Announcement

Collapse
No announcement yet.

একাত্তরের ইতিহাসঃ অধ্যায়ঃ ১৮ - নির্বাচন থেকে যুদ্ধ এবং ভারতীয় অধিকৃতি।

Collapse
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • একাত্তরের ইতিহাসঃ অধ্যায়ঃ ১৮ - নির্বাচন থেকে যুদ্ধ এবং ভারতীয় অধিকৃতি।

    রায় ছিনতাই

    স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের মূল যুক্তিটি হলো,১৯৭০’য়ের নির্বাচনী বিজয়।কিন্তু কিসের উপর নেয়া হয়েছিল সে গণরায়? সেটি কি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে? আওয়ামী লীগের সে নির্বাচনী বিজয়টি পাকিস্তান ভাঙ্গা বা স্বাধীনতার নামে অর্জিত হয়নি।পাকিস্তান ভাঙ্গা ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা শেখ মুজিবের নিজের গোপন অভিপ্রায় হতে পারে,গুপ্ত দলীয় এজেন্ডাও হতে পারে,কিন্তু যে নির্বাচনী মেনিফেস্টো জনসম্মুখে প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ নির্বাচন লড়েছিল তার কোথাও স্বাধীন বাংলাদেশের কথা বলা হয়নি।পাকিস্তান ভাঙ্গার কথাও বলা হয়নি।ভোট নিয়েছিল ৬ দফার নামে।৬ দফা ও স্বাধীনতা কি এক বিষয়? পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগের নির্বাচনি মেনিফেস্টোর কোথাও পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির কোন প্রমাণ পায়নি,ফলে দলটিকে নির্বাচনে অংশ নিতে কোনরূপ বাধা দেয়নি। নির্বাচনের পর গণরায়কে শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পক্ষে দলিল রূপে ব্যবহার করবেন -সেটি নির্বাচন কালে কোথাও বলেননি।এরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষযে রায় দেয়ার অধিকার ছিল একমাত্র জনগণের।কিন্তু জনগণ সে অধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায়নি।জনগণের সে অধিকার নির্বাচনের নামে ছিনতাই হয়েছে।গণতন্ত্রের ইতিহাসে এটি এক বড় রকমের জালিয়াতি।





    সত্তরের নির্বাচনে জনগণ প্রার্থীদের ভোট দিয়েছিল পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য হতে, বাংলাদেশ সংসদের সদস্য হওয়ার জন্য নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্যও নয়। সে নির্বাচনটি ছিল পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সংকটের সমাধান কল্পে, আদৌ দেশ বিভক্তির জন্য নয়। নির্বাচনের পর পাকিস্তান ভাঙ্গা হবে -সমগ্র নির্বাচন কালে এমন কথা মুজিবের মুখ থেকে কোথাও প্রকাশ্যে শোনা যায়নি। কোন পত্রিকাতেও দেশ ভাঙ্গার বিষয়টি আসেনি। এর প্রমাণ, সে আমলের পত্রিকাগুলোর পুরনো কপি। যে লক্ষ্যে জনগণ থেকে ভোট নেয়া হলো শেখ মুজিব ও তার দল সে লক্ষ্যে কাজ না করে নির্বাচনী বিজয়কে ব্যবহার করেছেন নিজের এজেন্ডা পূরণে –যার সাথে জড়িত করেছেন আগ্রাসী ভারতকে। সে এজেন্ডা পূরণে প্রকাণ্ড যুদ্ধও ডেকে এনেছেন। ২৫ মার্চের রাতে সেনা বাহিনী নামার আগেই শেখ মুজিব ৭ই মার্চ যার কাছে যা আছে তা নিয়ে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ারও আহবান দিয়েছিলেন। “এবারের লড়াই স্বাধীনতার লড়াই” বলেছেন। অথচ সত্তরের নির্বাচন সে অধিকার মুজিবকে দেয়নি।বিষয়টি লন্ডনের টিকিট কিনে টোকিও’র পথে যাওয়ার মত।এটি ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে মুজিবের উপর অর্পিত আমানতের খেয়ানত। সততা থাকলে শেখ মুজিবের উচিত ছিল স্বাধীনতার ইস্যুতে রিফারেন্ডামের মাধ্যমে জনরায় জেনে নেয়া। কিন্তু মুজিব সে পথে যাননি। গণরায় ছিনতাইয়ের এ এক অভিনব ইতিহাস।

    সংসদ সদস্যদের সব ক্ষমতা থাকে না। তারা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সরকার গঠন করতে পারেন, দেশের শাসনতন্ত্র বা আইনে পরিবর্তন আনতে পারেন, বাজেট পাস এবং বিদেশ নীতি নিয়েও সিদ্ধান্তও নিতে পারেন। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল বা শক্তির সাথে সংসদে দর কষাকষিও করতে পারেন। কিন্তু তারা দেশকে খণ্ডিত করবেন বা দেশের স্বাধীনতা বিলুপ্ত করবেন -সে অধিকার কোন দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের থাকে না। এটি সরাসরি রেফারেন্ডামের বিষয়। অথচ আওয়ামী লীগ নির্বাচনী বিজয়কে স্বাধীনতার পক্ষে রায় বলে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষাণিটি ১৯৭১’য়ের ২৫ মার্চে দিয়ে চট্টগ্রামে প্রচারের জন্য পাঠিয়েছিলেন। অর্থাৎ আর্মির এ্যাকশনের আগেই? প্রশ্ন হলো, শেখ মুজিব ঘোষণাটি দিলেন কোন বিধি অনুযায়ী? এটি কি সংসদ সদস্যদের কার্যবিধির মধ্যে পড়ে? নির্বাচনে জনগণ প্রার্থীদের সংসদের সদস্য নির্বাচন করে, স্বাধীনতার ঘোষক নয়। এরূপ ঘোষণাকে বৈধতা দিলে বাংলাদেশের যে কোন প্রান্ত থেকে যে কেউ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে তাকেই বা অবৈধ বলা যাবে কি করে?

