প্রসঙ্গঃ দারুল আমান
আমরা পূর্বের পর্বগুলোতে সবিস্তারে আলোচনা করে এসেছি, যে ভূখণ্ডে ইসলামের বিধান-সংবিধান প্রতিষ্ঠিত, তা-ই দারুল ইসলাম। এর ব্যাপকতার মধ্যে যা যা অন্তর্ভুক্ত হয়—
১. দারুল হারবের কোনো শহরের অধিবাসীরা যদি ইসলাম গ্রহণ করে নিজেদের শহরেই অবস্থান করে, তবে তাদের ইসলাম গ্রহণের সময় থেকে তা দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়ে যাবে।
২. দারুল হারবের কোনো ভূমি বিজয় এবং তার ওপর ইসলামের বিধিবিধান বাস্তবায়নের ঘোষণার মাধ্যমেও দেশ দারুল ইসলাম হয়। সারাখসি রহ. বলেন, “মুসলমানরা যদি শত্রুদের কোনো ভূমি বিজয় করে এবং তাদের পূর্ণ দখলে আসে, হারবি অধিবাসীরা পলায়ন করে, তবে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করার দ্বারা তা দারুল ইসলাম হয়ে যাবে।” [শরহুস সিয়ারিল কাবির— ৩/১০০৪-১০০৬, ৪/১২৫৩, ১২৫৭; আলমাবসুত— ১০/২৩, ১১৪]
৩. দারুল হারবের কোনো শহরের অধিবাসীরা যদি মুসলমানদের সাথে ‘যিম্মাহ চুক্তি’ করে এবং মুসলমানরা তাদের অঞ্চলে ইসলামি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত করে, তবে তাও দারুল ইসলাম।
৪. সন্ধির মাধ্যমে কোনো দেশ বিজিত হলে তার ভূমি থাকবে মুসলমানদের মালিকানায় এবং হারবি অধিবাসীরা খারাজ প্রদান করে সেখানে অবস্থান করতে পারবে— এটাও দারুল ইসলাম হিসেবেই গণ্য হবে।
এই চার প্রকারের বাইরে যা-কিছু আছে, সবই দারুল হারব, অন্য শব্দে— দারুল কুফর, দারুশ শিরক। পূর্বের লেখাগুলোতে আমরা পূর্ববর্তী ইমাম ও ফকিহগণের বক্তব্য উল্লেখের পাশাপাশি উস্তাদ আব্দুল কাদির আওদার ভাষায় দারুল হারবের সুন্দর সংজ্ঞা উদ্ধৃত করেছি। তিনি বলেন, “দারুল হারব প্রত্যেক এমন অনৈসলামিক রাষ্ট্রকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা মুসলমানদের শাসনব্যবস্থার অধীনে প্রবেশ করেনি, কিবা যেখানে ইসলামের বিধান প্রকাশিত নয়। এ রাষ্ট্রগুলো একই সরকারের পরিচালনাধীন থাক কিবা ভিন্ন ভিন্ন সরকারের— সবই সমান। তার স্থায়ী নাগরিকদের মাঝে মুসলমানরা থাকা বা না থাকা সবই সমান; যতোদিন তারা ইসলামের বিধান প্রতিষ্ঠিত করতে অক্ষম থাকে।” [আততাশরিউল জিনায়ি আলইসলামি— ১/২৭৭]
আমরা আরো আলোচনা করে এসেছি— দারুল হারব মানে যুদ্ধবিদ্ধস্ত বা যুদ্ধে লিপ্ত রাষ্ট্র নয়। অনেকে ভাবেন, দারুল হারব শুধু এমন রাষ্ট্রকেই বলা হয়, যা কোনো মুসলিম ভূখণ্ডের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। বাস্তবতা এমন নয়। কোনো ভূখণ্ডে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলে তাকে দারুল ইসলাম বলা হয় (বিস্তারিত জানতে পূর্বের পর্বগুলো দ্রষ্টব্য) আর কোথাও কুফরি এবং শিরকি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলে তাকে দারুল হারব বলা হয়। দারুল হারবকে অন্য শব্দে— দারুল কুফর, দারুশ শিরক ইত্যাদিও বলা হয়। এসব পরিভাষার মাঝে কোনো বিরোধ নেই। ফকিহগণ দারুল হারবের যে সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন, তার দিকে দৃষ্টিপাত করলে বিষয়টা অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। এজন্যই সারাখসি রহ. বলেন, “দারকে আমাদের দিকে বা তাদের দিকে নিসবত করাটা মূলত ক্ষমতা এবং প্রাধান্যতার বিচারে।’’ [আলমাবসুত, সারাখসি— ১০/১১৪]
এ বিষয়টাকেই আল্লামা কাসানি রহ. আরো বিস্তারিত করে এভাবে বলেছেন, “কোনো রাষ্ট্রে কুফরের আহকাম-বিধিবিধান প্রকাশিত হলে তা দারুল কুফর হয়ে যায়।… রাষ্ট্র শুধু কুফরের বিধানাবলী প্রকাশিত হওয়ার দ্বারাই দারুল কুফর বলে গণ্য হয়।” [বাদায়িউস সানায়ি— ৯/৪৩৭৫; আরো দেখুন— আহকামুদ দিয়ার, আবিদ সুফয়ানি— ১৫]
বোঝা গেলো, কোনো রাষ্ট্র দারুল হারব (অন্য শব্দে— দারুল কুফর, দারুশ শিরক) হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার জন্য লড়াই-যুদ্ধ চলমান থাকা অপরিহার্য নয়। এজন্যই হাম্বলি ফকিহগণ বলেন, “হারবি শব্দটা হারবের দিকে সম্পর্কিত। হারব অর্থ— কিতাল (লড়াই), তেমনি এর অর্থ দূরত্ব এবং বিদ্বেষও। তো দারুল হারব অর্থ হলো এমন রাষ্ট্র, যার সাথে মুসলমানদের দূরত্ব কিবা মুসলমানদের প্রতি রয়েছে যার বিদ্বেষ। হারবিকে হারবি এই দ্বিতীয় অর্থ, তথা দূরত্ব এবং বিদ্বেষ— এর বিচারেই বলা হয়। কার্যত যুদ্ধে লিপ্ত থাকা জরুরি নয়। [আলমুতলি’ আলা আবওয়াবিল মুকনি’, বা’লি— ২২৬]
উম্মাহর ফকিহগণের আলোচনা থেকে তো স্পষ্ট অনুমিত হয়, দারুল ইসলাম এবং দারুল হারবের বাইরে আর কোনো বিভক্তি তাদের দৃষ্টিতে ছিলো না। সমগ্র পৃথিবী দু’ভাগে বিভক্ত; একভাগের নাম দারুল ইসলাম, আরেক ভাগের নামের দারুল হারব। তৃতীয় আর কিছু নেই। এ ব্যাপারে উম্মাহর বিদগ্ধ ফকিহণের ঐকমত্য রয়েছে। এখানে আমরা দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকজনের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি।
কাজি আবু ইয়া’লা রহ. বলেন, “প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড যেখানে বিজয় কুফরের নয়, ইসলামের বিধান-সংবিধানের, তা দারুল ইসলাম। আর প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড যেখানে বিজয় ইসলামের নয়, কুফরেরর বিধান-সংবিধানের, তা দারুল কুফর। ব্যতিক্রম হলো গোমরাহ কাদারিয়্যাদের বক্তব্য। তারা বলে, যে ভূখণ্ডে পাপিষ্ঠদের প্রাধান্য, কাফির বা মুসলিমদের নয়, তা দারুল কুফর নয়, দারুল ইসলামও নয়; তা হলো দারুল ফিস্*ক। এ বক্তব্যের ভিত্তি হলো, তাদের সেই মূলনীতি— ‘মানযিলাতুন বাইনাল মানযিলাতাইন’ (ইসলাম এবং কুফরের মাঝে আরেকটি স্তর)। আমাদের দলিল ইমানের অধ্যায়ে বিগত হয়েছে। শরিয়তের মুকাল্লাফ যারা তাদের তো এ কয়েকটি অবস্থাই হতে পারে—
১. কাফির
২. মুমিন— পরিপূর্ণ ইমানের অধিকারী বা ত্রুটিপূর্ণ ইমানের অধিকারী।
তো সকল মানুষ হয়তো মুমিন, কিবা কাফির। এমন তো হতে পারে না যে, কোনো শরিয়তের মুকাল্লাফ মানুষ মুমিনও নয়, আবার কাফিরও নয়। (উল্লেখ্য, মুনাফিক আলাদা কিছু নয়। তারা তো কাফিরদের সর্বনিম্ন শ্রেণি। চিরস্থায়ী জাহান্নামী। জাহান্নামের সবচে নিম্নসতরে হবে তাদের বসবাস।) তেমনিভাবে ‘দার’ও দুই অবস্থা থেকে মুক্ত হবে না। হয়তো তা দারুল কুফর হবে, কিবা তা দারুল ইসলাম হবে। {আলমু’তামাদ ফি উসুলিদ দীন, আবু ইয়া’লাঃ ২৭৬}
আল্লামা ইবনু মুফলিহ রহ. বলতেন, “প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড, যেখানে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত, তা দারুল ইসলাম। আর যদি কোনো ভূখণ্ডে কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাহলে তা দারুল কুফর। এদু’য়ের বাইরে আর কোনো দার নেই।’’ {আরো দেখুন— আহকামু আহলিয যিম্মাহ, ইবনুল কায়্যিমঃ ১/৪৭৫-৪৭৬}
হাঁ, তৃতীয় আরেকটি ‘দারে’র অস্তিত্বের বর্ণনা আমরা পাই ইউরোপীয় ও প্রাচ্যবিদ গবেষকদের কাছে। তারা এটাকে ‘দারুল আহ্*দ’ নামে, কেউ ‘দারুল আমান’ নামে, কেউ ‘দারুল মুওয়াদায়াহ’ নামে উল্লেখ করেন। {দেখুন— ইকতিশাফুল মুসলিমিন লি উরুব্বা, বার্নাড লুইসঃ ৬৯; আততাকসিমুল ইসলামি লিল মা’মুরাহ, ড. মুহিউদ্দিন কাসিম; ৪৯; মানহাজুল ইসলাম ফিল হারব ওয়াস সালাম, ড. উসমান জুমআহ যামিরিয়্যাহঃ ৫৮}
সর্বপ্রথম আমরা এই বন্টন দেখতে পাই ‘দায়িরাতুল মা’আরিফ আলইসলামিয়া’র (Islamic Encyclopedia) লেখকদের কাছে। এরপর বিদগ্ধ গবেষকদের মধ্যে এই আলোচনার সূত্রপাত করেন ড. নজিব (আশশারুদ দুওয়ালি ফিল ইসলামঃ ৫০)। তারপর একে আরো শক্তিশালী করেন শায়খ আবু যুহরা (আলআলাকাতুদ দুওয়ালিয়্যাহঃ ৫৫; নাযরিয়্যাতুল হারবঃ ১৪)। একই চিন্তা লালন করেন ড. ওয়াহবা যুহায়লি, ড. মুহাম্মাদ দাসুকি, ড. আব্দুল হামিদ আলহাজ, ড. মাজিদ, উস্তাদ আল্লাল আলফাসি আলমাগরিবি
{দেখুন— আসারুল হারবঃ ১৭৫-১৭৬; আলআলাকাতুদ দুওয়ালিয়্যাহঃ ১০৭-১০৮; আলইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান ওয়া আসারুহু ফিল ফিকহঃ ৩৩০; আননুযুমুদ দুওয়ালিয়্যাহঃ ১৮২-১৮৩; আলকানুনুদ দুওয়ালি আলইসলামিঃ ২২-২৩; মাকাসিদুশ শারিয়াহ ওয়া মাকারিমুহাঃ ২২৯}
আমাদের ইমামগণের মতে দারুল হারব দুই প্রকার।
১. এমন দারুল হারব, যার সঙ্গে মুসলমানদের কোনো চুক্তি নেই। এটা হলো দারুল খাওফ— অর্থাৎ, ভয়ের শহর। যেখানে মুসলমানরা নিরাপদ নয়।
২. এমন দারুল হারব, যার অধিবাসীরা মুসলমানদের সঙ্গে মুসলমানদের নিরাপত্তা চুক্তি করেছে। এটাকে আমরা দারুল আমান, দারুল আহদ বা দারুল মুওয়াদাআহ বলতে পারি। এই রাষ্ট্র যদিও ইসলামি রাষ্ট্র নয়, কিন্তু সেখানে চুক্তির কারণে মুসলমানরা নিরাপদ। যেমন ছিলো রাসুলের যুগে নাজাশির রাষ্ট্র হাবাশাহ (ইথিওপিয়া)।
দ্বিতীয় প্রকারটিকেও আমাদের মহান ইমামগণ দারুল হারবের মাঝেই গণ্য করেছেন। তারা এটাকে স্বতন্ত্র কোনো ‘দার’ নয়, বরং দারুল হারব গণ্য করেই এর ভিত্তিতে অনেক মাসআলা এবং ফতোয়া প্রদান করেছেন।
ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেন, “দারুল হারবের দেশসমূহের কোনো দেশের অধিবাসীরা যদি মুসলমানদের সঙ্গে এই মর্মে চুক্তবদ্ধ হয়, তারা প্রতি বছর মুসলমানদের খারাজ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ অন্য কোনো কর প্রদান কর প্রদান করবে এই শর্তে যে, মুসলমানরা তাদের ওপর ইসলামের বিধিবিধান প্রয়োগ করবে না, এবং তারা যিম্মিও হয়ে যাবে না— এরপর তাদের কেউ এই চুক্তির ভিত্তিতে অনেক ধনসম্পদ নিয়ে দারুল ইসলামের উদ্দেশে বের হয়, তাহলে সে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত।”
ইমাম সারাখসি রহ. এর ইল্লত (Cause) বর্ণনা করেন, “যে লোকটি দারুল ইসলামের উদ্দেশে বেরিয়েছে, সে তার অবস্থানুযায়ী হারবি, যিম্মি নয়, তবে সে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত। কেননা চুক্তিবদ্ধ নাগরিকদের ওপর ইসলামের বিধান প্রয়োগ হয় না। … এই চুক্তির দ্বারা তাদের দেশ দারুল ইসলাম হয়ে যায়নি, যেহেতু সেখানে ইসলামের বিধিবিধান কার্যকর করা হয়নি। তা দারুল হারবই থেকে যায়।” {আসসিয়ারুল কাবির মা’আ শরহিস সারাখসিঃ ৫/২১৫৭, ২১৬৫}
ইমাম মুহাম্মাদ রহ. আরো বলেন, “চুক্তিকারীদের কোনো নাগরিক তাদের দেশে (দারুল মুওয়াদাআহ-তে) অপর কোনো নাগরিককে হত্যা করলে তার ওপর কিসাস কার্যকর হবে না। আর যদি আমাদের রাষ্ট্রে (দারুল ইসলামে) কোনো মুসতামিন অপর কোনো মুসতামিনকে হত্যা করে, তবে তার ওপর কিসাস অপরিহার্য হবে।”
ইমাম সারাখসি রহ. এর ইল্লত (Cause) বর্ণনা করেন, “কেননা চুক্তিকারীরা ইসলামের বিধিবিধান নিজেদের ওপর অপরিহার্য করে নেয়নি। কেননা তারা চুক্তিই করেছে এই মর্মে যে, তাদের ওপর ইসলামের বিধিবিধান কার্যকর করা হবে না। তাই তাদের রাষ্ট্র পূর্বের মতো দারুল হারবই থাকবে।” {আসসিয়ারুল কাবির মা’আ শরহিস সারাখসিঃ ৫/১৮৫৭, ১৮৯৩}
তিনি আরো বলেন, “কেননা যখন তারা ইসলামের বিধানের সামনে নতি স্বীকার করেনি, তখন চুক্তি করার দ্বারা চুক্তিকারী হলেও তারা ‘হারবি’র কাতার থেকে বেরিয়ে যায়নি। তুমি দেখছো না, কৃত চুক্তির মেয়াদ গত হলেই তো পুনরায় তারা (কাট্টা) হারবিই হয়ে যাবে।” {শরহুস সিয়ারিস সগির, আলমাবসুতের অন্তর্ভুক্তঃ ১০/৮৮-৮৯, ৯৭}
