আবাবিল প্রকাশন মিডিয়া পরিবেশিত
ইসলাম ও গণতন্ত্র
।।মাওলানা আসেম ওমররহিমাহুল্লাহ।।
এর থেকে– পঞ্চদশ পর্ব
ইসলাম ও গণতন্ত্র
।।মাওলানা আসেম ওমররহিমাহুল্লাহ।।
এর থেকে– পঞ্চদশ পর্ব
আয়াতের তাফসীর এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
এই আয়াতের তাফসীরে কোনো কোনো মুফাসসির এ কথা বলেছেন যে, এ আয়াতে কুফর দ্বারা উদ্দেশ্যكفردون كفرবা ছোট কুফরি। কোনো কোনো মুফাসসির বলেছেন, আয়াতটি ইহুদীদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। আসুন, বিষয়টা একটু ব্যাখ্যাসহ বোঝার চেষ্টা করি ।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমার মতليس الكفر الذي يذهبون اليه‘এটা সেই কুফরি নয় যা তারা উদ্দেশ্য নিয়ে থাকে’, খারেজীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। কারণ খারেজীরা এই আয়াতকে ভিত্তি বানিয়ে কোনো প্রকার তাফসিল ছাড়া সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমের বিরুদ্ধে কুফরের হুকুম লাগাত। অথচ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নিকট এতে তফসিল (ব্যাখ্যা) রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর শব্দ يذهبون اليه (তারা যে কুফরি উদ্দেশ্য নিয়ে থাকে) সুস্পষ্টরুপে এ কথাই বলছে যে, এই কথা খারেজীদের জবাবে বলেছেন। কারণ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের এ মাসলাকই ছিল না যে, তারা এই আয়াতকে ভিত্তি বানিয়ে নাউযুবিল্লাহ রাসূলের কোনো সাহাবীকে কাফের সাব্যস্ত করবেন। সুতরাং এটা যখন আহলে সুন্নাতের মাসলাকই ছিল না, তবে ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাদের সম্পর্কে এ কথা কেনো বলবেন, “তারা যে কুফরি উদ্দেশ্য নেয়”।
এমনিভাবে বিখ্যাত তাবেয়ী আবু মিজলায রহমাতুল্লাহি আলাইহির সেই কথপোকথন যা তার থেকে বনী আমর ইবনে সুদুসের লোকেরা এ সম্পর্কে বলেছে। মনে রাখবেন এরা খারেজী ছিল। হযরত আবু মিজলায রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাদেরকে এ কথাই বুঝিয়েছেন যে, এই আয়াতে সরাসরিভাবে কুফরের হুকুম নেই বরং তফসিল রয়েছে।
এই আলোচনায় আমরা যদি একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বুঝে নেই, তবে আয়াতটির তাফসীর বোঝা অত্যন্ত সহজ হয়ে যাবে। এই রেওয়ায়েত দুটি, যা ইমাম ইবনে জারীর তাবারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার তাফসীরে ১২০২৫ এবং ১২০২৬ নাম্বার আছরের অধীনে বর্ণনা করেছেন। ওই রেওয়ায়েতের কথপোকথন হযরত আবু মিজলায রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং বনী আমর ইবনে সুদুসের লোকদের মধ্যকার। স্মরণ রাখবেন, আবু মিজলায রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাবেয়ী ছিলেন। তিনি হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে মুহব্বত করতেন। আর বনী আমর ইবনে সুদুসের যে সব লোক তাঁর সাথে কথা বলতে এসেছিল, এরা প্রথমে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সঙ্গে ছিল। পরে খারেজী হয়ে গিয়েছিল।
তাদের বক্তব্য ছিল, হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং অন্যান্য সমস্ত সাহাবা (নাউযুবিল্লাহ) মুরতাদ হয়ে গিয়েছে। দলিল হিসেবে তারা এই আয়াত পেশ করত যে, যারা আল্লাহ প্রদত্ত আইনে ফয়সালা করে না তারা কাফের। এ বিষয়টি ওই যুগে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এজন্য সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীন তাদের জবাবে এ কথা বলেন যে, এই আয়াত দ্বারা তোমরা যে হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও অন্যান্য সাহাবীর কুফর প্রমাণ করতে চাও, এই কুফর সেই কুফর নয়। হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর মাঝে ওই জিনিসই নেই, যা তোমরা প্রমাণ করতে চাচ্ছো। সুতরাং দলিল হিসেবে এই আয়াত পেশ করা অযৌক্তিক। আপনারা হযরত আবু মিজলায রহমাতুল্লাহি আলাইহির শব্দগুলো লক্ষ্য করলে বিষয়টি সহজেই বুঝতে পারবেন।
খারেজীরা হযরত আবু মিজলায রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে জিজ্ঞাসা করে, এই তিন আয়াত (যেই তিন আয়াতে আল্লাহর শরীয়ত দ্বারা যারা ফয়সালা করে না, তাদেরকে কাফের ফাসেক এবং জালেম বলা হয়েছে) সম্পর্কে আপনার মত কি? এটা কি হক?
