আমেরিকার অবক্ষয়ঃ আলো ক্রমে আসিতেছে!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারাবিশ্বে নিজেদের আধিপত্য পাকাপোক্ত করার জন্য আমেরিকা তিনটি সংস্থা স্থাপনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দিয়েছিল।
সংস্থাটি তিনটি হচ্ছে- বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ ও ন্যাটো।
পাশাপাশি মার্কিন প্রশাসন খুব দ্রুত ওয়ার্ল্ড রিজার্ভ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) ও ওয়ার্ল্ড চেম্বার অফ কমার্স (বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা)-র উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে।
এই পাঁচটি সংস্থার নেতৃত্বে থাকার কারণে মার্কিন প্রশাসন সারাবিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্য শাসনব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখার সরাসরি ক্ষমতা লাভ করে।
তাদের প্রণয়ন করা নীতিগুলোকে মার্কিন সুশাসন ও সমৃদ্ধির একটি সর্বজনীন রেসিপি হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে।
যেমনটা অর্থনীতিবিদ জন উইলিয়ামসন বলেছেন, “দশকের পর দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধরেই নিয়েছে, তারাই বিশ্বের আদর্শ-নির্ধারক। ওয়াশিংটন কী চায়, তার উপরই বৈশ্বিক নীতি নির্ধারিত হবে এবং ‘মার্কিনী শ্রেষ্ঠত্ব’ সকল নীতি-নৈতিকতার মূল- এটা তাদের বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।”
আর, যারাই এই বিশ্বাসে আঘাত আনবে বা আনার চেষ্টা করবে তাদের কঠোর হাতে দমন করার অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আছে।
যদিও আমেরিকার কথা চিন্তা করলেই তাদের সামরিক আগ্রাসনের কথা সর্বপ্রথম স্মরণে আসে। কিন্তু, এই ‘অবিশ্বাসীদের’ (যারা আমেরিকানদের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করে না) দমনের জন্য মার্কিন প্রশাসন আরো অনেক জঘন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।
যেমন- অর্থনৈতিক অবরোধ, বাণিজ্যিক অবরোধ, মানবিক অনুদান স্থগিত ইত্যাদি। ১৯৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাকের ওপর অবরোধ আরোপে তেমনি একটি ঘটনা।
শুধু যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে মার্কিনিরা তাদের আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করে, এমনটা নয়। মাঝে মাঝে তারা মিত্র রাষ্ট্রগুলোর দিকেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর রাখে।
উদাহরণ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কথাই ধরা যায়। নির্বাচনের পূর্বে তার নাবালকসুলভ আচরণের কারনে কেউ কল্পনা করেনি যে, সে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদে নির্বাচিত হবে। কিন্তু সে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছে মিত্র মার্কিন প্রশাসনের পরোক্ষ মদদে। অল্প কিছুদিন আগেও জনসনের অসংখ্য অযোগ্যতা, মহামারিতে মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ও অর্থনৈতিক মন্দাকে মানুষ গায়ে মাখছিল না এবং তাঁকে সমর্থন দিয়ে আসছিল। কিন্তু একটি সাধারণ কারণে জনসনের জনসমর্থনে অবশেষে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। কারণটি হলো, তিনি এবং তাঁর সরকার মার্কিন প্রশাসনের সাধারণ নিয়মের ও স্বার্থের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন।
