আবাবিল প্রকাশন মিডিয়া পরিবেশিত
ইসলাম ও গণতন্ত্র
।।মাওলানা আসেম ওমররহিমাহুল্লাহ।।
এর থেকে– দশম পর্ব
ইসলাম ও গণতন্ত্র
।।মাওলানা আসেম ওমররহিমাহুল্লাহ।।
এর থেকে– দশম পর্ব
আল্লাহর হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করা
মা'বুদে হাকিকী ছাড়া অন্য কারো জন্য নিজের পক্ষ হতে আল্লাহর হালালকে বেআইনি অর্থাৎ হারাম এবং হারামকে আইন সম্মত অর্থাৎ হালাল ঘোষণা করার অধিকার নেই। এই হক ও অধিকার শুধুই মা'বুদের জন্য নির্দিষ্ট। সুতরাং যে ব্যক্তি এ কাজ করবে, অথবা কারো জন্য এই হক ও অধিকার স্বীকার করবে, এর অর্থ সে তাকে তার মা'বুদ বানালো, মা'বুদ হিসেবে গ্রহণ করল।
গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থায় আল্লাহর এই অধিকারে পার্লামেন্টকেও শরিক বানানো হয়। বরং বাস্তবতা হল, শুধু শরিকই বানানো হয় না, আল্লাহর এই অধিকার পরিপূর্ণরূপে পার্লামেন্ট বা রাষ্ট্রকে দিয়ে দেয়া হয়। সুতরাং পার্লামেন্টের অধিকাংশ সদস্য যদি সুদের মত অভিশাপকে হালাল (আইন সম্মত) ঘোষণা করে, তো গণতন্ত্রের অনুসারীদের জন্য তা ‘পবিত্র আইন'-এর অংশ। তাদের আকিদা অনুযায়ী এর সম্মান করা ওয়াজিব।
এই ঘৃণ্য কাজ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বড় কঠিনভাবে সতর্ক করেছেন। পবিত্র কুরআন এ আল্লাহ ইরশাদ করেন—
قُلْ أَرَأَيْتُم مَّا أَنزَلَ اللَّهُ لَكُم مِّن رِّزْقٍ فَجَعَلْتُم مِّنْهُ حَرَامًا وَحَلَالًا قُلْ آللَّهُ أَذِنَ لَكُمْ ۖ أَمْ عَلَى اللَّهِ تَفْتَرُونَ
বল, “তোমরা কি ভেবে দেখেছ, আল্লাহ তোমাদের জন্য যে রিয্ক নাযিল করেছেন, অতঃপর তোমরা তার কিছু করে নিয়েছ হারাম ও হালাল'। বল, ‘আল্লাহ কি তোমাদেরকে অনুমতি দিয়েছেন, নাকি আল্লাহর উপর তোমরা মিথ্যা রটাচ্ছ'? [সূরা ইউনুস : ৫৯]
انظُرْ كَيْفَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ ۖ وَكَفَىٰ بِهِ إِثْمًا مُّبِينًا
দেখ, কেমন করে তারা আল্লাহর উপর মিথ্যা রটনা করে । আর প্রকাশ্য পাপ হিসেবে এটিই যথেষ্ট। [সূরা নিসা : ৫০]
আল্লাহর বিরোধিতা ও আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাকেই এরা দ্বীন বলে। আল্লাহকে মিথ্যাপতিপন্ন করাকে ঈমান বলে। আল্লাহ তায়ালা যেই জিহাদকে ফরয করেছেন, এরা সেটাকে সন্ত্রাস ঘোষণা করে হারাম (বেআইনী) বলে।
হে ঈমানদারগণ! চোখ খুলে একটু দেখো, তোমাদের রবের বিরুদ্ধে কেমন নির্দয়ভাবে মিথ্যাচার করছে এবং তা প্রচার করে বেড়াচ্ছে... ।
এই আয়াতের তাফসীরে আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
কেমন বিস্ময়কর কথা! আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে এবং কুফর ও শিরকে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও নিজেকে আল্লাহর বন্ধু বলে এবং আল্লাহর প্রিয়ভাজন হওয়ার দাবি করে!
