কেন আমি আল কায়েদায় অংশগ্রহণ করলাম
মূল
শায়খ আবু মুসআব মুহাম্মদ উমায়ের আল কালাবী আল আওলাকী রহ.
ভাষান্তর
আবু হামযা আল হিন্দী
১৩. কারণ তারা আলেমদের যথাযোগ্য সম্মান করে, তবে তাদেরকে একেবারে নিষ্পাপ মনে করে না।
কেউ বলতে পারে, আপনি আল কায়েদার অতিরিক্ত প্রশংসা করছেন! আমি বলব, আমি যা সত্য বলে বিশ্বাস করি তাই লিখি। বাস্তবতা এটাই যে, আমি দেখেছি তারা আলেমদের ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে না ভেবে যথাযোগ্য সম্মান করে অর্থাৎ আলেমদের সম্মান করতে গিয়ে তাদের ভুলের ঊর্ধ্বে ভাবে না এবং নিষ্পাপ মনে করে না, বরং এতদুভয়ের মাঝে পার্থক্য করে।
এখানে আরেকটি কথা বলা সঙ্গত মনে করছি। বাস্তবতা ও তাত্ত্বিকতার মাঝে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। অনেক ছাত্রই একটা মূলনীতি নিয়ে তত্ত্বগত আলোচনা খুব করে, কিন্তু বাস্তবে তার পুরো বিপরীত কাজ করে। যেমন একটি প্রসিদ্ধ মূলনীতি হল,
এটি ছাত্রদের মাঝে প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ একটি মূলনীতি। কিন্তু বাস্তবে কত ছাত্র যে এর বিপরীত কাজ করে তার ইয়ত্তা নেই! যার ফলে দেখা যায় অনেক ছাত্র জিহাদ ও আকীদা সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা নিয়ে কথা বলে আর সে মনে করে, এটা সে দলীলের আলোকে জেনেছে। অথচ বাস্তবে সেটা অন্যের মুখ থেকে জানতে পেরেছে। অনেক সময় সে মুজাহিদদের ব্যাপারে অনেক কঠিন কঠিন কথা বলে। অথচ সে ভালোভাবে না বুঝেই এসব বিষয়ে কথা বলছে। উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনা উল্লেখ করছি, জিহাদবিরোধী চিন্তাধারী এক ছাত্রের সাথে ইলমী তর্ক-বিতর্ক করছিলাম। সে জিহাদী মানহাজের ব্যাপারে কুৎসা রটাচ্ছিলো এবং খুব নিন্দা করছিল। সে যুবকদের সতর্ক করছিল এবং সর্বশক্তি ব্যয় করে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করছিলো। সে দুঃসাহসিকতার সাথে এসব বলে যাচ্ছিল। তখন আমি তাকে কাফেরদের সাহায্য করার বিধান সম্পর্কে প্রশ্ন করে বসলাম। সে উত্তর দিলো, সাহায্যকারী কখনও বাধ্য হয়ে কিংবা তাবিল বা ব্যাখ্যা করে সাহায্য করে থাকে। তখন আমি তার কথা মেনে নিয়ে বললাম যদি সে বাধ্য কিংবা তাবিলকারী না হয়? তখন সে কোনো জবাব দিতে পারল না! আমি বললাম, তুমি এই মাসআলাটাই জানো না! তাহলে কেন মুজাহিদদের নামে কুৎসা রটাচ্ছো? মুজাহিদগণ যেসব মূলনীতি অনুসরণ করে থাকে তুমি তো তা বোঝো না! তখন সে বলল, তাদের বিরুদ্ধে কি হুজ্জত কায়েম হয়েছে? আমি বললাম, হুজ্জত কায়েম হওয়ার মানে কী? সে বলল, কোন গ্রহণযোগ্য আলেম এ ব্যাপারে ফতোয়া দেয়া ও এজাতীয় আরো কিছু কথা বলল। তখন আমি তাকে বললাম, তুমি তো দেখি হুজ্জত কায়েম হওয়ার মানেই বোঝ না! অতঃপর আমি তাকে এ বিষয়ে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্যটি শোনালাম এবং হুজ্জত কায়েম হওয়া ও হুজ্জত অনুধাবনের মধ্যকার পার্থক্য বর্ণনা করলাম। অতঃপর বললাম, মুজাহিদের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলার পূর্বে এই মাসআলাগুলো দেখে নিবে। কিন্তু সে কোন ভ্রুক্ষেপ করলো না, সে কোন ভিত্তি ছাড়াই কতিপয় আলেমের তাকলিদ করে নিজের গোঁড়ামির উপর অটল থাকলো। তো কোন আলেমের অগ্রহণযোগ্য ফতোয়ার উপর এমন অটল থাকা বা এই জাতীয় আচরণক করাকেই বলে আলেমদের ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে ভাবা এবং তাদেরকে মাত্রাতিরিক্ত সম্মান করা।
অনেকে আল কায়েদার ব্যাপারে আপত্তি করে বলে যে, আল কায়েদা নাকি আলেমদের ভুল ধরে, নিন্দা করে। অথচ বাস্তবতা হলো আমরা (আল কায়েদা) আলেমদের সম্মান করতে ও তাদের পদস্খলন ও অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলোর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করতে আদিষ্ট।
হ্যাঁ, আমরা শুধু ঐ সকল আলেমদেরই সম্মান করতে আদিষ্ট যারা হলেন রাব্বানী বা হকপন্থী, যারা দীন ইসলামকে সাহায্য করে। আর যারা ইহুদী-খ্রিস্টান ও তাগুতদের পক্ষে ফতোয়া দেয়, মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও তাদের রক্ত প্রবাহিত করাকে বৈধ মনে করে- এমন আলেমদের বিরুদ্ধে কথা বলতে মুজাহিদদের কোন সমস্যা নেই।
সর্বোপরি, আমাদের মুজাহিদ ভাইদের উচিত আলেমদের সাথে মধ্যপন্থার আচরণ করা, তাদের বক্তব্যকে আমরা কোরআন-সুন্নাহর উপর প্রাধান্যও দিব না, আবার তাদের সাথে অসৌজন্যমূলক ও অসমীচীন আচরণও করব না। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ বলেন, কিছু লোকের বোধশক্তি এতোটাই সংকীর্ণ হয়ে গেছে যে, তারা আলেমদের কথা মোটেই গ্রহণ করে না এবং তার প্রতি ভ্রুক্ষেপও করে না। অন্য একদল লোক এক্ষেত্রে সীমালংঘন করে ফেলেছে। ফলে আলেমরা যা হালাল করেছে তাই হালার মনে করেছে, যা হারাম করেছে তাই হারাম মনে করেছে আর তাদের বক্তব্যকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্পষ্ট ও সহীহ সনদে সাব্যস্ত সুন্নতের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছে। (ইগাছাতুল লাহফান, ১/১১৭)
সুতরাং আপনি সতর্ক থাকুন। অনেক সময় হয়তো আপনি ভাববেন, আপনি আলেমদের সম্মান করছেন। অথচ বাস্তবে আপনি তাদের ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে ভাবছেন। বিষয়টি ভালোভাবে বোঝার জন্য ফতোয়া প্রদানকারীর প্রতি না তাকিয়ে কতিপয় ফতোয়ার প্রতি লক্ষ্য করুন এবং ফতোয়াগুলো আপনার সুস্থ বিবেকের সামনে উপস্থাপন করে সেক্ষেত্রে আপনার অবস্থান নির্ণয় করুন। ফতোয়াগুলো শায়খ ইউসুফ আল উয়াইরি রহ. এর গ্রন্থ ‘ক্রুসেড যুদ্ধের স্বরূপ’ থেকে নেয়া :
১. জামে আজহারের শায়খ সাইয়েদ তানতাভীর ফতোয়া : তাকে যখন ৯/১১ এর হামলা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো তখন মাজলুমের সাহায্যে আল আজহারের ভূমিকা বা অবস্থান কী জানতে চাওয়া হল। তিনি উত্তর দিলেন, ‘নিরাপদ ব্যক্তিদের উপর হামলা করা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের শামিল। যেমন নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের হামলাটি।’
তারপর যখন আফগানিস্তানের উপর সম্ভাব্য আক্রমণের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হল তখন তিনি ফতোয়া দিলেন, ‘প্রত্যেক রাষ্ট্রের উচিত অন্যায়কারীদের প্রতিরোধ করা। ইসলামের অবস্থান সর্বদা মাজলুমের সাথে এবং জুলুম, সন্ত্রাসবাদ ও সীমালঙ্ঘনের বিপরীতে। সুতরাং যেকোনো রাষ্ট্রের উপর জুলুম ও সীমালংঘন করা হলে আমরা মুসলিমরা তাদের পক্ষে থাকবো যাদের প্রতি জুলুম করা হচ্ছে, চাই তা আমেরিকা হোক বা অন্য কোনো রাষ্ট্র।’ তিনি এ বিষয়েও খুব গুরুত্বারোপ করেন যে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা হত্যাকাণ্ডে জড়িত কোন ব্যক্তি কে বিচারের কাঠগড়ায় তখনই দাঁড় করানো উচিত যখন তার অপরাধ অকাট্য প্রমাণের মাধ্যমে সাব্যস্ত হবে।
২. সৌদী বিচার বিভাগের প্রধান শায়খ সালিহ আল লুহাইদানের ১/৭/১৪২২হি. তারিখের ফতোয়া:
‘ভিন্নধর্মীদের সাথে সদ্ব্যবহার করা, মাজলুম ও নিপীড়িতদের সাহায্য করা ও কঠোর হাতে জালেমকে প্রতিহত করা জুলুম দমনের অন্যতম মাধ্যম।’ তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ঐ সকল হামলায় আক্রান্তদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি সদ্ব্যবহারের নামান্তর। তাছাড়া এটা আল্লাহর পথে দাওয়াতের একটি মাধ্যম এবং ইসলামের উৎকৃষ্ট চরিত্রের প্রমাণবাহক।’
নিউইয়র্ক ও অন্যান্য স্থানের হামলায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বেচ্ছায় রক্ত ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করার বৈধতা সম্পর্কে যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল তখন তিনি একটি হাদীস বললেন,
৩. শায়খ করযাভী আমেরিকার বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনাকে শরীয়তে হারাম বলে ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘আমরা সকল মুসলিমকে উদ্বুদ্ধ করছি যেন তারা আমেরিকার দুর্ঘটনা কবলিত নির্দোষ মানুষদের স্বেচ্ছায় রক্তদান করে।’
৪. রাবেতায়ে আলামে ইসলামীর ফতোয়া : ডক্টর আব্দুল মুহসিন তুর্কী ২৯/৬/১৪২২ হিজরীতে একটি ফতোয়া প্রকাশ করেন। তাতে তিনি আমেরিকায় সংঘটিত হামলাগুলোর কঠোর নিন্দা করেন এবং সেই হামলা ও হামলাকারীদের থেকে ইসলামের দায়মুক্তির ঘোষণা দেন। তিনি দীর্ঘ চাটুকারিতার আশ্রয় নেন। তিনি বলেন, ‘মুসলিম জনগণ যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। কারণ ইসলাম মুসলিমকে হত্যাকারী, হত্যা কাজের মাধ্যম কিংবা মানুষকে সন্ত্রস্ত করে বা কষ্ট দেয় এমন কাজে লিপ্ত হতে নিষেধ করে। কারণ এসব জুলুম ও অন্যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অতি দ্রুত বিদ্রোহ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা বন্ধের রাষ্ট্রীয় আইন কানুন কার্যকর করা উচিত।’
৫. অবশেষে সৌদির প্রসিদ্ধ মুফতি শায়খ আবদুল আজিজ আলে শায়খের ফতোয়া উল্লেখ করছি-
