ষষ্ঠ খ্রিষ্টীয় শতাব্দী মানবজাতির ইতিহাসে ছিল এমন এক সময়, যখন সভ্যতার বহিরাবরণ যতই ঝলমলে হোক না কেন, আভ্যন্তরীণভাবে মানুষ ছিল এক নির্মম অন্ধকারে নিমজ্জিত। জ্ঞান ছিল, কিন্তু সে জ্ঞান ছিল আত্মাহীন; শক্তি ছিল, কিন্তু তা ছিল নির্মমতা ও নিপীড়নের বাহন; ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠিত ছিল নানা মতবাদ, কিন্তু তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল বিভেদ, রাজনীতি ও ক্ষমতালিপ্সার পণ্য। মানুষ তার প্রকৃত পরিচয় ভুলে গিয়ে ধ্বংসাত্মক স্বার্থের উপাসক হয়ে উঠেছিল। আত্মশক্তির অপব্যবহার এবং আত্মার উপেক্ষা—এই দ্বৈত বিষক্রিয়ায় মানবতা পর্যবসিত হয়েছিল দাসত্ব, শোষণ ও বিভ্রান্তির এক নিষ্ঠুর বাস্তবতায়।
ইরান, তখনকার পারস্য সাম্রাজ্য, যেখানে এক সময় ছিল প্রকৃতিবাদ, পরিণত হয়েছিল অগ্নিপূজার কঠিন এক কাঠামোতে। তারা 'আহুরা মাজদা' ও 'অহরিমান'-এর দ্বৈতবাদী চিন্তাধারায় বিভক্ত হয়ে আল্লাহর একত্ববাদ থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছিল। অবশিষ্ট ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা, শুদ্ধতা ছিল না অন্তরে।
রোমান সাম্রাজ্য, যদিও খ্রিষ্টধর্মের নাম ধারণ করেছিল, কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে রূপান্তরিত করেছিল এক ছদ্মবেশী উপাস্যতন্ত্রে। কনস্টান্টাইনের পর খ্রিষ্টধর্ম হয়ে পড়ে সাম্রাজ্যবাদী নীতির এক যন্ত্র, যেখানে গির্জা আর সিংহাসনের মাঝে গড়ে উঠেছিল অপবিত্র মেলবন্ধন। বহু দেবতা ও সাধুকে পূজা করার নামে গির্জাগুলোতে প্রবেশ করেছিল পৌত্তলিকতা, এবং আত্মা হারিয়েছিল খ্রিষ্টের প্রকৃত বার্তা।
চীন, যাকে প্রাচীন সভ্যতার সূতিকাগার হিসেবে ধরা হয়, তার আত্মিক চিত্র ছিল করুণ। পূর্বপুরুষপূজা, মৃতপূজা এবং আত্মিক শক্তিকে ঘিরে গড়ে ওঠা কুসংস্কার মানুষের চিন্তাশক্তিকে করেছিল ভীত ও সীমাবদ্ধ। ভূতপ্রেত, রাক্ষস, অশরীরী আত্মা—এসবই হয়ে উঠেছিল পূজ্য ও ভয়ংকর, আর মানুষের হৃদয়ে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক শক্তির আতঙ্ক ও অন্ধ আনুগত্য।
হিন্দুস্তানের চিত্র ছিল আরও গম্ভীর বিভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ। সমাজব্যবস্থা বিভক্ত ছিল জাতপাত ও বর্ণবাদের বিষাক্ত শিকলে। ব্রাহ্মণ্যবাদ একদল মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিল দেবত্বের দাবি, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল অবমাননার শিকার। হাজারো দেবতা, প্রতিমা, আচারের পেছনে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল হৃদয়ের ঈমান।
আরব উপদ্বীপ ছিল যেন নৃশংসতার লীলাভূমি। গোত্রভিত্তিক দ্বন্দ্ব, প্রতিশোধ, খুন-জখম, নারী অবমাননা, কন্যাশিশু হত্যা—সবকিছু মিলিয়ে সমাজ ছিল এক কর্কশ পশুত্বের প্রদর্শনী। কাবা, যেটি ছিল ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) ও ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম) -এর প্রতিষ্ঠিত তাওহীদের প্রতীক, সেটিও হয়ে উঠেছিল ৩৬০টি মূর্তির আবাস। গোত্রের বাইরের কাউকে মানুষ ভাবার দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল না। সহানুভূতি ও নৈতিকতা কেবল নিজেদের রক্তসম্পর্কের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল।
