গুপ্ত হত্যা: হাদিস-৪: আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা
একাকী জিহাদ ও গুপ্ত হত্যার ইমাম আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহু। আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা ঘটেছে ৬ষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধির পর। হুদায়বিয়ার সন্ধির একটা শর্ত ছিল, মক্কার কেউ মুসলমান হয়ে মদীনায় চলে এলে তাকে মক্কায় ফেরত পাঠাতে হবে, তবে মদীনার কেউ মুরতাদ হয়ে মক্কায় চলে গেলে তাকে মদীনায় পাঠনো হবে না। বাহ্যত এ সন্ধি মুসলমানদের জন্য অপমানকর মনে হলেও আল্লাহ তাআলা একেই ঘোষণা দিয়েছেন, ‘ফাতহুম মুবিন- সুস্পষ্ট বিজয়’। আর বাস্তবেও এমনই ছিল।
আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা ইমাম বুখারী রহ. এভাবে বর্ণনা করেছেন,
ثم رجع النبي صلى الله عليه و سلم إلى المدينة فجاءه أبو بصير رجل من قريش وهو مسلم فأرسلوا في طلبه رجلين فقالوا العهد الذي جعلت لنا فدفعه إلى الرجلين فخرجا به حتى إذا بلغا ذا الحليفة فنزلوا يأكلون من تمر لهم فقال أبو بصير لأحد الرجلين والله إني لأرى سيفك هذا يا فلان جيدا فاستله الآخر فقال أجل والله إنه لجيد لقد جربت به ثم جربت فقال أبو بصير أرني أنظر إليه فأمكنه منه فضربه حتى برد وفر الآخر حتى أتى المدينة فدخل المسجد يعدو فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم حين رآه ( لقد رأى هذا ذعرا ) . فلما انتهى إلى النبي صلى الله عليه و سلم قال قتل والله صاحبي وإني لمقتول فجاء أبو بصير فقال يا نبي الله قد والله أوفى الله ذمتك قد رددتني إليهم ثم نجاني الله منهم قال النبي صلى الله عليه و سلم ( ويل أمه مسعر حرب لو كان له أحد ) . فلما سمع ذلك عرف أنه سيرده إليهم فخرج حتى أتى سيف البحر قال وينفلت منهم أبو جندل بن سهيل فلحق بأبي بصير فجعل لا يخرج من قريش رجل قد أسلم إلا لحق بأبي بصير حتى اجتمعت منهم عصابة فوالله ما يسمعون بعير خرجت لقريش إلى الشأم إلا اعترضوا لها فقتلوهم وأخذوا أموالهم فأرسلت قريش إلى النبي صلى الله عليه و سلم تناشده بالله والرحم لما أرسل فمن آتاه فهو آمن فأرسل النبي صلى الله عليه و سلم إليهم فأنزل الله تعالى { وهو الذي كف أيديهم عنكم وأيديكم عنهم ببطن مكة من بعد أن أظفركم عليهم - حتى بلغ - الحمية حمية الجاهلية }
“এরপর (সন্ধি শেষে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় ফিরে এলেন। তখন আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহু- যিনি কুরাইশ গোত্রের লোক- (পালিয়ে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে চলে এলেন। তিনি মুসলমান ছিলেন। মক্কার কুরাইশরা তাঁর তালাশে দু‘জন লোক পাঠাল। তারা (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে) বলল, আপনি আমাদের সাথে যে চুক্তি করেছেন (তা পূর্ণ করুন এবং আবু বাসীরকে ফেরত দিন)। তিনি তাকে ঐ দুই ব্যাক্তির হাওয়ালা করে দিলেন। তাঁরা তাকে নিয়ে (মক্কায়) রওয়ানা হল। যুল-হুলায়ফায় পৌঁছে অবতরণ করল। সেখানে তাদের সাথে যে খেজুর ছিল তা খেতে লাগল।
আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের একজনকে বললেন, আল্লাহর কসম! হে অমুক, তোমার তরবারিটি খুবই চমৎকার দেখছি। সে লোকটি তরবারিটি বের করে বলল, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম! এটি একটি উৎকৃষ্ট তরবারি। আমি একাধিক বার তা পরীক্ষা করেছি। আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তলোয়ারটি আমি দেখতে চাই। আমাকে দেখাও। লোকটি আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তলোয়ারটি দিল। আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহু সেটি দ্বারা তাকে এমন আঘাত করলেন যে, সে মরে গেল। তার অপর সঙ্গী পালিয়ে মদিনায় এসে পৌঁছল এবং দৌঁড়তে দৌঁড়তে মসজিদে (নববীতে) প্রবেশ করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখে বললেন, লোকটি ভীতিজনক কিছু দেখে এসেছে।
লোকটি যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে উপস্থিত হল বলল, আল্লাহর কসম! আমার সঙ্গীকে হত্যা করা হয়েছে, (আপনার রক্ষা না করলে) আমিও নিহত হতে যাচ্ছি। তখন আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহুও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হলেন। বললেন, ইয়া নাবীয়াল্লাহ! আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনার চুক্তি পূর্ণ করেছেন। আপনি (চুক্তিমতো) আমাকে তাদের কাছে ফেরত দিয়েছেন। এরপর আল্লাহ আমাকে তাদের কবল থেকে নাজাত দিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সর্বনাশ! এ তো যুদ্ধের আগুন প্রজ্জলনকারী। যদি তাকে সহায়তা করার কেউ থাকতো!
