বোন তোমার নারীত্বের আঁচল এত সুন্দর কেন?
১৩ তম পর্ব
এক.
বাসের মাঝ বরাবর বসে আছি আমি। জানালার ফাঁকা দিয়ে ধূলোবালি আসায় ভার্সিটি পড়ুয়া এক ভাই বন্ধ করে দিয়েছেন। এদিকে বাহিরের প্রখর রৌদ্রের তাপ। অঝোরে ঘামছি। আমার একটু সামনেই একজন মা তাঁর আট-দশ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে বসে আছেন। সবার মতো ছেলেটির অবস্থাও নাকাল। শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। মমতাময়ী মা সেটা দেখার পর অস্থির হয়ে উঠলেন। কিছুক্ষণ ওড়নার আঁচল দিয়ে বাতাস করার পর এখন বই দিয়ে বাতাস করছেন। একটু পর পর ঘাম মুছে দিচ্ছেন। ছোট্ট একটা কাপড়ের টুকরা দিয়ে মাথা ঢেকে দিয়েছেন। তারপরও হালকা হালকা রৌদ্র লাগছে। এবার নিজের দুহাত সন্তানের মাথায় তুলে রাখলেন। কিছুটা এখন শান্ত হলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি সন্তানের জন্য এক মায়ের দরদ। আহ! কি নিঃস্বার্থ ভালবাসা। ইশ! কি পরম মমতা!
দুই.
ঐদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাজারে যাচ্ছি। বস্তির এক গলিতে আসা মাত্রই দেখি একজন মা তার সন্তানকে নিজের পায়ের সেন্ডেল পড়িয়ে দিচ্ছেন।
অথচ বাচ্চার বয়স হবে মাত্র ৪/৫ বছর আর তার জুতার সাইজ হলো ৩৮/৪০। ভাবলাম কি ব্যাপার তিনি এমন করলেন কেন! পরে খালি পাঁয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখি রাস্তার কার্পেটিং এতটাই গরম যে, দু-এক কদম খালি পাঁয়ে হাঁটলে পাঁয়ে ফোস্কা পড়ে যাবে তৎনগদ। অথচ ঐ মা পুরোটা রাস্তা খালি পাঁয়ে হেটেছেন আর সন্তানকে নিজের জুতা পড়িয়ে কষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন। এরই নাম মা! এরই নাম নারী! একেই বলে নারীত্বের বাঁধন!
তিন.
ঢাকার মিরপুর, শ্যামলীতে ঐতিয্যবাহী স্বায়ত্তশাসিত শিশু হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে দু-বছর বয়সী এক শিশুবাচ্চা। পাশের বেডে আমার এক আত্মীয়ের নবজাতক। ঘটনাক্রমে আমাকে দুদিন থাকতে হলো সেখানে। এ দুদিনের মধ্যে ঐ বাচ্চাকে এক মুহূর্তের জন্য কান্না থামাতে দেখেনি কিন্তু তার মা তাকে থামানোর জন্য যত্তধরণের চেষ্টা আছে সবই করে যাচ্ছে, সবই বিফল হচ্ছে। আমি বিরক্ত হয়ে দশ বারোবার বাহিরে চলে গেলাম। এসে আমার যেই সেই দেখি তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম এই মা দুদিনের মধ্যে একটিবারের জন্য তার ছোট্ট বাচ্চা উপর রাগ করেনি। দু এক পলক ঘোমাতেও দেখিনি। তখনই মনে মনে ভাবলাম- নারীত্বের আঁচল এত শক্ত!
চার.
আমার এক আত্মীয়ের বাচ্চা জন্মগত বোবা ও লেংরা। তার স্বামীর মুখ থেকে এ কথাগুলো শোনা। তার বউ তার এ ছেলেকে নিয়ে অনেক দূর স্বপ্ন দেখে। সুস্থ সবল ছেলের মতই আদর সোহাগ করে। পরম যত্নে খাইয়ে দেয়। তার নাপাক কাপড়-চোপড় ধোয়ে দেয়। অথচ বাচ্চা ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে একবারও ফিরে তাঁকাতে পারেনা। ছয় বছর হলো আজঅব্দি মা কোনোদিন কারো বাড়িতে বেড়াতে যায়নি। আমি শুনে কিছুটা অবাক হয়নি বরং অনেকটাই আশ্চর্য হয়েছি। যেদিন তার এ বাচ্চা মারা যায় এ দিন থেকেই সে নিঃশব্দ নিসঙ্গপনা হয়ে যায়। তার চোখ দিয়ে অশ্রু এখনো ঝরে তবে ঝরঝর করে নয় বরং রক্তক্ষরণ হয়ে। তার এ ঘটনা শুনে আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম-নারী তোমার নারীত্বের বাঁধন এত মমতাময় কেন?