আধুনিক বিশ্লেষকদের বক্তব্যের সারকথা
এবার আমরা বর্তমান বিশ্লেষকগণের বক্তব্যের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করি। সংক্ষিপ্ত পরিসরে সবার বক্তব্য উদ্ধৃত করা তো সম্ভব নয়। তাই সূত্রগুলো উল্লেখ করে দিয়েছি। কেউ চাইলে সেখান থেকে দেখে নিতে পারবে। তবে সংক্ষেপে তাদের বক্তব্যগুলোর মৌলিক কয়েকটি পয়েন্টের পর্যালোচনা উল্লেখ করার প্রয়াস পাবো।
১. তৃতীয় কোনো ‘দার’ এর অস্তিত্ব গণ্য করা মহান ইমাম এবং ফকিহণের ঐকমত্যের বিপরীত। সন্ধিকারীরা ইসলামের বিধিবিধানের অনুগত হলে তাদের রাষ্ট্র ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবেই গণ্য হবে, তাতে মুসলমানের সংখ্যা যতো কমই হোক কিবা মোটেও তাদের অস্তিত্ব না থাক। আর যদি তারা ইসলামের বিধান-সংবিধান এবং ইসলামি শাসনক্ষমতার সাথে একমত না হয়, তাহলে তা দারুল হারব। এর বাইরে আর কোনো সুরত নেই।
২. কেউ কেউ ইমাম শাফেয়ি এবং তার শাগরেদদের বক্তব্য দ্বারা এই তৃতীয় ‘দার’কে প্রমাণ করতে চান। ইমাম শাফেয়ি তো এক্ষেত্রে বড়ই মাজলুম। পূর্বের পর্বে আলোচনা করে এসেছি, একশ্রেণির অথর্ব ইমাম শাফেয়ির বক্তব্য বিকৃত করে পুরো দুনিয়াকে এক ‘দার’ হিসেবে অভিহিত করতে চায়। তারা দারুল ইসলাম এবং দারুল হারবের বিভক্তিকেই স্বীকার করে না। এই আরেক শ্রেণি তার বক্তব্যকে অপাত্রে প্রয়োগ করে, পুরো দুনিয়াকে তিন ‘দার’ বানাতে চায়। তবে মজার বিষয়, তারা তার বক্তব্যকে হুবহু উদ্ধৃত করেন না। এই অভিমতকে শুধু তার দিকে নিসবত করেই ক্ষান্ত হন। আল্লাহ জানেন, সামনে কে এসে কীভাবে আরো বিকৃত করে।
৩. কেউ কেউ তো ইমাম মুহাম্মাদ এবং কাজি আবু ইয়া’লা রহ. এর দিকেও এই সারহীন অভিমতকে নিসবত করে। ওপরে তো আমরা তাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য উল্লেখ করেই এসেছি। কাজি আবু ইয়া’লা রহ. তো পরিষ্কার ভাষায় তৃতীয় ‘দারে’র অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন।
৪. কেউ ইবনে তাইমিয়া রহ. এর একটি ফতোয়াকে কাজে লাগাতে চেয়েছেন। আমাদের এই সিরিজের তৃতীয় পর্বে আমরা সে সম্পর্কে আলোচনা করে এসেছি।
৫. কেউ মাওয়ারদি রহ. এর একটি বক্তব্য থেকে ভুল বুঝে বা অপাত্রে প্রয়োগ করেও এই মাকসাদ হাসিল করেছেন। তবে এই তৃতীয় ‘দারে’র অস্তিত্বের প্রথম ঘোষক প্রাচ্যবিদ মহোদয়গণ এতোটা বে-ইনসাফ হননি। তারা পর্যন্ত মাওয়ারদি রহ. এর বক্তব্য দ্বারা যে তৃতীয় কোনো ‘দারে’র অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না— স্বীকার করেছেন।
৬. হাবাশাকে তৃতীয় ‘দারে’র পক্ষে প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করা ইলমি অগভীরতার প্রমাণ বহন করে। কেননা হাবাশায় ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত ছিলো না, তাই তা দারুল হারব। হাঁ, সেখানে মুসলমানদেরকে নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছে। এর কারণে তা দারুল হারব থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা আমরা ওপরে বলে এসেছি, দারুল হারব দু’ধরনের— দারুল খাওফ (যেখানে মুসলমানরা নিরাপদ নয়) এবং দারুল আহদ, দারুল মুওয়াদাআহ বা দারুল আমান (যেখানে মুসলমানরা নিরাপদ)।
‘দারে’র ভিন্নতার কারণে আহকামের ভিন্নতা
‘দারে’র ভিন্নতার কারণে কি আহকামে ভিন্নতা আসে? দারুল ইসলামের বিধান এবং দারুল হারবের বিধান কি অভিন্ন থাকে না ভিন্ন হয়?
এ মাসআলার সমাধানে ইমামগণের দু’ধরনের অভিমত।
১. ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর মতে ‘দারে’র ভিন্নতা আহকামের ভিন্নতা অপরিহার্য করে। কেননা বাস্তবে কিবা হুকুমের বিচারে (এর ব্যাখ্যা সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ) ‘দার’ ভিন্ন হওয়াটা মৃত্যুর সমপর্যায়ের। আর মৃত্যু মালিকানা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তেমনি ‘দারে’র ভিন্নতাও মালিকানা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কেননা মালিকানা সাব্যস্ত হয় অধিকৃত বস্তুর ওপর কবজার দ্বারা। আর বাস্তবে কিবা হুকুমের বিচারে ‘দার’ ভিন্ন ভিন্ন হওয়া কবজার যোগ্যতা নষ্ট করে দেয়। বাস্তবে কবজা নষ্ট হয় মালিকের অধিকার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। আর হুকুমের বিচারে কবজা নষ্ট হয় ব্যক্তির হাত থেকে হস্তক্ষেপের অধিকার বিনষ্ট হওয়ার মাধ্যমে।
২. ইমাম শাফেয়িসহ অধিকাংশ ইমামের মতে ‘দারে’র ভিন্নতা আহকামে ভিন্নতা আনে না। কেননা ‘দার’ আর জায়গার তো কোনো আহকাম নেই। আহকাম তো সব আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত। আর ইসলামের দাওয়াত কাফিরদের ওপরও ব্যাপক, তারা তাদের দেশে থাক কিবা অন্য কোথাও। {তাখরিজুল ফুরু’ আলাল উসুল, যানজানি— ২৭৭-২৮৭; তাসিসুন নাযার, দাবুসি— ৭৯-৮০; বাদায়িউস সানায়ি’— ৯/৪৩৭৬}
এই ব্যাপক উসুলের আলোকে অগণিত শাখা এবং অসংখ্য মাসায়িল বের হয়। কিছু আহকাম পররাষ্ট্রনীতির সাথে সম্পৃক্ত আর কিছু স্বরাষ্ট্রনীতির সাথে সম্পৃক্ত। আমরা এখানে একটি ব্যাপক মূলনীতি এবং কয়েকটি মাসআলা আলোচনা করবো, যার বিধান ‘দারে’র ভিন্নতার কারণে পরিবর্তিত হয়।
দারুল হারবে অবস্থানরত হারবিদের সাথে মুসলমানদের আচরণ-রীতি
দারুল হারবে ‘আমান’ (নিরাপত্তা) নিয়ে প্রবেশকারী মুসলমানের আচরণ-রীতি এবং মুআমালা কেমন হবে সে সম্পর্কে ইমাম মুহাম্মাদ রহ. একটি ব্যাপক মূলনীতি বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “কোনো মুসলমান ব্যক্তি ‘আমান’ নিয়ে যখন দারুল হারবে প্রবেশ করে, তখন তার জন্য এই নিরাপত্তাচুক্তি লঙ্ঘন করা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা এবং তাদেরকে ধোঁকা দেয়া বৈধ নয়। তার ওপর অপরিহার্য তাদের সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করা, যেমনিভাবে তারা তাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করে। আর সে যখন তাদের হাতে বন্দি হিসেবে থাকবে, তখন সে ‘আমান’ গ্রহণকারী নয়। তার অধিকার আছে, সে যতো পারে তাদেরকে হত্যা করবে, যতোটুকু পারে তাদের ধনসম্পদ ছিনিয়ে নিবে।” {কিতাবুল আসল, সিয়ার অধ্যায়— ১৩৮; আসসিয়ারুল কাবির— ৪/১৪৮৬}
হানাফি ফকিহগণ ইমাম মুহাম্মাদের এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন— যখন কোনো মুসলমান ব্যবসা বা অন্য কোনো কাজে ‘আমান’ নিয়ে দারুল হারবে প্রবেশ করে, তখন তার জন্য তাদের জান মাল বা সম্মানের কোনো ক্ষতি করা বৈধ নয়। কেননা যখন সে ‘আমান’ নিয়ে প্রবেশ করেছে, তখন তার এই ‘আমানে’র মাঝেই এ বিষয়টা রয়েছে যে, সে তাদেরকে ধোঁকা দিবে না, তাদের কোনোপ্রকার ক্ষতি করবে না, তাদের মনোতুষ্টি ছাড়া তাদের মালিকানাধীন কোনোসম্পদ ভোগদখল করবে না। যখন সে এর ব্যতিক্রম করলো, তখন তো নিরাপত্তাচুক্তি লঙ্ঘন এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ হিসেবে ধর্তব্য হবে। এ তো সুস্পষ্ট হারাম। অসংখ্য নসে এর নিষিদ্ধতা বর্ণিত হয়েছে। যদি সে তাদেরকে ধোঁকা দিয়ে তাদের সম্পদ ছিনিয়ে আনে, এবং দারুল ইসলামে তা নিয়ে প্রবেশ করে তাহলে জেনেশুনে কোনো মুসলমানের জন্য তার থেকে সেই বস্তু কেনা জায়িয নয় (মাকরুহে তাহরিমি)। কেননা সে নিষিদ্ধ পন্থায় এই বস্তুর মালিকানা লাভ করেছে। এটা খাবিস উপার্জন। সদকা করার দ্বারা নিজের মালিকানা থেকে বের করে দেয়া ওয়াজিব।
তবে এই মূলনীতির থেকে ব্যতিক্রম ক্ষেত্রও রয়েছে, যখন সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া, হারবি হত্যা করা জায়িয হয়ে যায়, তবে সেক্ষেত্রেও সম্ভ্রমহানি করা যাবে না। এটা তখন, যখন কাফিরদের সরকার তাকে ধোঁকা দিয়ে বন্দি করে অথবা তার অর্থসম্পদ ছিনিয়ে নেয়, অথবা রাষ্ট্রের প্রজাদের কেউ তাকে ধোঁকা দেয়, কিন্তু সরকারপ্রধান অপরাধীকে বারণ করে না, তাহলে এটাও সরকারের সম্মতিতে সংঘটিত হয়েছে বলেই ধর্তব্য হবে, তখন এই মুসলমানের জন্য হারবিদেরকে হত্যা করা, তাদের ধনসম্পদ ছিনিয়ে নেয়া বৈধ হবে।
{দেখুন— আলমাবসুত— ১০/৬৫, ৯৬; শরহুস সিয়ারিল কাবির— ৪/১১৫-১১৬; আররাদ্দু আলা সিয়ারিল আওযায়ি— ১২৬; আলহিদায়াহ ওয়া শুরুহুহা— ৪/৩৪৭-৩৪৮; মাজমাউউল আনহুর এবং আদদুররুল মুনতাকা— ১/৬৫৫; আলফাতাওয়াল হিন্দিয়া— ২/২৩২; তাবয়িনুল হাকায়িক— ৩/২৬৬; আলফুরুক, কারাবিসি— ১/৩২৫, ৩২৭; রাদ্দুল মুহতার— ৪/১৬৬; আললুবাব শরহুল কিতাব— ৩/১৩৪-১৩৫; ইখতিলাফুল ফুকাহা, তাবারি— ৬৩, ১৯২-১৯৪}
প্রসঙ্গঃ দারুল হারবে সুদের লেনদেন
পূর্বের পোস্টে আমরা ‘দারে’র ভিন্নতার কারণে আহকামের ভিন্নতা এবং দারুল হারবে হারবিদের সাথে মুসলমানদের আচরণরীতি সম্পর্কে আলোচনা করেছি এবং সেখানে ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর বর্ণিত ব্যাপক মূলনীতি উদ্ধৃত করেছি। তার আলোকে আমরা ইনশাআল্লাহ ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি মাসআলা আলোচনা করবো। আজ আলোচ্যবিষয়— “দারুল হারবে সুদের লেনদেন”।
(উল্লেখ্য, বাংলা সুদের থেকে আরবি ‘রিবা’ শব্দটি অনেক ব্যাপক। এখানে বোঝার সুবিধার্থে সুদ শব্দ উল্লেখ করা হলো। এদুয়ের মাঝে পার্থক্য জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট স্থানে দ্রষ্টব্য।)
‘দারে’র ভিন্নতার কারণে আহকামে ভিন্নতা আসে কি না সেই ইখতিলাফের ভিত্তিতে এই মাসআলায় ইমামগণের দু’ধরনের অভিমত রয়েছে। তবে কিছু বিষয়ে তাদের সকলের ঐকমত্যও রয়েছে। মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে আমরা উভয় ফরিকের ঐকমত্যের ক্ষেত্রগুলোর দিকে একবার দৃষ্টিপাত করি।
ক. সকল ইমাম ও ফকিহের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত— দারুল ইসলামে মুসলমানের জন্য সুদি লেনদেন করা বৈধ নয়, এবং এমন স্থানেও তা বৈধ নয়, যেখানে মুসলমানদের বিধিবিধান চলে, যেমন দারুল হারবে অবস্থানরত মুসলিম সেনাদল। চাই উক্ত লেনদেন কোনো মুসলমানের সাথে করা হোক, কিবা কোনো যিম্মি বা মুসতামিন (দারুল ইসলামে অবস্থানরত নিরাপত্তাগ্রহণকারী হারবি) এর সাথে। কেননা কোনো মুসলমানের জন্য অমুসলিমদের সাথে শুধু সে লেনদেনগুলোই বৈধ, যা মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে বৈধ।
খ. তেমনি সকল ইমাম ও ফকিহের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত— দারুল হারবে কোনো মুসলমানের জন্য হারবিকে সুদ দেয়া বৈধ নয়, যেমনিভাবে দারুল ইসলামে তা বৈধ নয়। আর দারুল হারবে অবস্থানরত মুসলমানদের সাথে তার আচরণবিধি ঠিক তেমনই হবে, যেমন দারুল ইসলামে অবস্থানরত মুসলমানদের সাথে হয়। কেননা মুসলমান যেখানেই থাক, সে অবশ্যই ইসলামের বিধিবিধান মান্যকারী।
এরপর তৃতীয় বিষয়টিতে এসে ইমামগণের মাঝে মতানৈক্য হয়ে গেছে। কোনো মুসলমান যদি ‘আমান’ নিয়ে দারুল হারবে প্রবেশ করে, এরপর হারবিদের সাথে সুদি চুক্তিতে ক্রয়-বিক্রয় বা অন্য কোনো লেনদেন করে আর সে হারবিদের থেকে সুদ গ্রহণ করে— এ সুরতে ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মুহাম্মাদ, ইমাম আহমদের একটি বর্ণনা (শরহুয যারকাশি দ্রষ্টব্য, ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ঝোঁকও এই বর্ণনার দিকে অনুমিত হয়।) এবং আরো কিছু সালাফের মতে, যেমন ইবরাহিম নাখয়ি, ইবনুল মাজিশুন এবং অন্য আরো ক’জনের মতে তা বৈধ হবে।
