Announcement

Collapse
No announcement yet.

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন!!!

Collapse
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন!!!

    আলোচনার সূচনাতেই আমাদের একটি কথা সুস্পষ্টভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে—'নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন' কিংবা যে কোনো ধরনের তথাকথিত সংস্কার কমিটির কার্যক্রম মূলত বাংলাদেশকে একটি পূর্ণাঙ্গ Nation State-এ রূপান্তর করার গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। এ Nation State আদর্শ, যার ভিত্তি কুফরি মতবাদ—সেক্যুলারিজম, ডেমোক্রেসি, লিবারালিজম, ও ফেমিনিজমের মতো বাতিল তন্ত্র-মন্ত্র। এইসব মতবাদ এক কথায় ইসলামের আকীদার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ, আল্লাহ তা'আলার সার্বভৌমত্ব অস্বীকার এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিধানকে খণ্ডন করার ষড়যন্ত্র।

    এই কমিশনসমূহের প্রতিবেদন এবং তথাকথিত সংস্কার প্রস্তাবনা সরাসরি আল্লাহর বিধানের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত। এগুলো এমন এক দাওয়াত দিচ্ছে, যা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে শয়তানের অনুসরণে উৎসাহিত করে।

    তাদের প্রচারিত সেক্যুলারিজম আল্লাহর দীন থেকে বিচ্ছিন্ন এক জীবনব্যবস্থা, যার কোনো ঈমান নেই, আমল নেই, তাকওয়া নেই। ডেমোক্রেসি মানে আল্লাহর বিধান ছেড়ে মানুষের মনগড়া আইনকেই প্রভু বানানো। লিবারালিজম মানে হালাল-হারামের সীমানা মুছে দিয়ে চূড়ান্ত চাহিদাপূরণের জীবন। আর ফেমিনিজম এক ভয়াবহ ভাইরাস, যা পরিবার ধ্বংস করে, সমাজে অবাধ্যতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, নারীর প্রকৃত মর্যাদাকে পদদলিত করে। এ সমস্ত মতবাদ ইসলামের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের হাতিয়ার, কুফর ও বিদআতের কলুষিত স্রোত।

    সুতরাং শরীয়তের আলোকিত মানদণ্ডে এই সব কমিশন ও তাদের সমস্ত কার্যক্রম চরম বাতিল, সরাসরি প্রতিহতযোগ্য। এগুলোর কোনো আইনগত, নৈতিক বা শরয়ী গ্রহণযোগ্যতা নেই। এটি কোনো মতবিরোধের বিষয় নয়; এটি ঈমান ও কুফরের, হক ও বাতিলের স্পষ্ট ফারাক। এ লড়াইয়ে নিরপেক্ষ থাকা মানেই বাতিলের পক্ষ নেওয়া।

    আমাদের আলোচনার মূল বক্তব্য এই নয় যে ‘নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন’ কতটুকু ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিংবা কতটা সাংঘর্ষিক। বরং আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে যা রয়েছে, তা হলো এই রিপোর্ট ও কমিশনসমূহ কীভাবে এক সুপরিকল্পিত পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে—তা অনুধাবন করা।

    এই কমিশন রিপোর্টে মোট ১৭টি অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে আলোচনা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কায় আমরা শুরুতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে প্রথম দুটি অধ্যায়—‘ভূমিকা’ এবং ‘নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম’—এই অংশগুলো আপাতত বাদ রাখা হবে। কারণ এই অধ্যায়দ্বয় মূলত প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা ও কমিশনের পরিচিতিমূলক বর্ণনায় সীমাবদ্ধ, যা আমাদের মূল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু নয়।

    তাই আমরা সরাসরি আলোচনা শুরু করব তৃতীয় অধ্যায় থেকে, যার শিরোনাম—‘সংবিধান, আইন ও নারীর অধিকার: সমতা ও সুরক্ষার ভিত্তি’। এই অধ্যায় থেকেই কমিশনের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি ও এজেন্ডার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু করে, এবং এখান থেকেই মূল বিতর্কের সূত্রপাত হয়। আমরা আজকের আলোচনায় এই অধ্যায়ের সাড়ে তিনটি বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করব।

    এক—খেয়াল করার বিষয় হলো, এই কমিশনের আলোচ্য অধ্যায় মূলত নারী সম্মতি ও অধিকার নিয়ে কথা বলার কথা, অথচ এর মাঝখানে ‘সংবিধান-সংক্রান্ত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী নিশ্চিত করা’ (পৃষ্ঠা-৩৫) শীর্ষক অনুচ্ছেদে এমন একটি সুপারিশ ঠেলে দেওয়া হয়েছে, যার প্রকৃত লক্ষ্য নারী অধিকার নয়, বরং সরাসরি ধর্মকে রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা।

