"এদিকে লালিকেও কুরবানি দেওয়া হয়ে গেল। ঈদের পরের দিন বুবন ফিরল বাড়িতে। বাড়িতে ফিরেই তার মনটা হু হু করে উঠল। লালির দড়িটা গাছে বাঁধা আছে এখনো, কিন্তু লালি নেই। এ দৃশ্য দেখে চিৎকার করে পুরো বাড়ি মাতিয়ে তুলল সে। লালিকে তার এনে দিতেই হবে। কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছিল না তাকে। অবশেষে মক্তবের হুজুরের মাধ্যমে ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম)-এর কুরবানির ঘটনা শুনিয়ে বুবনকে শান্ত করা হলো। কিন্তু লালির মুখোচ্ছবি বুবনের মন থেকে সরানো গেল না। বারবার সে গাছের তলায় লালির দড়ির কাছে এসে লালিকে খুঁজতে থাকে। লালির দড়ির কাছে আনমনে কি যেন ভাবে। হাহাকারে ঘেরা মনটাকে কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারছিল না বুবন। লালিকে তো তার অনেক গল্প বলার ছিল। অনেক কথা অনেক প্রশ্নও জমা ছিল মনে। কিছুই তো বলা হলো না। লালি কি আর ফিরে আসবে কখনো। কখনো কি লালি তার মায়াবি চোখে বুবনের দিকে তাকাবে? তার হাতে খাবার খাবে? লালি নাকি আল্লাহর কাছে চলে গেছে। সেখানে ভালো থাকবে লালি। এ কথাগুলোই বুবনের কাছে সান্ত্বনার বাণী হয়ে থাকল।"
এটি একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত শিশুসাহিত্যের গল্প—সতর্কভাবে গাঁথা, সহজ ভাষায় লেখা, কিন্তু এর গভীরে রয়েছে একটি চিন্তাজাগানিয়া প্রবণতা, যা বিশেষভাবে আমাদের খেয়াল করা উচিত। গল্পটির কেন্দ্রে একটি শিশু- বুবন, এবং তার প্রিয় গরু- লালি। ঈদে কুরবানি দেওয়া হয় লালিকে। ঈদের পরে বুবন যখন বাড়ি ফেরে, তখন তার ছোট্ট মন যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সে আর লালিকে পায় না, শুধু পায় ফাঁকা গাছের নিচে পড়ে থাকা সেই পুরোনো দড়িটা—যেটা দিয়ে একসময় লালিকে বেঁধে রাখা হতো। সেই মুহূর্তে তার হাহাকার- যেন একটাই কথা বলে: “লালিকে ফিরিয়ে দাও।”
এই ছোট্ট গল্পে একটা সাধারণ অনুভূতি তুলে ধরা হয়েছে—একটি শিশুর প্রাণীর প্রতি মায়া, একটি প্রাণীর অভাববোধে তার কষ্ট। এতদূর পর্যন্ত সব ঠিকই আছে। শিশুদের মধ্যে করুণা, দয়া ও প্রাণীর প্রতি মমত্ববোধ জাগানো ইসলামেরই শিক্ষা। আমরা আমাদের সন্তানদেরকে শিখিয়ে থাকি, কোনো পশু-পাখিকে অন্যায়ভাবে আঘাত করা যাবে না। নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে পশুদের প্রতি এতটা মমত্বশীল ছিলেন তা হাদিস থেকে জানা যায়।
কিন্তু, উপরোক্ত এই গল্পে সমস্যাটা শুরু হয় যখন শিশুটিকে ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম)-এর কুরবানির ঘটনা শোনানো হয়, যাতে তার মন শান্ত হয়, যাতে সে বুঝতে পারে যে এটি কোনো নিষ্ঠুরতা নয়, বরং আল্লাহর হুকুম পালনের একটি মহান নিদর্শন। কিন্তু তারপরও বুবনের মন থেকে সরে না লালির স্মৃতি। সে ঘটনা মেনে নিতে পারে না, বারবার ফিরে আসে গাছতলায়, খোঁজে লালিকে। তার মন প্রশ্নে ভরা—“লালি কি আর আসবে না? এখানেই সূক্ষ্মভাবে এক বিপজ্জনক বীজ রোপণ করা হয়।
এই গল্পে ঈমান ও ইবাদতের ধারণাকে শিশুর আবেগ ও স্নেহের কাছে নরম করে দেওয়া হয়েছে। যেন বলা হচ্ছে, হ্যাঁ কুরবানি এক ধরনের ধর্মীয় রীতি, কিন্তু এটি আসলে বেদনাদায়ক, বিভ্রান্তিকর—এমনকি অবিচারপূর্ণও। এই কথাগুলো সরাসরি বলা হয়নি, বরং শিশুর মনের দোলাচলের মাধ্যমে পাঠকের মনের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিশু-পাঠক যারা এই গল্প পড়বে, তাদের মনেও জন্ম নিতে পারে এমন প্রশ্ন: “আল্লাহ কি সত্যিই চেয়েছিলেন লালিকে কোরবানি দিতে?” কিংবা, “আমার প্রিয় গরুটা কি সত্যিই এক ধর্মীয় কর্তব্যে উৎসর্গযোগ্য?”
