Announcement

Collapse
No announcement yet.

"ইসলামে কি গুপ্তহত্যা হারাম।"

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • "ইসলামে কি গুপ্তহত্যা হারাম।"

    ইসলামে গুপ্তহত্যা কি হালাল?

    গুপ্ত হত্যাকে আরবী ভাষায় বলা হয় ‘আল ইগতিয়াল’ যার বহু বচন হল ‘আল ইগতিয়ালাত’ আর ইংরেজী ভাষায় একই অর্থ বুঝাতে ব্যবহার হয় ‘Assassination’ শব্দ। বাংলা ভাষায় এর শাব্দিক অর্থ হলো অপ্রস্তুত অবস্থায় অতর্কিত আক্রমণ করে কিংবা গোপন কোন কৌশলে কাউকে হত্যা করা।
    ইসলামি পরিভাষায় ‘ইগতিয়াল’ বলা হয় ইসলাম ও মুসলমানদেরকে কারো চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও দুষ্কৃতি থেকে রক্ষা এবং অন্য কেউ যেন ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ষড়যন্ত্র করার দুঃসাহস না পায় তার জন্য দৃষ্টান্তমুলক শাস্তিস্বরূপ অতর্কিতে আক্রমণ করে কিংবা গুপ্তভাবে কাউকে হত্যা করা।
    ইসলামে গুপ্তহত্যা শুধুই কোন সামরিক কর্মকাণ্ড নয়; বরং গুপ্তহত্যা হল যুগপৎ এবং কার্যকরী একটি সামরিক কৌশল, যা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

    ইসলামী শরিয়াতে গুপ্ত হত্যার বৈধতা

    হযরত মুহাম্মাদ এবং তাঁর সাহাবিদের জীবনী অধ্যয়ন করলে একথা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তাদের জিহাদ তথা সামরিক কৌশল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গুপ্তহত্যা ছিলো একটি শিল্প হিসেবে বিবেচ্য বিষয় এবং তাদের সামরিক কর্মকাণ্ডের একটি অন্যতম অংশ। জিহাদ ও জিহাদ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য হুকুম আহকাম ইসলামে যেমন সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তেমনি একই হুকুমের আওতাভুক্ত হবে গুপ্তহত্যার এই শিল্পকলা। পাঠকদের সদয় অবগতির জন্য মুল আলোচনা আরম্ভ করার আগেই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই সূরা তওবার একটি অায়াত –
    “কিন্তু চুক্তি সম্পাদনের পরও যদি ওরা ওদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং তোমাদের ধর্ম নিয়ে বিদ্রুপ করে, তাহলে কুফুরের নেতাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো, যাতে ওরা (তোমাদের আক্রমণ করা থেকে) নিবৃত্ত হয়। ওদের কাছে ওদের নিজস্ব অঙ্গীকারেরও কোনো মূল্য নেই।” (সূরা তওবা -১২)
    উল্লেখিত অায়াতে ‘আইম্মাতুল কুফুর’ বা কুফুরের নেতাদের গুপ্তহত্যার বৈধতা এমনই একটি স্বতঃসিদ্ধ মাসআলা যে পূর্ববর্তী মুজতাহিদের কেউই এর বৈধতার ব্যপারে দ্বিমত পোষণ করেননি।

    কুরআন ও সুন্নাহ থেকে গুপ্ত হত্যার দলীল

    ১ম দলীলঃ কাফির মুশরিকদের হত্যার সাধারণ বিধান


    আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন ঈমানদারদেরকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন – “তোমরা মুশরিকদেরকে হত্যা করো যেখানেই তাদেরকে পাও, তাদেরকে ধরো, তাদেরকে বেঁধে ফেলো, তাদেরকে হত্যার জন্য ঘাটিতে ওঁত পেতে অপেক্ষা করতে থাকো।” (সূরা আত তাওবা, আয়াত ৫)
    এ আয়াতে গুপ্ত হত্যার বৈধতার দিকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। ইমাম কুরতুবী এ আয়াতের وَاقْعُدُواْ لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ এর ব্যাখ্যায় বলেন : এর অর্থ হলো-
    তাদের উপর আক্রমণ করার জন্য, তাদেরকে হত্যা করার জন্য, অতর্কিতে তাদের উপর আক্রমণের জন্য গোপন ঘাটিতে ওঁত পেতে থাকো। এরপর ইমাম কুরতুবী বলেন –
    وهذادليل على جواز اغتيالهم قبل الدعوة অর্থাৎ এ আয়াতের মধ্যে এ কথার স্বপক্ষে দলীল রয়েছে যে, মুশরিকদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার পূর্বেও হত্যা করা বৈধ। তবে মনে রাখা দরকার যে এ হুকুম কেবল রক্ষণাত্মক জিহাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; কেননা আক্রমণাত্মক যুদ্ধের ক্ষেত্রে অবশ্যই আক্রমণ শুরু করার পূর্বে তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে।
    এই আয়াত কাফেরদের ধরার জন্য গোপন ঘাঁটি তৈরী, তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করা ও তাদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করার বৈধতা দেয়। এ কারণে মালেকী মাযহাবের প্রখ্যাত আলেম ও ফকীহ ইমাম ইবনুল আরাবী তার তাফসীর গ্রন্থ আহকামুল কুরআনে বলেন, ‘আমাদের ফকীহগণ তাদেরকে হত্যার জন্য ওঁত পেতে থাকা এবং তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াত দেয়ার পূর্বে গুপ্তভাবে হত্যা করা প্রসঙ্গে বলেন যে, এ হত্যার ব্যপারে যথেষ্ট মজবুত দলীল প্রমাণ রয়েছে’। ইমাম ইবনে কাসীর তার তাফসীর গ্রন্থে এর ব্যখ্যা প্রসঙ্গে বলেন-
    – وَاحْصُرُوهُم ْوَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَد، لا تكتفوا بمجرد وجدانكم لهم بل اقصدوهم بالحصار في معاقلهم وحصونهم والرصد في طرقهم ومسالكهم حتى تضيقوا عليهم الواسع وتضطروهم إلى القتل أو الإسلام
    অর্থাৎ ‘তাদেরকে তোমাদের হাতের নাগালে পেয়ে তারপর হত্যা করবে শুধু এমন চিন্তা করে বসে থাকা যথেষ্ট নয়; বরং এ আয়াত বলছে যে তোমরা তাদের বাড়ি ঘরে, তাদের শহর নগরে গিয়ে তাদেরকে আক্রমণ করো, ঘাটি স্থাপন করো, ওঁত পেতে থাকো, তাদেরকে ঘিরে ফেলে অবরোধ করে রাখো যাতে করে পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং তারা এমন এক অবস্থার মধ্যে পড়ে যায় যে হয় যুদ্ধ করতে হবে অথবা ইসলাম গ্রহণ করতে হবে।’
    বিশিষ্ট জিহাদি নেতা প্রয়াত শায়খ আব্দুল্লাহ আযযাম তার সূরা আত তাওবার তাফসীরে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এ আয়াত প্রমাণ করে যে কাফেরদেরকে সতর্ক করার পূর্বেই তাদেরকে গুপ্তভাবে হত্যা করা জায়েয; আর এখানে যেহেতু আল্লাহ্ একাজের হুকুম দিয়েছেন অতএব গুপ্ত হত্যার আমল একটি সুস্পষ্ট বোধগম্য ফরয হুকুম।