পাঁচ.
এই তো গত শীতে চিতই পিঠা খাওয়ার খুব সখ জেগেছে। তাই কাছের এক বন্ধুকে নিয়ে চলে গেলাম দূর গ্রামাঞ্চলে। কনকনে শীত আর ঘনঘন ধোঁয়াশায় সবকিছুই ধোঁয়াসা। দু তিন পা হাঁটি আর রাস্তা খোঁজে বের করি। হঠাৎ কাচুমাচু গায়ে কে যেন মাটির এক হাঁড়ি নিয়ে শরষে ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে রাস্তায় উঠছে। কৌতুহল বশত এগিয়ে গেলাম। যাওয়া মাত্রই দেখি অল্প বয়স্ক এক মহিলা মাথায় হাঁড়ি আর পিঠে ওড়না দিয়ে পেচানো ২ বছরের শিশু বাচ্চা। বাচ্চার শুধু নাকের ঢগাটা দেখা যাচ্ছে। চট করে মহিলা বলে ফেললেন-বাবারা! তোমরা খেঁজুরের রস খাবে? তৃপ্তিভরে খেয়ে বাকি রসটা পলিতে করে নিয়ে আসলাম। চিতই পিঠা আর খাওয়া হলো না। তখনই মাথায় ধরলো- নারী তার নারীত্বের আঁচল কি মধুর!
ছয়.
আমার ছোট্ট বোনের কথাই বলি। ভারি মিষ্টি একটা মেয়ে। মুখের রস আখের রসের চাইতেও বেশি। পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিতে হয় আমি শিখেছি তার কাছ থেকে। ছোট্ট খুকী আর শ্রদ্ধয়দের আপ্যায়নে বেশ কিছু জাদুকরী কারিশমা রয়েছে তার। উপস্থাপন আর আপ্যায়ন না দেখলে তফাৎ বুঝা অসম্ভব। তিনি আমাকে মজার মজার ঘটনা শুনান-এখন না কিন্তু যখন আমি ছোট ছিলাম। আর কিছুদিন পরই তিনি বুড়িদের কাতারে নাম লেখাবেন আর আমি তার অতীতের স্থানে। সেই ভোর সকালে আপুর কাছে একটা মহিলা তার ছয় বা সাত বছরের এক মেয়েকে দিয়ে চলে যেতো। সারাদিন কোনো খোঁজখরব নাই, না খাওয়ার না দাওয়ার না! সন্ধ্যায় কোথ্থেকে চট করে এসে হুট করে সন্তানকে নিয়ে চলে যেতো।
বিষয়টা আমার কাছে খুব আচানক লাগলো। মন রহস্য উদঘাটনের প্যারায় পড়ে গেলো। আর মহিলা যে সময়টাতে আসে ঐ সময় আমার বাড়িতে কম সময়ই থাকা হয়। ঐদিন বিকাল আর বাহিরে বের হলাম না, মহিলা আসা মাত্রই জিজ্ঞেস করে বসলাম-আন্টি আপনি সারাদিন কি করেন? কোথায় থাকেন? মহিলা ওড়নাটা দিয়ে ঘাম মুছার ভান করে আমতা আমতা করে বললো- বাবা এই তো! আমি বললাম- এই তো কি? আন্টি জানালে খুব খুশি হবো। একটা নিঃশেষ ছেড়ে বললো-ওর বাবা মারা গেছে তিন বছর হলো। দুই সন্তানের সে বড়, আর ছোটটা আমার সাথেই থাকে। আমি ইট ভাটায় কাজ করি, প্রতিদিন কিছু পয়সা দেন মাহাজন। তা দিয়ে চলতে পারি। তার সম্পর্কে আপুর কাছে আরো বিস্তারিত জানতে পারলাম। তখনই ভাবলাম-নারী তোমার তুলনা করাই কম হয়ে যায়! এদিকে জানতে পারলাম বোন আমার তাকে ৩ বছর যাবৎ ফিরে কুরআন শিখাচ্ছে। অথচ অবস্থা এমন, যে কেউ দেখলে মনে হবে বাচ্চাটা তার নিজের পেটের বাচ্চা।
প্রিয় বোন!
