আবাবিল প্রকাশন মিডিয়া পরিবেশিত
ইসলাম ও গণতন্ত্র
।।মাওলানা আসেম ওমররহিমাহুল্লাহ।।
এর থেকে– অষ্টম পর্ব
ইসলাম ও গণতন্ত্র
।।মাওলানা আসেম ওমররহিমাহুল্লাহ।।
এর থেকে– অষ্টম পর্ব
গণতন্ত্র : কুরআন ও হাদীসের আলোকে
গণতন্ত্রের ভিত্তিই কুফরির উপর
আল্লাহর নিকট হিদায়াত কামনা করে এই আলোচনায় আমরা এ কথা জানার চেষ্টা করব যে, গণতন্ত্র সম্পর্কে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়ত আমাদেরকে কি ফয়সালা দেয়। যেই ব্যক্তি শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শেষ নবী হিসেবে বিশ্বাস করে এবং মানে, তার উচিত শরীয়তের ফয়সালাকেই গ্রহণ করা। এই আলোচনায় আমরা শরীয়তে মুতাহহারার দালায়েল ও প্রমাণাদিই শুনব, কোনো ব্যক্তি বিশেষের আমল দেখব না। গণতন্ত্রের পক্ষে কারও নিকট মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়তের কোনো দলিল-প্রমাণ থাকলে, সে যেনো তা পেশ করে।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, গণতন্ত্রের সংজ্ঞার দিক থেকে এতে গণমানুষের বুঝ-বুদ্ধি ও চাওয়া-পাওয়াকে (মানুষের সংখ্যাকে) ওহীর উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এজন্য এই গণতন্ত্র সরাসরি কুফরি। গণতন্ত্র কেবল সেটাই, যাতে মানুষের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হয় এবং শাসনের অধিকার মানুষের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। এ ছাড়া কোনো গণতন্ত্রই গণতন্ত্র হতে পারে না।
গণতন্ত্র কি ভিন্ন কোনো ধর্ম?
সামনে গিয়ে কুরআন, হাদীস এবং ফুকাহায়ে কেরামের ভাষ্য দ্বারা এ কথা প্রমাণ করা হবে যে, গণতন্ত্র ও ইসলাম একটা আরেকটার বিপরীত। না ইসলাম গণতন্ত্রের সাথে থেকে ইসলাম থাকতে পারে, না গণতন্ত্র ইসলামের প্রকৃত রূহের সাথে থেকে গণতন্ত্র থাকতে পারে। সুতরাং গণতন্ত্রের সাথে থেকে একজন মুসলমান কতটুকু মুসলমান থাকতে পারে, তা বোঝা কষ্টকর কিছু নয়। কিছুটা আল্লাহর উপর ঈমান, আর বেশিটা গায়রুল্লাহর উপর ঈমান। অথচ আল্লাহ তায়ালা তার অনুগতদেরকে পুরোপুরি তারই অনুগত দেখতে চান। কোনো মুসলমান সরিষার দানা পরিমাণও যদি অন্যের হয়, তবে সে সেই অন্যেরই হয়ে যায়। আল্লাহর সাথে তার কোনো সম্পর্ক থাকে না। তেমনিভাবে আল্লাহওয়ালা হওয়ার জন্য জরুরি হল, বান্দা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সেই ভাবে তার নবী মানবে, যেভাবে আল্লাহ তায়ালা হুকুম করেছেন, মানতে বলেছেন ।
کی محمد سے وفا تو نے تو ہم ترے ہیں
یہ جہاں چیزہے کیا لوح قلم تیرے ہیں
গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ কুফরি
প্রতিটি মুসলমানের জানা উচিত যে, ইসলাম ইসলামই আর কুফর কুফরই। একটার সাথে আরেকটার সামান্যতম সম্পর্ক নেই। আপনার যদি ঈমান থাকে যে, আল্লাহ তায়ালা এই দ্বীনকে তাঁর প্রিয়তম নবীর উপর মুকাম্মাল করে দিয়েছেন, পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন, তবে এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে যে, দুনিয়ার কোনো আলেমই, হোক সে যত বড়, সে ইসলামকে কুফর আর কুফরকে ইসলাম প্রমাণ করতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা সেই সব ফকীহদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিন, যারা তাদের জীবনকে এই দ্বীন বোঝার জন্য কুরবান করে দিয়েছেন। এরপর এই দ্বীনের সুক্ষ সুক্ষ প্রতিটি বিষয় খুলে খুলে উম্মতকে বুঝিয়েছেন ।
ইসলাম কি আর কুফর কি?