যাই হোক, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার এবং ২০ বছর ধরে চলমান কথিত “সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে” ক্রমাগত প্রতিরোধের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা ‘সামরিক শ্রেষ্ঠত্বে’র মিডিয়া-সৃষ্ট আবরণ বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া এক্ষেত্রে আরও ভূমিকা পালন করেছে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তাদের হস্তক্ষেপের হতাশাজনক পরিণতি, ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে অপসারণের পরে তাদের দ্বারা সে দেশের ক্ষমতা কাঠামোর অবলোপন, ১৯৭৯-এ ইরানে খোমেনি শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে ব্যর্থতা এবং ১৯৭৫-এ ভিয়েতনামে বামপন্থীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কৌশলগত ব্যর্থতা ইত্যাদি। এই তালিকায় অবশ্যই যুক্ত আছে ‘আরব বসন্ত’-এর বিষয়টিও।
আমেরিকার নীতি-নির্ধারকরা বুঝতে পেরেছে যে, এই যুদ্ধগুলোর ফলে শুধুমাত্র তাদের সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে তা নয়; বরং এতে মার্কিন প্রশাসন ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আফগানিস্তানে সামরিক পরাজয়ের পর মার্কিন প্রশাসনের এটা উপলব্ধি করতে বেশি সময় লাগনি যে, তারা খুব দ্রুতই চীনের কাছে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে পরাস্ত হতে চলেছে।
কেননা, যখন আফগানিস্তান ও ইরাকে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ আমেরিকা পুরোপুরি মগ্ন ছিল; তখন চীন অর্থনৈতিক সুবিধাকে ব্যবহার করে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে মনোনিবেশ করে। ফলে এই রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে চীনের ভূরাজনৈতিক বলয়ে প্রবেশ করছে। চীন ক্রমেই তার ভূরাজনৈতিক প্রভাব-বলয়ের পরিধি প্রসারিত করছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের মতে, – “গত এক দশকে মার্কিনীদের তৈরি করা বিশ্বায়ন, শিল্পনীতি এবং রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ একটি ‘বেইজিং কনসেনসাস’-এর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।”
অনেক বৈশ্বিক নিয়ম নির্ধারণী সংস্থা, যা একসময় ইউরোপীয় এবং আমেরিকান প্রাধান্যের ওপর চলত, তারা এখন চীনা নেতাদের ওপর ক্রমে নির্ভরশীল হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন এবং ইন্টারন্যাশনাল ইলেকট্রো টেকনিক্যাল কমিশন অন্তর্ভুক্ত।
একসময় বৈশ্বিক পুঁজি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ছিল একতরফা আধিপত্য। এখন সেই অবস্থা আর নেই। বৈশ্বিক পর্যায়ে বিনিয়োগযোগ্য সবচেয়ে বড় অঙ্কের তহবিল রয়েছে চীনের হাতে। বিশ্বের বৃহৎ ১০ ব্যাংকের অর্ধেকের কাছাকাছি মালিকানা রয়েছে হংকংসহ চীনা কোম্পানির হাতে। বিকল্প বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রক্রিয়া যে অনেক দূর এগিয়েছে- তা এখন অনেকটাই স্পষ্ট।
সবচেয়ে বড় কথা চীনা বাজারের আধিপত্য এড়ানো খুব সহজ নয়। অধিকাংশ দেশ আমেরিকার সঙ্গে না জড়িয়ে চীনের সঙ্গে অধিক মাত্রায় বাণিজ্য সম্পর্কে জড়াচ্ছে। এমনকি আমেরিকার অগ্রণী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য আবার চালু করার জন্য আর্জি জানাচ্ছে।
বিশ্ববাজারে ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের কারণে চীনের তৈরি নিয়মকানুন ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করেছে। এই সব নিয়মের প্রতি পশ্চিমারা প্রতিশ্রুতিশীল থাকবে কি না, তা একটি জরুরি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য কিছু পশ্চিমা সরকার প্রচলিত ‘নিয়মভিত্তিক অনুশাসন’ (মিশ্র অনুশাসন)-এর আদলে বৈশিক নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা পুনর্বিন্যাসের কথা চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, শি জিং পিংয়ের চীনা নীতির সঙ্গে পশ্চিমাদের নীতির মধ্যে সমঝোতা ঘটানোর কোনো উপায় বের করা যায় কি না, সে বিষয়ে তারা চিন্তাভাবনা করছে।