    ২য় দলীলঃ কিসাস বা সমান শাস্তির বিধান প্রয়োগ –


    আল্লাহ্ এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে বলেন- যে তোমাদের উপর বাড়াবাড়ি করেছে তোমরাও তার উপর ঠিক ততখানি বাড়াবাড়ি করবে যতখানি তারা তোমাদের উপর করেছে।(সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৯৪)
    (ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য হল) তারা যখন অন্যায় বাড়াবাড়ির শিকার হয় তখন তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করে; আর দুষ্কৃতির বদলা হল তার সমপরিমাণ দুষ্কৃতি; তবে যে মাফ করে দেবে এবং সংশোধন করে দেবে তার বিনিময় আল্লাহর কাছে রক্ষিত; নিশ্চয়ই তিনি যালিমদেরকে মোটেই ভালোবাসেন না। আর যুলুমের শিকার হয়ে যদি কেউ প্রতিশোধ গ্রহণ করে তবে তাদের উপর কোন অভিযোগ দায়ের করা চলবে না; অভিযোগ তো কেবল তাদের উপর যারা মানুষের উপর যুলুম করবে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বাড়াবাড়ি করে বেড়াবে; তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (সূরা আশ শূরা, আয়াত ৩৯-৪২)
    আর তোমরা যদি তোমাদের শত্রুদেরকে শাস্তি দাও তাহলে ঠিক সেইভাবে তাদেরকে শাস্তি দিবে যেভাবে তারা তোমাদের উপর আক্রমণ করেছে। (সূরা আন নাহল, আয়াত ১২৬)
    ইসলামি আইন অনুযায়ী এ সকল আয়াত সমুহ বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে নাযিল হলেও এর সামগ্রিক হুকুম সাধারণ ভাবে প্রযোজ্য। কেননা আল কুরআনের কোন আয়াত বিশেষ কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ হলেও সে আয়াতের হুকুম কেবল সেই ঘটনার সাথেই খাস নয় বরং একই রকম সকল ঘটনার ক্ষেত্রেই সে আয়াতের হুকুম সমান ভাবে জারি থাকবে। এ ব্যপারে ইসলামের মূলনীতি হল:-
    العبرة بعموم اللفظ لابخصوص السبب অর্থাৎ শিক্ষা গ্রহণ করা হবে শব্দের সাধারণ অর্থের উপর ভিত্তি করে; শুধু আয়াত নাযিলের ঘটনার সাথে হুকুমকে খাস করা হবে না। ইমাম ইবনুল কাইয়েম এ আয়াত সমূহের ব্যখ্যায় বলেন – ‘এ সব আয়াত সমূহ প্রমাণ করে যে জান মাল, সহায় সম্পদ, ঘর-বাড়ি, নারী, শিশু যাবতীয় ক্ষেত্রে সমান প্রতিশোধ গ্রহণ বৈধ। সমান প্রতিশোধ গ্রহণের বৈধতা ইসলামী শরিয়তে এমনই স্বীকৃত একটি বিধান যে স্বয়ং মুসলমানদের নিজেদের মধ্যেও এ কিসাস তথা হত্যার বদলে হত্যা বা সমান প্রতিশোধ গ্রহণ বৈধ; অতএব যে অপরাধের কারণে যে শাস্তি মুসলমানদের উপর প্রয়োগ বৈধ সে বিধান কাফেরদের
    ক্ষেত্রে তো সন্দেহাতীত ভাবে কার্যকর।’