যুক্তরাষ্ট্রে যে বিস্ফোরণগুলো ঘটেছে, বিমান ছিনতাই, নিরাপদ জনগণের মনে ত্রাস সৃষ্টি ও অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা ও এই জাতীয় যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো অন্যায়, জুলুম ও বিদ্রোহের নামান্তর। এগুলো হারাম এবং কবীরা গুনাহ। তিনি এটাও খুব জোর দিয়ে বলেছেন যে, নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের যেসকল ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার কারণে শত শত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে সেগুলো এমন কাজ ইসলামী শরীয়ত যার অনুমোদন দেয় না এবং তা কোন দীনী কাজ নয় ও ইসলামী শরীয়তের মূল নীতির সাথে তা মিলে না।
( আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন : حقيقة الحروب الصليبية)
১৪. কারণ তারা মুহাক্কিক আলেমদের পথে চলে।
আকিদার কিতাব সমূহে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মানহাজ সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত আছে। আল্লাহর অনুগ্রহে আল কায়েদা আহলে সুন্নাহর বিজ্ঞ আলেমদের মানহাজের উপর প্রতিষ্ঠিত। আহলে সুন্নাহর আকিদা হল-
এক. আল্লাহর শরীয়ত বিরোধী আইন রচনা করা বিনা বাক্যে কুফর। মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন,
তিনি আরো বলেন,
আল্লামা শানকীতী রহ. বলেন, বিধান রচনায় আল্লাহ তাআলার সাথে কাউকে শরীক করা ইবাদতে শরীক করার মতোই আল্লাহ তাআলা তার বিধান দানের ক্ষমতার ব্যাপারে বলেন,
সাত কিরাতের মধ্য থেকে ইবনে আমেরের কিরাতে নাহি তথা নিষেধ বাচক শব্দ যোগে এসেছে: “আর তুমি বিধান রচনায় তার সাথে কাউকে শরীক করো না।” মহান আল্লাহ তাআলা ইবাদতের শিরকের ব্যাপারে বলেন,
সুতরাং এ উভয় প্রকার শিরকের ক্ষেত্রে সমান। (আদওআউল বায়ান ৭/৪৮)
তিনি আরো বলেন, উল্লিখিত নসসমূহের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, যারা শয়তান কর্তৃক তার বন্ধুদের মাধ্যমে রচিত আল্লাহর শরীয়ত বিরোধী বিধানের অনুসরণ করে তাদের কুফর ও শিরকের ব্যাপারে কেবল ওই ব্যক্তিই সন্দেহ করতে পারে যাকে আল্লাহ তাআলা অন্ধ বানিয়েছেন এবং ওহীর আলো থেকে বঞ্চিত করেছেন। (আদওআউল বায়ান, ৩/২৫৯)
আর আল কায়েদাও এক*ই মত পোষণ করে।
দুই. আহলে সুন্নাহের নিকট আল্লাহর বিধান ছাড়া ফয়সালা করা দুই প্রকার। প্রথম প্রকার: সামগ্রিকভাবে বিচারকার্য আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো বিধানাবলী দ্বারা পরিচালনা করা। এটা কুফরে আকবার তথা বড় কুফর। দ্বিতীয় প্রকার: নির্দিষ্ট কোন মুকাদ্দমায় আল্লাহর বিধান ব্যতীত অন্য কোন বিধান দ্বারা ফয়সালা করা। এটা কুফরে আসগর তথা ছোট কুফর। আর আল কায়েদাও এ কথারই প্রবক্তা।
তিন. মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফির-মুশরিকদের সাহায্য করা:
আহলে সুন্নাহর আকিদা মতে আল কায়েদা বিশ্বাস করে যে, এ কাজ কুফর। যেমনটি শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহহাব রাহি. ঈমান ভঙ্গের দশটি কারণ এর অধীনে আলোকপাত করেছেন। তিনি বলেন, (ঈমান ভঙ্গের) অষ্টম কারণ: মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের সহায়তা করা। এর দলিল হল নিম্নে বর্ণিত আল্লাহ তাআলার বাণী,
وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
তোমাদের মধ্যে যে তাদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানাবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। নিশ্চয় আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে হেদায়েত দান করেন না। (মাজমুউত তাওহীদ, ২৪)
চার. হুজ্জত কায়েম হওয়া :- এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল হুজ্জত কায়েম হওয়া এবং তা বোঝার মাঝে পার্থক্য রয়েছে। এছাড়া হুজ্জত কায়েম হওয়া কেবল অস্পষ্ট মাসআলার ক্ষেত্রে শর্ত। সুস্পষ্ট এবং অকাট্য বিষয়ে নয়। সাথে সাথে অন্যান্য শর্ত পূরণ হওয়া এবং প্রতিবন্ধকতা দূর হওয়াও বিবেচ্য বিষয়। আল কায়েদা উল্লিখিত নীতির আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যদি কেউ ইনসাফের দাবি করে সে যেন উক্ত মাসাআলায় শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. ও অন্যান্য ইমামদের বক্তব্য পড়ে নেয়। অতঃপর তাদের এবং আল কায়েদার মূলনীতির মাঝে সামাঞ্জস্যতা অনুধাবন করে: কারা বিচক্ষণ ও বিদগ্ধ ইমামদের মানহাজের অনুসরণে ধন্য হয়েছে? আল কায়েদা নাকি তারা, যারা বিধান রচনাকে ব্যাখ্যা সাপেক্ষ ভাবে এবং মনে করে, সামগ্রিকভাবে ও নির্দিষ্ট মুকাদ্দমায় আল্লাহর বিধান ছাড়া বিচারকার্য পরিচালনা করা একই রকম আর এ ক্ষেত্রে ইসতিহলাল (বৈধ ভাবা) ছাড়া কুফর*ও হবে না? আবার এই বৈধ ভাবাও কতকের নিকট সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তি ছাড়া জানা সম্ভব নয়!! কারা বিচক্ষণ ইমামদের মানহাজের অনুসারী; আল কায়েদা নাকি তারা, যারা বলে শাসকরা কুফরিতে লিপ্ত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু অজ্ঞতার ওজরের কারণে তাদেরকে তাকফির করা যাবে না। কেননা তাদের কাছে হুজ্জত পৌঁছেনি? মূলত তারা জানেই না, প্রকাশ্য বিষয়ে হুজ্জত কায়েম হওয়া শর্ত নয়। এটা কেবল অস্পষ্ট বিষয়ের ক্ষেত্রেই ধর্তব্য। পূর্বে এ বিষয়ে আমরা কতিপয় আলেমের বক্তব্য উল্লেখ করেছি। তারা এটাও জানে না, হুজ্জত কায়েমে*র অর্থ হচ্ছে হুজ্জত পৌঁছা কিংবা তা পৌঁছার ব্যবস্থা থাকা। যার কাছে পৌঁছাবে অথবা পৌঁছার সুযোগ থাকবে তার ওপরই হুজ্জত কায়েম হয়ে যাবে। তর্ক শাস্ত্রবিদদের প্রতিউত্তরে ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, রাসুলদের ব্যাপারে আল্লাহর হুজ্জত মূলত তাদের সম্পর্কে জ্ঞান লাভের সুযোগ থাকার দ্বারাই কায়েম হয়ে গেছে। এজন্যই মাদ*ঊদের ইলম শর্ত নয়। ফলে কুরআন মনোযোগ সহকারে শ্রবণ ও অনুধাবন থেকে কাফেরদের উপেক্ষা হুজ্জত কায়েমের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয় নি। এমনিভাবে নবীদের থেকে বর্ণিত নির্দেশনাবলী থেকে তাদের অনাগ্রহ হুজ্জত কায়েমের ক্ষেত্রে বাধা হয়নি। কেননা জ্ঞান লাভের সুযোগ বিদ্যমান রয়েছে। (অররদ্দু আলাল মানতিকীয়ীন, ৯৯)
তিনি আরো বলেন, যদি কেউ তার বার্তায় সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ সংগঠিত হওয়ার সংবাদ দেয় তখন সেই আদেশ ও নিষেধ পৃথিবীর সকল ব্যক্তির নিকট পৌঁছা আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার সংঘটিত হওয়ার শর্ত বলে গণ্য হয় না। স্বয়ং রিসালাতে নববীর ক্ষেত্রে যখন এটা শর্ত নয় তখন কিভাবে সেটা তার আনুষাঙ্গিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে শর্ত হবে। বরং তার নিকট পৌঁছা সম্ভব থাকাই শর্ত। এরপর যদি তারা অবহেলা করে এবং সেই বার্তা তাদের নিকট পৌঁছার চেষ্টা না করে তাহলে এর দায়ভার মুকাল্লাফদের উপর বর্তাবে; দায়ীর উপর নয়। (মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড: ২৮, পৃ. ১২৫-১২৬)
শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব রহ. বলেন, শাইখুল ইসলামের যে বক্তব্য তোমরা উল্লেখ করেছ ‘যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে এবং তার উপর হুজ্জত কায়েম হবে’ এবং এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তোমরা বর্তমান তাগুত ও তাদের অনুসারীদের ব্যাপারে সন্দিহান যে, তাদের উপর হুজ্জত কায়েম হয়েছে কিনা- এটা আশ্চর্যের বিষয়! তোমরা কিভাবে এ ব্যাপারে সন্দেহ করো অথচ আমি বারবার তা সুস্পষ্ট করে দিয়েছি। শোন, নতুন ইসলাম গ্রহণ করলে কিংবা সদূর মরুতে বসবাসকারী হলে অথবা আলোচ্য বিষয়টি অস্পষ্ট হলে তবেই হুজ্জত কায়েমের প্রশ্ন আসবে। সে অস্পষ্ট মাসালা না জানা পর্যন্ত তাকে তাকফির করা হবে না। কিন্তু দীনের যে সব মৌলিক বিষয় মহান আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করে দিয়েছেন এবং তাঁর পবিত্র কিতাবে বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন সে সব বিষয়ে কোরআন*ই হুজ্জত। সুতরাং যার কাছে কোরআন পৌঁছেছে তার কাছে হুজ্জত* ও পৌঁছে গেছে। আসল কথা হচ্ছে তোমরা হুজ্জত কায়েম হওয়া আর তা বোঝার মাঝে পার্থক্য করতে পার না। দেখ, অধিকাংশ কাফের এবং মুনাফিক আল্লাহর হুজ্জত বোঝেনা। কিন্তু তাদের উপর সেই হুজ্জত ঠিকই কায়েম হয়ে গেছে। যেমন মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
হুজ্জত কায়েম হওয়া এবং পৌঁছা ভিন্ন বিষয় যা এদের ব্যাপারে বাস্তবায়িত হয়েছে আর হুজ্জত বোঝা ভিন্ন বিষয়। (মুআল্লাফাতুশ শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব, পৃ. ২৪৪)
সুতরাং বর্তমান শাসক শ্রেণীর কাছে কি হুজ্জত পৌঁছেনি? তারা কি হুজ্জত জানতে সক্ষম নয়? হুজ্জত কি শরীয়ত পরিবর্তন ও ইহুদী-খ্রিস্টানদের সাহায্য করার মতো অকাট্য বিষয়গুলোতেও শর্ত, নাকি এটা বোঝা শর্ত যে, আল কায়েদা হকের উপর আছে? আল কায়েদা হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার বিষয়টি তাদের বুঝে আসা শর্ত নয়। যে এমন শর্ত করল সে যেন হুজ্জত ‘বোঝা’কে শর্ত করল। দুয়ের মধ্যকার পার্থক্য একটু আগে আলোচনা করা হয়েছে।
হে মুমিন ভাই, উক্ত মাসআলায় আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামদের বক্তব্য সামনে রাখুন। অতঃপুর মিলিয়ে দেখুন যে, আল কায়েদা কি তাদের মূলনীতি বিরোধী নাকি না!
তাছাড়া শাখাগত বিষয়ে মতবিরোধের সুযোগও রয়েছে।
এখন আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই,
(১) আল কায়েদার কারো শাখাগত বিষয়ের ভুলকে আপনি কি মৌলিক বিষয়ে ভুলের মতো ভাববেন?