আমরা বুঝতে পারি, সাহিত্য ও গল্প অনেক শক্তিশালী মাধ্যম। এদের মাধ্যমে শুধু বিনোদন নয়, বিশ্বাস, আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গিও গঠন করা হয়। পশ্চিমা দুনিয়ায় বহু আগে থেকেই চলচ্চিত্র, কার্টুন, গল্প ও নাটকের মাধ্যমে ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে। আমাদের দুনিয়াতেও এখন সেই ধারা ঢুকে পড়েছে। সরাসরি প্রশ্ন করা নয়, বরং কোমল ভাষায়, সংবেদনশীল দৃষ্টিকোণে উপস্থাপন করে শিশুদের মনে এমন ভাবনার চারা রোপণ করা হচ্ছে যা কালক্রমে আস্থাহীনতা ও দ্বিধার বৃক্ষ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অবাক হবার কিছু নেই যে, ঈমান ও ইসলামী মূল্যবোধকে আঘাত করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে, সেগুলোকে “অনুভূতির বিরুদ্ধে” দাঁড় করানো। আজকের দুনিয়া অনুভূতির দুনিয়া—“আমার অনুভবটাই সত্য”, “আমার দুঃখটাই বড়”—এমন এক দর্শন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যেখানে সত্যের বিচার হয় আবেগ দিয়ে। এই গল্পটিও সেই ধারারই একটি নমুনা। শিশুটির অনুভবের সামনে ইবাদতকে একধরনের ‘সমস্যা’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা তাকে আঘাত দিয়েছে, তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে—
উত্তরটা সোজাসাপ্টা: না, আমাদের সন্তানরা এই ধরনের গল্প পড়বে না। কোনো দ্বিধা বা সমঝোতার জায়গা নেই এখানে। আর এই না বলার পেছনে রয়েছে দুটো গভীর, শরঈ ও বুদ্ধিবৃত্তিক কারণ।
প্রথম কারণ হলো সায়্যিদুনা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু)-এর সেই ঐতিহাসিক ঘটনা।
হযরত ওমর (রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) একবার তাওরাতের কিছু অংশ পড়ে খুব ভালো লাগা অনুভব করলেন। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)–এর কাছে এসে বললেন:
يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنِّي مَرَرْتُ بِأَخٍ لِي مِنْ بَنِي قُرَيْظَةَ، فَكَتَبَ لِي جَوَامِعَ كَلَامٍ مِنَ التَّوْرَاةِ أَلَا أَعْرِضُهَا عَلَيْكَ؟
“ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি বনী কুরায়যার একজন ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম। সে তাওরাত থেকে কিছু সংক্ষিপ্ত নসিহত লিখে দিয়েছে। আপনি কি অনুমতি দেন আমি তা আপনার সামনে পেশ করি?”
এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)–এর চেহারা রাগে লাল হয়ে গেল এবং তিনি বললেন:
أَمُتَهَوِّكُونَ فِيهَا يَا ابْنَ الْخَطَّابِ؟ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَقَدْ جِئْتُكُمْ بِهَا بَيْضَاءَ نَقِيَّةً، لَا تَسْأَلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ عَنْ شَيْءٍ فَيُصَدِّقُوكُمْ بِبَاطِلٍ، أَوْ يُكَذِّبُوكُمْ بِحَقٍّ، وَاللَّهِ لَوْ كَانَ مُوسَى حَيًّا مَا وَسِعَهُ إِلَّا أَنْ يَتَّبِعَنِي
“হে খাত্তাব–পুত্র! তুমি কি এখনো দ্বিধান্বিত? (তাদের কিতাবের প্রতি আগ্রহ দেখিয়ে) সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! আমি তোমাদের কাছে একটি পরিপূর্ণ, বিশুদ্ধ দ্বীন নিয়ে এসেছি। তোমরা আহলে কিতাবদের কাছে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করো না—তারা হয়তো তোমাদেরকে কোনো ভুল কথা বলে সত্য বলে বিশ্বাস করাবে, অথবা কোনো সত্যকে মিথ্যা বলবে। আল্লাহর কসম, যদি মূসা (আলাইহিস সালাম) আজ জীবিত থাকতেন, তিনিও আমার অনুসরণ করা ছাড়া কোনো পথ খুঁজে পেতেন না।”
(মুসনাদ আহমদ –১৪৬৩১)
সাহাবীদের মধ্যে যিনি “ফারূক”—সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী নামে খ্যাত, সেই মহান সাহাবীকে যদি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এভাবে সতর্ক করে দেন, তাহলে আজ আমরা কিভাবে নির্দ্বিধায় আমাদের কোমলমতি শিশুদের এমন সব গল্প পড়তে দিই, যেখানে ইবাদতের রূপকে বিকৃত করে দেখানো হয়? রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যদি একজন প্রাপ্তবয়স্ক, বিচক্ষণ, ইমানদার সাহাবীকেও সরাসরি নিষেধ করেন, তাহলে শিশুদেরকে এমন ‘শিক্ষামূলক’ গল্প পড়ানোর কী যুক্তি থাকতে পারে?
দ্বিতীয় কারণ হলো—শিশুদের মন অত্যন্ত কোমল ও সংবেদনশীল। তারা যা দেখে, যা শোনে, যা পড়ে—তা তাদের মনে স্থায়ী দাগ কেটে যায়। এই গল্পগুলোর মতো সূক্ষ্মভাবে গাঁথা আখ্যানগুলো শিশুদের মধ্যে এমন এক আস্থাহীনতা সৃষ্টি করতে পারে, যা পরবর্তীতে তাদের ঈমান, আকিদা ও তাওহীদ-বোধের ভিত নড়বড়ে করে দিতে পারে।
যদি গল্প পড়ানো জরুরি হয়, তাহলে কেন আমরা তাদের রাসূলদের কাহিনি, সাহাবাদের আত্মত্যাগ, ইসলামের ভিত্তিভূমি আকীদাহ এবং সঠিক ইবাদতের শিক্ষা দিয়ে শুরু করব না? বরং সেখান থেকেই শুরু করা উচিত। ছোটবেলা থেকেই যদি বাচ্চারা বুঝে রাখে—“আমার আল্লাহ এক, তাঁর হুকুমই চূড়ান্ত, রাসূলের পথই আমার পথ”—তবে পরবর্তী জীবনে যখন তারা আরও জটিল বিষয়ের মুখোমুখি হবে, তখন তারা বিভ্রান্ত হবে না, বরং দৃঢ় থাকবে।
এই যুগে “গল্প” আর “গল্পই তো” বলেই শিশুদের হাতে তুলে দেওয়া হয় এমন অনেক সাহিত্য যা আদতে এক ধরনের চিন্তাগত বিষ। তা সরাসরি নয়—বরং ‘মানবতা’, ‘সংবেদন’, ‘আবেগ’—এই মোড়কে। আর ঠিক এখানেই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ গল্প শিশুদের শুধু বিনোদন দেয় না, এটি তাদের বিশ্বাসের কাঠামোও গড়ে তোলে।
তাই আমরা বলি—না, আমাদের বাচ্চারা এই ধরনের গল্প পড়বে না। কারণ আমরা চাই না, তারা এমন কোনো আখ্যান পড়ে বড় হোক, যা তাদের মনে ইবাদতের প্রতি সন্দেহ, কুরবানির প্রতি আক্ষেপ, বা আল্লাহর হুকুমের প্রতি দুঃখ জন্ম দেয়।
আমরা চাই, আমাদের সন্তানরা বড় হোক এমন গল্প পড়ে, যেগুলো তাদের হৃদয়ে সাহাবীদের মতো সাহস, তাওহীদের প্রতি আনুগত্য, এবং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা জন্ম দেয়। যেন তারা হযরত আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু)'র মত বলতে পারে যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞাসা করেন, “তুমি পরিবার-পরিজনের জন্য কী রেখে এসেছো?” তিনি উত্তর দেন, “আল্লাহ ও তাঁর রাসূল।”
