তাওহীদ আল-‘আমালী
শহীদ শাইখুল মুজাহিদীন ইমাম আব্দুল্লাহ আযযাম (রহিঃ)
শহীদ শাইখুল মুজাহিদীন ইমাম আব্দুল্লাহ আযযাম (রহিঃ)
১। পুস্তক পরিচিতিঃ “তাওহীদ আল-‘আমালী” প্রকৃতপক্ষে শহীদ শাইখুল মুজাহিদীন, ইমাম আব্দুল্লাহ আযযাম (রহিঃ) কর্তৃক প্রদানকৃত একটি খুতবার অংশ বিশেষ।
২। লেখক পরিচিতিঃ শাইখ আব্দুল্লাহ আযযামকে (১৯৪১-১৯৮৯ খ্রীঃ) বলা হয় বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিশ্বব্যাপী জিহাদ উত্থানের বাস্তব-গুরু। জীবন পরিক্রমায় প্যালেস্টাইনের জাতীয়তাবাদী যুদ্ধে বিতশ্রদ্ধ হয়ে, জর্ডান, মিশরের আল-আজহার ইউনিভার্সিটি, সৌদি-আরব ও পাকিস্তান পেরিয়ে পরিশেষে নিজেকে যখন সোভিয়েত- আফগান যুদ্ধের ময়দানে (১৯৭৯-১৯৮৯ খ্রিঃ) আবিষ্কার করলেন, তিনি উতফুল্ল চিত্তে উচ্চারণ করলেন ‘এটাইতো প্রকৃত জিহাদ’। তার লিখিত সেই ঐতিহাসিক ফাতওয়া- “ফাতওয়াঃ আলিমগণের দ্বারা ইসলামের কোন বিষয়ে রায় প্রদান করা” যা তৎকালীন শাইখ বিন বাজ সহ, বিশ্বব্যাপী প্রায় সকল মাযহাবের বহু আলেম-উলামা কর্তৃক বিপুলভাবে সমর্থন লাভ করে[1] জিহাদের ফারজিয়াতকে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে পুনঃপ্রাসংগিক করে তুলেছিল।[2]
৩। পুস্তক এর শিক্ষনীয় বিষয়ঃ
ক। তাওহীদ তিন ধরনের, যার মধ্যে নিম্নে বর্ণিত ৩য়টি হল সকল তাওহীদ অর্জনের মূলঃ
(১) তাওহীদুর রুবূবীয়্যাহ (রব হিসেবে আল্লাহর একত্ববাদ),ত
(২) তাওহীদুল আসমা অস্ সিফাত (আল্লাহর নাম গুণাবলীতে একত্ববাদ)
(৩) তাওহীদুল উলুহীয়্যাহ (ইবাদাতে মাবুদ হিসেবে আল্লাহর একত্ববাদ)/তাওহীদুল ইবাদাহ ।
খ। যুগে যুগে নবী বা রাসুলগণকে প্রেরণই করা হয়েছে তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ এর জন্যে। [3] প্রথম দুইটি তথা তাওহীদ আর রুবুবিয়াহ ও আসমা আস্* সিফাত হল ঈমানের তাত্বিক দিক, যা কেবল পরিষ্কারভাবে জানা ও মনে মনে যথাযথ ভাবে স্বীকৃতি প্রদান করাই কর্তব্য।
গ। এখন এই তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ কিভাবে অর্জন হবে? যেমনটি ‘রাসুলুল্লাহ (সাঃ) শিখিয়েছেন যে, কোন বিদ্যা শিক্ষার মাধ্যমে তাওহীদুল উলুহীয়্যাহ প্রতিষ্ঠিত হবার নয়। বরং, এটি প্রতিষ্ঠিত হবে আত্নশুদ্ধির মাধ্যমে, জিহাদের ময়দানে কাফিরদের মোকাবেলার মাধ্যমে, তাগুতের মুখোমুখি হয়ে অত্যাচার সহ্য করার মাধ্যমে ও সর্বোপরী নফসের কুরবানীর মাধ্যমে’। [4]