যদিও সেই ভাবনার সঙ্গে বাইডেনের যুক্তরাষ্ট্র একেবারেই একমত নয়। সে কারণেই সম্প্রতি শেষ হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলনে চীন ও রাশিয়ার মতো কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কড়া বার্তা দিয়েছে।
তবে আসন্ন ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি প্রণয়ণের ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র তথা পশ্চিমাদের হাতে থেকে অপসারিত হয়ে চীন ও তার সঙ্গীদের নাগালে চলে আসতে পারে- তার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু, বৈশ্বিক নীতি নির্ধারণের আসনে পশ্চিমারা (আমেরিকা ও তার মিত্ররা) থাকুক অথবা প্রাচ্যের ক্ষমতাধর দেশগুলোর হাতে- তাতে মুসলিম উম্মাহর কোন কল্যাণ নিহিত নয়।
মুসলিমদের জন্য করণীয় হচ্ছে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া।
দুটি বিশ্বযুদ্ধে নাকাল হয়ে ইউরোপিয়ানদের পতনের কালেও, কেবলমাত্র সঠিক রাজনৈতিক ও সামরিক বিকল্প প্রস্তুতে অপারগ হওয়াতে মুসলিমরা শূন্যস্থান পূরণে অক্ষম হয়। তাই আমেরিকার পতনের কালে মুসলিম উম্মাহর শক্তি সঞ্চয় ও প্রস্তুতিগ্রহণ আবশ্যক হয়ে পড়েছে। আসন্ন শূন্যস্থান পূরণে বৈশ্বিক আদর্শ হিসেবে একমাত্র বিকল্প ইসলাম! তবে আশংকা এই যে, ইসলামের আমানতবাহীদের দূর্বলতা ও অসচেতনতার ফল সেক্যুলার, পুজিবাদী শক্তিগুলো লুটে নিয়ে যেতে পারে!
অতএব, বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম ও দূরদর্শী নেতৃবৃন্দের আহবানে সাড়া দিয়ে সকল ইসলামপন্থীদের জন্য জরুরী যে- তারা সঠিক শরঈ মূলনীতির আলোকে রাজনৈতিক ও সামরিক মাত্রায় নিজেদের দীক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করবে। প্রত্যেকের জন্যই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতনতাবোধ ও সক্ষমতা হাসিলে শেষ পর্যন্ত লেগে থাকতে হবে, যদি তারা চায়- আমেরিকার পতনের পর বিশ্বের নের্তৃত্বের আসনে ইসলামপন্থীদের আরোহণ অনিবার্য হোক।
লিখেছেন : আসাদ ইরফান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারাবিশ্বে নিজেদের আধিপত্য পাকাপোক্ত করার জন্য আমেরিকা তিনটি সংস্থা স্থাপনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দিয়েছিল।
সংস্থাটি তিনটি হচ্ছে- বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ ও ন্যাটো।
পাশাপাশি মার্কিন প্রশাসন খুব দ্রুত ওয়ার্ল্ড রিজার্ভ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) ও ওয়ার্ল্ড চেম্বার অফ কমার্স (বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা)-র উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে।
এই পাঁচটি সংস্থার নেতৃত্বে থাকার কারণে মার্কিন প্রশাসন সারাবিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্য শাসনব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখার সরাসরি ক্ষমতা লাভ করে।
তাদের প্রণয়ন করা নীতিগুলোকে মার্কিন সুশাসন ও সমৃদ্ধির একটি সর্বজনীন রেসিপি হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে।
যেমনটা অর্থনীতিবিদ জন উইলিয়ামসন বলেছেন, “দশকের পর দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধরেই নিয়েছে, তারাই বিশ্বের আদর্শ-নির্ধারক। ওয়াশিংটন কী চায়, তার উপরই বৈশ্বিক নীতি নির্ধারিত হবে এবং ‘মার্কিনী শ্রেষ্ঠত্ব’ সকল নীতি-নৈতিকতার মূল- এটা তাদের বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।”
আর, যারাই এই বিশ্বাসে আঘাত আনবে বা আনার চেষ্টা করবে তাদের কঠোর হাতে দমন করার অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আছে।
যদিও আমেরিকার কথা চিন্তা করলেই তাদের সামরিক আগ্রাসনের কথা সর্বপ্রথম স্মরণে আসে। কিন্তু, এই ‘অবিশ্বাসীদের’ (যারা আমেরিকানদের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করে না) দমনের জন্য মার্কিন প্রশাসন আরো অনেক জঘন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।
