“প্রতিটি গলিতে লাশ ফেলতে ফেলতে যাবে” : আন্দোলনের সময় সুদীপ কুমারের নির্দেশ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপির) যুগ্ম-কমিশনার ছিল সুদীপ কুমার চক্রবর্তী। তখন সে ট্রাফিক উত্তর বিভাগের দায়িত্বে থাকলেও ছাত্র-জনতা দমনে হাতে তুলে নেয় চাইনিজ রাইফেল। র্যাব-সেনাদের নিষেধ সত্ত্বেও ছাত্র-জনতা হত্যায় মেতে ওঠে সে। অভিযোগ রয়েছে পুলিশের যারা বেপরোয়া ছিল, তাদের অন্যতম ছিল পুলিশের এ কর্মকর্তা। যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া এলাকায় তার গুলিতে নিহত হন অনেক আন্দোলনকারী।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশের এই কর্মকর্তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তাকে ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ডিএমপি সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হলেও পলাতক রয়েছে। শোনা যাচ্ছে, সুদীপ কুমার পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে গেছে।
তার স্ত্রী পুলিশ সুপার সুনন্দা রায়ও (সুপারনিউমারারি অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) দেশেই আছে। তাকে গত ৮ অক্টোবর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে রাজশাহী রেঞ্জে সংযুক্ত করা হলে ইতোমধ্যে রাজশাহীতে যোগ দিয়েছে। অপরদিকে কর্মে যোগ না দেওয়া সুদীপ কুমারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার চূড়ান্ত প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বহু আন্দোলনকারীকে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা করে সুদীপ। বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা বিরোধী দলগুলোর ওপর নানা দমন-পীড়ন চালিয়ে সরকারের আস্থা অর্জন করেছিল। বগুড়ার পুলিশ সুপার থেকে গেল বছর পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি হয়। পরে তাকে ডিএমপিতে পদায়ন করা হয়। এরপর সে ডিএমপির ট্রাফিক উত্তর বিভাগের দায়িত্ব পায়।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ১৫ থেকে ১৯ জুলাই বাড্ডা-ভাটারায় ছাত্র আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে সুদীপ ডিএমপির অনুমতি ছাড়াই পার্শ্ববর্তী দেশের দূতাবাসের আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেয়। নিজে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালায় আন্দোলনকারীদের ওপর।
গত ২০ জুলাই রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে শনির আখড়া পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আন্দোলনকারীদের দখলে ছিল। সড়ক দখলমুক্ত করতে সেনা, র্যাব ও পুলিশের যৌথ দল অভিযানে নামে। সুদীপ এখানে এসে হাজির হয়। তবে এই অভিযানে চাইনিজ রাইফেল ফায়ার করার মতো কোনো পরিস্থিতি ছিল না বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সুদীপ কুমার চাইনিজ রাইফেল দিয়ে অসংখ্য গুলি করে। শনির আখড়া ফ্লাইওভারের ওপর থেকে দুই পাশে প্রায় ১৫০ মিটার দূরে অবস্থানরত আন্দোলনকারী জনতাকে লক্ষ্য করে অসংখ্য ‘লাইভ বুলেট’ ফায়ার করে সে। এতে প্রায় ১৬ জনের মৃত্যু হয়। লাইভ বুলেট ফায়ার না করার জন্য বলা হলেও সুদীপ কারও কথা না শুনে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
সুদীপ কুমারের নির্দেশে প্রথমে ফ্লাইওভারের ওপর থেকে বাম দিকে অবস্থানরত উৎসুক জনতাকে লক্ষ্য করে পুলিশ তিনটি চাইনিজ রাইফেল ফ্লাইওভারের প্যারাপেট দেয়ালের ওপর পাশাপাশি রেখে টানা ৩০ রাউন্ড গুলি করে। পুলিশের কাছে যেসব চাইনিজ রাইফেল আছে তাতে একবারে ১০ রাউন্ড গুলি লোড করা যায় বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়।
তাছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন গলিতে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে অসংখ্য গুলি করা হয়। এ সময় যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার যাদের দিয়ে গুলি করিয়েছে তাদের উদ্দেশে তাকে বলতে শোনা যায়- ‘তোমাদের ১০০ রাউন্ড চাইনিজ গুলি দিয়ে কয়টি লাশ ফেলতে পেরেছ?’
২১ জুলাই শনির আখড়া থেকে সেনা, র্যাব ও পুলিশের যৌথ টিম সাইনবোর্ড এলাকার উদ্দেশে রওনা করে। এ সময় পুলিশ ‘অগ্রগামী দল’ হিসেবে মাতুয়াইল পর্যন্ত ব্যারিকেড ও আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেয়। সে সময় কোনো চাইনিজ রাইফেল ফায়ার করতে দেখা যায়নি। বেলা ১টার দিকে যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী ঘটনাস্থলে এসে পুলিশের দায়িত্ব নেয়। এরপরই সে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করা শুরু করে। তার নির্দেশে দি ওয়ান রেস্টুরেন্ট-এর পাশের গলিতে তিনজন নিরস্ত্র আন্দোলনকারীকে টার্গেট কিলিং করা হয় চাইনিজ রাইফেল দিয়ে। পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে সুদীপকে বলতে শোনা যায়, ‘প্রতিটি গলিতে লাশ ফেলতে ফেলতে যাবে; যাতে কেউ সামনে আসতে সাহস না পায়। প্রতিবেদন বলছে, সুদীপ অন্তত ৫০ জন আন্দোলনকারী বা জনতাকে চাইনিজ রাইফেলের গুলিতে হত্যা করে।
এদিকে যাত্রাবাড়ী এলাকার চিটাগাং রোডে ইমন হোসেন গাজী নিহতের ঘটনায় করা মামলার আসামি সুদীপ কুমার। এ ছাড়া আরও মামলায় নামীয় আসামি এই গণহত্যাকারী।
তথ্যসূত্র:
১. প্রতিটি গলিতে লাশ ফেলবে যাতে কেউ সামনে আসতে সাহস না পায়
– https://tinyurl.com/4mdx6c66