ভারতের ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৫ : ভারতের মুসলিমদের জন্য এক নীরব ঘূর্ণিঝড়
- মুনশি আব্দুর রহমান

ভারতবর্ষ ছিল এমন একটি দেশ, যাদের মুসলিম শাসকরা মুসলিম-হিন্দু সবার উপর ইনসাফ করতেন, ন্যায় বিচার করতেন। এখানের মুসলিমরা হলেন এমন এক জাতি, যাদের পূর্বপুরুষেরা বহু শতাব্দী ধরে নিজেরা ক্ষুধার্ত থেকেও আল্লাহর রাস্তায় জমি দান করতেন। মসজিদ, মাদরাসা, কবরস্থান, খানকাহ—এসব পবিত্র উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা ওয়াকফ সম্পত্তি ছিল তাদের ঈমানদারির এক জীবন্ত চিহ্ন। তারা নিজেদের ধন-সম্পদ ও জায়গাজমি থেকে আল্লাহর রাস্তায় অকাতরে দান করে দিতেন। সময়ের সাথে সাথে এই জমিগুলো শুধু ধর্মীয় প্রয়োজনেই নয়, বরং মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক-সামাজিক মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আজ যেন হঠাৎ সেই জমিতে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার বিষ ঢেলে দিল —নাম তার ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৫।[১]
একটি অন্ধকার অধ্যায়ের শুরু
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ভারতের লোকসভায় পাশ হলো এমন এক বিল, যা দেখে দেশের কোটি কোটি মুসলমানের হৃদয়ে ঝড় উঠেছে। ভারতের ইতিহাসে এমন বহু আইন এসেছে, যা মুসলিমদের ভয় পাইয়ে দিয়েছে, তবে এই বিল যেন তলোয়ার হয়ে এসে সরাসরি মুসলিম জাতির হৃদপিন্ডে আঘাত হেনেছে।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড–এর মতে, এই বিল একটি ষড়যন্ত্র, যার উদ্দেশ্য স্পষ্ট—মুসলিমদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ভিতকে একসাথে ভেঙে দেওয়া। [২]
এই বিলের মাধ্যমে কী ঘটতে চলেছে?
এখানে গল্পটা আসলে কল্পনা নয়, বাস্তব। নতুন এই সংশোধনী বিলের মাধ্যমে:
- সরকার ওয়াকফ বোর্ডের স্বাধীনতা হরণ করতে পারে, চাইলে ‘জাতীয় কমিশন’ তৈরি করে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ বাড়াতে পারে।
- ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা এবং নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় সরকার সহজেই নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারবে।
- যেসব সম্পত্তি শত বছর ধরে মুসলিম সম্প্রদায়ের অধীনে ছিল, সেগুলিকে সরকারি ‘পাবলিক ইউটিলিটি’ ঘোষণার অজুহাতে দখলে নেওয়া যাবে।
- মুসলমানদের কোনও সম্মতি ছাড়াই ঐতিহ্যবাহী জমিগুলোকে অন্য কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
এ যেন মুসলিমদের পূর্বপুরুষদের ‘দান’কে ছিনতাইয়ে পরিণত করার একটি মোড়ক-পরা আইনি কৌশল।
জনগণের কণ্ঠরোধ ও প্রতিরোধের জন্ম
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এই বিলকে "গণতন্ত্রের কালো অধ্যায়" বলে আখ্যা দিয়েছে। তারা বলেছে, এটি কেবল মুসলিমদের জন্য বিপজ্জনক নয়, বরং ভারতের গণতন্ত্রকেও কলুষিত করেছে। [৩]
এই বিল পাশ হওয়ার আগে না শোনা হয়েছে মুসলিমদের, না মানা হয়েছে তাঁদের আপত্তি। দেশের বহু সংগঠন, এমনকি কিছু সচেতন বিরোধীদল এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করলেও, সরকার তাদের মতামতকে উপেক্ষা করেছে। [৪] এই একতরফা আচরণ ভারতীয় সংবিধানের তথাকথিত 'চেতনাকে' প্রশ্নের মুখে ফেলে।
মুসলিম জাতির জন্য বিপর্যয়ের ঘন্টা
এই বিল যদি রদ না হয়, তবে ভারতের মুসলিমদের জন্য এক ভয়াবহ পরিণতির দরজা খুলে যাবে। যেমন:
- ওয়াকফের অর্থে পরিচালিত হাজারো মাদরাসা, হাসপাতাল ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের মুখে পড়বে।
মুসলমানরা আরও বেশি গরিব ও পেছিয়ে পড়বে। - মুসলিম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মুছে ফেলা হবে; বহু খানকাহ, ঈদগাহ ও ঐতিহাসিক মসজিদ হারিয়ে যাবে উন্নয়নের নামে।
- দেশে নতুন করে ধর্মীয় উত্তেজনা, সামাজিক সংঘর্ষ সৃষ্টি হবে এবং এতে বরাবরের ন্যায় মুসলিমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর প্রতি আহ্বান
এই দুঃসময়ে ভারতের মুসলিমরা একা নয়। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া—সব দেশের আলিম, দাঈ ও সাধারণ মুসলিমদের উচিত তাঁদের কণ্ঠ এই নিপীড়িত ভাইদের পক্ষে তোলা। এটি কেবল ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নয়, এটি একটি ধর্মীয় জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন। এই ইস্যুতে বিশ্বজুড়ে মুসলিম সংগঠনগুলো কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন—
- আপনারা ভারত সরকারের এই বিলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফোরামে আওয়াজ তুলুন!