আর অধিকাংশ ইমাম ও ফকিহের মতে তা বৈধ নয়। নিচে আমরা ইমামগণের বক্তব্য এবং উভয় ফরিকের মৌলিক দলিলগুলোর প্রতি আলোকপাত করার প্রয়াস পাবো।
ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর অভিমত
ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেন, “মুসলমান যখন ‘আমান’ নিয়ে দারুল হারবে প্রবেশ করে, তখন তার জন্য হারবিদের মনোতুষ্টির সাথে তাদের সম্পদ গ্রহণ করা বৈধ— তা যে-কোনো পন্থায়ই হোক।” {আসসিয়ারুল কাবির— ৪/১৪১০, ১৪৮৬; কিতাবুল আসল, সিয়ার অধ্যায়— ১৮১}
ইমাম সারাখসি রহ. এর ইল্লত (Cause) বর্ণনা করেন, “কেননা ‘আমান’ নিয়ে প্রবেশ করার দ্বারাই তো আর হারবিদের অর্থসম্পদ সংরক্ষিত (معصوم) হয়ে যায় না। তবে সে ‘আমান’ চুক্তির দ্বারা এ অঙ্গীকার করে নিয়েছে যে, সে খেয়ানত করবে না। এজন্য খেয়ানত থেকে বেঁচে থাকা তার ওপর অপরিহার্য। যে-কোনো পন্থায় সে তাদের মনোতুষ্ট করে অর্থসম্পদ গ্রহণ করলে সে তো বৈধ পন্থায় তা গ্রহণ করেছে বলেই বিবেচিত হবে। সে কোনো ধোঁকা-প্রতারণার তো আশ্রয় নেইনি। এজন্য তার জন্য সেই সম্পদ পবিত্র বলে বিবেচিত হবে। বন্দি এবং ‘আমান’গ্রহণকারী উভয়ের এক্ষেত্রে একই বিধান। এমনকি সে যদি এক দিরহামের বিনিময়ে দুই দিরহাম গ্রহণ করে, কিবা অর্থের বিনিময়ে মৃত বস্তু বিক্রি করে, অথবা কিমার-জুয়ার পন্থায় তাদের থেকে অর্থসম্পদ গ্রহণ করে— এ সবই তার জন্য বৈধ বলে বিবেচিত হবে।
এটা পুরোটাই ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর অভিমত।
ইমাম সুফয়ান সাওরি রহ. বলেন, বন্দি মুসলিমের জন্য তা তো বৈধ হবে; কিন্তু ‘আমান’গ্রহণকারী মুসলিমের জন্য তা বৈধ হবে না। ইমাম আবু ইউসুফ রহ. এরও একই মত।
তাদের জবাবে আমরা বলবো, বন্দির থেকে ‘আমান’গ্রহণকারীর বিধানের ভিন্নতা তো শুধু হারবিদের মনোতুষ্টি ছাড়ার অর্থসম্পদ ছিনিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে। মনোতুষ্টির সাথে অর্থসম্পদ গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘আমান’গ্রহণকারীর বিধান বন্দির মতোই। কেননা তার ওপর শুধু এতোটুকু অপরিহার্য, সে তাদেরকে ধোঁকা দিবে না। আর মনোতুষ্টির সাথে অর্থসম্পদ গ্রহণের মাঝে তো কোনো ধোঁকা নেই। {শরহুস সিয়ারিল কাবির— ৪/১৪১০-১৪১১}
ইমাম মুহাম্মাদ রহ. আরো বলেন, “আমানগ্রহণকারী যদি তাদের কাছে এক বছর মেয়াদে দুই দিরহামের বিনিময়ে এক দিরহাম বিক্রি করে, এরপর আমাদের রাষ্ট্রে চলে আসে, তারপর পুনরায় তাদের কাছে ফিরে যায় অথবা সেই বছর চলে এসে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গিয়ে দিরহাম গ্রহণ করে, তাহলে কোনোই সমস্যা নেই। কেননা মুসলমানদের বিধিবিধান ওখানে চলে না। {আসসিয়ারুল কাবির— ৪/১৪৮৬; কিতাবুল আসল, সিয়ার অধ্যায়— ১৮১; শরহু মুশকিলিল আসার, তাহাবি— ৮/২৪৮}
ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, কোনো মুসলমান যদি ‘আমান’ নিয়ে দারুল হারবে প্রবেশ করে, এরপর তাদের কাছে দুই দিরহামের বিনিময়ে এক দিরহাম বিক্রি করে, তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই। কেননা মুসলমানদের বিধিবিধান তাদের ওপর প্রয়োগ হবে না। তাই তাদের সন্তুষ্টির সাথে যে-কোনো উপায়ে তাদের সম্পদ গ্রহণ করে, তা বৈধ। {কিতাবুর রদ আলা সিয়ারিল আওযায়ি; কিতাবুর রাদ আলা মুহাম্মাদ, কিতাবুল উম— ৭/৩৭৮-৩৭৯}
এবার আমরা তাদের দলিলগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করি। এই মাসআলার ভিত্তি হাদিস আসার এবং কিয়াসের ওপর। ধারাবাহিকভাবে সবগুলো উল্লেখ করা হচ্ছে।
ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর দলিল
১ম দলিল—
ألا وإن كل ربا في الجاهلية موضوع لكم رءوس أموالكم لا تظلمون ولا تظلمون غير ربا العباس بن عبد المطلب فإنه موضوع كله
রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, শোনো, জাহেলি যুগের সুদ বিলুপ্ত। তোমরা মূলধন পাবে। তোমরা জুলুম করবে না। তোমাদের ওপরও জুলুম করা হবে না। তবে আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের সুদের কথা ভিন্ন। কেননা তা পুরোটাই বিলুপ্ত। {সহিহ মুসলিম— ১২১৮ (১৪৭); সুনানে ইবনে মাজাহ— ৩০৭৪; সুনানে তিরমিযি— ৩০৮৭। ইমাম তিরমিযি বলেন, এই হাদিসটি হাসান সহিহ।}
আব্বাস রা. এর ইসলামগ্রহণের সময় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে মতভিন্নতা রয়েছে। কেউ বলেন, তিনি বদর যুদ্ধের পূর্বে ইসলামগ্রহণ করেছেন। আর কারো বক্তব্য হলো, বদরযুদ্ধে তিনি বন্দি হয়েছেন। এরপর ইসলামগ্রহণ করেছেন। অনন্তর রাসুলুল্লাহ সা. সকলের অনুমতি নিয়ে তাকে মক্কায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। তো ইসলামগ্রহণের পর থেকে পর্যন্ত তিনি মক্কায় অবস্থানরত ছিলেন। মক্কা বিজয় পর্যন্ত সেখানে তিনি সুদি লেনদেন করতেন। অথচ সুদ হারাম হওয়ার বিধান মক্কা বিজয়ের অনেক আগেই নাযিল হয়েছে। খায়বারের দিন রাসুলুল্লাহ সা. দুই সাদ রা. (সাদ ইবনে আবি ওয়াককাস এবং সাদ ইবনে উবাদা) এর উদ্দেশ্যে বলেছেন—
أربيتما فردا
তোমরা সুদি লেনদেন করেছো। তাই ফিরিয়ে দাও। {মুয়াত্তা মালিক— ২/৬৩২; আততামহিদ— ২৪/১০৬; শরহুয যারকানি— ৩/২৭৬। উল্লেখ্য, কারো কারো বর্ণনায় দিনটিকে হুনায়নের দিন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন— গাওয়ামিযুল আসমা, ইবনে বাশকুওয়াল— ২০২}
তাছাড়া পবিত্র কোরআনের আয়াত—
ياأيُّها الَّذين آمنوا لا تأكلوا الرِّبا أضعافاً مُضاعفة
হে ইমানদারগণ, তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেও না। {সুরা আলে ইমরান— ১৩০}
এই আয়াত মক্কা বিজয়ের অনেক পূর্বে উহুদ যুদ্ধের সময়ে নাযিল হয়। এরপরও মক্কা বিজয়ের সময় রাসুলুল্লাহ সা. আব্বাস রা. এর লেনদেনগুলোকে বাতিল ঘোষণা করেননি, শুধু সেগুলো ছাড়া, যার কবজা পূর্ণ হয়নি— এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দারুল হারবে মুসলমান এবং হারবির মাঝে সুদি লেনদেন বৈধ। আর কবজা করার পূর্বেই সেই ভূমি দারুল ইসলাম হয়ে গেলে চুক্তি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। {শরহুস সিয়ারিল কাবির— ৪/১৪৮৭-১৪৮৮}
ইবনে আব্বাস রা. এর সুদ বিলুপ্তির বর্ণনার পরে ইমাম সারাখসি রহ. বলেন, “এ বিধান দেয়া হয়েছে, কেননা ইবনে আব্বাস রা. ইসিলামগ্রহণ করার পরে মক্কায় ফিরে এসেছেন আর তিনি সুদি লেনদেন করতেন। তিনি তার কাজকর্মের কথা রাসুলুল্লাহ সা. থেকে গোপন রাখতেন না। এরপরও রাসুলুল্লাহ সা. যখন তাকে তা থেকে বারণ করেননি, এটাই প্রমাণ করে যে, তা বৈধ। এর মধ্য থেকে মক্কা বিজয়ের মুহূর্ত পর্যন্ত যা কবজা করা হয়নি রাসুলুল্লাহ সা. সেগুলোকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছেন। আমাদের অভিমতও এটাই। এই আয়াতের প্রেক্ষাপটও তাই—
وذَرُوا ما بَقيَ منَ الرِّبا
তোমরা বকেয়া সুদ ছেড়ে দাও। {সুরা বাকারাহ— ২৭৮} । {দেখুন— আলমাবসুত— ১৪/৫৭}
ইমাম আবু জাফর তহাবি রহ. বলেন, “আব্বাস রা. এর ইসলামগ্রহণ খায়বার বিজয়ের পূর্বেই হয়েছিলো, যেমনতা হাজ্জাজ ইবনে ইলাত সুলামির হাদিস (দেখুন— শরহু মুশকিলিল আসার— ৮/২৪২-২৪৪; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক— ৫/৪৬৬-৪৬৯; মুসনাদে আহমাদ— ৩/১৩৮-১৩৯; বায়হাকি— ৯/১৫১) প্রমাণ করে। সে সময়ে দারুল ইসলামে মুসলমানদের ওপর সুদ হারাম ছিলো। … এরপর বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
ربا الجاهلية موضوع
“জাহেলি যুগের সুদ বিলুপ্ত”— আ বাক্যের মাঝেই প্রমাণ রয়েছে যে, মক্কা যেহেতু দারুল হারব ছিলো, তাই বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত সেখানে সুদ প্রতিষ্ঠিত ছিলো। কেননা মক্কা থেকে জাহিলিয়্যাত দূর হয়েছে তার বিজয়ের দ্বারা। রাসুলুল্লাহ সা. এর ওই বাক্যটিতে প্রমাণ রয়েছে যে, আব্বাস রা. এর সুদও কায়িম ছিলো অনন্তর রাসুলুল্লাহ সা. তা বিলুপ্ত করেছেন। কেননা তা-ই শুধু বিলুপ্ত করা যায়, যা কায়িম থাকে। যা পূর্বেই রহিত হয়ে আছে, তা বিলুপ্ত করা যায় না। খায়বার বিজয় হয়েছে সপ্তম হিজরিতে। মক্কা বিজয় হয়েছে অষ্টম হিজরিতে। আর বিদায় হজ হয়েছে দশম হিজরিতে।
এতেই প্রমাণ রয়েছে যে, মক্কা ব্জয় পর্যন্ত আব্বাস রা. এর সুদি লেনদেন অব্যাহত ছিলো। অথচ তিনি তো মুসলিম আগেই হয়েছেন। এর মাঝে এই প্রমাণও রয়ে গেছে যে, মক্কা দারুল হারব হওয়ায় সেখানে মুসলমান এবং উশরিকদের মধ্যে সুদি লেনদেন হালাল ছিলো। অথচ তখন দারুল ইসলামে তা মুসলমানদের মাঝে হারাম ছিলো। {শরহু মুশকিলিল আসার, তাহাবি— ৮/৪৪২-৪৫২; মুখতাসারু ইখতিলাফিল উলামা লিত তাহাবি, জাসসাস— ৩/৪৯২; আলমুকাদ্দিমাতুল মুমাহহিদাত— ২/৯-১০; আহকামুল কুরআন, জাসসাস— ১/৩৭১}
২য় দলিল—
মাকহুল রহ. রাসুলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেন—
لا ربا بين أهل الحرب
ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বলেন, আমার ধারণা, এরপরের শব্দটা এরূপ—
و أهل الإسلام
ইমাম সারাখসি রহ. এভাবে বর্ণনা করেছেন—
لا ربا بين المسلمين و بين أهل الحرب في دار الحرب
অর্থাৎ— দারুল হারবে মুসলমান এবং হারবিদের মাঝে কোনো সুদ নেই। {আররাদ্দু আলা সিয়ারিল আওযায়ি— ৯৭; কিতাবুল উম— ৭/৩২৬; মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, বায়হাকি— ১৩/২৭৬; নাসবুর রায়াহ— ৪/৪৪; তাকমিলাতুল মাজমু শরহুল মুহাযযাব, নববি— ১১/১৫৯; ফাতহুল কাদির— ৫/৩০০}
ইমাম সারাখসি রহ. বলেন, “এই হাদিসটি যদিও মুরসাল, তবে মাকহুল রহ. ফকিহ এবং সিকাহ। এমন ব্যক্তিত্ব থেকে মুরসাল গ্রহণীয়। দারুল হারবে হারবিদের কাছে দুই দিরহামের বিনিময়ে এক দিরহাম বিক্রি করার বৈধতার ব্যাপারে এটা ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর দলিল।” {আলমাবসুত, সারাখসি— ১৪/৫৬}
৩য় দলিল—
বনু কাইনুকার হাদিস। কেননা নবি সা. যখন তাদেরকে নির্বাসিত করেছেন, তখন তারা বললো, আমাদের কিছু ঋণ রয়েছে, যা পরিশোধের মেয়াদ এখনও আসেনি। তখন রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, নগদ দিয়ে দাও এবং (এর কারণে কিছু) কম দাও। বনু নাযির গোত্রকে নির্বাসন করার সময়ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। {আসসিয়ারুল কাবির— ৪/১৪১২}
সারাখসি রহ. বলেন, এটা তো সুবিদিত যে, এ ধরনের লেনদেন মুসলমানদের মাঝে বৈধ নয়। কেননা যার যিম্মায় নির্দিষ্ট মেয়াদে অন্য কারো ঋণ থাকে, এরপর সে নগদ দেয়ার শর্তে তা কিছুটা কমিয়ে দেয়, তাহলে এটা বৈধ নয়। উমর, যায়দ বিন সাবিত এবং ইবনে উমর রা. তা অপছন্দ করেছেন। নবিজি সা. তাদের ব্যাপারে এটার বৈধতা দিয়েছেন, কেননা তারা সেই সময়ে হারবি ছিলো। এজন্য তাদেরকে নির্বাসিত করেছেন। তো আমরা জানতে পারলাম, মুসলমান এবং হারবির মাঝে এমন সব বিষয় বৈধ, যা মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে বৈধ নয়। {শরহুস সিয়ারিল কাবির— ৪/১৪১২}
