আবাবিল প্রকাশন মিডিয়া পরিবেশিত
ইসলাম ও গণতন্ত্র
।।মাওলানা আসেম ওমররহিমাহুল্লাহ।।
এর থেকে– ত্রয়োদশ পর্ব
ইসলাম ও গণতন্ত্র
।।মাওলানা আসেম ওমররহিমাহুল্লাহ।।
এর থেকে– ত্রয়োদশ পর্ব
তৃতীয় অধ্যায়
আল্লাহর শরীয়ত ছাড়া অন্য কোনো আইনে ফয়সালা করা
আল্লাহর শরীয়ত ছাড়া অন্য কোনো আইনে ফয়সালা করা
আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদেরকে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন যে, তারা কেবল আল্লাহরই ইবাদত করবে। কিন্তু আদালতে যদি কুরআন প্রতিষ্ঠিত না হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য যদি আন্তর্জাতিক অর্থপ্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরিকৃত আইনের অধীনে করা হয়, আর সরকার ব্যবস্থা যদি হয় গণতান্ত্রিক তাহলে আল্লাহর ইবাদত কিভাবে করা সম্ভব?
অথচ আল্লাহ তায়ালার লক্ষ্য তো এই, জমিনের বুক হতে সমস্ত বাতিল ধর্ম ও আদর্শ নিশ্চিহ্ন করে আল্লাহর প্রেরিত দ্বীন কায়েম করা। শুধু মুসলমানরাই নয় বরং কাফেররাও সেই দ্বীনের দেয়া ব্যবস্থার অধীনে জীবন যাপন করবে। যাতে কোনো সামর্থ্যবান ব্যক্তি কোনো দুর্বল ব্যক্তির উপর জুলুম করতে না পারে। মজলুমরা যেন ন্যায়বিচার লাভ করে। গরীবরা যেনো সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকার পায়।
আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফয়সালা করার নির্দেশ শুধু মুসলমানদের সমস্যার ক্ষেত্রেই নয় বরং কাফেরদের সমস্যা ও মামলাতেও (শুধু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয় ছাড়া) এই ইলাহী সংবিধান ও আইনের আলোকে সমাধান করা হবে। কিন্ত চিন্তার নীচুতা ও আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশের প্রতি উদাসীনতার অনুমান করুন যে, কাফেরদের মাঝে ফয়সালা করা তো দূরের কথা, মুসলমানদের আদালতে মুসলমানদের ফয়সালাই করা হচ্ছে কাফেরদের আইনে। এ অনুযায়ীই জীবন যাপন করতে বাধ্য করা হচ্ছে, ফয়সালা প্রয়োগের জন্য পুলিশ ও সেনাবাহিনী গঠন করা হয়েছে। যারা এই কুফরিকে জোরপূর্বক বাস্তবায়ন করে । এর রিটকে সুনিশ্চত করে । অথচ আল্লাহ তায়ালা’র পবিত্র কুরআনই একমাত্র আইন, যে অনুযায়ী ফয়সালা করা উচিত।
فَاحْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ
সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তুমি তার মাধ্যমে ফয়সালা কর এবং তোমার নিকট যে সত্য এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না ।(সূরা মায়েদা : ৪৮)
এই অধ্যায়ে আমরা গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থার একটি মৌলিক স্তম্ভ অর্থাৎ গণতান্ত্রিক আদালত ও বিচার ব্যবস্থার পর্যবেক্ষণ করব এবং এ উদ্দেশ্যে এই বুনিয়াদি প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করব যে, এসব আদালত ও বিচার ব্যবস্থায় আল্লাহর শরীয়তের স্থলে মানুষের প্রবর্তিত আইন অনুযায়ী ফয়সালা ও বিচার করার যেই ধারা জারি রয়েছে, শরীয়তের দৃষ্টিতে তার হুকুম কি?