- মুসলিম মিডিয়াগুলো এই বিষয়টি তুলে ধরে গণচেতনা তৈরি করুন!
- মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি করুন!
এখন উপমহাদেশের মুসলিমদের করণীয় কী?
উপমহাদেশের মুসলিমদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে, সীমাহীন ধৈর্য, সংবেদনশীলতা ও কৌশল দিয়ে আমাদেরকে এই চলমান আন্দোলনের গল্পের নায়ক হতে হবে। এই আন্দোলনকে বিপ্লবের মহান দরোজায় পৌঁছে দিতে হবে। সারা বিশ্বের উলামায়ে কেরাম, মুজাহিদিন উমারা ও সৎ ব্যক্তিদের নির্দেশনা মেনে এই বিলকে বাতিল করতে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নিম্নে আমি কিছু করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিচ্ছি—
১. আইনি লড়াই: মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড ইতিমধ্যেই আদালতের দ্বারস্থ হতে যাচ্ছে। ভারতের সকল মুসলমানদের উচিত এই আইনি লড়াইয়ে অর্থ ও সাহসে সহায়তা করা।
২. গণআন্দোলন: পুরো বিশ্ব বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে শান্তিপূর্ণ কিন্তু শক্তিশালী প্রতিবাদ হওয়া চাই। একেকটা মসজিদের মিম্বার, একেকটা মাদরাসা, স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দরস-ক্লাস যেন এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে।
৩. রাজনৈতিক সচেতনতা: মুসলমানদের রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বকে নিজ জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এই বিপর্যয়কর মুহূর্তে কারা বিশ্বাসঘাতকতা করছে, সেটি তুলে ধরতে হবে।
৪. সংযম ও হিকমাহ: রাষ্ট্রের উস্কানিতে পড়ে এখনই কোনো ধরনের অস্থিরতা তৈরি না করে, ধৈর্য ও কৌশলের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এবং দীর্ঘমেয়াদী সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে হবে।
৫. বয়কট ইন্ডিয়ান প্রোডাক্ট: বাংলাদেশ, পাকিস্তান সহ পুরো বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ এই বিল বাতিল না হওয়া পর্যন্ত ইন্ডিয়ান পণ্য বয়কট করুন এবং বিশ্বজুড়ে বয়কটের আহ্বান করুন! ইতোপূর্বে আপনারা বাংলাদেশে ইন্ডিয়ান পণ্য বয়কটের প্রভাব কি হয়েছিল, সেটি দেখতে পেয়েছেন।
৬. বিশ্বব্যাপী ইসলামী প্রতিরোধ সংগঠন একিউর নির্দেশনা ও পরামর্শসমূহ মান্য করুন! আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি একিউ ভারতবর্ষের মুসলিম জাতির অন্যতম অকৃত্রিম বন্ধু।
ভারতের মুসলিমদের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট বার্তা—
আপনাদের ইতিহাস, ভবিষ্যৎ, ধর্মীয় চিহ্ন সবই প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে। ভারতবর্ষ থেকে আপনাদের নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র চলছে। নিজেদের জিজ্ঞাসা করুন, এভাবেই কী হার মেনে নেবেন? যে জাতি মুঘল আমলে সাড়ে তিন লাখ ওয়াকফ সম্পত্তি গড়েছে, যে জাতি দান-সদকার মাধ্যমে শতাব্দী ধরে ইসলামী প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রেখেছে—তারা কি এই ষড়যন্ত্রের জালে নিজেকে বিলিয়ে দেবে? এখন সিদ্ধান্ত আপনার, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন নাকি এখনই রুখে দাঁড়াবেন?