(২) বলা হয়, যেহেতু তোমরা শাখাগত বিষয়ে মতবিরোধের সুযোগ আছে বলে মনে কর তাহলে কেন সেসব আলেমদের ঘৃণা কর যারা শাসকদের তাকফীর করে না?
আমরা বলব, এটি একটি যুক্তিসঙ্গত আপত্তি এবং এর সমাধান হওয়া জরুরি। যেসকল আলেম শাসকদের তাকফীর করে না আল কায়েদা তাদের সবাইকে ঘৃণা করে না; বরং তাদের নিকট যারা তাকফীর করে না তারা দুভাগে বিভক্ত-
(ক) রাজদরবার থেকে দূরে থাকা আলেমগণ। তারা শাসকশ্রেণী থেকে দূরে থাকে। তারা নিজস্ব ইজতিহাদের মাধ্যমে তাকফীর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে নি এবং তারা মুজাহিদদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয় না। এ শ্রেণীর উলামায়ে কেরাম আল কায়েদার নিকট সম্মানিত। তাদের ইজতিহাদের সুযোগ রয়েছে।
(খ) যেসব আলেম শাসকদের তাকফীর করে না এবং মুজাহিদের বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করে। তারা মুজাহিদদের পথভ্রষ্ট বলে আখ্যায়িত করে এবং তাগুতদের প্রশংসা করে। আলেমদের এ শ্রেণীর ব্যাপারে আল কায়েদা সতর্ক করে থাকে। কারণ তাদের মাধ্যমে উম্মাহ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আর কায়েদা বিচক্ষণ আলেমদের পথের পথিক। তাদের পন্থা হল- শর্ত পূরণ এবং প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের সাথে সাথে (যখন প্রয়োজন হয়) কুফর ও কাফেরদের থেকে সম্পর্ক ত্যাগ করা। কুফরি থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করল কিন্তু কাফেরদের থেকে করল না-এটা আলেমদের পথ নয়। সুতরাং হে ঐ সমস্ত ভাই, যারা শাখাগত বিষয়ে আল কায়েদার ব্যাপারে বিদ্বেষ পোষণ করো! ইতিহাসে কি এমন সময় যায়নি যখন উলামায়ে কেরাম উপযুক্ত ব্যক্তিদের কুফরীর হুকুম দিয়েছেন। শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রহ. বলেন, তাকফির ও কিতালের মাসআলায় সত্যান্বেষীদের জন্য আপত্তি নিরসনে সবচেয়ে বড় ঘটনা হল যাকাত অস্বীকার কারীদের বিরুদ্ধে কিতালের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামদের ইজমা’ সংগঠিত হওয়া, তাদেরকে মুরতাদ ঘোষণা করা এবং তাদের সন্তানদের বন্দি করা। ইসলামী ইতিহাসে এটাই সর্বপ্রথম কিতাল যা মুসলিম দাবিদারদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম থেকে আমাদের যুগ পর্যন্ত আলেমদের থেকে প্রকাশিত ঘটনাবলীর মধ্যে এটাই সবচেয়ে সুস্পষ্ট ঘটনা। ইমাম আবুল ওয়াফা ইবনে আকিল রহ. বলেন, জাহেল ও ইতর শ্রেণীর জন্য যখন শরীয়তের আদেশাবলী কঠিনসাধ্য হয় তখন তারা শরীয়তের বিধান থেকে সরে আসে এবং নিজেদের রচিত জীবনব্যবস্থার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। ফলে তা তাদের জন্য সহজবোধ্য হয়ভ কেননা এখন তারা অন্যের বিধানের অধীনস্থ হয়নি। এভাবে বিধান রচনার কারণে তারা আমার নিকট কাফের হিসেবে বিবেচিত হবে। যেমন কবরকে সম্মান করা, মৃত ব্যক্তির কাছে প্রয়োজন পূরণের কামনা করা, লাত ও উজ্জাতের পূজারীদের অনুসরণ করা। (মুফিদুল মুস্তাফিদ ফী কুফরী তারিকিত তাওহীদ, ২৬)
এখানে আমাদের উদ্দিষ্ট স্থান হল- ‘এভাবে বিধান রচনার দরুন তারা আমার নিকট কাফের্’
ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহ. কবর পূজাকে অস্বীকার করতে গিয়ে বলেন, এই মুশরিকরা এই পর্যন্ত পৌঁছেছে যে, তাদের মাঝে কিছু সীমালঙ্ঘনকারী উক্ত বিষয়ে কিতাব সংকলন করেছে যার নাম দিয়েছে ‘মানাসিকুল মাশাহিদ’। প্রকাশ থাকে যে তাদের এই কাজ ইসলামকে ত্যাগ এবং মূর্তিপূজার ধর্মে প্রবেশের নামান্তর (ইগাছাতুল লাহফান, ১/১৯৭)
এখানে ইবনুল কায়্যিম রহ. ইবনুল মুফীদ নামক এক ব্যক্তির কথা আলোচনা করেছেন। আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন, তার বক্তব্য কতটা সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট ছিল। সুতরাং তাকফীরে মুআইয়ান বা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের তাকফীরকে কিভাবে অস্বীকার করা যায়? আমরা তাকফীরের ক্ষেত্রে ইমামদের কিছু বক্তব্য তুলে ধরছি-
হানাফী
এক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য অত্যন্ত কঠোর। এমনকি তারা মুসাইহিফ, মুসাইজিদ বলা ও ওজু ছাড়া নামাজ পড়ার ক্ষেত্রেও তাকফিরে মুআইয়ান করে থাকে। আন নাহরুল ফা*ইক গ্রন্থে উল্লেখ আছে, শায়খ কাশেম শরহে দুরারিল বিহারে বলেন, সাধারণ মানুষ যেসব মান্নত করে থাকে যেমন- সৎ মানুষদের কবরে এসে ডাকা যে, হে সম্মানিত, যদি আমি হারানো বস্তু ফিরে পাই কিংবা আমার রোগ ভালো হয়ে যায় তাহলে আমি আপনার জন্য স্বর্ণ-রূপা, মোমবাতি, তেল ইত্যাদি দান করব। বেশ কিছু কারণে এসব মান্নত সকলের ঐক্যমতে বাতিল..... একটি কারণ হচ্ছে এই ধারণা করা যে, মৃত ব্যক্তি কার্য সম্পাদন করতে পারে। এই বিশ্বাস কুফর।....মানুষ এতে ব্যাপকভাবে লিপ্ত হয়েছে। বিশেষ করে শাইখ আহমদ আল বাদাভীর জন্মের ক্ষেত্রে।
লক্ষ্য করুন, এখানে মানুষ ব্যপকভাবে তাতে লিপ্ত হলেও স্পষ্টভাবে তাকফীর করেছে।
আবুল আব্বাস রহ. বলেন, ইবনুল খুদাইরী তার পিতা শায়খ খুদাইর _যিনি সে যুগে হানাফী মাযহাবের ইমাম ছিলেন_তার থেকে বর্ণনা করেন, ‘ইবনে সিনার ব্যাপারে বুখারার ফুক্বাহায়ে কেরামের বক্তব্য ছিল- সে বুদ্ধিমান কাফের।’ ইবনে সিনাকে বোখারার ফুকাহায়ে কেরামের পক্ষ থেকে তাকফীরের ঘটনা সে যুগের হানাফী মাযহাবের ইমাম বর্ণনা করেছেন অথচ ইবনে সিনা এমন ব্যক্তি ছিলেন যিনি মুসলমান হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। এটা ছিল তাকফীরে মুয়াইয়ান।
মালেকী
তাকফিরের ব্যাপারে মালেকীদের বক্তব্য তো আরো সুস্পষ্ট ও অগণিত। মালেকী ফুকাহাদের ব্যাপারে প্রসিদ্ধ যে, তারা সেই ব্যক্তিকেও অতিদ্রুত হত্যার ফতোয়া দিতেন যে এমন বাক্য উচ্চারণ করত মানুষ যা বোঝে না। কাজী ইয়ায রহ. “আশ-শিফা” গ্রন্থের শেষে এমন বেশ কিছু ফতোয়া উল্লেখ করেছেন। যেমন তিনি বর্ণনা করেছেন যে ব্যক্তি সম্মানার্থে গাইরুল্লাহর নামে কসম করবে সে কাফের হয়ে যাবে। অথচ এসব বিষয় আমাদের তাকফীরের কারণগুলোর চেয়েও নিম্নতর ও সামান্যতম।
শাফেয়ী
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. শরহুল আরবাঈন গ্রন্থে ইবনে আব্বাস রা. এর হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, اذا سالت فاسال الله ‘তুমি কিছু চাইলে আল্লাহর কাছেই চাও’- এর মর্মকথা হল- যে গাইরুল্লাহর কাছে চাইবে, তাকে ডাকবে সে কাফের। (আল বালাগুল মুবীন, ১/২২৫)
এমনকি তিনি এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র গ্রন্থ*ই রচনা করেছেন, যার নাম হল الإعلام بقواطع الإسلام সেখানে তিনি এমন কিছু কথা ও কর্মের বর্ণনা দিয়েছেন যার কারণে ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় এবং তাকফীরে মুআইয়ানের উপযুক্ত হয়ে যায়। অথচ সেগুলো গুরুত্বের বিচারে আমাদের আলোচিত বিষয়ের (হাকিমিয়্যাহ, আল ওয়ালা ওয়াল বারা, মুযাহারা) দশ ভাগের এক ভাগেরও সমান হবে না। এ ব্যাপারে ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, তাকফিরের ব্যাপারে আপত্তি দূর করতে এবং বিশ্বাস দৃঢ় করতে সবচেয়ে শক্তিশালী বিষয় হল আহলে ইসলামের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের পরবর্তী উলামায়ে একরামের বিভিন্ন আচরণ। যেমন বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বারাআ রা.কে পতাকাসহ এক ব্যক্তির কাছে পাঠালেন _যে নিজ পিতার স্ত্রীকে বিবাহ করেছে_ যেন তিনি তাকে হত্যা করেন এবং তার সম্পদ নিয়ে নেন। এমনিভাবে বনু মুস্তালিকের বিরুদ্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুদ্ধের অভিপ্রায়। কারণ তাদের বিরুদ্ধে যাকাত প্রদানের অস্বীকৃতির অভিযোগ ছিল। অনুরূপ যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারীদের বিরুদ্ধে আবু বকর সিদ্দিক রা. ও সাহাবাদের কিতাল, তাদের সন্তানদের বন্দি করা, তাদের সম্পদ গনীমত হিসেবে গ্রহণ করা এবং তাদেরকে মুরতাদ ঘোষণা দেয়া।
এমনিভাবে ওমর রা. এই যুগে কুদামাহ ইবনে মায*ঊন ও তার সাথীদের তাকফীরের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা। কারণ তারা নিম্নোক্ত আয়াতের আলোকে বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য মদের বৈধতা সাব্যস্ত করেছিল। আয়াত-
এরপর হযরত ওসমান রা. এর জামানায় ওইসব আহলে মসজিদের তাকফীরের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা যারা শুধুমাত্র মুসাইলামাতুল কাজ্জাবের নবুওয়াতের ব্যাপারে কথা বলতো কিন্তু তার অনুসরণ করত না সাহাবায়ে কেরাম শুধুমাত্র তাদের তওবা কবুলের ক্ষেত্রে মতানৈক্য করেছিলেন। (তাকফিরের ব্যাপারে নয়।)
এমনিভাবে আলী রা. কর্তৃক তার সাথীদের আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া। কারণ তারা আলী রা. এর ব্যাপারে সীমালংঘন করেছিল।
পরবর্তীতে মুখতার ইবনে আবু ওবায়দা এবং তার অনুসারীদের কুফরের ব্যাপারে বাকি সাহাবীদের সাথে তাবেঈনদের ইজমা। যদিও সে দাবি করত যে, সে হুসাইন ও আহলে বাইতের রক্তের মূল্য চায়।
অনুরূপ জা’দ ইবনে দিরহামকে হত্যার ব্যাপারে তাবেঈনদের ইজমা। অথচ সে ভালো আলেম ও প্রসিদ্ধ দীনদার ছিল। এ ধরনের বহু ঘটনা ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়।
পূর্ববর্তী পরবর্তী কেউই তো আবু বক্কর ও অন্যান্যদের ব্যাপারে এমন মন্তব্য করেননি যে, কিভাবে আপনি বনু হানিফের সাথে জিহাদ করবেন, তারা তো কালিমা পড়ে, নামাজ পড়ে, যাকাত দেয়?! এমনিভাবে কুদামা ও তার সাথীরা যখন তাওবা করে নি তখন তাদের তাকফীরের ব্যাপারে কেউ আপত্তি করেনি!