    প্রতারণা নিজ অঙ্গীকারের সাথে

    শেখ মুজিব ও তার দল ১৯৭০-এর নির্বাচনে অংশ নেয়ার পূর্বে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার দেয়া ৫ দফা লিগ্যাল ফ্রেমওংয়ার্ক অর্ডারে বিনা প্রতিবাদে স্বাক্ষর করেন।শর্তগুলো ছিল নিম্নরূপঃ ১).পাকিস্তানকে অবশ্যই ইসলামী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।২).অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পর দেশের জন্য গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে।৩).আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সংহতির বিষয়কে অবশ্যই শাসনতন্ত্রে গুরুত্ব দিতে হবে।৪).দেশের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে অবশ্যই দূর করতে হবে।৫).কেন্দ্র ও প্রদেশগুলির মধ্যে ক্ষমতা অবশ্যই এমনভাবে বণ্টন করতে হবে যাতে প্রদেশগুলি সর্বাধিক পরিমাণ স্বায়ত্তশাসন পায়।কেন্দ্রকে আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষাসহ ফেডারেল দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট ক্ষমতা থাকতে হবে।

    উপরুক্ত ৫ দফা লিগ্যাল ফ্রেমওংয়ার্ক অর্ডার ছিল একটি অঙ্গীকারনামা।এটি ছিল পাকিস্তানের আগামী শাসনতন্ত্রের জন্য ন্যূনতম ফর্মুলা –যা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারি দলগুলি মেনে নিয়ে নির্বাচনে নামে।১৯৭০ সালের নির্বাচনের মূল লক্ষ্যটি ছিল লিগ্যাল ফ্রেমওংয়ার্ক অর্ডারের শর্তগুলি পূরণ করা।নির্বাচনের পূর্বে পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক নেতাদের ন্যায় শেখ মুজিবও শর্তগুলো স্বেচ্ছায় মেনে নিয়ে দস্তখত করেছিলেন।কেউ তাকে এটি মেনে নিতে জবরদস্তি করেছে -সে প্রমাণ নাই।লেগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডারের কোন একটি বিষয়ে শেখ মুজিবের সামান্যতম আপত্তি ছিল -সেটিও কোনদিন প্রকাশ করেননি।এ অঙ্গীকার নামা’র কোথাও উল্লেখ নাই যে নির্বাচনে বিজয়ী হলে মুজিবকে স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণার অধিকার দেয়া হবে।এ কথাও বলা হয়নি,নির্বাচিত সদস্যদের অধিকার থাকবে পাকিস্তানের ভৌগলিক মানচিত্রে পরিবর্তন আনা।বরং বলা হয়েছিল,নির্বাচিত সদস্যগণ আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সংহতিরক্ষায় অধিক দায়বদ্ধ হবেন।পাকিস্তানকে ইসলামী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত করবেন –সে অঙ্গীকারও তাদেরকে করতে হয়েছিল। ইসলামী আদর্শ বিষয়ক এ ধারাটি নিয়ে আওয়ামী লীগের সে সময় আপত্তি ছিল -শেখ মুজিব সে কথাটি কখনোই জনসম্মুখে বলেননি।ধর্মশূণ্য ও ইসলামে অঙ্গীকারশূণ্যদের ন্যায় ইসলামী মৌল বিশ্বাস বা আদর্শের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ালে মুজিব কি কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট পেতেন? মুজিব ও অনুসারিগণ যে সেসব নীতিমালা মেনে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন –সেটি কোন গোপন বিষয় নয়।ফলে প্রশ্ন উঠে,তা হলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটি কোথায়? মুজিব নিজেকে মুসলিম রূপে দাবী করতেন।মুসলিম কি কখনো তার নিজকৃত অঙ্গীকার বা ওয়াদা ভঙ্গ করে? তাতে কি ঈমান থাকে?



