Announcement

Collapse
No announcement yet.

Banality of Evil - অপরাধের সাধারণতা

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • Banality of Evil - অপরাধের সাধারণতা

    "Most evil is done by people who never makes up their mind to be GOOD or EVIL"
    - Hannah Arendt

    হাসিনা ও তার হায়েনালীগের ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শাসনকাল ছিল নিঃসন্দেহে এক অন্ধকার সময়, যেখানে দেশে একটি ভয়ানক জুলুমের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সময়কালে, সরকার তার প্রতিপক্ষ এবং জনগণের প্রতি যে ধরনের নিপীড়ন চালিয়েছে, তা রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অস্বাভাবিক দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় টার্গেট ছিল ইসলাম এবং মুসলিম সম্প্রদায়, এবং সেই লক্ষ্যে তারা একের পর এক এমন পদক্ষেপ নিয়েছে, যা সমাজের বৃহত্তর অংশের মধ্যে আতঙ্ক এবং বৈষম্য সৃষ্টি করেছে।

    এই সময়ে, ইসলামি রাজনীতি এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে নানাবিধ দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে। একদিকে সরকারের বিরুদ্ধে যে সমস্ত ইসলামি চিন্তাবিদ, আলেম-ওলামা, এবং ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো দাঁড়িয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পিত আক্রমণ চলতে থাকে। একাধিক আলেম-ওলামাকে নিশানা করা হয়, এবং তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, অপহরণ, এবং জংগী নাটক সাজানোর ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। এইসব কার্যকলাপের মাধ্যমে, সরকার তাদের আদর্শ এবং ইসলামী চেতনার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে।

    আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে যে ধরনের দমনমূলক কর্মকাণ্ড চালানো হয়েছে, তা শুধুমাত্র ব্যক্তি নির্যাতন নয়, বরং একটি বৃহৎ সমাজের প্রতি সরকারের শাসনযন্ত্রের হুমকি ছিল। মিথ্যা মামলা, জঙ্গি নাটক, এবং হত্যাকাণ্ড—এসব সরকার কর্তৃক আরোপিত ‘অপরাধ’ ছিল, যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গণতান্ত্রিক ও ইসলামি সাংস্কৃতিক অবকাঠামোকে দুর্বল করতে পরিচালিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে, সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল শুধু বিরোধী মতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া নয়, বরং জনগণকে এক ধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেওয়া, যাতে তারা সরকারের শোষণমূলক ব্যবস্থাকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়।

    এছাড়া, হাসিনা সরকারের শাসনকালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরও নির্যাতন ও অত্যাচারের বন্যা বয়ে যায়। গণতন্ত্রের মুখোশধারী এই সরকার, তথাকথিত ইসলামী ও সেক্যুলার রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। রাজনৈতিক মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল, বিশেষ করে বিরোধী দলগুলোর প্রতি সরকারের শোষণমূলক আচরণ প্রকট ছিল। সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হয়রানি, এবং ছাত্রলীগ ও পুলিশলীগ দ্বারা রাজনৈতিক প্রতিবাদকারীদের ওপর আক্রমণ একে অপরকে অতিক্রম করেছিল।

    এইতো ছিল হাসিনার প্রতিপক্ষের অবস্থা। কিন্তু সাধারণ জনগণের কী অবস্থা ছিল? তারা কি খুব স্বাচ্ছন্দ্যে ছিল?

    বরং চিত্রটা পুরোই উল্টো। সাধারণ জনগণের জন্য এই সময়কাল ছিল এক দুঃস্বপ্নের মতো। অর্থনৈতিক ধস, লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, এবং দেশের সম্পদের অব্যবস্থাপনার ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সরকার যখন নিজেদের দুর্নীতির ক্ষত ঢাকতে ব্যস্ত ছিল, তখন এর বোঝা সাধারণ জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি যখন ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, তখন এর ভার বহন করতে বাধ্য করা হয় সাধারণ মানুষকে।

    এই সংকটের মূল চালিকাশক্তি ছিল দুর্নীতি। সরকারি কর্মকর্তাদের লাগামহীন লুটপাট, প্রভাবশালী মহলের সুবিধাবাদী নীতি, এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অবাধ অপব্যবহার অর্থনীতিকে এক ভয়াবহ দুর্দশার দিকে ঠেলে দেয়। বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়, অথচ সেই ঋণের সঠিক ব্যবহারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বড় বড় প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে, কিন্তু এর সুফল জনগণ কখনোই পায়নি।