(মুশরিক লোকটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ কথা থেকে বুঝেছিল যে, যদি তার আরো কতক সাথী থাকতো তাহলে আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহু হত্যা করে পালাতে পারতো না। তবে প্রচ্ছন্নভাবে মূলত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন যে, তুমি কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আগুন জ্বালাও। এ কাজের জন্য তোমার সাথে আরো কিছু সাথী থাকলে ভাল হবে। এজন্য মক্কার নির্যাতিত মুসলমানগণ যেন পালিয়ে তোমার সাথে মিলিত হয়। চুক্তি থাকার কারণে সরাসরি আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে একথা বলতে পারছিলেন না। তাই ঈঙ্গিতে বলেছেন। হাফেজ ইবনে হাজার রহ. ফাতহুল বারিতে এমনই বলেছেন।)
আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন এ কথা শুনলেন, বুঝতে পারলেন, (এখানে থাকলে) তিনি তাকে আবার কাফেরদের কাছে ফেরত পাঠাবেন। তাই তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লেন এবং সমূদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় চলে গেলেন।
বর্ণনাকারী বলেন, এ দিকে আবু জানদাল ইবনু সুহাইল রাদিয়াল্লাহু আনহু কাফেরদের কবল থেকে পালিয়ে এসে আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে মিলিত হলেন। এরপর থেকে কুরাইশ গোত্রের ইসলাম গ্রহণ করেছে এমন যে-ই পালাতে পারতো, সে-ই আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে এসে মিলিত হতো। এভাবে (চল্লিশ বা সত্তরজনের মতো) তাদের একটি দল হয়ে গেল। আল্লাহর কসম! তারা যখনই শুনতেন যে, কুরাইশদের কোন বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া যাচ্ছে, তখনই তারা তাদের পথ অবরোধ করতেন। তাদের হত্যা করতেন। তাদের মাল-সম্পদ কেড়ে নিতেন। (অবস্থা বেগতিক দেখে) কুরাইশরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে লোক পাঠাল। আল্লাহ ও আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে আবেদন করল, ‘আপনি আবু বাসীরের কাছে এ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ পাঠান। এখন থেকে (মক্কা থেকে) কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে চলে এলে সে নিরাপদ থাকবে (কুরাইশদের কাছে ফেরত পাঠাতে হবে না)’।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাদের কাছে (এ মর্মে) নির্দেশ পাঠালেন। তখন আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাযিল করেন: وَهُوَ الَّذِي كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ عَنْهُمْ بِبَطْنِ مَكَّةَ مِنْ بَعْدِ أَنْ أَظْفَرَكُمْ عَلَيْهِمْ থেকে الْحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ পর্যন্ত।”- সহীহ বুখারী ২৫৮১
ঘটনার পরের অংশের বিবরণে হাফেয ইবনে হাজার রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,
وفي رواية موسى بن عقبة عن الزهري فكتب رسول الله صلى الله عليه و سلم إلى أبي بصير فقدم كتابه وأبو بصير يموت فمات وكتاب رسول الله صلى الله عليه و سلم في يده فدفنه أبو جندل مكانه وجعل عند قبره مسجدا قال وقدم أبو جندل ومن معه إلى المدينة فلم يزل بها إلى أن خرج إلى الشام مجاهدا فاستشهد في خلافة عمر. اهـ