এই ভয়াবহ চারিত্রিক অবনতির এক বিষণ্ন সন্ধিক্ষণে আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে শেষবারের মতো পথপ্রদর্শনের জন্য পাঠালেন তাঁর মহাগ্রন্থ—আল-কুরআন। এটি এমন এক কিতাব, যা শুধু একটি নির্দিষ্ট জাতির জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবতার চিরকালীন হিদায়াতের মূল উৎস। এটি এমন এক আলো, যা একবার উদিত হলে আর নিভে না; এমন এক দিগন্ত, যেখানে চিন্তা, ইবাদত, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, আইন এবং নৈতিকতা—সবই এক মহান ঐক্যে আবদ্ধ।
‘আল-কুরআন’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘قراءة’ ধাতু থেকে, যার অর্থ—পড়া বা উচ্চারণ করা। এই নাম শুধু একটি আক্ষরিক তাৎপর্য বহন করে না, বরং এ নামের মাধ্যমে প্রকাশ পায় কুরআনের ধারাবাহিক তিলাওয়াত, এর নিরন্তর চর্চা এবং চিন্তন-মননের দৃষ্টিভঙ্গি। আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেন, "إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ"—"এর সংরক্ষণ এবং পাঠ করানো আমাদের দায়িত্ব"। এই আয়াত শুধু কুরআনের মুখস্থকরণ নয়, বরং এর সঠিক অধ্যয়ন ও প্রেরিত লক্ষ্যপূরণের প্রতিশ্রুতি বহন করে।
বিশ্বসাহিত্যে বহু কবি, দার্শনিক ও সাধক কুরআনের গভীরতা ও ভাষার অলংকারে বিস্মিত হয়েছেন। পারস্যের অমর কবি সাদী শিরাজী বলেন, "কুরআন এমন এক সমুদ্র, যেখানে প্রতিটি আয়াত মুক্তার মতো আলো ছড়ায়, আর প্রতিটি শব্দ অগাধ অর্থের বাহক।"
কুরআনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো—এটি চিন্তা ও গবেষণার আহ্বান জানায়। শুধু পাঠ নয়, পাঠের সঙ্গে সাথে গভীর অনুধ্যান, মনোযোগী ধ্যান এবং ভাবনাচিন্তার অবিচ্ছিন্ন আবর্তন এর দাবি। এ জন্যই আল্লাহ বলেন: "أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ؟"—"তারা কি কুরআনের আয়াত নিয়ে চিন্তা করে না?" অর্থাৎ, কুরআন কেবল আবেগ নয়, যুক্তি ও প্রজ্ঞার দাওয়াত। এটি কোনো মন্ত্র নয়, বরং একটি জীবন্ত সংলাপ।
আবার কুরআন বলে: "فَاقْرَؤُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ"—"তোমাদের জন্য যতটুকু সহজ হয়, তা পড়ো।" এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায় যে, কুরআন এমন এক মহাকিতাব, যা সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত, সহজ পাঠযোগ্য এবং আত্মার আহার।
আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহ লিখিতরূপে নাযিল হয়েছিল, কিন্তু কুরআন এসেছে একটি জীবন্ত শিক্ষার পদ্ধতিতে—জিবরাইল (আলাইহিস সালাম) আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষভাবে নবী করীম ﷺ-কে পাঠ শেখাতেন। এ জন্যই বলা হয়েছে, "سَنُقْرِئُكَ فَلَا تَنسَى"—"আমরা তোমাকে এমনভাবে পড়াবো, যাতে তুমি তা ভুলে না যাও।"
অবশেষে, কুরআনের প্রথম শব্দটি—"اقْرَأْ" (পড়ো)—একটি বিপ্লবী ঘোষণা, যা জানিয়ে দেয় এই ধর্মের ভিত্তি জ্ঞানে, চিন্তনে এবং ঈমানি আত্মসংশোধনে। তাই 'কুরআন' নামটি কেবল একটি অভিধানগত ব্যাখ্যা নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন, একটি চিরন্তন আহ্বান, এবং এক নিরন্তর চিন্তাময় পাঠ্যযাত্রার সূচনা।