    কোন একটি অঙ্গীকার নামায় স্বাক্ষর করার পর সেটি মেনে চলার দায়বদ্ধতা বিশাল।সাক্ষরিত প্রতিটি অঙ্গীকারনামাই একটি দলিল।যে কোন সভ্য দেশেই অঙ্গীকারভঙ্গটি দণ্ডনীয় ফৌজদারি অপরাধ।যে কোন দায়িত্বশীল নেতার অঙ্গীরেরই মূল্য থাকা উচিত।নইলে বহুশ্রম,বহুমেধা ও বহুসময় ব্যয়ে অর্জিত চুক্তি বা সমঝোতার মূল্য কী? ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব তো নিজ অঙ্গীকারগুলোর উপর সর্বাবস্থায় অটল থাকাতে।নইলে ব্যক্তি তো ব্যক্তিত্বহীন হয়। কথা হলো,নিজ নিজ অঙ্গীকারের সাথে নিজেরা ওয়াদাভঙ্গ করলে মানুষ একে অপরকে বিশ্বাস করবে কীরূপে? তাতে সমাজ এবং রাষ্ট্রই বা পরিচালিত হবে কীরূপে? সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানই বা হবে কীরূপে? রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের কাছে ওয়াদাভঙ্গ করা বা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়া মামূলী ব্যাপার,বহু ধুর্ত নেতার কাছে সেটি রাজনীতির মোক্ষম হাতিয়ারও।কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এটি মানব চরিত্রের গুরুতর ব্যাধি।এ ব্যাধির কারণে বিলুপ্ত হয় ব্যক্তির ঈমান,নীতিবোধ ও মূল্যবোধ।মহান নবীজী (সাঃ)র কাছে ওয়াদাভঙ্গ গণ্য হয়েছে মুনাফেকির আলামত রূপে -যা কুফরির চেয়েও নিকৃষ্ট।কাফেরগণ অন্তত তাদের প্রকৃত পরিচয়কে গোপন করেনা,তারা যা সেটিই সবার সামনে প্রকাশ করে।মুজিবের ব্যর্থতাটি এক্ষেত্রে বিশাল,তিনি তার স্বাক্ষরিত অঙ্গীকারের উপর অটল থাকতে পারেননি।নির্বাচনের পর লিগ্যাল ফ্রেমওংয়ার্ক অর্ডারকে তিনি হয়তো পুনরায় পড়ে দেখার প্রয়োজনও বোধ করেননি।নির্বাচনী বিজয়ের পর পরই সেটিকে তিনি আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছিলেন।অথচ সে অঙ্গীকারনামাটি ছিল দেশের রাজনীতিতে নির্বাচন পরবর্তী সর্বদলীয় রোডম্যাপ।শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়ার কথা সে রোডম্যাপ অনুযায়ী।অথচ সে রোডম্যাপকে শেখ মুজিব গুরুত্বহীন ও অপ্রাসঙ্গিক করে ফেললেন।তার কাছে তখন গুরুত্ব পায় স্রেফ পাকিস্তান ভাঙ্গা।এবং সেটি বুঝা যায় ইয়াহিয়া খানের সাথে তার বৈঠকে। প্রশ্ন হলো,এটি কি রাজনৈতিক সততা? ভাবটা এমন,কোন অঙ্গীকারনামায় তিনি কোন কালেই স্বাক্ষর করেননি।তার দাবি,নির্বাচনে তিনিই বিজয়ী হয়েছেন,অতএব তিনি যা বলেন একমাত্র সেটিই সাড়ে সাত কোটি মানুষের কথা।সেটি ছাড়া অন্যসব কিছুই গুরুত্বহীন।এমন কি যেসব ওয়াদা করে তিনি নির্বাচন জিতেছিলেন সেগুলিও। এমনকি গুরুত্বহীন গণ্য করেন নির্বাচনপূর্ব তার নিজের স্বাক্ষরিত অঙ্গীকারগুলিও।পাকিস্তানের ভবিষ্যৎকে এভাবে নিজ এজেন্ডার কাছে জিম্মি করে ফেলেন।কিন্তু প্রশ্ন হলো,সত্তরের নির্বাচন তো পাকিস্তান ভাঙ্গা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রশ্নে হয়নি,অতএব মুজিবের কথা ও জনগণের কথা এক হয় কি করে?



    প্রশ্ন হলো,কোন দলিল বা অঙ্গিকানামাকে অস্বীকার বা অমান্য করলে সে দলিল অনুযায়ী অর্জিত বিষয়ের উপর কি সংশ্লিষ্ট পক্ষের কোন বৈধ অধিকার থাকে? বৈধতার ভিত্তি তো নির্বাচনপূর্ব অঙ্গীকারনামা।লিগ্যাল ফ্রেমওংয়ার্ক অর্ডার ছিল তেমনি একটি স্বাক্ষরিত দলিল।ফলে যে দলিলের উপর ভিত্তি করে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয়,সেটি অমান্য করলে কি সংসদের সদস্যপদ থাকে? তাছাড়া অঙ্গীকার পালনে একজন মুসলিমের দায়বদ্ধতাটি তো বিশাল।তার ঈমানদারীর মূল পরিচয়টি তো অঙ্গীকার পালনে।স্বেচ্ছায় এবং স্বহস্তে মুজিব যে অঙ্গীকার নামায় স্বাক্ষর করেন সে অনুযায়ী তিনি দায়বদ্ধ ছিলেন পাকিস্তানের সংবিধান তৈরীতে। পাকিস্তানের বৃহৎ দলের নেতা রূপে তার দায়ভারটি ছিল সর্বাধিক। আর সংবিধান তো কোন একটি দলের ও একটি প্রদেশের সংসদ সদস্যদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়।সে জন্য প্রয়োজন ছিল দেশের অন্য ৪টি প্রদেশের সদস্যদের সাথে আলোচনায় বসা।কিন্তু আওয়ামী লীগ সে পথে যায়নি।তাদের সাথে আলোচনায় মুজিবের অনাগ্রহ ও অনগ্রসরতার কারণেই তো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাধ্য হন জাতীয় পরিষদের বৈঠক মুলতবি করতে। অথচ সে মুলতবিকে বাহানা করে আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগ দেশের পরিস্থিতিকে চরম অরাজকতার দিয়ে নিয়ে যায় এবং অবশেষে যুদ্ধ শুরু করে।



