নেফাকির সেকাল একাল
نحمده ونصلي على رسوله الكريم اما بعد
বুখারী শরীফের একটি হাদীসে এসেছে
- عن حذيفة رضي الله تعالي عنه قال إنما كان النفاق على عهد النبي صلي الله عليه وسلم فأما اليوم فإنما هو الكفر بعد الإيمان
- অর্থ: হযরত হুযাইফা রাঃ আনহু হতে বর্ণিত:নিশ্চয় নেফাক ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায়, সুতরাং এখন (বর্তমানে) শুধু রয়েছে ঈমানের পর কুফর।(অর্থাৎ: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় যেরূপ মুনাফেক ছিল সেরকম মুনাফেক বর্তমানে নেই)।
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় এভাবে বলেন যে,
- قال إبن التين كان المنافقون على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم آمنوا بألسنتهم ولم توءمن قلوبهم وانا من جاء بعدهم فإنه ولد في الإسلام وعلى فطرته فمن كفر منهم فهو مرتد ولذلك إختلف الحمام المنافقين والمرتدين إنتهي؛ والذي يظهر ان حذيفة رضي الله عنه لم يرد نفي الوقوع وإنما أراد نفي إتفاق الحكم لأن النفاق إظهار الإيمان و إخفاء الكفر و وجود ذلك ممكن في كل عصر وإنما إختلف الحكم لأن النبي صلي الله عليه وسلم كان ليتألفهم ويقبل ما أظهروه من الإسلام ولو ظهر منهم إحتمال خلافه وأما بعده اى بعد النبي صلي الله عليه وسلم فمن أظهر شيئا فإنه يوءاخذ به ولا يترك لمصلحة التألف لعدم الإحتاج إلى ذلك
- অর্থ: ইবনুত ত্বীন রহঃ বলেন: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় মুনাফেক ছিল যারা মুখে ঈমান আনতো অন্তরে না। সুতরাং যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানার পর আসবে ( মুনাফেকদর মত মুখে ঈমান ও অন্তরে বিদ্বেষ রেখে) নিশ্চয় সে ইসলামের ফিতরত তথা স্বভাবের উপর জন্মগ্রহণ করেছে। সুতরাং তাদের মধ্যে হতে যে( ইসলাম ও ইসলামের ফিতরতের উপর জন্মগ্রহণ করার পর) কুফরি করবে সে হবে মুরতাদ।আর (মুনাফেক মুরতাদ ভিন্ন বিষয়) এই কারণে মুনাফেক ও মুরতাদের বিধান ভিন্ন হয়েছে।
- এখানে এটি স্পষ্ট যে,হুযাইফা রাঃ বাস্তবে(মুনাফেক) না পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেননি বরং মুনাফেকের বিধান ভিন্ন সেটার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। কেননা নিফাক হচ্ছে: ঈমান প্রকাশ ও কুফর গোপন করার নাম।আর এমনটি প্রত্যেক যুগে পাওয়া যাওয়া সম্ভব।আর হুকুম ভিন্ন হওয়ার কারণ হল: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রতি কোমল ছিলেন এবং ইসলামের যা তারা (যবানে) প্রকাশ করতো তা গ্রহণ করতেন। যদিও তাদের থেকে উহার বিপরীত সম্ভাবনা প্রকাশ পেত। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর যে কেউ (নেফাকির) কিছু প্রকাশ করবে নিশ্চয় সে পাকড়াও হবে। এবং (তাকে) কোমলতার মাসলাহাত/ কল্যাণের কারণে ছাড় দেওয়া হবে না। কেননা (এখন আর) ছাড় দেয়ার প্রয়োজন (বাকি) নেই।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি রহঃ বলেন:
