Announcement

Collapse
No announcement yet.

বাজেটের চোরাবালি (৪র্থ পর্ব): রাজস্বনীতি নামে চাঁদাবাজি - কেন? কিভাবে?? কোথায়???

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • বাজেটের চোরাবালি (৪র্থ পর্ব): রাজস্বনীতি নামে চাঁদাবাজি - কেন? কিভাবে?? কোথায়???

    আমাদের পরিবারগুলোর দৈনন্দিন জীবনে যে প্রক্রিয়াটি ঘটে, সেটিই আসলে বাজেটের সবচেয়ে সহজ ও বাস্তব রূপ। সাধারণত, পরিবারের বাবা, ভাই, ছেলে—সবাই মিলে সারা মাসে যে যেভাবে পারেন, উপার্জন করেন। কেউ চাকরি করেন, কেউ ব্যবসা, কেউবা দিনমজুরি। মাস শেষে আমরা সবাই মিলে বসি এবং আলোচনা করি—এই মাসে কে কত আয় করেছে এবং সেই অর্থ কিভাবে ব্যয় করা হবে।

    আমরা সিদ্ধান্ত নিই, কে কোন খাতে টাকা দেবে। যেমন—বাবার আয়ে বাসাভাড়া দেওয়া হবে, ভাইয়ের আয়ে বাজার করা হবে, আমার উপার্জনে বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল মেটানো হবে। এভাবে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের উপার্জন একত্রিত করে একটা সম্মিলিত অর্থভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরি হয়। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য থাকে—সকল গুরুত্বপূর্ণ খরচ মেটানো, সঞ্চয় নিশ্চিত করা, এবং অপ্রত্যাশিত ব্যয়ের জন্য প্রস্তুত থাকা।

    কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায়, মাসের নির্ধারিত খরচগুলো আমাদের মোট আয়ের চেয়ে বেশি হয়ে যাচ্ছে। তখন আমরা চিন্তা করি—এই ঘাটতি কিভাবে পূরণ করা যায়? আমরা কি কারো কাছ থেকে টাকা ধার নেব? নিলে কাকে নেব? কীভাবে সেই ঋণ শোধ করব? এই ঘাটতি পূরণের উপায় খোঁজাও বাজেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

    পরিবারিক এই আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা, খরচের অগ্রাধিকার নির্ধারণ, সম্ভাব্য ঘাটতির পূর্বানুমান, এবং ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের রূপরেখা মিলিয়ে—এই সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাকেই আমরা ‘বাজেট’ বলতে পারি।

    এই ধারণাটিই বৃহৎ পরিসরে গিয়ে জাতীয় বাজেটের রূপ নেয়, যেখানে একটি দেশের সরকার ঠিক করে—দেশের জনগণের কাছ থেকে কর এবং অন্যান্য উৎস থেকে সংগৃহীত অর্থ কীভাবে ব্যয় করা হবে, কোন খাতে কত বরাদ্দ যাবে, এবং ঘাটতি হলে কোথা থেকে ঋণ নেওয়া হবে, তা কিভাবে পরিশোধ করা হবে।

    রাষ্ট্র তো আর কৃষক-শ্রমিকদের মতো ভোরে উঠে মাঠে গিয়ে ঘাম ঝরিয়ে রোজগার করতে পারে না। সে শস্য ফলাতে জানে না, ইট বহন করে ঘর তুলতেও জানে না। মধ্যবিত্ত নাগরিকদের মতো সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চাকরি করে মাসশেষে বেতনের আশায় অপেক্ষা করাও তার স্বভাব নয়। তাহলে রাষ্ট্রের উপার্জনের পথ কী? তার তো নেই কোনো জমি, নেই কোনো কারখানা, নেই কোনো সেবা বিক্রির বাজার। অর্থ উপার্জনের কোনো স্বাভাবিক বা উৎপাদনশীল রাস্তা রাষ্ট্রের নেই বললেই চলে।

    কিন্তু তবুও রাষ্ট্র বেঁচে থাকে, চলে, কখনো ফুলে-ফেঁপেও ওঠে। কীভাবে? অর্থ সংগ্রহ করে সে। আর এই অর্থ সংগ্রহের রাস্তাও সীমিত—প্রধানত দুটো—ভিক্ষুকের পথ অথবা চাঁদাবাজের পথ।