কুরআনের রাজনীতিবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত স্পষ্ট, বাস্তবমুখী এবং চিরকালীনভাবে কার্যকর। এটি শুধু আধ্যাত্মিক কল্যাণের পাথেয় নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও মানবসমাজে ইনসাফভিত্তিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কার্যকর রূপরেখা। কুরআন এমন এক পথপ্রদর্শক, যা শুধুমাত্র বিশ্বাসীদের ইবাদত ও আখিরাতের সফলতার দিকনির্দেশনা দেয় না, বরং শাসনব্যবস্থা, সামাজিক সুবিচার, অর্থনৈতিক ভারসাম্য এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়নীতি সম্পর্কেও সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে।
আজকের বিশ্ব বহু রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতার পরেও শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল শুধু সামরিক সংঘাত নয়; বরং এটি ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, ভ্রান্ত মতবাদ এবং আত্মঘাতী জাতীয়তাবাদের নিষ্ঠুর ফল। দুই দফা ধ্বংসযজ্ঞের পর বিশ্ব এক অদৃশ্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রান্তে দাঁড়িয়ে। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অক্ষমতা, রাজনৈতিক দ্বিচারিতা এবং ‘পাওয়ার ব্লক’ সংস্কৃতির কারণে মানবজাতি আজও নিরাপত্তাহীনতার শিকার। কুরআন এই ধরনের সংকটকে "طاغوت" বা ‘অত্যাচারী কর্তৃত্বের উপাসনা’ বলে আখ্যায়িত করে।
বিশ্ব আজ অজস্র ‘ইজম’ ও মতবাদে ছিন্নভিন্ন: পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, উদারতাবাদ—যার প্রতিটিই নিজস্বভাবে কিছু সত্য ধারণ করলেও সামগ্রিকভাবে মানুষের মুক্তি ও সাম্য আনতে ব্যর্থ হয়েছে। এই মতবাদগুলো মানুষকে মানবিক গুণাবলি থেকে বিচ্যুত করে কেবল স্বার্থনির্ভর শক্তির লড়াইয়ে পরিণত করেছে। প্রতিটি মতবাদ নিজেকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অন্য মতকে দমন করে; ফলে এই দ্বন্দ্ব থেকেই জন্ম নেয় যুদ্ধ, বিভাজন এবং বৈশ্বিক অস্থিরতা।
এই বাস্তবতায় কুরআন একটি ব্যতিক্রমী পথপ্রদর্শক। এটি আইনের উৎস হিসেবে মানবের ওপর মানবের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে বলে:
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ
“ফয়সালার অধিকার তো একমাত্র আল্লাহরই।” (সূরা ইউসুফ: ৪০)
এই আয়াত একটি মৌলিক রাজনৈতিক ঘোষণাও বটে—যেখানে শাসনব্যবস্থা এবং আইনের প্রণয়ন সরাসরি আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীন। কুরআনের রাজনীতি ‘ক্ষমতার জন্য রাজনীতি’ নয়; বরং এটি হল ‘দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা’।
কুরআনের রাজনৈতিক চিন্তায় যে নীতিসমূহ ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করে তা হলো:
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র—মদীনার সনদ (Constitution of Madinah)—এমন একটি রাজনৈতিক দলিল, যেখানে মুসলিম, ইহুদি ও অন্যান্য গোত্রসমূহকে একটি সম্মিলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার ছায়ায় এনে সকলের অধিকার নিশ্চিত করা হয়। এই রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি ছিল ইনসাফ, নিরাপত্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, যা আজকের তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো বহু শতাব্দী পরেও নিশ্চিত করতে পারেনি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