    ৩য় দলীলঃ কা’ব বিন আশরাফের হত্যাকাণ্ড –

    মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক (৭০৪-৭৬৮ সাল), আল-তাবারী (৮৩৯-৯২৩ সাল), আল-ওয়াকিদি (৭৪৮-৮২২ খৃষ্টাব্দ), মুহাম্মদ ইবনে সা’দ (৭৮৪-৮৪৫ খৃষ্টাব্দ), ইমাম বুখারী (৮১০-৮৭০ খৃষ্টাব্দ), ইমাম মুসলিম (৮১৭/৮২১-৮৭৫ খৃষ্টাব্দ) প্রমুখ আদি ও বিশিষ্ট মুসলিম মনীষীদের সবাই এই ঘটনার বিশদ বর্ণনা বিভিন্নভাবে তাঁদের নিজ নিজ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন।
    এ ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিলো ৩য় হিজরী সনের রবিউল আউয়াল মাসের ১৪ তারিখ রাতে। নবীজি তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটি দলকে প্রেরণ করেন, তিনি তাদেরকে বিদায় জানানোর সময় বলেন, ‘আল্লাহর নামে তোমরা বেরিয়ে পড়ো, হে আল্লাহ্ তুমি তাদেরকে সাহায্য করো।’ এরপর তিনি ঘরে এসে সালাত আদায় করতে থাকেন এবং তাদের সফলতার জন্য আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে মোনাজাত করতে থাকেন। জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক দিন বলেন –
    “কা’ব বিন আশরাফকে হত্যার জন্য কে আছো? সে আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসুলকে কষ্ট দিয়েছে।” আল্লাহর রাসূলের একথা শুনে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি কি সত্যিই চান আমি তাকে হত্যা করে ফেলি? তিনি বলেন, হ্যাঁ আমি তাই চাই। মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ বলেন, তাহলে আমাকে কিছু (মিথ্যা কথা) বলার অনুমতি দিন। নবী বললেন, তোমার যা প্রয়োজন বলো। অতঃপর মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ কা’ব বিন আশরাফের কাছে এসে নবীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, এ ব্যক্তি আমাদের কাছে শুধু সাদাকা চায়, সে তো আমাদেরকে মহা কষ্টে ফেলে দিয়েছে! তখন সে বলে যে, এখন পর্যন্ত আর কিইবা দেখেছো, সে তো তোমাদেরকে শেষ করে ছাড়বে। মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ তখন বলেন, একবার যেহেতু তাঁর অনুসারীর খাতায় নাম লিখিয়েছি এখন আর তাঁর শেষ না দেখে ছাড়ছি না। যাই হোক শোনো, আমরা তোমার কাছে এসেছিলাম (এই বিপদের সময়) তুমি আমাদেরকে এক দুইসা’ ধার দেবে এই জন্য। সে বললো, আচ্ছা তা দেয়া যাবে তবে তার বিনিময়ে আমার কাছে কিছু বন্ধক রাখতে হবে। মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, আচ্ছা তুমিই বলো তুমি কী বন্ধক চাও; সে (কা’ব) বললো, তোমাদের নারীদেরকে আমার কাছে বন্ধক রাখো। (রাগ ক্ষোভ সব চেপে রেখে স্বাভাবিক থাকার ভান করে তার কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে) তিনি বললেন, আমরা কিভাবে আমাদের নারীদেরকে তোমার কাছে বন্ধক রাখি অথচ তুমি হচ্ছো আরবের সবচেয়ে সুদর্শন সুপুরুষ! তারপর সে বললো, তাহলে তোমাদের সন্তানদেরকে বন্ধক রাখো; তিনি বললেন, কিভাবে আমরা আমাদের সন্তানদেরকে বন্ধক রাখি বলো, তাহলে তো লোকেরা গালাগালি দিয়ে তাদেরকে বলবে যে, এই তোদেরকেই তো মাত্র এক দু’ সা’ এর বিনিময়ে বন্ধক রাখা হয়েছিলো! তার চেয়ে বরং আমরা আমাদের অস্ত্রশস্ত্র তোমার কাছে বন্ধক রাখি। অবশেষে সে সম্মত হয়। তারা রাতে গোপনে তার সাথে দেখা করার কথা বলে চলে যান।
    রাতের বেলা মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ কা’ব বিন আশরাফের দুধ ভাই আবু নায়লাকে সাথে নিয়ে আসলেন। তারা দু’জন তাকে ডাক দিলে সে যখন নেমে আসতে যাচ্ছিলো তখন তার স্ত্রী তাকে বললো, ‘এতো রাতে কোথায় যাচ্ছো? আমার কাছে মনে হচ্ছে যেন তার কথা থেকে রক্তের ফোঁটা ঝরে পড়ছে’। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে যে সে বলেছে, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে যেন তার মুখের আওয়াজের সাথে রক্ত বেরিয়ে আসছে’। সে বললো, আরে! এতো আমার বন্ধু মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ ও আমার দুধভাই আবু নায়লা এসেছে, ওদের সাথে একটু কথা বলতে যাচ্ছি। মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ আবু নায়লা ছাড়াও আরও দু’জনকে সাথে নিয়ে এসেছিলেন, তারা হলেন আবু আবস বিন হাবর ও উব্বাদ বিন বিশার। তিনি তাদেরকে আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন যে, তিনি তার ঘাড় ধরে যখন তার মাথা নুইয়ে দেবেন তখন যেন তারা তাদের কাজ সেরে ফেলে।
    অতঃপর সে যখন নেমে এলো তারা বললো বাহ! তোমার শরীর থেকে তো চমৎকার সুঘ্রান আসছে! সে বললো, হ্যাঁ, তা তো হতেই পারে কারণ আমার কাছে রয়েছে আরবের সবচেয়ে সুগন্ধিনি নারী। মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রাঃ বললেন আমি কি একটু তোমার চুল থেকে ঘ্রান শুঁকে দেখতে পারি? সে বললো, অবশ্যই, এই নাও শুঁকে দেখো; সে একবার শুঁকে ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষন পর আবার বললো, (ওহ যা ঘ্রান!) আমাকে তোমার মাথাটা আরেকবার শুঁকতে অনুমতি দেবে? এবার সে তার মাথার চুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মাথাটা নিচু করে ধরে অন্যদের বললো, এবার তোমাদের কাজ সেরে ফেলো, আর তারা সাথে সাথে তাকে হত্যা করে ফেলে। (সহীহ বুখারী ৩৮১১, ও সহীহ মুসলিম)
    কা’ব বিন আশরাফ নিহত হওয়ার পর তার জাতির ইহুদীরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললো, আমাদের একজন অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে আপনার অনুসারীদের দ্বারা গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। রসুলুল্লাহ তাদেরকে বলেন, তার মতো একই রকম চিন্তার যেসব লোকেরা পালিয়ে গেছে তাদের মতো সেও যদি পালিয়ে যেত তাহলে তার এই দশা হতো না, কিন্তু সে আমাদেরকে বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, আমাদেরকে অপমান করেছে; আর ভবিষ্যতেও কেউ যদি এমন দুঃসাহস দেখায় তাহলে সেও তার ঘাড়ের উপর তলোয়ার ছাড়া কিছু দেখতে পাবে না। (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও সীরাতে ইবনে হিশাম)
    ফতহুল বারী গ্রন্থে ইবনে হাজার ইকরামা এর সুত্রে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর গোটা ইহুদী সম্প্রদায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামের কাছে এসে তাদের নেতার গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার ঘটনা তাকে জানায়। রাসুলুল্লাহ তার রক্তপণের ব্যপারে কোন কথা না বলে বরং তাদেরকে তিনি মনে করিয়ে দিতে লাগলেন যে সে আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রাসূল ও ঈমানদারদের সম্পর্কে কি সব আপত্তিকর কথাবার্তা বলে বেড়াতো। এত টুকুতেই তিনি ক্ষান্ত হননি, বরং তাদেরকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে ভবিষ্যতেও যদি কেউ তার মতো আচরণ করে তাহলে তার পরিণতিও একই রকম হবে।
    হাফেজ ইবনে হাজার বলেন: ‘কাউকে দ্বীনের দাওয়াত না দিয়ে হত্যার বৈধতার ব্যপারে এ ঘটনা একটি মজবুত দলীল।’
    হাফেজ ইবনে হাজার এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, “এ ঘটনার মধ্যে সাধারণভাবে ইসলামের দাওয়াত সবার কাছে পৌঁছে গেলে যে কোন মুশরিককে ব্যক্তিগত ভাবে ইসলামের দাওয়াত না দিয়ে হত্যা করার বৈধতা রয়েছে। ইমাম বুখারী এ হাদিসটিকে জিহাদ অধ্যায়ে ‘যুদ্ধে মিথ্যা বলা’ অনুচ্ছেদে সংকলন করেছেন।
    ইমাম নববী এ হাদিসের ব্যখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, “কা’ব বিন আশরাফই প্রথম ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে নিরাপত্তা চুক্তি লংঘন করেছে, আর মুহাম্মাদ বিন মাসলামাও তাকে প্রথমে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে তারপর তাকে হত্যা করেছেন বিষয়টি এমন নয়। কাযী আইয়ায সহীহ মুলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থ আল মিনহাজের মধ্যে বলেন, ‘কারো জন্য একথা বলা বৈধ নয় যে কা’ব বিন আশরাফের হত্যাকাণ্ড কোন বিশ্বাসঘাতকতা ছিল’; আলী ইবনে আবী ত্বালিব এর মজলিসে কোন এক ব্যক্তি এমন মন্তব্য করলে তিনি তাকে হত্যার নির্দেশ দেন”।
    শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া ‘আস সরিমুল মাসলুল’ গ্রন্থে এ হাদিসের উপর আলোচনা পেশ করে বলেন – এ ঘটনা প্রমাণ করে যে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকে যে কষ্ট দিবে বা কুৎসা রটনা করবে। তাকে হত্যা করা যে কোন মুসলমানের জন্য হালাল।