    তারা সুপারিশ করেছে: “অনুচ্ছেদ এক—যেহেতু রাষ্ট্র একটি ইহজাগতিক সত্ত্বা, সেহেতু কোনো ধর্মীয় বিধান অনুসরণ করে সংবিধান শুরু হওয়া উচিত নয়। তা ছাড়া, একটি ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই, অনুচ্ছেদটি বাতিল করা প্রয়োজন।” এই বাক্য শুধু কোনো সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব না, বরং এটি একটি আদর্শিক ঘোষণা। তারা মূলত বলতে চাচ্ছে—নারী ও পুরুষের সমতার পথে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ধর্ম, আর সেই বাধা দূর করতে হলে যে করেই হোক ধর্মকে পাশ কাটাতে হবে।

    এই তথাকথিত সমতার ধারণাটি এখানে এক ধরনের ‘অজুহাত রাজনীতি’তে পরিণত হয়েছে, যার অন্তরালে একটি বড় এজেন্ডা কাজ করছে—এটা হচ্ছে ধর্মকে ধাপে ধাপে সরিয়ে দিয়ে সেক্যুলারিজমকে একটি পূর্ণাঙ্গ, চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার প্রয়াস। নারী অধিকার যেন এখানে মূল ইস্যু নয়, বরং এটি একটি মোড়ক, যার ভিতর লুকিয়ে আছে গভীর বিশ্বাসগত পরিবর্তনের ছক।

    আসলে তাদের বক্তব্যকে এক বাক্যে সংক্ষেপ করা যায় এভাবে—“Religion increases injustice, whereas nation-state (secularism) ensures justice.” অর্থাৎ, ধর্ম অন্যায়ের উৎস, আর সেক্যুলারিজম ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা। এর চেয়ে স্পষ্টভাবে ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ আর কী হতে পারে? এই সুপারিশ প্রমাণ করে যে, কথিত নারী অধিকার আসলে একটি বৃহত্তর আদর্শিক সংঘাতের নামমাত্র অজুহাত—মূলত এটি একটি পরিপূর্ণ বিশ্বাসগত কাঠামোর উপর আঘাত।


    দুই—এই কমিশনের প্রধান কথিত লক্ষ্য হচ্ছে নারী ও পুরুষের মাঝে সমতা প্রতিষ্ঠা। এটাই তো তাদের বারবার বলা বুলি, তাই না? কিন্তু আমরা যদি তাদের প্রস্তাবিত 'নারী কমিশন গঠন' সম্পর্কিত বক্তব্যটি একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ি, তাহলে দেখতে পাব—

    একটি স্থায়ী ও স্বতন্ত্র নারী কমিশন প্রতিষ্ঠা করা, যার ক্ষমতা থাকবে বৈষম্যমূলক আইন, নীতি ও প্রথা পর্যালোচনা ও চিহ্নিত করার; যা লিঙ্গ-সংবেদনশীল আইনগত, নীতিগত ও বাস্তব সংস্কার তদারকি করবে এবং কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে।” (পৃষ্ঠা -৩৫)

    এখানে খেয়াল করার মতো বিষয় হলো—তারা “নারী” শব্দটি ব্যবহার করলেও পরবর্তী ব্যাখ্যায় সরাসরি বলে ফেলেছে “লিঙ্গ-সংবেদনশীল আইন”। এখন প্রশ্ন হলো, যদি এই কমিশন নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে, তবে কেন তারা সরাসরি “নারী-সংবেদনশীল আইন” না বলে “লিঙ্গ-সংবেদনশীল আইন” বলছে?

    এই পরিবর্তন নিছক ভাষাগত নয়—এটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, বরং বলা যায়, এটি একটি এজেন্ডাভিত্তিক শব্দচয়ন। কারণ আন্তর্জাতিক ভাষ্য ও আইনি পরিভাষায় ‘gender-sensitive law’ মানে শুধু নারী নয়; বরং এর মধ্যে ট্রান্সজেন্ডার, গে, লেসবিয়ান, নন-বাইনারি সহ সমস্ত বিকল্প লিঙ্গ পরিচয়ধারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