এরপর বনু ওবায়দা যারা পাশ্চাত্য মিশর ও শামসহ একাধিক অঞ্চলে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল তারা প্রকাশ্যে ইসলাম পালন করত, জুমার নামাজ* ও জামাত কায়েম করতো, কাজী ও মুফতি নিয়োগ করতো; তথাপি যখন তারা জঘন্য সব কথাবার্তা ও কাজকর্ম প্রকাশ করেছিল তখন কোন আলেম তাদের সাথে কিতালের ব্যাপারে কোন আপত্তি করেনি। এমনকি তারা বিরত*ও থাকে নি। অথচ সে যুগে ছিল ইবনুল জাওযীর মতো ব্যক্তিবর্গ। তাদের থেকে মিশর দখল করার পর ইবনুল জাওযী একটি কিতাবে লিখেন, যার নাম ছিল النصر على مصر (মিসর বিজয়।) পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কেউই উক্ত কিতাব প্রত্যাখ্যান করেননি। তাদের ইসলামের দাবী, কালিমা পাঠ কিংবা ইসলামের কিছু রুকন পালনের দরুন কোন আপত্তিও আসেনি। কেবলমাত্র বর্তমান যুগের কতিপয় অভিশপ্ত শয়তান থেকে শোনা যাচ্ছে যে, এসব কুফর ঠিকই। কিন্তু যে ব্যক্তি তা সম্পাদন করবে কিংবা ভালো মনে করবে বা তার সাথী হবে বা তাওহীদকে ঘৃণা করবে অথবা তাওহীদবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে তাওহীদের কারণেই বা তাদেরকে ঘৃণা করবে তাকে তাকফির করা যাবে না। কারণ সে কালিমা পাঠ করে, ইসলামের পাঁচ রুকন আদায় করে। এ ব্যাপারে দলীল হিসেবে বলে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটাকেই ইসলাম বলেছেন। এমন জঘন্য কথা বর্তমান যুগের মুলহিদ কাফের ছাড়া অন্য কারো থেকে শোনা যায় না। যদি তারা এ ব্যাপারে আলেমদের থেকে একটি অক্ষরও কিংবা একজনকেও দেখাতে পারে যার মাধ্যমে তারা নিজেদের অসার দাবির দলিল দাঁড় করাতে পারে তাহলে সেটা তারা উল্লেখ করুক। (মুফিদুল মুস্তাফিদ ফী কুফরি তারিকিত তাওহীদ, পৃ. ৩৬)
শায়খ নাসির আল ফাহাদ (ফাক্কাল্লাহু আসরাহু) এমন ১৪ টি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন যেখানে উলামায়ে কেরাম মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সহযোগিতা কারীকে তাকফীর করেছেন।
মূলত ঘটনা এই দাঁড়ালো যে- খারেজী আদর্শকে খণ্ডনের জন্য ইরজার চেতনা প্রতিষ্ঠা লাভ করলো। অর্থাৎ এক বিদআতের মোকাবেলায় আরেক বিদআত দাঁড়িয়ে গেল। আর আহলে সুন্নাহ মুরজিয়া ও খারেজীদের মধ্যবর্তী পথ ঈমানকেই অবলম্বন করল।
সুতরাং হে আল্লাহর বান্দা, তুমি সতর্ক হও। তোমার আবেগ যেন দীনের বিরুদ্ধে না যায়, যার ফলশ্রুতিতে তুমি উপযুক্ত ও যথার্থ তাকফীরের বিরুদ্ধে লড়ছ আর তুমি তা অনুভব*ই করতে পারছ না! এমন কি তুমি মানুষের সামনে কুফরকে সামান্য করে তুলছো ফলে তারা কুফরের কদর্যতায় লিপ্ত হচ্ছে আর সেটাকে কুফর না ভেবে শুধু গুনাহ মনে করছে।
হে আল্লাহর বান্দা, তুমি মুরজিয়াদের মাযহাব প্রচারে সতর্ক হও! এমন যেন না হয় যে, তুমি মুরজিয়াদের মাযহাব প্রচার করছো আর তুমি মনে করছ আমি আহলে সুন্নাহর মাযহাব প্রচার করছি।
নাযর ইবনে শামীল রহ. বলেন, আমি খলীফা মামুনের দরবারে গেলাম। খলীফা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো? আমি বললাম, ভালো আছি আমিরুল মুমিনিন! অতঃপর আমাকে বললেন, তুমি কি জানো ইরজা কাকে বলে? আমি বললাম, ইরজা হল এমন দীন যা বাদশাহর অনুগামী হয়, যা দ্বারা তারা দুনিয়া অর্জন করে আর আখেরাত ধ্বংস করে। তিনি বললেন, সত্য বলেছ। (তারিখু মাদিনাতি দিমাশক, ৩৩/২৮৬)
অন্য জায়গায় আছে, নজর ইবনে শামীল রহ. বলেন, খলিফা মামুন আমাকে বললেন হে আবুল হাসান, ইরজা হলো রাজা-বাদশাদের ধর্ম।
আলহামদুলিল্লাহ- আকিদাগত বিষয়গুলোতে আল কায়েদা আহলে সুন্নাহর মানহাজের উপর রয়েছে। বিশেষ করে ঈমান, আসমা ও সিফাত, তাকদীর, কোরআন ও সাহাবা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে তারা আহলে সুন্নাহর মানহাজ অনুসরণ করে।
তুমি কি দেখেছ কুফর নয় এমন পাপের কারণে আল কায়েদা কাউকে তাকফীর করেছে? তারা কি যিনাকারী হত্যাকারীর মত অন্যান্য পাপাচারীদের ব্যাপারে আহলে সুন্নাহর আকীদা পোষণ করে না? মুসলিমদের হত্যা করা আর মূর্তি পূজারীদের ছেড়ে দেয়া কি খারেজীদের বৈশিষ্ট্য নয়? বর্তমানে আল কায়েদাই সবচেয়ে বড় জিহাদী তানজীম যারা মূর্তি পূজারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে। মাথা মুণ্ডানো কি খারেজীদের বৈশিষ্ট্য নয়? অথচ আল কায়েদার অধিকাংশই লম্বা চুলে অভ্যস্ত।
১৫. যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট হাদীস সমূহের কারণে
যুদ্ধসংশ্লিষ্ট হাদিস সমূহে তিনটি স্থানের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে:
১. শাম।
২. খোরাসান।
৩. আদনে আবীন।
আব্দুল্লাহ ইবনে হাওয়ালাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“পরিস্থিতি তার কাজের ধারা অনুযায়ী চলতে থাকবে যতক্ষণ না তোমরা তিনটি বাহিনীতে পরিণত হও :
একটি বাহিনী শামের,
একটি বাহিনী ইয়েমেনের
আর আরেকটি ইরাকের।”
ইবনে হাওয়ালাহ (রা.) বললেনঃ ‘হে আল্লাহর রাসুল, যদি আমি সেই দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকি তবে আমার জন্য একটি বাহিনী নির্ধারণ করে দিন।’
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন,“তোমার শামে যাওয়া উচিত হবে, কারণ এটি আল্লাহর শেষ্ঠ জমীন এবং তাঁর শ্রেষ্ঠ বান্দারাই সেখানে জড়ো হবে! আর যদি তুমি তা না চাও তবে তোমার ইয়ামানে যাওয়া উচিত এবং সেখানকার কূপ থেকে পানি পান করা উচিত। কারণ আল্লাহ আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি সিরিয়া এবং তার মানুষের উপর খেয়াল রাখবেন!” (ইমাম আহমদ ৪/১১০, আবু দাউদ ২৪৮৩)
এই স্থানগুলোর আজকের অবস্থাকে দুই দশক পূর্বেকার অবস্থার সাথে তুলনা করলে পুরোই ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এই দেশগুলোর অবস্থা ক্রমেই উন্নতির দিকে যাচ্ছে। শাম বিশ বছর পূর্বেও বর্তমানের তুলনায় দীন থেকে অনেক দূরে ছিল। খোরাসান ছিল সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় শাসিত। আদনে আবীনের অবস্থাও একই রকম ছিল। কিন্তু এখন আল্লাহর রহমতে খোরাসানে আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় জিহাদী দুর্গটির অবস্থান। শামেও চলছে জিহাদী বিপ্লব। আদনে আবীনেও শুরু হয়েছে ইসলামী জাগরণ। অচিরেই ইনশাআল্লাহ এসকল স্থানে মুজাহিদগণের হাতে ইসলামের অনেক বিজয় সূচিত হবে।
উল্লিখিত স্থানসমূহে আল কায়েদার রয়েছে সরব উপস্থিতি। খোরাসান তো আল কায়েদার কেন্দ্রভূমি এবং শায়খ উসামা বিন লাদেন রহ. সেখানেই আছেন। আদনে আবীনে সবচেয়ে বড় জিহাদী যে সংগঠনটি কাজ করে যাচ্ছে তা হলো আল কায়েদা। শামেও আল কায়েদার অনেক শাখা রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে গাজায় তাদের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হবে ইনশাআল্লাহ।
সুতরাং এসব স্থানে বিজয়ের শুভ লক্ষণ প্রতিভাত এবং জিহাদের ঝাণ্ডা উত্তোলনের কারণে ইসলামের বিজয় অত্যাসন্ন।
পরবর্তী পর্বগুলোও শীঘ্রই দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ…. নেক দুআয় ভুলবেন না….
মূল
শায়খ আবু মুসআব মুহাম্মদ উমায়ের আল কালাবী আল আওলাকী রহ.
ভাষান্তর
আবু হামযা আল হিন্দী
১৩. কারণ তারা আলেমদের যথাযোগ্য সম্মান করে, তবে তাদেরকে একেবারে নিষ্পাপ মনে করে না।
কেউ বলতে পারে, আপনি আল কায়েদার অতিরিক্ত প্রশংসা করছেন! আমি বলব, আমি যা সত্য বলে বিশ্বাস করি তাই লিখি। বাস্তবতা এটাই যে, আমি দেখেছি তারা আলেমদের ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে না ভেবে যথাযোগ্য সম্মান করে অর্থাৎ আলেমদের সম্মান করতে গিয়ে তাদের ভুলের ঊর্ধ্বে ভাবে না এবং নিষ্পাপ মনে করে না, বরং এতদুভয়ের মাঝে পার্থক্য করে।
এখানে আরেকটি কথা বলা সঙ্গত মনে করছি। বাস্তবতা ও তাত্ত্বিকতার মাঝে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। অনেক ছাত্রই একটা মূলনীতি নিয়ে তত্ত্বগত আলোচনা খুব করে, কিন্তু বাস্তবে তার পুরো বিপরীত কাজ করে। যেমন একটি প্রসিদ্ধ মূলনীতি হল,
الحق لا يعرف بالرجال و لكن الرجال يعرفون بالحق، فاعرف الحق تعرف أهله.