    ৪র্থ দলীলঃ ইবনে আবুল হুকায়েক আবু রাফে’র হত্যাকাণ্ড –

    আবু রাফে’ ছিলো খায়বার অঞ্চলে বসবাসকারী একজন ইহুদী নেতা, হিজাযের বিখ্যাত ব্যবসায়ী। ৫ম হিজরী সনের যুলকা’দাহ কিংবা যুলহিজ্জা মাসে তাঁকে হত্যা করা হয়।
    ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক এ ঘটনার সুত্রপাত হিসেবে ইমাম যুহরী, আব্দুল্লাহ ও কা’ব বিন মালেক এর সুত্রে বর্ণনা করেন যে, আওস এবং খাযরাজ গোত্রের লোকেরা একে অপরের সাথে ইসলামের জন্য যুদ্ধে কোন গোত্র কেমন ভুমিকা পালন করেছে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা করতো। অন্যান্য দিক থেকে উভয় গোত্র প্রায় সমান সমান থাকলেও আওস গোত্র দ্বারা সংগঠিত কা’ব বিন আশরাফের হত্যাকাণ্ডের মতো কোন উদাহরণ খাযরাজ গোত্রের লোকেরা উপস্থাপন করতে পারলো না। তখন তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে বললো, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি আমাদেরকে এমন এক ব্যক্তির নাম বলে দিন যাকে হত্যা করে আমরা আওস কর্তৃক কা’ব বিন আশরাফকে হত্যার কৃতিত্বের সমতা রক্ষা করতে পারি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন তাদেরকে আবু রাফে’কে হত্যার নির্দেশ দেন।
    এই অভিযানে পাঁচজন সাহাবীর একটি দল অংশ নেয়। তারা হলেন (১) আব্দুল্লাহ ইবনে আতীক (২) মাসউদ বিন সিনান (৩)আব্দুল্লাহ বিন উনায়স (৪) আবু কাতাদা বিন হারিস (৫) খুযা’য়ী বিন আল আসওয়াদ রাঃ।
    সহীহ আল বুখারিতে বারা বিন আযিব এর সুত্রে বর্ণিত রয়েছে যে তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ আনসারদের একটি দলকে ইহুদী আবু রাফে’কে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তাদের মধ্য থেকে একজন (আবু আতীক) এগিয়ে গিয়ে ইহুদীদের দুর্গে প্রবেশ করেন। তিনি বলেন, অতঃপর আমি গিয়ে তাদের পশুর আস্তাবলে প্রবেশ করলাম আর তারা দুর্গের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিল। এদিকে তাদের একজনের একটি গাধা হারিয়ে গিয়েছিলো; তারা গাধাটি খুঁজতে বেরিয়ে পড়লে আমিও গাধা খোঁজার ভান ধরে তাদের সাথে বেরিয়ে পড়লাম। আমি তাদেরকে বুঝাতে চাচ্ছিলাম যে আমিও তাদের সাথে গাধা খোঁজ করছি। অবশেষে গাধাটি পেয়ে গেলে তারা যখন দুর্গে প্রবেশ করে তখন আমিও তাদের সাথে আবার দুর্গে প্রবেশ করি। তারপর আমি লক্ষ করলাম যে তারা দুর্গের ফটক বন্ধ করে চাবিটি একটি কুলুঙ্গির মধ্যে রেখে দিলো। অতঃপর তারা ঘুমিয়ে পড়লে আমি চাবি নিয়ে ফটক খুলে রেখে (অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে) আবু রাফে’র ঘরে গিয়ে পৌঁছলাম।
    আমি ‘ও আবু রাফে’ বলে ডাক দিলে সে আমার ডাকে সাড়া দিলো। আমি তার আওয়াজ দ্বারা তার অবস্থান অনুমান করে তরবারির আঘাত হানলাম, আর অমনি সে চিৎকার করে উঠলো; আর আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। যেন তার সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে এসেছে এমন ভান করে আমি আবার ঘরে প্রবেশ করে গলার স্বর পরিবর্তন করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ও আবু রাফে’ (চিৎকার করলে কেন) তোমার কী হয়েছে? সে বলল, তোমার মা ধ্বংস হোক (তাড়াতাড়ি আসছো না কেন) কি হল তোমার, কে যেন আমার ঘরে ঢুকে আমাকে আঘাত করেছে। তিনি (আবু আতীক) বলেন, অতঃপর আমি আমার তরবারি তার পেটের উপর রেখে শরীরের সকল শক্তি দিয়ে এমন জোরে চেপে ধরলাম যে তার (মেরুদণ্ডের) হাড্ডি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকার শব্দ হল। (এরপর তার চিৎকারে ও বাচ্চাদের কান্নাকাটির শব্দে অন্যরাও জেগে উঠে দরজা খুলতে লাগলো) অতঃপর আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে গিয়ে পড়ে গেলাম এবং এতে আমার পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পেলাম। যাই হোক কোন মতে আমি বেরিয়ে এসে আমার সঙ্গীদের সাথে মিলিত হলাম। আমি তাদেরকে বললাম, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি (আবু রাফে’র) মৃত্যু সংবাদ শুনতে না পাই ততক্ষন পর্যন্ত আমি এ স্থান ত্যাগ করবো না। সত্যিই হিজাযের বিখ্যাত ব্যবসায়ী আবু রাফে’র মৃত্যু সংবাদ না শুনে আমি সে স্থান ত্যাগ করলাম না। মৃত্যু সংবাদ যখন আমি শুনলাম তখন আমি দাড়িয়ে গেলাম এবং আমার যেন কোন ব্যথাই ছিলো না। অবশেষে আমি আল্লাহর রাসুলের কাছে গিয়ে আবু রাফে’কে হত্যার খবর দিলাম। (বুখারী হাদিস নং ৩০২২, ৩০২৩, ৪০৩৮-৪০৪০; আধুনিক প্রকাশনীর ছাপায় হাদিস নং ২৮০০ এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ছাপায় হাদিস নং ২৮১০)
    (বিভিন্ন হাদিস ও ইতিহাস গ্রন্থে এ ঘটনার আরও খুটিনাটি বিভিন্ন বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণণা এসেছে। আগ্রহী পাঠকগণ চাইলে তা পড়ে আরও বেশী উপকৃত হতে পারেন।)
    এক বর্ণনায় রয়েছে যে, নবীর কাছে আসার পর তিনি তার পায়ের ব্যথার স্থানে তাঁর মুখের থুথু লাগিয়ে দেন এবং আবুল আতিক বলতেন, এরপর তিনি কখনো সেখানে কোন ব্যথা অনুভব করেননি।
    ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় অবশ্য রয়েছে যে, তারা পাঁচজনই দুর্গে প্রবেশ করেছিলেন এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উনায়স তার উপর তরবারির আঘাত হানেন; আব্দুল্লাহ বিন আতিক এর পা ভেঙ্গে যায় এবং তারা তাকে ধরাধরি করে বের করে নিয়ে আসেন ইত্যাদি।
    হাফেজ ইবনে হাজার এই হাদিসের ব্যখ্যায় ফতহুল বারী গ্রন্থে বলেন, ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছে এমন মুশরিকদেরকে হত্যার বৈধতা সহ আল্লাহর রাসুলের (আনীত দ্বীনের) বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করে শক্তি সম্পদ কিংবা জবান দ্বারা কেউ যদি তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করে তাহলে তাদেরকে যে কোন উপায়ে হত্যা করা এবং যুদ্ধরত কাফিরদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির ব্যপারে এ ঘটনা থেকে বৈধতা পাওয়া যায়।

    ৫ম দলীলঃ খালিদ বিন সুফিয়ান আল হুযায়লীর হত্যাকাণ্ড –

    খালিদ বিন সুফিয়ান ছিল বনু হুযায়ল গোত্রের লোক। সে আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য মদীনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে বিশাল এক সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেছিল। ইমাম আহমাদ তার মুসনাদে এবং অন্যান্য অনেক হাদিস সংকলকগণ আব্দুল্লাহ বিন উনায়স থেকে এ ঘটনার বর্ণনা সংকলন করেছেন, যা এরূপ :-
    একদিন রাসুলুল্লাহ আমাকে ডেকে বলেন ‘আমার কাছে এই সংবাদ এসেছে যে খালিদ বিন সুফিয়ান আল হুযায়লী আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য লোকজন জড়ো করছে, অতএব তুমি গিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলো’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সুফিয়ান আল হুযায়লীকে শায়েস্তা করার মতো কে আছো? সে আমাকে অপমান করছে, কষ্ট দিচ্ছে!’
    আব্দুল্লাহ বিন উনায়স বলেন, আমি আল্লাহর রাসুলকে বললাম, আপনি আমার কাছে তার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন যাতে আমি তাকে চিনতে পারি। রাসুল বললেন, তার চেহারার দিকে তাকালেই তোমার মধ্যে একটা ঘৃণা ও বিরক্তির উদ্রেক হবে। এরপর আমি প্রস্তুতি নিয়ে রওয়ানা হয়ে পড়লাম, আমি যখন তার কাছে গিয়ে পৌঁছলাম তখন ঠিক তেমনই পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম যেমনটি রাসূলুল্লাহ বর্ণনা করেছিলেন। তাকে দেখলাম সে অস্থিরতার সাথে কাঁপছে আর পায়চারী করছে। সেখানে দেখলাম কিছু পতিতাদের আনাগোনা রয়েছে যারা তার কাছে আসা যাওয়া করতো। আমাকে দেখে সে জিজ্ঞাসা করলো তুমি কে? আমি বললাম, আমি আপনার কথা শুনে এবং আপনার বাহিনী প্রস্তুত করার খবর শুনে যোগ দিতে এসেছি। আমি তার সাথে কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করলাম, এরপর (এক নির্জন গলি পথে এসে) সে যেই আমাকে সুযোগ করে দিলো আমি অমনি তার উপর তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম এবং হত্যার পর রাস্তার বালু পাথর ইত্যাদি দিয়ে তাকে ঢেকে ফেললাম।
    অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে তিনি বলেন ‘অতঃপর রাত গভীর হয়ে পড়লে লোকেরা যখন ঘুমিয়ে পড়লো তখন আমি চুপচাপ তাকে হত্যা করে তার মাথা কেটে নিয়ে এলাম। তারপর যখন তার কাটা মাথা নিয়ে রাসূলের কাছে আসলাম তখন তিনি আমাকে দেখেই বললেন, – أفلح الوجه অর্থাৎ তোমার চেহারা সফলতায় উদ্ভাসিত হয়েছে; আমি বললাম ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি আল্লাহর ইচ্ছায় তাকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছি। তিনি বললেন, তুমি সত্য বলেছো। তারপর তিনি আমাকে নিয়ে তাঁর ঘরে প্রবেশ করে আমাকে একটি লাঠি উপহার দিয়ে বললেন, হে আব্দুল্লাহ ইবনে উনায়স, এই লাঠিটি কেয়ামতের দিন আমার ও তোমার মাঝে (সম্পর্কের) নিদর্শন স্বরূপ তোমার কাছে রেখে দাও।
    খুব কম মানুষই সেদিন এমন লাঠির অধিকারী হবে। বর্ণনাকারী বলেন, আব্দুল্লাহ সেই লাঠিটিকে তার তলোয়ারের সাথে লাগিয়ে রেখেছিলেন, তিনি সেটিকে সব সময় সাথে সাথে রাখতেন, এমনকি মৃত্যুর সময় তিনি এটি তার সাথে দিয়ে দিতে নির্দেশ দেন; আর এভাবে সে লাঠিটি তার কাফনের মধ্যে দিয়ে তাকে দাফন করা হয়।