إِنَّ اللّهَ يَأْمُرُكُمْ أَن تُؤَدُّواْ الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُم بَيْنَ النَّاسِ أَن تَحْكُمُواْ بِالْعَدْلِ
“আল্লাহ তোমাদের আদেশ দেন—অমানত তার যথার্থ দাবিদারকে ফিরিয়ে দিতে এবং যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করো, তখন ইনসাফভিত্তিক ফয়সালা করো।” (সূরা নিসা: ৫৮)
এখন প্রশ্ন—কেন কুরআনের এই রাজনৈতিক মডেল আজ বাস্তবায়িত হয় না? কারণ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের তৈরি একটি কাঠামো, যেখানে ক্ষমতার উৎস ‘জনগণ’—এবং সেই কাঠামো মূলত আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে। ফলে আল্লাহর দেওয়া শাসননীতি ও ন্যায়বিচার সেখানে বাস্তবায়নের সুযোগ পায় না।
অথচ কুরআন যখন নাজিল হচ্ছিল, তখনও মানুষের অবস্থা আজকের মতোই ছিল—গোত্রীয় অহংকার, শোষণ, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, নারী নিপীড়ন, দুর্বলদের উপর অত্যাচার এবং বিচারবিভাগে দুর্নীতি। এই অন্ধকার থেকে মুক্তির একমাত্র পথ ছিল আল্লাহর ওহীর আলো। কুরআন সেই আলো, যা মানুষের অন্তরে প্রথম দীপ্তি জাগায়, এরপর পরিবারে, সমাজে, সর্বশেষ রাষ্ট্রে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا
“তোমরা ছিলে আগুনের গহ্বরের কিনারায়, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের তা থেকে রক্ষা করলেন।” (আলে ইমরান: ১০৩)
এ আয়াতটি কোনো কেবল অতীত স্মরণ নয়; বরং প্রতিটি যুগের জন্য একটি সতর্কবার্তা—যদি কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচ্যুত হও, তবে তোমরাও সেই আগুনের কিনারায় পৌঁছে যাবে। তাই সময় এসেছে কুরআনের রাজনীতি, ইনসাফ ও নেতৃত্বের চিন্তাকে শুধু তাফসিরের পাতায় সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তব জীবনে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে এবং নীতিনির্ধারণে ফিরিয়ে আনার।
ইরান, তখনকার পারস্য সাম্রাজ্য, যেখানে এক সময় ছিল প্রকৃতিবাদ, পরিণত হয়েছিল অগ্নিপূজার কঠিন এক কাঠামোতে। তারা 'আহুরা মাজদা' ও 'অহরিমান'-এর দ্বৈতবাদী চিন্তাধারায় বিভক্ত হয়ে আল্লাহর একত্ববাদ থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছিল। অবশিষ্ট ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা, শুদ্ধতা ছিল না অন্তরে।
রোমান সাম্রাজ্য, যদিও খ্রিষ্টধর্মের নাম ধারণ করেছিল, কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে রূপান্তরিত করেছিল এক ছদ্মবেশী উপাস্যতন্ত্রে। কনস্টান্টাইনের পর খ্রিষ্টধর্ম হয়ে পড়ে সাম্রাজ্যবাদী নীতির এক যন্ত্র, যেখানে গির্জা আর সিংহাসনের মাঝে গড়ে উঠেছিল অপবিত্র মেলবন্ধন। বহু দেবতা ও সাধুকে পূজা করার নামে গির্জাগুলোতে প্রবেশ করেছিল পৌত্তলিকতা, এবং আত্মা হারিয়েছিল খ্রিষ্টের প্রকৃত বার্তা।
চীন, যাকে প্রাচীন সভ্যতার সূতিকাগার হিসেবে ধরা হয়, তার আত্মিক চিত্র ছিল করুণ। পূর্বপুরুষপূজা, মৃতপূজা এবং আত্মিক শক্তিকে ঘিরে গড়ে ওঠা কুসংস্কার মানুষের চিন্তাশক্তিকে করেছিল ভীত ও সীমাবদ্ধ। ভূতপ্রেত, রাক্ষস, অশরীরী আত্মা—এসবই হয়ে উঠেছিল পূজ্য ও ভয়ংকর, আর মানুষের হৃদয়ে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক শক্তির আতঙ্ক ও অন্ধ আনুগত্য।