    প্রশ্ন হলো,কোথা থেকে শেখ মুজিব পেলেন পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের অধিকার? জনগণ কখন দিল তাকে সে অধিকার? দিলে তার প্রমাণ ক্ই? সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়া এবং স্বাধীনতার ঘোষক হওয়া কি এক কথা? এটি কি তার সিদ্ধান্ত ছিল যে,নির্বাচনে একবার বিজয়ী হলে তিনি লিগ্যাল ফ্রেমওংয়ার্ক অর্ডারের দিকে আর ফিরে তাকাবেন না? এবং সে লিগ্যাল ফ্রেমওংয়ার্ক অর্ডারেকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিবেন? সেটি তো বিশাল জালিয়াতি।স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় এরূপ জালিয়াতির প্রয়োজন ছিল কি? এটি কি স্বচ্ছ ও ট্রান্সপ্যারেন্ট পদ্ধতিতে স্বাধীনতা অর্জনের পথ? ভারতের ন্যায় একটি আগ্রাসী দেশকে যুদ্ধে টেনে এনে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কেন ভারতের দান রূপে কংলকিত করা হলো? অনেকের পক্ষ থেকে বলা হয়,২৫শে মার্চ পাকিস্তান আর্মির হাতে ঢাকায় গণহত্যা পাকিস্তান ভাঙ্গাকে অনিবার্য করেছে।কথা হলো,২৫ শে মার্চ রাতে যত জন মারা যায়,মুজিব আমলে রক্ষি বাহিনীর হাতে তার চেয়ে বেশী মারা যায় উত্তরবঙ্গে।অনেক প্রাণহানী হয়েছিল আত্রাইয়ে।রক্ষিবাহিনীর হাতে শত শত বামপন্থী মারা গেছে পাবনায়।সে কারণে উত্তরবঙ্গের এমপিগণ কি তবে স্বাধীনতা ঘোষণা করবে?

    রক্তপাতের পথে

    আওয়ামী লীগ জেনে বুঝে রক্তপাতের পথটি বেছে নেয়। বিনা রক্তপাতে দেশ স্বাধীন করার পথটি ছিল রেফারেন্ডামের পথ। কিন্তু আওয়ামী লীগ জেনে বুঝেই সে পথে যায়নি। যখনই কোন মুসলিম রাষ্ট্রকে ক্ষুদ্রতর করার চেষ্টা হয় তখনই জনগণের মাঝে পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্তি আসে, যুদ্ধ শুরু হয় এবং প্রচুর রক্তপাতও ঘটে। যে কোন দেশে সেটি অনিবার্য। বিষয়টি এমন ছিল না যে, শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেই পাকিস্তান সরকার সে স্বাধীনতা মেনে নিবে। দেশটির সংহতির রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীই একমাত্র শক্তি ছিল না, লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষও পাকিস্তানের অখণ্ডতার জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিল। সেটি যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে, তেমনি পূর্ব পাকিস্তানেও। মাত্র ২৩ বছর আগে যে বাংলার ৯৮% ভাগ ভোটার স্বেচ্ছায় পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানভূক্ত করার জন্য ভোট দিল সে দেশটির সংহতি সংকট পড়লে সেটি রুখতে সপক্ষে যোদ্ধা পাবে না -সেটি কি ভাবা যায়? ভারত লক্ষ লক্ষ সৈন্য নিয়ে হামলা না করলে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা কি দেশটিকে ভাঙ্গতে পারতো? ৯ মাসের যুদ্ধে একটি জেলা দূরে থাক, একটি থানাকেও কি স্বাধীন করতে পেরেছিল? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে ভারতীয় সেনা বাহিনীর পক্ষ থেকে যুদ্ধজয়ের ফল -তা কি অস্বীকারের উপায় আছে? ভারতের কাছে তাই স্বাধীন বাংলাদেশের দায়বদ্ধতাটি তাই বিশাল। সে জন্যই বাংলাদেশ থেকে ভারত ইচ্ছামত ফায়দা নিচ্ছে এবং মুজিব আমলে দেশকে ২৫ সালা দাসচুক্তিতে আবদ্ধ করেছিল -সেটি তো তারই ফল।

    তাছাড়া একটি মুসলিম দেশকে খণ্ডিত করা সেক্যুলারিস্ট, সোসালিস্ট, জাতীয়তাবাদী, নাস্তিক এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টানদের কাছে যত প্রিয়ই হোক, ধর্মপ্রাণ মুসলিমের কাছে সেটি হারাম। আলেমদের মাঝে এ বিষয়ে সামান্যতম দ্বি-মত নেই। হারাম হওয়ার স্পষ্ট দলিল রয়েছে পবিত্র কোরআনে। এজন্য কোন আলেম বা কোন ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের কোন একজন নেতা বা কর্মী ভারতে যায়নি। তারা মুক্তি বাহিনী বা মুজিব বাহিনীর সদস্যও হয়নি। আলেম, ইসলামী চিন্তাবিদ বা ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগ ও তার সেক্যুলারিস্ট জাতীয়তাবাদী সঙ্গিগণ যেরূপ ঢালাও ভাবে রাজাকার বলে তার মূলে তো একাত্তরের সে বাস্তবতা। একাত্তরের ইতিহাসে এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ইসলামপন্থীগণ পরাজিত হলেও বিলুপ্ত হয়নি। অতএব পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধ হলে সেটি যে রক্তাত্ব হবে সেটি আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও বুঝতেন। ষাটের দশকে শেখ মুজিব কারাবন্দী থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের হাল ধরে ছিলেন মিসেস আমেনা বেগম। তখন তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদীকা। শেখ মুজিবের যে পথে এগুচ্ছেন তাতে যে গভীর রক্তপাত হবে -সে বিষয়ে তিনি মুজিবকে হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন। কিন্ত মুজিবের সে রক্তপাত নিয়ে পরওয়া ছিলনা। জেনে বুঝেই তিনি সে পথটি বেছে নেন। এবং সেটি ভারতের সাহায্যে যুদ্ধের পথ।

    পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে জনগণের সমর্থণ পাবেন –তা নিয়ে শেখ মুজিব কোন কালেই আশাবাদী ছিলেন না। তাই জনগণকে বোকা বানাতে তাকে প্রতি মিটিংয়ে জোর গলায় পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিতে হয়েছে। ১৯৭০’য়ের প্রথম নির্বাচনী জনসভাটি হয়েছিল ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্দানে জানুয়ারি মাসে। সে জনসভায় তিনি বলেছিলেন,“আমাকে বলা হয় আমি নাকি পাকিস্তান ভাঙতে চাই। আপনারা এমন জোরকন্ঠে পাকিস্তান জিন্দাবাদ আওয়াজ তুলুন যাতে পিণ্ডির শাসকদের কানে পৌঁছে যায়।” সে মিটিংয়ে লেখক নিজে উপস্থিত ছিলেন। এমনকি সেটি ১৯৭১’য়ের ৭ই মার্চের রেস কোর্সের বক্তৃতাতেও পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেছেন। এ মিটিংয়েও লেখক উপস্থিত ছিলেন। জনগণকে এবং সে সাথে সরকারকে ধোকা দিতেই শেখ মুজিব লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্কেও স্বাক্ষর করেছেন। তবে মুজিবের রাজনীতিতে অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার রাজনীতি ছিল না। সেটি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৩ মার্চে শেখ মুজিবের সাথে তার শেষ বৈঠকে বুঝতে পারেন। এরপর বৈঠকে তিনি ইতি টানেন। মুজিবের রাজনীতি চলতে থাকে ভারতের দেয়া রোডম্যাপটি অনুসরণ করে। সে রোড ম্যাপে যেমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল, তেমনি পাকিস্তান ভাঙ্গাও ছিল। সে সাথে ব্যাপক ও বীভৎস ভাবে বিহারী হত্যাও ছিল। ভারত মুজিবের হাতে সে রোড ম্যাপটি তুলে দেয় নির্বাচনি বিজয়ের বহু পূর্বেই। মুজিব আগরতলা মামলায় ধরা পড়লেও সে রোডম্যাপটি কখনোই বর্জন করেননি। ভারত একাত্তরে বিশাল বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে নামে এবং পূর্ব পাকিস্তানকে অধিকৃত করে -সে ভারতীয় রোড ম্যাপের অংশ রূপেই।

    বাস্তবতা হলো, ভারতের সামনে রক্তাত্ব পথ ছাড়া পাকিস্তান ভাঙ্গার ভিন্ন কোন রাস্তাও ছিল না। সেটি ভারত যেমন বুঝতো, তেমনি মুজিবও বুঝতো। ভারতের লক্ষ্য ছিল, যেভাবেই হোক পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে রক্তপাতের পথে টেনে আনা এবং রক্তপাতকে আরো গভীরতর করা। লক্ষ্য ছিল, ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনীকে অবাঙালীদের বিরুদ্ধে আরো হিংস্র ও হত্যাপাগল করা। কারণ, ভারতের লক্ষ্য শুধু পাকিস্তানকে খণ্ডিত করা নয়, বরং উপমহাদেশের মুসলিমদের মাঝে গভীর ঘৃণা ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি। এরূপ লক্ষ্য অর্জনে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকগণ তাদের ১৯০ বছেরর শাসনে ব্যর্থ হলেও ভারত সফল হয়েছে। কারন ভারত পেয়েছিল হাজার হাজার বাঙালী ট্র্র্র্রোজান হর্স -যারা ছিল ভারতের আজ্ঞাবহ। ভারত জানতো, রক্তপাত যত গভীরতর হবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে তিক্ততা ততই তীব্রতর হবে। এবং তাতে রুদ্ধ হবে পাকিস্তানের দুই অংশের মাঝে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান। তখন অসম্ভব হবে দুই প্রদেশের মাঝে সংহতি। এর ফলে ভারতের প্রতি বাড়বে বাঙালী মুসলিমের আনুগত্য ও নির্ভরশীলতা। ভারত সে পরিকল্পনা নিয়েই এগুয়।

    প্রস্তুতি বহু পূর্ব থেকেই

    স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টিকে যারা পাকিস্তান আর্মির ২৫শে মার্চে অপারেশনের ফলশ্রুতি বলেন তারা সঠিক বলেন না। অনেকে বলেন, মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করাটাই সব সমস্যার মূল। তারাও সঠিক বলেন না। তারা সেটি বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে মার্চের বৈঠকে মুজিব কি চেয়েছিলেন সেটি না জেনেই। যারা মনে করেন ৬ দফা না মানাতেই সমস্যা দেখা দিয়েছিল –তারাও ঠিক বলেন না। মার্চে ইয়াহিয়া ও মুজিবের মাঝে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। ইয়াহিয়া এবং ভূট্টো উভয়ই ৬ দফা মেনে নিয়েছিলেন। -(Sisson and Rose 1990)। মুজিব চেয়েছিলেন শুধু পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা, সমগ্র পাকিস্তানের নয়। আরো চেয়েছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের উপর থেকে সামরিক আইন তুলে নেয়া হোক। তখন সুস্পষ্ট বোঝা যায়, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা নেয়া এবং অখণ্ড পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখা মুজিবের রোড ম্যাপের অংশ ছিল না। সেটি যেমন আওয়ামী বাকশালীদের অভিমত, তেমন মার্কিন গবেষক রিচার্ড সিসন এবং লিও রোজেরও অভিমত।-(Sisson and Rose 1990)। ভারতও সেটি চাইতো না। মার্চের বৈঠকের অনেক আগেই ৬ দফা এক দফাতে পরিণত হয়েছিল।