    ৬ষ্ঠ দলীলঃ ইহুদী নারীর হত্যাকাণ্ড –

    ইমাম শা’বী রহঃ হযরত আলি রাঃ এর সুত্রে বর্ণনা করেন, এক ইহুদী মহিলা ছিল যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি গালাজ করতো এবং তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন রকম আপত্তিকর মন্তব্য করতো। অতঃপর এক ব্যক্তি তার শ্বাসনালী চেপে ধরে তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকে মেরে ফেলে। এ ঘটনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলে তিনি সে মহিলার কোন রক্তমুল্য পরিশোধের নির্দেশ দেননি (অর্থাৎ, খুনিকে ক্ষমা করা হয়।)
    ইমাম আবু দাউদ ও অন্যান্য সংকলকগণ এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, এ হাদিসটি উত্তম, কারণ ইমাম শা’বী আলী (রাঃ) কে দেখেছেন এবং তার থেকে তিনি নিজে বর্ণনা করেছেন।
    এ ঘটনা দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, নারী হোক কিংবা পুরুষ, যিম্মী হোক বা চুক্তিবদ্ধ, এমনকি যদি মুসলিম নামধারীও হয় তবুও আল্লাহর রাসূলের শানে অসম্মান জনক কথা বললে তাকে হত্যা করা সম্পূর্ণ বৈধ।কারণ এ ঘটনায় অপরাধী হল একজন মহিলা এবং সে মদীনার চুক্তিবদ্ধ ইহুদী সম্প্রদায়ের লোক ছিল।

    ৭ম দলীলঃ মুশরিকদের গুপ্তচরকে হত্যার ঘটনা –

    সালামা ইবনু আকওয়া বর্ণনা করেন, একবার রাসূলুল্লাহর কোন এক সফরের সময় তাঁর কাছে মুশরিকদের পাঠানো একজন গুপ্তচর আসলো। সে এসে তাঁর সাহাবিদের সাথে বসে বেশ কিছুক্ষন কথাবার্তা বলে চলে গেলো। এরপর (যখন তিনি জানতে পারলেন যে সে গুপ্তচর ছিলো তখন) তিনি বললেন اطلبوه واقتلوه তাকে খুঁজে বের করে এনে হত্যা করে ফেলো। তারপর (কোন এক সাহাবী) তাকে খুঁজে বের করে হত্যা করে ফেলে; নবী তখন নিহতের কাছে থাকা মালামাল হত্যাকারীকে প্রদান করেন (গনিমত হিসেবে।)
    (সহীহ আল বুখারী হাদিস নং ৩০৫১, সহীহ মুসলিম হাদিস নং ১৭৫৩, আধুনিক প্রকাশনীর ছাপায় বুখারির হাদিস নং ২৮২৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ছাপায় বুখারির হাদিস নং ২৮৩৩; মুসনাদে আহমাদ হাদিস নং ১৬৫২৩)

    ৮ম দলীলঃ আসমা বিনতে মারওয়ানের হত্যাকাণ্ড –

    শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া তার ‘আস স-রিমুল মাসলুল আ’লা শাতিমির রাসূল’ নামক গ্রন্থে এবং ইমাম মাকরিযী ‘ইমতাউল ইসমা’ নামক গ্রন্থে এ ঘটনাটি সংকলন করেছেন।
    ইবনে আব্বাস বলেন, খুতামা গোত্রের এক মহিলা রাসূলুল্লাহর শানে অপমান জনক কথাবার্তা বলতো; রাসূলুল্লাহ এক দিন বলেন, আমার পক্ষ থেকে তাকে শায়েস্তা করার কে আছো? সেই মহিলার গোত্রের এক ব্যক্তি দাড়িয়ে বলল, আমি আছি ইয়া রাসূলাল্লাহ। অতঃপর সে তাকে হত্যা করে এসে নবীকে খবর দেয়। তিনি খবর শুনে (তার রক্তপণ প্রসঙ্গে) তিনি বলেন দু’টো ছাগলও তার (রক্তপণের) ব্যাপারে বাদানুবাদ করতে পারে না। (অর্থাৎ তার রক্তপন পরিশোধের কোন প্রশ্নই ওঠে না!)
    আসহাবুল মাগাযী বা যুদ্ধের ঘটনা সংকলকগণের অনেকেই আরও বিস্তারিতভাবে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ইমাম ওয়াকেদী বলেন, আব্দুল্লাহ বিন হারিস ফুযায়ল থেকে তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করে যে আসমা বিনতে মারওয়ান ছিল ইয়াযিদ বিন হিসান আল খাত্তামির অধিনস্ত। সে আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দিতো এবং ইসলামের সমালোচনা করতো এবং এ উদ্দেশ্যে সে কবিতা রচনা করতো। উমায়র বিন আদি আল খাত্তামী এই দুষ্ট মহিলার কথাবার্তা শুনে বলেন, হে আল্লাহ, আমি তোমার নামে একটি মান্নত করছি, আমি যদি মদিনায় ফিরতে পারি তাহলে আল্লাহর রাসূলের তরফ থেকে আমি তাকে হত্যা করবো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদর থেকে ফিরে আসার পর এক রাতে উমায়ের বেরিয়ে পড়েন তার মিশন সফল করতে। তিনি গভীর রাতে এসে তার ঘরে প্রবেশ করেন। তিনি অন্ধকারে হাতড়ে তাকে বের করে বুঝতে পারেন যে, সে তার এক বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে। তিনি বাচ্চাটিকে আস্তে করে ছাড়িয়ে নিয়ে তার পেটের মধ্যে তলোয়ার ঢুকিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেন। মিশন শেষ করে এসে তিনি আল্লাহর রাসুলের সাথে ফজর সালাত আদায় করেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ উমায়রের দিকে তাকিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কি আসমা বিনতে মারওয়ানকে হত্যা করে ফেলেছ? তিনি বললেন, আমার পিতা আপনার জন্য কুরবান হোক ইয়া রসুলাল্লাহ, হ্যা আমি তাকে হত্যা করেছি।
    উমায়ের ভয় পাচ্ছিলেন যে, সে মহিলাকে হত্যার কারণে আল্লাহর রাসুলের উপর আবার কোন ঝামেলা এসে পড়ে কি না; তাই সংশয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন : ইয়া রাসুলাল্লাহ, এ কারণে কি আমার উপর (রক্তমুল্য পরিশোধের) কোন দায় ভার বর্তাবে? তিনি বলেন তার (রক্তমুল্যের) ব্যাপারে দুটো ছাগলও বাদানুবাদ করতে পারে না। অতঃপর নবী মোহাম্মদ তাঁর আশপাশে যারা ছিল তাদেরকে লক্ষ করে বললেন, তোমাদের যখন মন চাইবে এমন কোন ব্যক্তির দিকে তাকাতে যে আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসুলকে সাহায্য করেছে তখন তোমরা উমায়ের বিন আদি এর দিকে তাকাবে। ওমর ইবনুল খাত্তাব তখন বলেন, তোমরা এই অন্ধ ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে দেখ যে আল্লাহর আনুগত্যে ঝাপিয়ে পড়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কথা শুনে বলেন-
    لاتقل الأعمى ولكنه البصير তাকে অন্ধ বল না সে তো চক্ষুষ্মান। উমায়ের যখন নবীর কাছ থেকে বেরিয়ে এসে তার নিজ গোত্রের এলাকায় আসলেন তখন লোকেরা সেই মহিলার দাফন কাফনে ব্যস্ত ছিলো। তারা তাকে মদিনার দিক থেকে আসতে দেখে সন্দেহ করলো; তাকে জিজ্ঞাসা করলো – উমায়ের! তুমিই কি এই মহিলাকে হত্যা করেছ? তিনি বললেন, হ্যা আমিই হত্যা করেছি; অতএব তোমরা সবাই মিলে আমাকে শায়েস্তা করার যে কোন ফন্দি আঁটতে পারো, আর আমাকে ( তা প্রতিরোধের) কোন অবকাশই দিও না। যার হাতে আমার প্রাণ আমি সেই সত্ত্বার কসম করে বলছি, তোমরা সকলেও যদি তার মতো একই কথা বলতে তাহলে আমি একা তোমাদের সবার উপর তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম; হয় আমি নিহত হতাম অথবা তোমাদেরকে হত্যা করে ফেলতাম। (আবু দাউদ- ৪৩৬৩, দারা কুতনি- ১০১, আল মু’জামুল কাবীর- ১১৯৮৪, বুলুগুল মারাম- ১২০৪, তাবাকাত ইবনে সাদ)
    ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, সাহাবায়ে কেরামদের মাঝে এটা একটা সাধারণ প্রচলন ছিল যে, আল্লাহর রাসূলকে কেউ কষ্ট দিয়েছে একথা তারা জানতে পারলে তারা তাকে নির্দ্বিধায় হত্যা করে ফেলতেন, কেননা তার এ অপরাধের শাস্তি হিসেবে এটাই তার প্রাপ্য। কেবল আল্লাহর রাসুলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা সাপেক্ষে তিনি যদি কাউকে ক্ষমা করে দিতেন তবেই কেউ হত্যার হাত থেকে বাঁচতে পারতো। তবে এ ধরণের অপরাধী কোন ব্যক্তিকে ক্ষমা প্রার্থনার আগেই যদি কেউ হত্যা করে ফেলত তাহলে রাসূলুল্লাহ হত্যাকারীকে কোন দোষারোপ করতেন না, বরং তাকে বাহবা দিতেন এবং তার প্রশংসা করতেন; কেননা সে তো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে সাহায্য করেছে।
    যেমন হযরত ওমর এক ব্যক্তিকে হত্যা করে ফেলেছিলেন এ কারণে যে, সে আল্লাহর রাসুলের বিচারে সন্তুষ্ট হয়েছিলো না। আল্লাহর রাসূলের ইন্তেকালের সাথে সাথে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে আর বাকি রয়ে গেছে কেবল শাস্তি প্রয়োগের বিধান।