আমাদের সন্তানদের মুখেও যেন একদিন সেই কথাই উচ্চারিত হয়—“আমার অনুভব নয়, আমার রবের হুকুমই সর্বোচ্চ।”
এটাই হবে তাদের গল্প। এটাই হবে আমাদের জবাবদিহিতার প্রমাণ।
বুবনের ঈদ ও লালির গল্প
-দৈনিক যুগান্তর, (পৃষ্ঠা -৭)
তারিখ: ৩১ মে, ২০২৫
-দৈনিক যুগান্তর, (পৃষ্ঠা -৭)
তারিখ: ৩১ মে, ২০২৫
এটি একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত শিশুসাহিত্যের গল্প—সতর্কভাবে গাঁথা, সহজ ভাষায় লেখা, কিন্তু এর গভীরে রয়েছে একটি চিন্তাজাগানিয়া প্রবণতা, যা বিশেষভাবে আমাদের খেয়াল করা উচিত। গল্পটির কেন্দ্রে একটি শিশু- বুবন, এবং তার প্রিয় গরু- লালি। ঈদে কুরবানি দেওয়া হয় লালিকে। ঈদের পরে বুবন যখন বাড়ি ফেরে, তখন তার ছোট্ট মন যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সে আর লালিকে পায় না, শুধু পায় ফাঁকা গাছের নিচে পড়ে থাকা সেই পুরোনো দড়িটা—যেটা দিয়ে একসময় লালিকে বেঁধে রাখা হতো। সেই মুহূর্তে তার হাহাকার- যেন একটাই কথা বলে: “লালিকে ফিরিয়ে দাও।”
এই ছোট্ট গল্পে একটা সাধারণ অনুভূতি তুলে ধরা হয়েছে—একটি শিশুর প্রাণীর প্রতি মায়া, একটি প্রাণীর অভাববোধে তার কষ্ট। এতদূর পর্যন্ত সব ঠিকই আছে। শিশুদের মধ্যে করুণা, দয়া ও প্রাণীর প্রতি মমত্ববোধ জাগানো ইসলামেরই শিক্ষা। আমরা আমাদের সন্তানদেরকে শিখিয়ে থাকি, কোনো পশু-পাখিকে অন্যায়ভাবে আঘাত করা যাবে না। নবী (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে পশুদের প্রতি এতটা মমত্বশীল ছিলেন তা হাদিস থেকে জানা যায়।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত: “আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সঙ্গে একটি সফরে ছিলাম। তিনি কিছুক্ষণের জন্য আমাদের থেকে সরে গেলেন। এ সময় আমরা একটি লালচে পাখি দেখতে পেলাম, যার সঙ্গে দুটি ছানা ছিল। আমরা ছানাগুলো ধরে ফেললাম। তখন মা পাখিটি আমাদের চারপাশে পাখা ঝাপটাতে লাগল। এ সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ ফিরে এসে বললেন: ‘কে এই পাখির ছানাগুলো নিয়ে তার কষ্টের কারণ হয়েছে? ছানাগুলোকে তার কাছে ফিরিয়ে দাও।’”
(সুনান আবু দাউদ, হাদীস: ২৬৭৫)
(সুনান আবু দাউদ, হাদীস: ২৬৭৫)
কিন্তু, উপরোক্ত এই গল্পে সমস্যাটা শুরু হয় যখন শিশুটিকে ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম)-এর কুরবানির ঘটনা শোনানো হয়, যাতে তার মন শান্ত হয়, যাতে সে বুঝতে পারে যে এটি কোনো নিষ্ঠুরতা নয়, বরং আল্লাহর হুকুম পালনের একটি মহান নিদর্শন। কিন্তু তারপরও বুবনের মন থেকে সরে না লালির স্মৃতি। সে ঘটনা মেনে নিতে পারে না, বারবার ফিরে আসে গাছতলায়, খোঁজে লালিকে। তার মন প্রশ্নে ভরা—“লালি কি আর আসবে না? এখানেই সূক্ষ্মভাবে এক বিপজ্জনক বীজ রোপণ করা হয়।
এই গল্পে ঈমান ও ইবাদতের ধারণাকে শিশুর আবেগ ও স্নেহের কাছে নরম করে দেওয়া হয়েছে। যেন বলা হচ্ছে, হ্যাঁ কুরবানি এক ধরনের ধর্মীয় রীতি, কিন্তু এটি আসলে বেদনাদায়ক, বিভ্রান্তিকর—এমনকি অবিচারপূর্ণও। এই কথাগুলো সরাসরি বলা হয়নি, বরং শিশুর মনের দোলাচলের মাধ্যমে পাঠকের মনের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিশু-পাঠক যারা এই গল্প পড়বে, তাদের মনেও জন্ম নিতে পারে এমন প্রশ্ন: “আল্লাহ কি সত্যিই চেয়েছিলেন লালিকে কোরবানি দিতে?” কিংবা, “আমার প্রিয় গরুটা কি সত্যিই এক ধর্মীয় কর্তব্যে উৎসর্গযোগ্য?”