মনে তো চায় তাদের অসহায়ত্বের জায়গায় গিয়ে একটু আনন্দ ঢেলে দিতে তবে তা কি কখনোই সম্ভব! খোদায়ি ফরমান কেউ কি নিজ হাতে সাঁজাতে পারে! খোদায়ি দাবি অন্য কেউ কি পূরণ করতে পারে! অসম্ভব শব্দের ব্যবহারের দাবি ছাড়া আর কিছুই করা সম্ভব না। তবে একটি পথ খোলা আছে, যা তাদের জন্যই সৃষ্টি, নারী তার নারীত্বের আঁচল ফিরিয়ে আনা। নারী তার নারীত্বের বাঁধন চিনতে পারা।।
বোনদের এ ঘটনাগুলো শুনে যেমন মনটা হুহু করে কেঁদে উঠে অপরদিকে আনন্দের আতিশয্যে দু-চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে। কারণ এমন কিছু বোন আছে যারা তার নারীত্বের আঁচলে দ্বীনের ছোঁয়া লাগাতে বেশ তৎপর। আবার এমন কিছু বোন আছে যারা তার নারীত্বের বাঁধন ধর্মের রশি দিয়ে বাঁধতে বদ্ধপরিকর। পরিবার গঠনের রাজকীয় কল্পনা অন্তরে ঠায় না দিয়ে শরীয়াহ মোতাবেক পরিবার চালানোর বৈধ চিন্তা সারাক্ষণ মাথায় ঘুরঘুর করে।
উপরোক্ত দুটি ঘটনাই যথেষ্ট নারীদের ত্যাগের প্রমাণে-তাদের এ কুরবানীর পথটা যদি একটু ঘুরিয়ে দেয়া যায়, তাদের এ পরিশ্রমের মনমানসিকতার রুপটা যদি একটু সাঁজিয়ে দেয়া যায় তাহলে তারাও যানিরা ও দাওসিয়া রাদিআল্লাহু আনহার মত হতে বেশিদিন সময় লাগবে না। ময়দানে উম্মে আম্মারার মত হতে কাল বিলম্ব করবে না। সন্তানের বেলায় ইমাম শাফীর মায়ের মত দূরদর্শী হতে অস্বীকার করবে না। আম্মাজান আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহার মত চৌকান্না ও গুণবতী হতে দিনক্ষণ লাগবে না।
বোন তুমিই পারো তোমার সতীর্থ নারীদের রুপ লাবণ্যের কদর শিখাতে। ত্যাগ আর বিসর্জনের পথগুলোকে দ্বীনি নালায় সংযোগ করিয়ে দিতে।
তুমি যদি হও সন্তানের বেলায় ধর্মীয় কষ্টি পাথর তাহলে সে তো হবে আল্লাহ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাতী ইমাম হাসান হুসাইন রা. এর মত স্বর্গীয় পুরুষ। তুমি যদি হও স্বামীর বেলায় শরীয়ার পরশ পাথর তাহলে সে তো হবে খালেদ বিন ওয়ালিদ রা. এর মত কালজয়ী ধর্মযোদ্ধা।
বোন তুমি জানো! তোমার মনের খুঁটির সাথে রণাঙ্গনের খুঁটির যোগসূত্র কতটা প্রয়োজন? তোমার আত্মায় রয়ে যাওয়া আশাগুলো বাস্তবে রুপ দিতে কতটা উঁচু মনের হওয়া প্রয়োজন? তোমার পেটের সলাহিয়াত যতটুকু তোমার সন্তানের ভবিষ্যত রাজত্ব ততটুকু। তোমার হৃদয়ের ইখলাছিয়্যাত যতটুকু তোমার সন্তানের ভবিষ্যত গড়বে ততটুকু। সুতরাং নারী তোমার নারীত্বের আঁচল এত সুন্দরই হয়েছে নারীর উঁচু মনোভাবের ওপর ভর করে। অথচ তুমি কিনা তার থেকে এত দূরে?