    কিন্তু অধিকাংশ সময়, রাষ্ট্র ভিক্ষুক না হয়ে বেছে নেয় দ্বিতীয় পথটি—চাঁদাবাজের পথ।

    রাষ্ট্র যখন কর, ভ্যাট, সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি, সারচার্জ, ফাইন, লেট ফি—নানা নামে নাগরিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় বোঝা, তখন সে হয়ে ওঠে এক ঠাণ্ডা মাথার চাঁদাবাজ। সে বলে না, ‘দয়া করে কর দিন’। সে বলে, ‘কর না দিলে আইন আছে, জেল আছে, জরিমানা আছে।’ এই চাঁদাবাজ রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মুখে ‘উন্নয়ন’ ও ‘জাতীয় স্বার্থ’-এর কথা শোনায়, কিন্তু আদতে তা হয় একটি শ্রেণির বিলাস ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার খরচ বহন করানোর কৌশল।

    আমাদের আজকের আলোচনা তিনটি প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ঘুরবে।

    এক, কেন রাষ্ট্র এত সহজে নিজেদের চাঁদাবাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পেরেছে?
    দুই, তারা ঠিক কীভাবে এই চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে?
    এবং তিন, এই চাঁদাবাজির টাকা কোথায় খরচ হয়, আর কীভাবে আমাদের চোখের সামনে একটি মোড়ক চাপিয়ে সত্যকে লুকিয়ে রাখা হয়?


    প্রশ্ন এক, কেন রাষ্ট্র এত সহজে নিজেদের চাঁদাবাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পেরেছে?

    খিলাফতের পতনের পর মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর আজকের অবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায়, অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে শরীয়াই নিজেই সেই বিচ্যুতির মূল কারণ এবং শরীয়া তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অপারগ। এটা এক ধরনের ভুল ধারণা, যা শরীয়ার প্রকৃত মাহাত্ম্যকে অবমূল্যায়ন করে। এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে কারণ অনেকেই শরীয়াকে যুগোপযোগী ও পরিবর্তনশীল জীবন ব্যবস্থার প্রতিপাদ্য হিসেবে দেখতে অস্বীকার করেছে।

    আরেকটি বিপজ্জনক মিথ্যাচার ছড়িয়েছে, যেখানে বলা হয় জীবনকে দুই ভাগে ভাগ করতে হবে—শরীয়া অথবা দুনিয়া। যেন এই দুটির মধ্যে কোনো সমঝোতা বা মিল হতে পারে না। এই মিথ্যা দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে বাধ্য করেছে ভাবতে যে শরীয়া জীবনের উন্নয়নের পথে বাঁধা, এবং উন্নত জীবন চাইলে শরীয়াকে পরিত্যাগ করতেই হবে। ফলশ্রুতিতে, অনেকেই এই ভুল বোঝাবুঝির কারণে শরীয়ার বাইরে চলে গেছেন, আধুনিকতার মায়ায় বিভ্রান্ত হয়েছেন, এবং নিজেদের জন্য ক্ষতিকর পথ বেছে নিয়েছেন।

    এই ভুল পথ আমাদের সমাজকে বিভক্ত করেছে, আমাদের আত্মবিশ্বাসকে হারিয়েছে এবং আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বপ্নকে ফিকে করে দিয়েছে।

    পশ্চিমারা এই সমসাময়িক বাস্তবতাকে খুব সূক্ষ্মভাবে বুঝতে পেরেছে। তারা জানে, কিভাবে নিজেদেরকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হয়, যেন মনে হয় তারা মানবজাতির একমাত্র সমস্যার সমাধানদাতা। তারা নিজেদের এমনভাবে চিত্রিত করেছে যেন তারা এমন সব পদ্ধতি, নীতি ও আইন আবিষ্কার করতে সক্ষম, যা আধুনিক জীবনব্যবস্থার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ, সময়ের দাবি মেটায় এবং সমাজে স্থিতিশীলতা আনে।

    তারা যুক্তি, বুদ্ধি ও চিন্তার মোড়কে এমন এক কাঠামো দাঁড় করিয়েছে, যার ফলে তাদের প্রণীত আইনগুলো আপাতত দৃষ্টিতে ন্যায়পরায়ণ, বাস্তবভিত্তিক এবং সর্বজনগ্রাহ্য মনে হয়। কিন্তু এই সব কিছু ব্যবস্থার গভীরে লুকিয়ে আছে একটি সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া—ইসলাম ও শরীয়াকে ধীরে ধীরে ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন এবং রাষ্ট্রচিন্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া। ইসলামী আদর্শ যেন আর কোনো কেন্দ্রীয় অবস্থান না পায়—সেটিই তাদের মূল লক্ষ্য।