৪র্থ দলিল— কিয়াস
দারুল হারবে হারবিদের সম্পদ তো মৌলিকভাবে বৈধ। তা গ্রহণ করার অর্থ হলো অমালিকানাধীন মুবাহ সম্পদের কবজা নেয়া। ‘আমান’ গ্রহণের মাধ্যমে তা সংরক্ষিত সম্পদ হয়ে যায়নি। তবে ‘আমান’গ্রহণকারী মুসলিম দারুল হারবে পবেশের সময়ে অঙ্গীকার করে নিয়েছে যে, সে তাদেরকে ধোঁকা দিবে না, তাদের মনোতুষ্টি ছাড়া তাদের অর্থসম্পদ ভোগদখল করবে না। এখন তার জন্য এ বিষয়গুলো নিষিদ্ধ, যাতে সে ধোঁকাবাজ প্রতীয়মান না হয়। হারবি যখন স্বেচ্ছায় তার অর্থ প্রদান করলো, তখন নিষিদ্ধতার কারণ দূর হয়ে গেলো। মৌলিক বৈধতার কারণেই এক্ষেত্রে তা গ্রহণ করা বৈধ হয়েছে, সুদ হালাল— এ বিবেচনায় নয়। {আলইনায়াহ— ৫/৩০০; আলবাহরুর রায়িক— ৬/১৪৭; তাবয়িনুল হাকায়িক— ৪/৯৭; বাদায়িউস সানায়ি’— ৯/৪৩৭৮; মাজমাউল আনহুর এবং আদদুররুল মুনতাকা— ২/৮৯-৯০}
ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম মুহাম্মাদের বক্তব্যের কারণ বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে ইমাম সারাখসি রহ. বলেন, “তারা বলছেন, এ তো মনোতুষ্টির সাথে কাফিরের সম্পদ গ্রহণ। এর অর্থ— তাদের অর্থসম্পদ মৌলিক বৈধতার ওপরেই আছে। সে নিজেই অঙ্গীকার করে নিয়েছে যে, তাদের সাথে খেয়ানত করবে না। এ সকল উপায়ে সে তাদেরকে সন্তুষ্ট করে নিচ্ছে ধোঁকা-প্রতারণা থেকে দূরে থাকার জন্য। এরপর সে তাদের সম্পদ গ্রহণ করছে মৌলিক বৈধতার কারণেই, (নিষিদ্ধ) চুক্তির কারণে নয়। এর মাধ্যমেই হুকুম দারুল ইসলামে অবস্থানকারী আমানগ্রহণকারী কাফিরদের থেকে ভিন্ন হয়ে গেলো। কেননা ‘আমানে’র মাধ্যমে তাদের অর্থস্মপদ সংরক্ষিত হয়ে গেছে। বৈধতার বিচারে তা গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। {আলমাবসুত— ১০/৯৫; আলফুরুক,কারাবিসি— ১/৩২৬-৩২৭; মাজমাউল আনহুর— ২/৯০; ফাতাওয়া শামি— ৫/১৮৬}
এই হলো তাদের দলিলের প্রতি সংক্ষিপ্ত আলোকপাত। {আরো দেখুন— শরহুস সিয়ারিল কাবির— ৪/১৪৮৬; শরহু মুশকিলিল আসার, তাহাবি— ৮/২৪৮-২৪৯; মুখতাসারু ইখতিলাফিল উলামা— ৩/৪৯১; তাবয়িনুল হাকায়িক— ৪/৯৭; ফাতহুল কাদির এবং আলইনায়াহ— ৫/৩০০; আলবাহরুর রায়িক— ৬/১৪৭; মাজমাউল আনহুর— ২/৯০; আলমুকাদ্দিমাতুল মুমাহহিদাত, ইবনে রুশদ— ২/৯-১০; আলমুবদি’ শরহুল মুকনি’— ৪/১৫৭; আলইনসাফ— ৫/৫৩; আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবি— ১/৫১৬; ইখতিলাফুল ফুকাহা, তাবারি— ৫৯}
জমহুরের অভিমত
অধিকাংশ ইমাম ও ফকিহ— আবু ইউসুফ, হাসান ইবনে যিয়াদ, শাফেয়ি, মালিক, আওযায়ি, লাইস ইবনে সা’দ, আবু সাওর, আহমদ ইবনে হাম্বলের এক বর্ণনা, ইসহাক এবং অন্যান্যদের অভিমত হলো, মুসলমানের জন্য দারুল হারবে হারবিদের থেকে সুদ গ্রহণ করা জায়িয নয়। {দেখুন— প্রাগুক্ত এবং আওরাদ্দু আলা সিয়ারিল আওযায়ি, ইমাম আবু ইউসুফ— ৯৬-৯৭; কিতাবুল আসল, সিয়ার অধ্যায়— ১৮০-১৮১; কিতাবুল উম, ইমাম শাফেয়ি— ৪/১৬২-১৬৫, ১৮১-১৮২, ৭/৩২৬; তাকমিলাতুল মাজমু’— ১১/১৫৮-১৫৯; রাওযাতুত তালিবিন— ৩/৩৯৫; আলমুগনি, ইবনে কুদামা— ৪/১৭৬-১৭৭, ১০/৫০৭; কাশশাফুল কিনা’— ৩/২৫৯; মাতালিবু উলিন নুহা— ৩/১৮৯; আলমুহাল্লা— ৮/৫১৪-৫১৫; আলফুরুক, কারাফি— ৩/২০৭; হাশিয়া ইবনুশ শাত আলাল ফুরুক— ২৩১; ইখতিলাফুল ফুকাহা, তাবারি— ৬০-৬৩; মা’রিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, বায়হাকি— ১৩/২৭৬}
জমহুরের দলিল
জমহুরের দলিল তো অসংখ্য। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করছি—
১. পবিত্র কোরআনের আয়াত এবং অগণিত সহিহ হাদিসে সুদ নিষিদ্ধতার ব্যাপকতা। এসব তো কোনো জায়গা বা কোনো কাওমের সাথে বিশেষিত নয়। সর্বদা সব জায়গায় প্রযোজ্য।
২. মুসলমান যেখানেই থাক, শরিয়তের বিধান মান্যকারী থাকবে। কোনো নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা তার থেকে হক বিদূরিত করবে না, যেমন দারুশ শিরকে অবস্থান সত্ত্বেও তার থেকে নামাজের বিধান রহিত হয় না। আর ইসলামের বিধান হচ্ছে এ ধরনের কারবার-লেনদেন হারাম। যেমনিভাবে তা দারুল ইসলামে আমান নিয়ে বসবাসকারী হারবিদের সঙ্গে বৈধ নয়, তেমনি দারুল হারবের হারবিদের সঙ্গেও তা বৈধ হবে না।
৩. দারুল ইসলামে যা কিছু হারাম, তার সবই দারুল হারবেও হারাম। যেমন— মদপান, ব্যভিচার থেকে শুরু করে সকল অশ্লীলতা, পাপাচার ও গুনাহ।
৪. সুদ যেমনিভাবে মুসলমানদের জন্য হারাম, তেমনি কাফিরদের জন্যও হারাম। কেননা শরিয়তের নিষিদ্ধ এবং হারাম বিধিবিধানের মুখাতাব তারাও। কোরআনের নস দ্বারা কাফিরদের জন্যও সুদ হারাম করা হয়েছে। {এ বিষয়টা বিস্তারিত জানতে দেখুন— উসুলুস সারাখসি— ১/৭২-৭৮; তাইসিরুত তাহরির— ২/১৪৮-১৫০; আততালওয়িহ আলাত তাওযিহ— ১/২১৩-২১৫; তাফসিরে কুরতুবি— ৬/১২, ৪/১৪৬; কাশফুল আসরার— ৪/২৪৩-২৪৫; আলবুরহান, ইমামুল হারামাইন জুওয়াইনি— ১/১০৭-১১০; শরহু তানকিহিল ফুসুল, কারাফি— ১৬৬-১৬৭; আলফুরুক— ১/২১৮; নিহায়াতুস সুল— ১/৩৬৯-৩৮৩; শরহুল কাওকাবিল মুনির— ১/৫০০-৫০৫; তাখরিজুল ফুরু’ আলাল উসুল, যানজানি— ৯৮-১০০; আততামহিদ, ইসনাওয়ি— ১২৬-১৩২; আলকাওয়ায়িদ ওয়াল ফাওয়ায়িদ আলউসুলিয়্যাহ, ইবনুল লাহহাম— ৪৯-৫৭; আলমানসুর ফিল কায়ায়িদ, যারকাশি— ৩/৯৭-১০১; শরহুল মানহাজিল মুনতাখাব ইলা কাওয়ায়িদিল মাযহাব, ইমাম আহমাদ ইবনে আলী মানজুর— ২৬১-২৬৬; উসুলুল ফিকহ, শায়খ আবুন নুর যুহায়র— ১/১৮৪-১৯১}
৫. এই কারবারে গৃহীত সম্পদ ফাসিদ চুক্তির মাধ্যমে গৃহীত সম্পদ। আর ফাসিদ চুক্তি মালিকানার ফায়দা দেয় না।
৬. দারুল হারব দারুল বাগয়ি (বিদ্রোহের শহর) এর মতো, তার ওপর আদিল ইমাম (মুসলমানদের ন্যায়নিষ্ঠ শাসক) এর কোনো কতৃত্ব নেই। আর সর্বসম্মতিক্রমে দারুল বাগয়িতে সুদের লেনদেন বৈধ নয়। তেমনি দারুল হারবেও তা বৈধ হবে না।
জমহুরের পক্ষ থেকে ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম মুহাম্মাদের দলিলসমূহের খণ্ডন
১. দারুল হারবে সুদের লেনদেনের বৈধতার পক্ষে আব্বাস রা. এর ঘটনা দ্বারা দলিল পেশ করা অনেক কারণেই যুক্তিযুক্ত নয়। মৌলিক কারণ দুটো।
ক. আব্বাস রা. এর যিম্মায় সুদ ছিলো জাহেলি যুগে, তার ইসলামগ্রহণের পূর্বে। হাদিসের শব্দকে এ অর্থে গ্রহণ করাই যথেষ্ট। তিনি ইসলামগ্রহণের পরও সুদি লেনদেন অব্যাহত রেখেছেন— এমন কোনোই দলিল নেই। আর যদি মেনেও নেয়া হয় যে, ইসলামগ্রহণের পরও তিনি সুদি কায়কারবার করেছেন, তাহলে হতে পারে যে, তিনি তা হারাম হওয়ার ব্যাপারে অবগত ছিলেন না। তাই নবিজি সা. এই মূলনীতি সেদিন থেকে এই মূলনীতি স্থির করতে চেয়েছেন।
খ. আব্বাস রা. সাধারণভাবেই মুশরিকদের থেকে সুদ নিতেন। তা এজন্য করতেন না যে, দারুল ইসলামে সুদের লেনদেন অবৈধ হলেও দারুল হারবে তা বৈধ। বরং এজন্য যে, তখনও সুদ চূড়ান্তভাবে হারাম হয়নি। সুদের নিষিদ্ধতা কয়েক ধাপে অবতীর্ণ হয়েছে এবং তা পূর্ণতা লাভ করেছে এই আয়াতের মাধ্যমে—
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
হে ইমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় করো এবং বকেয়া সুদ ছেড়ে দাও। যদি মুমিন হয়ে থাকো, তবে তা করো। {সুরা বাকারাহ— ২৭৮}
এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে সাকিফ গোত্রের ইসলামগ্রহণ এবং সন্ধির পর, যা হিজরি নবম বর্ষে সংঘটিত হয়েছে; অর্থাৎ, বিদায় হজের কিছু আগের ঘটনা। এর আগে সুদের নিষিদ্ধতা অকাট্য এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত ছিলো না। এজন্য আব্বাস রা. মক্কায় মুশরিকদের সাথে সুদি লেনদেন করতেন এবং তাদের থেকে সুদ নিতেন। নবম হিজরিতে অবতীর্ণ সেই আয়াতকেই বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ সা. আরো তাকিদ করেছেন তার সেই ঐতিহাসিক বক্তব্যের দ্বারা।
২. মাকহুল রহ. থেকে বর্ণিত হাদিসটি প্রমাণিত নয়। এমনকি অনেক হানাফি আলিমও মন্তব্য করেছেন, এটা একটি মাজহুল (অজ্ঞাত) বর্ণনা, যা কোনো সহিহ, মুসনাদ কিবা নির্ভরযোগ্য কোনো কিতাবে বর্ণিত হয়নি। তাছাড়া এটি একটি মুরসাল বর্ণনা, যা হাদিস হওয়ার সম্ভাবনা রাখে মাত্র। এই সম্ভাবনাপূর্ণ একটি বর্ণনা সুদের নিষিদ্ধতার ব্যাপারে অকাট্য সব দলিলের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে না।
আর যদি এই মুরসাল বর্ণনার প্রামাণ্যতা মেনেও নেয়া হয়, তবুও হানাফিদের উসুলেই তা টিকে না। কেননা হানাফিদের উসুল হলো, খবরে ওয়াহিদের মাধ্যমে কিতাবুল্লাহর ওপর যিয়াদাহ করা জায়িয নেই। কেননা তখন এটা নসখ বলে ধর্তব্য হয়। আর খবরে ওয়াহিদ কিতাবুল্লাহ নসখ করার যোগ্যতা রাখে না।
তাছাড়া “লা রিবা” বলার দ্বারা “নাহি”ও উদ্দেশ্য হতে পারে। যেমন এই আয়ানে “নাফি” দ্বারা “নাহি” উদ্দেশ্য—
فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي الْحَجِّ
আর দলিলের মাঝে একাধিক সম্ভাবনা চলে আসলে তা দলিল হিসেবে উল্লেখ করার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।
৩. তাদের কিয়াসও এক্ষেত্রে দলিল হিসেবে টিকে না। কেননা গনিমতের মাধ্যমে তাদের অর্থসম্পদ বৈধ হওয়া তো এটা অপরিহার্য করে না যে, ফাসিদ চুক্তির মাধ্যমেও তা বৈধ হবে। এজন্যই তো হারবি নারীদেরকে বন্দি করার মাধ্যমে তারা হালাল হয়ে যায়, কিন্তু তাই বলে ফাসিদ চুক্তির মাধ্যমে তা তো বৈধ হয় না। সুদ ইসলামে নিষিদ্ধ একটি চুক্তি। সুতরাং এর দ্বারা মালিকানা লাভ হতে পারে না। তাই এটা অবৈধ পন্থায় সম্পদ আত্মসাৎ হিসেবে ধর্তব্য হবে, পবিত্র কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে যা সুস্পষ্ট ও অকাট্য হারাম।
৪. বনু নাযিরের ঘটনাকেও দলিল হিসেবে উল্লেখ করা সঙ্গত নয়। কেননা এই বর্ণনাটি এতোই দুর্বল, যা প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করার যোগ্য নয়। তাছাড়া এই দলিলে আরো একাধিক সমস্যার দিক রয়েছে। বিস্তারিত জানতে শাইখুল ইসলাম তাকি উসমানি দা. বা. প্রণীত “বুহুস ফি কাযায়া ফিকহিয়্যা মুআসিরাহ” দ্রষ্টব্য।
জমহুরের দলিল এবং ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মাদের দলিলের পর্যালোচনা সম্পর্কে জানতে ওপরের সূত্রগুলো দ্রষ্টব্য।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে দারুল হারবে হারবিদের থেকে সুদ গ্রহণের মাসআলায় জমহুরের মাযহাব যে শক্তিশালী তা প্রমাণিত হলো। তাছাড়া অনেক হানাফি ফকিহও এই অভিমতই পোষণ করেছেন। যেমন ওপরে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. এর কথা বর্ণিত হয়েছে। বিদগ্ধ হানাফি মুফতিরাও এর আলোকেই ফতোয়া দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। দু-চারজন ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মাদের মতকে অবলম্বন করেছেন। এর ভিত্তিতেই মুফতি খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানি দা. বা. ভারতে কাফিরদের থেকে সুদ নেয়া বৈধ, যেহেতু ভারত দারুল হারব— মর্মে ফতোয়া দিয়েছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞ মুফতিগণ তার এই ফতোয়া গ্রহণ করেননি।