- السادس ما قاله حذيفة ذهب النفاق وإنما كان النفاق علي عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم ولكنه الكفر بعد الإيمان فإن الإسلام شاع وتوالد الناس عليه فمن نافق بان أظهر الإسلام وأبطن خلافه فهو مرتد
- ষষ্ঠম: হুযায়ফা রাঃ যেটি বলেছেন যে,নেফাক দূর হয়ে গেছে নিশ্চয় নেফাক তো ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় এখন তো হচ্ছে ঈমানের পর কুফর। কেননা নিশ্চয় ইসলাম প্রসার হয়ে গেছে এবং মানুষ ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করছে, সুতরাং যে ব্যক্তি ইসলাম প্রকাশ এবং উহার বিপরীত (তথা কুফরী) বিষয়কে গোপন করার মাধ্যমে মুনাফেকি করবে সে হবে মুরতাদ।
তিনি আরো বলেন:
إنما هو الكفر" لأن المسلم إذا أبطن الكفر صار مرتدا هذه ظاهرة
- إنما هو الكفر (এর ব্যাখ্যায় বলেন, নিশ্চয় মুসলিম যখন কুফর গোপন করে তখন সে মুরতাদ হয়ে যায়।এটি (إنما هو الكفر) উহার প্রকাশ্য বা জাহেরী অর্থ।
আল্লামা ইবনে কাছীর রহঃ এভাবে বলেন:
- ومنها ما قال بعضهم أنه لم يقتلهم لأنه أى النبى صلى الله عليه و سلم كان يخاف من شرهم مع وجوده عليه السلام بين أظهرهم يتلو عليهم آيات الله مبينات،فأما بعده فيقتلون إذا أظهروا النفاق وعلمه المسلمون،قال مالك: المنافق في عهد رسول الله عليه السلام هو الزنديق اليوم
- কতক ব্যক্তি বলেন: রাসুল(সাঃ) তাদের (মুনাফেক) হত্যা করেননি কেননা রাসুল (সাঃ) তাদের মাঝে উপস্হিত ছিলেন,আল্লাহ তাআলার আয়াতসমূহ স্পষ্ট করে তাদের প্রতি বর্ননা করছিলেন।তথাপি তিনি তাদের (মুনাফেকদের) থেকে ক্ষতির ভয় করতেন।কিন্তু উনার (মৃত্যুর) পর যখন মুনাফিকরা নেফাক প্রকাশ করবে এবং মুসলমানগণ তা জানতে পারবে তখন তাকে হত্যা করবে।মালেক রহঃ বলেন: রাসুল (সাঃ) এর যামানার মুনাফেক হচ্ছে বর্তমানে জিন্দিক।
- أنواع النفاق: قال إبن رجب: النفاق في الشرع ينقسم إلى قسمين ،الأول: النفاق الأكبر،وهو أن يظهر الإنسان الإيمان بالله وملاءكته و كتبه ورسله واليوم الآخر و يبطن مايناقص ذلك كله أو بعضه،وهذا هو النفاق الذى كان على عهد رسول الله صلى الله عليه و سلم ونزل القرآن بذم أهله وتكفيرهم، وأخبر أنهم فالدرك الأسفل من النار، والثاني: النفاق الأصغر أو نفاق العمل،وهو أن يظهر الإسلام علانية صالحة ويبطن ما يخالف ذلك،
- (১) বড় নিফাক বলা হয় যে,মানুষ আল্লাহ তাআলা,তার ফেরেস্তা,কিতাবসমূহ,তেনার রাসুলগণ ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান প্রকাশ করে।আর ঐ সমস্ত কিছু বা কিছু বিষয়কে ভংগো করে এমন বিষয় গোপন করে।এটিই সেই নিফাক যা রাসুল (সাঃ) এর যামানায় ছিল,আর এসব ব্যক্তিদের প্রতি তিরস্কার ও তাকফীর করে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।কুরআন এই সংবাদ দিয়েছে যে,নিশ্চয় তারা জাহান্নামের অতল গহ্বরে অবস্হান করবে।