আল্লাহর শরীয়ত ব্যাতীত অন্য কোনো আইনে ফয়সালা করা
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
আর যারা আল্লাহর নাযিলকৃত (কুরআন) দ্বারা ফয়সালা করে না, তারাই কাফের। [সূরা মায়েদা :৪৪ ]
আল্লাহ তায়ালা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতকে তাঁর দ্বীন হেফাজতের জন্য নির্বাচন করেছেন। তাঁর দ্বীনকে কম-বেশি করা থেকে নিরাপদ রাখার তাওফীক দিয়েছেন। কুরআন ও হাদীসকে তার সঠিক অর্থ-মর্মের সাথে বর্ণনা করা এবং তা সালফে সালেহীনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনুযায়ী বোঝার তাওফীক দান করেছেন। যাতে এরা দ্বীনে মুবিন তথা সুস্পষ্ট দ্বীনকে সব ধরনের মিশ্রণ থেকে পবিত্র করেন। কঠোরতা ও সীমালঙ্ঘন কণ্টকাকীর্ণ পথ থেকে বাঁচিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ রাজপথে চালান। যার কারণে এই উম্মত প্রত্যেক যুগেই ফিতনার ঘোর অমানিশাতেও সফলভাবে যাত্রা করেছে এবং সম্মুখে অগ্রসর হয়েছে। শত্রুদের পক্ষ হতে শত প্রোপাগাণ্ডার মাঝেও এরা হকের ভারসাম্যপূর্ণ পথ ছাড়েনি। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ওলামায়ে কেরাম এই কাফেলাকে ডাকাত বুদ্ধিজীবী, ধর্মব্যবসায়ী দরবারি আলেম এবং ঈমানের ধূর্ত দুশমনদের কবল থেকে বাঁচিয়ে গন্তব্যপানে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَاتَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظَا هِرِيْنَ عَلَي الْحَقِّ لاَ يَضُرُّ هُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّي يَأتي أَمْرُ اللهِ
আমার উম্মতের একটি দল হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে কিতাল করতে থাকবে। যারা এই দলকে ত্যাগ করবে, তারা এই দলের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। অবশেষে আল্লাহর ফয়সালা এসে যাবে।[1]
তাই অন্যান্য বিষয়ের মত এই মাস’আলাতেও (আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফয়সালা না করা) প্রত্যেক যুগের হক্কানী ওলামায়ে কেরাম নিজ নিজ যুগের প্রান্তিকতা ও কম-বেশি চিহ্নিত করে বর্ণনা করেছেন এবং মাসআলাকে শরীয়তের শিক্ষার আলোকে বুঝিয়েছেন ।
এজন্য এ যুগেও আহলে হক ওলামায়ে কেরামের জন্য জরুরি, সর্বপ্রথম নিজেদের সম্মুখে বিদ্যমান সমস্যার রূপকে গভীরভাবে বোঝা। শুধু এর জাহেরী অবস্থা ও প্রচলিত প্রচ্ছন্ন পরিভাষার (মুবহাম ইসতিলাহাত) উপরই শরয়ী হুকুম বর্ণনা না করা। যাতে কুরআন ও হাদীসের আলোকে উম্মতকে রাহনুমায়ী করা যায়। কোনো মাসআলাতে নিজের পক্ষ হতে কঠোরতাও আরোপ না করা। শরীয়ত অবকাশ দিয়ে থাকলে নিজের পক্ষ হতে এসব বিষয়ে কঠোরতা আরোপ ও চাপাচাপি না করা। আবার সহজ করতে গিয়ে দ্বীনের সীমানাও লঙ্ঘন না করা, যা কুফর ও ইসলামের মাঝে বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা দান করে ।
