আন নাসর মিডিয়াপরিবেশিত
“ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
একবিংশ শতাব্দীর গণতন্ত্র’’
(সূরা আসরের আলোকে)
।।মাওলানা আসেম উমর হাফিজাহুল্লাহ ||
এর থেকে– ২২তম পর্ব
“ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
একবিংশ শতাব্দীর গণতন্ত্র’’
(সূরা আসরের আলোকে)
।।মাওলানা আসেম উমর হাফিজাহুল্লাহ ||
এর থেকে– ২২তম পর্ব
ফলাফল: পাকিস্তান কি কালিমা পাঠ করেছে?
এ পর্যায়ে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এ বলে প্রতারণা করার চেষ্টা করা হয় যে, রাষ্ট্র তো কালিমা পাঠ করেছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র এ কথার বিশ্বাস রাখে যে, আইন প্রণয়ন ও হাকিমিয়্যাহর ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর জন্য আছে। সমস্যা তো তা বাস্তবায়নে। সুতরাং বিশ্বাস ঠিক থাকলে কাজের দুর্বলতার কারণে কাউকে কাফের বলা যায় না।
এটি একটি নিরেট ভুল ধারণা। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে উক্ত বিশ্বাস রাখা সত্ত্বেও যদি কেউ কাজের বেলায় সেই ক্ষমতা (আদেশ-নিষেধের ক্ষমতা) আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে সোপর্দ করে, এটিও কুফরী। যেমন ওপরে খৃষ্টানদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, তারা তাদের পাদ্রীদেরকে উপাস্য বানিয়ে নেয়নি; বরং তাদের কাজ ছিল, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা পাদ্রীদের জন্য মেনে নেওয়া। এটিকেই কুরআন উপাস্য বানানো বলেছে, যেটির ব্যাখ্যা রাসূল ﷺ নিজেই দিয়েছেন।
ইমাম রাযী রহ. এর তাফসীরে যা বলেছেন, তা দ্বিতীয়বার পড়ুন-
المسألة الثانية: الأكثرون من المفسرين قالوا: ليس المراد من الأرباب أنهم اعتقدوا فيهم أنهم آلهة العالم، بل المراد أنهم أطاعوهم في أوامرهم ونواهيهم
‘অধিকাংশ মুফাসসিরের মতামত হলো, রব বানানো থেকে এ কথা উদ্দেশ্য নয় যে, তারা নিজেদের পাদ্রীদের ব্যাপারেও এ বিশ্বাস রাখতে শুরু করেছে যে, তারাই জগতের উপাস্য; বরং এর উদ্দেশ্য হলো, তারা হুকুম ও আইন-কানুনে সেসব পাদ্রীর অনুসরণ করত।’
অথচ এ বিশ্বাস রাখার জন্য গণতন্ত্র বাধ্য করছে। এটিকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। এর দলিল হলো, কোনো শহরবাসী বা কোনো সংসদ সদস্য এ কথা বলতে পারে না যে, রাষ্ট্রপরিচালনার এ পদ্ধতি (কোনো বিল পাশ করানোর জন্য পার্লামেন্টে পেশ করা) আমি মানি না। এটি শরীয়াহবিরোধী, কুফরী। তখন দেখবেন, সেই কুফরের রক্ষক শক্তিগুলো এ লোককে কেমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়।
কোনো জাতিরই নেতৃস্থানীয় লোকজন আল্লাহর কিতাব ছেড়ে নিজেই শরীয়তপ্রণেতা কেন হয়ে যায়? কেন তারা আইন প্রণয়নে হাত দিয়ে দেয় এবং আল্লাহর সেই ক্ষমতাকে নিজের হাতে তুলে নেয়?
কারণ, সেই ক্ষমতার মাধ্যমে যে সে নিজের দাপট-কর্তৃত্বের ভিত্তি মজবুত করতে পারে! নিজের এবং তার সমমনাদের প্রবৃত্তির সুরক্ষা দিতে পারে! এর মাধ্যমে ইচ্ছামতো আইন তৈরি করতে পারে এবং সাধারণ মানুষকে নিজেদের দাস বানিয়ে রাখতে পারে! তারপর সেই আইন প্রণয়নকে সম্মানিত করার জন্য সেটিকে কোনো ধর্ম বা কোনো বাদ-মতবাদের মুখোশ পরিয়ে দেয়; যাতে মানুষ ধর্মীয় শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে সেটির ইবাদত করে এবং সেটির বিরোধিতাকে পাপ মনে করে। ফলে সাধারণ মানুষ পুরো জীবন নেতৃস্থানীয়দের সেবাদাস হয়েই থাকে।
এ ক্ষমতা অর্জিত হওয়ার পর ক্ষমতাশালীরা শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আইন প্রণয়নই করেনি; বরং সমাজকে নিজেদের ক্ষমতার ক্রীড়নক বানাতেও নিজেদের পক্ষ থেকে আইন বানিয়ে নেয়। তারা আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই পরিপূর্ণ একটি ধর্ম বানিয়ে নেয়।
মক্কার জাহেলী যুগের পার্লামেন্ট (দারুন নাদওয়া) এই কাজই করত। নিজেদের কর্তৃত্ব, ক্ষমতা, দাপট, রাজত্বকে দৃঢ় করার জন্য যা ইচ্ছা হালাল বা বৈধ করে দিত, যা ইচ্ছা হারাম বা অবৈধ করে দিত। তারপর সেই আইন প্রণয়নকে ধর্মের মুখোশ পরানোর জন্য নিজেদের উপাস্যদের দিকে সম্বন্ধ করে দিত যে, এসব তো তোমাদের উপাস্যদের পক্ষ থেকে; যাতে মূর্খ মানুষ তাতে প্রশ্ন করার অবকাশ না পায়।