    এর ফলে সরকার রাজস্ব ঘাটতি সামলাতে সাধারণ জনগণের ঘাড়ে করের বোঝা চাপিয়ে দেয়। ট্যাক্স, ভ্যাট, শুল্ক সবকিছুর হার বাড়িয়ে দেওয়া হয়। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ যারা ইতোমধ্যেই জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির চাপে পিষ্ট ছিল, তাদের জন্য এটি এক নতুন দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে চাকরির বাজার সংকুচিত হয়ে আসে, বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। চাল, ডাল, তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ—যে সবকিছুতেই জনগণের জীবন নির্ভরশীল, সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে থাকে, অথচ আয়ের উৎস আগের মতোই সীমিত থাকে।

    দেশের উৎপাদন খাতেও স্থবিরতা নেমে আসে। বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারায়, বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়, এবং দেশের অর্থনীতি কেবলমাত্র আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমতে থাকে, ফলে টাকার মান দুর্বল হয়ে যায় এবং জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বৃদ্ধি পায়।

    সরকারের এই অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় শিকার হয় সাধারণ জনগণ। তাদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার খরচ বেড়ে যায়, এবং জীবনযাত্রার মান ক্রমশ নিম্নগামী হতে থাকে। কিন্তু এতকিছুর পরও সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণের কোনো কার্যকর প্রতিবাদ গড়ে ওঠেনি।

    এই আর্থসামাজিক দুর্দশা শুধু যে ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়; বরং এটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়। নৈতিকতা, জবাবদিহিতা, ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তি ভেঙে পড়ে। সরকার যখন জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তখন জনগণ কেবল শোষণের শিকার হয়।

    এই শাসনকাল ছিল এক প্রতারণার যুগ, যেখানে উন্নয়নের নামে জনগণের সর্বস্ব লুট করা হয়েছে, অথচ তাদেরই করের টাকা দিয়ে সেই লুটপাটের ক্ষত পূরণের চেষ্টা করা হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের এই ভয়াবহ ব্যর্থতা এবং সাধারণ জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া দুঃসহ বোঝা এই শাসনের প্রকৃত চিত্রকে উন্মোচিত করে দেয়।

    ঠিক এই জায়গায় এসে আমাদের সামনে দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে।

    প্রথমত, প্রায় ১৫ বছর ধরে সাধারণ জনগণ কেন এই জুলুম মেনে নিল? এত দমন-পীড়ন, নির্যাতন, দুর্নীতি ও ব্যর্থতার পরও কেন হাসিনার শাসনকাল এত স্বাভাবিকভাবে চলল? সাধারণত, যখন কোনো শাসকগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে জনগণের অধিকার হরণ করে, অর্থনীতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়, এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, তখন জনগণের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন তেমনটা হয়নি?

    দ্বিতীয়, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন: সাধারণ জনগণ কেন আবার সেই দিকেই হাঁটতে চাচ্ছে? কেন তারা (ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়) কোনো রাজনৈতিক দলকে পুনরায় নিজেদের ওপর মুসল্লাত বা গালিব হতে দিচ্ছে, যাতে তারা পুনরায় জুলুম-অত্যাচারের শিকার হয়?


    এই প্রশ্নগুলোর সম্ভাব্য উত্তর দিতে পারে হান্না আরেন্ট'র Banality of Evil তত্ত্ব।

    এই তত্ত্বের ভিত্তি হলো, দুনিয়ার বড় বড় জুলুম, নিপীড়ন এবং গণহত্যাগুলোর পেছনে থাকা ব্যক্তিরা সচেতনভাবে 'শয়তান'সুলভ চরিত্রের নয়; বরং তারা দায়িত্ব পালন করতে করতে, আদেশ মানতে মানতে এবং প্রচলিত নিয়মের অনুসারী হতে গিয়ে ধীরে ধীরে এক ভয়ঙ্কর দানবে পরিণত হয়। তারা নিজেরা হয়তো কখনোই গভীরভাবে চিন্তা করে না যে, যা করছে তা ন্যায়সঙ্গত কি না, নৈতিক কি না। তারা কেবল প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর ভেতরে থেকে নিয়ম মানতে থাকে এবং সেটাকেই নিজেদের দায়িত্ব বলে ভাবে।