হিদায়াত কি আর গোমরাহী কি?
আল্লাহর পথ কোনটি আর শয়তানের পথ কোনটি?
প্রতিটি বিষয়ই তারা স্পষ্টভাবে উম্মতকে বুঝিয়ে দিছেন। কোথাও সামান্য পরিমাণ অস্পষ্টতা রাখেননি ।
কিন্তু বর্তমানে দ্বীনের সাথে সম্বন্ধযুক্ত, দুনিয়ার স্বাদ-মজায় আকণ্ঠ ডুবন্ত প্রবৃত্তিপূজারী শ্রেণী চায়, হক আর বাতিল, হিদায়াত আর গোমরাহী, আলো আর অন্ধকার... এগুলোকে এমনভাবে গোঁজামিল করে দেয়া, এমনভাবে তালগোল পাকিয়ে ফেলা, যাতে ইসলাম ও কুফরের মাঝে কোনো পার্থক্য অবশিষ্ট না থাকে। আর প্রবৃত্তি পূজারীর এই দল যা ইচ্ছা করতে পারে। এরা চায় ইসলামের উপহাসকারীদের কুফরির কথা আলোচনা না করা হোক। আমাদের প্রিয়তম নবীজির সুন্নাত অবমাননাকারীদের হুকুম বলা না হোক। এমনকি তারা এ দাবিও করে যে, কাফেরদেরকেও কাফের বলা না হোক। যারা আম্মাজান আয়েশা রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করেছে, তাদেরকেও কোনো কিছু বলা না হোক।
নাউযুবিল্লাহ! এরা কোন দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছে, যেখানে ইসলাম ও কুফরির কোনো সীমানা নির্দিষ্ট নেই? কুফর কি আর ইরতিদাদ কাকে বলে? ইলহাদ কি আর শিরকের সংজ্ঞা কি? মুসলমান হওয়ার জন্য জরুরি কি আর কিভাবে ঈমান হেফাজত করতে হয়? কোনো কিছুই স্পষ্ট নয়, পরিস্কার নয়। এটা কেমন দ্বীন যেখানে মুরতাদ ও যিন্দিক কাদিয়ানীরাও যিম্মি সাব্যস্ত হয়? অথচ এ বিষয়ে উম্মতের ইজমা রয়েছে যে, মুরতাদ ও যিন্দিকরা যিম্মি হতে পারে না।
এজন্য আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের কিতাবে যে বিষয়গুলোকে কুফরি লিখেছে, আমরা সর্বাবস্থায় সেগুলোকে কুফরি বলব এবং এর আলোচনা করে যাব। এর কারণে যদি কেউ আমাদের বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করে, করবে। আমরা যদি নিজেদের পক্ষ হতে কোনো কথা বলে থাকি, তবে আমরা সেই অপবাদের অবশ্যই উপযুক্ত হব। কিন্তু এসব মাসআলায় আমরা আমাদের আসলাফের ভাষ্যই পেশ করব। এরপর যার ইচ্ছা সে যেন এসব আসলাফের বিরুদ্ধে অপবাদ লাগিয়ে তার ঈমান ও আকিদা বরবাদ করে এবং নিজেকে তাদের কাতার থেকে বের করে দাজ্জাল ও তার মিত্রদের কাতারে দাঁড় করায়। সবাইকে আল্লাহর নিকটই ফিরে যেতে হবে। সে দিন মুখে তালা লাগিয়ে দেয়া হবে। ছোট বড় প্রতিটি আমলকে সবার সম্মুখে উপস্থাপন করা হবে। সেদিন কোনো জেনারেল কাজে আসবে না, কোনো মন্ত্রী কাজে আসবে না, সরকারি মিডিয়াও সেদিন সঙ্গে থাকবে না। যেই সব শয়তান আজ সাহায্য করছে, ডলার দিচ্ছে, নিজেদের খরচে বহিঃদেশে ভ্রমণ করাচ্ছে, তারাও সেদিন পাশে থাকবে না।
