ইমাম মাহমুদের ফিতনা পর্ব – ১ | দাবী ও পরিচিতি
২০১৭/১৮ সালের দিকে বাংলাদেশে একটা দলের আবির্ভাব হয়। তারা দাবী করে ইমাম মাহদির পূর্বে অন্য একজন নেতা আসবেন তার নাম হবে মাহমুদ এবং তার সহচর হিসেবে আরেকজন আসবেন তার উপাধী হবে সাহেবে কিরান। এই দলের সদস্যরা তাদের প্রতিশ্রুত নেতা ইমাম মাহমুদ এবং সাহেবে কিরানের প্রচার প্রচারণা আরম্ভ করার পরেই আমরা যানতে পারি অদূর ভবিষ্যতে এই নামে হয়তো কেউ একজন উম্মাহর রাহবার হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছেন। আজ আমরা গোটা বিশ্বের যেদিকে তাকায় সেদিকেই কেবল মুসলিমরা নির্যাতিত, নিপিরীত। প্রায় এক শতাব্দী মুসলিম জাতী লাঞ্চনা ও যিল্লতির গ্লানি টানছে ঠিক সে সময় এই যুলুম অত্যাচারের অবসান ঘটাতে আল্লাহ তায়ালা তার বিশেষ এক বান্দাকে আমাদের মাঝে পাঠান, ইমামুল জিহাদ ওয়াল মুজাদ্দিদ শাইখ উসামা ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে লাদিন রহ. কে। স্রেফ এই নামটাই যেন বিশ্ব কুফফারদের কাছে আতঙ্কের কারণ। তিনিই এই উম্মাহর অন্তরে ঘুরে দাড়ানোর সাহস সঞ্চার করেছেন, তার সময়কাল থেকেই শুরু হয় মুসলিমদের উত্থানের নতুন এক অধ্যায়। তিনি গোটা বিশ্বের প্রতি ইঞ্চি ভূমিতে ইসলামী হুকুমত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গ্লোবাল মানহায প্রতিষ্ঠা করেন যেই কার্যক্রম এখনো অব্যাহত রয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। যেহেতু আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এই শতাব্দী মুসলিমদের উত্থানের শতাব্দী তাই অবিশ্বাসের কোনো কারণ নেই যে আগামীতে এমন আরোও আল্লাহ তায়ালার বিশেষ বান্দাদের শুভাগমন ঘটতে পারে। এ কারণেই ইমাম মাহমুদ সম্পর্কে যানার আগ্রহ আরো বৃদ্ধি পেতে লাগলো। এরপর অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম এবং সেই দলের সদস্যদের থেকে যা যানতে পারলাম তা কিছুটা এমন –
(১) শেষ জামানায় মাহদির পূর্বে মাহমুদ আসবেন। পিতার নাম আব্দুল ক্বাদির এবং তিনি কুরাইশ বংশদ্ভূত হবেন। (২) তার সাথে থাকবে তার বন্ধু সাহেবে কিরান তারা উভয়ই হবেন আল্লাহর মনোনীত বিশেষ বান্দা। (৩) ২০২৩ সালে ফুরাত থেকে স্বর্ণের পাহাড় প্রকাশ পাবে। (৪) ২০২৪ সালে মাহমুদের আবির্ভাব ঘটবে এবং গাজওয়াতুল হিন্দ হবে। (৫) ২০২৫ সালে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অর্থাৎ আল মালহামা সংঘটিত হবে। (৬) ২০২৮ সালে মাহদি আবির্ভূত হবেন। (৭) ইমাম মাহমুদ এবং সাহেবে কিরান কে আল্লাহ তায়ালা গাজওয়াতুল হিন্দের নেতা মনোনীত করবেন। (৮) তাদের কে আল্লাহ তায়ালা ইলহামের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিবেন। (৯) আল্লাহ তায়ালা তাদের লিখিত ইলহাম দিবেন অর্থাৎ ইলহাম সংরক্ষন করা হবে।
উল্লেখিত দাবী সমূহের দলিল হলো কিছু বাংলা হাদিস এবং দুইটা ভবিষ্যদ্বাণীর কবিতা। এরপর যখন বিষয়গুলো নিয়ে গবেষনা শুরু করলাম তখন আমার কাছে কয়েকটা জায়গায় গোলমেলে এবং সন্দেহজনক মনে হলো। আর তা হলো – (ক) এই যে দাবীগুলো করা হচ্ছে তা কেবল একটা নির্দিষ্ট দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ দাবীগুলোর ব্যাপারে ১০ বছর আগেও বাংলাদেশের কেউ কিছুই বলেনি শুধু বাংলাদেশ নয় অন্যান্য দেশেও এর আলোচনা পাওয়া যায় না এমনকি ময়দানের আলেম ওলামাগণও এই বিষয়ে কোনো আলোচনা করেন নাই। (খ) হাদিসগুলোর ভাষাগত দিকও খুব নিম্ন মানের। (গ) হাদিস গ্রন্থের যেই রেফারেন্স দেওয়া হয় তার মধ্যে কিছু গ্রন্থের নাম অপরিচিত। (ঘ) সাল ধরে ধরে ভবিষ্যদ্বাণী করা কুরআন সুন্নাহর নিয়মের পরিপন্থী।