    এই তত্ত্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ১৯৬১ সালে ইসরায়েলের জেরুজালেমে অনুষ্ঠিত নাজি অফিসার আডলফ আইখমান-এর বিচার থেকে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আইখমান লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানোর দায়িত্বে ছিল। কিন্তু বিচার চলাকালে দেখা যায়, সে কোনো রক্তপিপাসু খুনি নয়, বরং এক সাধারণ আমলা, যে কেবল ‘উপরের নির্দেশ’ পালন করেছে। সে নিজেকে অপরাধী মনে করেনি, কারণ তার বিশ্বাস ছিল, সে কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে এই কাজ করেনি, বরং রাষ্ট্রীয় আদেশ পালন করেছে।

    আরেন্ট দেখান যে, আধুনিক সমাজের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো ও অন্ধ আনুগত্য মানুষকে ধীরে ধীরে বিবেকহীন যন্ত্রে পরিণত করে, যারা আর ন্যায়-অন্যায় নিয়ে ভাবে না। ব্যক্তিগতভাবে হয়তো তারা ভয়ঙ্কর কিছু করতে চাইতো না, কিন্তু তারা নিয়মের অধীন হয়ে নিষ্ঠুরতা চালিয়ে যায়, কারণ সেটাই তখন "স্বাভাবিক" হয়ে ওঠে।

    এই তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করলে বোঝা যায়, কেন জনগণ দমন-পীড়ন ও জুলুমের শিকার হয়েও চুপ থাকে, কেন অত্যাচারী শাসকরা বছরের পর বছর ক্ষমতায় থাকে, এবং কেন অনেক সাধারণ মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বদলে তাতে সহযোগিতা করতে শুরু করে।

    হান্না আরেন্টের Banality of Evil তত্ত্ব এবং আধুনিকতার বিশ্লেষণ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা বোঝার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরেন্ট দেখিয়েছেন, আধুনিক বিশ্ব এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে ব্যক্তি কেবল শ্রম ও ভোগের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত হয়, তার নৈতিক ও রাজনৈতিক সত্তা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। মানুষ নিজেকে একজন মুক্তচিন্তক নাগরিক হিসেবে নয়, বরং কেবল একজন উৎপাদক ও ভোক্তা হিসেবে দেখে। ফলে, রাষ্ট্র যখন তার অধিকার খর্ব করে, তখন সে সেটাকে প্রতিহত করার পরিবর্তে মানিয়ে নেওয়ার পথ বেছে নেয়। এই মানসিকতা সমাজে এমন একটি বাস্তবতা তৈরি করে, যেখানে শাসনের জুলুম স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, এবং জনগণের দৃষ্টিতে সেটাই হয়ে যায় নিয়মতান্ত্রিক বাস্তবতা।

    বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটি অত্যন্ত গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। দীর্ঘদিন ধরে জনগণ এমন এক ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করছে, যেখানে তাদের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার ক্রমাগত খর্ব করা হয়েছে, কিন্তু তারা ধীরে ধীরে এটাকে মেনে নিয়েছে। দমন-পীড়ন, রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, দুর্নীতি ও জবাবদিহিতার অভাবের মধ্যে বাস করেও জনগণের বৃহৎ অংশ এটাকে প্রশ্ন না করে বরং নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা খুঁজতে ব্যস্ত থেকেছে। ফলে, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেতনাই ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এসেছে।

    আরেন্ট দেখিয়েছেন, আধুনিকতার প্রকৃতি এমন যে, এটি ব্যক্তি ও সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ব্যক্তির আত্মপরিচয়, তার রাজনৈতিক ভূমিকা, তার প্রতিবাদী সত্তা বিলীন হয়ে যায়, এবং সে কেবল নিজের ক্ষুদ্র পরিসরে বন্দি হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্র অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে এই বিচ্ছিন্নতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। গণমাধ্যম, শিক্ষা, প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে রাষ্ট্র এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছে যেখানে জনগণের মধ্যে ভয়, আত্মকেন্দ্রিকতা ও নিঃসঙ্গতা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনৈতিক দমনপীড়ন, নির্বিচার গ্রেপ্তার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে একটি স্থায়ী আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে, যা তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষ করে দিয়েছে।