    এবং যখন আমরা, মুসলিম সমাজ, নির্দ্বিধায় এই ব্যবস্থাগুলিকে গ্রহণ করতে শুরু করেছি, তখন প্রকৃতপক্ষে আমরা শুধু কোনো আইন মেনে নিচ্ছি না, বরং আমরা তাদের হাতে একপ্রকার কর্তৃত্ব ও বৈধতা তুলে দিচ্ছি। এই বৈধতার মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে আমাদের উপর একটি ক্ষমতাধর ও সর্বময় নিয়ন্ত্রক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এর ফলাফল দাঁড়িয়েছে এই—তারা আমাদের উপর নিজেদের তৈরি করা আইন চাপিয়ে দিতে পারে, আমাদের অর্থনীতির উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে, এমনকি আমাদের জীবনযাপন নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারও নিজেদের বলে দাবি করতে পারে।

    এইভাবে তারা শুধু শাসক নয়, একপ্রকার চাঁদাবাজ রূপে আবির্ভূত হয়েছে—যারা আমাদের কাছ থেকেই আদায় করে নেয় কর, ফি, শুল্ক, ঋণের সুদ আর নানা ধরণের জবরদস্তিমূলক আর্থিক বোঝা। আর আমরা নিজেদের অজান্তেই এই গোটা প্রক্রিয়ায় পরিণত হচ্ছি নিঃস্ব, আত্মহীন ও পরাধীন এক জনগোষ্ঠীতে।

    প্রশ্ন দুই, তারা ঠিক কীভাবে এই চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে?

    আমরা যদি আমাদের চারপাশে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব যে জীবনের প্রায় প্রতিটি দিকই কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রের অধীনস্থ হয়ে পড়েছে। এই নিয়ন্ত্রণ সবসময় সরাসরি হয় না; বরং অনেক সময় এটি পরোক্ষ, নীতিনির্ধারণমূলক, বা লাইসেন্সিংয়ের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়। এমনকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এমনসব সাধারণ অভ্যাস বা লেনদেন—যেগুলো একসময় একেবারেই স্থানীয় এবং মুক্ত ছিল—তাও আজ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের আওতায় চলে এসেছে।

    সরকার সাধারণত তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বা জনকল্যাণের নামে। যেমন, কৃষি, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ, পানি, পরিবহন—এসব মৌলিক খাত সরকার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে। জনগণের জন্য এসব খাতের গুরুত্ব অপরিসীম বলে দেখিয়ে সেগুলোতে সরকারি হস্তক্ষেপ ‘যৌক্তিক’ বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের সক্ষমতা বা সদিচ্ছার সীমাবদ্ধতার কারণে সবকিছু সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। তখনই তারা বিকল্প পথ বেছে নেয়—সেটা হলো লাইসেন্স, সার্টিফিকেট, অনুমোদন, বা মান নিয়ন্ত্রণের নামে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।

    এই পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের একটি খুব সাধারণ উদাহরণ আমাদের শিশুকালের বাজার সংস্কৃতি। এক সময় ছিল, যখন আমরা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে ঝালমুড়ি, মোয়া, কটকটি, নাড়ু—এই ধরনের খাবার সরাসরি কিনে খেতাম। পাঁচ টাকা দিলে পাঁচ টাকার জিনিস পাওয়া যেত। সেখানে কোনো প্যাকেট, কোনো বারকোড, কোনো ফুড অথরিটির সিল ছিল না। ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে একটি সরল বিশ্বাস ও লেনদেনের সম্পর্ক ছিল। আজকে সেই চিত্র সম্পূর্ণ বদলে গেছে। এখন সেই একই পণ্যের জন্য আমাদের যেতে হয় ব্র্যান্ডেড দোকানে, অথবা কিনতে হয় প্যাকেটজাত মোড়কে। সেই প্যাকেটের ভেতরে থাকা পণ্য হয়তো আগে যা ৫ টাকায় পেতাম, এখন ৫ টাকায় সেই একই পরিমাণ পাই না। কারণ সেই পণ্যের দামে যুক্ত হয়েছে কর, লাইসেন্স ফি, প্যাকেজিং খরচ, ও কোম্পানির লাভের হিসাব। এবং এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার পেছনে রয়েছে একটি রাষ্ট্রীয় অনুমোদন কাঠামো—যা বাধ্যতামূলক।