কিন্ত আফসোসের বিষয় হল, বর্তমান যুগে আলোচ্য বিষয়ে মানুষ অত্যন্ত উদাসীন ও চাটুকারিতায় লিপ্ত। এখন তো অবস্থা এই যে, সাধারণ মানুষ তো পরের কথা, ওলামায়ে কেরামের পরিবারেও এ বিষয়ের অনুভূতি নেই যে, আল্লাহর শরীয়ত ছাড়া অন্য কোনো আইনের অধীনে বেঁচে থাকা, গায়রুল্লাহর আইনকে শাসক মানা, তার উপর নিরব থাকা, খুশি থাকা-এটা যেনতেন অপরাধ নয়, সাধারণ কোনো গুনাহ নয়। আল্লাহ তায়ালা এটাকে বড় কঠিন শব্দে বর্ণনা করেছেন।
এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালার কঠিন ধমকিকে নিজের পক্ষ হতে হালকা করে পেশ করা, কোনো সাহাবীর উক্তিকে অজাগায় উপস্থাপন করা, এটা কী পরিমাণ অন্যায় কাজ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আসমান ও জমিনের শাহানশাহ মানুষদেরকে ভীতিপ্রদর্শন করছে যে, যে ব্যক্তি আমার আইন ব্যাতিত অন্য আইনে ফয়সালা করল, সে কাফের। কিন্তু এমন মানুষও রয়েছে, যে আল্লাহর এই ধমকির সামনে দাঁড়িয়ে যায়। নিজেও কুফরি করে এবং অন্যদেরকেও সাহস যোগায় যে, না এতে কোনো সমস্যা নেই। তুমি যত বড় অপরাধ মনে করছ, বাস্তবে তা নয়। নাউযুবিল্লাহ।
এমনিভাবে এ বিষয়টিও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মাসলাকের খেলাফ যে, কুরআন ও হাদীসের বাহ্যিক অর্থ দেখে এমন ব্যাখ্যা করা যা আসলাফে উম্মত থেকে প্রমাণিত নেই।
সামনে হাজির হওয়া কোনো সমস্যায় আমরা তখনই ভুল করে বসি, যখন আমরা সমস্যার গভীরে না গিয়ে এবং সমস্যা সম্পর্কে সালফে সালেহীন কর্তৃক বর্ণিত বিস্তারিত বিবরণ আলোচনা না করে শুধু বাহ্যিক অবস্থার উপর ফয়সালা দেই। এমনিভাবে আরেকটি ভুল এই হয় যে, আসলাফে উম্মতের বর্ণনাকৃত বিস্তারিত বিবরণকে আমরা এমন স্থানে প্রয়োগ করি, যেখানে সেটা কোনোভাই উপযোগী হয় না।
আলোচ্য বিষয়ও (কুরআন ব্যতীত অন্য আইনে ফয়সালা করা) এ ধরনেরই একটি সমস্যা যাতে সমস্যার প্রকৃতির (সুরতে মাসআলা) গভীরে যাওয়া ছাড়াই প্রচলিত ব্যবস্থা সম্পর্কে শরয়ী হুকুম বর্ণনা করা হয়। অধম সমস্যার প্রকৃতিকে (সুরতে মাসআলা) স্পষ্টরূপে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছে। যাতে হক্কানী ওলামায়ে কেরাম শরীয়তের আলোকে আমাদের রাহনুমায়ী করেন।
সতর্কতা জ্ঞাপন
কুরআন ব্যতীত অন্য কোনো আইনে ফয়সালাকারী ব্যক্তি কাফের কি না? এই আলোচনায় একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, পুরো আলোচনাটি একটি মাত্র শরয়ী হুকুমের সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ একজন জজ বা বিচারক কুরআনের সমস্ত ফয়সালা প্রদান করে। কিন্তু অকাট্যভাবে প্রমাণিত একটা মাত্র শররী হুকুম কুরআন ব্যাতীত অন্য আইনে ফয়সালা দেয়। (যেমন যেনার শরয়ী শাস্তির পরিবর্তে ইংরেজি আইনে শাস্তির ফয়সালা করে।) তবে সে ইসলামের পুরোপুরি গণ্ডি থেকে বের হয়ে গিয়েছে কি না?