    অর্থাৎ, এখানে একটি সূক্ষ্ম কিন্তু কৌশলগত জায়গা থেকে সমাজে নতুন এক “অধিকার শ্রেণি”র বীজ বপনের চেষ্টা চলছে—যেখানে নারী কেবল প্রথম ধাপ, আর তার পরের ধাপে রয়েছে সেইসব পরিচয়, যেগুলোর সামাজিক ও ধর্মীয় ভিত্তিতে কোনো স্বীকৃতি নেই। ইসলাম যেখানে মানব পরিচয়কে নারী ও পুরুষের দ্বিত্বে সীমিত রাখে, সেখানে এই তথাকথিত “লিঙ্গ-সংবেদনশীলতা” নতুন এক পরিচয় রাজনীতিকে চালু করে, যা ঈমানি সমাজব্যবস্থার ভিত্তিমূলে আঘাত হানে।

    তাহলে প্রশ্ন আসে, এখানে কি কেবল নারী অধিকারই আলোচ্য, নাকি সেই আড়ালে অন্য লিঙ্গ পরিচয়গুলোর সামাজিক স্বীকৃতির পথও তৈরি করা হচ্ছে? বাস্তবে এটি একধরনের ভূমিকা—একটি 'soft insertion'—যার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সমাজকে এমন এক রূপান্তরের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, যেখানে ‘অধিকার’ আর ‘সুরক্ষা’ শিরোনামের আড়ালে ইসলামের মৌল কাঠামোকে খণ্ডিত করা যায়।

    সুতরাং, এই শব্দচয়ন হালকা মনে করার কিছুই নেই। এটি স্রেফ লেখার ধরন নয়, বরং একটি মতাদর্শিক দখল প্রক্রিয়ার সূচনা।


    তিন—আমার মনে হয় না পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্ম আছে, যেখানে বেশ্যাবৃত্তি একটি গ্রহণযোগ্য পেশা হিসেবে স্বীকৃত। এটি প্রতিটি ধর্মের নৈতিক কাঠামোতে স্পষ্টভাবে পতনের চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। অর্থাৎ, এটা শুধু ইসলামে নয়—খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু কিংবা অন্য যেকোনো ঐতিহ্যিক ধর্মেও এটি ঘৃণিত ও নিন্দিত।

    এমন একটি প্রেক্ষাপটে কমিশনের সুপারিশে যখন বলা হয়—“যৌন পেশাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা এবং শ্রম আইনে একে স্বীকৃতি দেওয়া” (পৃষ্ঠা -৩৭) তখন সেটা নিছক সামাজিক বাস্তবতা বিবেচনার নাম করে ধর্ম, শালীনতা ও মানবিক মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত। এটি এমন এক সুপারিশ, যা শুধু ধর্মীয় বোধকে বুড়ো আঙুল দেখানো নয়, বরং এর ভেতর দিয়ে এক ধরনের 'আইনি স্বৈরতন্ত্র' প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে—যেখানে বলা হচ্ছে, “ধর্ম কী বলছে, নৈতিকতা কী বলছে, তা বিবেচ্য নয়—Nation State চাইলেই সবকিছু বৈধতা দিতে পারে, এবং সেই আইন সবাইকে মানতে হবে।”

    এখানে মূল বার্তা খুব পরিষ্কার: ধর্ম, ইতিহাস, সামাজিক বোধ—সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্র নিজের আদর্শিক অবস্থানকে চূড়ান্ত কর্তৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর এই যৌন পেশার স্বীকৃতির সুপারিশ শুধু সেই রাষ্ট্রীয় অহংকারের একটি নজির মাত্র।

    বলা যায়, এটি একটি বিপজ্জনক ঘোষণা—যেখানে বলা হচ্ছে, “সকল ধর্ম ও নৈতিকতার ঊর্ধ্বে গিয়ে আইন প্রণয়ন ও মানতে বাধ্য করার ক্ষমতা রাখে জাতিরাষ্ট্র।
    এখানে নারী অধিকার, শ্রম অধিকার বা মানবাধিকার—কোনো কথাই মূল বিষয় নয়; বরং এসব ব্যবহৃত হচ্ছে এক ধরনের আদর্শিক শূন্যতাবাদের উপস্থাপনা হিসেবে, যেখানে সব মূল্যবোধকে আপেক্ষিক বানিয়ে কেবল রাষ্ট্রকে একমাত্র বিধানদাতা বানানো হচ্ছে।

    সাড়ে তিন নং বিষয় হলো —এখানে একটি হাস্যকর এবং মজার ব্যাপার দেখা যাচ্ছে, যা হল এই কমিশনের সুপারিশে সব জায়গায় নারী ও পুরুষের সমতার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবতায় এই সমতা কতটা পক্ষপাতমূলক এবং অসম সেটা সহজেই ধরা পড়ে।