এজন্য সমস্ত আহলে ইলমের উপর ফরয হল, গণতন্ত্রের ভেতর যেসব কুফরি পাওয়া যায় তা আলোচনা করা। অন্যথায় হক কথা না বলার অপরাধে কিয়ামতের দিন পাকড়াও করা হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে এর থেকে হেফাজত করুন। গণতন্ত্রের বক্ষে লুকায়িত কুফরি
১. মানবিক জ্ঞান-বুদ্ধি ও চাওয়া- পাওয়াকে ওহীর উপর প্রাধান্য দান।
গণতন্ত্রে মানবজ্ঞানকে ওহীর চেয়েও বেশি মর্যাদা দেয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় ওহী ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণীয় নয়, যতক্ষণ না মানবজ্ঞান (সংসদ সদস্য) তা অনুমোদন না করে। আর ফুকাহায়ে উম্মত এমন কাজকে স্পষ্ট কুফরি বলেছেন। এমনকি গণতন্ত্র আরও এক ধাপ এগিয়ে মানব প্রবৃত্তিকেও ওহীর উপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। এটা যে কুফরি, তাতে কি কোনো সন্দেহ থাকতে পারে?
আল্লাহর নাযিলকৃত কোনো বিধানই ততক্ষণ পর্যন্ত ওয়াজিবুল আমল হতে পারে না যতক্ষণ না সংসদ সদস্যরা তার অনুমোদন না করেন। এটা নিঃসন্দেহে এমন কুফরি, যা মানুষকে মিল্লাত থেকে খারেজ করে দেয়। যেমন আল্লাহ তায়ালা বিবাহিত ব্যাভিচারী নারী-পুরুষের শাস্তির বিধান তার কিতাবে তার সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাজিল করেছেন। আর এই বিধান এই উম্মতের জন্য আইন হিসেবে রেখে দেয়া হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আল্লাহর দেয়া এই বিধান (নাউযুবিল্লাহ) সংসদ সদস্যদের অনুমোদন ছাড়া আমলযোগ্য মনে করা হয় না। বোঝা গেল, এই ব্যবস্থায় কোনো আইন যদি ইসলাম সম্মতও তৈরি করা হয়, তো সেই আইন এজন্য তৈরি করা হয়নি যে, এটা আল্লাহর আইন। বরং এই আইন এজন্য মেনে নেয়া হয়েছে যে, মানবজ্ঞান তথা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কর্মীরা এটাকে উপযুক্ত মনে করেছেন বিধায় এটাকে আইনে পরিণত করা হয়েছে। কারণ আল্লাহর হুকুমই যদি যথেষ্ট হত, তবে সেটা মানুষের অনুমোদন ও বিল হিসেবে উপস্থাপনের প্রয়োজন পড়ত না। বরং এ প্রক্রিয়া ছাড়াই এই আইন মেনে নেয়া হত, যা আহকামুল হাকিমীন মহান আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয়তম নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাজিল করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এই ঘৃণ্যকর্মের আলোচনা এভাবে করেছেন যে-