১৩ তম পর্ব
এক.
বাসের মাঝ বরাবর বসে আছি আমি। জানালার ফাঁকা দিয়ে ধূলোবালি আসায় ভার্সিটি পড়ুয়া এক ভাই বন্ধ করে দিয়েছেন। এদিকে বাহিরের প্রখর রৌদ্রের তাপ। অঝোরে ঘামছি। আমার একটু সামনেই একজন মা তাঁর আট-দশ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে বসে আছেন। সবার মতো ছেলেটির অবস্থাও নাকাল। শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। মমতাময়ী মা সেটা দেখার পর অস্থির হয়ে উঠলেন। কিছুক্ষণ ওড়নার আঁচল দিয়ে বাতাস করার পর এখন বই দিয়ে বাতাস করছেন। একটু পর পর ঘাম মুছে দিচ্ছেন। ছোট্ট একটা কাপড়ের টুকরা দিয়ে মাথা ঢেকে দিয়েছেন। তারপরও হালকা হালকা রৌদ্র লাগছে। এবার নিজের দুহাত সন্তানের মাথায় তুলে রাখলেন। কিছুটা এখন শান্ত হলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি সন্তানের জন্য এক মায়ের দরদ। আহ! কি নিঃস্বার্থ ভালবাসা। ইশ! কি পরম মমতা!
দুই.
ঐদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাজারে যাচ্ছি। বস্তির এক গলিতে আসা মাত্রই দেখি একজন মা তার সন্তানকে নিজের পায়ের সেন্ডেল পড়িয়ে দিচ্ছেন।
অথচ বাচ্চার বয়স হবে মাত্র ৪/৫ বছর আর তার জুতার সাইজ হলো ৩৮/৪০। ভাবলাম কি ব্যাপার তিনি এমন করলেন কেন! পরে খালি পাঁয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখি রাস্তার কার্পেটিং এতটাই গরম যে, দু-এক কদম খালি পাঁয়ে হাঁটলে পাঁয়ে ফোস্কা পড়ে যাবে তৎনগদ। অথচ ঐ মা পুরোটা রাস্তা খালি পাঁয়ে হেটেছেন আর সন্তানকে নিজের জুতা পড়িয়ে কষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন। এরই নাম মা! এরই নাম নারী! একেই বলে নারীত্বের বাঁধন!
তিন.
ঢাকার মিরপুর, শ্যামলীতে ঐতিয্যবাহী স্বায়ত্তশাসিত শিশু হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে দু-বছর বয়সী এক শিশুবাচ্চা। পাশের বেডে আমার এক আত্মীয়ের নবজাতক। ঘটনাক্রমে আমাকে দুদিন থাকতে হলো সেখানে। এ দুদিনের মধ্যে ঐ বাচ্চাকে এক মুহূর্তের জন্য কান্না থামাতে দেখেনি কিন্তু তার মা তাকে থামানোর জন্য যত্তধরণের চেষ্টা আছে সবই করে যাচ্ছে, সবই বিফল হচ্ছে। আমি বিরক্ত হয়ে দশ বারোবার বাহিরে চলে গেলাম। এসে আমার যেই সেই দেখি তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম এই মা দুদিনের মধ্যে একটিবারের জন্য তার ছোট্ট বাচ্চা উপর রাগ করেনি। দু এক পলক ঘোমাতেও দেখিনি। তখনই মনে মনে ভাবলাম- নারীত্বের আঁচল এত শক্ত!
চার.
আমার এক আত্মীয়ের বাচ্চা জন্মগত বোবা ও লেংরা। তার স্বামীর মুখ থেকে এ কথাগুলো শোনা। তার বউ তার এ ছেলেকে নিয়ে অনেক দূর স্বপ্ন দেখে। সুস্থ সবল ছেলের মতই আদর সোহাগ করে। পরম যত্নে খাইয়ে দেয়। তার নাপাক কাপড়-চোপড় ধোয়ে দেয়। অথচ বাচ্চা ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে একবারও ফিরে তাঁকাতে পারেনা। ছয় বছর হলো আজঅব্দি মা কোনোদিন কারো বাড়িতে বেড়াতে যায়নি। আমি শুনে কিছুটা অবাক হয়নি বরং অনেকটাই আশ্চর্য হয়েছি। যেদিন তার এ বাচ্চা মারা যায় এ দিন থেকেই সে নিঃশব্দ নিসঙ্গপনা হয়ে যায়। তার চোখ দিয়ে অশ্রু এখনো ঝরে তবে ঝরঝর করে নয় বরং রক্তক্ষরণ হয়ে। তার এ ঘটনা শুনে আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম-নারী তোমার নারীত্বের বাঁধন এত মমতাময় কেন?