হযরত আবু মিজলায রহমাতুল্লাহি আলাইহি উত্তর দেন, হ্যাঁ, এটা হক।
খারেজীরা জিজ্ঞাসা করে, তবে এই শাসকরা কি শরীয়ত অনুযায়ী বিচার করে? তিনি উত্তর দেন-
هو دينهم الذي يدينون به. وبه يقولون. وإليه يدْعون. فنهم تركوا شئًا منه عرفوا أنهم قد أصابوا ذنبًا!
এই শরীয়তই তো তাদের দ্বীন ও নিযাম। যা তারা দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। এরা তো এরই সমর্থক এবং মানুষদেরকে এর প্রতিই আহ্বান করে। এ থেকে কোনো কিছু বাদ দিলে তারা এ বিশ্বাস করে যে তারা গুনাহের কাজ করেছে।
এরপর আরও কথপোকথন হয়। শেষে তিনি বলেন-
এই আয়াত ইহুদী, নাসারা, মুশরিক এবং তাদের মত লোকদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। [তাফসীরে তাবারী: জুয :১০]
অর্থাৎ যে মুসলমান শাসক এই শরীয়তকে আইন হিসেবে তার দেশে বাস্তবায়ন করবে, নিফাযে শরীয়তের প্রবক্তা হবে, এরই আহ্বান করবে। এরপরও কোনো আইনের উপর আমল করতে গিয়ে অবহেলা বা বিলম্ব হলে নিজেকে গুনাহগার মনে করে। এমন শাসকদের বেলায় এই আয়াত নয়। এই আয়াত তো সে সব শাসকদের ব্যাপারে, যারা ইহুদী নাসারা ও মুশরিকদের মত আল্লাহর শরীয়ত ত্যাগ করে। আল্লাহর শরীয়ত নিজ রাষ্ট্রে বাস্তবায়নও করে না, এ সম্পর্কে কোনো কথাও বলে না, শরীয়ত বাস্তবায়নের জন্য কাউকে আহ্বানও করে না। এক কথায় আল্লাহর শরীয়ত নিজ রাষ্ট্রে বাস্তবায়ন তো করেই না, গায়রুল্লাহর আইনে রাষ্ট্র পরিচালনা ও বিচারব্যবস্থা চালু রাখার কারণে নিজেকে অপরাধীও মনে করে না। সে যে ভয়ঙ্কর পাপে লিপ্ত, সে অনুভূতিই তার মধ্যে নেই। এমন শাসক ইহুদী নাসারাদের মত পাক্কা কাফের কিন্তু তোমরা (খারেজীরা) যেই আয়াতের আলোকে হযরত সাহাবায়ে কেরামকে কাফের প্রমাণিত করতে চাচ্ছো, মনে রেখো, এই আয়াত তাদের ব্যাপারে নয়। এই আয়াত ইহুদী, নাসারা এবং সে সব লোকদের ব্যাপারে যারা মামলা মোকাদ্দমা ও বিচারব্যবস্থায় ইহুদীদের মত কাজ করে।
এখন হয়ত আপনারা বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন যে, যে সব সাহাবা ও তাবেয়ীন মুফাসসির এই আয়াত সম্পর্কে এ কথা বলেছেন যে, আয়াতটি মুসলমানদের ব্যাপারে নয়, বরং ইহুদী ও নাসারাদের ব্যাপারে৷ তাদের উদ্দেশ্য এটাই যে, খারেজীরা ইহাকে সাহাবীদের উপর প্রয়োগ করতে চায়, তা সঠিক নয়। খারেজীদের ভ্রান্ত বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে তারা এমন বলেছেন। এই আয়াতে যেই কুফরির কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তা ইহুদীদের ভেতর ছিল, তারা আল্লাহর শরীয়ত ত্যাগ করে তাদের নিজেদের বানানো আইনে ফয়সালা করত এবং নিজেদের বানানো নিয়মকেই আইন সাব্যস্ত করত, যার জন্য তাদের ভেতর অনুতাপ ও অনুশোচনা ছিল না, নিজেদেরকে পাপী ও গুনাহগার মনে করত না- হযরত সাহাবায়ে কেরাম এই কুফরি থেকে পরিপূর্ণ পবিত্র ছিলেন।