আমরা বুঝতে পারি, সাহিত্য ও গল্প অনেক শক্তিশালী মাধ্যম। এদের মাধ্যমে শুধু বিনোদন নয়, বিশ্বাস, আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গিও গঠন করা হয়। পশ্চিমা দুনিয়ায় বহু আগে থেকেই চলচ্চিত্র, কার্টুন, গল্প ও নাটকের মাধ্যমে ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে। আমাদের দুনিয়াতেও এখন সেই ধারা ঢুকে পড়েছে। সরাসরি প্রশ্ন করা নয়, বরং কোমল ভাষায়, সংবেদনশীল দৃষ্টিকোণে উপস্থাপন করে শিশুদের মনে এমন ভাবনার চারা রোপণ করা হচ্ছে যা কালক্রমে আস্থাহীনতা ও দ্বিধার বৃক্ষ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অবাক হবার কিছু নেই যে, ঈমান ও ইসলামী মূল্যবোধকে আঘাত করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে, সেগুলোকে “অনুভূতির বিরুদ্ধে” দাঁড় করানো। আজকের দুনিয়া অনুভূতির দুনিয়া—“আমার অনুভবটাই সত্য”, “আমার দুঃখটাই বড়”—এমন এক দর্শন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যেখানে সত্যের বিচার হয় আবেগ দিয়ে। এই গল্পটিও সেই ধারারই একটি নমুনা। শিশুটির অনুভবের সামনে ইবাদতকে একধরনের ‘সমস্যা’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা তাকে আঘাত দিয়েছে, তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে—
এই ধরনের গল্প কি আমাদের শিশুরা পড়বে না?
উত্তরটা সোজাসাপ্টা: না, আমাদের সন্তানরা এই ধরনের গল্প পড়বে না। কোনো দ্বিধা বা সমঝোতার জায়গা নেই এখানে। আর এই না বলার পেছনে রয়েছে দুটো গভীর, শরঈ ও বুদ্ধিবৃত্তিক কারণ।
প্রথম কারণ হলো সায়্যিদুনা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু)-এর সেই ঐতিহাসিক ঘটনা।
হযরত ওমর (রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু) একবার তাওরাতের কিছু অংশ পড়ে খুব ভালো লাগা অনুভব করলেন। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)–এর কাছে এসে বললেন:
يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنِّي مَرَرْتُ بِأَخٍ لِي مِنْ بَنِي قُرَيْظَةَ، فَكَتَبَ لِي جَوَامِعَ كَلَامٍ مِنَ التَّوْرَاةِ أَلَا أَعْرِضُهَا عَلَيْكَ؟
“ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি বনী কুরায়যার একজন ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম। সে তাওরাত থেকে কিছু সংক্ষিপ্ত নসিহত লিখে দিয়েছে। আপনি কি অনুমতি দেন আমি তা আপনার সামনে পেশ করি?”
এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)–এর চেহারা রাগে লাল হয়ে গেল এবং তিনি বললেন:
أَمُتَهَوِّكُونَ فِيهَا يَا ابْنَ الْخَطَّابِ؟ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَقَدْ جِئْتُكُمْ بِهَا بَيْضَاءَ نَقِيَّةً، لَا تَسْأَلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ عَنْ شَيْءٍ فَيُصَدِّقُوكُمْ بِبَاطِلٍ، أَوْ يُكَذِّبُوكُمْ بِحَقٍّ، وَاللَّهِ لَوْ كَانَ مُوسَى حَيًّا مَا وَسِعَهُ إِلَّا أَنْ يَتَّبِعَنِي
“হে খাত্তাব–পুত্র! তুমি কি এখনো দ্বিধান্বিত? (তাদের কিতাবের প্রতি আগ্রহ দেখিয়ে) সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! আমি তোমাদের কাছে একটি পরিপূর্ণ, বিশুদ্ধ দ্বীন নিয়ে এসেছি। তোমরা আহলে কিতাবদের কাছে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করো না—তারা হয়তো তোমাদেরকে কোনো ভুল কথা বলে সত্য বলে বিশ্বাস করাবে, অথবা কোনো সত্যকে মিথ্যা বলবে। আল্লাহর কসম, যদি মূসা (আলাইহিস সালাম) আজ জীবিত থাকতেন, তিনিও আমার অনুসরণ করা ছাড়া কোনো পথ খুঁজে পেতেন না।”
(মুসনাদ আহমদ –১৪৬৩১)
সাহাবীদের মধ্যে যিনি “ফারূক”—সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী নামে খ্যাত, সেই মহান সাহাবীকে যদি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এভাবে সতর্ক করে দেন, তাহলে আজ আমরা কিভাবে নির্দ্বিধায় আমাদের কোমলমতি শিশুদের এমন সব গল্প পড়তে দিই, যেখানে ইবাদতের রূপকে বিকৃত করে দেখানো হয়? রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যদি একজন প্রাপ্তবয়স্ক, বিচক্ষণ, ইমানদার সাহাবীকেও সরাসরি নিষেধ করেন, তাহলে শিশুদেরকে এমন ‘শিক্ষামূলক’ গল্প পড়ানোর কী যুক্তি থাকতে পারে?