- (২)ছোট নিফাক: বলা হয় যে,মানুষ ভালো হওয়াটা প্রকাশ করে এবং উহার বিপরীতটা গোপন করে।
- الزنديق عند جمهور الفقهاء إظهار الإسلام و إبطان الكفر، فالزنديق هو من يظهر الإسلام ويبطن الكفر،قال الدسوقى: وهو المسمى فى الصدر الأول منافقا و يسميه الفقهاء زنديقا
- জমহুর ফুকাহাদের মত অনুযায়ী যানদাকা বা নাস্তিকতা হচ্ছে:ইসলাম প্রকাশ এবং কুফর গোপন করা।সুতরাং যিন্দিক হচ্ছে যে ইসলাম প্রকাশ করে এবং কুফর গোপন করে।ইমাম দুসুকি রহঃ বলেন: এমন ব্যক্তিকে প্রথম( তথা রাসুল (সাঃ) এর) যামানায় মুনাফিক বলা হতো এবং তাকেই (বর্তমানে) ফকীহগন যিন্দিক তথা নাস্তিক বলে নামকরণ করেছেন।
- المنافق ........وفي الإصطلاح:هو الذى يظهر الإسلام ويبطن الكفر،فالمنافق كانوا في عهد النبي وقد أخبر الله تعالى نبيه بهم،وخذلهم،وجميعهم بادوا في تلك الآونة،أما الآن فلا يطلق المنافق على أحد يظن أنه يبطن الكفر،إنما يطلق عليه الملحد أو الزنديق
- মুনাফিক..…...... পরিভাষায় ঐ ব্যক্তিকে বলে যে,ইসলাম প্রকাশ করে।সুতরাং মুনাফেক তারা রাসুল (সাঃ) এর যামানায় ছিল,আল্লাহ তাআলা উনার নবীকে তাদের ব্যাপারে জানিয়েছেন,তাদের অপমানিত করেছেন,এবং তাদের(মুনাফেকদের) সকলে ঐসময়(তথা রাসুল সাঃ এর যামানায়) ধ্বংস হয়েছে।কিন্তু এখন (বর্তমানে)
- যদি কারো ব্যাপারে ধারনা হয় যে সে কুফর গোপন করছে এমন কাউকে মুনাফিক বলা যাবেনা।বরং তাকে মুলহিদ ও যিন্দিক বলা হবে।
- شرح مقاصد میں علامہ تفتازانی اقسام کفر کی اسطرح تفصیل نقل فرماۓ ہیں : یہ بات ظاہر ہو چکی ہے کہ اس شخص کا نام ہے،جو مؤمن نہ ہو،پہر اگر وہ ظاہر میں ایمان کا مدعی ہوں تو اسکو منافق کہیگے ....... اور اگر نبی علیہ السلام کی نبوت کے اقرار اور شعار اسلام نماز،روزہ وغیرہ کے اظہار کے ساتھ ایسے عقائد دلی رکھتا ہوں،جو بالاتفاق کفر ہیں تو اسکو زندیق کہا جاتاہے،(ترجمہ عبارت شرح مقاصد : .....) ومثله فى كلية ابي البقاء:٥٥٣
- زنديق کی تعریف میں جو عقائد کفریہ دل میں رکھنا ذکر کیا گیا ہ،اس کا مطلب یہ نہیں کہ وہ مثل منافق کے اپنا عقیدہ ظاہر نہیں کرتا،بلکہ ہی مراد ہےکہ اپنے عقیدۂ کفریہ کو ملمع کرکے اسلامی صورت میں ظاہر کرتا ہے،كما ذكره الشامى حيث قال:فإن الزنديق يموه كفره ويروحج عقيدته الفاسدة ويخرجها في الصورة الصحيحة وهذا معنى إبطان الكفر فلاينافى إظهار الدعوى،
- আল্লামা তাফতাযানি রহঃ শরহে মাকাসেদের মধ্যে কুফরের প্রকারসমূহ এভাবে বিস্তারিতভাবে বর্ননা করেছেন যে,"এটা প্রকাশিত কথা যে,ঐব্যক্তির নাম যে মুমিন নয়।অতপর যদি সে প্রকাশ্যভাবে ঈমানের দাবি করে তাহলে তার নাম মুনাফেক বলা হবে।......এবং যদি নবী(সাঃ) কে স্বীকার করে এবং নামায রোযা ইত্যাদি প্রকাশের সাথে সাথে অন্তরে এমন কিছু বিশ্বাস রাখে যেটি সর্বসম্মতিক্রমে কুফর তাহলে তাকে যিন্দিক বলা হবে।