উপরন্তু এসব মুফাসসিরদের নিকটও এই আয়াতের হুকুম আ’ম ও ব্যাপক। অর্থাৎ ইহুদীদের ভেতর যে সব বিষয় ছিল, তা যদি কোনো মুসলমান শাসক ও বিচারকের ভেতর পাওয়া যায়, তবে সেও ইহুদীদের মত পুরোপুরি কাফের বিবেচিত হবে। যেমন আবু মিজলায রহমাতুল্লাহি আলাইহির বর্ণনায় এ কথা উল্লেখ রয়েছে যে, ‘ইহুদী ও নাসারাদের মত যারা করবে, এই আয়াত তাদের ব্যাপারেও।' অর্থাৎ এই আয়াতের হুকুম তাদের বেলায়ও সমানভাবে প্রযোজ্য হবে ।
এ কথা আমরা নিজেদের পক্ষ হতে বলছিল না। ইমামুল মুফাসসিরীন হযরত ইবনে জারীর তাবারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই আয়াতের উপর ব্যাপক আলোচনার পর নিজের মত এভাবে বর্ণনা করেছেন-
আবু জাফর ইবনে জারীর তাবারী বলেন, আমার নিকট এ সমস্ত মতের (আকওয়াল) মধ্যে সবচেয়ে সঠিক মত মনে হয়েছে এটা...। আয়াতটি ইহুদীদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে । কারণ এই আয়াতের পূর্বের ও পরের আয়াত ইহুদীদের সম্পর্কে।
এখন কেউ যদি এই প্রশ্ন করে যে, আল্লাহ তায়ালা তো এই হুকুম প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য আ’ম রেখেছেন, ব্যাপক রেখেছেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর শরীয়ত দ্বারা ফয়সালা করবেন না- আপনি এটাকে (ইহুদীদের সাথে) খাস করলেন কোনো, নির্দিষ্ট করলেন কেনো?
এর উত্তর হল, আল্লাহ তায়ালা এমন ব্যক্তিদের আ’ম (ব্যাপক) হুকুম বর্ণনা করেছেন- যারা আল্লাহর আইন অস্বীকার করে ছেড়ে দেয়, ত্যাগ করে। সুতরাং বিচার ব্যবস্থায় যারা আল্লাহর আইন ইহুদীদের মত ছেড়ে দিবে, তারা কাফের। এমনিভাবে যে ব্যক্তিই আল্লাহর হুকুম অস্বীকার করে ছেড়ে দিবে, সে কাফের। হযরত ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুও তাই বলেছেন। কারণ এই আইন আল্লাহ তায়ালা তার কিতাবে নাযিল করেছেন, এ কথা জানার পরও আল্লাহর হুকুম (আইন) অস্বীকার করা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর নবী জানার পরও তীকে নবী অস্বীকার করার মতই । [তাফসীরে তাবারী]
আরও পড়ুন
চতুর্দশ পর্ব ---------------------------------------------------------------------------------- ষষ্ঠদশ পর্ব