ذَٰلِكُم بِأَنَّهُ إِذَا دُعِيَ اللَّهُ وَحْدَهُ كَفَرْتُمْ ۖ وَإِن يُشْرَكْ بِهِ تُؤْمِنُوا ۚ فَالْحُكْمُ لِلَّهِ الْعَلِيِّ الْكَبِيرِ
(তাদেরকে বলা হবে) “তোমাদের এই অবস্থা (জাহান্নামে চিরদিনের জন্য অবস্থান) তো এজন্য যে, যখন আল্লাহকে এককভাবে ডাকা হত তখন তোমরা তাকে অস্বীকার করতে আর যখন তাঁর সাথে শরিক করা হত তখন তোমরা বিশ্বাস করতে। সুতরাং (দুনিয়াতে) যাবতীয় কর্তৃত্ব সমুচ্চ, মহান আল্লাহর। [সূরা গাফির : ১২]
এই গণতন্ত্রের কুফরিও এটা যে, আল্লাহর শরীয়তকে কেবল আল্লাহর শরীয়ত মনে করে মানা হয় না, গ্রহণ করা হয় না। হ্যাঁ, আল্লাহর সঙ্গে এই পার্লামেন্টকেও যদি অংশীদার বানানো হয়, তখন তারা আল্লাহর শরীয়তকে মেনে নেয়। এখন হক্কানী ওলামায়ে কেরামই বলুন, এই হাকিকত ও বাস্তবতা জানার পরও আল্লাহর শরীয়তকে অনুমোদনের জন্য মানুষের সামনে পেশ করা কেমন?
সেই সাথে এখানে এ বিষয়টিও খুব ভালো করে বুঝে নেয়া উচিত যে, যেই পার্লামেন্টে শতভাগ দ্বীনদার ও শরীয়তের পূর্ণ অনুসারী ব্যক্তিত্বগণ বসেন, কিন্তু ওই পার্লামেন্ট অনুমোদন না দেয়া পর্যন্ত আল্লাহর শরীয়ত আইনে পরিণত হয় না, এমন পার্লামেন্টেরও একই হুকুম।
কেউ যদি এ কথা বলে যে, আমরা এই প্রক্রিয়া ছাড়াই আল্লাহর শরীয়তকে আইনের অংশ বানিয়ে দেব, তাদের এই বুঝ গণতন্ত্রের সংজ্ঞা, প্রকৃতি এবং তার নিযাম ও ব্যবস্থার প্রকৃত মোহাফেজদের না বোঝারই দলিল। এ ধরনের লোকেরা গণতন্ত্রকে এক ফোঁটাও বোঝেনি। এরা পুরোপুরি ধোঁকার মধ্যে রয়েছে। গণতন্ত্রকে ওই সময় পর্যন্ত গণতন্ত্রই বলা যাবে না, যতক্ষণ না প্রতিটি জিনিসে মানবজ্ঞানের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা না হবে। চাই সেটা ওহীই হোক না কেন, যা ফেরেশতাদের সরদার নবীকুলের সরদারের নিকট আনতেন।
২.আধুনিক শয়তানি জীবনব্যবস্থা, যাতে প্রবৃত্তিকে উপাসকবানানো হয়।
গণতন্ত্রে দস্তুরে হায়াত তথা জীবনব্যবস্থা (আইন) প্রণয়নের অধিকার তারা তাদের খায়েশ অনুযায়ী যা ইচ্ছা সংবিধানে রূপ দিবে এবং আইনের মর্যাদা দিবে। আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়তে এই অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কারও নেই।
সুতরাং এমন আকিদা বিশ্বাস লালন করা আল্লাহর সাথে কুফরি করা।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُم مِّنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَن بِهِ اللَّهُ