হিন্দুস্তানের চিত্র ছিল আরও গম্ভীর বিভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ। সমাজব্যবস্থা বিভক্ত ছিল জাতপাত ও বর্ণবাদের বিষাক্ত শিকলে। ব্রাহ্মণ্যবাদ একদল মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিল দেবত্বের দাবি, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল অবমাননার শিকার। হাজারো দেবতা, প্রতিমা, আচারের পেছনে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল হৃদয়ের ঈমান।
আরব উপদ্বীপ ছিল যেন নৃশংসতার লীলাভূমি। গোত্রভিত্তিক দ্বন্দ্ব, প্রতিশোধ, খুন-জখম, নারী অবমাননা, কন্যাশিশু হত্যা—সবকিছু মিলিয়ে সমাজ ছিল এক কর্কশ পশুত্বের প্রদর্শনী। কাবা, যেটি ছিল ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) ও ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম) -এর প্রতিষ্ঠিত তাওহীদের প্রতীক, সেটিও হয়ে উঠেছিল ৩৬০টি মূর্তির আবাস। গোত্রের বাইরের কাউকে মানুষ ভাবার দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল না। সহানুভূতি ও নৈতিকতা কেবল নিজেদের রক্তসম্পর্কের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল।
এই ভয়াবহ চারিত্রিক অবনতির এক বিষণ্ন সন্ধিক্ষণে আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে শেষবারের মতো পথপ্রদর্শনের জন্য পাঠালেন তাঁর মহাগ্রন্থ—আল-কুরআন। এটি এমন এক কিতাব, যা শুধু একটি নির্দিষ্ট জাতির জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবতার চিরকালীন হিদায়াতের মূল উৎস। এটি এমন এক আলো, যা একবার উদিত হলে আর নিভে না; এমন এক দিগন্ত, যেখানে চিন্তা, ইবাদত, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, আইন এবং নৈতিকতা—সবই এক মহান ঐক্যে আবদ্ধ।
‘আল-কুরআন’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘قراءة’ ধাতু থেকে, যার অর্থ—পড়া বা উচ্চারণ করা। এই নাম শুধু একটি আক্ষরিক তাৎপর্য বহন করে না, বরং এ নামের মাধ্যমে প্রকাশ পায় কুরআনের ধারাবাহিক তিলাওয়াত, এর নিরন্তর চর্চা এবং চিন্তন-মননের দৃষ্টিভঙ্গি। আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেন, "إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ"—"এর সংরক্ষণ এবং পাঠ করানো আমাদের দায়িত্ব"। এই আয়াত শুধু কুরআনের মুখস্থকরণ নয়, বরং এর সঠিক অধ্যয়ন ও প্রেরিত লক্ষ্যপূরণের প্রতিশ্রুতি বহন করে।
বিশ্বসাহিত্যে বহু কবি, দার্শনিক ও সাধক কুরআনের গভীরতা ও ভাষার অলংকারে বিস্মিত হয়েছেন। পারস্যের অমর কবি সাদী শিরাজী বলেন, "কুরআন এমন এক সমুদ্র, যেখানে প্রতিটি আয়াত মুক্তার মতো আলো ছড়ায়, আর প্রতিটি শব্দ অগাধ অর্থের বাহক।"
কুরআনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো—এটি চিন্তা ও গবেষণার আহ্বান জানায়। শুধু পাঠ নয়, পাঠের সঙ্গে সাথে গভীর অনুধ্যান, মনোযোগী ধ্যান এবং ভাবনাচিন্তার অবিচ্ছিন্ন আবর্তন এর দাবি। এ জন্যই আল্লাহ বলেন: "أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ؟"—"তারা কি কুরআনের আয়াত নিয়ে চিন্তা করে না?" অর্থাৎ, কুরআন কেবল আবেগ নয়, যুক্তি ও প্রজ্ঞার দাওয়াত। এটি কোনো মন্ত্র নয়, বরং একটি জীবন্ত সংলাপ।
আবার কুরআন বলে: "فَاقْرَؤُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ"—"তোমাদের জন্য যতটুকু সহজ হয়, তা পড়ো।" এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায় যে, কুরআন এমন এক মহাকিতাব, যা সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত, সহজ পাঠযোগ্য এবং আত্মার আহার।
আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহ লিখিতরূপে নাযিল হয়েছিল, কিন্তু কুরআন এসেছে একটি জীবন্ত শিক্ষার পদ্ধতিতে—জিবরাইল (আলাইহিস সালাম) আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষভাবে নবী করীম ﷺ-কে পাঠ শেখাতেন। এ জন্যই বলা হয়েছে, "سَنُقْرِئُكَ فَلَا تَنسَى"—"আমরা তোমাকে এমনভাবে পড়াবো, যাতে তুমি তা ভুলে না যাও।"
অবশেষে, কুরআনের প্রথম শব্দটি—"اقْرَأْ" (পড়ো)—একটি বিপ্লবী ঘোষণা, যা জানিয়ে দেয় এই ধর্মের ভিত্তি জ্ঞানে, চিন্তনে এবং ঈমানি আত্মসংশোধনে। তাই 'কুরআন' নামটি কেবল একটি অভিধানগত ব্যাখ্যা নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন, একটি চিরন্তন আহ্বান, এবং এক নিরন্তর চিন্তাময় পাঠ্যযাত্রার সূচনা।
কুরআনের রাজনীতিবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত স্পষ্ট, বাস্তবমুখী এবং চিরকালীনভাবে কার্যকর। এটি শুধু আধ্যাত্মিক কল্যাণের পাথেয় নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও মানবসমাজে ইনসাফভিত্তিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কার্যকর রূপরেখা। কুরআন এমন এক পথপ্রদর্শক, যা শুধুমাত্র বিশ্বাসীদের ইবাদত ও আখিরাতের সফলতার দিকনির্দেশনা দেয় না, বরং শাসনব্যবস্থা, সামাজিক সুবিচার, অর্থনৈতিক ভারসাম্য এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়নীতি সম্পর্কেও সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে।
আজকের বিশ্ব বহু রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতার পরেও শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল শুধু সামরিক সংঘাত নয়; বরং এটি ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, ভ্রান্ত মতবাদ এবং আত্মঘাতী জাতীয়তাবাদের নিষ্ঠুর ফল। দুই দফা ধ্বংসযজ্ঞের পর বিশ্ব এক অদৃশ্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রান্তে দাঁড়িয়ে। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অক্ষমতা, রাজনৈতিক দ্বিচারিতা এবং ‘পাওয়ার ব্লক’ সংস্কৃতির কারণে মানবজাতি আজও নিরাপত্তাহীনতার শিকার। কুরআন এই ধরনের সংকটকে "طاغوت" বা ‘অত্যাচারী কর্তৃত্বের উপাসনা’ বলে আখ্যায়িত করে।
বিশ্ব আজ অজস্র ‘ইজম’ ও মতবাদে ছিন্নভিন্ন: পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, উদারতাবাদ—যার প্রতিটিই নিজস্বভাবে কিছু সত্য ধারণ করলেও সামগ্রিকভাবে মানুষের মুক্তি ও সাম্য আনতে ব্যর্থ হয়েছে। এই মতবাদগুলো মানুষকে মানবিক গুণাবলি থেকে বিচ্যুত করে কেবল স্বার্থনির্ভর শক্তির লড়াইয়ে পরিণত করেছে। প্রতিটি মতবাদ নিজেকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অন্য মতকে দমন করে; ফলে এই দ্বন্দ্ব থেকেই জন্ম নেয় যুদ্ধ, বিভাজন এবং বৈশ্বিক অস্থিরতা।
এই বাস্তবতায় কুরআন একটি ব্যতিক্রমী পথপ্রদর্শক। এটি আইনের উৎস হিসেবে মানবের ওপর মানবের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে বলে:
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ
“ফয়সালার অধিকার তো একমাত্র আল্লাহরই।” (সূরা ইউসুফ: ৪০)