আমরা পূর্বের পর্বগুলোতে সবিস্তারে আলোচনা করে এসেছি, যে ভূখণ্ডে ইসলামের বিধান-সংবিধান প্রতিষ্ঠিত, তা-ই দারুল ইসলাম। এর ব্যাপকতার মধ্যে যা যা অন্তর্ভুক্ত হয়—
১. দারুল হারবের কোনো শহরের অধিবাসীরা যদি ইসলাম গ্রহণ করে নিজেদের শহরেই অবস্থান করে, তবে তাদের ইসলাম গ্রহণের সময় থেকে তা দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়ে যাবে।
২. দারুল হারবের কোনো ভূমি বিজয় এবং তার ওপর ইসলামের বিধিবিধান বাস্তবায়নের ঘোষণার মাধ্যমেও দেশ দারুল ইসলাম হয়। সারাখসি রহ. বলেন, “মুসলমানরা যদি শত্রুদের কোনো ভূমি বিজয় করে এবং তাদের পূর্ণ দখলে আসে, হারবি অধিবাসীরা পলায়ন করে, তবে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করার দ্বারা তা দারুল ইসলাম হয়ে যাবে।” [শরহুস সিয়ারিল কাবির— ৩/১০০৪-১০০৬, ৪/১২৫৩, ১২৫৭; আলমাবসুত— ১০/২৩, ১১৪]
৩. দারুল হারবের কোনো শহরের অধিবাসীরা যদি মুসলমানদের সাথে ‘যিম্মাহ চুক্তি’ করে এবং মুসলমানরা তাদের অঞ্চলে ইসলামি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত করে, তবে তাও দারুল ইসলাম।
৪. সন্ধির মাধ্যমে কোনো দেশ বিজিত হলে তার ভূমি থাকবে মুসলমানদের মালিকানায় এবং হারবি অধিবাসীরা খারাজ প্রদান করে সেখানে অবস্থান করতে পারবে— এটাও দারুল ইসলাম হিসেবেই গণ্য হবে।
এই চার প্রকারের বাইরে যা-কিছু আছে, সবই দারুল হারব, অন্য শব্দে— দারুল কুফর, দারুশ শিরক। পূর্বের লেখাগুলোতে আমরা পূর্ববর্তী ইমাম ও ফকিহগণের বক্তব্য উল্লেখের পাশাপাশি উস্তাদ আব্দুল কাদির আওদার ভাষায় দারুল হারবের সুন্দর সংজ্ঞা উদ্ধৃত করেছি। তিনি বলেন, “দারুল হারব প্রত্যেক এমন অনৈসলামিক রাষ্ট্রকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা মুসলমানদের শাসনব্যবস্থার অধীনে প্রবেশ করেনি, কিবা যেখানে ইসলামের বিধান প্রকাশিত নয়। এ রাষ্ট্রগুলো একই সরকারের পরিচালনাধীন থাক কিবা ভিন্ন ভিন্ন সরকারের— সবই সমান। তার স্থায়ী নাগরিকদের মাঝে মুসলমানরা থাকা বা না থাকা সবই সমান; যতোদিন তারা ইসলামের বিধান প্রতিষ্ঠিত করতে অক্ষম থাকে।” [আততাশরিউল জিনায়ি আলইসলামি— ১/২৭৭]
আমরা আরো আলোচনা করে এসেছি— দারুল হারব মানে যুদ্ধবিদ্ধস্ত বা যুদ্ধে লিপ্ত রাষ্ট্র নয়। অনেকে ভাবেন, দারুল হারব শুধু এমন রাষ্ট্রকেই বলা হয়, যা কোনো মুসলিম ভূখণ্ডের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। বাস্তবতা এমন নয়। কোনো ভূখণ্ডে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলে তাকে দারুল ইসলাম বলা হয় (বিস্তারিত জানতে পূর্বের পর্বগুলো দ্রষ্টব্য) আর কোথাও কুফরি এবং শিরকি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলে তাকে দারুল হারব বলা হয়। দারুল হারবকে অন্য শব্দে— দারুল কুফর, দারুশ শিরক ইত্যাদিও বলা হয়। এসব পরিভাষার মাঝে কোনো বিরোধ নেই। ফকিহগণ দারুল হারবের যে সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন, তার দিকে দৃষ্টিপাত করলে বিষয়টা অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। এজন্যই সারাখসি রহ. বলেন, “দারকে আমাদের দিকে বা তাদের দিকে নিসবত করাটা মূলত ক্ষমতা এবং প্রাধান্যতার বিচারে।’’ [আলমাবসুত, সারাখসি— ১০/১১৪]
এ বিষয়টাকেই আল্লামা কাসানি রহ. আরো বিস্তারিত করে এভাবে বলেছেন, “কোনো রাষ্ট্রে কুফরের আহকাম-বিধিবিধান প্রকাশিত হলে তা দারুল কুফর হয়ে যায়।… রাষ্ট্র শুধু কুফরের বিধানাবলী প্রকাশিত হওয়ার দ্বারাই দারুল কুফর বলে গণ্য হয়।” [বাদায়িউস সানায়ি— ৯/৪৩৭৫; আরো দেখুন— আহকামুদ দিয়ার, আবিদ সুফয়ানি— ১৫]
বোঝা গেলো, কোনো রাষ্ট্র দারুল হারব (অন্য শব্দে— দারুল কুফর, দারুশ শিরক) হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার জন্য লড়াই-যুদ্ধ চলমান থাকা অপরিহার্য নয়। এজন্যই হাম্বলি ফকিহগণ বলেন, “হারবি শব্দটা হারবের দিকে সম্পর্কিত। হারব অর্থ— কিতাল (লড়াই), তেমনি এর অর্থ দূরত্ব এবং বিদ্বেষও। তো দারুল হারব অর্থ হলো এমন রাষ্ট্র, যার সাথে মুসলমানদের দূরত্ব কিবা মুসলমানদের প্রতি রয়েছে যার বিদ্বেষ। হারবিকে হারবি এই দ্বিতীয় অর্থ, তথা দূরত্ব এবং বিদ্বেষ— এর বিচারেই বলা হয়। কার্যত যুদ্ধে লিপ্ত থাকা জরুরি নয়। [আলমুতলি’ আলা আবওয়াবিল মুকনি’, বা’লি— ২২৬]
উম্মাহর ফকিহগণের আলোচনা থেকে তো স্পষ্ট অনুমিত হয়, দারুল ইসলাম এবং দারুল হারবের বাইরে আর কোনো বিভক্তি তাদের দৃষ্টিতে ছিলো না। সমগ্র পৃথিবী দু’ভাগে বিভক্ত; একভাগের নাম দারুল ইসলাম, আরেক ভাগের নামের দারুল হারব। তৃতীয় আর কিছু নেই। এ ব্যাপারে উম্মাহর বিদগ্ধ ফকিহণের ঐকমত্য রয়েছে। এখানে আমরা দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকজনের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি।
কাজি আবু ইয়া’লা রহ. বলেন, “প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড যেখানে বিজয় কুফরের নয়, ইসলামের বিধান-সংবিধানের, তা দারুল ইসলাম। আর প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড যেখানে বিজয় ইসলামের নয়, কুফরেরর বিধান-সংবিধানের, তা দারুল কুফর। ব্যতিক্রম হলো গোমরাহ কাদারিয়্যাদের বক্তব্য। তারা বলে, যে ভূখণ্ডে পাপিষ্ঠদের প্রাধান্য, কাফির বা মুসলিমদের নয়, তা দারুল কুফর নয়, দারুল ইসলামও নয়; তা হলো দারুল ফিস্*ক। এ বক্তব্যের ভিত্তি হলো, তাদের সেই মূলনীতি— ‘মানযিলাতুন বাইনাল মানযিলাতাইন’ (ইসলাম এবং কুফরের মাঝে আরেকটি স্তর)। আমাদের দলিল ইমানের অধ্যায়ে বিগত হয়েছে। শরিয়তের মুকাল্লাফ যারা তাদের তো এ কয়েকটি অবস্থাই হতে পারে—
১. কাফির
২. মুমিন— পরিপূর্ণ ইমানের অধিকারী বা ত্রুটিপূর্ণ ইমানের অধিকারী।
তো সকল মানুষ হয়তো মুমিন, কিবা কাফির। এমন তো হতে পারে না যে, কোনো শরিয়তের মুকাল্লাফ মানুষ মুমিনও নয়, আবার কাফিরও নয়। (উল্লেখ্য, মুনাফিক আলাদা কিছু নয়। তারা তো কাফিরদের সর্বনিম্ন শ্রেণি। চিরস্থায়ী জাহান্নামী। জাহান্নামের সবচে নিম্নসতরে হবে তাদের বসবাস।) তেমনিভাবে ‘দার’ও দুই অবস্থা থেকে মুক্ত হবে না। হয়তো তা দারুল কুফর হবে, কিবা তা দারুল ইসলাম হবে। {আলমু’তামাদ ফি উসুলিদ দীন, আবু ইয়া’লাঃ ২৭৬}
আল্লামা ইবনু মুফলিহ রহ. বলতেন, “প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড, যেখানে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত, তা দারুল ইসলাম। আর যদি কোনো ভূখণ্ডে কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাহলে তা দারুল কুফর। এদু’য়ের বাইরে আর কোনো দার নেই।’’ {আরো দেখুন— আহকামু আহলিয যিম্মাহ, ইবনুল কায়্যিমঃ ১/৪৭৫-৪৭৬}
হাঁ, তৃতীয় আরেকটি ‘দারে’র অস্তিত্বের বর্ণনা আমরা পাই ইউরোপীয় ও প্রাচ্যবিদ গবেষকদের কাছে। তারা এটাকে ‘দারুল আহ্*দ’ নামে, কেউ ‘দারুল আমান’ নামে, কেউ ‘দারুল মুওয়াদায়াহ’ নামে উল্লেখ করেন। {দেখুন— ইকতিশাফুল মুসলিমিন লি উরুব্বা, বার্নাড লুইসঃ ৬৯; আততাকসিমুল ইসলামি লিল মা’মুরাহ, ড. মুহিউদ্দিন কাসিম; ৪৯; মানহাজুল ইসলাম ফিল হারব ওয়াস সালাম, ড. উসমান জুমআহ যামিরিয়্যাহঃ ৫৮}
সর্বপ্রথম আমরা এই বন্টন দেখতে পাই ‘দায়িরাতুল মা’আরিফ আলইসলামিয়া’র (Islamic Encyclopedia) লেখকদের কাছে। এরপর বিদগ্ধ গবেষকদের মধ্যে এই আলোচনার সূত্রপাত করেন ড. নজিব (আশশারুদ দুওয়ালি ফিল ইসলামঃ ৫০)। তারপর একে আরো শক্তিশালী করেন শায়খ আবু যুহরা (আলআলাকাতুদ দুওয়ালিয়্যাহঃ ৫৫; নাযরিয়্যাতুল হারবঃ ১৪)। একই চিন্তা লালন করেন ড. ওয়াহবা যুহায়লি, ড. মুহাম্মাদ দাসুকি, ড. আব্দুল হামিদ আলহাজ, ড. মাজিদ, উস্তাদ আল্লাল আলফাসি আলমাগরিবি
{দেখুন— আসারুল হারবঃ ১৭৫-১৭৬; আলআলাকাতুদ দুওয়ালিয়্যাহঃ ১০৭-১০৮; আলইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান ওয়া আসারুহু ফিল ফিকহঃ ৩৩০; আননুযুমুদ দুওয়ালিয়্যাহঃ ১৮২-১৮৩; আলকানুনুদ দুওয়ালি আলইসলামিঃ ২২-২৩; মাকাসিদুশ শারিয়াহ ওয়া মাকারিমুহাঃ ২২৯}
আমাদের ইমামগণের মতে দারুল হারব দুই প্রকার।
১. এমন দারুল হারব, যার সঙ্গে মুসলমানদের কোনো চুক্তি নেই। এটা হলো দারুল খাওফ— অর্থাৎ, ভয়ের শহর। যেখানে মুসলমানরা নিরাপদ নয়।
২. এমন দারুল হারব, যার অধিবাসীরা মুসলমানদের সঙ্গে মুসলমানদের নিরাপত্তা চুক্তি করেছে। এটাকে আমরা দারুল আমান, দারুল আহদ বা দারুল মুওয়াদাআহ বলতে পারি। এই রাষ্ট্র যদিও ইসলামি রাষ্ট্র নয়, কিন্তু সেখানে চুক্তির কারণে মুসলমানরা নিরাপদ। যেমন ছিলো রাসুলের যুগে নাজাশির রাষ্ট্র হাবাশাহ (ইথিওপিয়া)।
দ্বিতীয় প্রকারটিকেও আমাদের মহান ইমামগণ দারুল হারবের মাঝেই গণ্য করেছেন। তারা এটাকে স্বতন্ত্র কোনো ‘দার’ নয়, বরং দারুল হারব গণ্য করেই এর ভিত্তিতে অনেক মাসআলা এবং ফতোয়া প্রদান করেছেন।
ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেন, “দারুল হারবের দেশসমূহের কোনো দেশের অধিবাসীরা যদি মুসলমানদের সঙ্গে এই মর্মে চুক্তবদ্ধ হয়, তারা প্রতি বছর মুসলমানদের খারাজ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ অন্য কোনো কর প্রদান কর প্রদান করবে এই শর্তে যে, মুসলমানরা তাদের ওপর ইসলামের বিধিবিধান প্রয়োগ করবে না, এবং তারা যিম্মিও হয়ে যাবে না— এরপর তাদের কেউ এই চুক্তির ভিত্তিতে অনেক ধনসম্পদ নিয়ে দারুল ইসলামের উদ্দেশে বের হয়, তাহলে সে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত।”
ইমাম সারাখসি রহ. এর ইল্লত (Cause) বর্ণনা করেন, “যে লোকটি দারুল ইসলামের উদ্দেশে বেরিয়েছে, সে তার অবস্থানুযায়ী হারবি, যিম্মি নয়, তবে সে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত। কেননা চুক্তিবদ্ধ নাগরিকদের ওপর ইসলামের বিধান প্রয়োগ হয় না। … এই চুক্তির দ্বারা তাদের দেশ দারুল ইসলাম হয়ে যায়নি, যেহেতু সেখানে ইসলামের বিধিবিধান কার্যকর করা হয়নি। তা দারুল হারবই থেকে যায়।” {আসসিয়ারুল কাবির মা’আ শরহিস সারাখসিঃ ৫/২১৫৭, ২১৬৫}
ইমাম মুহাম্মাদ রহ. আরো বলেন, “চুক্তিকারীদের কোনো নাগরিক তাদের দেশে (দারুল মুওয়াদাআহ-তে) অপর কোনো নাগরিককে হত্যা করলে তার ওপর কিসাস কার্যকর হবে না। আর যদি আমাদের রাষ্ট্রে (দারুল ইসলামে) কোনো মুসতামিন অপর কোনো মুসতামিনকে হত্যা করে, তবে তার ওপর কিসাস অপরিহার্য হবে।”
ইমাম সারাখসি রহ. এর ইল্লত (Cause) বর্ণনা করেন, “কেননা চুক্তিকারীরা ইসলামের বিধিবিধান নিজেদের ওপর অপরিহার্য করে নেয়নি। কেননা তারা চুক্তিই করেছে এই মর্মে যে, তাদের ওপর ইসলামের বিধিবিধান কার্যকর করা হবে না। তাই তাদের রাষ্ট্র পূর্বের মতো দারুল হারবই থাকবে।” {আসসিয়ারুল কাবির মা’আ শরহিস সারাখসিঃ ৫/১৮৫৭, ১৮৯৩}
তিনি আরো বলেন, “কেননা যখন তারা ইসলামের বিধানের সামনে নতি স্বীকার করেনি, তখন চুক্তি করার দ্বারা চুক্তিকারী হলেও তারা ‘হারবি’র কাতার থেকে বেরিয়ে যায়নি। তুমি দেখছো না, কৃত চুক্তির মেয়াদ গত হলেই তো পুনরায় তারা (কাট্টা) হারবিই হয়ে যাবে।” {শরহুস সিয়ারিস সগির, আলমাবসুতের অন্তর্ভুক্তঃ ১০/৮৮-৮৯, ৯৭}