ঘ। অর্থাৎ, ‘জিহাদের ময়দানে অংশগ্রহণ করা ব্যতীত একজন মানুষের অন্তরে তাওহীদের ভিত্তি মজবুত হতে পারে না’।[5] কেন? “ একজন মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে তার জীবন। যখন, এই জীবন আপনার হাতের তালুতে রাখবেন-দিনে এবং রাতে আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করবেন যেন আল্লাহ তা গ্রহণ করে আপনাকে পবিত্র করে এবং আপনি দুঃখিত হবেন যদি বিশ্ব জগতের রব তা গ্রহণ না করে, তখন কিভাবে আপনি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করবেন? যে প্রতিদিন মৃত্যুর সামনে উপস্থিত হয়, সে কি কোন কিছুকে ভয় পেতে পারে আল্লাহ ছাড়া? সুতরাং তাওহীদ অন্তরে সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, সম্পূর্ণভাবে শিকড় গাড়তে পারে না- জিহাদ করা ব্যাতীত।
ঙ। দ্বীনের সত্যিকারের বুঝ অন্তরে ধারন করতে হলেও আপনাকে জিহাদে যোগদান করতে হবে। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন, “.......তাদের প্রত্যেকটি বড় দল হতে এক একটি ছোট দল (জিহাদে) বহির্গত হয়, যাতে তারা ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে পারে আর প্রত্যাবর্তন করে নিজ কওমের লোকদের ভয় প্রদর্শন করতে পারে, যেন তারা পরহেয করে চলে” (সুরা তওবাঃ১২২)[6]
ইবনে আব্বাস (রাঃ), আত-তাবারী এবং সাইয়্যেদ কুতুব (রঃ) বর্নণা করেছেন যে, যেই দলটি আল্লাহ’র পথে জিহাদে বের হয় তারাই দ্বীনের বুঝ অর্জন করতে পারবে...তারাই দ্বীনের লুক্বায়িত সৌন্দর্য বুঝতে পারবে এবং দ্বীন তার আভ্যন্তরীণ মুক্তা তাদের নিকট প্রকাশ করে দিবে। [7]
সাইয়্যেদ কুতুব আরো বলেছেনঃ “ নিশ্চই, এই দ্বীন একজন ফক্বীহ’র নিকট এর সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না, যে, ঠান্ডা আলোচনায় বসে অথচ এই দ্বীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জিহাদ করে না ...”।
হ্যাঁ...এই দ্বীন...আপনি এর সঠিক বুঝ পেতে পারেন না যদি না আপনি এর জন্য আত্নত্যাগ করেন। যখন এই দ্বীনের জন্য আপনি কিছু (আত্নত্যাগ স্বীকার) করবেন তখন এই দ্বীন আপনাকে দিবে (এর সঠিক বুঝ)... “দেওয়া ও নেওয়া রীতি”।
অত্নত্যাগ! তখনই বিশ্বজগতের রব আপনার জন্য দরজা উম্নুক্ত করে দিবেন...