আয়াতের শানে নুযুল ও প্রেক্ষাপট
প্রথমে আয়াতটির শানে নুযুল ও প্রেক্ষাপট বুঝে নিন। এরপর আয়াতের তাফসীরে মশহুর মুফাসসিরীনদের (মুতাকাদ্দিমীন ও মুতাআখখিরীন) কথা ও মত বর্ণনা করা হবে। আমরা যদি এই আলোচনাটি- ভালোভাবে বুঝি, তা হলে ইনশাআল্লাহ, ইসলাম এবং কুফর- আধুনিক দাজ্জালি মস্তিস্ক যাকে একাকার করার চেষ্টা করেছে- স্পষ্ট হয়ে যাবে।
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
আর যারা আল্লাহর নাযিলকৃত (কুরআন) দ্বারা ফয়সালা করে না, তারাই কাফের।[সূরা মায়েদা : 8৪]
মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার মারেফুল কুরআনে ইমাম বাগবী রহমাতুল্লাহি আলাইহির উদ্বৃতিতে আয়াতটির শানে নুযুল এভাবে বর্ণনা করেছেন-
এটি একটি যেনার ঘটনা। খায়বারের ইহুদীদের মধ্যে এই ঘটনাটি ঘটে। তাওরাতের শাস্তি অনুযায়ী যেনাকারী নারী-পুরুষ উভয়কে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করা আবশ্যক ছিল। কিন্তু এরা ছিল বড় একটি খান্দানের মানুষ। ইহুদীরা তাদের পুরাতন অভ্যাস অনুযায়ী এদের শাস্তি হ্রাস করতে চাচ্ছিল। আর তারা এ কথা জানত যে, ইসলাম ধর্মে অনেক সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছে। তাই তারা এ কথা মনে করছিল যে, ইসলামে হয়ত এ শাস্তির ক্ষেত্রেও ছাড় আছে। খায়বারের লোকেরা তাদের মিত্র বনি কুরায়জার লোকদেরকে এই পয়গাম পাঠায় যে, বিষয়টি মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দ্বারা ফয়সালা কর।
যাইহোক, কা’আব বিন আশরাফ সহ একটি প্রতিনিধি তাদেরকে নিয়ে হযরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাজির হয় এবং জিজ্ঞাসা করে, বিবাহিত নারী পুরুষ ব্যাভিচারে লিপ্ত হলে তার শাস্তি কি?
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি আমার ফয়সালা মানবে?
তারা উত্তর দেয়, হ্যাঁ, আমরা আপনার ফয়সালা মানব।
হযরত জিবরাইল আমীন তখন আল্লাহর এই হুকুম নিয়ে নাযিল হন যে, এর শাস্তি হল প্রস্তারাঘাতে হত্যা করা। তারা যখন এই ফয়সালা শোনে, হতভম্ব হয়ে পড়ে এবং ফয়সালা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। হযরত জিবরাইল আমীন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পরামর্শ দিলেন, আপনি এদেরকে বলুন, আমার ফয়সালা মানা নামানার ক্ষেত্রে ইবনে সুরিয়াকে বিচারক বানাও। এরপর তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইবনে সুরিয়ার অবস্থা ও গুণ-বৈশিষ্ট্য বলে দেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই প্রতিনিধি দলকে বললেন, তোমরা কি ফিদাকে বসবাসকারী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি ইবনে সুরিয়াকে চেনো? সবাই স্বীকার করল, হ্যাঁ চিনি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তাকে তোমরা কেমন মনে কর? তারা বলল, পৃথিবীর বুকে ইহুদীদের মধ্যে তার চেয়ে বড় কোনো আলেম আর একজনও নেই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে ডেকে আনো। এরপর তাকে ডেকে আনা হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এ সম্পর্কে তাওরাতের বিধান কি?