দ্বিতীয় কারণ হলো—শিশুদের মন অত্যন্ত কোমল ও সংবেদনশীল। তারা যা দেখে, যা শোনে, যা পড়ে—তা তাদের মনে স্থায়ী দাগ কেটে যায়। এই গল্পগুলোর মতো সূক্ষ্মভাবে গাঁথা আখ্যানগুলো শিশুদের মধ্যে এমন এক আস্থাহীনতা সৃষ্টি করতে পারে, যা পরবর্তীতে তাদের ঈমান, আকিদা ও তাওহীদ-বোধের ভিত নড়বড়ে করে দিতে পারে।
যদি গল্প পড়ানো জরুরি হয়, তাহলে কেন আমরা তাদের রাসূলদের কাহিনি, সাহাবাদের আত্মত্যাগ, ইসলামের ভিত্তিভূমি আকীদাহ এবং সঠিক ইবাদতের শিক্ষা দিয়ে শুরু করব না? বরং সেখান থেকেই শুরু করা উচিত। ছোটবেলা থেকেই যদি বাচ্চারা বুঝে রাখে—“আমার আল্লাহ এক, তাঁর হুকুমই চূড়ান্ত, রাসূলের পথই আমার পথ”—তবে পরবর্তী জীবনে যখন তারা আরও জটিল বিষয়ের মুখোমুখি হবে, তখন তারা বিভ্রান্ত হবে না, বরং দৃঢ় থাকবে।
এই যুগে “গল্প” আর “গল্পই তো” বলেই শিশুদের হাতে তুলে দেওয়া হয় এমন অনেক সাহিত্য যা আদতে এক ধরনের চিন্তাগত বিষ। তা সরাসরি নয়—বরং ‘মানবতা’, ‘সংবেদন’, ‘আবেগ’—এই মোড়কে। আর ঠিক এখানেই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ গল্প শিশুদের শুধু বিনোদন দেয় না, এটি তাদের বিশ্বাসের কাঠামোও গড়ে তোলে।
তাই আমরা বলি—না, আমাদের বাচ্চারা এই ধরনের গল্প পড়বে না। কারণ আমরা চাই না, তারা এমন কোনো আখ্যান পড়ে বড় হোক, যা তাদের মনে ইবাদতের প্রতি সন্দেহ, কুরবানির প্রতি আক্ষেপ, বা আল্লাহর হুকুমের প্রতি দুঃখ জন্ম দেয়।
আমরা চাই, আমাদের সন্তানরা বড় হোক এমন গল্প পড়ে, যেগুলো তাদের হৃদয়ে সাহাবীদের মতো সাহস, তাওহীদের প্রতি আনুগত্য, এবং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা জন্ম দেয়। যেন তারা হযরত আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু)'র মত বলতে পারে যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞাসা করেন, “তুমি পরিবার-পরিজনের জন্য কী রেখে এসেছো?” তিনি উত্তর দেন, “আল্লাহ ও তাঁর রাসূল।”
(সূত্র: সুনান আবু দাউদ, হাদীস: ১৬৭৮)
আমাদের সন্তানদের মুখেও যেন একদিন সেই কথাই উচ্চারিত হয়—“আমার অনুভব নয়, আমার রবের হুকুমই সর্বোচ্চ।”
এটাই হবে তাদের গল্প। এটাই হবে আমাদের জবাবদিহিতার প্রমাণ।
Comment