    এখানে কিছু সুপারিশের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে—যেমন:

    অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রবর্তন করা, যা বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তান পালনের অধিকার ও উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত সকল বিষয়ে ন্যায়বিচার ও সমতার ভিত্তিতে সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য একইভাবে প্রযোজ্য হবে।” (পৃষ্ঠা-৪৫)

    এছাড়া, “মালয়েশিয়া ও তুরস্কের মডেলের ন্যায় বাংলাদেশেও বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে ন্যায়সংগত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করতে বৈবাহিক সম্পত্তির ৫০-৫০ ভাগাভাগি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর করা।” (পৃষ্ঠা-৪১)

    এখানে কথিত ‘সমতার’ ভিত্তিতে সুপারিশ করা হচ্ছে যে, বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পুরুষের অর্ধেক সম্পত্তি নারীর কাছে চলে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—যখন দেনমোহর দেওয়া হয়, যা ইসলামী আইন অনুযায়ী স্বামীর কর্তব্য, তখন সেই দেনমোহরকেও নারীর অধিকার হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে, সমতা কোথায়? যদি ৫০-৫০ ভাগাভাগি সম্পত্তির কথা বলা হয়, তবে পুরুষের কাছে তার যথাযথ দেনমোহর পাওয়ার অধিকার নেই কেন? তার মানে কি এখানে, পুরুষের ওপর আর কোনো বোঝা দেওয়া হবে না, অথচ তার সম্পত্তির অর্ধেক কে নিতে পারে?

    এছাড়া, যখন বলা হয় “মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৪ সংশোধন করে বিবাহবিচ্ছেদ নিবন্ধনের আগে বাধ্যতামূলকভাবে দেনমোহর পরিশোধ সংক্রান্ত বিধান অন্তর্ভুক্ত করা।”, তখন আসলে এটি মূলত ইসলামিক আইন এবং সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পুরুষের কাছে দেনমোহর নেওয়ার প্রস্তাব থাকলেও, একই সময়ে তাকে তার সম্পত্তি থেকে অর্ধেক ভাগ দেওয়ার প্রস্তাব আসে—এটা কীভাবে সমতার সাথে মেলে?


    আমি চেয়েছিলাম আমার লেখা এখানেই শেষ করব। কিন্তু এমন একটি বিষয় আমার চোখে পড়েছে, যা উল্লেখ না করলে লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই বিষয়টি শুধু চোখে পড়ার মতো না—বরং এটি এতটাই গুরুতর, যে একে এড়িয়ে যাওয়া মানে গোটা আলোচনার মূল সুরকে চাপা দিয়ে ফেলা। তাই বাধ্য হয়েই আমি এই অংশটি যুক্ত করছি।

    আপনারা নিশ্চয়ই সবাই স্মরণ করতে পারছেন ভারতের বিতর্কিত তিন তালাক আইন—যে আইনকে মুসলিম পারিবারিক বিধান এবং শরীয়তের ওপর একরকম রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বলে দেখেছেন বহু মুসলিম চিন্তাবিদ ও ইসলামি স্কলার। এখন ভাবুন, যদি বাংলাদেশেও কেউ সেই ধাঁচে শরীয়ত-বহির্ভূত আইন সুপারিশ করে—তাও আবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, ‘চালাকির’ ভঙ্গিতে—তাহলে তা কি নিছক আইনি উন্নয়ন, নাকি আদর্শিক আগ্রাসনের সূক্ষ্ম খেলা?

    কমিশন তাদের প্রস্তাবে বলছে—
    "পুরোনো ও জটিল বিবাহবিচ্ছেদ আইন: পুরুষদের ন্যায় নারীদের বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার নিশ্চিত করে The Indian Divorce (Amendment) Act, 2001-এর ন্যায় বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৮৬৯ সংশোধন করে যুগোপযোগী করা..." (পৃষ্ঠা -৪০)

    এখানে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বিষয় হলো—ভারতের আইন-এর রেফারেন্স দিয়ে বাংলাদেশে আইনের সংস্কার করার সুপারিশ। এটি নিছক আইন নয়—আইনকে হাতিয়ার বানিয়ে আদর্শ ঢুকিয়ে দেওয়া। আর যেহেতু এটি সরাসরি মুসলিম পারিবারিক শরীয়তের বিরোধী না হয়ে এক ধরনের "ক্রিশ্চিয়ান বিবাহ আইন"-এর নামে আসছে, তাই এটিকে অনেকেই হয়তো ধরতে পারবে না—কিন্তু এর আসল টার্গেট স্পষ্ট: সামাজিক কাঠামোতে পশ্চিমা ও হিন্দু প্রধান রাষ্ট্রের আইনগত চেতনার অনুকরণ চালু করা।