ইবনে সুরিয়া বলল, সেই সত্ত্বার কসম, যার কসম আপনি আমাকে দিয়েছেন, আপনি যদি কসম নাও দিতেন, আর আমার যদি এই ভয় না থাকত যে, ভুল বলার ক্ষেত্রে তাওরাত আমাকে জ্বালিয়ে ফেলবে, তবে আমি এই সত্য প্রকাশ করতাম না। সত্য হল, ইসলামের মত তাওরাতেও এই একই নির্দেশ রয়েছে। তাদের উভয়কে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করতে হবে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, তবে এমন কী আপদ এসেছে যে, তোমরা তাওরাতের নির্দেশের বিরোধিতা করছ?
ইবনে সুরিয়া তখন বলে, আসল বিষয় হল, আমাদের ধর্মেও যেনার শরয়ী শাস্তি এটাই, প্রস্তারাঘাতে হত্যা করা। কিন্তু একবার আমাদের এক শাহজাদা এই অপরাধ করে বসে। তার পক্ষপাতিত্ব করতে গিয়ে আমরা তাকে ছেড়ে দেই। তাকে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করা হয় না। কিছুদিন পর একই অপরাধ একজন সাধারণ মানুষও করে। দায়িত্বশীলরা তাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করতে চায়। অপরাধীর পরিবার তখন এর বিরোধিতা করে। তারা বলে, একে যদি শরয়ী শাস্তি দিতে চাও, তবে আগে শাহজাদাকে দাও। না হলে আমরা একেও এই শাস্তি দিতে দেব না।
এক সময় বিষয়টি অনেক বড় সমস্যায় রূপ নেয়। তখন সবাই মিলে এই সমঝোতা করা হয় যে, সবার জন্য একই শাস্তি নির্ধারণ করা হোক এবং তাওরাতের বিধান বাদ লঘু শাস্তির বিধান জারি করা হোক। এরপর থেকে তাওরাতের বিধানের পরিবর্তে সবার ক্ষেত্রে এই শাস্তিই প্রচলিত রয়েছে।'
এই আয়াতের শানে নুযুলে ইমাম বুখারী রহামতুল্লাহি আলাইহি এবং ইমাম মুসলিম রহমাতুল্লাহি আলাইহিও এই ঘটনাই উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য তাফসীরকারকগণ বর্ণনা করেছেন যে, তাওরাতে উল্লেখিত এই শাস্তি ছিল, মুখে কালি মাখিয়ে উভয়কে গাধার উপর উল্টা করে বসিয়ে শহরের অলিতে গলিতে ঘুরানো এবং বেত্রাঘাত করা।
কয়েকটি গুরুতপূর্ণ বিষয়
- তাওরাতের সাদাকাত ও সততার উপর ওই ইহুদীর ঈমান দেখুন। সে ভুল কথা বলার ক্ষেত্রে ভয় পাচ্ছে যে, তাওরাত তাকে জ্বালিয়ে ফেলবে। সেই সাথে আল্লাহর ওয়াহদানিয়াতের উপর ইয়াকিনও লক্ষ্য করুন যে, কসম দেয়ার কারণে এমন সত্য কথা বলতে সে উদ্বুদ্ধ হয়েছে যার দ্বারা তার গোটা জাতি ও ধর্মের বেইজ্জতি হচ্ছিল।
- সে তাওরাতের প্রস্তারাঘাতের হুকুম এমনভাবে অস্বীকার করেনি যে, সে তা منزل من الله(আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিলকৃত) হওয়ার মুনকির (অস্বীকারকারী) হয়ে গিয়েছিল। বরং সে তাওরাতের হুকুমের মোকাবেলায় নিজেদের পক্ষ হতে আরেকটি আইন মঞ্জুর করে নিয়েছিল এবং সেটা বাস্তবায়ন করত।