আধুনিক বিশ্লেষকদের বক্তব্যের সারকথা
এবার আমরা বর্তমান বিশ্লেষকগণের বক্তব্যের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করি। সংক্ষিপ্ত পরিসরে সবার বক্তব্য উদ্ধৃত করা তো সম্ভব নয়। তাই সূত্রগুলো উল্লেখ করে দিয়েছি। কেউ চাইলে সেখান থেকে দেখে নিতে পারবে। তবে সংক্ষেপে তাদের বক্তব্যগুলোর মৌলিক কয়েকটি পয়েন্টের পর্যালোচনা উল্লেখ করার প্রয়াস পাবো।
১. তৃতীয় কোনো ‘দার’ এর অস্তিত্ব গণ্য করা মহান ইমাম এবং ফকিহণের ঐকমত্যের বিপরীত। সন্ধিকারীরা ইসলামের বিধিবিধানের অনুগত হলে তাদের রাষ্ট্র ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবেই গণ্য হবে, তাতে মুসলমানের সংখ্যা যতো কমই হোক কিবা মোটেও তাদের অস্তিত্ব না থাক। আর যদি তারা ইসলামের বিধান-সংবিধান এবং ইসলামি শাসনক্ষমতার সাথে একমত না হয়, তাহলে তা দারুল হারব। এর বাইরে আর কোনো সুরত নেই।
২. কেউ কেউ ইমাম শাফেয়ি এবং তার শাগরেদদের বক্তব্য দ্বারা এই তৃতীয় ‘দার’কে প্রমাণ করতে চান। ইমাম শাফেয়ি তো এক্ষেত্রে বড়ই মাজলুম। পূর্বের পর্বে আলোচনা করে এসেছি, একশ্রেণির অথর্ব ইমাম শাফেয়ির বক্তব্য বিকৃত করে পুরো দুনিয়াকে এক ‘দার’ হিসেবে অভিহিত করতে চায়। তারা দারুল ইসলাম এবং দারুল হারবের বিভক্তিকেই স্বীকার করে না। এই আরেক শ্রেণি তার বক্তব্যকে অপাত্রে প্রয়োগ করে, পুরো দুনিয়াকে তিন ‘দার’ বানাতে চায়। তবে মজার বিষয়, তারা তার বক্তব্যকে হুবহু উদ্ধৃত করেন না। এই অভিমতকে শুধু তার দিকে নিসবত করেই ক্ষান্ত হন। আল্লাহ জানেন, সামনে কে এসে কীভাবে আরো বিকৃত করে।
৩. কেউ কেউ তো ইমাম মুহাম্মাদ এবং কাজি আবু ইয়া’লা রহ. এর দিকেও এই সারহীন অভিমতকে নিসবত করে। ওপরে তো আমরা তাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য উল্লেখ করেই এসেছি। কাজি আবু ইয়া’লা রহ. তো পরিষ্কার ভাষায় তৃতীয় ‘দারে’র অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন।
৪. কেউ ইবনে তাইমিয়া রহ. এর একটি ফতোয়াকে কাজে লাগাতে চেয়েছেন। আমাদের এই সিরিজের তৃতীয় পর্বে আমরা সে সম্পর্কে আলোচনা করে এসেছি।
৫. কেউ মাওয়ারদি রহ. এর একটি বক্তব্য থেকে ভুল বুঝে বা অপাত্রে প্রয়োগ করেও এই মাকসাদ হাসিল করেছেন। তবে এই তৃতীয় ‘দারে’র অস্তিত্বের প্রথম ঘোষক প্রাচ্যবিদ মহোদয়গণ এতোটা বে-ইনসাফ হননি। তারা পর্যন্ত মাওয়ারদি রহ. এর বক্তব্য দ্বারা যে তৃতীয় কোনো ‘দারে’র অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না— স্বীকার করেছেন।
৬. হাবাশাকে তৃতীয় ‘দারে’র পক্ষে প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করা ইলমি অগভীরতার প্রমাণ বহন করে। কেননা হাবাশায় ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত ছিলো না, তাই তা দারুল হারব। হাঁ, সেখানে মুসলমানদেরকে নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছে। এর কারণে তা দারুল হারব থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা আমরা ওপরে বলে এসেছি, দারুল হারব দু’ধরনের— দারুল খাওফ (যেখানে মুসলমানরা নিরাপদ নয়) এবং দারুল আহদ, দারুল মুওয়াদাআহ বা দারুল আমান (যেখানে মুসলমানরা নিরাপদ)।
‘দারে’র ভিন্নতার কারণে আহকামের ভিন্নতা
‘দারে’র ভিন্নতার কারণে কি আহকামে ভিন্নতা আসে? দারুল ইসলামের বিধান এবং দারুল হারবের বিধান কি অভিন্ন থাকে না ভিন্ন হয়?
এ মাসআলার সমাধানে ইমামগণের দু’ধরনের অভিমত।
১. ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর মতে ‘দারে’র ভিন্নতা আহকামের ভিন্নতা অপরিহার্য করে। কেননা বাস্তবে কিবা হুকুমের বিচারে (এর ব্যাখ্যা সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ) ‘দার’ ভিন্ন হওয়াটা মৃত্যুর সমপর্যায়ের। আর মৃত্যু মালিকানা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তেমনি ‘দারে’র ভিন্নতাও মালিকানা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কেননা মালিকানা সাব্যস্ত হয় অধিকৃত বস্তুর ওপর কবজার দ্বারা। আর বাস্তবে কিবা হুকুমের বিচারে ‘দার’ ভিন্ন ভিন্ন হওয়া কবজার যোগ্যতা নষ্ট করে দেয়। বাস্তবে কবজা নষ্ট হয় মালিকের অধিকার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। আর হুকুমের বিচারে কবজা নষ্ট হয় ব্যক্তির হাত থেকে হস্তক্ষেপের অধিকার বিনষ্ট হওয়ার মাধ্যমে।
২. ইমাম শাফেয়িসহ অধিকাংশ ইমামের মতে ‘দারে’র ভিন্নতা আহকামে ভিন্নতা আনে না। কেননা ‘দার’ আর জায়গার তো কোনো আহকাম নেই। আহকাম তো সব আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত। আর ইসলামের দাওয়াত কাফিরদের ওপরও ব্যাপক, তারা তাদের দেশে থাক কিবা অন্য কোথাও। {তাখরিজুল ফুরু’ আলাল উসুল, যানজানি— ২৭৭-২৮৭; তাসিসুন নাযার, দাবুসি— ৭৯-৮০; বাদায়িউস সানায়ি’— ৯/৪৩৭৬}
এই ব্যাপক উসুলের আলোকে অগণিত শাখা এবং অসংখ্য মাসায়িল বের হয়। কিছু আহকাম পররাষ্ট্রনীতির সাথে সম্পৃক্ত আর কিছু স্বরাষ্ট্রনীতির সাথে সম্পৃক্ত। আমরা এখানে একটি ব্যাপক মূলনীতি এবং কয়েকটি মাসআলা আলোচনা করবো, যার বিধান ‘দারে’র ভিন্নতার কারণে পরিবর্তিত হয়।
দারুল হারবে অবস্থানরত হারবিদের সাথে মুসলমানদের আচরণ-রীতি
দারুল হারবে ‘আমান’ (নিরাপত্তা) নিয়ে প্রবেশকারী মুসলমানের আচরণ-রীতি এবং মুআমালা কেমন হবে সে সম্পর্কে ইমাম মুহাম্মাদ রহ. একটি ব্যাপক মূলনীতি বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “কোনো মুসলমান ব্যক্তি ‘আমান’ নিয়ে যখন দারুল হারবে প্রবেশ করে, তখন তার জন্য এই নিরাপত্তাচুক্তি লঙ্ঘন করা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা এবং তাদেরকে ধোঁকা দেয়া বৈধ নয়। তার ওপর অপরিহার্য তাদের সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করা, যেমনিভাবে তারা তাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করে। আর সে যখন তাদের হাতে বন্দি হিসেবে থাকবে, তখন সে ‘আমান’ গ্রহণকারী নয়। তার অধিকার আছে, সে যতো পারে তাদেরকে হত্যা করবে, যতোটুকু পারে তাদের ধনসম্পদ ছিনিয়ে নিবে।” {কিতাবুল আসল, সিয়ার অধ্যায়— ১৩৮; আসসিয়ারুল কাবির— ৪/১৪৮৬}
হানাফি ফকিহগণ ইমাম মুহাম্মাদের এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন— যখন কোনো মুসলমান ব্যবসা বা অন্য কোনো কাজে ‘আমান’ নিয়ে দারুল হারবে প্রবেশ করে, তখন তার জন্য তাদের জান মাল বা সম্মানের কোনো ক্ষতি করা বৈধ নয়। কেননা যখন সে ‘আমান’ নিয়ে প্রবেশ করেছে, তখন তার এই ‘আমানে’র মাঝেই এ বিষয়টা রয়েছে যে, সে তাদেরকে ধোঁকা দিবে না, তাদের কোনোপ্রকার ক্ষতি করবে না, তাদের মনোতুষ্টি ছাড়া তাদের মালিকানাধীন কোনোসম্পদ ভোগদখল করবে না। যখন সে এর ব্যতিক্রম করলো, তখন তো নিরাপত্তাচুক্তি লঙ্ঘন এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ হিসেবে ধর্তব্য হবে। এ তো সুস্পষ্ট হারাম। অসংখ্য নসে এর নিষিদ্ধতা বর্ণিত হয়েছে। যদি সে তাদেরকে ধোঁকা দিয়ে তাদের সম্পদ ছিনিয়ে আনে, এবং দারুল ইসলামে তা নিয়ে প্রবেশ করে তাহলে জেনেশুনে কোনো মুসলমানের জন্য তার থেকে সেই বস্তু কেনা জায়িয নয় (মাকরুহে তাহরিমি)। কেননা সে নিষিদ্ধ পন্থায় এই বস্তুর মালিকানা লাভ করেছে। এটা খাবিস উপার্জন। সদকা করার দ্বারা নিজের মালিকানা থেকে বের করে দেয়া ওয়াজিব।
তবে এই মূলনীতির থেকে ব্যতিক্রম ক্ষেত্রও রয়েছে, যখন সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া, হারবি হত্যা করা জায়িয হয়ে যায়, তবে সেক্ষেত্রেও সম্ভ্রমহানি করা যাবে না। এটা তখন, যখন কাফিরদের সরকার তাকে ধোঁকা দিয়ে বন্দি করে অথবা তার অর্থসম্পদ ছিনিয়ে নেয়, অথবা রাষ্ট্রের প্রজাদের কেউ তাকে ধোঁকা দেয়, কিন্তু সরকারপ্রধান অপরাধীকে বারণ করে না, তাহলে এটাও সরকারের সম্মতিতে সংঘটিত হয়েছে বলেই ধর্তব্য হবে, তখন এই মুসলমানের জন্য হারবিদেরকে হত্যা করা, তাদের ধনসম্পদ ছিনিয়ে নেয়া বৈধ হবে।
{দেখুন— আলমাবসুত— ১০/৬৫, ৯৬; শরহুস সিয়ারিল কাবির— ৪/১১৫-১১৬; আররাদ্দু আলা সিয়ারিল আওযায়ি— ১২৬; আলহিদায়াহ ওয়া শুরুহুহা— ৪/৩৪৭-৩৪৮; মাজমাউউল আনহুর এবং আদদুররুল মুনতাকা— ১/৬৫৫; আলফাতাওয়াল হিন্দিয়া— ২/২৩২; তাবয়িনুল হাকায়িক— ৩/২৬৬; আলফুরুক, কারাবিসি— ১/৩২৫, ৩২৭; রাদ্দুল মুহতার— ৪/১৬৬; আললুবাব শরহুল কিতাব— ৩/১৩৪-১৩৫; ইখতিলাফুল ফুকাহা, তাবারি— ৬৩, ১৯২-১৯৪}
প্রসঙ্গঃ দারুল হারবে সুদের লেনদেন
পূর্বের পোস্টে আমরা ‘দারে’র ভিন্নতার কারণে আহকামের ভিন্নতা এবং দারুল হারবে হারবিদের সাথে মুসলমানদের আচরণরীতি সম্পর্কে আলোচনা করেছি এবং সেখানে ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর বর্ণিত ব্যাপক মূলনীতি উদ্ধৃত করেছি। তার আলোকে আমরা ইনশাআল্লাহ ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি মাসআলা আলোচনা করবো। আজ আলোচ্যবিষয়— “দারুল হারবে সুদের লেনদেন”।
(উল্লেখ্য, বাংলা সুদের থেকে আরবি ‘রিবা’ শব্দটি অনেক ব্যাপক। এখানে বোঝার সুবিধার্থে সুদ শব্দ উল্লেখ করা হলো। এদুয়ের মাঝে পার্থক্য জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট স্থানে দ্রষ্টব্য।)
‘দারে’র ভিন্নতার কারণে আহকামে ভিন্নতা আসে কি না সেই ইখতিলাফের ভিত্তিতে এই মাসআলায় ইমামগণের দু’ধরনের অভিমত রয়েছে। তবে কিছু বিষয়ে তাদের সকলের ঐকমত্যও রয়েছে। মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে আমরা উভয় ফরিকের ঐকমত্যের ক্ষেত্রগুলোর দিকে একবার দৃষ্টিপাত করি।
ক. সকল ইমাম ও ফকিহের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত— দারুল ইসলামে মুসলমানের জন্য সুদি লেনদেন করা বৈধ নয়, এবং এমন স্থানেও তা বৈধ নয়, যেখানে মুসলমানদের বিধিবিধান চলে, যেমন দারুল হারবে অবস্থানরত মুসলিম সেনাদল। চাই উক্ত লেনদেন কোনো মুসলমানের সাথে করা হোক, কিবা কোনো যিম্মি বা মুসতামিন (দারুল ইসলামে অবস্থানরত নিরাপত্তাগ্রহণকারী হারবি) এর সাথে। কেননা কোনো মুসলমানের জন্য অমুসলিমদের সাথে শুধু সে লেনদেনগুলোই বৈধ, যা মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে বৈধ।
খ. তেমনি সকল ইমাম ও ফকিহের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত— দারুল হারবে কোনো মুসলমানের জন্য হারবিকে সুদ দেয়া বৈধ নয়, যেমনিভাবে দারুল ইসলামে তা বৈধ নয়। আর দারুল হারবে অবস্থানরত মুসলমানদের সাথে তার আচরণবিধি ঠিক তেমনই হবে, যেমন দারুল ইসলামে অবস্থানরত মুসলমানদের সাথে হয়। কেননা মুসলমান যেখানেই থাক, সে অবশ্যই ইসলামের বিধিবিধান মান্যকারী।
এরপর তৃতীয় বিষয়টিতে এসে ইমামগণের মাঝে মতানৈক্য হয়ে গেছে। কোনো মুসলমান যদি ‘আমান’ নিয়ে দারুল হারবে প্রবেশ করে, এরপর হারবিদের সাথে সুদি চুক্তিতে ক্রয়-বিক্রয় বা অন্য কোনো লেনদেন করে আর সে হারবিদের থেকে সুদ গ্রহণ করে— এ সুরতে ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মুহাম্মাদ, ইমাম আহমদের একটি বর্ণনা (শরহুয যারকাশি দ্রষ্টব্য, ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ঝোঁকও এই বর্ণনার দিকে অনুমিত হয়।) এবং আরো কিছু সালাফের মতে, যেমন ইবরাহিম নাখয়ি, ইবনুল মাজিশুন এবং অন্য আরো ক’জনের মতে তা বৈধ হবে।