    তাহলে প্রশ্ন আসে—যে রাষ্ট্র মুখে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কথা বলে, সে রাষ্ট্রের আইনত সংস্থা কিভাবে ভারতীয় আইনকে নিজের দেশে বাস্তবায়নের সুপারিশ করে? এটি তো সেই গল্পের মতো: মুখে বলা হচ্ছে “আমরা স্বাধীন,” আর হাত-পা বাঁধা হচ্ছে অন্য দেশের নীতিতে।

    এখানে আপনার প্রশ্নটাই আসল পয়েন্ট:
    "তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো?"
    যতই বলা হোক—আমরা ভারতের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে চাই, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভারতের আদর্শিক কাঠামোই সুপারিশের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শিরোনাম পাল্টে দিলেই যদি আইনের আদর্শ পাল্টে যেত, তবে তো ভারতের সংবিধানেও 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি থাকত না!

    এই চালাকি আসলে স্পষ্টতই বোঝায়—এখানে লক্ষ্য হলো সমাজে এমন এক আদর্শ চাপিয়ে দেওয়া, যা আমাদের আত্মপরিচয় ও ধর্মীয় বিধানকে ধীরে ধীরে মুছে দেবে, আর সেটা হবে “আইনি সংস্কার” বা “নারীর অধিকার” ইত্যাদি সুগন্ধি মোড়কে। এবং একবার সেটা ঢুকে গেলে, তখন সেটা ঠেকানো সহজ হবে না।

    সুতরাং, কথিত উন্নয়নের নামে যদি অন্যের আইন আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে এটাকে স্বাধীনতা বলা যায় না—এটা একরকম ‘পলিটিকাল রিক্রুটমেন্ট’ বা আদর্শিক দাসত্ব।

    তিউনিসিয়া থেকে শুরু হওয়া আরব বসন্ত কিংবা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঘটে যাওয়া জুলাই বিপ্লব—উভয়ের পরিণতি দেখলে একটি নির্দিষ্ট ব্যর্থতার ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

    শাসক বদলেছে, কিন্তু শাসনব্যবস্থা বদলায়নি। কুফরি কাঠামো ঠিকই রয়ে গেছে। জনগণ দাসত্বের শিকল ছিঁড়েছে ভেবে উল্লাস করেছে, কিন্তু বুঝতে পারেনি—যে শিকল তারা ছিঁড়েছে, সেই শিকলের রঙ আর নকশা পাল্টেছে মাত্র, শিকলটা একই কুফরি লোহায় গড়া।

    এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা—যে কুফরি ব্যবস্থার মধ্যে বসে কেবল নেতৃত্ব বদলের স্বপ্ন দেখা হয়, সেখানে প্রকৃত ইনকিলাব আসবে না। কারণ কুফর, শিরক, তাগুত—এসব শুধু চিন্তায় নয়, বাস্তব কাঠামোতেও উপড়ে ফেলতে হয়। আর শাসক যদি মুসলিম নামধারী হয়, কিন্তু সে যদি কুফরি বিধানেই শাসন করে, তবে সে আল্লাহর বিধানের সঙ্গে বিদ্রোহ করছে।

    তাই আমাদের স্পষ্টভাবে মনে রাখতে হবে—শাসক মুসলিম হওয়া যেমন জরুরি, তেমনি শাসনব্যবস্থার তাওহীদী ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করাও ফরজ। অন্যথায়, সব বিপ্লব, সব আন্দোলন, সব দাবি হয়ে যাবে আরেকটি রাজনৈতিক ডামাডোল, যার ভেতরে কুফরি কাঠামো ঠিকই অটুট থেকে যাবে।

    وَقٰتِلُوۡهُمۡ حَتّٰى لَا تَكُوۡنَ فِتۡنَةٌ وَّيَكُوۡنَ الدِّيۡنُ لِلّٰهِ​ؕ فَاِنِ انتَهَوۡا فَلَا عُدۡوَانَ اِلَّا عَلَى الظّٰلِمِيۡنَ‏
    ​​​অর্থ: ফিতনা দূরীভূত না হওয়া পর্যন্ত এবং দীন আল্লাহর জন্য নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, অতঃপর যদি তারা বিরত হয় তবে যালিমদের উপরে ছাড়া কোনও প্রকারের কঠোরতা অবলম্বন জায়িয হবে না। (সুরা বাকারাহ; ২:১৯৩)

    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ
Working...
X