তাদের জন্য কি এমন কিছু শরিক আছে, যারা তাদের জন্য দ্বীনের বিধান দিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? [সূরা আশ-শূরা : ২১] (এর বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ)
৩. গণতন্ত্র আল্লাহর আইন প্রণয়নের সিফাতকে গায়রুল্লাহর(অর্থাৎ পার্লামেন্ট) কাছে অর্পণ করে।
এটাই গণতন্ত্রের রূহ বা আত্মা। এতে যদি কেউ এ কথা সংযোজন করে যে, আইন প্রণয়ন কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হওয়া উচিত, তবে এটা শুধুই কথার কথা, যা মুখ ফসকে বের হয়েছে। অন্যথায় গণতন্ত্রের রুহ ও আত্মা ওহীর কোনো ধরনের পাবন্দি করা কবুল করে না। এর স্পষ্ট শরীয়ত পরিপন্থি সে সব আইন যা এই ‘মূর্তি’র মাধ্যমে করা হয়। পার্লামেন্টের অধিকাংশ সদস্য যেটাকে হালাল (আইন সম্মত) বলে, সেটা হালাল। চাই সেটা সুদ, ব্যাভিচার এবং মদের মত অভিশপ্ত বস্তুই হোক না কেন? অথবা আল্লাহর ‘হুদুদ'ই হোক না কেন? যেগুলো নিশ্চিহ্ন করা তো পরের কথা, সংযোজন বিয়োজন করাও কুফরি। এমনিভাবে পার্লামেন্ট যেটাকে হারাম (বেআইনি) বলে, সেটা হারাম। হোক সেটা জিহাদের মত মহান ইবাদতই হোক না কেন? এখন এর সম্মান করা, এটাকে পবিত্র মনে করা এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রতিটি সংসদ সদস্যের জন্য ফরয। যারা এটাকে হারাম (বেআইনি) বলবে এবং এর বিরোধিতা করবে, তাদেরকে এই আইনের বিদ্রোহী বলা হবে। এখন কেউ যদি এই আইন বাদ দিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আইন অনুযায়ী ফয়সালা করতে এবং করাতে চেষ্টা করে, তবে সে এই গণতান্ত্রিক শরীয়তের (জীবনব্যবস্থার) রিটকে চ্যালেঞ্জকারী সাব্যস্ত হবে। আর রাষ্ট্র তাকে দেশদ্রোহী সাব্যস্ত করে তার বিরুদ্ধে পুলিশ ও সৈনিক থেকে নিয়ে বিমান বাহিনী পর্যন্ত লেলিয়ে দেয়া বৈধ মনে করবে। এমন লোকদেরকে হত্যা করা এবং এদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিজেদের জীবন দেয়া সৈনিকদের জন্য ফরয হয়ে যাবে।
এজন্য এই ব্যবস্থায় জড়িত ধর্মীয় লোকদের মুখেও আপনি একটা বাক্য অবশ্যই শুনতে পাবেন-
“আমরা আইনের সীমানার ভেতর থেকে শরীয়ত ব্যবস্থা বাস্তবায়নের তৎপরতা চালিয়ে যাব৷”
হ্যাঁ, আইনের সীমা সেটাই যা গণতন্ত্র প্রণয়ন করেছে। অর্থাৎ কোনো আইনকেই (চাই তা আল্লাহরই আইন হোক না কোনো) ততক্ষণ পর্যন্ত আইন মনে করা হবে না, যতক্ষণ না তা গণতান্ত্রিকভাবে আইনে পরিণত করা না হবে। অর্থাৎ এখানে আল্লাহর ‘আমর' (নির্দেশ) নয় বরং মানুষের ‘আমর' চলে!