    ৯ম দলীলঃ ইহুদী আবু আফাকের হত্যাকাণ্ড –

    সীরাত ও যুদ্ধের ঘটনা সংলকদের অনেকেই এ ঘটনা সংকলন করেছেন। ইমাম ওয়াকেদী বর্ণনা করেন যে, বনু আমর গোত্রের এক অতিশয় বয়স্ক বৃদ্ধ ছিল যাকে আবু আফাক বলে ডাকা হতো; তার বয়স হয়ে গিয়েছিলো একশত বিশ বছর। নবী মদিনায় আগমন করলে সে ইসলামে তো প্রবেশ করেইনি বরং আদা জল খেয়ে তাঁর বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়। নবী যখন বদর যুদ্ধের জন্য মদিনা থেকে বের হন তখন তাঁর হিংসার আগুন আরও জ্বলে ওঠে, সে যা খুশি তাই বলা আরম্ভ করে, সে আল্লাহর রাসুলের শানে অপমানজনক কবিতা লিখে প্রচার করে এবং তাঁর সাহাবিদের নামেও বিভিন্ন রকম কুৎসা রটনা আরম্ভ করে। সালিম বিন উমায়ের (রাঃ) তার এসব শুনে বলেন, আমি মানত করলাম যে হয় আমি তাকে হত্যা করবো অথবা আমি নিহত হব; মদিনায় ফিরে তিনি অপেক্ষায় থাকেন কখন সুযোগ পাওয়া যায়। অতঃপর এক দিন তিনি সেই মোক্ষম সুযোগটি পেয়ে গেলেন। এক গরমের রাতে আবু আফাক বাইরে শুয়ে ছিল। সালিম বিন উমায়ের আস্তে করে তার কাছে গিয়ে শরীরের মাঝখান থেকে এমনভাবে তলোয়ার চালিয়ে দেন যে, সে প্রায় দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়।
    আল্লাহর শক্র তারস্বরে চিৎকার আরম্ভ করে দেয়; সালিম বিন উমায়র চুপিসারে সরে পড়েন। তারপর তাঁর আশপাশের লোকেরা এসে জড়ো হয়ে বলতে থাকে, আল্লাহর কসম আমরা যদি তার হত্যাকারীকে শনাক্ত করতে পারি তাহলে অবশ্যই তাকে হত্যা করবো। ইমাম ওয়াকেদী বলেন, আবু আফাকের হত্যাকাণ্ড হিজরতের বিশ মাসের মাথায় শাওয়াল মাসে সংগঠিত হয়েছিলো। ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, ঘটনাটি সংগঠিত হয়েছিলো কা’ব বিন আশরাফের ঘটনার পূর্বে; আর এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে চুক্তিবদ্ধ কোন জাতি গোষ্ঠীর লোকেরাও যদি আল্লাহ কিংবা তাঁর রাসুলের শানে অপমানজনক কিছু বলে তাহলে সে ব্যক্তির নিরাপত্তা রহিত হয়ে যায়।
    ১০ম দলীলঃ আসওয়াদ আল আনাসীর হত্যাকাণ্ড-
    আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া, তাবাকাতে ইবনে সা’দ, সীরাতে ইবনে হিশাম, তারিখে তাবারী সহ ইসলামের ইতিহাসও আল্লাহর রাসুলের যতো সীরাত গ্রন্থ রয়েছে তার প্রায় সকল গ্রন্থেই এ ঘটনা বিশুদ্ধ সনদে সংকলিত হয়েছে। বিভিন্ন সংকলকের বর্ণনার মধ্যে খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয়ে সামান্য তারতম্য থাকলেও সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপক কোন মত পার্থক্য নেই। আমি এখানে সে সব বর্ণনাসমূহের সমন্বিত একটি ধারা বর্ণনা তুলে ধরবো।
    বিদায় হজ্জের পর নবী মোহাম্মদ যখন ক্রমান্বয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন তখন বিভিন্ন দিকে নবুওয়ত দাবির ফেতনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এসব নবুওয়ত দাবিদারদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিল ইয়েমেনের আসওয়াদ আল আনাসী। সে আগে থেকেই গণক শ্রেণীর লোক ছিল, সে যাদু বিদ্যায়ও পারদর্শী ছিল। সে বেশ প্রভাবশালীও ছিল; মানুষকে বিমোহিত ও মন্ত্রমুগ্ধ করার এক বিশেষ দক্ষতা ছিল তাঁর। এসব কারণে সে শুধু সমাজের সাধারণ মানুষের উপরই নয় বরং সমাজের উচুস্তর ও বিত্তশালী লোকদের উপরও সে বেশ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সে নিজেকে এক রহস্যময় মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জনসমক্ষে বের হওয়ার সময় বিশেষ এক ধরণের মুখোশ পড়ে বের হতো। আসওয়াদ আল আনাসীর হত্যাকাণ্ডে যিনি সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন তিনি হলেন ফিরোজ আদ দায়লামী।
    ইয়েমেনে সে সময় যারা প্রভাবশালী ও সম্মানের অধিকারী ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল আবনা সম্প্রদায়ের লোকজন। এই সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল পারস্যের সাসানী শাসক শ্রেণীর উত্তর পুরুষ যারা দীর্ঘ দিন ইয়েমেনকে শাসন করেছে এবং এদের মায়েরা ছিল স্থানীয় আরব। ফিরোজ আদ দায়লামি ছিলেন ইয়েমেনের এই আবনা সম্প্রদায়ের লোক।
    ইসলামের আবির্ভাবের সময় আবনাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিল বাজান এবং সে–ই পারস্য সাম্রাজ্যেরপক্ষ থেকে এ অঞ্চলে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতো। যখন সে ইসলামের সত্যতা তথা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আসমানী দাওয়াতের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হল তখন পারস্য সাম্রাজ্য থেকে আনুগত্য প্রত্যাহার করে ইসলাম গ্রহণ করে এবং তার অধিনস্ত লোকেরাও তাকে অনুসরণ করে ইসলাম গ্রহণ করে।
    নবী মোহাম্মদও তাকে শাসক হিসেবে বহাল রাখেন। কিন্তু আসওয়াদ আল আনাসীর আবির্ভাবের কিছু দিন পূর্বে তিনি ইন্তেকাল করেন। আসওয়াদ আল আনাসীর গোত্র বনু মুদহিজ সর্বপ্রথম তার মিথ্যা নবুওয়তের দাবীর প্রতি সমর্থন জানায়। সে তার গোত্রীয় বাহিনী নিয়ে ইয়েমেনের সানায় আক্রমণ চালিয়ে এখানকার গভর্ণর বাধানের পুত্র শাহারকে হত্যা করে এবং তার স্ত্রী দাদওয়াহকে সে জোরপূর্বক নিজে গ্রহণ করে। সানা থেকে সে আশপাশের অঞ্চলে একের পর এক অভিযান চালাতে থাকে। তার এই অতর্কিতে আক্রমণের ফলে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে হাদরামাওত থেকে তায়েফ ও আল আহসা থেকে এডেন পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল তার দখলে চলে আসে। আসওয়াদ আল আনাসীর ফিতনা যখন প্রায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং রাসুলুল্লাহ তার কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হন তখন একটি চিঠি দিয়ে সাহাবি মু’য়ায বিন জাবাল এর নেতৃত্বে দশ জন সাহাবীকে ইয়েমেনের বিশ্বস্ত অনুসারীদের নিকট প্রেরণ করেন। তিনি যে কোন মুল্যে আসওয়াদ আল আনাসীর ফিতনা নির্মূল করার নির্দেশ দেন।
    আল্লাহর রাসুলের চিঠি পাওয়ার পর ফিরোজ আদ দায়লামী তার অন্যান্য সাথী সঙ্গীদেরকে নিয়ে কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য বৈঠকে বসেন। এ ব্যাপারে ফিরোজ আদ দায়লামী বলেন-