পরিশেষে একিউর নেতৃবৃন্দের কিছু উপদেশ আপনাদের সামনে পেশ করছি—
ভারতের মুসলিমদের উদ্দেশ্যে শাইখ আইমান আয যাওয়াহিরী বলেন—"জিহাদ, ত্যাগ তিতিক্ষা, শাহাদাত, বন্দিত্ব, হিজরত ও নিজেদেরকে উৎসর্গ করা ছাড়া কখনোই নিজেদের অধিকার অর্জন, নিজেদের ভূখণ্ড স্বাধীন করা, নিজেদের সম্মান-সম্ভ্রম রক্ষা করা এবং রবের মনোনীত শরীয়ত বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবেন না। সক্ষমতা অর্জনের জন্য উপরোক্ত কাজগুলো আপনাদেরকে করতেই হবে।" [৫]
ভারতের সিংহপুরুষ মাওলানা শানুল হক সাম্ভালি (আসিম উমর) রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন—"আমার আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মুসলমান ভাইয়েরা! আপনারা আপনাদের মন থেকে এই চিন্তা দূর করে দেন যে, ভারত হিন্দুদের, এরা যখনই চাবে আমাদেরকে ভারত থেকে বের করে দিবে … আপনারা আল্লাহর শক্তির উপর ভরসা করুন, এই জমিন আপনাদের রব আল্লাহর, ব্রাহ্মণের প্রতিমাদের নয়, এই জমিনের উপর আপনারা নয়শ বছর শাসন করেছেন!" [৬]
একিউ উপমহাদেশ শাখার বর্তমান আমীর উস্তাদ উসামা মাহমুদ হাফিজাহুল্লাহ বলেন— "ভারতের আমার প্রিয় ভাইয়েরা! বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা মানি আর না মানি, প্রস্তুতি নেই বা না নেই, এ বাস্তবতা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, ভারতের ভূমিতে এক ভয়াবহ তুফান আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। এমন নির্দয় ঝঞ্ঝা ধেয়ে আসছে, যার কল্পনা করলেও হৃদয়-আত্মা কেঁপে উঠে, শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়। যদি এ ভয়াবহ তুফানের মোকাবেলার প্রস্তুতিতে বেশি দেরী হয়ে যায়, তবে আল্লাহ না করুন! ভারতের ভূমিতেও সেই হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটবে, যা কিছুদিন পূর্বে মিয়ানমারে আমাদের রোহিঙ্গা ভাইদের উপর নেমে এসেছিল। সেটা এমনই এক বিভৎস দৃশ্য, যার কল্পনা হলে যে কোন ঈমানদার মাত্রই চেতনা হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়।" [৭]
মনে রাখবেন! আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। আর যখন আল্লাহ কারো সঙ্গে থাকেন, তখন শাসকের বিষ দাঁতও ভেঙে পড়ে।
- মুনশি আব্দুর রহমান
জুমাবার, ০৪ মার্চ ২০২৫ ইং
------------------------------
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন লিংক-
[১] বিবিসি হিন্দিতে প্রকাশিত সংবাদের লিংক- https://archive.ph/uoy8a এবং https://archive.ph/N07Bw
[২] অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড–এর বিবৃতি (وقف ترمیمی بل 2025 کے سلسلے میں حکومت کا رخ افسوسناک) এর লিংক- https://archive.ph/fgNHb
[৩] অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড–এর বিবৃতি (وقف ترمیمی بل 2025 کے سلسلے میں حکومت کا رخ افسوسناک) এর লিংক- https://archive.ph/fgNHb
[৪] ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের বিক্ষোভ কর্মসূচির লিংক- https://archive.ph/RWdYh
[৫] কাশ্মীর ও ফিলিস্তিনঃ একই দুর্ভোগের পুনরাবৃত্তি- https://archive.ph/7dS78
[৬] কুফরি স্লোগানের স্বীকৃতি নয়- https://archive.ph/q9aFQ
[৭] ইসলাম তোমার দেশ, তুমি মুহাম্মাদের সৈনিক!- https://archive.ph/VPyRW
Comment