৪. এই পার্লামেন্টে অনুমোদিত জীবন বিধানকে মানুষের জন্য বাস্তবায়ন করা, মানুষদেরকে এর নিয়মানুবর্তী করা, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ ও অন্যান্য প্রশাসনিক বিভাগ থেকে এর উপর আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করা এবং এর উপর কাজ করার আকিদা ও চিন্তাধারা লালন করা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত শরীয়তের স্পষ্ট অস্বীকার।
৫. গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থায় মুসলমান ও কাফের উভয়ে সমান। অথচ এ বিষয়ে উম্মতের ইজমা রয়েছে এবং কুরআনে কারীমের বহু জায়গায় এ কথা বর্ণিত হয়েছে যে, মুসলমান আর কাফের বরাবর হতে পারে না, সমান হতে পারে না।
৬.গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট এবং কতিপয় পদাধিকারী ব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র থাকেন। আইনের উর্ধ্বে থাকেন। প্রশ্ন হল, আপনাদের আইন যদি ইসলামীই হয়ে থাকে, তো এর অর্থ হয় এটা ইসলাম থেকে বাদ দেয়ার নামান্তর। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থার কতিপয় ব্যক্তিকে ইসলামী জীবনব্যবস্থা (শরীয়ত) থেকে উর্ধ্বে সাব্যস্ত করা । এদেরকে এ পরিমাণ পবিত্র জ্ঞান করা হয় যে, ইসলামী আইনও এদের অপরাধের শাস্তি দিতে পারে না! অথচ শরীয়তে মুহাম্মাদীতে তো তার কন্যাও ব্যতিক্রম ছিলেন না। গণতান্ত্রিক এই চিন্তাধারাও ইজমায়ে উম্মতের পরিপন্থি।
৭. কোনো দেশের আইন যদি শতকরা ৯৯ ভাগ ইসলামী হয় আর একটিমাত্র অনুচ্ছেদ অনৈসলামিক হয়, যা নিয়মতান্ত্রিকভাবে আইনের অংশ, তো শরীয়তে মুতাহহারা এই শিরককে কবুল করে না। সুতরাং এই আইনকে ইসলামী বলা যাবে না, বরং এটিকে কুফরি আইনই বলা হবে। বিধায় কোনো মুসলমান যদি এই আইনকে জীবনবিধান ও এ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা আবশ্যক সাব্যস্ত করে, তবে এটা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের আনীত দ্বীনকে ত্যাগ করা হবে। কারণ বান্দার জন্য এমন একটা বিষয় আবশ্যক করছে, যা আল্লাহ তায়ালা আবশ্যক করেননি।
৮. মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়তে কোনো কাফের মুসলমানের অফিসার, শাসক এবং জজ হতে পারবে না। এমন কি কোনো যিম্মি কাফেরও (যে কাফের খেলাফতের অধীনে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে কর দেয় আর রাষ্ট্র তার জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করে) অফিসার হয় তবে তার'যিম্মিয়াত'শেষ হয়ে যাবে এবং তার খুন মুবাহ হবে। ইমাম আবু বকর জাসসাস তার আহকামূল কুরআনে এমনটিই বলেছেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক শরীয়তে (জীবনব্যবস্থায়) হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান অথবা যে কোনো বিধর্মীই শাসক ও জজ হতে পারে। যার বাস্তবায়ন আমরা স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছি।
৯. গণতন্ত্রের পার্লামেন্ট যেই শরীয়ত (সংবিধান) তৈরি করে, তার আলোকে নারীরাও রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারে। এই আকিদাও ইজমায়ে উম্মতের পরিপন্থি।