এই দ্বীনের জন্য আত্নত্যাগ করুন তখনি আল্লাহ আপনাকে তাঁর আয়াত ও হাদিস শিক্ষা দিবেন। একটা সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, আপনি জিহাদ ব্যাতিত কুরআনের অনেক আয়াতের মর্মার্থ বুঝতে পারবেন না।
উদাহরণ স্বরুপঃ সুরা আততাওবাহ, সুরা আল-আনফাল, সুরা আলি-ইমরান ...কিভাবে আপনি উক্ত সুরাসমূহ বুঝতে পারবেন জিহাদের জন্য চেষ্টা সাধনা ব্যাতীত? এটি কখনই সম্ভব নয়।
চ। আত্নার পরিশুদ্ধি। জিহাদের মাধ্যমে প্রথম যে লাভ অর্জিত হয় তা হচ্ছেঃ মানুষের আত্নার পরিশুদ্ধি। আত্না পরিশুদ্ধ হয়ে এর মধ্যে তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ অর্থাৎ, তাওহীদুল উবুদিয়্যাহ তথা তাওহী উল ‘আমালী প্রতিষ্ঠিত হয়। একজন বান্দার আচরণ এমন হয় যেন সে তার রবকে দেখছে এবং রব তার অতি নিকটেই আছে (আল্লাহ আল –ক্বারিব)।
ছ। আল্লাহর মু’জিযা স্বচক্ষে দেখতে হলে, আপনাকে জিহাদ করতে হবে। আকলমানদের জন্যে শাইখ আযযাম তার বইতে কতিপয় উদাহরণ তুলে ধরেছেনঃ
(১) “ আরসালান শহরে যুদ্ধের এক পর্যায়ে কিছু মুজাহিদীনকে রাশিয়ান ট্যাঙ্ক চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে। ওরা চেয়েছিল জীবিত ধরতে। মুজাহিদীনদের পালাবার আর কোন পথ ছিলনা। অতঃপর তারা দু’আ করলেন, “হে আল্লাহ, একজন কাফিরকেও আমাদের উপর ক্ষমতা দিও না”!। হঠাৎ ট্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে বিকট শব্দ শোনা গেল। সমস্ত রাশিয়ান বাহিনী পলায়ন করল, অথচ ওদেরকে লক্ষ্য করে কোন গুলি ছোড়া হয়নি! এরপরও মুজাহিদীনরা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবে না কেন”?[8]
(২) “একবার রাশিয়ান প্লেন মুজাহিদদের উপর বম্বিং করতে শুরু করল। মোঃ উমর নামে একজন তার ফিতরাত অনুযায়ী দুই হাত তুলে প্লেনটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে আমার রব! কে বড়? আপনি, নাকি প্লেনটি? কে বেশী শক্তিশালী? আপনি? নাকি এই প্লেনটি? আপনি কি আপনার এই বান্দাদেরকে প্লেনগুলীর থাবার মধ্যে ছেড়ে দেবেন?’ ...পরের সংবাদ, কাবুল রেডিও ষ্টেশন থেকে প্রচার করা হল, সেই প্লেনটি ভূপাতিত হয়েছে এবং এর মধ্যে একজন রাশিয়ান জেনারেল ছিল...”[9]
জ। মৃত্যু আল্লাহ’রই খাস ইচ্ছায় হয়। পারপার্শ্বিক কোন কারণ মৃত্যুর জন্য কেবল আল্লাহরই মনোনীত উসিলা মাত্র, এর প্রকৃত কারণ নয়। শাইখ তামিম একবার প্রবল গুলি বর্ষণের মধ্যে থেকেও অক্ষত ফিরে এসে তার সেই অভিজ্ঞতা থেকে [10] বললেন, “ সেই দিন থেকে আমি উপলব্ধি করতে পারলাম যে, বিশ্বজাহানের রব আল্লাহ’র নির্ধারিত মুহূর্ত ব্যতীত কেউই মারা যাতে পারে না এবং খুব কঠিন ঝুঁকি নিলেও মৃত্যূ মুহূর্ত পরিমাণ কাছে চলে আসে না, আর, নিরাপদ জায়াগায় থাকলেও মৃত্যু মুহূর্ত পরিমাণ দূরে চলে যায় না”।
৪। বাস্তবক্ষেত্রে তাওহীদ আল 'আমালী'র প্রয়োগ/ সংযোগ/ কিংবা করনীয়ঃ
