আন নাসর মিডিয়া পরিবেশিত
“কুদসের মুক্তির পথ!”
।।উস্তাদ উসামা মাহমুদ হাফিযাহুল্লাহ ||
এর থেকে– পঞ্চম পর্ব
“কুদসের মুক্তির পথ!”
।।উস্তাদ উসামা মাহমুদ হাফিযাহুল্লাহ ||
এর থেকে– পঞ্চম পর্ব
ফিলিস্তিনের বাইরে ফিলিস্তিনের যুদ্ধ
এমন পরিস্থিতিতে গাজাবাসীদের কেন সাহায্য করা যায়নি—এই প্রশ্নের সবচেয়ে সরল উত্তর হলো: আমাদের দেশগুলোর সেই যুদ্ধ, যা আমেরিকার সমর্থনে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে। বিষয়টি সহজভাবে বোঝার নিয়ম হলো: যে সেনাবাহিনী বা সরকার ইতিহাসে যত বেশি আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল, গাজাবাসীদের অবরুদ্ধ করার পেছনে তাদের ভূমিকা তত বেশি। গাজার যুদ্ধ শুরু হয়েছে সাত অক্টোবর, অথচ এই বাহিনীগুলো দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এমনই নির্লজ্জ যে, তারা একদিকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আমেরিকার মিত্র, তারা নিজেদের ভূমি আমেরিকার সামরিক ঘাঁটির জন্য উৎসর্গ করে, তারা ভাড়াটে খুনি হয়ে আমেরিকার থেকে বিলিয়ন ডলার শুষে নেয় [[1]], নিজেদের নির্যাতন-কক্ষগুলোকে ‘উম্মাহর প্রতিরক্ষার’ জন্য যুদ্ধরত মুজাহিদীন দিয়ে পূর্ণ করে এবং প্রতিটি অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়ে আমেরিকার দাসত্ব করে অপরদিকে যখন গাজাবাসীদের গণহত্যা চলে, তখন কুমিরের চোখে অশ্রু ফেলে, সম্মেলনের আয়োজন করে এবং গাজার পক্ষে বক্তৃতা দিয়ে প্রশংসা কুড়ায়।
তুরস্ক, পাকিস্তান ও আরব উপসাগরীয় দেশগুলোতে এই একই দ্বিচারিতা ও কপটতা বিদ্যমান। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আমেরিকাকে প্রদত্ত সেবাগুলো কি কোনো গোপন বিষয়? দুঃখের বিষয়, আমাদের কিছু ধর্মীয় রাজনৈতিক নেতা গাজার ধ্বংসযজ্ঞে নীরব রয়েছেন।
আমি শোকার্ত ও ক্রুদ্ধ, কিন্তু একই সাথে যেসব সেনাবাহিনী আমেরিকাকে রক্ষা করে, তাদেরকে নিজেদের সেনাবাহিনী বলে দাবি করি; আমেরিকাকে উম্মাহর শত্রু ঘোষণা করি, অন্যদিকে যেসব মুজাহিদ আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়াই করতে এগিয়েছিলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আমেরিকান যুদ্ধকে তাদের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’-ও বলি।
গাজাকে কি এভাবে সাহায্য করা সম্ভব? আমেরিকার দাসত্ব কবুল করা মুসলিম উম্মাহর বিশ্বাসঘাতক সেনাবাহিনীগুলোর পক্ষ নিয়ে যদি আমরা এভাবে অজুহাত দাঁড় করাই, তাহলে কি কখনও ইসরাঈলকে দুর্বল করতে পারব? গাজার মানুষের ত্যাগ, ধৈর্য ও অটলতা দেখে যখন তারা বিজয় অর্জন করে, তখন তাদের জন্য উল্লাস করা এবং প্রশংসার স্তুতি গাওয়া, অথচ নিজেদের দেশে যারা গাজার বিপক্ষে অপরাধে জড়িত সেই অপরাধী বাহিনীকে সম্মান ও নিরাপত্তা দেওয়া এবং আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সেই যুদ্ধকে দ্বীন ও মিল্লাতের স্বার্থে উপস্থাপন করা—এটা তো কেমন যেন এখানে-সেখানে থেকে টুকরো এনে জোড়া লাগানো একটা জোড়াতালির মতো আচরণ। এখন সময় এসেছে এই সব দ্বিচারিতা থেকে বের হয়ে আসার। আমাদের সমর্থন বা বিরোধিতা এবং ভালবাসা বা শত্রুতা—সবকিছুর ভিত্তি জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেমের সেক্যুলার নীতির ওপর নয়, বরং ইসলামের নীতির ওপর স্থাপন করা এবং তা শরিয়তের আলোকে গঠন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