এই আয়াত একটি মৌলিক রাজনৈতিক ঘোষণাও বটে—যেখানে শাসনব্যবস্থা এবং আইনের প্রণয়ন সরাসরি আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীন। কুরআনের রাজনীতি ‘ক্ষমতার জন্য রাজনীতি’ নয়; বরং এটি হল ‘দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা’।
কুরআনের রাজনৈতিক চিন্তায় যে নীতিসমূহ ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করে তা হলো:
- আল্লাহর সার্বভৌমত্ব (Sovereignty of Allah)
- ইনসাফ ও মিযান (Justice and Balance)
- শূরা (পরামর্শভিত্তিক শাসন)
- অধিকার ও কর্তব্যের ভারসাম্য
- জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
- মুত্তাকী নেতৃত্ব এবং আমানতদার প্রশাসন
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র—মদীনার সনদ (Constitution of Madinah)—এমন একটি রাজনৈতিক দলিল, যেখানে মুসলিম, ইহুদি ও অন্যান্য গোত্রসমূহকে একটি সম্মিলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার ছায়ায় এনে সকলের অধিকার নিশ্চিত করা হয়। এই রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি ছিল ইনসাফ, নিরাপত্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, যা আজকের তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো বহু শতাব্দী পরেও নিশ্চিত করতে পারেনি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
إِنَّ اللّهَ يَأْمُرُكُمْ أَن تُؤَدُّواْ الأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُم بَيْنَ النَّاسِ أَن تَحْكُمُواْ بِالْعَدْلِ
“আল্লাহ তোমাদের আদেশ দেন—অমানত তার যথার্থ দাবিদারকে ফিরিয়ে দিতে এবং যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করো, তখন ইনসাফভিত্তিক ফয়সালা করো।” (সূরা নিসা: ৫৮)
এখন প্রশ্ন—কেন কুরআনের এই রাজনৈতিক মডেল আজ বাস্তবায়িত হয় না? কারণ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের তৈরি একটি কাঠামো, যেখানে ক্ষমতার উৎস ‘জনগণ’—এবং সেই কাঠামো মূলত আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে। ফলে আল্লাহর দেওয়া শাসননীতি ও ন্যায়বিচার সেখানে বাস্তবায়নের সুযোগ পায় না।
অথচ কুরআন যখন নাজিল হচ্ছিল, তখনও মানুষের অবস্থা আজকের মতোই ছিল—গোত্রীয় অহংকার, শোষণ, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, নারী নিপীড়ন, দুর্বলদের উপর অত্যাচার এবং বিচারবিভাগে দুর্নীতি। এই অন্ধকার থেকে মুক্তির একমাত্র পথ ছিল আল্লাহর ওহীর আলো। কুরআন সেই আলো, যা মানুষের অন্তরে প্রথম দীপ্তি জাগায়, এরপর পরিবারে, সমাজে, সর্বশেষ রাষ্ট্রে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا
“তোমরা ছিলে আগুনের গহ্বরের কিনারায়, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের তা থেকে রক্ষা করলেন।” (আলে ইমরান: ১০৩)
এ আয়াতটি কোনো কেবল অতীত স্মরণ নয়; বরং প্রতিটি যুগের জন্য একটি সতর্কবার্তা—যদি কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচ্যুত হও, তবে তোমরাও সেই আগুনের কিনারায় পৌঁছে যাবে। তাই সময় এসেছে কুরআনের রাজনীতি, ইনসাফ ও নেতৃত্বের চিন্তাকে শুধু তাফসিরের পাতায় সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তব জীবনে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে এবং নীতিনির্ধারণে ফিরিয়ে আনার।