- যিন্দিকের সংজ্ঞায় অন্তরে কুফরী আক্বীদা রাখার কথা বলা হয়েছে উহার উদ্দেশ্য এটা নয় যে,সে মুনাফেকের মত নিজের আক্বীদা প্রকাশ করেনা,বরং উদ্দেশ্য ইহা যে,নিজ কুফরি আক্বীদাকে ইসলামের ঢংয়ে সাজিয়ে প্রকাশ করে।যেমনটি আল্লামা শামী রহঃ বলেছেন: যে,নিশ্চয় যিন্দিক তার কুফরি মুখে প্রকাশ করে এবং সঠিক পদ্ধতির মত করে তার ভ্রান্ত আক্বীদার প্রসার ঘটায়,আর এটিই হচ্ছে তার(যিন্দিকের) কুফর গোপন করা(অর্থাৎ:এখানে ইসলামের ঢংয়ে সাজিয়ে প্রকাশ করে কুফর লুকানোর চেষ্টা করাকে বলা হয়েছে إبطان كفر বা কুফর লুকানো।
এরকম ব্যখ্যা নাসরুল বারী শরহে বুখারীর ৪৩১/১২ তেও করা হয়েছে।(ইসলামিয়া কুতুবখানা হতে প্রকাশিত)
এব্যাপারে ভারতের প্রথিতযশা আলেমেদ্বীন আল্লামা খালেদ সাইফুল্লাহ রহমানী সাহেব বলেন:
- عنوان:زنديق:زنديق وه شخص ہےجو اپنا مسلمان ہونا ظاہر کرتا ہو اور بباطن کافر ہو،گویا عہد نبوت میں جنکو منافق کہا جاتا تھا فی زمانہ وہی زندیق کہلائیں گے
- যিন্দিক ঐ ব্যক্তি যে নিজের মুসলমান হওয়াকে প্রকাশ করে এবং গোপনে সে কাফের।সুতরাং রাসুল সাঃ এর যামানায় যাদেরকে মুনাফিক বলা হতো বর্তমানে তাদেরকেই যিন্দিক বলা হবে।
অর্থাৎ সারকথা হলো রাসুল সাঃ এর যামানায় যাদের মুনাফিক বলা হতো(যেমন মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই) তারাই হচ্ছে বর্তমানের যিন্দিক/ নাস্তিক, এরাই হচ্ছে এযুগের আবদুল্লাহ ইবনে উবাই।তবে যে হাদিসে বলা হয়েছে যে,মুনাফিকির আলামত ৩/৪টা সেটা দ্বারা উদ্দশ্য হচ্ছে আমলগতভাবে সে মুনাফিক সাব্যস্ত হবে যদি ঐ আলামত গুলো পাওয়া যায়।কিন্তু এখানে যে নেফাকির আলোচনা করা হয়েছে সেটা আমলি নেফাক নয় ই'তেকাদি তথা বিশ্বাসগত নিফাক।আর এই বিশ্বাসগত নিফাকধারী ব্যক্তিকে তাকফীর করা হবে অর্থাৎ সে কাফে্য সাব্যস্ত হবে।এমন কাফের বিধান হচ্ছে ইসলামী শাসন থাকে তাহলে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার গ্রেফতারের পূর্বে যদি তাওবা করে তাহলে তা গ্রহন করা হবে।কিন্তু গ্রেফতারের পর তাওবা করলে তা গ্রহণ করা হবে না।।এখানে কিছু রেফারেন্স উল্লেখ করে দিচ্ছি অনুসন্ধানি ভাইয়েরা দেখে নিতে পারেন।
- ১/ফতোয়ায়ে শামী,৩৭০/৬,কিতাবুল জিহাদ,মাকতাবাতুয যাকারিয়া
- ২/তাবয়ীনুল হাকায়েক শরহে কানযুদ দাকায়েক,১৭২/৪,বাবুল মুরতাদ্দিন,মাকতাবাতুয যাকারিয়া
- ৩/ফাতহুল কাদীর,৬৬/৬,বাবু আহকামিল মুরতাদ্দিন,আল মাকযাবাতুল আশরাফিয়া।
পরিশেষে বলবো "রাসুল সাঃ এর জামানায় মুনাফেক ছিল বর্তমানে রয়েছে ঈমানের পর কুফর" এর অর্থ হলো সেঈ সময়ের মুনাফেক যারা ছিল তাদের মত মুনাফেকদের বর্তমানে বলা হবে যিন্দিক,আর এই নিফাকি দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ই'তেকাদি বা বিশ্বাসগত নিফাক।তবে আমলী মুনাফেক সর্ব যামানায় ছিল আছে এবং থাকবে।
- (বিঃদ্রঃ: এটি একটি ইলমি আলোচনা, আশা করি এই আলোচনা অনেক ভাইয়ের বিভিন্ন বিষয়ে বুঝতে অনেকটা সহায়ক হবে ইনশাআল্লাহ)