সত্যবাদী হলে প্রমান দাও
পবিত্র কুরআনে সূরা আনআমের ১৫০ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
قُلْ هَلُمَّ شُهَدَاءَكُمُ الَّذِينَ يَشْهَدُونَ أَنَّ اللَّهَ حَرَّمَ هَٰذَا ۖ فَإِن شَهِدُوا فَلَا تَشْهَدْ مَعَهُمْ ۚ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَالَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ وَهُم بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُونَ
বল, “তোমাদের সাক্ষীদেরকে নিয়ে আস, যারা সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ এটি হারাম করেছেন” । অতএব যদি তারা সাক্ষ্য দেয়, তবে তুমি তাদের সাথে সাক্ষ্য দিয়ো না। আর তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে, যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না এবং যারা তাদের রবের সমকক্ষ নির্ধারণ করে। [সূরা আল আনআম : ১৫০]
ইমাম বায়যাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি সাক্ষ্য না দেয়ার উদ্দেশ্য ইহা বর্ণনা করেছেন যে-
আপনি তার সাক্ষ্য সত্যায়ন করবেন না। আপনি তার সাক্ষ্যর অনিষ্টতা বর্ণনা করুন।[1]
আল্লামা আলুসী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
এই সাক্ষী হল তাদের নেতারা, যারা এই গোমরাহী ও ভ্রষ্টতার প্রতিষ্ঠাতা ও আবিষ্কারক। যারা এর ভিত্তি রেখেছে।[তাফসিরে রুহুল মাআনী]
গণতন্ত্রের পূজারীদের নিকটও কি কোনো সরকারি মৌলভী রয়েছে যারা এ কথার সাক্ষী দিবে যে, গণতন্ত্রের সংসদ যা কিছু (যেমন হরবি কাফেরদের সাথে কিতাল, বিবাহিত ব্যভিচারী নারী-পুরুষকে প্রস্তারাঘাতে হত্যা ইত্যাদি) হারাম বা বেআইনী ঘোষণা করে- এর পক্ষে তাদের নিকট কুরআন ও হাদীসের. দলিল প্রমাণ রয়েছে?...
আল্লাহওয়ালারা কি এরপরও এমন জায়গায় বসতে পারে, যেখানে আল্লাহর বিরুদ্ধে এমন অপবাদ আরোপ করা হয়?...
এমন মন্দিরের পক্ষে কি কেউ কুরআন-হাদীস দ্বারা দলিল দিতে পারে, যেখানে এসব জনপ্রতিনিধিদেরকে আল্লাহর সমান বানানো হয়?...
এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কুফরি হওয়ার বিষয়টি পূর্বে যদি অস্পষ্টও থেকে থাকে, এখন তো অন্ততপক্ষে ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর এবং হক্কানী অনেক ওলামায়ে কেরামের প্রামান্য রচনাবলী প্রকাশিত হওয়ার পর, এর কুফরি হওয়ার বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
সুতরাং এখনও এই মন্দিরে বসার দুঃসাহস সেই ব্যক্তিই করতে পারে, যে দুনিয়ার জীবনকেই প্রকৃত জীবন ভেবেছে এবং দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতার জন্যই দৌড় ঝাপ করছে ।... এটা কত মারাত্মক জুলুম ও গাদ্দারী মুহাম্মাদ (সা.) ও তার রবের সাথে।
হালালকে হারাম এবং হারামকে হালালকারীর হুকুম
শাইখ আবদুল্লাহ আযযাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
تحليل الحرام وتحريم الحلال في أية جزئية كفر يخرج من الاسلام يقول ابن تيمية : (من ادعي حل النظرة فقد كفر بالاجماع.ومن حرام الخبز فقد كفر بالاجماع)
যে কোনো একটা হারামকে হালাল বলা অথবা হালালকে হারাম বলা এমন কুফরি, যা দ্বীন থেকে খারেজ করে দেয়। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যে ব্যক্তি গাইর-মাহরামকে (পরনারী বা পরপরুষ) দেখা বৈধ হওয়ার দাবি করেছে, সর্বসম্মতিক্রমে সে কুফরি করেছে। আর যে ব্যক্তি রুটিকে হারাম ঘোষণা করেছে, সেও সর্বসম্মতিক্রমে কুফরি করেছে।[2]
ইমাম আবু জাফর তাহাবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি شرح معاني الاثار গ্রন্থে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। ফাতহুল বারীর باب حدالخمر এর অধীনে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীসটি কানজুল উম্মালেও উল্লেখ রয়েছে।
হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-হযরত ইয়াজিদ বিন আবি সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম যে জামানায় সিরিয়ার আমির ছিলেন, সিরিয়ার কতিপয় মানুষ এ কথা বলে মদ পান করা শুরু করে যে, ‘আমাদের জন্য তো মদ হালাল।' তারা পবিত্র কুরআনের আয়াত لَيْسَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيمَا طَعِمُوا দ্বারা মদ বৈধ হওয়ার দলিল পেশ করে। তখন ইয়াজিদ বিন আবি সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত ওমর ফারুক রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে এই ফিতনা সম্পর্কে অবগত করেন।
হযরত ওমর ফারুক রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাৎক্ষণাৎ ইয়াজিদ রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে লিখে পাঠান- ‘এরা ওখানে গোমরাহী ছড়ানোর পূর্বেই তুমি এদেরকে গ্রেফতার করে আমার নিকট পাঠিয়ে দাও।' হযরত ইয়াজিদ রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাদেরকে গ্রেফতার করে পাঠানোর পর হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাদের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করেন। সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম সর্বসম্মতিক্রমে বলেন, ‘আমীরুল মুমিনীন! আমাদের মতে তো এরা (আয়াতে কারিমার তাবিল [অপব্যখ্যা] করে) আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধে অপবাদ লাগিয়েছে। আর আল্লাহ তায়ালা যেই জিনিসকে হারাম করেছেন, কোনো অবস্থাতেই অনুমতি দেননি, এরা ধর্মে সেই জিনিসকে হালাল বানিয়েছে । সুতরাং (এরা মুরতাদ) আপনি এদের সবাইকে হত্যা করুন।
(সাহাবায়ে কেরামের এই মত প্রকাশের পরও) হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু চুপ ছিলেন। হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আবুল হাসান! তোমার মত কি?
আলী রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, আমার মত হল এদেরকে এই আকিদা থেকে তাওবা করার হুকুম দিন। যদি তাওবা করে, তবে মদ পান করার অপরাধে এদেরকে আশি বেত্রাঘাত মদ্যপানের হদ-শাস্তি) লাগিয়ে ছেড়ে দিন। আর যদি তাওবা না করে, তবে এদেরকে (কাফের এবং মুরতাদ ঘোষণা করে) হত্যা করুন। কারণ তারা আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলেছে আর ধর্মে এমন জিনিসকে জায়েয ও হালাল সাব্যস্ত করেছে, আল্লাহ তায়ালা যার অনুমতি দেননি।'
যাহোক, সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম এই মতের উপর একমত হন এবং হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাদেরকে তাওবা করার নির্দেশ দেন। তারা তাওবা করে। এরপর (মদপানের শাস্তি হিসেবে) তাদেরকে আশি বেত্রাঘাত লাগানো হয়।[3]
এখন যদি কেউ এ কথা বলে যে, আমরা তো গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থার মধ্যে থেকেও আল্লাহর হারামকৃত বস্তুকে হারামই মনে করি। তাহলে প্রশ্ন, এমন কি হতে পারে যে, হারামকে হারাম বিশ্বাস করবেন আর সেই কাগজপত্র ও সংবিধানকে পবিত্র বলবেন, যাতে অসংখ্য হারাম বিষয়কে হালাল এবং হালালকে হারাম বলা হয়েছে? এই সংবিধানের উপর আনুগত্যের শপথ নিবেন, এর আনুগত্য করার জন্য মানুষকে আহ্বান করবেন। এর বিরুদ্ধে টু শব্দটি পর্যন্ত করবেন না...? এটা কি আল্লাহর বিধানাবলীর সাথে উপহাস করা নয়?
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِالْحَقِّ لَمَّا جَاءَهُ
আর সে ব্যক্তির চেয়ে জালিম আর কে, যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে অথবা তার নিকট সত্য আসার পর তা অস্বীকার করে? [সূরা আনকাবুত : ৬৮]
আল্লাহ তায়ালা অন্য এক জায়গায় এই মিথ্যার কথাও বর্ণনা করেছেন, যা তার বিরুদ্ধে বলা হত।
وَإِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً قَالُوا وَجَدْنَا عَلَيْهَا آبَاءَنَا وَاللَّهُ أَمَرَنَا بِهَا
আর যখন তারা কোন অশ্লীল কাজ করে তখন বলে, আমরা এতে ‘আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে পেয়েছি এবং আল্লাহ আমাদেরকে এর নির্দেশ দিয়েছেন'। [সূরা আরাফ : ২৮]
[1] -আনওয়ারুত তানযীল ওয়া আসরারুত তাবীল লিল বায়যাবী
[2]العقدة و أثرها في بناء الجيل : للشيخ عبد الله عزام رحمة الله. ص:82
[3] শরহু মাআনিল :২/৮৯, ইমাম আবু জাফার তাহাবী