    ‘আমরা আগে থেকেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম আসওয়াদ আল আনাসীকে শায়েস্তা করার জন্য, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিলাম না। এরপর আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি পাওয়ার পর আমাদের নৈতিক শক্তি বহু গুনে বৃদ্ধি পায় এবং আমাদের প্রত্যেকে তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে এ দায়িত্ত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য। এদিকে আসওয়াদ আল আনাসী তার একের পর এক সফলতার কারণে বেশ অহংকারী হয়ে পড়ে; ফলে সে তার সেনাপতিদের সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করা আরম্ভ করে যে স্বয়ং তাদেরও মনে হচ্ছিলো যে, পান থেকে চুন খসলে তারাও যে কেউ যে কোন সময় তার আক্রোশের শিকার হয়ে যেতে পারে। তার একজন সেনাপতি ছিল কায়েস বিন ইয়াগুস; আমি আমার চাচাত বোন দাদাহকে নিয়ে একদিন কায়েসের সাথে সাক্ষাত করে রাসুলের চিঠি সম্পর্কে তাকে অবহিত করলাম এবং তাকে বললাম যে, তার হাতে তুমি শায়েস্তা হওয়ার আগে বরং তুমি তাকে শায়েস্তা করে ফেলো। সে আমাদের প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেয় এবং আমাদেরকে সে আসওয়াদ আল আনাসীর বেশ কিছু গোপন তথ্য সরবরাহ করে। এরপর আমরা তিনজন পরিকল্পনা করলাম যে আমরা তাকে দুর্গের ভেতর থেকে আক্রমন করবো এবং আমাদের অন্য ভাইয়েরা বাহির থেকে থেকে আক্রমন করবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা আমাদের আত্মীয়া দাদওয়ায়হকেও আমাদের দলে ভেড়াবো, যার স্বামীকে হত্যা করে আসওয়াদ আল আনাসী তাকে জোর পূর্বক নিজের স্ত্রী বানিয়ে নিয়েছিলো। আমরা আসওয়াদ আল আনাসীর দুর্গে গিয়ে দাদওয়ায়হ এর সাথে সাক্ষাত করে তাকে বললাম, তুমি ভালো করেই টের পাচ্ছো যে এই ব্যক্তি তোমার জীবনকে কিভাবে দুর্বিষহ করে তুলেছে, সে তোমার স্বামীকে হত্যা করেছে, তোমার সম্প্রদায়ের নারী পুরুষ সবাইকে লাঞ্ছিত করেছে, তাদেরকে হত্যা করে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে। আল্লাহর রাসুল আমাদের কাছে এই ফিতনাকে চিরতরে মিটিয়ে দেয়ার জন্য এই চিঠি পাঠিয়েছেন। তুমি কি এ ব্যপারে আমাদেরকে সহযোগিতা করবে?
    সে বললো, আমি কিভাবে তোমাদেরকে সহযোগিতা করতে পারি? আমি তার ইতিবাচক মনোভাব বুঝতে পেরে সরাসরি বলে ফেললাম যে আমরা তাকে হত্যা করতে চাই। আমার কথা শুনে সে বললো, ‘আল্লাহর কসম আমিও মনে মনে একই কথা ভাবছিলাম, সেই সত্ত্বার কসম যিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, আমি তার অধীনে থাকলেও আমার মনে আমার ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে কখনো বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক হয়নি, আল্লাহ আমার জন্য তার চেয়ে নিকৃষ্ট কোন ব্যক্তিকে সৃষ্টি করেননি। আল্লাহর কসম! আমি যখন থেকে তাকে দেখে আসছি তাকে কেবল মিথ্যাচারী, ভণ্ড, প্রতারক ও শয়তান রূপেই দেখে আসছি; তার থেকে আমি আজ পর্যন্ত ভালো কিছু দেখিনি’।
    আমি তাকে বললাম, এখন বলো কিভাবে আমরা তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে পারি। সে তো সব সময় নিরাপত্তা রক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। সে আমাদেরকে দুর্গের একটি পরিত্যক্ত রুমের কথা বলে বললো, তোমরা রাতের প্রথম প্রহরে ওখান থেকে প্রবেশ করবে, ওখানে তোমাদের জন্য অস্ত্র ও আলোর ব্যবস্থা করা থাকবে, আর স্বয়ং আমিও সেখানে থাকবো। আমি বললাম, তুমি যা বলেছো মন্দ নয় তবে এভাবে প্রবেশ করতে গেলে আমরা নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে ধরা পড়ে যেতে পারি, তুমি তার চেয়ে আমার কাছে তোমার একজন বিশ্বস্ত একজন কাজের লোককে পাঠাও, আমি তাকে বুঝিয়ে দেবো, দুর্গের কোন স্থানে ভেতর থেকে একটি প্রবেশপথ তৈরি করে রাখলে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যাবে।
    এরপর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে আমরা একদিন রাতে আমাদের তৈরি করা নির্দিষ্ট স্থান দিয়ে প্রবেশ করলাম, পরিকল্পনা মাফিক সেখানে অস্ত্র ও আলো আগে থেকেই রাখা ছিল; আমরা আস্তে করে আল্লাহর শত্রুর রুমের দিকে অগ্রসর হলাম, আমার আত্মীয়াকে তার দরজায় দাঁড়ানো পেলাম, সে আমাদেরকে তার অবস্থান স্থল দেখিয়ে দিলো। আমরা তার ঘরে প্রবেশ করে দেখলাম সে গভীর ঘুমে নাক ডাকছে। আমি তার গলায় তলোয়ার চালাতেই সে ষাঁড় জবাই করার সময় যেভাবে শব্দ করে সেভাবে গোঙ্গানি দিয়ে উঠলো। শব্দ শুনে রুমের অদুরে দাড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা রক্ষীরা ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করলো, কী হয়েছে? কিসের শব্দ হল এটা? দাদওয়ায়হ তাদেরকে বলল, তোমরা তোমাদের কাজে যাও, আল্লাহর নবীর উপর ওয়াহী অবতীর্ণ হচ্ছে! একথা শুনে তারা চলে গেলো। আমরা সকাল অব্দি দুর্গের মধ্যেই অবস্থান করলাম। ফজরের সময় ঘনিয়ে এলে আমি একটি ওয়ালের উপর উঠে তিন বার তাকবীর দিলাম; তারপর আযান দেয়া আরম্ভ করলাম, ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল) বলে তার সাথে আরো যোগ করলাম ‘ওয়া আশহাদু আন্না আসওয়াদ আল আনাসী আল কাযযাব’ (এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আসওয়াদ আল আনাসী হল মহা মিথ্যাবাদী।)
    এটাই ছিল আমাদের পূর্ব নির্ধারিত সংকেত যার দ্বারা আমাদের অন্য সাথীরা মিশন সফল হওয়ার সুসংবাদ পাবে। আমি এই ঘোষণা দেয়ার পর চারিদিক থেকে মুসলমানরা আল্লাহু আকবার তাকবীর ধ্বনি দিয়ে একযোগে আক্রমন করে। সকালের আলো ফুটে ওঠার আগেই তার দুর্গের পতন ঘটলো এবং আমাদের মিশন সফল হল এবং সাথে সাথে আমরা বিশেষ দূত মারফত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আল্লাহর শত্রুর সদলবলে নিহত হওয়ার সংবাদ প্রেরণ করি। কিন্তু বার্তা বাহক মদিনায় পৌঁছে দেখতে পায় যে, নবী সেই রাতেই ইন্তেকাল করেছেন। তবে অন্যান্য সাহাবীদের থেকে তারা জানতে পারেন যে, যখন আমাদের অপারেশন সফল হয় তখনই তিনি এ সংবাদ ওয়াহীর মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন’।