আর অধিকাংশ ইমাম ও ফকিহের মতে তা বৈধ নয়। নিচে আমরা ইমামগণের বক্তব্য এবং উভয় ফরিকের মৌলিক দলিলগুলোর প্রতি আলোকপাত করার প্রয়াস পাবো।
ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর অভিমত
ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেন, “মুসলমান যখন ‘আমান’ নিয়ে দারুল হারবে প্রবেশ করে, তখন তার জন্য হারবিদের মনোতুষ্টির সাথে তাদের সম্পদ গ্রহণ করা বৈধ— তা যে-কোনো পন্থায়ই হোক।” {আসসিয়ারুল কাবির— ৪/১৪১০, ১৪৮৬; কিতাবুল আসল, সিয়ার অধ্যায়— ১৮১}
ইমাম সারাখসি রহ. এর ইল্লত (Cause) বর্ণনা করেন, “কেননা ‘আমান’ নিয়ে প্রবেশ করার দ্বারাই তো আর হারবিদের অর্থসম্পদ সংরক্ষিত (معصوم) হয়ে যায় না। তবে সে ‘আমান’ চুক্তির দ্বারা এ অঙ্গীকার করে নিয়েছে যে, সে খেয়ানত করবে না। এজন্য খেয়ানত থেকে বেঁচে থাকা তার ওপর অপরিহার্য। যে-কোনো পন্থায় সে তাদের মনোতুষ্ট করে অর্থসম্পদ গ্রহণ করলে সে তো বৈধ পন্থায় তা গ্রহণ করেছে বলেই বিবেচিত হবে। সে কোনো ধোঁকা-প্রতারণার তো আশ্রয় নেইনি। এজন্য তার জন্য সেই সম্পদ পবিত্র বলে বিবেচিত হবে। বন্দি এবং ‘আমান’গ্রহণকারী উভয়ের এক্ষেত্রে একই বিধান। এমনকি সে যদি এক দিরহামের বিনিময়ে দুই দিরহাম গ্রহণ করে, কিবা অর্থের বিনিময়ে মৃত বস্তু বিক্রি করে, অথবা কিমার-জুয়ার পন্থায় তাদের থেকে অর্থসম্পদ গ্রহণ করে— এ সবই তার জন্য বৈধ বলে বিবেচিত হবে।
এটা পুরোটাই ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর অভিমত।
ইমাম সুফয়ান সাওরি রহ. বলেন, বন্দি মুসলিমের জন্য তা তো বৈধ হবে; কিন্তু ‘আমান’গ্রহণকারী মুসলিমের জন্য তা বৈধ হবে না। ইমাম আবু ইউসুফ রহ. এরও একই মত।
তাদের জবাবে আমরা বলবো, বন্দির থেকে ‘আমান’গ্রহণকারীর বিধানের ভিন্নতা তো শুধু হারবিদের মনোতুষ্টি ছাড়ার অর্থসম্পদ ছিনিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে। মনোতুষ্টির সাথে অর্থসম্পদ গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘আমান’গ্রহণকারীর বিধান বন্দির মতোই। কেননা তার ওপর শুধু এতোটুকু অপরিহার্য, সে তাদেরকে ধোঁকা দিবে না। আর মনোতুষ্টির সাথে অর্থসম্পদ গ্রহণের মাঝে তো কোনো ধোঁকা নেই। {শরহুস সিয়ারিল কাবির— ৪/১৪১০-১৪১১}
ইমাম মুহাম্মাদ রহ. আরো বলেন, “আমানগ্রহণকারী যদি তাদের কাছে এক বছর মেয়াদে দুই দিরহামের বিনিময়ে এক দিরহাম বিক্রি করে, এরপর আমাদের রাষ্ট্রে চলে আসে, তারপর পুনরায় তাদের কাছে ফিরে যায় অথবা সেই বছর চলে এসে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গিয়ে দিরহাম গ্রহণ করে, তাহলে কোনোই সমস্যা নেই। কেননা মুসলমানদের বিধিবিধান ওখানে চলে না। {আসসিয়ারুল কাবির— ৪/১৪৮৬; কিতাবুল আসল, সিয়ার অধ্যায়— ১৮১; শরহু মুশকিলিল আসার, তাহাবি— ৮/২৪৮}
ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, কোনো মুসলমান যদি ‘আমান’ নিয়ে দারুল হারবে প্রবেশ করে, এরপর তাদের কাছে দুই দিরহামের বিনিময়ে এক দিরহাম বিক্রি করে, তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই। কেননা মুসলমানদের বিধিবিধান তাদের ওপর প্রয়োগ হবে না। তাই তাদের সন্তুষ্টির সাথে যে-কোনো উপায়ে তাদের সম্পদ গ্রহণ করে, তা বৈধ। {কিতাবুর রদ আলা সিয়ারিল আওযায়ি; কিতাবুর রাদ আলা মুহাম্মাদ, কিতাবুল উম— ৭/৩৭৮-৩৭৯}
এবার আমরা তাদের দলিলগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করি। এই মাসআলার ভিত্তি হাদিস আসার এবং কিয়াসের ওপর। ধারাবাহিকভাবে সবগুলো উল্লেখ করা হচ্ছে।
ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর দলিল
১ম দলিল—
ألا وإن كل ربا في الجاهلية موضوع لكم رءوس أموالكم لا تظلمون ولا تظلمون غير ربا العباس بن عبد المطلب فإنه موضوع كله
রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, শোনো, জাহেলি যুগের সুদ বিলুপ্ত। তোমরা মূলধন পাবে। তোমরা জুলুম করবে না। তোমাদের ওপরও জুলুম করা হবে না। তবে আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের সুদের কথা ভিন্ন। কেননা তা পুরোটাই বিলুপ্ত। {সহিহ মুসলিম— ১২১৮ (১৪৭); সুনানে ইবনে মাজাহ— ৩০৭৪; সুনানে তিরমিযি— ৩০৮৭। ইমাম তিরমিযি বলেন, এই হাদিসটি হাসান সহিহ।}
আব্বাস রা. এর ইসলামগ্রহণের সময় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে মতভিন্নতা রয়েছে। কেউ বলেন, তিনি বদর যুদ্ধের পূর্বে ইসলামগ্রহণ করেছেন। আর কারো বক্তব্য হলো, বদরযুদ্ধে তিনি বন্দি হয়েছেন। এরপর ইসলামগ্রহণ করেছেন। অনন্তর রাসুলুল্লাহ সা. সকলের অনুমতি নিয়ে তাকে মক্কায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। তো ইসলামগ্রহণের পর থেকে পর্যন্ত তিনি মক্কায় অবস্থানরত ছিলেন। মক্কা বিজয় পর্যন্ত সেখানে তিনি সুদি লেনদেন করতেন। অথচ সুদ হারাম হওয়ার বিধান মক্কা বিজয়ের অনেক আগেই নাযিল হয়েছে। খায়বারের দিন রাসুলুল্লাহ সা. দুই সাদ রা. (সাদ ইবনে আবি ওয়াককাস এবং সাদ ইবনে উবাদা) এর উদ্দেশ্যে বলেছেন—
أربيتما فردا
তোমরা সুদি লেনদেন করেছো। তাই ফিরিয়ে দাও। {মুয়াত্তা মালিক— ২/৬৩২; আততামহিদ— ২৪/১০৬; শরহুয যারকানি— ৩/২৭৬। উল্লেখ্য, কারো কারো বর্ণনায় দিনটিকে হুনায়নের দিন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন— গাওয়ামিযুল আসমা, ইবনে বাশকুওয়াল— ২০২}
তাছাড়া পবিত্র কোরআনের আয়াত—
ياأيُّها الَّذين آمنوا لا تأكلوا الرِّبا أضعافاً مُضاعفة
হে ইমানদারগণ, তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেও না। {সুরা আলে ইমরান— ১৩০}
এই আয়াত মক্কা বিজয়ের অনেক পূর্বে উহুদ যুদ্ধের সময়ে নাযিল হয়। এরপরও মক্কা বিজয়ের সময় রাসুলুল্লাহ সা. আব্বাস রা. এর লেনদেনগুলোকে বাতিল ঘোষণা করেননি, শুধু সেগুলো ছাড়া, যার কবজা পূর্ণ হয়নি— এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দারুল হারবে মুসলমান এবং হারবির মাঝে সুদি লেনদেন বৈধ। আর কবজা করার পূর্বেই সেই ভূমি দারুল ইসলাম হয়ে গেলে চুক্তি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। {শরহুস সিয়ারিল কাবির— ৪/১৪৮৭-১৪৮৮}
ইবনে আব্বাস রা. এর সুদ বিলুপ্তির বর্ণনার পরে ইমাম সারাখসি রহ. বলেন, “এ বিধান দেয়া হয়েছে, কেননা ইবনে আব্বাস রা. ইসিলামগ্রহণ করার পরে মক্কায় ফিরে এসেছেন আর তিনি সুদি লেনদেন করতেন। তিনি তার কাজকর্মের কথা রাসুলুল্লাহ সা. থেকে গোপন রাখতেন না। এরপরও রাসুলুল্লাহ সা. যখন তাকে তা থেকে বারণ করেননি, এটাই প্রমাণ করে যে, তা বৈধ। এর মধ্য থেকে মক্কা বিজয়ের মুহূর্ত পর্যন্ত যা কবজা করা হয়নি রাসুলুল্লাহ সা. সেগুলোকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছেন। আমাদের অভিমতও এটাই। এই আয়াতের প্রেক্ষাপটও তাই—
وذَرُوا ما بَقيَ منَ الرِّبا
তোমরা বকেয়া সুদ ছেড়ে দাও। {সুরা বাকারাহ— ২৭৮} । {দেখুন— আলমাবসুত— ১৪/৫৭}
ইমাম আবু জাফর তহাবি রহ. বলেন, “আব্বাস রা. এর ইসলামগ্রহণ খায়বার বিজয়ের পূর্বেই হয়েছিলো, যেমনতা হাজ্জাজ ইবনে ইলাত সুলামির হাদিস (দেখুন— শরহু মুশকিলিল আসার— ৮/২৪২-২৪৪; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক— ৫/৪৬৬-৪৬৯; মুসনাদে আহমাদ— ৩/১৩৮-১৩৯; বায়হাকি— ৯/১৫১) প্রমাণ করে। সে সময়ে দারুল ইসলামে মুসলমানদের ওপর সুদ হারাম ছিলো। … এরপর বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
ربا الجاهلية موضوع
“জাহেলি যুগের সুদ বিলুপ্ত”— আ বাক্যের মাঝেই প্রমাণ রয়েছে যে, মক্কা যেহেতু দারুল হারব ছিলো, তাই বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত সেখানে সুদ প্রতিষ্ঠিত ছিলো। কেননা মক্কা থেকে জাহিলিয়্যাত দূর হয়েছে তার বিজয়ের দ্বারা। রাসুলুল্লাহ সা. এর ওই বাক্যটিতে প্রমাণ রয়েছে যে, আব্বাস রা. এর সুদও কায়িম ছিলো অনন্তর রাসুলুল্লাহ সা. তা বিলুপ্ত করেছেন। কেননা তা-ই শুধু বিলুপ্ত করা যায়, যা কায়িম থাকে। যা পূর্বেই রহিত হয়ে আছে, তা বিলুপ্ত করা যায় না। খায়বার বিজয় হয়েছে সপ্তম হিজরিতে। মক্কা বিজয় হয়েছে অষ্টম হিজরিতে। আর বিদায় হজ হয়েছে দশম হিজরিতে।
এতেই প্রমাণ রয়েছে যে, মক্কা ব্জয় পর্যন্ত আব্বাস রা. এর সুদি লেনদেন অব্যাহত ছিলো। অথচ তিনি তো মুসলিম আগেই হয়েছেন। এর মাঝে এই প্রমাণও রয়ে গেছে যে, মক্কা দারুল হারব হওয়ায় সেখানে মুসলমান এবং উশরিকদের মধ্যে সুদি লেনদেন হালাল ছিলো। অথচ তখন দারুল ইসলামে তা মুসলমানদের মাঝে হারাম ছিলো। {শরহু মুশকিলিল আসার, তাহাবি— ৮/৪৪২-৪৫২; মুখতাসারু ইখতিলাফিল উলামা লিত তাহাবি, জাসসাস— ৩/৪৯২; আলমুকাদ্দিমাতুল মুমাহহিদাত— ২/৯-১০; আহকামুল কুরআন, জাসসাস— ১/৩৭১}
২য় দলিল—
মাকহুল রহ. রাসুলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেন—
لا ربا بين أهل الحرب
ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বলেন, আমার ধারণা, এরপরের শব্দটা এরূপ—
و أهل الإسلام
ইমাম সারাখসি রহ. এভাবে বর্ণনা করেছেন—
لا ربا بين المسلمين و بين أهل الحرب في دار الحرب
অর্থাৎ— দারুল হারবে মুসলমান এবং হারবিদের মাঝে কোনো সুদ নেই। {আররাদ্দু আলা সিয়ারিল আওযায়ি— ৯৭; কিতাবুল উম— ৭/৩২৬; মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, বায়হাকি— ১৩/২৭৬; নাসবুর রায়াহ— ৪/৪৪; তাকমিলাতুল মাজমু শরহুল মুহাযযাব, নববি— ১১/১৫৯; ফাতহুল কাদির— ৫/৩০০}
ইমাম সারাখসি রহ. বলেন, “এই হাদিসটি যদিও মুরসাল, তবে মাকহুল রহ. ফকিহ এবং সিকাহ। এমন ব্যক্তিত্ব থেকে মুরসাল গ্রহণীয়। দারুল হারবে হারবিদের কাছে দুই দিরহামের বিনিময়ে এক দিরহাম বিক্রি করার বৈধতার ব্যাপারে এটা ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর দলিল।” {আলমাবসুত, সারাখসি— ১৪/৫৬}
৩য় দলিল—
বনু কাইনুকার হাদিস। কেননা নবি সা. যখন তাদেরকে নির্বাসিত করেছেন, তখন তারা বললো, আমাদের কিছু ঋণ রয়েছে, যা পরিশোধের মেয়াদ এখনও আসেনি। তখন রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, নগদ দিয়ে দাও এবং (এর কারণে কিছু) কম দাও। বনু নাযির গোত্রকে নির্বাসন করার সময়ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। {আসসিয়ারুল কাবির— ৪/১৪১২}
সারাখসি রহ. বলেন, এটা তো সুবিদিত যে, এ ধরনের লেনদেন মুসলমানদের মাঝে বৈধ নয়। কেননা যার যিম্মায় নির্দিষ্ট মেয়াদে অন্য কারো ঋণ থাকে, এরপর সে নগদ দেয়ার শর্তে তা কিছুটা কমিয়ে দেয়, তাহলে এটা বৈধ নয়। উমর, যায়দ বিন সাবিত এবং ইবনে উমর রা. তা অপছন্দ করেছেন। নবিজি সা. তাদের ব্যাপারে এটার বৈধতা দিয়েছেন, কেননা তারা সেই সময়ে হারবি ছিলো। এজন্য তাদেরকে নির্বাসিত করেছেন। তো আমরা জানতে পারলাম, মুসলমান এবং হারবির মাঝে এমন সব বিষয় বৈধ, যা মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে বৈধ নয়। {শরহুস সিয়ারিল কাবির— ৪/১৪১২}