যেমন- অর্থনৈতিক অবরোধ, বাণিজ্যিক অবরোধ, মানবিক অনুদান স্থগিত ইত্যাদি। ১৯৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাকের ওপর অবরোধ আরোপে তেমনি একটি ঘটনা।
শুধু যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে মার্কিনিরা তাদের আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করে, এমনটা নয়। মাঝে মাঝে তারা মিত্র রাষ্ট্রগুলোর দিকেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর রাখে।
উদাহরণ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কথাই ধরা যায়। নির্বাচনের পূর্বে তার নাবালকসুলভ আচরণের কারনে কেউ কল্পনা করেনি যে, সে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদে নির্বাচিত হবে। কিন্তু সে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছে মিত্র মার্কিন প্রশাসনের পরোক্ষ মদদে। অল্প কিছুদিন আগেও জনসনের অসংখ্য অযোগ্যতা, মহামারিতে মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ও অর্থনৈতিক মন্দাকে মানুষ গায়ে মাখছিল না এবং তাঁকে সমর্থন দিয়ে আসছিল। কিন্তু একটি সাধারণ কারণে জনসনের জনসমর্থনে অবশেষে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। কারণটি হলো, তিনি এবং তাঁর সরকার মার্কিন প্রশাসনের সাধারণ নিয়মের ও স্বার্থের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন।
যাই হোক, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার এবং ২০ বছর ধরে চলমান কথিত “সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে” ক্রমাগত প্রতিরোধের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা ‘সামরিক শ্রেষ্ঠত্বে’র মিডিয়া-সৃষ্ট আবরণ বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া এক্ষেত্রে আরও ভূমিকা পালন করেছে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তাদের হস্তক্ষেপের হতাশাজনক পরিণতি, ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে অপসারণের পরে তাদের দ্বারা সে দেশের ক্ষমতা কাঠামোর অবলোপন, ১৯৭৯-এ ইরানে খোমেনি শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে ব্যর্থতা এবং ১৯৭৫-এ ভিয়েতনামে বামপন্থীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কৌশলগত ব্যর্থতা ইত্যাদি। এই তালিকায় অবশ্যই যুক্ত আছে ‘আরব বসন্ত’-এর বিষয়টিও।
আমেরিকার নীতি-নির্ধারকরা বুঝতে পেরেছে যে, এই যুদ্ধগুলোর ফলে শুধুমাত্র তাদের সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে তা নয়; বরং এতে মার্কিন প্রশাসন ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আফগানিস্তানে সামরিক পরাজয়ের পর মার্কিন প্রশাসনের এটা উপলব্ধি করতে বেশি সময় লাগনি যে, তারা খুব দ্রুতই চীনের কাছে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে পরাস্ত হতে চলেছে।
কেননা, যখন আফগানিস্তান ও ইরাকে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ আমেরিকা পুরোপুরি মগ্ন ছিল; তখন চীন অর্থনৈতিক সুবিধাকে ব্যবহার করে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে মনোনিবেশ করে। ফলে এই রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে চীনের ভূরাজনৈতিক বলয়ে প্রবেশ করছে। চীন ক্রমেই তার ভূরাজনৈতিক প্রভাব-বলয়ের পরিধি প্রসারিত করছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের মতে, – “গত এক দশকে মার্কিনীদের তৈরি করা বিশ্বায়ন, শিল্পনীতি এবং রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ একটি ‘বেইজিং কনসেনসাস’-এর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।”