    এখানে রাষ্ট্র সরাসরি সেই মুড়ি বানাচ্ছে না, কিন্তু রাষ্ট্র বলছে—"তুমি যদি বানাতে চাও, তবে আমার অনুমতি লাগবে।" আবার বলছে—"তুমি যদি বিক্রি করতে চাও, তবে আমার লাইসেন্স লাগবে।" অর্থাৎ, রাষ্ট্র নিজে কিছু তৈরি না করেও, সে প্রতিটি উৎপাদনের পেছনে একটি নিয়ন্ত্রণমূলক অস্তিত্ব হিসেবে থেকে যাচ্ছে এবং এই অবস্থানকে বৈধতা দিচ্ছে আইন, সার্টিফিকেট, ট্যাক্স, এবং নিরাপত্তার নামে।

    এভাবে ধীরে ধীরে রাষ্ট্র এমন এক অবয়বে পরিণত হয়েছে, যেটি আমাদের ঘরের চুলা থেকে শুরু করে ফ্যাক্টরির চিমনি পর্যন্ত—সবকিছুতে অংশীদার। চুলায় কী রাঁধবো, কীভাবে পরিবেশন করবো, কোন ব্র্যান্ডের তেল বা ডাল ব্যবহার করবো—সবকিছুতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বা ‘অনুমতি’ জড়িয়ে গেছে।

    এই চিত্র শুধু খাওয়া-দাওয়ায় সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা, ধর্মীয় কর্মকাণ্ড—সব ক্ষেত্রেই এই নিয়ন্ত্রণের জাল বিস্তৃত হয়েছে। আপনি যদি একটি ছোট স্কুল খুলতে চান, তাহলেও লাইসেন্স লাগবে। যদি একটি মসজিদে মাইকে আজান দিতে চান, সেখানে পর্যন্ত সাউন্ড পারমিশন নিতে হয়। এই ব্যবস্থাটি শুধুই নিরাপত্তার প্রশ্ন না; এটি মূলত নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন।

    এভাবেই ধীরে ধীরে সরকার বা রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে প্রবেশ করে ফেলেছে। শুধু প্রবেশই নয়—এই প্রবেশের মাধ্যমে তারা আমাদের উপর এক ধরনের পরোক্ষ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছে। আমরা হয়তো স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করছি না, কিন্তু প্রতিটি লেনদেন, প্রতিটি সেবা, এমনকি প্রতিটি চাহিদার পেছনে সরকার এখন কোনো না কোনোভাবে উপস্থিত।

    এই উপস্থিতির একটি বড় দিক হলো অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ—বিশেষ করে ভ্যাট, ট্যাক্স, শুল্ক, ফি ইত্যাদির মাধ্যমে। হোক সেটা বাজারে কেনাকাটা, বা গ্যাস-পানির বিল দেওয়া, কিংবা কোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কিছু কেনা—আমরা যেখানেই হাত দিচ্ছি, সেখানেই রাষ্ট্র আমাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে। কেউ চাইলেও এই কাঠামোর বাইরে থাকতে পারছে না। আর কেউ না চাইলেও, চুপচাপ থেকে সেই সিস্টেমের অংশ হয়ে যাচ্ছে। অবচেতনভাবেই আমরা এই কাঠামোকে স্বীকৃতি দিচ্ছি, এবং আরও দুঃখজনকভাবে, নিজের পকেটের টাকা দিয়েই সরকারকে শক্তিশালী করছি।

    আমরা বুঝি বা না বুঝি, চাই বা না চাই—এই ব্যবস্থায় আমাদের অংশগ্রহণ সরকারকে আরও অধিক নিয়ন্ত্রণক্ষম, এবং অর্থনৈতিকভাবে আরও বেশি নির্ভরযোগ্য করে তুলছে। এ যেন এমন এক খেলা, যেখানে আপনি না খেললেও আপনার হাতের পয়সা দিয়ে খেলোয়াড়কে জেতাতে বাধ্য হচ্ছেন।

    প্রশ্ন তিন, এই চাঁদাবাজির টাকা কোথায় খরচ হয়, আর কীভাবে আমাদের চোখের সামনে একটি মোড়ক চাপিয়ে সত্যকে লুকিয়ে রাখা হয়?