৪র্থ দলিল— কিয়াস
দারুল হারবে হারবিদের সম্পদ তো মৌলিকভাবে বৈধ। তা গ্রহণ করার অর্থ হলো অমালিকানাধীন মুবাহ সম্পদের কবজা নেয়া। ‘আমান’ গ্রহণের মাধ্যমে তা সংরক্ষিত সম্পদ হয়ে যায়নি। তবে ‘আমান’গ্রহণকারী মুসলিম দারুল হারবে পবেশের সময়ে অঙ্গীকার করে নিয়েছে যে, সে তাদেরকে ধোঁকা দিবে না, তাদের মনোতুষ্টি ছাড়া তাদের অর্থসম্পদ ভোগদখল করবে না। এখন তার জন্য এ বিষয়গুলো নিষিদ্ধ, যাতে সে ধোঁকাবাজ প্রতীয়মান না হয়। হারবি যখন স্বেচ্ছায় তার অর্থ প্রদান করলো, তখন নিষিদ্ধতার কারণ দূর হয়ে গেলো। মৌলিক বৈধতার কারণেই এক্ষেত্রে তা গ্রহণ করা বৈধ হয়েছে, সুদ হালাল— এ বিবেচনায় নয়। {আলইনায়াহ— ৫/৩০০; আলবাহরুর রায়িক— ৬/১৪৭; তাবয়িনুল হাকায়িক— ৪/৯৭; বাদায়িউস সানায়ি’— ৯/৪৩৭৮; মাজমাউল আনহুর এবং আদদুররুল মুনতাকা— ২/৮৯-৯০}
ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম মুহাম্মাদের বক্তব্যের কারণ বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে ইমাম সারাখসি রহ. বলেন, “তারা বলছেন, এ তো মনোতুষ্টির সাথে কাফিরের সম্পদ গ্রহণ। এর অর্থ— তাদের অর্থসম্পদ মৌলিক বৈধতার ওপরেই আছে। সে নিজেই অঙ্গীকার করে নিয়েছে যে, তাদের সাথে খেয়ানত করবে না। এ সকল উপায়ে সে তাদেরকে সন্তুষ্ট করে নিচ্ছে ধোঁকা-প্রতারণা থেকে দূরে থাকার জন্য। এরপর সে তাদের সম্পদ গ্রহণ করছে মৌলিক বৈধতার কারণেই, (নিষিদ্ধ) চুক্তির কারণে নয়। এর মাধ্যমেই হুকুম দারুল ইসলামে অবস্থানকারী আমানগ্রহণকারী কাফিরদের থেকে ভিন্ন হয়ে গেলো। কেননা ‘আমানে’র মাধ্যমে তাদের অর্থস্মপদ সংরক্ষিত হয়ে গেছে। বৈধতার বিচারে তা গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। {আলমাবসুত— ১০/৯৫; আলফুরুক,কারাবিসি— ১/৩২৬-৩২৭; মাজমাউল আনহুর— ২/৯০; ফাতাওয়া শামি— ৫/১৮৬}
এই হলো তাদের দলিলের প্রতি সংক্ষিপ্ত আলোকপাত। {আরো দেখুন— শরহুস সিয়ারিল কাবির— ৪/১৪৮৬; শরহু মুশকিলিল আসার, তাহাবি— ৮/২৪৮-২৪৯; মুখতাসারু ইখতিলাফিল উলামা— ৩/৪৯১; তাবয়িনুল হাকায়িক— ৪/৯৭; ফাতহুল কাদির এবং আলইনায়াহ— ৫/৩০০; আলবাহরুর রায়িক— ৬/১৪৭; মাজমাউল আনহুর— ২/৯০; আলমুকাদ্দিমাতুল মুমাহহিদাত, ইবনে রুশদ— ২/৯-১০; আলমুবদি’ শরহুল মুকনি’— ৪/১৫৭; আলইনসাফ— ৫/৫৩; আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবি— ১/৫১৬; ইখতিলাফুল ফুকাহা, তাবারি— ৫৯}
জমহুরের অভিমত
অধিকাংশ ইমাম ও ফকিহ— আবু ইউসুফ, হাসান ইবনে যিয়াদ, শাফেয়ি, মালিক, আওযায়ি, লাইস ইবনে সা’দ, আবু সাওর, আহমদ ইবনে হাম্বলের এক বর্ণনা, ইসহাক এবং অন্যান্যদের অভিমত হলো, মুসলমানের জন্য দারুল হারবে হারবিদের থেকে সুদ গ্রহণ করা জায়িয নয়। {দেখুন— প্রাগুক্ত এবং আওরাদ্দু আলা সিয়ারিল আওযায়ি, ইমাম আবু ইউসুফ— ৯৬-৯৭; কিতাবুল আসল, সিয়ার অধ্যায়— ১৮০-১৮১; কিতাবুল উম, ইমাম শাফেয়ি— ৪/১৬২-১৬৫, ১৮১-১৮২, ৭/৩২৬; তাকমিলাতুল মাজমু’— ১১/১৫৮-১৫৯; রাওযাতুত তালিবিন— ৩/৩৯৫; আলমুগনি, ইবনে কুদামা— ৪/১৭৬-১৭৭, ১০/৫০৭; কাশশাফুল কিনা’— ৩/২৫৯; মাতালিবু উলিন নুহা— ৩/১৮৯; আলমুহাল্লা— ৮/৫১৪-৫১৫; আলফুরুক, কারাফি— ৩/২০৭; হাশিয়া ইবনুশ শাত আলাল ফুরুক— ২৩১; ইখতিলাফুল ফুকাহা, তাবারি— ৬০-৬৩; মা’রিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, বায়হাকি— ১৩/২৭৬}
জমহুরের দলিল
জমহুরের দলিল তো অসংখ্য। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করছি—
১. পবিত্র কোরআনের আয়াত এবং অগণিত সহিহ হাদিসে সুদ নিষিদ্ধতার ব্যাপকতা। এসব তো কোনো জায়গা বা কোনো কাওমের সাথে বিশেষিত নয়। সর্বদা সব জায়গায় প্রযোজ্য।
২. মুসলমান যেখানেই থাক, শরিয়তের বিধান মান্যকারী থাকবে। কোনো নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা তার থেকে হক বিদূরিত করবে না, যেমন দারুশ শিরকে অবস্থান সত্ত্বেও তার থেকে নামাজের বিধান রহিত হয় না। আর ইসলামের বিধান হচ্ছে এ ধরনের কারবার-লেনদেন হারাম। যেমনিভাবে তা দারুল ইসলামে আমান নিয়ে বসবাসকারী হারবিদের সঙ্গে বৈধ নয়, তেমনি দারুল হারবের হারবিদের সঙ্গেও তা বৈধ হবে না।
৩. দারুল ইসলামে যা কিছু হারাম, তার সবই দারুল হারবেও হারাম। যেমন— মদপান, ব্যভিচার থেকে শুরু করে সকল অশ্লীলতা, পাপাচার ও গুনাহ।
৪. সুদ যেমনিভাবে মুসলমানদের জন্য হারাম, তেমনি কাফিরদের জন্যও হারাম। কেননা শরিয়তের নিষিদ্ধ এবং হারাম বিধিবিধানের মুখাতাব তারাও। কোরআনের নস দ্বারা কাফিরদের জন্যও সুদ হারাম করা হয়েছে। {এ বিষয়টা বিস্তারিত জানতে দেখুন— উসুলুস সারাখসি— ১/৭২-৭৮; তাইসিরুত তাহরির— ২/১৪৮-১৫০; আততালওয়িহ আলাত তাওযিহ— ১/২১৩-২১৫; তাফসিরে কুরতুবি— ৬/১২, ৪/১৪৬; কাশফুল আসরার— ৪/২৪৩-২৪৫; আলবুরহান, ইমামুল হারামাইন জুওয়াইনি— ১/১০৭-১১০; শরহু তানকিহিল ফুসুল, কারাফি— ১৬৬-১৬৭; আলফুরুক— ১/২১৮; নিহায়াতুস সুল— ১/৩৬৯-৩৮৩; শরহুল কাওকাবিল মুনির— ১/৫০০-৫০৫; তাখরিজুল ফুরু’ আলাল উসুল, যানজানি— ৯৮-১০০; আততামহিদ, ইসনাওয়ি— ১২৬-১৩২; আলকাওয়ায়িদ ওয়াল ফাওয়ায়িদ আলউসুলিয়্যাহ, ইবনুল লাহহাম— ৪৯-৫৭; আলমানসুর ফিল কায়ায়িদ, যারকাশি— ৩/৯৭-১০১; শরহুল মানহাজিল মুনতাখাব ইলা কাওয়ায়িদিল মাযহাব, ইমাম আহমাদ ইবনে আলী মানজুর— ২৬১-২৬৬; উসুলুল ফিকহ, শায়খ আবুন নুর যুহায়র— ১/১৮৪-১৯১}
৫. এই কারবারে গৃহীত সম্পদ ফাসিদ চুক্তির মাধ্যমে গৃহীত সম্পদ। আর ফাসিদ চুক্তি মালিকানার ফায়দা দেয় না।
৬. দারুল হারব দারুল বাগয়ি (বিদ্রোহের শহর) এর মতো, তার ওপর আদিল ইমাম (মুসলমানদের ন্যায়নিষ্ঠ শাসক) এর কোনো কতৃত্ব নেই। আর সর্বসম্মতিক্রমে দারুল বাগয়িতে সুদের লেনদেন বৈধ নয়। তেমনি দারুল হারবেও তা বৈধ হবে না।
জমহুরের পক্ষ থেকে ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম মুহাম্মাদের দলিলসমূহের খণ্ডন
১. দারুল হারবে সুদের লেনদেনের বৈধতার পক্ষে আব্বাস রা. এর ঘটনা দ্বারা দলিল পেশ করা অনেক কারণেই যুক্তিযুক্ত নয়। মৌলিক কারণ দুটো।
ক. আব্বাস রা. এর যিম্মায় সুদ ছিলো জাহেলি যুগে, তার ইসলামগ্রহণের পূর্বে। হাদিসের শব্দকে এ অর্থে গ্রহণ করাই যথেষ্ট। তিনি ইসলামগ্রহণের পরও সুদি লেনদেন অব্যাহত রেখেছেন— এমন কোনোই দলিল নেই। আর যদি মেনেও নেয়া হয় যে, ইসলামগ্রহণের পরও তিনি সুদি কায়কারবার করেছেন, তাহলে হতে পারে যে, তিনি তা হারাম হওয়ার ব্যাপারে অবগত ছিলেন না। তাই নবিজি সা. এই মূলনীতি সেদিন থেকে এই মূলনীতি স্থির করতে চেয়েছেন।
খ. আব্বাস রা. সাধারণভাবেই মুশরিকদের থেকে সুদ নিতেন। তা এজন্য করতেন না যে, দারুল ইসলামে সুদের লেনদেন অবৈধ হলেও দারুল হারবে তা বৈধ। বরং এজন্য যে, তখনও সুদ চূড়ান্তভাবে হারাম হয়নি। সুদের নিষিদ্ধতা কয়েক ধাপে অবতীর্ণ হয়েছে এবং তা পূর্ণতা লাভ করেছে এই আয়াতের মাধ্যমে—
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
হে ইমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় করো এবং বকেয়া সুদ ছেড়ে দাও। যদি মুমিন হয়ে থাকো, তবে তা করো। {সুরা বাকারাহ— ২৭৮}
এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে সাকিফ গোত্রের ইসলামগ্রহণ এবং সন্ধির পর, যা হিজরি নবম বর্ষে সংঘটিত হয়েছে; অর্থাৎ, বিদায় হজের কিছু আগের ঘটনা। এর আগে সুদের নিষিদ্ধতা অকাট্য এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত ছিলো না। এজন্য আব্বাস রা. মক্কায় মুশরিকদের সাথে সুদি লেনদেন করতেন এবং তাদের থেকে সুদ নিতেন। নবম হিজরিতে অবতীর্ণ সেই আয়াতকেই বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ সা. আরো তাকিদ করেছেন তার সেই ঐতিহাসিক বক্তব্যের দ্বারা।
২. মাকহুল রহ. থেকে বর্ণিত হাদিসটি প্রমাণিত নয়। এমনকি অনেক হানাফি আলিমও মন্তব্য করেছেন, এটা একটি মাজহুল (অজ্ঞাত) বর্ণনা, যা কোনো সহিহ, মুসনাদ কিবা নির্ভরযোগ্য কোনো কিতাবে বর্ণিত হয়নি। তাছাড়া এটি একটি মুরসাল বর্ণনা, যা হাদিস হওয়ার সম্ভাবনা রাখে মাত্র। এই সম্ভাবনাপূর্ণ একটি বর্ণনা সুদের নিষিদ্ধতার ব্যাপারে অকাট্য সব দলিলের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে না।
আর যদি এই মুরসাল বর্ণনার প্রামাণ্যতা মেনেও নেয়া হয়, তবুও হানাফিদের উসুলেই তা টিকে না। কেননা হানাফিদের উসুল হলো, খবরে ওয়াহিদের মাধ্যমে কিতাবুল্লাহর ওপর যিয়াদাহ করা জায়িয নেই। কেননা তখন এটা নসখ বলে ধর্তব্য হয়। আর খবরে ওয়াহিদ কিতাবুল্লাহ নসখ করার যোগ্যতা রাখে না।
তাছাড়া “লা রিবা” বলার দ্বারা “নাহি”ও উদ্দেশ্য হতে পারে। যেমন এই আয়ানে “নাফি” দ্বারা “নাহি” উদ্দেশ্য—
فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي الْحَجِّ
আর দলিলের মাঝে একাধিক সম্ভাবনা চলে আসলে তা দলিল হিসেবে উল্লেখ করার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।
৩. তাদের কিয়াসও এক্ষেত্রে দলিল হিসেবে টিকে না। কেননা গনিমতের মাধ্যমে তাদের অর্থসম্পদ বৈধ হওয়া তো এটা অপরিহার্য করে না যে, ফাসিদ চুক্তির মাধ্যমেও তা বৈধ হবে। এজন্যই তো হারবি নারীদেরকে বন্দি করার মাধ্যমে তারা হালাল হয়ে যায়, কিন্তু তাই বলে ফাসিদ চুক্তির মাধ্যমে তা তো বৈধ হয় না। সুদ ইসলামে নিষিদ্ধ একটি চুক্তি। সুতরাং এর দ্বারা মালিকানা লাভ হতে পারে না। তাই এটা অবৈধ পন্থায় সম্পদ আত্মসাৎ হিসেবে ধর্তব্য হবে, পবিত্র কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে যা সুস্পষ্ট ও অকাট্য হারাম।
৪. বনু নাযিরের ঘটনাকেও দলিল হিসেবে উল্লেখ করা সঙ্গত নয়। কেননা এই বর্ণনাটি এতোই দুর্বল, যা প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করার যোগ্য নয়। তাছাড়া এই দলিলে আরো একাধিক সমস্যার দিক রয়েছে। বিস্তারিত জানতে শাইখুল ইসলাম তাকি উসমানি দা. বা. প্রণীত “বুহুস ফি কাযায়া ফিকহিয়্যা মুআসিরাহ” দ্রষ্টব্য।
জমহুরের দলিল এবং ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মাদের দলিলের পর্যালোচনা সম্পর্কে জানতে ওপরের সূত্রগুলো দ্রষ্টব্য।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে দারুল হারবে হারবিদের থেকে সুদ গ্রহণের মাসআলায় জমহুরের মাযহাব যে শক্তিশালী তা প্রমাণিত হলো। তাছাড়া অনেক হানাফি ফকিহও এই অভিমতই পোষণ করেছেন। যেমন ওপরে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. এর কথা বর্ণিত হয়েছে। বিদগ্ধ হানাফি মুফতিরাও এর আলোকেই ফতোয়া দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। দু-চারজন ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মাদের মতকে অবলম্বন করেছেন। এর ভিত্তিতেই মুফতি খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানি দা. বা. ভারতে কাফিরদের থেকে সুদ নেয়া বৈধ, যেহেতু ভারত দারুল হারব— মর্মে ফতোয়া দিয়েছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞ মুফতিগণ তার এই ফতোয়া গ্রহণ করেননি।