গাজা যুদ্ধ ও মসজিদুল আকসার মুক্তির সংগ্রাম শুধু ফিলিস্তিনেই সংঘটিত হতে পারে— এমন ধারণা করা কেবল সরলতা নয়, বরং এটি উম্মাহর বিরুদ্ধে একটি অপরাধ। এটি সূর্যের আলোর চেয়েও স্পষ্ট যে, ফিলিস্তিনে গাজাবাসীর এই সংগ্রাম তখনই সফল হবে, যখন আমরা এর বাইরে নিজেদের ভূমিতে— যেখানে আমরা প্রকৃতপক্ষে কিছু করতে সক্ষম— এটিকে নিজেদের সংগ্রাম হিসেবে বিবেচনা করব এবং ইসরাঈলের প্রাণস্বরূপ শক্তিগুলোকে দুর্বল করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হব। ব্রিটিশ-গঠিত এই জায়নিস্ট দাসসেনাকে নিজেদের বাহিনী বলে দাবি করার পরিবর্তে আমাদের নিজেদের ইসলামী বাহিনী গঠন করতে হবে, মসজিদ-মাদরাসা ও মিম্বর-মিহরাবকে আমাদের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে এবং নিজেদের ভূমিতে হিজবুল্লাহর মতো হয়ে হিজবুশ শয়তান— এই জায়নিস্ট জোটের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে হবে।
এখন সময় এসেছে যে, আমরা খোলা চোখে হিমালয়ের মতো উচ্চ ও স্পষ্ট সত্যের দিকে তাকাবো এবং এর অস্তিত্ব স্বীকার করব। গাজার ধ্বংস ও পবিত্র স্থানগুলির উপর আধিপত্যের দায় শুধু ইসরাঈলের নয়, বরং এর মূল ও কেন্দ্রীয় ভূমিকা ছিল আমেরিকান জোটের। এখন আমাদের এই সত্য মেনে নেওয়া জরুরি এবং তারপর এই বিষয়ে উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে যে, আমেরিকা হলো উম্মাহর উপর চাপিয়ে দেওয়া সেই বৈশ্বিক ঔপনিবেশিক শক্তি, যা উপেক্ষা করা স্ববিরোধিতা, গাজাবাসীর প্রতি অবিচার এবং এই নির্যাতিত মানুষদের এই জায়নিস্ট শক্তির মুখে একা ছেড়ে দেওয়া হলো মুসলিম উম্মাহর দুর্দশা ও দাসত্বের রাতকে দীর্ঘায়িত করা।
এই সত্যটিও স্বীকার করা উচিত যে, এই বাহিনীগুলো হলো জায়নবাদী উপনিবেশের সৈনিক। এগুলোকে নিজেদের ভেবে আমরা না ইসরাঈল ও আমেরিকার কবল থেকে উম্মাহ ও তার পবিত্র স্থানগুলো মুক্ত করতে পারব, আর না শরীয়ত বাস্তবায়নের দিকে এক কদমও এগোতে পারব। যখন এটাই সত্য, তখন আমাদের নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করা উচিত— যে সংগ্রামে এই বাহিনীগুলোকে নিজেদের ভাবা হয়, সেখানে তাদের অপসারণ ও তাদের স্থানে আল্লাহভীরু মুজাহিদ শক্তি আনার কোনো গভীর প্রচেষ্টা না থাকলে, এমন প্রচেষ্টা কি নির্যাতিত উম্মাহর কোনো উপকারে আসতে পারে? পৃথিবীতে কি এমন শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কখনো সফল হয়েছে? আমাদের স্বীকার করা উচিত যে, আমেরিকান দ্যা র্যান্ড কর্পোরেশন প্রণীত ও সমর্থিত পথগুলোকে সঠিক ভেবে সেগুলোতে চললে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আমরা জায়নবাদী উপনিবেশকেই সাহায্য করব। আর এটা হলো চোখ বুজে এমন পথে চলা, যার ভোগান্তি গোটা উম্মাহ আজ ভুগছে।