    এই টাকা গুলো কোথায় এবং কিভাবে খরচ হয়—এটাই আজকের দিনে এসে সবচেয়ে বড় এবং জরুরি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্র যখন প্রতিবছর বিশাল বাজেট ঘোষণা করে এবং জনগণের ঘাড়ে করের বোঝা চাপিয়ে দেয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই জনমনে একধরনের সংশয় তৈরি হয় যে, এই অর্থের ব্যবহার আসলে কীভাবে ও কার স্বার্থে হচ্ছে। এই প্রশ্ন শুধু অর্থনৈতিক নয়; এটি রাজনৈতিক এবং নৈতিক প্রশ্নও বটে। কারণ বাজেট কেবল টাকার হিসাব নয়, এটি একটি রাষ্ট্র কীভাবে জনগণকে দেখে, জনগণকে কতটুকু গণ্য করে এবং রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র কেমন—এই প্রশ্নগুলোরও উত্তর বহন করে।

    সাধারণত দেখা যায়, এই বাজেটের টাকা মূলত দুইটি প্রধান খাতে ব্যয় করা হয়ে থাকে: প্রতিরক্ষাখাত এবং উন্নয়নখাত। এমন রাষ্ট্রগুলো, যেগুলো সামরিকভাবে সক্রিয়, যুদ্ধ বা আন্তর্জাতিক শক্তির খেলায় যুক্ত, তারা নিজেদের জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থকে বৈধতা দেওয়ার জন্য প্রতিরক্ষাখাতে ব্যয়ের একটি নাটকীয় রূপ তুলে ধরে। মিসাইল, জেট ফাইটার, সাবমেরিন, ট্যাংক—এগুলোর সংখ্যা এবং মডেল দিয়ে বোঝানো হয় যে, রাষ্ট্র নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় কতটা সজাগ। এমন উদাহরণ আমরা দেখতে পাই ভারত, পাকিস্তান, ইসরাইল, আমেরিকা বা তুরস্কের মতো দেশগুলোতে। এদের প্রতিরক্ষা বাজেট শুধু বিশাল নয়, বরং প্রতিটি বরাদ্দের সঙ্গে জড়িত থাকে আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাণিজ্য, লবিস্ট গ্রুপ এবং ভূ-রাজনৈতিক শক্তির হিসাবনিকাশ। এই খাতে দুর্নীতি এবং কমিশন বাণিজ্য বৈশ্বিক পরিসরে এতটাই গভীর যে অনেক সময় একেকটি যুদ্ধ বা সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান মূলত অস্ত্র বিক্রির পটভূমি তৈরির জন্য পরিচালিত হয়।

    কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র, যা সামরিক দিক থেকে তুলনামূলকভাবে নিষ্ক্রিয় এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতি থেকে দূরে, সেখানে জনগণকে সরাসরি প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের যৌক্তিকতা বোঝানো কঠিন। তাই এখানে কৌশল পাল্টানো হয়—প্রতিরক্ষার বদলে উন্নয়নকে সামনে আনা হয়। বড় বড় মেগা প্রকল্প যেমন পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল বা স্মার্ট শহরের মতো দৃষ্টিনন্দন পরিকল্পনাগুলো দেখিয়ে বোঝানো হয় যে রাষ্ট্র উন্নয়নমুখী।

    তবে প্রকল্পের অর্থনীতির বাইরেও রয়েছে এর রাজনীতি। প্রকল্প মানেই টেন্ডার, কমিশন, বিদেশি ঋণ, কনসালট্যান্সি—যেখানে প্রশাসনের এক শ্রেণির কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মিলে তৈরি করে দুর্নীতির অবিরাম চক্র। প্রকল্প যত বড়, লুটপাটের সুযোগ ততই বিশাল। এবং এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে শুধু অর্থ লোপাটই নয়, তৈরি হয় রাষ্ট্রের ‘উন্নয়নের ব্র্যান্ডিং’—যা ব্যবহার করা হয় রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে, নির্বাচনের আগে জনমত গঠনের হাতিয়ার হিসেবে।