পাঁচ.
এই তো গত শীতে চিতই পিঠা খাওয়ার খুব সখ জেগেছে। তাই কাছের এক বন্ধুকে নিয়ে চলে গেলাম দূর গ্রামাঞ্চলে। কনকনে শীত আর ঘনঘন ধোঁয়াশায় সবকিছুই ধোঁয়াসা। দু তিন পা হাঁটি আর রাস্তা খোঁজে বের করি। হঠাৎ কাচুমাচু গায়ে কে যেন মাটির এক হাঁড়ি নিয়ে শরষে ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে রাস্তায় উঠছে। কৌতুহল বশত এগিয়ে গেলাম। যাওয়া মাত্রই দেখি অল্প বয়স্ক এক মহিলা মাথায় হাঁড়ি আর পিঠে ওড়না দিয়ে পেচানো ২ বছরের শিশু বাচ্চা। বাচ্চার শুধু নাকের ঢগাটা দেখা যাচ্ছে। চট করে মহিলা বলে ফেললেন-বাবারা! তোমরা খেঁজুরের রস খাবে? তৃপ্তিভরে খেয়ে বাকি রসটা পলিতে করে নিয়ে আসলাম। চিতই পিঠা আর খাওয়া হলো না। তখনই মাথায় ধরলো- নারী তার নারীত্বের আঁচল কি মধুর!
ছয়.
আমার ছোট্ট বোনের কথাই বলি। ভারি মিষ্টি একটা মেয়ে। মুখের রস আখের রসের চাইতেও বেশি। পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিতে হয় আমি শিখেছি তার কাছ থেকে। ছোট্ট খুকী আর শ্রদ্ধয়দের আপ্যায়নে বেশ কিছু জাদুকরী কারিশমা রয়েছে তার। উপস্থাপন আর আপ্যায়ন না দেখলে তফাৎ বুঝা অসম্ভব। তিনি আমাকে মজার মজার ঘটনা শুনান-এখন না কিন্তু যখন আমি ছোট ছিলাম। আর কিছুদিন পরই তিনি বুড়িদের কাতারে নাম লেখাবেন আর আমি তার অতীতের স্থানে। সেই ভোর সকালে আপুর কাছে একটা মহিলা তার ছয় বা সাত বছরের এক মেয়েকে দিয়ে চলে যেতো। সারাদিন কোনো খোঁজখরব নাই, না খাওয়ার না দাওয়ার না! সন্ধ্যায় কোথ্থেকে চট করে এসে হুট করে সন্তানকে নিয়ে চলে যেতো।
বিষয়টা আমার কাছে খুব আচানক লাগলো। মন রহস্য উদঘাটনের প্যারায় পড়ে গেলো। আর মহিলা যে সময়টাতে আসে ঐ সময় আমার বাড়িতে কম সময়ই থাকা হয়। ঐদিন বিকাল আর বাহিরে বের হলাম না, মহিলা আসা মাত্রই জিজ্ঞেস করে বসলাম-আন্টি আপনি সারাদিন কি করেন? কোথায় থাকেন? মহিলা ওড়নাটা দিয়ে ঘাম মুছার ভান করে আমতা আমতা করে বললো- বাবা এই তো! আমি বললাম- এই তো কি? আন্টি জানালে খুব খুশি হবো। একটা নিঃশেষ ছেড়ে বললো-ওর বাবা মারা গেছে তিন বছর হলো। দুই সন্তানের সে বড়, আর ছোটটা আমার সাথেই থাকে। আমি ইট ভাটায় কাজ করি, প্রতিদিন কিছু পয়সা দেন মাহাজন। তা দিয়ে চলতে পারি। তার সম্পর্কে আপুর কাছে আরো বিস্তারিত জানতে পারলাম। তখনই ভাবলাম-নারী তোমার তুলনা করাই কম হয়ে যায়! এদিকে জানতে পারলাম বোন আমার তাকে ৩ বছর যাবৎ ফিরে কুরআন শিখাচ্ছে। অথচ অবস্থা এমন, যে কেউ দেখলে মনে হবে বাচ্চাটা তার নিজের পেটের বাচ্চা।
প্রিয় বোন!