জেরুজালেমের মুক্তি একটি অধিকার
আমেরিকার বিরুদ্ধে জিহাদে রুখে দাঁড়ানো উম্মাহর ইচ্ছাধীন বিষয় নয়, বরং বাধ্যবাধকতা (এই উম্মাহ স্বেচ্ছায় কোনো অপশন হিসেবে এই পথ গ্রহণ করবে— বিষয়টা এমন নয়; বরং উম্মাহ এই পথ অবলম্বন করতে বাধ্য)। এখন প্রশ্ন হলো— এই জিহাদ কি আদৌ সম্ভব? বাস্তবতা হলো, এই জিহাদ নিঃসন্দেহে কঠিন, কিন্তু একেবারেই অসম্ভব নয়। তিন দশক আগে উম্মাহ-দরদী শায়খ উসামা বিন লাদেন রহিমাহুল্লাহ তাঁর ঘর-বাড়ি, জন্মভূমি, সম্পদ, সন্তান ও সহচরদের কুরবানি দিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে জিহাদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উম্মাহর সামনে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। তিনি এবং তাঁর সহচররা—বিশেষত শায়খ আইমান আয-যাওয়াহিরী যুক্তি-প্রমাণসহ আমেরিকার বিরুদ্ধে জিহাদের অপরিহার্যতা এবং তার পদ্ধতি বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। এই পুরো সময়ে কোনো একটি ঘটনাও তাদের এই দাওয়াত ও আহ্বানকে ভুল প্রমাণ করতে পারেনি। এমনকি গাজার বর্তমান যুদ্ধ এই বিশ্বব্যাপী ক্যান্সারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং উম্মাহকে জাগ্রত করার প্রয়োজনীয়তার উপর নতুন করে সত্যতার সিলমোহর এঁটেছে এবং দেখিয়ে দিয়েছে যে, বুদ্ধি ও যুক্তির ভিত্তিতে মুসলিম উম্মাহকে এই অপমান থেকে উদ্ধার করতে চাইলে, আমেরিকার বিরুদ্ধে জিহাদ ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই।”
এমন অবস্থায় যদি আমরা এই আহ্বানকে শুধু এই কারণে উপেক্ষা করে এর বিরোধিতা শুরু করি যে এটি কঠিন, তাহলে কি আমরা বাস্তবতা পরিবর্তন করতে পারব? তাহলে কি মুসলিম উম্মাহর কষ্ট লাঘব হবে? নাকি কঠোর ভাষায় বলতে গেলে, আল্লাহ না করুন, আমাদের ও উম্মাহর গন্তব্য কি ভিন্ন? তাহলে যদি কঠিন ও সহজই মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে গাজাবাসীর প্রশংসা আমরা আবার কেন করব? তারা কি কঠিন ও সহজ দেখে ‘তুফানুল আকসা’-এর পথ বেছে নিয়েছিল? যদি আমরা বলি যে তাদের কোনো বিকল্প পথ ছিল না এবং তারা এই যুদ্ধে ন্যায়সংগত ছিলেন, তাহলে কি আজ আমাদের কাছে এমন কোনো পথ অবশিষ্ট আছে যার মাধ্যমে আমরা ফিলিস্তিনের কোনো সাহায্য করতে পারি? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরাগভাজন না হয়ে, কোনো ব্যক্তি কি এটা প্রমাণ করতে পারে যে আজ না হোক কাল ইসরাঈলের অস্তিত্ব আমরা ধ্বংস করে দেব?
[1] ২০০২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমেরিকা পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযোগিতার’ নামে ১৩৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে—এটি শুধু প্রকাশ্য সহায়তা, অপ্রকাশ্য সহায়তা এর চেয়ে অনেক বেশি।
আরও পড়ুন
চতু্র্থ পর্ব ----------------------------------------------------------------------------------------------- শেষ পর্ব