‘ব্যক্তির দ্বারা সত্যকে চেনা যায় না, সত্যের মাধ্যমেই ব্যক্তির অবস্থান নির্ণীত হয়। সুতরাং তুমি সত্যকে চেনো তাহলেই সত্যপন্থীকে চিনতে পারবে।’এটি ছাত্রদের মাঝে প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ একটি মূলনীতি। কিন্তু বাস্তবে কত ছাত্র যে এর বিপরীত কাজ করে তার ইয়ত্তা নেই! যার ফলে দেখা যায় অনেক ছাত্র জিহাদ ও আকীদা সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা নিয়ে কথা বলে আর সে মনে করে, এটা সে দলীলের আলোকে জেনেছে। অথচ বাস্তবে সেটা অন্যের মুখ থেকে জানতে পেরেছে। অনেক সময় সে মুজাহিদদের ব্যাপারে অনেক কঠিন কঠিন কথা বলে। অথচ সে ভালোভাবে না বুঝেই এসব বিষয়ে কথা বলছে। উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনা উল্লেখ করছি, জিহাদবিরোধী চিন্তাধারী এক ছাত্রের সাথে ইলমী তর্ক-বিতর্ক করছিলাম। সে জিহাদী মানহাজের ব্যাপারে কুৎসা রটাচ্ছিলো এবং খুব নিন্দা করছিল। সে যুবকদের সতর্ক করছিল এবং সর্বশক্তি ব্যয় করে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করছিলো। সে দুঃসাহসিকতার সাথে এসব বলে যাচ্ছিল। তখন আমি তাকে কাফেরদের সাহায্য করার বিধান সম্পর্কে প্রশ্ন করে বসলাম। সে উত্তর দিলো, সাহায্যকারী কখনও বাধ্য হয়ে কিংবা তাবিল বা ব্যাখ্যা করে সাহায্য করে থাকে। তখন আমি তার কথা মেনে নিয়ে বললাম যদি সে বাধ্য কিংবা তাবিলকারী না হয়? তখন সে কোনো জবাব দিতে পারল না! আমি বললাম, তুমি এই মাসআলাটাই জানো না! তাহলে কেন মুজাহিদদের নামে কুৎসা রটাচ্ছো? মুজাহিদগণ যেসব মূলনীতি অনুসরণ করে থাকে তুমি তো তা বোঝো না! তখন সে বলল, তাদের বিরুদ্ধে কি হুজ্জত কায়েম হয়েছে? আমি বললাম, হুজ্জত কায়েম হওয়ার মানে কী? সে বলল, কোন গ্রহণযোগ্য আলেম এ ব্যাপারে ফতোয়া দেয়া ও এজাতীয় আরো কিছু কথা বলল। তখন আমি তাকে বললাম, তুমি তো দেখি হুজ্জত কায়েম হওয়ার মানেই বোঝ না! অতঃপর আমি তাকে এ বিষয়ে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্যটি শোনালাম এবং হুজ্জত কায়েম হওয়া ও হুজ্জত অনুধাবনের মধ্যকার পার্থক্য বর্ণনা করলাম। অতঃপর বললাম, মুজাহিদের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলার পূর্বে এই মাসআলাগুলো দেখে নিবে। কিন্তু সে কোন ভ্রুক্ষেপ করলো না, সে কোন ভিত্তি ছাড়াই কতিপয় আলেমের তাকলিদ করে নিজের গোঁড়ামির উপর অটল থাকলো। তো কোন আলেমের অগ্রহণযোগ্য ফতোয়ার উপর এমন অটল থাকা বা এই জাতীয় আচরণক করাকেই বলে আলেমদের ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে ভাবা এবং তাদেরকে মাত্রাতিরিক্ত সম্মান করা।
অনেকে আল কায়েদার ব্যাপারে আপত্তি করে বলে যে, আল কায়েদা নাকি আলেমদের ভুল ধরে, নিন্দা করে। অথচ বাস্তবতা হলো আমরা (আল কায়েদা) আলেমদের সম্মান করতে ও তাদের পদস্খলন ও অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলোর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করতে আদিষ্ট।
হ্যাঁ, আমরা শুধু ঐ সকল আলেমদেরই সম্মান করতে আদিষ্ট যারা হলেন রাব্বানী বা হকপন্থী, যারা দীন ইসলামকে সাহায্য করে। আর যারা ইহুদী-খ্রিস্টান ও তাগুতদের পক্ষে ফতোয়া দেয়, মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও তাদের রক্ত প্রবাহিত করাকে বৈধ মনে করে- এমন আলেমদের বিরুদ্ধে কথা বলতে মুজাহিদদের কোন সমস্যা নেই।
সর্বোপরি, আমাদের মুজাহিদ ভাইদের উচিত আলেমদের সাথে মধ্যপন্থার আচরণ করা, তাদের বক্তব্যকে আমরা কোরআন-সুন্নাহর উপর প্রাধান্যও দিব না, আবার তাদের সাথে অসৌজন্যমূলক ও অসমীচীন আচরণও করব না। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ বলেন, কিছু লোকের বোধশক্তি এতোটাই সংকীর্ণ হয়ে গেছে যে, তারা আলেমদের কথা মোটেই গ্রহণ করে না এবং তার প্রতি ভ্রুক্ষেপও করে না। অন্য একদল লোক এক্ষেত্রে সীমালংঘন করে ফেলেছে। ফলে আলেমরা যা হালাল করেছে তাই হালার মনে করেছে, যা হারাম করেছে তাই হারাম মনে করেছে আর তাদের বক্তব্যকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্পষ্ট ও সহীহ সনদে সাব্যস্ত সুন্নতের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছে। (ইগাছাতুল লাহফান, ১/১১৭)
সুতরাং আপনি সতর্ক থাকুন। অনেক সময় হয়তো আপনি ভাববেন, আপনি আলেমদের সম্মান করছেন। অথচ বাস্তবে আপনি তাদের ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে ভাবছেন। বিষয়টি ভালোভাবে বোঝার জন্য ফতোয়া প্রদানকারীর প্রতি না তাকিয়ে কতিপয় ফতোয়ার প্রতি লক্ষ্য করুন এবং ফতোয়াগুলো আপনার সুস্থ বিবেকের সামনে উপস্থাপন করে সেক্ষেত্রে আপনার অবস্থান নির্ণয় করুন। ফতোয়াগুলো শায়খ ইউসুফ আল উয়াইরি রহ. এর গ্রন্থ ‘ক্রুসেড যুদ্ধের স্বরূপ’ থেকে নেয়া :
১. জামে আজহারের শায়খ সাইয়েদ তানতাভীর ফতোয়া : তাকে যখন ৯/১১ এর হামলা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো তখন মাজলুমের সাহায্যে আল আজহারের ভূমিকা বা অবস্থান কী জানতে চাওয়া হল। তিনি উত্তর দিলেন, ‘নিরাপদ ব্যক্তিদের উপর হামলা করা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের শামিল। যেমন নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের হামলাটি।’
তারপর যখন আফগানিস্তানের উপর সম্ভাব্য আক্রমণের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হল তখন তিনি ফতোয়া দিলেন, ‘প্রত্যেক রাষ্ট্রের উচিত অন্যায়কারীদের প্রতিরোধ করা। ইসলামের অবস্থান সর্বদা মাজলুমের সাথে এবং জুলুম, সন্ত্রাসবাদ ও সীমালঙ্ঘনের বিপরীতে। সুতরাং যেকোনো রাষ্ট্রের উপর জুলুম ও সীমালংঘন করা হলে আমরা মুসলিমরা তাদের পক্ষে থাকবো যাদের প্রতি জুলুম করা হচ্ছে, চাই তা আমেরিকা হোক বা অন্য কোনো রাষ্ট্র।’ তিনি এ বিষয়েও খুব গুরুত্বারোপ করেন যে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা হত্যাকাণ্ডে জড়িত কোন ব্যক্তি কে বিচারের কাঠগড়ায় তখনই দাঁড় করানো উচিত যখন তার অপরাধ অকাট্য প্রমাণের মাধ্যমে সাব্যস্ত হবে।
২. সৌদী বিচার বিভাগের প্রধান শায়খ সালিহ আল লুহাইদানের ১/৭/১৪২২হি. তারিখের ফতোয়া:
‘ভিন্নধর্মীদের সাথে সদ্ব্যবহার করা, মাজলুম ও নিপীড়িতদের সাহায্য করা ও কঠোর হাতে জালেমকে প্রতিহত করা জুলুম দমনের অন্যতম মাধ্যম।’ তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ঐ সকল হামলায় আক্রান্তদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি সদ্ব্যবহারের নামান্তর। তাছাড়া এটা আল্লাহর পথে দাওয়াতের একটি মাধ্যম এবং ইসলামের উৎকৃষ্ট চরিত্রের প্রমাণবাহক।’
নিউইয়র্ক ও অন্যান্য স্থানের হামলায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বেচ্ছায় রক্ত ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করার বৈধতা সম্পর্কে যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল তখন তিনি একটি হাদীস বললেন,
في كل كبد رطبة أجر
প্রত্যেক তরতাজা প্রাণেই রয়েছে প্রতিদান।
এবং একটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন, প্রত্যেক তরতাজা প্রাণেই রয়েছে প্রতিদান।
و يطعمون الطعام على حبه مسكينا و يتيما و أسيرا.