মনে তো চায় তাদের অসহায়ত্বের জায়গায় গিয়ে একটু আনন্দ ঢেলে দিতে তবে তা কি কখনোই সম্ভব! খোদায়ি ফরমান কেউ কি নিজ হাতে সাঁজাতে পারে! খোদায়ি দাবি অন্য কেউ কি পূরণ করতে পারে! অসম্ভব শব্দের ব্যবহারের দাবি ছাড়া আর কিছুই করা সম্ভব না। তবে একটি পথ খোলা আছে, যা তাদের জন্যই সৃষ্টি, নারী তার নারীত্বের আঁচল ফিরিয়ে আনা। নারী তার নারীত্বের বাঁধন চিনতে পারা।।
বোনদের এ ঘটনাগুলো শুনে যেমন মনটা হুহু করে কেঁদে উঠে অপরদিকে আনন্দের আতিশয্যে দু-চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে। কারণ এমন কিছু বোন আছে যারা তার নারীত্বের আঁচলে দ্বীনের ছোঁয়া লাগাতে বেশ তৎপর। আবার এমন কিছু বোন আছে যারা তার নারীত্বের বাঁধন ধর্মের রশি দিয়ে বাঁধতে বদ্ধপরিকর। পরিবার গঠনের রাজকীয় কল্পনা অন্তরে ঠায় না দিয়ে শরীয়াহ মোতাবেক পরিবার চালানোর বৈধ চিন্তা সারাক্ষণ মাথায় ঘুরঘুর করে।
উপরোক্ত দুটি ঘটনাই যথেষ্ট নারীদের ত্যাগের প্রমাণে-তাদের এ কুরবানীর পথটা যদি একটু ঘুরিয়ে দেয়া যায়, তাদের এ পরিশ্রমের মনমানসিকতার রুপটা যদি একটু সাঁজিয়ে দেয়া যায় তাহলে তারাও যানিরা ও দাওসিয়া রাদিআল্লাহু আনহার মত হতে বেশিদিন সময় লাগবে না। ময়দানে উম্মে আম্মারার মত হতে কাল বিলম্ব করবে না। সন্তানের বেলায় ইমাম শাফীর মায়ের মত দূরদর্শী হতে অস্বীকার করবে না। আম্মাজান আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহার মত চৌকান্না ও গুণবতী হতে দিনক্ষণ লাগবে না।
বোন তুমিই পারো তোমার সতীর্থ নারীদের রুপ লাবণ্যের কদর শিখাতে। ত্যাগ আর বিসর্জনের পথগুলোকে দ্বীনি নালায় সংযোগ করিয়ে দিতে।
তুমি যদি হও সন্তানের বেলায় ধর্মীয় কষ্টি পাথর তাহলে সে তো হবে আল্লাহ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাতী ইমাম হাসান হুসাইন রা. এর মত স্বর্গীয় পুরুষ। তুমি যদি হও স্বামীর বেলায় শরীয়ার পরশ পাথর তাহলে সে তো হবে খালেদ বিন ওয়ালিদ রা. এর মত কালজয়ী ধর্মযোদ্ধা।
বোন তুমি জানো! তোমার মনের খুঁটির সাথে রণাঙ্গনের খুঁটির যোগসূত্র কতটা প্রয়োজন? তোমার আত্মায় রয়ে যাওয়া আশাগুলো বাস্তবে রুপ দিতে কতটা উঁচু মনের হওয়া প্রয়োজন? তোমার পেটের সলাহিয়াত যতটুকু তোমার সন্তানের ভবিষ্যত রাজত্ব ততটুকু। তোমার হৃদয়ের ইখলাছিয়্যাত যতটুকু তোমার সন্তানের ভবিষ্যত গড়বে ততটুকু। সুতরাং নারী তোমার নারীত্বের আঁচল এত সুন্দরই হয়েছে নারীর উঁচু মনোভাবের ওপর ভর করে। অথচ তুমি কিনা তার থেকে এত দূরে?