১০. হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ইহুদীরা তার নিকট কোনো কোনো বিষয় ফতওয়া নিতে জিজ্ঞাসা করত যে, এ বিষয়ে আপনার শরীয়ত কি বলে, এ বিষয়ে আপনি কি হুকুম দেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফতওয়া যদি তাদের মনমত হত, তখন তারা ফয়সালার জন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসত। আর তাদের মনমত না হলে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফতওয়াকে প্রত্যাখ্যান করত। আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়েদায় তাদের এই কর্মের আলোচনা করেছেন । আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ مِن بَعْدِ مَوَاضِعِهِ
তারা বিধানাবলিকে আপন স্থান থেকে সরিয়ে ফেলে। [সূরা মায়েদা : ৪১]
প্রচলিত গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থাও যেহেতু ইহুদীদের সৃষ্টি, তাই এখানেও ইহুদী খাসলত পুরোদমে লক্ষ্য রাখা হয়েছে। ইসলামের যে সব আইন ও নিয়ম-নীতি তাদের মনমত হয়েছে, তাদের চাওয়া-পাওয়ার সাথে মিলেছে, সেগুলোকে মানুষের মাধ্যমে অনুমোদন করানোর পর আইনে রূপ দেয়া হয়েছে। যাতে ‘ইসলাম প্রিয়'রাও এই কুফরি জীবনব্যবস্থাকে ইসলামী প্রমাণ করার দলিল পেয়ে যায়, আবার নিজেদের প্রবৃত্তি প্রতিমাও সন্তুষ্ট থাকে। আর খায়েশাত ও প্রবৃত্তি যেখানে আল্লাহর আইনকে সমর্থন করে না, মেনে নেয় না, সেখানে আল্লাহর হুকুমকে অস্বীকার, হঠকারিতা, ঔদ্ধত্য, টালবাহানা ও গোঁজামিল দিয়ে কাজ চালিয়ে যায়।
পার্লামেন্ট সম্পর্কে গুরুতৃপূর্ণ প্রশ্ন
যারা সংসদে বসে সেখানে উপস্থাপিত ইসলামী বিলের বিরুদ্ধে ভোট দেয় এবং গণতান্ত্রিক পন্থায়ও ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাকে বরদাশত করে না, তাদের কাফের হওয়ার বিষয়ে কি কোনো সন্দেহ রয়েছে? এটা কি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত শরীয়তের প্রকাশ্য প্রত্যাখ্যান করা নয়? তারা জিহাদ ও কিতালের মাধ্যমেও ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে দিচ্ছে না, আবার সংসদেও ইসলামের নাম শুনতে ইচ্ছুক নয়।
ভাবার বিষয় হল, বিরোধিতার এই ‘অধিকার’ তাদেরকে দিয়েছে কে? নিঃসন্দেহে এই গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা ও এই পার্লামেন্টই তাদেরকে এই অধিকার দিয়েছে। সুতরাং এমন জীবনব্যবস্থা ও পার্লামেন্ট, যা আল্লাহ ও তার রাসূলের শরীয়তের বিরোধিতা করা এবং তা প্রত্যাখ্যান করাকে আইনী অধিকার সাব্যস্ত করে, এর চেয়ে বড় কুফরি ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান আর কী হতে পারে?
এই ব্যবস্থা কি শরীয়ত বিলের বিরোধিতাকারীদেরকে হেফাজত করে না? অথচ তাদের মুরতাদ হওয়ার ব্যাপারে কারও মতানৈক্য থাকা উচিত নয় । তবে তাওবা না করা অবস্থায় তাদেরকে হত্যা করা কি আইন সম্মত (হালাল-বৈধ) হতে পারে? ইসলামী বিল প্রত্যাখ্যানকারীদের সংসদ সদস্য পদ কি অপসরণ করা হয়? তাদের সাথে কি মুরতাদের মত আচরণ করা হয়? কখনোই না । কারণ গণতন্ত্রের দৃষ্টিতে এরা এখনো সম্মানিত এবং পবিত্র । আর কেউ যদি তাদের সাথে তর্ক করে, তবে রাষ্ট্রীয় মিশনারী তাদের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করবে ।
আপনারাই লক্ষ্য করুন, যারা আল্লাহর কানুনকে প্রত্যাখ্যান করছে, তাদেরকে কেউ কিছুই বলতে পারে না। গণতন্ত্র তাদেরকে এই অধিকার দিয়েছে। কিন্তু কোনো নাগরিক যদি গণতন্ত্রের আইন মানতে অস্বীকার করে, তবে তাকে দেশদ্রোহী বলা হয়। সংসদ সদস্যরা নিজেদের মতামতের ভিত্তিতে তাদেরকে হত্যা করতে এবং তাদের বিরুদ্ধে সেনা অপারেশন চালাতে আইন পাশ করে। এর থেকে বোঝা গেল যে, 'দেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম’ ইসলাম নয় বরং ধর্মহীনতা (ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র )।
আরও পড়ুন
সপ্তম পর্ব
Comment