খাবারের প্রতি আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত এতিম ও বন্দীদের আহার দান করে। (দাহর, আয়াত : ৮) (উল্লেখ্য, আয়াতে উল্লিখিত বন্দীটি কাফের ছিল।) এরপর তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাফেরের প্রয়োজন পূরণে তাকে সাহায্য করা হলো মানব সম্প্রদায়ের প্রতি ইহসান ও অনুগ্রহ করা এবং তা আল্লাহর পথে দাওয়াতের মাধ্যম ও ইসলামের উচ্চ শিক্ষা এবং আল্লাহর জন্য সত্য দীনকে আঁকড়ে ধরা মুসলিমের উত্তম চরিত্রের প্রমাণ বাহক। মাজলুম যদিও কাফের হয় তাকে সাহায্য করলে সওয়াব পাওয়া যাবে, কোন গুনাহ হবে না।৩. শায়খ করযাভী আমেরিকার বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনাকে শরীয়তে হারাম বলে ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘আমরা সকল মুসলিমকে উদ্বুদ্ধ করছি যেন তারা আমেরিকার দুর্ঘটনা কবলিত নির্দোষ মানুষদের স্বেচ্ছায় রক্তদান করে।’
৪. রাবেতায়ে আলামে ইসলামীর ফতোয়া : ডক্টর আব্দুল মুহসিন তুর্কী ২৯/৬/১৪২২ হিজরীতে একটি ফতোয়া প্রকাশ করেন। তাতে তিনি আমেরিকায় সংঘটিত হামলাগুলোর কঠোর নিন্দা করেন এবং সেই হামলা ও হামলাকারীদের থেকে ইসলামের দায়মুক্তির ঘোষণা দেন। তিনি দীর্ঘ চাটুকারিতার আশ্রয় নেন। তিনি বলেন, ‘মুসলিম জনগণ যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। কারণ ইসলাম মুসলিমকে হত্যাকারী, হত্যা কাজের মাধ্যম কিংবা মানুষকে সন্ত্রস্ত করে বা কষ্ট দেয় এমন কাজে লিপ্ত হতে নিষেধ করে। কারণ এসব জুলুম ও অন্যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অতি দ্রুত বিদ্রোহ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা বন্ধের রাষ্ট্রীয় আইন কানুন কার্যকর করা উচিত।’
৫. অবশেষে সৌদির প্রসিদ্ধ মুফতি শায়খ আবদুল আজিজ আলে শায়খের ফতোয়া উল্লেখ করছি-
যুক্তরাষ্ট্রে যে বিস্ফোরণগুলো ঘটেছে, বিমান ছিনতাই, নিরাপদ জনগণের মনে ত্রাস সৃষ্টি ও অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা ও এই জাতীয় যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো অন্যায়, জুলুম ও বিদ্রোহের নামান্তর। এগুলো হারাম এবং কবীরা গুনাহ। তিনি এটাও খুব জোর দিয়ে বলেছেন যে, নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের যেসকল ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার কারণে শত শত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে সেগুলো এমন কাজ ইসলামী শরীয়ত যার অনুমোদন দেয় না এবং তা কোন দীনী কাজ নয় ও ইসলামী শরীয়তের মূল নীতির সাথে তা মিলে না।
( আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন : حقيقة الحروب الصليبية)
১৪. কারণ তারা মুহাক্কিক আলেমদের পথে চলে।
আকিদার কিতাব সমূহে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মানহাজ সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত আছে। আল্লাহর অনুগ্রহে আল কায়েদা আহলে সুন্নাহর বিজ্ঞ আলেমদের মানহাজের উপর প্রতিষ্ঠিত। আহলে সুন্নাহর আকিদা হল-
এক. আল্লাহর শরীয়ত বিরোধী আইন রচনা করা বিনা বাক্যে কুফর। মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন,
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ وَلَوْلَا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
নাকি তাদের রয়েছে এমন শরীক যারা দীনের এমন সব বিধান রচনা করে আল্লাহ তায়ালা যার অনুমতি দেননি? যদি পূর্বসিদ্ধান্ত না থাকতো তবে নিশ্চিত তাদের মাঝে ফায়সালা করে দেয়া হতো। আর নিশ্চয়ই জালেমদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সুরা শূরা, আয়াত: ২১)তিনি আরো বলেন,
أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
জেনে রাখো, সৃষ্টি ও বিধান দানের ক্ষমতা কেবল তাঁর*ই। (আ’রাফ, আয়াত: ৫৪)আল্লামা শানকীতী রহ. বলেন, বিধান রচনায় আল্লাহ তাআলার সাথে কাউকে শরীক করা ইবাদতে শরীক করার মতোই আল্লাহ তাআলা তার বিধান দানের ক্ষমতার ব্যাপারে বলেন,
وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا
আর তারা যেন তার হুকুমের ক্ষেত্রে কাউকে শরীক না করে। (কাহাফ, আয়াত: ২৬)সাত কিরাতের মধ্য থেকে ইবনে আমেরের কিরাতে নাহি তথা নিষেধ বাচক শব্দ যোগে এসেছে: “আর তুমি বিধান রচনায় তার সাথে কাউকে শরীক করো না।” মহান আল্লাহ তাআলা ইবাদতের শিরকের ব্যাপারে বলেন,
فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا
যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎ কাজ করে এবং তার রবের ইবাদতের মাঝে কাউকে শরীক না করে। (কাহাফ, আয়াত: ১১০)সুতরাং এ উভয় প্রকার শিরকের ক্ষেত্রে সমান। (আদওআউল বায়ান ৭/৪৮)
তিনি আরো বলেন, উল্লিখিত নসসমূহের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, যারা শয়তান কর্তৃক তার বন্ধুদের মাধ্যমে রচিত আল্লাহর শরীয়ত বিরোধী বিধানের অনুসরণ করে তাদের কুফর ও শিরকের ব্যাপারে কেবল ওই ব্যক্তিই সন্দেহ করতে পারে যাকে আল্লাহ তাআলা অন্ধ বানিয়েছেন এবং ওহীর আলো থেকে বঞ্চিত করেছেন। (আদওআউল বায়ান, ৩/২৫৯)
আর আল কায়েদাও এক*ই মত পোষণ করে।
দুই. আহলে সুন্নাহের নিকট আল্লাহর বিধান ছাড়া ফয়সালা করা দুই প্রকার। প্রথম প্রকার: সামগ্রিকভাবে বিচারকার্য আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো বিধানাবলী দ্বারা পরিচালনা করা। এটা কুফরে আকবার তথা বড় কুফর। দ্বিতীয় প্রকার: নির্দিষ্ট কোন মুকাদ্দমায় আল্লাহর বিধান ব্যতীত অন্য কোন বিধান দ্বারা ফয়সালা করা। এটা কুফরে আসগর তথা ছোট কুফর। আর আল কায়েদাও এ কথারই প্রবক্তা।
তিন. মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফির-মুশরিকদের সাহায্য করা:
আহলে সুন্নাহর আকিদা মতে আল কায়েদা বিশ্বাস করে যে, এ কাজ কুফর। যেমনটি শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহহাব রাহি. ঈমান ভঙ্গের দশটি কারণ এর অধীনে আলোকপাত করেছেন। তিনি বলেন, (ঈমান ভঙ্গের) অষ্টম কারণ: মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের সহায়তা করা। এর দলিল হল নিম্নে বর্ণিত আল্লাহ তাআলার বাণী,
وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
তোমাদের মধ্যে যে তাদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানাবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। নিশ্চয় আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে হেদায়েত দান করেন না। (মাজমুউত তাওহীদ, ২৪)
চার. হুজ্জত কায়েম হওয়া :- এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল হুজ্জত কায়েম হওয়া এবং তা বোঝার মাঝে পার্থক্য রয়েছে। এছাড়া হুজ্জত কায়েম হওয়া কেবল অস্পষ্ট মাসআলার ক্ষেত্রে শর্ত। সুস্পষ্ট এবং অকাট্য বিষয়ে নয়। সাথে সাথে অন্যান্য শর্ত পূরণ হওয়া এবং প্রতিবন্ধকতা দূর হওয়াও বিবেচ্য বিষয়। আল কায়েদা উল্লিখিত নীতির আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যদি কেউ ইনসাফের দাবি করে সে যেন উক্ত মাসাআলায় শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. ও অন্যান্য ইমামদের বক্তব্য পড়ে নেয়। অতঃপর তাদের এবং আল কায়েদার মূলনীতির মাঝে সামাঞ্জস্যতা অনুধাবন করে: কারা বিচক্ষণ ও বিদগ্ধ ইমামদের মানহাজের অনুসরণে ধন্য হয়েছে? আল কায়েদা নাকি তারা, যারা বিধান রচনাকে ব্যাখ্যা সাপেক্ষ ভাবে এবং মনে করে, সামগ্রিকভাবে ও নির্দিষ্ট মুকাদ্দমায় আল্লাহর বিধান ছাড়া বিচারকার্য পরিচালনা করা একই রকম আর এ ক্ষেত্রে ইসতিহলাল (বৈধ ভাবা) ছাড়া কুফর*ও হবে না? আবার এই বৈধ ভাবাও কতকের নিকট সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তি ছাড়া জানা সম্ভব নয়!! কারা বিচক্ষণ ইমামদের মানহাজের অনুসারী; আল কায়েদা নাকি তারা, যারা বলে শাসকরা কুফরিতে লিপ্ত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু অজ্ঞতার ওজরের কারণে তাদেরকে তাকফির করা যাবে না। কেননা তাদের কাছে হুজ্জত পৌঁছেনি? মূলত তারা জানেই না, প্রকাশ্য বিষয়ে হুজ্জত কায়েম হওয়া শর্ত নয়। এটা কেবল অস্পষ্ট বিষয়ের ক্ষেত্রেই ধর্তব্য। পূর্বে এ বিষয়ে আমরা কতিপয় আলেমের বক্তব্য উল্লেখ করেছি। তারা এটাও জানে না, হুজ্জত কায়েমে*র অর্থ হচ্ছে হুজ্জত পৌঁছা কিংবা তা পৌঁছার ব্যবস্থা থাকা। যার কাছে পৌঁছাবে অথবা পৌঁছার সুযোগ থাকবে তার ওপরই হুজ্জত কায়েম হয়ে যাবে। তর্ক শাস্ত্রবিদদের প্রতিউত্তরে ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, রাসুলদের ব্যাপারে আল্লাহর হুজ্জত মূলত তাদের সম্পর্কে জ্ঞান লাভের সুযোগ থাকার দ্বারাই কায়েম হয়ে গেছে। এজন্যই মাদ*ঊদের ইলম শর্ত নয়। ফলে কুরআন মনোযোগ সহকারে শ্রবণ ও অনুধাবন থেকে কাফেরদের উপেক্ষা হুজ্জত কায়েমের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয় নি। এমনিভাবে নবীদের থেকে বর্ণিত নির্দেশনাবলী থেকে তাদের অনাগ্রহ হুজ্জত কায়েমের ক্ষেত্রে বাধা হয়নি। কেননা জ্ঞান লাভের সুযোগ বিদ্যমান রয়েছে। (অররদ্দু আলাল মানতিকীয়ীন, ৯৯)
তিনি আরো বলেন, যদি কেউ তার বার্তায় সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ সংগঠিত হওয়ার সংবাদ দেয় তখন সেই আদেশ ও নিষেধ পৃথিবীর সকল ব্যক্তির নিকট পৌঁছা আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার সংঘটিত হওয়ার শর্ত বলে গণ্য হয় না। স্বয়ং রিসালাতে নববীর ক্ষেত্রে যখন এটা শর্ত নয় তখন কিভাবে সেটা তার আনুষাঙ্গিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে শর্ত হবে। বরং তার নিকট পৌঁছা সম্ভব থাকাই শর্ত। এরপর যদি তারা অবহেলা করে এবং সেই বার্তা তাদের নিকট পৌঁছার চেষ্টা না করে তাহলে এর দায়ভার মুকাল্লাফদের উপর বর্তাবে; দায়ীর উপর নয়। (মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড: ২৮, পৃ. ১২৫-১২৬)
শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব রহ. বলেন, শাইখুল ইসলামের যে বক্তব্য তোমরা উল্লেখ করেছ ‘যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে এবং তার উপর হুজ্জত কায়েম হবে’ এবং এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তোমরা বর্তমান তাগুত ও তাদের অনুসারীদের ব্যাপারে সন্দিহান যে, তাদের উপর হুজ্জত কায়েম হয়েছে কিনা- এটা আশ্চর্যের বিষয়! তোমরা কিভাবে এ ব্যাপারে সন্দেহ করো অথচ আমি বারবার তা সুস্পষ্ট করে দিয়েছি। শোন, নতুন ইসলাম গ্রহণ করলে কিংবা সদূর মরুতে বসবাসকারী হলে অথবা আলোচ্য বিষয়টি অস্পষ্ট হলে তবেই হুজ্জত কায়েমের প্রশ্ন আসবে। সে অস্পষ্ট মাসালা না জানা পর্যন্ত তাকে তাকফির করা হবে না। কিন্তু দীনের যে সব মৌলিক বিষয় মহান আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করে দিয়েছেন এবং তাঁর পবিত্র কিতাবে বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন সে সব বিষয়ে কোরআন*ই হুজ্জত। সুতরাং যার কাছে কোরআন পৌঁছেছে তার কাছে হুজ্জত* ও পৌঁছে গেছে। আসল কথা হচ্ছে তোমরা হুজ্জত কায়েম হওয়া আর তা বোঝার মাঝে পার্থক্য করতে পার না। দেখ, অধিকাংশ কাফের এবং মুনাফিক আল্লাহর হুজ্জত বোঝেনা। কিন্তু তাদের উপর সেই হুজ্জত ঠিকই কায়েম হয়ে গেছে। যেমন মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَمْ تَحْسَبُ أَنَّ أَكْثَرَهُمْ يَسْمَعُونَ أَوْ يَعْقِلُونَ إِنْ هُمْ إِلَّا كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ سَبِيلًا
আপনি কি মনে করেন তাদের অধিকাংশই শুনে অতঃপর বুঝে? তারা তো চতুষ্পদ প্রাণীর মত। বরং তারা আরো পথভ্রষ্ট।হুজ্জত কায়েম হওয়া এবং পৌঁছা ভিন্ন বিষয় যা এদের ব্যাপারে বাস্তবায়িত হয়েছে আর হুজ্জত বোঝা ভিন্ন বিষয়। (মুআল্লাফাতুশ শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব, পৃ. ২৪৪)
সুতরাং বর্তমান শাসক শ্রেণীর কাছে কি হুজ্জত পৌঁছেনি? তারা কি হুজ্জত জানতে সক্ষম নয়? হুজ্জত কি শরীয়ত পরিবর্তন ও ইহুদী-খ্রিস্টানদের সাহায্য করার মতো অকাট্য বিষয়গুলোতেও শর্ত, নাকি এটা বোঝা শর্ত যে, আল কায়েদা হকের উপর আছে? আল কায়েদা হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার বিষয়টি তাদের বুঝে আসা শর্ত নয়। যে এমন শর্ত করল সে যেন হুজ্জত ‘বোঝা’কে শর্ত করল। দুয়ের মধ্যকার পার্থক্য একটু আগে আলোচনা করা হয়েছে।
হে মুমিন ভাই, উক্ত মাসআলায় আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামদের বক্তব্য সামনে রাখুন। অতঃপুর মিলিয়ে দেখুন যে, আল কায়েদা কি তাদের মূলনীতি বিরোধী নাকি না!