এভাবে কিছুদিন যেতে না যেতেই একটা মজার ঘটনা ঘটলো ২০২০ এ খবর আসলো তাগুতি প্রশাসনের হাতে কয়েকজন জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছে যানা গেলো তাদের মধ্যে একজন আছেন যিনি নিজেকে ইমাম মাহমুদ দাবী করে তার সাথে সাহেবে কিরানও রয়েছে, তারা ২০১৭ বা তারও আগে অথবা কিছু সময় আগ পিছ হবে এই বিষয়ে সবাইকে দাওয়াত দিচ্ছে। তখন আমাদের কাছে পুরো বিষয়টা পানির মত পরিস্কার হয়ে গেলো। আসলে এতোদিন যারা ইমাম মাহমুদের ভবিষ্যদ্বাণী করছিলো তারা আর কেউ না তারাই হলো স্বয়ং ইমাম মাহমুদ এবং সাহেবে কিরান। তারাই সেই শুরু থেকে নিজেদের আগমনের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করে যাচ্ছে। সে সময় তারা অনলাইন এবং এবং অফলাইনে বেশ সুসংগঠিত। বাংলাদেশের প্রায় জেলায় তাদের মযবুত অবস্থান রয়েছে হোক সেটা সংখ্যায় অল্প। পরে যানা যায় যে ব্যাক্তি নিজেকে ইমাম মাহমুদ দাবী করছে তার আসল নাম মূলত ‘জুয়েল’ আর তার বন্ধু সাহেবে কিরানের নাম ‘শামীম’। জুয়েলের বাড়ি নাটোর আর শামীমের বাড়ি পাবনা জেলার সাথিয়া থানা। শামীমের সাথে জুয়েলের পরিচয় হয় মসজিদের ইমাম হওয়ার সুবাদে। শামীমদের এলাকার মসজিদে ইমামতি করত জুয়েল সেখান থেকেই জুয়েল ও শামীম দুজনে মিলে এলাকার মধ্যে তাদের এই দাবীগুলো প্রচার করতে শুরু করে এরপর তারা তাদের দাওয়াত ব্যাপক করতে ফেইসবুকে সত্যের সৈনিক নামে একাউন্ট খুলে নিয়মিত পোষ্ট করতে থাকে শামীম। রাতারাতি পোষ্টগুলো সোশ্যাল মিডিয়ার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পরে আর সেখান থেকেই মুসলিম জনসাধারন যানতে পারে নতুন এই দল ও মতের ব্যাপারে । দাওয়াহর কাজ চলা অবস্থায় জুয়েল এবং শামীম পারি জমায় রাজশাহীতে অবশ্য এর পেছনে একটা কারণ উল্ল্যেখ করা হয় যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য রাজশাহী অর্থাৎ মাখদুম নগরী বাছাই করেছেন তাই তারা সেখানে যান। তাদের দাওয়াতের উসিলায় অনেকেই রাজশাহীতে এসে জুয়েল কে বাইয়াত দেয় এবং দিন দিন তাদের সদস্য সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, হঠাত একদিন র্যাপিড একশন ব্যাটিলিয়ন-১ অভিযান চালিয়ে জুয়েল কে রাজশাহী থেকে এবং শামীম কে সিরাজগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করে। এক বছরের ও বেশি সময় কারাভোগ করার পর অবশেষে তারা জামিনে বের হয়। সকল তথ্য অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা বিশ্লেসনের পরে ইমাম মাহমুদের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান হলো ‘ইমাম মাহমুদ’ এই নব আবিষ্কৃত মতটি শেষ জামানার নানবিধ ফিতনার মধ্য থেকে একটি। কারণ –
[১] আমরা অনেক অনুসন্ধ্যানের পর ইমাম মাহমুদ প্রসঙ্গে আহলুস সুন্নাহর কোনো গ্রন্থ থেকে একটি হাদিসেরও অস্তিত্ব খুজে পায়নি এমনকি যঈফ/মুনকার সনদেরও না। এ ব্যাপারে যখন আমরা তাদের অনুসারীদের নিকট প্রশ্ন করি তারা আশানরূপ উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়। শেষ জামানার হাদিসগুলো অনুসন্ধান করে কয়েকজন কে পেয়েছি যারা শেষ জামানায় আবির্ভূত হবেন। (১) হারিস ইবনে হাররাস (২) মানসুর (৩) শুয়াইব ইবনে সালিহ (৪) মাহদি (৫) ঈসা আঃ (৬) কাহতানী শাসক (৭) জাহজাহ। (জাহজাহ এবং কাহতানী শাসকের ব্যাপারেও সংশয় ছড়ানো হয়েছে যা নিয়ে পরবর্তী কোনো এক পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।) এছাড়াও লক্ষ্য করলে দেখা যায় হাদিসের যেখানে যেখানে মাহমুদের নাম রয়েছে বা তার আগমনের ব্যাপারে বলা হয়েছে সেই হাদিসগুলো এমন গ্রন্থে আছে যে গ্রন্থের নাম এর আগে কখনো শোনা যায়নি অথবা অগ্রহনযোগ্য যেমন- “আখীরুজ্জামানা আল মাহদি ফিল আলামাতিল কিয়ামাহ” এই গ্রন্থের লেখক কে? কোথাকার বাসিন্দা তিনি? লেখক সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহর মুহাদ্দিসীনদের মতামত কি এ ব্যাপারে কিছুই যানা যায় না। মানসুর, মাহদি, কিংবা হারিস হাররাস সম্পর্কে তো যুগ যুগ ধরেই উম্মতে মুসলিমা অধ্যায়ন করে আসছে, শত শত বছর ধরে তাদের আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে আলোচনার ক্ষেত্রে হয়তো সনদের মান চিন্তা করে কম বেশ হয় কিন্তু হাদিসের অস্তিত্ব তো সেই হাদিস সংকলনের যুগ থেকেই রয়েছে। অথচ ইমাম মাহমুদের হাদিসগুলো নিয়ে না আছে কোনো মুহাদ্দিসিনদের আলোচনা আর না আছে কোনো সমালোচনা। হঠাত হাদিসগুলো এমন সময় প্রকাশ পেলো যখন কিনা হাদিসে বর্ণিত ব্যক্তিগনই চলে এসেছেন। তাই এগুলো যে তাদের হাতের কাজ তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। সচেতন যে কেউ তাদের জালিয়াতি ধরতে পারবে। ইসলামের মধ্যে নতুন নতুন ফেরকা প্রতিষ্ঠিত করতে জাল হাদিস তৈরীর ইতিহাস নতুন না এমন ডজন ডজন প্রমাণ দেওয়া যাবে যারা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে নিজেদের সমর্থনে হাদিস তৈরী করেছে।
[২] ইমাম মাহমুদ দাবীর প্রধান এবং অন্যতম দলীল হলো শাহ নেয়ামতুল্লাহর ভবিষ্যদবানী। প্রথমত শরীয়তে এ ধরণের ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই তবে আমরা এটার সত্যতা যানতে এই কবিতার সূত্র অনুসন্ধান করি এবং যা যানতে পারি তাতে ইমাম মাহমুদ যে একটি মিথ্যা বানোয়াট চরিত্র সে ব্যাপারে আমাদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়। ইরানের শাহ নেয়ামতুল্লাহ তার জীবদ্দশায় একটি ভবিষ্যদ্বাণীর কবিতা লিখেছিলেন যা তার মৃত্যুর প্রায় পাচশত বছর পর সন্ধান পাওয়া যায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গা থেকে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে শাহ নেয়ামতুল্লাহর নামে আরো কিছু ভবিষ্যদ্বাণীর কবিতা প্রকাশিত হয়। একটার সাথে অন্যটার কোনো মিল নেই কোনোটা ৩০ লাইনের তো কো্নোটা আবার ৩৬ লাইনের এভাবে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এই কবিতাগুলো সামনে আসতো ভিন্ন ভিন্ন বিষয় সম্বলিত হয়ে। সৈয়দ মুহাম্মাদ আল মাহদী (১৮৪৫-১৯০২) নিজকে ইমাম মাহদী দাবী করত তার সময়েও দলীল হিসেবে নেয়ামতুল্লাহর নামে বানানো কবিতাগুলো ব্যবহৃত হয়। মোটকথা যখন যার যেভাবে প্রয়োজন সেভাবে এটাকে ব্যবহার করেছে এবং সাইনবোর্ড হিসেবে শাহ নেয়ামতুল্লাহর নামে চালিয়ে দিয়েছে। বর্তমান আমাদের নিকট শাহ নেয়ামতুল্লাহর নামে মোট চারটি কবিতা সংগ্রহে রয়েছে। বাংলাদেশে যেটা প্রচলিত অর্থাৎ “কাসিদা সওগাত” এবং পাকিস্তানের “পেশান গুয়ি” এই দুইটি কবিতা সম্পূর্ণ আলাদা একটার সাথে অন্যটার কোনো মিল নেই সুতরাং স্পষ্টতই এগুলো ইমাম মাহমুদের দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করার একটি হাতিয়ার মাত্র।
– আবু আম্মার সাইফুল্লাহ