    ইয়াহিয়া খান বহু ভূল করেছেন। পাকিস্তান আর্মি বহু নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে এবং বহু মানুষের ঘর-বাড়ী এবং দোকানে আগুণ দিয়েছে। শেখ মুজিবকেও তিনি বহু নাজায়েজ ফায়দা দিয়েছেন। কিন্তু সেসব ভূলের কারণে ভারত একাত্তরে যুদ্ধ করেনি এবং ভারতীয় সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আসেনি। পুর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত নিয়ে ভারতের আদৌ মাথাব্যাথা ছিল না;বেশী রক্তপাত হচ্ছে তো কাশ্মীরে। ভারত যুদ্ধ শুরু করেছে তার নিজস্ব এজেন্ডা পূরণে;এবং সেটি নিজস্ব পরিকল্পনা মাফিক। এরূপ আগ্রাসী যুদ্ধের পরিকল্পনা ১৯৭১’য়ে হয়নি; ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল বহু পূর্ব থেকেই। সে প্রমাণ এসেছে এমনকি আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্য থেকেও। আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আব্দুর রাজ্জাক ১৯৮৭ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক মেঘনা পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আগেই বলেছি আমরা বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট করেছিলাম। (নেতৃত্বে সিরাজুল আলম খান ও কাজী আরেফ আহমেদও ছিল) ...বঙ্গবন্ধুকে বলি ..আমাদের প্রস্তুতির জন্য ভারতের সাথে যোগাযোগ থাকা চাই। ...আমাকে তিনি একটা ঠিকানা দিলেন। বললেন,“এই ঠিকানায় তুই যোগাযোগ করবি।” তিনি তখনই আমাদের বললেন ভারতের সাথে তার একটা লিংক আগে থেকেই ছিল- ১৯৬৬ সাল থেকে। “তারা তোদের সব রকম সাহায্য করবে। তুই এই ঠিকানায় গিয়ে দেখা করবি।” তখন তিনি চিত্ত রঞ্জণ সুতারের সঙ্গে দেখা করতে বললেন। (এই সেই চিত্তরঞ্জন সুতোর যে বাংলাদেশ ভেঙ্গে স্বাধীন বঙ্গভূমি বানানোর আন্দোলনের নেতা)। বললেন,“তোরা শিগগিরই একটি ট্রান্সমিশন বেতার কেন্দ্র পাবি। সেটা কোথা থেকে কার মাধ্যমে পাওয়া যাবে তাও বলে দিলেন।”-(সাপ্তাহিক মেঘনা,৪/০২/৮৭,পৃষ্ঠা ১৮)। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টি তাই হঠাৎ করে ২৫শে মার্চ সামনে আসেনি। শেখ মুজিব ভারতীয় সাহায্য ও সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি পাকাপোক্ত করেছিলেন অনেক আগেই। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তো সে অভিযোগই আনা হয়েছিল। অথচ সে অভিযোগকে তিনি মিথ্যা বলেছিলেন। তিনি আগরতলা মামলাকে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মামলা বলে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। আব্দুর রাজ্জাকের উপরুক্ত সাক্ষাৎকারের পরও কি বুঝতে বাকি থাকে কে ছিলেন মিথ্যাবাদী ও ষড়যন্ত্রকারী?

    দেশের স্বার্থ বনাম দলীয় স্বার্থ

    যে কোন সভ্য ও সুস্থ ধ্যান-ধারণায় ব্যক্তি বা দলের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থ বড়। তাই যে কোন সভ্য দেশে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে দেশের স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। নইলে দেশ বিপদে পড়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিবের কাছে দলীয় স্বার্থ এবং দলীয় নেতাই বড়। তারা দেশের স্বার্থ নিয়ে ভাবেননি। সেটি যেমন পাকিস্তানের বেলায় তেমনি বাংলাদেশের বেলায়। সেটি বার বার দেখা যায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। ফলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয়ে দেশ ও গণতন্ত্র বিপদে পড়ে। দলের স্বার্থকে তারা দেশের স্বার্থের চেয়ে ছোট করে দেখতে রাজী ছিল না। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ব্যক্তি ও দলের স্বার্থ বাঁচাতে দেশ এ দেশবাসীকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে তখন একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলেও দেশের স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থ বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। প্রাধান্য পেয়েছে ভারতের স্বার্থও। সেটি স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ পায় ১৯৭০’য়ের নির্বাচনের পর।