অনেক বৈশ্বিক নিয়ম নির্ধারণী সংস্থা, যা একসময় ইউরোপীয় এবং আমেরিকান প্রাধান্যের ওপর চলত, তারা এখন চীনা নেতাদের ওপর ক্রমে নির্ভরশীল হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন এবং ইন্টারন্যাশনাল ইলেকট্রো টেকনিক্যাল কমিশন অন্তর্ভুক্ত।
একসময় বৈশ্বিক পুঁজি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ছিল একতরফা আধিপত্য। এখন সেই অবস্থা আর নেই। বৈশ্বিক পর্যায়ে বিনিয়োগযোগ্য সবচেয়ে বড় অঙ্কের তহবিল রয়েছে চীনের হাতে। বিশ্বের বৃহৎ ১০ ব্যাংকের অর্ধেকের কাছাকাছি মালিকানা রয়েছে হংকংসহ চীনা কোম্পানির হাতে। বিকল্প বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রক্রিয়া যে অনেক দূর এগিয়েছে- তা এখন অনেকটাই স্পষ্ট।
সবচেয়ে বড় কথা চীনা বাজারের আধিপত্য এড়ানো খুব সহজ নয়। অধিকাংশ দেশ আমেরিকার সঙ্গে না জড়িয়ে চীনের সঙ্গে অধিক মাত্রায় বাণিজ্য সম্পর্কে জড়াচ্ছে। এমনকি আমেরিকার অগ্রণী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য আবার চালু করার জন্য আর্জি জানাচ্ছে।
বিশ্ববাজারে ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের কারণে চীনের তৈরি নিয়মকানুন ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করেছে। এই সব নিয়মের প্রতি পশ্চিমারা প্রতিশ্রুতিশীল থাকবে কি না, তা একটি জরুরি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য কিছু পশ্চিমা সরকার প্রচলিত ‘নিয়মভিত্তিক অনুশাসন’ (মিশ্র অনুশাসন)-এর আদলে বৈশিক নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা পুনর্বিন্যাসের কথা চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, শি জিং পিংয়ের চীনা নীতির সঙ্গে পশ্চিমাদের নীতির মধ্যে সমঝোতা ঘটানোর কোনো উপায় বের করা যায় কি না, সে বিষয়ে তারা চিন্তাভাবনা করছে।
যদিও সেই ভাবনার সঙ্গে বাইডেনের যুক্তরাষ্ট্র একেবারেই একমত নয়। সে কারণেই সম্প্রতি শেষ হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলনে চীন ও রাশিয়ার মতো কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কড়া বার্তা দিয়েছে।
তবে আসন্ন ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি প্রণয়ণের ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র তথা পশ্চিমাদের হাতে থেকে অপসারিত হয়ে চীন ও তার সঙ্গীদের নাগালে চলে আসতে পারে- তার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু, বৈশ্বিক নীতি নির্ধারণের আসনে পশ্চিমারা (আমেরিকা ও তার মিত্ররা) থাকুক অথবা প্রাচ্যের ক্ষমতাধর দেশগুলোর হাতে- তাতে মুসলিম উম্মাহর কোন কল্যাণ নিহিত নয়।
মুসলিমদের জন্য করণীয় হচ্ছে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া।
দুটি বিশ্বযুদ্ধে নাকাল হয়ে ইউরোপিয়ানদের পতনের কালেও, কেবলমাত্র সঠিক রাজনৈতিক ও সামরিক বিকল্প প্রস্তুতে অপারগ হওয়াতে মুসলিমরা শূন্যস্থান পূরণে অক্ষম হয়। তাই আমেরিকার পতনের কালে মুসলিম উম্মাহর শক্তি সঞ্চয় ও প্রস্তুতিগ্রহণ আবশ্যক হয়ে পড়েছে। আসন্ন শূন্যস্থান পূরণে বৈশ্বিক আদর্শ হিসেবে একমাত্র বিকল্প ইসলাম! তবে আশংকা এই যে, ইসলামের আমানতবাহীদের দূর্বলতা ও অসচেতনতার ফল সেক্যুলার, পুজিবাদী শক্তিগুলো লুটে নিয়ে যেতে পারে!
অতএব, বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম ও দূরদর্শী নেতৃবৃন্দের আহবানে সাড়া দিয়ে সকল ইসলামপন্থীদের জন্য জরুরী যে- তারা সঠিক শরঈ মূলনীতির আলোকে রাজনৈতিক ও সামরিক মাত্রায় নিজেদের দীক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করবে। প্রত্যেকের জন্যই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতনতাবোধ ও সক্ষমতা হাসিলে শেষ পর্যন্ত লেগে থাকতে হবে, যদি তারা চায়- আমেরিকার পতনের পর বিশ্বের নের্তৃত্বের আসনে ইসলামপন্থীদের আরোহণ অনিবার্য হোক।
লিখেছেন : আসাদ ইরফান