো ফজরের সময় ইমাম সাহেব আর মুআজ্জিন সাহেব ব্যতিত কারো উপস্থিত হওয়ার সুযোগ হয়না। কিন্তু যদি আমরা আল্লাহর রাসূলের অনুসরণে দ্রুত ঘুমিয়ে যেতাম এবং শেষ রাতের ও তাহাজ্জুদের গুরুত্ব দিতাম। তাহলে ফজরের সময় আমাদের মসজিদগুলোর এ করুণ অবস্থা হতোনা। অথচ আল্লাহ তাআলার নিকট যুবক বয়সের ইবাদত বন্দেগী অনেক প্রিয়। যে সাত শ্রেণীর লোকদেরকে আল্লাহর ছায়াতলে আশ্রয় দান করবেন, তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হল ঐ যুবক যে তার যৌবনকালকে আল্লাহ তাআলার ইবাদত বন্দেগীতে কাটিয়েছে। গুনাহের প্রবল স্রোতে যে গা ভাসিয়ে দেয়নি। কিন্তু আফসোসের বিষয় হল, আজকের অনেক তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী সময়ের যথাযথ কদর করছে না। বিশেষত তারা রাতকে অবাধ মনে করে। ইন্টারনেটের বিষাক্ত ছোবল তাদের ঈমান-আমল এবং আখলাক সবকিছুই কেড়ে নিচ্ছে। ডিভাইসের স্পর্শে রাতের পর রাত তারা নষ্ট করে দিচ্ছে। রাতকে দিন বানাচ্ছে আর দিনকে রাত। আল্লাহ তাআলার নেয়ামকে তারা পরিবর্তন করে দিচ্ছে। জীবনের এই বক্র ধারা থেকে আল্লাহ তাদের ফিরে আসার তাওফীক দিন। আসুন জীবনকে সে স্রষ্টার নিকট সঁপে দিই, যিনি আমাদের জীবন দান করেছেন।
بقدرِ الكدِّ تكتسبُ المعالي ومن طلب العلا سهر الليالي
ومن رام العلا من غير كد أضاع العمر في طلب المحال
চেষ্টা অনুপাতে মর্যাদা অর্জন হয় যে মর্যাদা প্রত্যাশা করে সে (ভোর) রাতে জাগে।
যে ব্যক্তি কষ্ট করা ছাড়া উঁচু মর্যাদা লাভের আকাঙ্খা করে, সে অসম্ভব জিনিস অন্বেষণে জীবন নষ্ট করে।