জিহাদের সাথে তাওহীদের এই সম্পৃক্তি, বা স্বয়ং আল্লাহ ও তদীয় রাসুল (সাঃ) কর্তৃক তাওহীদ প্রতিষ্ঠায় জিহাদের তাগিদ সংক্রান্ত আলোচনার প্রভুত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমাদের অনেকেরই, তাওহীদ ও জিহাদের মধ্যে 'সম্পর্ক' সংক্রান্ত কোন জ্ঞানই নেই। ফলে তারা, তাদের অস্তিত্বর মূল্য যেমন বোঝেন না, আর না বোঝেন তাদের করনীয়ই বা কি। এমন অনেকেই আছেন, যারা না বুঝে, না জেনেই আফগানিস্তানের মুজাহিদদের সমালোচনা করেন, অনেক সময় কুফফারদের সুরে সুর মিলিয়ে ‘জংগি’ (Terrorist) বলতেও দ্বিধা করেন না, অথচ এই ভাইদের মাধ্যমেই মহান আল্লাহ'তাআলা মুসলিমীনদের সম্মানিত করেছেন, মর্যদা বৃদ্ধি করেছেন এবং মুসলমানিত্বের পতাকাকে সমুন্নত করে, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সমীহ অর্জনে সক্ষম করেছেন। [11] আল্লাহ'র ইচ্ছায়, এঁদেরই কারনে আজ, তথাকথিত 'সুপার পাওয়ার' ইসলামকে ভয় পায়, শ্রদ্ধা করে এবং মুসলমানদের সাথে কিছু করতে চাইলে কয়েকবার ভাবে। যাই হোক, ‘ওয়াহান’[12] তথা ‘দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও মৃত্যুকে ঘৃণার’ কালো ছায়া আজ মানুষের অন্তরে ভর করেছে। ফলে তারা গাফেল হয়ে রয়েছ। এবং তারা দেখেনা। মহান আল্লাহ'তাআলা যেন আমাদের সকলকে 'ওয়াহান' থেকে মুক্তি দান করেন এবং এই উম্মাহকে জিহাদের পথে অটল অবিচল রাখেন যেভাবে তিনি পছন্দ করেন এবং পুনরায় আমাদের খিলাফাহ'র স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে দেন।
৫। উপসংহারঃ
পরিশেষে সারকথাটুকু এই যে, মুসলমানিত্বের প্রথম ফরয- তাওহীদকে বোঝা ও একে বাস্তবায়ন করা। আর “বর্তমানে”, তাওহীদ বাস্তবায়নের একমাত্র সঠিক পথই হল ‘জিহাদ’।
[1] মুসলিমদের ভূমিকে প্রতিরক্ষা করা, শাইখ আবুল্লাহ আযযাম, পৃষ্ঠা ১৫,
[2] মুসলিমদের ভূমিকে প্রতিরক্ষা করা, শাইখ আবুল্লাহ আযযাম, পৃষ্ঠা ১১,
[3] তাওহীদ আল-‘আমালী, শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম (রহঃ) , পৃষ্ঠা নং ৭, শেষের দুই প্যারা দ্রষ্টব্য।
[4] তাওহীদ আল-‘আমালী, শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম (রহঃ), পৃষ্ঠা নং ৫,
[5] তাওহীদ আল-‘আমালী, শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম (রহঃ) , পৃষ্ঠা নং ৫
[6] তাওহীদ আল-‘আমালী, শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম (রহঃ) , পৃষ্ঠা নং ১১, সুরা তওবাঃ১২২ ও এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য
[7] তাওহীদ আল-‘আমালী, শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম (রহঃ) , পৃষ্ঠা নং ১১, প্যারা ৫ দ্রষ্টব্য
[8] তাওহীদ আল-‘আমালী, শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম (রহঃ) , পৃষ্ঠা নং ১২, ৪র্থ প্যারাগ্রাফ দ্রষ্টব্য
[9] তাওহীদ আল-‘আমালী, শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম (রহঃ) , পৃষ্ঠা নং ৮, ১ম প্যারাগ্রাফ দ্রষ্টব্য
[10] তাওহীদ আল-‘আমালী, শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম (রহঃ) , পৃষ্ঠা নং ৮ ও ৯ এর বর্নণা দ্রষ্টব্য
[11] তাওহীদ আল-‘আমালী, শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম (রহঃ) , পৃষ্ঠা নং ৫, শেষের প্যারাগ্রাফ দ্রষ্টব্য
[12] তাওহীদ আল-‘আমালী, শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম (রহঃ) , পৃষ্ঠা নং ৬, দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফ দ্রষ্টব্য
মূল বাংলা বইটি নিচের লিংকে পাওয়া যেতে পারেঃ