    প্রিয় মুমিন পাঠক, আপনি এতক্ষণ যা পড়েছেন তা কি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে?
    আমি যে রেফারেন্সগুলি এখানে দিয়েছি তার সত্যাসত্য যাচাই করা কঠিন কিছু নয়, শুধু একটু গুগল সার্চ করলেই সব পেয়ে যাবেন। প্রেক্ষাপট, আগ-পিছ, হেতু এসবও জানতে পারবেন খুব সহজে। আর তাফসীর বির রাঈ (নিজের মনমতো ব্যাখ্যা করা) হারাম।
    আসুন জেনে নিই, নবীর কটুক্তিকারীর শাস্তি সম্পর্কে পরবর্তী যুগের ফকীহ এবং মুফতিদের কি মতামত — ইবনে হাজার আসকালানী : নবীকে কটুক্তিকারীকে মুরতাদ হওয়ার অপরাধে হত্যা করতে হবে, এবং তাকে তওবা করার অনুরোধ করার প্রয়োজন নেই (বুলুগুল মারাম, ১৩২)
    ‘নবীকে গালি দিলে বা কটুক্তি করলে তাকে যেকোনভাবে হত্যা করা ফরজ।’

    প্রমাণ পঞ্জী : জামেউল আহাদীস ২২৩৬৬, জামউল জাওয়ামে ৫০৯৭, দায়লামী ৫৬৮৮, আস সারিমুল মাসলুল ৯২, ফতোয়ায়ে বাযযাযিয়াহ ৩২৮, ফাতহুল কাদীর ৪/৪০৭, কিতাবুশ শিফা ২/২১১, অাসসাইফুল মাসলুল অালা মান সাব্বার রাসুল, সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ ১২/২১, রাসায়েলে ইবনে আবিদীন ১/৩১৬, বুলুগুল মারাম ১৩৩, মাহাসিনিত তাবীল ৫/১৪২, ফাতহুল বারী-ইবনে হাজার।

    যেসব গ্রন্থে রেফারেন্স দিলাম তার রচয়িতা কে, গ্রন্থের গ্রহণযোগ্যতা কটতুকু, এখনকার যুগে এসব ফতোয়া সচল নাকি অচল – এব্যাপারে আলেমদের কাছে জিজ্ঞেস করুন; জাহেলী আচরণ কাম্য নয়।
    শেষ প্রশ্ন : জঙ্গিরা যা করছে তা কি ইসলাম-বহির্ভূত?
    ব্লগার হত্যা কি ইসলাম-বহির্ভূত?

    -Collected‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬‬
    Last edited by Munshi Abdur Rahman; 02-17-2021, 10:15 PM.
    ক্বিতাল ব্যতীত দ্বীন অসম্পূর্ণ -ড.আব্দুল্লাহ আযযাম রহিঃ!!

  • #2
    মাশা আল্লাহ, দলীলভিত্তিক লেখা। আমাদের সকলের এ থেকে উপকৃত হওয়া উচিত।
    আল্লাহ এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের মেহনতকে কবুল করুন ও উত্তম জাযা দান করুন।
    “ধৈর্যশীল সতর্ক ব্যক্তিরাই লড়াইয়ের জন্য উপযুক্ত।”-শাইখ উসামা বিন লাদেন রহ.

    Comment


    • #3
      Originally posted by Munshi Abdur Rahman View Post
      মাশা আল্লাহ, দলীলভিত্তিক লেখা। আমাদের সকলের এ থেকে উপকৃত হওয়া উচিত।
      আল্লাহ এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের মেহনতকে কবুল করুন ও উত্তম জাযা দান করুন।
      আমিন ছুম্মা আমিন।

      Comment


      • #4
        Originally posted by Munshi Abdur Rahman View Post
        মাশা আল্লাহ, দলীলভিত্তিক লেখা। আমাদের সকলের এ থেকে উপকৃত হওয়া উচিত।
        আল্লাহ এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের মেহনতকে কবুল করুন ও উত্তম জাযা দান করুন।
        আমিন! ইয়া! রব্বাল 'আলামিন!
        হয় শাহাদাহ নাহয় বিজয়।

        Comment


        • #5
          আলহামদুলিল্লাহ, উপকৃত হওয়ার মত পোস্ট। আল্লাহ আপনার খেদমতকে কবুল করুন ও জাযায়ে খাইর দান করুন। আমীন
          ‘যার গুনাহ অনেক বেশি তার সর্বোত্তম চিকিৎসা হল জিহাদ’-শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.

          Comment

          Working...
          X