- ইহুদী আলেমরা তাওরাতের রজমের হুকুম তুলে দিয়ে নিজেদের সংযোজিত আইন গেজেট আকারে বা সাংবিধানিকরূপে প্রকাশ করেনি। তাওরাতের আইনের বিপরীতে কোনো সংবিধান লিখিতভাবেও প্রণয়ন করেনি। বরং তাওরাতে তখনো আল্লাহর নাযিলকৃত 'রজম আইন’ই বিদ্যমান ছিল। এই সংযোজন ছিল শুধু মৌখিক।
পক্ষান্তরে বর্তমানে আল্লাহর কুরআনের বিপরীতে লিখিতরূপে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। যা নিয়মতান্ত্রিকভবে পড়ানো হয় এবং কুরআনের বিপরীতে তা দেশে জোরপূর্বক বাস্তবায়ন করা হয়। এর ভেতর অসংখ্য শরীয়ত পরিপন্থি সংযোজন রয়েছে। এরপরও এটাকে ইসলামী বলা হয়। যেন কুরআন ইসলামী নয়, ইসলামী বরং যে আইন পাকিস্তানে রয়েছে, সেটা। অথবা চোরের হাত কাটা ও বিবাহিত নারী- পুরুষ কে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করার যে আইন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এনেছেন, সেটা ইসলামী নয় । ইসলামী বরং যা পাকিস্তানের আইনে রয়েছে।
- এই ঘটনা থেকে জানা গেল, আল্লাহর নাযিলকৃত আইনে সংযোজনকারীদের বিরুদ্ধে কুফরির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যারা এমন আইন সংযোজন করে, তারা কাফের।
এখন আপনিই একটু ভেবে দেখুন, বর্তমান গনতন্ত্রের ধর্মহীন ধবজাধারীরা এবং তাদের সশস্ত্র রক্ষীরাও তো এমনই করছে। তারা বরং ইহুদীদের থেকেও এক ধাপ এগিয়ে৷ তারা ইহুদীদের থেকেও অনেক বেশি ঘৃণ্য কাজ করছে। আপনারা বর্তমানের গনতন্ত্রের সাথে শরিক ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোকে দেখুন, তারা কেমন উদ্ধত্যের সাথে কুরআনের বিধি-বিধানকে হিংস্রতা ও পাশবিকতা বলছে।
কুরআনের আইনকে পশ্চাদপদ ও অন্ধকার যুগের আইন বলছে । ক্ষমতাবলে তা বাস্তবায়ন করতে বাধা দিচ্ছে। তাদের মধ্যে না ভদ্রতা রয়েছে না আল্লাহর ভয়ের কোনো পরোয়া রয়েছে।
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُসম্পর্কে মুফাস্সিরীনের মতামত
আসুন, আয়াতটি উম্মতের সেসব মুফাসিরদের তাফসির দ্বারা বুঝি, যেই তাফসীরের উপর সবাই একমত।
ইমামুল মুফাসসিরীন ইবনে জারীর তাবারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই আয়াতের তাফসীরে বলেন-
يقول تعالي ذكره : ومن كتم حكم الله الذي أنزله في كتابه وجعله حكما بين عباده فأخفاه وحكم بغيره كحم اليهود....