“মূসা ইবনে উকবা রহ. যুহরি রহ. থেকে বর্ণনা করেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে পত্র পাঠালেন। তার কাছে যখন চিঠি পৌঁছল, তখন তিনি মৃত্যু শয্যায় শায়িত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি হাতে অবস্থায়ই তিনি মৃত্যু বরণ করেন। আবু জানদাল রাদিয়াল্লাহু আনহু সেখানেই তাকে দাফন করেন এবং তার কবরের কাছে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি বলেন, (এরপর) আবু জানদাল রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং তার সঙ্গীরা মদীনায় চলে আসেন। তখন থেকে তিনি সেখানেই ছিলেন। উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতকালে তিনি শামে জিহাদে যান এবং সেখানেই শাহাদাত বরণ করেন।”- ফাতহুল বারি ৫/৩৫১
এ হাদিস একাকী জিহাদ ও গুপ্ত হত্যার সুস্পষ্ট ও আমলী দলীল। আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহু কাফের লোকটিকে হত্যা করলেন। অপরটিকে ধাওয়া করে মদিনা পর্যন্ত নিয়ে এলেন। সমূদ্র উপকূলে গিয়ে যখন আশ্রয় নিলেন, আস্তে আস্তে একটা তায়েফা হয়ে গেল, মুশরিকদের বাণিজ্যিক কাফেলাগুলো টার্গেট করে আক্রমণ করলেন, হত্যা করলেন, লুণ্টন করলেন; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসবের কোনটির উপরই কোন আপত্তি করলেন না। বরং প্রচ্ছন্নভাবে উৎসাহ দিলেন। আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহুর হামলা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৌন সমর্থন ও উৎসাহ সুস্পষ্ট দলীল যে, ইমাম না থাকাবস্থায় একাকী বা ছোট্ট তায়েফা মিলে জিহাদ করতে এবং হরবি কাফেরদের গুপ্ত হত্যা করতে কোন সমস্যা নেই। চুক্তি নেই এমন যেকোন কাফেরকে বাগে পেয়ে হত্যা করা যাবে। এককভাবেও করা যাবে, তায়েফাগতভাবেও করা যাবে। প্রকাশ্যেও করা যাবে, গোপনেও করা যাবে। হত্যাও করা যাবে, লুণ্টনও করা যাবে। কোনটাতেই কোন সমস্যা নেই।
হাফেয ইবনে হাজার রহ. (৮৫২ হি.) বলেন,
وفي قصة أبي بصير من الفوائد جواز قتل المشرك المعتدي غيلة ولا يعد ما وقع من أبي بصير غدرا لأنه لم يكن في جملة من دخل في المعاقدة التي بين النبي صلى الله عليه و سلم وبين قريش لأنه إذ ذاك كان محبوسا بمكة لكنه لما خشي أن المشرك يعيده إلى المشركين درأ عن نفسه بقتله ودافع عن دينه بذلك ولم ينكر النبي قوله ذلك وفيه أن من فعل مثل فعل أبي بصير لم يكن عليه قود ولا دية. اهـ
“আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা প্রমাণ যে, সীমালঙ্গনকারী মুশরিককে গুপ্ত হত্যা করা যাবে এবং আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহু যা করেছেন, তা গাদ্দারি নয়। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও কুরাইশদের মাঝে সম্পাদিত চুক্তিতে তিনি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। কেননা, তিনি তখন মক্কায় বন্দী ছিলেন। তবে যখন তার আশঙ্কা হল যে, মুশরিকটি তাকে (মক্কার) মুশরিকদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, তখন তাকে হত্যা করে নিজের প্রতিরক্ষা করেছে। এর মাধ্যমে তিনি আপন দ্বীন রক্ষা করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এ কথায় কোন আপত্তি করেননি।
এ থেকে এও বুঝা গেল যে, যে ব্যক্তি আবু বাসীর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতো (হত্যা ও লুণ্টন) করবে, তার উপর কিসাস বা দিয়াত কোন কিছু বর্তাবে না।”- ফাতহুল বারি ৫/৩৫১
আমরাও একই কথা বলি: আমাদের মুসলিম ভাইদের যদি তাগুতি শাসন বিলুপ্ত করার সামর্থ্য নাও থাকে, তথাপি তারা যেখানেই পাবেন তাগুত, তাগুত বাহিনির সৈন্য ও কাফের-মুরতাদদের হত্যা করবেন। এতে তাদের উপর না কোন কিসাস বর্তাবে, আর না কোন দিয়াত। বরং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে পাবেন অশেষ প্রতিদান। আর নিহত হলে পাবেন শাহাদাতের মর্যাদা।
***
Comment