তাছাড়া শাখাগত বিষয়ে মতবিরোধের সুযোগও রয়েছে।
এখন আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই,
(১) আল কায়েদার কারো শাখাগত বিষয়ের ভুলকে আপনি কি মৌলিক বিষয়ে ভুলের মতো ভাববেন?
(২) বলা হয়, যেহেতু তোমরা শাখাগত বিষয়ে মতবিরোধের সুযোগ আছে বলে মনে কর তাহলে কেন সেসব আলেমদের ঘৃণা কর যারা শাসকদের তাকফীর করে না?
আমরা বলব, এটি একটি যুক্তিসঙ্গত আপত্তি এবং এর সমাধান হওয়া জরুরি। যেসকল আলেম শাসকদের তাকফীর করে না আল কায়েদা তাদের সবাইকে ঘৃণা করে না; বরং তাদের নিকট যারা তাকফীর করে না তারা দুভাগে বিভক্ত-
(ক) রাজদরবার থেকে দূরে থাকা আলেমগণ। তারা শাসকশ্রেণী থেকে দূরে থাকে। তারা নিজস্ব ইজতিহাদের মাধ্যমে তাকফীর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে নি এবং তারা মুজাহিদদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয় না। এ শ্রেণীর উলামায়ে কেরাম আল কায়েদার নিকট সম্মানিত। তাদের ইজতিহাদের সুযোগ রয়েছে।
(খ) যেসব আলেম শাসকদের তাকফীর করে না এবং মুজাহিদের বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করে। তারা মুজাহিদদের পথভ্রষ্ট বলে আখ্যায়িত করে এবং তাগুতদের প্রশংসা করে। আলেমদের এ শ্রেণীর ব্যাপারে আল কায়েদা সতর্ক করে থাকে। কারণ তাদের মাধ্যমে উম্মাহ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আর কায়েদা বিচক্ষণ আলেমদের পথের পথিক। তাদের পন্থা হল- শর্ত পূরণ এবং প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের সাথে সাথে (যখন প্রয়োজন হয়) কুফর ও কাফেরদের থেকে সম্পর্ক ত্যাগ করা। কুফরি থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করল কিন্তু কাফেরদের থেকে করল না-এটা আলেমদের পথ নয়। সুতরাং হে ঐ সমস্ত ভাই, যারা শাখাগত বিষয়ে আল কায়েদার ব্যাপারে বিদ্বেষ পোষণ করো! ইতিহাসে কি এমন সময় যায়নি যখন উলামায়ে কেরাম উপযুক্ত ব্যক্তিদের কুফরীর হুকুম দিয়েছেন। শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রহ. বলেন, তাকফির ও কিতালের মাসআলায় সত্যান্বেষীদের জন্য আপত্তি নিরসনে সবচেয়ে বড় ঘটনা হল যাকাত অস্বীকার কারীদের বিরুদ্ধে কিতালের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামদের ইজমা’ সংগঠিত হওয়া, তাদেরকে মুরতাদ ঘোষণা করা এবং তাদের সন্তানদের বন্দি করা। ইসলামী ইতিহাসে এটাই সর্বপ্রথম কিতাল যা মুসলিম দাবিদারদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম থেকে আমাদের যুগ পর্যন্ত আলেমদের থেকে প্রকাশিত ঘটনাবলীর মধ্যে এটাই সবচেয়ে সুস্পষ্ট ঘটনা। ইমাম আবুল ওয়াফা ইবনে আকিল রহ. বলেন, জাহেল ও ইতর শ্রেণীর জন্য যখন শরীয়তের আদেশাবলী কঠিনসাধ্য হয় তখন তারা শরীয়তের বিধান থেকে সরে আসে এবং নিজেদের রচিত জীবনব্যবস্থার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। ফলে তা তাদের জন্য সহজবোধ্য হয়ভ কেননা এখন তারা অন্যের বিধানের অধীনস্থ হয়নি। এভাবে বিধান রচনার কারণে তারা আমার নিকট কাফের হিসেবে বিবেচিত হবে। যেমন কবরকে সম্মান করা, মৃত ব্যক্তির কাছে প্রয়োজন পূরণের কামনা করা, লাত ও উজ্জাতের পূজারীদের অনুসরণ করা। (মুফিদুল মুস্তাফিদ ফী কুফরী তারিকিত তাওহীদ, ২৬)
এখানে আমাদের উদ্দিষ্ট স্থান হল- ‘এভাবে বিধান রচনার দরুন তারা আমার নিকট কাফের্’
ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহ. কবর পূজাকে অস্বীকার করতে গিয়ে বলেন, এই মুশরিকরা এই পর্যন্ত পৌঁছেছে যে, তাদের মাঝে কিছু সীমালঙ্ঘনকারী উক্ত বিষয়ে কিতাব সংকলন করেছে যার নাম দিয়েছে ‘মানাসিকুল মাশাহিদ’। প্রকাশ থাকে যে তাদের এই কাজ ইসলামকে ত্যাগ এবং মূর্তিপূজার ধর্মে প্রবেশের নামান্তর (ইগাছাতুল লাহফান, ১/১৯৭)
এখানে ইবনুল কায়্যিম রহ. ইবনুল মুফীদ নামক এক ব্যক্তির কথা আলোচনা করেছেন। আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন, তার বক্তব্য কতটা সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট ছিল। সুতরাং তাকফীরে মুআইয়ান বা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের তাকফীরকে কিভাবে অস্বীকার করা যায়? আমরা তাকফীরের ক্ষেত্রে ইমামদের কিছু বক্তব্য তুলে ধরছি-
হানাফী
এক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য অত্যন্ত কঠোর। এমনকি তারা মুসাইহিফ, মুসাইজিদ বলা ও ওজু ছাড়া নামাজ পড়ার ক্ষেত্রেও তাকফিরে মুআইয়ান করে থাকে। আন নাহরুল ফা*ইক গ্রন্থে উল্লেখ আছে, শায়খ কাশেম শরহে দুরারিল বিহারে বলেন, সাধারণ মানুষ যেসব মান্নত করে থাকে যেমন- সৎ মানুষদের কবরে এসে ডাকা যে, হে সম্মানিত, যদি আমি হারানো বস্তু ফিরে পাই কিংবা আমার রোগ ভালো হয়ে যায় তাহলে আমি আপনার জন্য স্বর্ণ-রূপা, মোমবাতি, তেল ইত্যাদি দান করব। বেশ কিছু কারণে এসব মান্নত সকলের ঐক্যমতে বাতিল..... একটি কারণ হচ্ছে এই ধারণা করা যে, মৃত ব্যক্তি কার্য সম্পাদন করতে পারে। এই বিশ্বাস কুফর।....মানুষ এতে ব্যাপকভাবে লিপ্ত হয়েছে। বিশেষ করে শাইখ আহমদ আল বাদাভীর জন্মের ক্ষেত্রে।
লক্ষ্য করুন, এখানে মানুষ ব্যপকভাবে তাতে লিপ্ত হলেও স্পষ্টভাবে তাকফীর করেছে।
আবুল আব্বাস রহ. বলেন, ইবনুল খুদাইরী তার পিতা শায়খ খুদাইর _যিনি সে যুগে হানাফী মাযহাবের ইমাম ছিলেন_তার থেকে বর্ণনা করেন, ‘ইবনে সিনার ব্যাপারে বুখারার ফুক্বাহায়ে কেরামের বক্তব্য ছিল- সে বুদ্ধিমান কাফের।’ ইবনে সিনাকে বোখারার ফুকাহায়ে কেরামের পক্ষ থেকে তাকফীরের ঘটনা সে যুগের হানাফী মাযহাবের ইমাম বর্ণনা করেছেন অথচ ইবনে সিনা এমন ব্যক্তি ছিলেন যিনি মুসলমান হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। এটা ছিল তাকফীরে মুয়াইয়ান।
মালেকী
তাকফিরের ব্যাপারে মালেকীদের বক্তব্য তো আরো সুস্পষ্ট ও অগণিত। মালেকী ফুকাহাদের ব্যাপারে প্রসিদ্ধ যে, তারা সেই ব্যক্তিকেও অতিদ্রুত হত্যার ফতোয়া দিতেন যে এমন বাক্য উচ্চারণ করত মানুষ যা বোঝে না। কাজী ইয়ায রহ. “আশ-শিফা” গ্রন্থের শেষে এমন বেশ কিছু ফতোয়া উল্লেখ করেছেন। যেমন তিনি বর্ণনা করেছেন যে ব্যক্তি সম্মানার্থে গাইরুল্লাহর নামে কসম করবে সে কাফের হয়ে যাবে। অথচ এসব বিষয় আমাদের তাকফীরের কারণগুলোর চেয়েও নিম্নতর ও সামান্যতম।
শাফেয়ী
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. শরহুল আরবাঈন গ্রন্থে ইবনে আব্বাস রা. এর হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, اذا سالت فاسال الله ‘তুমি কিছু চাইলে আল্লাহর কাছেই চাও’- এর মর্মকথা হল- যে গাইরুল্লাহর কাছে চাইবে, তাকে ডাকবে সে কাফের। (আল বালাগুল মুবীন, ১/২২৫)
এমনকি তিনি এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র গ্রন্থ*ই রচনা করেছেন, যার নাম হল الإعلام بقواطع الإسلام সেখানে তিনি এমন কিছু কথা ও কর্মের বর্ণনা দিয়েছেন যার কারণে ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় এবং তাকফীরে মুআইয়ানের উপযুক্ত হয়ে যায়। অথচ সেগুলো গুরুত্বের বিচারে আমাদের আলোচিত বিষয়ের (হাকিমিয়্যাহ, আল ওয়ালা ওয়াল বারা, মুযাহারা) দশ ভাগের এক ভাগেরও সমান হবে না। এ ব্যাপারে ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, তাকফিরের ব্যাপারে আপত্তি দূর করতে এবং বিশ্বাস দৃঢ় করতে সবচেয়ে শক্তিশালী বিষয় হল আহলে ইসলামের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের পরবর্তী উলামায়ে একরামের বিভিন্ন আচরণ। যেমন বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বারাআ রা.কে পতাকাসহ এক ব্যক্তির কাছে পাঠালেন _যে নিজ পিতার স্ত্রীকে বিবাহ করেছে_ যেন তিনি তাকে হত্যা করেন এবং তার সম্পদ নিয়ে নেন। এমনিভাবে বনু মুস্তালিকের বিরুদ্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুদ্ধের অভিপ্রায়। কারণ তাদের বিরুদ্ধে যাকাত প্রদানের অস্বীকৃতির অভিযোগ ছিল। অনুরূপ যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারীদের বিরুদ্ধে আবু বকর সিদ্দিক রা. ও সাহাবাদের কিতাল, তাদের সন্তানদের বন্দি করা, তাদের সম্পদ গনীমত হিসেবে গ্রহণ করা এবং তাদেরকে মুরতাদ ঘোষণা দেয়া।
এমনিভাবে ওমর রা. এই যুগে কুদামাহ ইবনে মায*ঊন ও তার সাথীদের তাকফীরের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা। কারণ তারা নিম্নোক্ত আয়াতের আলোকে বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য মদের বৈধতা সাব্যস্ত করেছিল। আয়াত-
لَيْسَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيمَا طَعِمُوا إِذَا مَا اتَّقَوْا وَآمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ثُمَّ اتَّقَوْا وَآمَنُوا ثُمَّ اتَّقَوْا وَأَحْسَنُوا
যারা ঈমান আনে ও ভালো কাজ করে এরূপ লোকদের উপর তাতে কোন গুনাহ নেই, যা তারা পানাহার করেছে; যদি তারা আল্লাহকে ভয় করে এবং ঈমান আনে ও ভালো কাজ করে। পুনরায় আল্লাহকে ভয় করতে থাকে এবং ভাল কাজ করতে থাকে। (সূরা মায়েদা, আয়াত : ৯৩)এরপর হযরত ওসমান রা. এর জামানায় ওইসব আহলে মসজিদের তাকফীরের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা যারা শুধুমাত্র মুসাইলামাতুল কাজ্জাবের নবুওয়াতের ব্যাপারে কথা বলতো কিন্তু তার অনুসরণ করত না সাহাবায়ে কেরাম শুধুমাত্র তাদের তওবা কবুলের ক্ষেত্রে মতানৈক্য করেছিলেন। (তাকফিরের ব্যাপারে নয়।)
এমনিভাবে আলী রা. কর্তৃক তার সাথীদের আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া। কারণ তারা আলী রা. এর ব্যাপারে সীমালংঘন করেছিল।
পরবর্তীতে মুখতার ইবনে আবু ওবায়দা এবং তার অনুসারীদের কুফরের ব্যাপারে বাকি সাহাবীদের সাথে তাবেঈনদের ইজমা। যদিও সে দাবি করত যে, সে হুসাইন ও আহলে বাইতের রক্তের মূল্য চায়।
অনুরূপ জা’দ ইবনে দিরহামকে হত্যার ব্যাপারে তাবেঈনদের ইজমা। অথচ সে ভালো আলেম ও প্রসিদ্ধ দীনদার ছিল। এ ধরনের বহু ঘটনা ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়।
পূর্ববর্তী পরবর্তী কেউই তো আবু বক্কর ও অন্যান্যদের ব্যাপারে এমন মন্তব্য করেননি যে, কিভাবে আপনি বনু হানিফের সাথে জিহাদ করবেন, তারা তো কালিমা পড়ে, নামাজ পড়ে, যাকাত দেয়?! এমনিভাবে কুদামা ও তার সাথীরা যখন তাওবা করে নি তখন তাদের তাকফীরের ব্যাপারে কেউ আপত্তি করেনি!