]فألئك هم الكافرون[يقول : هؤلاء الذين لم يحكموا بما أنزالله في كتابه ولكن بدلوا وغير واحكمه وكتموا الحق الذي أنزله في كتابه
]هم الكافرون[يقول : هم الذين ستروا الحق الذي كان عليهم كشفه وتبينه وغطوه عن الناس و أظهروا لهم غيره وقضوا به لسحت أخذوه منهم عليه
আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সেই হুকুমকে গোপন করল, যা তিনি তার কিতাবে নাযিল করেছেন এবং যেই হুকুমকে তার বান্দাদের জন্য আইন বানিয়েছেন। সুতরাং সে এই আইনকে গোপন করল এবং ইহুদীদের মত এই আইন ব্যতীত অন্য আইনে ফয়সালা করল।
তারা কাফের- অর্থাৎ যারা আল্লাহর নাযিলকৃত (আইন) দ্বারা ফয়সালা করে না, বরং আল্লাহর শরীয়তকে উল্টিয়ে দেয় এবং সেই হককে গোপন করে যা আল্লাহ তায়ালা তার কিতাবে নাজিল করেছেন।
এরা কাফের- যারা হককে গোপন করেছে, যা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা তাদের জন্য আবশ্যক ছিল। এবং অন্যদের দৃষ্টি হতে এই হককে আড়ালে রেখেছে। আর মানুষের সম্মুখে এই হক ব্যাতীত অন্যান্য বিষয় প্রকাশ করেছে এবং সেই অনুযায়ী ফয়সালা করেছে, ঘুষের কারণে। যা তারা নিয়েছিল।[2]
ফায়দা : ইমাম ইবনে জারীর তাবারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই আয়াতের তাফসীরে যে বিবরণ উল্লেখ করেছেন, আজকের বিচার ব্যবস্থায় তা পুরোপুরিই পাওয়া যায়। আল্লাহর আইন গোপন করা। অর্থাৎ চলমান মামলার ক্ষেত্রে আল্লাহর আইন কি, মামলার সময় তা উল্লেখই না করা। বরং নিজেদের তৈরিকৃত আইনকে ইসলামী আইন বলা এবং এ কথা বলা যে, আমাদের আদালত ও বিচার ব্যবস্থা ইসলামী আইনের আলোকেই ফয়সালা করে। আল্লাহর আইনে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা (যেমন বিবাহিত নারী-পুরুষকে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করার পরিবর্তে কয়েক বছরের জেলের শাস্তি ইত্যাদি)... এ সবই এমন কাজ যার কারণে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে ইহুদীদেরকে কাফের ঘোষণা করেছেন।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা এই আয়াতের তাফসীরে বলেন
من جحد ما أنزل الله فقد كفر. ومن أقربه ولم يحكم فهو ظالم فاسق
কোনো ব্যক্তি আল্লাহর ‘হুদুদ' )প্রস্তারাঘাত করা, বেত্রাঘাত করা ইত্যাদি) হতে একটা আইনও যদি অস্বীকার করে, সে কাফের। আর যে ব্যক্তি এগুলো স্বীকার করে ঠিক, কিন্তু এ অনুযায়ী ফয়সালা করে না, সে জালেম এবং ফাসেক।
হযরত ইকরামা রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
معناه: ومن لم يحكم بما أنزل الله جاحدا به فقد كفر. ومن أقربه ولم يحكم به فهو ظالم فاسق
এর অর্থ হল, যে ব্যক্তি আল্লাহর আইন অস্বীকার করে এ অনুযায়ী ফয়সালা করে না, সে ব্যক্তি সত্যিই কাফের । আর যে এই আইন স্বীকার করে কিন্তু এ অনুযায়ী ফয়সালা করে না, সে ব্যক্তি জালেম এবং ফাসেক।[3]
[1]الصحيح لمسلم: الجزء10,كتاب الامارة.باب قوله صلي الله عليه وسلم لاتزال طائفة من أمتي ظاهرين علي الحق لايضرهم من خالفهم
[2] جامع البيان في تاويل القران : محمد بن جرير يزيد بن غالب الاملي. ابو جعفر الطبري ]متوفي : 310 ه[
[3] الكشف والبيان: الجزء5.أبو اسحاق أحمد بن محمد بن ابراهيم الثعلبي النيسا بوري )المتوفي :437ه)
[2] جامع البيان في تاويل القران : محمد بن جرير يزيد بن غالب الاملي. ابو جعفر الطبري ]متوفي : 310 ه[
[3] الكشف والبيان: الجزء5.أبو اسحاق أحمد بن محمد بن ابراهيم الثعلبي النيسا بوري )المتوفي :437ه)