    মার্চের শুরুতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ইয়াহিয়া খান কর্তৃক মুলতবি করাতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডারগণ ঢাকা শহরে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে। শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন। শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাস ছাত্রদের সামরিক ট্রেনিং। অথচ অধিবেশন মুলতবির এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল যা প্রেসিডেন্ট হিসাবে ইয়াহিয়া খানের পক্ষে অগ্রাহ্য করা সম্ভব ছিল না। অধিবেশন মুলতবি হয়েছিল কিছু জটিল বিষয়ে আলোচনার আরো সুযোগ দেয়ার জন্য। অপর দিকে দেশে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির জন্য আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের জঙ্গিবাহিনীর জন্য বাহানা দরকার ছিল। তারা এ মুলতবিকেই বাহানা রূপে ব্যবহার করে। পরবর্তীতে সে আওয়ামী জঙ্গিবাহিনী দেশে একটি যুদ্ধ ডেকে আনতে সমর্থ হয়। অথচ দেশের স্বার্থকে বড় ভেবেছিলেন প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের নেত্রী অঙ সাঙ সুচি। নব্বইয়ের দশকে নির্বাচনে তার দল বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়। কিন্তু তিনি ক্ষমতায় যেতে পারেননি। অঙ সাঙ সুচির হাতে ক্ষমতা না দিয়ে সেনা বাহিনী তাকে জেলে পাঠায়। কিন্তু সে জন্য কি তিনি এবং তার দল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে? সামরিক বাহিনীর সে হঠকারিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হলে মিয়ানমারের অবস্থা কীরূপ হত?

    কোন মুসলিম দেশ ভাঙ্গা ইসলামে হারাম। সেটি নিষিদ্ধ জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ীও। এজন্যই ভারতের হামলার পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যে অধিবেশন হয় সে অধিবেশনে ১০৪টি রাষ্ট্র পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতির পক্ষ্যে ভোট দেয়। মাত্র ১০টি রাষ্ট্র বিরোধীতা করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পর মাত্র ৩টি রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং সে রাষ্ট্রগুলো হলো ভারত, ভূটান, সোভিয়েত রাশিয়া। কোন মুসলিম রাষ্ট্রই পাকিস্তানের বিভক্তির পক্ষে ভোট দেয়নি। শেখ মুজিব দেশভাঙ্গার রাজনীতিতে পা বাড়িয়েছেন বহু পূর্ব থেকেই। কিন্তু সেটি প্রকাশ্যে বলার সাহস তার ছিল না। দেশের সাধারণ মানুষের ইসলামী চেতনাকে তিনি ভয় করতেন। সে চেতনার প্রবল রূপটি তিনি স্বচোখে দেখেছিলেন চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলন চলা কালে। ফলে পাকিস্তান ভাঙ্গার গোপন অভিলাষটি ভারতীয় কর্তাদের বললেও সেটিকে নির্বাচনী ইস্যুতে পরিণত করার সাহস পাননি। প্রথম বার প্রকাশ্যে যখন বলেন তখন বাংলাদেশ লক্ষাধিক ভারতীয় সৈন্য দ্বারা অধিকৃত। সেটি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারিতে পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্দানের জনসভায়। সেদিনই তিনি প্রথম বারের মত মনের গোপন কথাটি প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, “স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের শুরু একাত্তর থেকে নয়, ১৯৪৭ সাল থেকে।” (লেখক নিজে শুনেছেন সে কথা)।



    সুযোগটি আসে একাত্তরে

    বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র হওয়ার কারণে পাকিস্তান জন্ম থেকেই শত্রুর টার্গেটে পরিণত হয়। শুধু ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার নয়, ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও। শত্রুরা শুরুতেই চেয়েছিল পাকিস্তানে ভূগোল ছোট করতে। কাশ্মীরকে এজন্যই পাকিস্তানকে দেয়া হয়নি। বৃহৎ ভূগোল হলো রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নবীজী (সাঃ) তাই সাহাবাদের ভূগোল বৃদ্ধির নসিহত দিয়ে যান। নসিহত করে যান রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানি কনসটান্টিনোপল দখলের। মুসলিমগণ তাই এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের দিকে জিহাদে বের হন;এবং অতি দ্রুত বিশ্বশক্তিতে পরিণত হন। হাতির শক্তির উৎস বিপুল দেহ; ধারালো দাঁত বা লম্বা নখড় না থাকাতেও তার চলে। দেহের ভারেই বহু বাঘ-ভালুককে সে পদপিষ্ট করে। উসমানিয়া খেলাফতের হাতে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ছিল না। কিন্তু ছিল বিশাল সাম্রাজ্য। ফলে ব্রিটিশ, ফরাশী বা স্পেনীশদের ন্যায় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদীদের উপনিবেশ খুঁজতে উসমানিয়া খেলাফতের অতি কাছের ভূমি ছেড়ে বহু হাজার মাইল দূরে বাংলার মত দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন দেশ খুঁজতে হয়েছে। শত্রুদেশগুলি এজন্যই মুসলিম দেশের ভূগোল ভাঙ্গতে চায়। শত্রুগণ অখণ্ড আরব ভূখণ্ডকে তাই ২২ টুকরোয় বিভক্ত করেছে। প্রায় তিরিশ টুকরোয় বিভক্ত করেছে উসমানিয়া খেফাফতকে। ইসলামের শত্রুগণ চায়,মুসলিম বিশ্বের বিভক্ত মানচিত্রকে স্থায়ী করতে; এবং রুখতে চায় ঐক্যের যে কোন উদ্যোগকে। অপর দিকে মহান আল্লাহতায়ালার কড়া নির্দেশ,বিভক্তি থেকে বাঁচায়।তিনি এ হুশিয়ারিও শুনিয়েছেন, বিভক্তের পথে পা বাড়ালে সেটি হবে কঠিন আযাবের পথ। -(সুরা আল ইমরান,আয়াত ১০৫)।অতএব মুসলিম দেশ ভাঙ্গার পথটি আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার পথ নয়। বিভক্তির সে পথ খুশি করে ইসলামের শত্রুদের। মুজিব একাত্তরে শত্রুর খুশি করার সে পথটিই বেছে নেন। আর মুজিবের সে নাশকতায় এগিয়ো আসে ভারতও সোভিয়েত রাশিয়ার ন্যায় ইসলামের চিহ্নিত শত্রুপক্ষ ।