এখানে সেই ধর্মীয় রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝা প্রয়োজন যে, প্রত্যেক যুগে ক্ষমতাবানরা আইন প্রণয়নের পর সেটিকে নিজেদের প্রভুদের প্রতি সম্বন্ধ করেছে। (সেই প্রভু কোনো মূর্তি হোক বা কোনো ভবন হোক বা কোনো সংস্থা)। এ ক্ষমতাবানশ্রেণী সেই আইন প্রণয়নকে নিজেদের দিকে সম্বন্ধ করে না। নব্য জাহেলী ব্যবস্থায় হাকিমিয়্যাহর সব ক্ষমতাকে জনগণের দিকে সম্বন্ধ করা হয়। আর এটিই হলো, এ জাহেলী ব্যবস্থার প্রধান প্রতারণা। বাস্তবতা হলো, সব ক্ষমতা নেতাদের হাতেই থাকে। ঠিক যেমনটি করে পাথর কিংবা ভবন পূজারিরা, তারা সব ক্ষমতা পাথর কিংবা ভবনকে দেওয়ার আড়ালে নিজেদের খায়েশই বাস্তবায়ন করছে। অথবা মৃত ব্যক্তির কথা বলে মাজারের মুতাওয়াল্লীরা নিজেদের প্রবৃত্তিকেই পূর্ণ করছে।
ইমাম রাযী রহ. এ সত্যকে উৎঘাটন করে বলেন-
وَقَالَ الْكَلْبِيُّ: كَانَ لِآلِهَتِهِمْ سَدَنَةٌ وَخُدَّامٌ وَهُمُ الَّذِينَ كَانُوا يُزَيِّنُونَ لِلْكَفَّارِ قَتْلَ أَوْلَادِهِمْ
‘কালবী বলেন, কাফেরদের মূর্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও উপাসনালয়ের খাদেম হিসেবে যারা দায়িত্বরত ছিল, তারাই কাফেরদের জন্য নিজেদের সন্তান হত্যাকে বৈধ বানিয়ে দিত।’
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারকবাহক ও প্রতিবেশীরাও আজ নিজেদের সুযোগ-সুবিধার জন্য নিজেরাই একটি নতুন ধর্ম বানিয়ে নিয়েছে। যার রয়েছে আলাদা ফরয-ওয়াজিব। (যা পালন করা প্রত্যেক নাগরিকের জন্য আবশ্যক)। রয়েছে হালাল-হারাম (বৈধ-অবৈধ), মুস্তাহাব-মাকরূহ।
এটি কি আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন সাধন নয়? যেমনটি সূরা নিসার ১১৯ নং আয়াতে উল্লেখ হয়েছে- (অভিশপ্ত শয়তান আল্লাহকে বলেছিল...)
وَلَأُضِلَّنَّهُمْ وَلَأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آذَانَ الْأَنْعَامِ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللَّهِ وَمَن يَتَّخِذِ الشَّيْطَانَ وَلِيًّا مِّن دُونِ اللَّهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُّبِينًا ﴿النساء: ١١٩﴾
“তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব, তাদেরকে আশ্বাস দেব; তাদেরকে পশুদের কর্ণ ছেদন করতে বলব এবং তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্ট আকৃতি পরিবর্তন করতে আদেশ দেব। যে কেউ আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়।” (সূরা নিসা: ১১৯)
এ আয়াতে وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللَّهِ (শয়তান বলেছে) অবশ্যই আমি তাদেরকে হুকুম দেব, তখন তারা আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন সাধন করবে। এখানে আগেকার যুগের মুফাসসিরগণের মতে, خَلْقَ اللَّه দ্বারা আল্লাহর ধর্মই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তারা আল্লাহর হারামকৃত বস্তুকে হালাল (বৈধ) এবং হালালকৃত বস্তুকে অবৈধ বা হারাম করার মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীনকে পাল্টে ফেলবে।
কাযী সানাউল্লাহ পানিপথী রহ. তাফসীরে মাজহারীতে বলেন, শয়তান যেন তার কথার মাধ্যমে ইঙ্গিত করেছে যে, আমার আদেশ মতে, তারা আল্লাহর হালালকৃত বস্তুকে হারাম করবে। যে সব জন্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পূর্ণতা দিয়ে সৃজন করা হয়েছে, তাকে অপূর্ণাঙ্গ বানিয়ে দেবে।
নিঃসন্দেহে আইন প্রণয়নের অধিকার আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য নির্দিষ্ট করা এমন কুফরী, যেটা থেকে ফিরে আসতে যুগে যুগে নবীগণ দাওয়াত দিয়ে গেছেন। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেছেন-
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ فَمِنْهُم مَّنْ هَدَى اللَّهُ وَمِنْهُم مَّنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلَالَةُ فَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِينَ ﴿النحل: ٣٦﴾
“আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর এবং তাগুত থেকে নিরাপদ থাক। অতঃপর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যককে আল্লাহ হেদায়েত করেছেন এবং কিছু সংখ্যকের জন্যে বিপথগামিতা অবধারিত হয়ে গেল। সুতরাং তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ মিথ্যারোপকারীদের কিরূপ পরিণতি হয়েছে।” (সূরা নাহল: ৩৬)