    তবে সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় হলো, এই বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বাস্তবে ব্যয় হয় নজরদারি এবং দমননীতির পেছনে। গণতন্ত্র, নিরাপত্তা, বা ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার কথা বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আধুনিক সরঞ্জাম, প্রযুক্তি ও ক্ষমতা দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে একটি তথাকথিত “নিরাপদ রাষ্ট্র” তৈরি করা হয়—যেখানে জনগণের ওপর সর্বক্ষণ নজরদারি চলে, বিরোধী কণ্ঠ দমন করা হয়, এবং ভিন্নমত পোষণকারীরা ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ ট্যাগ পেয়ে নিপীড়নের শিকার হন। এসবের পেছনে যে অর্থ ব্যয় হয়, সেটি প্রকাশ্যে স্বচ্ছ না হলেও বাজেটের খাত অনুযায়ী বরাদ্দ থাকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, ইন্টেলিজেন্স, ICT surveillance, কিংবা বিশেষ বাহিনীর আধুনিকায়নের নামে।

    বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমরা এই চিত্র বারবার দেখতে পাই। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি যেন একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। বড় বড় প্রকল্পের নামে বাজেটের টাকা নিজেদের পকেটে ঢোকানো হয়েছে, আবার সেই একই রাষ্ট্রের পুলিশ, র‍্যাব, সাইবার সেল ব্যবহার করা হয়েছে জনগণের কণ্ঠরোধে। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা’ নামে গণতন্ত্রের কণ্ঠ দমন করা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি করে প্রতিবাদী কণ্ঠ বন্ধ করা হয়েছে। ফলে যে অর্থ জনগণ উন্নয়নের জন্য দিয়েছে, সেটি একদিকে রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের হাতে লুট হয়েছে, অন্যদিকে জনগণের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হয়েছে।

    এই বাস্তবতায় আমরা দেখতে পাই, একটি রাষ্ট্রের বাজেট প্রকৃতপক্ষে তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি বড় অংশ চলে যায় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতিতে, আরেকটি অংশ ব্যয় হয় নজরদারি ও দমনব্যবস্থার জন্য, এবং বাকি ক্ষুদ্র একটি অংশ ব্যয় হয় এমন কিছু খাতে, যা জনসাধারণের চোখে ‘উন্নয়ন’ বলে প্রতীয়মান হয়। এর ফলে রাষ্ট্রের প্রকৃত উৎপাদনশীলতা কমে যায়, ঋণ-নির্ভরতা বাড়ে, এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কেবল পরিসংখ্যানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

    এই চক্রটি যদি চলতেই থাকে, তবে রাষ্ট্র এক সময় তার অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা হারাবে। এভাবে প্রতিবছর রাষ্ট্রীয় বাজেটের মূল অর্থের একটি বড় অংশ ‘লিক’ হয়ে যায়—দুর্নীতি, নজরদারি ও রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহতকরণের খাতে। যার ফলে রাষ্ট্রের প্রকৃত আর্থিক সক্ষমতা ক্রমাগত কমতে থাকে। অর্থনীতির মেরুদণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে। বাজেটের আকার বাড়বে, কিন্তু কার্যকারিতা কমবে। একদিকে বৈদেশিক ঋণ ও করের চাপ বাড়বে, অন্যদিকে জনগণের হাতে থাকবে না মৌলিক সেবা, জীবনমান বা নিরাপত্তা। কিছু বছরের মধ্যেই, কিংবা কয়েক যুগ পরে, এই ব্যবস্থার ফল দাঁড়াবে এক ধরনের ‘সুশৃঙ্খল দেউলিয়াত্ব’—যেখানে রাষ্ট্র টিকে থাকবে, কিন্তু তার নীতিগত স্বাধীনতা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকবে না।

    ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ একটি আমানত, যা জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা কর্তব্য।

    নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন—
    عَنْ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ:
    "كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ..."

    ইবনে উমর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি:
    “তোমাদের প্রত্যেকেই একজন রাখাল, এবং প্রত্যেকেই তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। ইমাম (শাসক) একজন রাখাল, সে তার প্রজাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে...”


    [এরপর হাদীসে পরিবারের প্রধান, নারীর দায়িত্ব, দাসের দায়িত্ব ইত্যাদিও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।](সহীহ বুখারী, হাদীস: ৮৯৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১৮২৯)
    কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় রাষ্ট্র যেন এক ভয়ঙ্কর তামাশার মঞ্চ, যেখানে রাখালই লুটে নিচ্ছে ভেড়াগুলোর চামড়া।
    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ
Working...
X