    মুসলিম উম্মাহ আজ যে কারণে শক্তিহীন তা সম্পদের কমতিতে নয়;বরং খণ্ডিত ভূগোল। রাশিয়া ও ভারতের শক্তির মূলে হলো দেশ দুটির বিশাল ভূগোল। শক্তি বাড়াতেই ভারত কাশ্মীর এবং মুসলিম শাসিত গোয়া, মানভাদর ও হায়দারাবাদ দখলে নেয়। দখলে নিয়েছে সিকিম। এবং চেষ্টা চালিয়ে আসছে পূর্ব পাকিস্তান দখলেরও। নিজ দেশে সৈন্য পালনের চেয়ে প্রতিবেশী দেশে দালাল তথা ট্রোজান হর্স প্রতিপালনে খরচ কম;এবং তাতে লাভও অধীক। একাজে প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরে ভারতের বিনিয়োগটি তাই বিশাল। সে বিনিয়োগের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে একাত্তরে হাজার হাজার ট্রোজান হর্সে পরিণত হয়। পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধে এরাই ভারতের পক্ষ নেয়।

    তবে সামরিক অধিকৃতির পাশা পাশি অতি গুরত্বপূর্ণ হলো সাংস্কৃতিক অধিকৃতি। সে জন্যই সামরিক পরিকল্পনার পাশাপাশি ভারত শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দুর্বল ও নতজানু বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য নিজ অর্থ, নিজ অস্ত্র ও নিজ সেনাবাহিনী দিয়ে যুদ্ধ লড়তে ভারত ১৯৪৭ সাল থেকেই প্রস্তুত ছিল।একাত্তরের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী বা মুজিব বাহিনীর ন্যায় কিছু বাহিনীর প্রয়োজন ছিল স্রেফ সাইড শো রূপে। সেটি আন্তর্জাতিক মহলে যুদ্ধকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য। প্রয়োজন ছিল বাংলা মাটিতে হাজার হাজার মুজিব-তাজউদ্দীনের। ভারতের পরিচালিত যুদ্ধকে স্বাধীনতার যুদ্ধ বলবে এবং ভারতীয় অধিকৃতিকে স্বাধীনতা বলবে -এমন ভারতসেবী নেতৃত্ব পঞ্চাশের বা ষাটের দশকে বঙ্গীয় ভূমিতে ছিল না। দিল্লির শাসকচক্র সে সময় মুজিব-তাজউদ্দীনের ন্যায় রাজনীতিবিদ পায়নি। ভারতকে তাই নিজস্ব রোড ম্যাপ নিয়ে ২৩ বছর অপেক্ষ করতে হয়েছে। অবশেষে ১৯৭০’য়ে মুজিবের নির্বাচনী বিজয় সেটি সহজ করে দেয়। সহজ করে দেয় একাত্তরের যুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী অধিকৃতি। আগ্রাসী ভারতকে বাদ দিয়ে তাই মুজিবের রাজনীতি নিয়ে ভাবা যায় না, তেমনি ভাবা যায় না একাত্তরের যুদ্ধ এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির বিষয়টিও।

    গ্রন্থপঞ্জি

    Sisson, Richard and Leo Rose (1990): War and Secession: Pakistan, India and the Creation of Bangladesh, University of California; Berkeley.

  • #2
    প্রিয় মুজাহিদ ভাই। আপনি অনেক কষ্ট করে লেখাটা লেখেছেন। আল্লাহ আপনাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। প্রিয় ভাই আদেশ নয় অনুরোধ করছি, এতবড় লেখা একসাথে না দিয়ে পর্ব করে দিলে আমাদের জন্য পড়তে সুবিধা হতো। ভাই কিছু মনে করবেন না। ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অাল্লাহ আপনার ইলম ও আমলের মধ্যে বরকত দান করেন। আমিন।
    ফিরে এসো দ্বীনের পথে।

    Comment


    • #3
      একাত্তরের ইতিহাস নতুন করে শিখতেছি।
      হতভাগা জাতির হতভাগা এক সদস্য। তাই তো ইতিহসে অজ্ঞ।

      Comment


      • #4
        জাযাকাল্লাহ।

        Comment


        • #5
          Originally posted by Diner pothe View Post
          প্রিয় মুজাহিদ ভাই। আপনি অনেক কষ্ট করে লেখাটা লেখেছেন। আল্লাহ আপনাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। প্রিয় ভাই আদেশ নয় অনুরোধ করছি, এতবড় লেখা একসাথে না দিয়ে পর্ব করে দিলে আমাদের জন্য পড়তে সুবিধা হতো। ভাই কিছু মনে করবেন না। ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অাল্লাহ আপনার ইলম ও আমলের মধ্যে বরকত দান করেন। আমিন।
          ঠিক...

          আল্লাহ পোষ্টদাতা ভাইকে উত্তম প্রতিদান দান করুন! বইটি হার্ডকপি আকারে বাজারে বের হলে অনেক উপকারী হবে ইংশাআল্লাহ। পুরো দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে যাবে। হয়ত অল্প কয়েকদিনেই ব্যান্ড হয়ে যাবে। তবুও যা প্রচার হবে, তাতেই বহুত কিছু। আর নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি মানুষের আসক্তি আরো বাড়বে বৈ কি?

          Comment

          Working...
          X