এরপর বনু ওবায়দা যারা পাশ্চাত্য মিশর ও শামসহ একাধিক অঞ্চলে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল তারা প্রকাশ্যে ইসলাম পালন করত, জুমার নামাজ* ও জামাত কায়েম করতো, কাজী ও মুফতি নিয়োগ করতো; তথাপি যখন তারা জঘন্য সব কথাবার্তা ও কাজকর্ম প্রকাশ করেছিল তখন কোন আলেম তাদের সাথে কিতালের ব্যাপারে কোন আপত্তি করেনি। এমনকি তারা বিরত*ও থাকে নি। অথচ সে যুগে ছিল ইবনুল জাওযীর মতো ব্যক্তিবর্গ। তাদের থেকে মিশর দখল করার পর ইবনুল জাওযী একটি কিতাবে লিখেন, যার নাম ছিল النصر على مصر (মিসর বিজয়।) পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কেউই উক্ত কিতাব প্রত্যাখ্যান করেননি। তাদের ইসলামের দাবী, কালিমা পাঠ কিংবা ইসলামের কিছু রুকন পালনের দরুন কোন আপত্তিও আসেনি। কেবলমাত্র বর্তমান যুগের কতিপয় অভিশপ্ত শয়তান থেকে শোনা যাচ্ছে যে, এসব কুফর ঠিকই। কিন্তু যে ব্যক্তি তা সম্পাদন করবে কিংবা ভালো মনে করবে বা তার সাথী হবে বা তাওহীদকে ঘৃণা করবে অথবা তাওহীদবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে তাওহীদের কারণেই বা তাদেরকে ঘৃণা করবে তাকে তাকফির করা যাবে না। কারণ সে কালিমা পাঠ করে, ইসলামের পাঁচ রুকন আদায় করে। এ ব্যাপারে দলীল হিসেবে বলে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটাকেই ইসলাম বলেছেন। এমন জঘন্য কথা বর্তমান যুগের মুলহিদ কাফের ছাড়া অন্য কারো থেকে শোনা যায় না। যদি তারা এ ব্যাপারে আলেমদের থেকে একটি অক্ষরও কিংবা একজনকেও দেখাতে পারে যার মাধ্যমে তারা নিজেদের অসার দাবির দলিল দাঁড় করাতে পারে তাহলে সেটা তারা উল্লেখ করুক। (মুফিদুল মুস্তাফিদ ফী কুফরি তারিকিত তাওহীদ, পৃ. ৩৬)
শায়খ নাসির আল ফাহাদ (ফাক্কাল্লাহু আসরাহু) এমন ১৪ টি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন যেখানে উলামায়ে কেরাম মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সহযোগিতা কারীকে তাকফীর করেছেন।
মূলত ঘটনা এই দাঁড়ালো যে- খারেজী আদর্শকে খণ্ডনের জন্য ইরজার চেতনা প্রতিষ্ঠা লাভ করলো। অর্থাৎ এক বিদআতের মোকাবেলায় আরেক বিদআত দাঁড়িয়ে গেল। আর আহলে সুন্নাহ মুরজিয়া ও খারেজীদের মধ্যবর্তী পথ ঈমানকেই অবলম্বন করল।
সুতরাং হে আল্লাহর বান্দা, তুমি সতর্ক হও। তোমার আবেগ যেন দীনের বিরুদ্ধে না যায়, যার ফলশ্রুতিতে তুমি উপযুক্ত ও যথার্থ তাকফীরের বিরুদ্ধে লড়ছ আর তুমি তা অনুভব*ই করতে পারছ না! এমন কি তুমি মানুষের সামনে কুফরকে সামান্য করে তুলছো ফলে তারা কুফরের কদর্যতায় লিপ্ত হচ্ছে আর সেটাকে কুফর না ভেবে শুধু গুনাহ মনে করছে।
হে আল্লাহর বান্দা, তুমি মুরজিয়াদের মাযহাব প্রচারে সতর্ক হও! এমন যেন না হয় যে, তুমি মুরজিয়াদের মাযহাব প্রচার করছো আর তুমি মনে করছ আমি আহলে সুন্নাহর মাযহাব প্রচার করছি।
নাযর ইবনে শামীল রহ. বলেন, আমি খলীফা মামুনের দরবারে গেলাম। খলীফা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো? আমি বললাম, ভালো আছি আমিরুল মুমিনিন! অতঃপর আমাকে বললেন, তুমি কি জানো ইরজা কাকে বলে? আমি বললাম, ইরজা হল এমন দীন যা বাদশাহর অনুগামী হয়, যা দ্বারা তারা দুনিয়া অর্জন করে আর আখেরাত ধ্বংস করে। তিনি বললেন, সত্য বলেছ। (তারিখু মাদিনাতি দিমাশক, ৩৩/২৮৬)
অন্য জায়গায় আছে, নজর ইবনে শামীল রহ. বলেন, খলিফা মামুন আমাকে বললেন হে আবুল হাসান, ইরজা হলো রাজা-বাদশাদের ধর্ম।
আলহামদুলিল্লাহ- আকিদাগত বিষয়গুলোতে আল কায়েদা আহলে সুন্নাহর মানহাজের উপর রয়েছে। বিশেষ করে ঈমান, আসমা ও সিফাত, তাকদীর, কোরআন ও সাহাবা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে তারা আহলে সুন্নাহর মানহাজ অনুসরণ করে।
তুমি কি দেখেছ কুফর নয় এমন পাপের কারণে আল কায়েদা কাউকে তাকফীর করেছে? তারা কি যিনাকারী হত্যাকারীর মত অন্যান্য পাপাচারীদের ব্যাপারে আহলে সুন্নাহর আকীদা পোষণ করে না? মুসলিমদের হত্যা করা আর মূর্তি পূজারীদের ছেড়ে দেয়া কি খারেজীদের বৈশিষ্ট্য নয়? বর্তমানে আল কায়েদাই সবচেয়ে বড় জিহাদী তানজীম যারা মূর্তি পূজারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে। মাথা মুণ্ডানো কি খারেজীদের বৈশিষ্ট্য নয়? অথচ আল কায়েদার অধিকাংশই লম্বা চুলে অভ্যস্ত।
১৫. যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট হাদীস সমূহের কারণে
যুদ্ধসংশ্লিষ্ট হাদিস সমূহে তিনটি স্থানের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে:
১. শাম।
২. খোরাসান।
৩. আদনে আবীন।
আব্দুল্লাহ ইবনে হাওয়ালাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“পরিস্থিতি তার কাজের ধারা অনুযায়ী চলতে থাকবে যতক্ষণ না তোমরা তিনটি বাহিনীতে পরিণত হও :
একটি বাহিনী শামের,
একটি বাহিনী ইয়েমেনের
আর আরেকটি ইরাকের।”
ইবনে হাওয়ালাহ (রা.) বললেনঃ ‘হে আল্লাহর রাসুল, যদি আমি সেই দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকি তবে আমার জন্য একটি বাহিনী নির্ধারণ করে দিন।’
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন,“তোমার শামে যাওয়া উচিত হবে, কারণ এটি আল্লাহর শেষ্ঠ জমীন এবং তাঁর শ্রেষ্ঠ বান্দারাই সেখানে জড়ো হবে! আর যদি তুমি তা না চাও তবে তোমার ইয়ামানে যাওয়া উচিত এবং সেখানকার কূপ থেকে পানি পান করা উচিত। কারণ আল্লাহ আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি সিরিয়া এবং তার মানুষের উপর খেয়াল রাখবেন!” (ইমাম আহমদ ৪/১১০, আবু দাউদ ২৪৮৩)
এই স্থানগুলোর আজকের অবস্থাকে দুই দশক পূর্বেকার অবস্থার সাথে তুলনা করলে পুরোই ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এই দেশগুলোর অবস্থা ক্রমেই উন্নতির দিকে যাচ্ছে। শাম বিশ বছর পূর্বেও বর্তমানের তুলনায় দীন থেকে অনেক দূরে ছিল। খোরাসান ছিল সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় শাসিত। আদনে আবীনের অবস্থাও একই রকম ছিল। কিন্তু এখন আল্লাহর রহমতে খোরাসানে আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় জিহাদী দুর্গটির অবস্থান। শামেও চলছে জিহাদী বিপ্লব। আদনে আবীনেও শুরু হয়েছে ইসলামী জাগরণ। অচিরেই ইনশাআল্লাহ এসকল স্থানে মুজাহিদগণের হাতে ইসলামের অনেক বিজয় সূচিত হবে।
উল্লিখিত স্থানসমূহে আল কায়েদার রয়েছে সরব উপস্থিতি। খোরাসান তো আল কায়েদার কেন্দ্রভূমি এবং শায়খ উসামা বিন লাদেন রহ. সেখানেই আছেন। আদনে আবীনে সবচেয়ে বড় জিহাদী যে সংগঠনটি কাজ করে যাচ্ছে তা হলো আল কায়েদা। শামেও আল কায়েদার অনেক শাখা রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে গাজায় তাদের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হবে ইনশাআল্লাহ।
সুতরাং এসব স্থানে বিজয়ের শুভ লক্ষণ প্রতিভাত এবং জিহাদের ঝাণ্ডা উত্তোলনের কারণে ইসলামের বিজয় অত্যাসন্ন।
পরবর্তী পর্বগুলোও শীঘ্রই দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ…. নেক দুআয় ভুলবেন না….