    এই পরিস্থিতিতে জনগণের ভূমিকা একধরনের আত্মবিচ্ছিন্নতায় পরিণত হয়েছে। মানুষ নিজেদের রাজনৈতিক সত্তাকে একরকম পরিত্যাগ করেছে, এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সীমিত নিরাপত্তার মধ্যেই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করছে। একদিকে, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন যখন নিয়মিত চর্চায় পরিণত হয়, অন্যদিকে জনগণের প্রতিরোধ ক্ষমতা যখন ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তখন এমন একটি সামাজিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যেখানে জনগণ নিজেরাই স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রের দমনমূলক নীতির সঙ্গে আপস করতে শুরু করে। আরেন্টের ভাষায়, এটাই হল আধুনিক totalitarianism-এর সবচেয়ে ভয়াবহ দিক—জনগণ শুধু নিপীড়নের শিকার হয় না, বরং একসময় তারা এই নিপীড়নকেই নিজেদের জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নেয়।

    বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই বাস্তবতার একটি জীবন্ত উদাহরণ। যখন জনগণ দেখে যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে, রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর দমননীতি চালানো হচ্ছে, অথচ সাধারণ মানুষ এই বিষয়ে প্রতিবাদ না করে বরং নিশ্চুপ রয়েছে, তখন বোঝা যায় যে Banality of Evil তত্ত্ব কীভাবে কার্যকর হচ্ছে। জনগণ মনে করতে শুরু করে যে, এই দমননীতি কেবল নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে, তাই তারা সরাসরি এর শিকার হচ্ছে না বলে তারা নিশ্চিন্ত থাকে। অথচ বাস্তবে এই নিপীড়ন কাঠামোটি পুরো সমাজকে গ্রাস করে নেয়, এবং শেষ পর্যন্ত কেউই এর বাইরে থাকতে পারে না।

    আরেন্ট দেখিয়েছেন, totalitarian regimes সাধারণত জনগণের ভয় এবং বিচ্ছিন্নতাকে ব্যবহার করে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস হারিয়ে ফেলে, যখন সে নিজেকে শুধু একজন অর্থনৈতিক জীব হিসেবে দেখে, তখন সে তার রাজনৈতিক ভূমিকা ভুলে যায়। বাংলাদেশেও আমরা দেখতে পাই, রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের নীরবতা আসলে তাদের নিজেদের বিচ্ছিন্নতার প্রতিফলন। তারা রাষ্ট্রের দমননীতি মেনে নেয়, কারণ তারা মনে করে যে, প্রতিবাদ করা আরও বেশি অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।

    এই নিপীড়নমূলক বাস্তবতা কেবল রাজনৈতিক পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়, এটি ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্ককেও প্রভাবিত করে। জনগণ একে অপরের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে পড়ে, তারা নিজেদের প্রতিবেশী বা সহকর্মীর সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা করতে ভয় পায়, কারণ রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা নজরদারি ও দমননীতির ফলে যে কোনো সময় যে কেউ বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। এই পরিস্থিতি জনগণের মধ্যে আরও বেশি বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে, যার ফলে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

    আরেন্ট দেখিয়েছেন, ব্যক্তির lack of personal courage অর্থাৎ ব্যক্তিগত সাহসের অভাব এই পুরো ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার প্রধান চালিকাশক্তি। যখন মানুষ দেখে যে, তার প্রতিবাদ করার শক্তি নেই, তার আশেপাশের কেউ সাহস করে কথা বলছে না, তখন সে নিজেও নিশ্চুপ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে এই নিশ্চুপ থাকার অভ্যাসই সমাজের স্বাভাবিক আচরণে পরিণত হয়। বাংলাদেশে আজ এই বাস্তবতা স্পষ্ট। মানুষ ব্যক্তিগতভাবে হয়তো রাষ্ট্রের নিপীড়নকে ঘৃণা করে, কিন্তু তারা সেটার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছে। এই ভয়, বিচ্ছিন্নতা এবং রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তার সমন্বয়ই রাষ্ট্রের দমননীতিকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে।

    এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হল, দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা নিপীড়ন ও জনগণের নীরবতা একসময় এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যেখানে জনগণ আর রাষ্ট্রের নিপীড়নকে নিপীড়ন হিসেবেও দেখে না। তারা এটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়, তারা মনে করে যে, "এটাই তো হওয়ার কথা।" একসময় তারা নিজেদের ওপর আর কোনো অধিকার থাকার কল্পনাও করতে পারে না, তারা রাষ্ট্রের যেকোনো দমননীতিকেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে শুরু করে। এই অবস্থাটিই Banality of Evil-এর চূড়ান্ত রূপ, যেখানে রাষ্ট্রের অত্যাচার আর কোনো ব্যতিক্রম নয়, বরং তা সমাজের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম হয়ে ওঠে।
Working...
X